অর্পিতা সরকার
কী ব্যাপার অনন্যা, এবারেও কী ফার্স্ট প্রাইজটা ”কলাকুশলীর” হাত থেকে বেরিয়ে গেল নাকি? আর ”ক” বিভাগের কী খবর? সুতপা কী করল?
অনন্যা বলল, স্যার আমি সর্বসাধারণের গ্রুপে দ্বিতীয় হয়েছি। ধৈর্যচ্যুত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন, সুবর্ণ চক্রবর্তী। পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসরপ্রাপ্ত। এতদিন ধরে বিভিন্ন কবিতার অনুষ্ঠানে জাজ থেকেছেন। ওনার লেখা কবিতা প্রকাশিতও হয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। অবসরের পরে নেশাটাকেই পেশায় পরিণত করেছেন। অবসর জীবনের কুঁড়েমি ওনার ভারী অপছন্দের। তাই বাড়ির দক্ষিণের বারান্দা সংলগ্ন ঘরেই খুলে বসেছেন কবিতা আবৃত্তি, শ্রুতি নাটক শিক্ষার স্কুল। হেমাতপুর অঞ্চলের মান্যগন্য মানুষ বলেই হয়তো, এক সপ্তাহেই ওনার কবিতা আবৃত্তির স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি ঈর্ষণীয়। মাত্র এক সপ্তাহেই অনেক অভিভাবকই তার সন্তানকে স্টেজ ফ্রি আর সঠিক উচ্চারণ শেখানোর উদ্দেশ্যেই হয়তো নিয়ে এসেছেন কলাকুশলীতে। সুবর্ণ চক্রবর্তী মনপ্রাণ ঢেলে ছাত্রছাত্রীদের শেখাচ্ছেন, দেখো কবিতা একটা অনুভূতির নাম। এর প্রতিটা কালো অক্ষরকে আগে উপলব্ধি করতে হবে। তারপর তাকে আত্মস্থ করতে হবে। যদি কবিতার অর্থই না পরিষ্কার হয়, যদি এই শব্দগুচ্ছের সঙ্গে একাত্মই না হতে পার, তাহলে কবিতা মুখস্ত বলাই সার হবে। কবিতা আবৃত্তির পদে উন্নীত হবে না সেটা। তাই আমি প্রথমের যে কোনো কবিতার প্রতিটা শব্দের মানে বোঝাবো, তারপর শেখাবো বলার টেকনিক।
বাংলার শিক্ষকের অবসর জীবনেও কর্মব্যস্ততা। আবারও সেই ক্লাস নেওয়ার তাগিদ। আবারও সেই বাংলা শব্দের অলিগলিতে ভ্রমণ, নতুন করে মেতে উঠেছেন সুবর্ণ চক্রবর্তী। কলাকুশলীর বয়েস দেখতে দেখতে বর্ষপূর্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। সপ্তাহে পাঁচদিন ক্লাস নিতে হয় এখন সুবর্ণ বাবুকে। এ চত্বর ছাড়িয়ে আশেপাশেও ছড়িয়ে পড়েছে কলাকুশলীর নাম। সুবর্ণবাবু এখন আর কবিতা কম্পিটিশনে জাজমেন্ট করেন না। কারণ ওনার স্কুলের ছাত্রীছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। তাই বিচার যেন ত্রুটিপূর্ণ না হয় বলেই উনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনকী কোনো প্রোগ্রামেই উনি উপস্থিত থাকতেন না। ওনার ছাত্র-ছাত্রীরা স্যারকে দেখে ভয় পাবে বা নার্ভাস ফিল করবে বলেই উনি এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এই কয়েকমাস ধরে সমস্ত ক্লাবের রবীন্দ্র-নজরুল কবিতা কম্পিটিশন হোক বা যুব উৎসবে সুকান্তের কবিতাবৃত্তি হোক সবেতেই কলাকুশলীর স্টুডেন্টরা এগিয়ে। লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে এই সংস্থার নাম। লোকজন আড়ালে আলোচনা করে— সুবর্ণ চক্রবর্তীর স্টুডেন্টরা প্রতিযোগিতাতে নাম দিলে অন্যদের নাম কাটিয়ে দেওয়াই ভালো। কারণ জিতবে তো সেই সুবর্ণ চক্রবর্তীর স্টুডেন্টরাই। এই কয়েকমাসেই জিততে জিততে প্রায় অভ্যেস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সুবর্ণবাবুর। দৃঢ় ধারণা ছিল, কলাকুশলীর ছাত্রছাত্রীরা উপস্থিত থাকলে অন্য কেউ প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পারবে না এ যেন অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই নিয়ে বার তিনেক এর ব্যতিক্রম ঘটল। সর্বসাধারণের গ্রুপে এবং ছোটদের ”ক” বিভাগের প্রথম পুরস্কার দুটো হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কোনো এক স্বয়ংসিদ্ধা বালন নাকি প্রথম স্থান নিয়ে নিচ্ছে সর্বসাধারণ বিভাগের।
সুবর্ণবাবু নিজের থুতনিতে হাত দিয়ে একটু ভেবেই বললেন, একজন ননবেঙ্গলি মেয়ে রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করে আমার স্টুডেন্টদের হারিয়ে দিচ্ছে?
ভাবতে কষ্ট হচ্ছে অনন্যা। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। সেই কলেজ লাইফ থেকে কবিতা লিখছি, রিসাইট করছি, বলতে গেলে কবিতা আমার ধমনীতে প্রবাহিত হয়। সেই নেশাই আমি তোদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছি, এরপরেও অন্য কেউ কী ভাবে প্রথম হয়? এই নিয়ে বার তিনেক হল, কলাকুশলীর স্টুডেন্টরা হেরে গেল। আর প্রতিবারেই এই স্বয়ংসিদ্ধা বালনের নাম উঠে এসেছে তোদের মুখে।
আবার সেই পুরোনো রাগটা বুজবুজি কাটছে মাথার মধ্যে। এই রাগটাকে সুবর্ণ নিজেই বড্ড ভয় পান। এ রাগের কারণ একটাই, হার মেনে নিতে পারেন না উনি। তবে বড্ড ভয়ংকর আকার নেয় এই রাগ। ভদ্র সমাজে বসবাস করার হেতু এ উগ্র রাগকে উনি ধীরে ধীরে বশে এনেছেন। উনি চান না, ওনার ওই মুখোশবিহীন হিংস্র রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে যাক স্টুডেন্টদের সামনে। নিজের ধীর-স্থির, শান্ত-মার্জিত যে রূপটা এতদিন ধরে অতি যত্নে লালিত করে আসছেন ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে সেই রূপের ওপরের পালিশটা খসে পড়ুক এটা উনি চান না। তাই শান্ত স্বরে বললেন, ঠিক আছে। একটা প্রতিযোগিতাই তো মাপকাঠি নয় আমার শিক্ষার। সামনে ডিস্ট্রিক্ট কম্পিটিশন আছে, সকলে তার জন্য রেডি হও। আজকে এসো সবাই। কলাকুশলী ফাঁকা হয়ে গেলো আস্তে আস্তে। স্যারকে প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল স্টুডেন্টরা।
আস্তে আস্তে দক্ষিণের ঘরে তালা দিয়ে বাড়ির ভিতরে পা দিলেন সুবর্ণবাবু।
অর্চনা ওর ব্যালকনির টবগুলোয় জল দিচ্ছে, আর গুনগুন করে বলেছে…
‘এখন থেকে সময়ের হিসাব করে বেরোই—
সে হিসাব আমার কাজের সঙ্গে ঠিকটি মেলে না, প্রায় ঠিক মেলে ওদের বেরোবার সময়ের সঙ্গে,
প্রায়ই হয় দেখা।
মনে মনে ভাবি, আর-কোনো সম্বন্ধ না থাক
ও তো আমার সহযাত্রিণী।
নির্মল বুদ্ধির চেহারা
ঝকঝক করছে যেন।’
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন সুবর্ণবাবু। কবিগুরুর ক্যামেলিয়ার লাইন না?
অর্চনার এখনও মুখস্থ আছে? লাস্ট কবে কবিতা বলেছিল, অর্চনা? বিয়ের আগেই বোধহয়।
আচমকা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন সুবর্ণ। অর্চনা যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে সুবর্ণকে, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকে তুমি খুন কেন করলে সুবর্ণ? কী উত্তর দেবে তখন ও? ভেবেই কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা।
যদি কখনো সামনে দাঁড়িয়ে বলে, সুবর্ণ চক্রবর্তী তুমি কবে থেকে কবি হলে? কবে থেকে তুমি আবৃত্তির শিক্ষক হলে? কী উত্তর দেবে সুবর্ণ?
বাহারি ঝাউ গাছটার দুটো অপ্রয়োজনীয় পাতা কাঁচি দিয়ে কুটকুট করে কেটে দিল অর্চনা। ঠিক যেমনভাবে বিয়ের পরে যৌথ পরিবারের দোহাই দিয়ে অর্চনার চাকরি আর কবিতার নেশাটাকে তার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই কেটে দিল পাতাটা। আজ হঠাৎ এত বছর আগের সব কথা কেন ফিরে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছে সুবর্ণর? তবে কী কলাকুশলীর পরাজয়ই ওকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে অতীতের এক পরাজয়ের দিনে? তা প্রায় আটত্রিশ বছর আগের বিকেলে এসে থমকে দাঁড়াল সুবর্ণ।
বছর তেইশের তরতাজা যুবক। ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। বাংলা নিয়ে মাস্টার্স করছিল ও তখন। ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্টের ওপরেই সেবারে দায়িত্ব পড়েছিল নবীন বরণ উৎসবের। অবসরে দু-চার লাইন কবিতা লেখার দৌলতেই হয়তো অনেকেই সুবর্ণকে নব্য কবি বলে লেগপুল করত। কবি হবার সুপ্ত বাসনাটা অবশ্য কয়লার ধিকধিকে আগুনের মতোই জিইয়ে রেখেছিল ও নিজের মধ্যে। সাজপোশাকেও অতিআধুনিকতাকে প্রবেশ করতে না দিয়ে পাঞ্জাবিতে নিজেকে অভ্যস্ত করছিল সুবর্ণ। একটু উসকোখুসকো চুল, পরনে হালকা রঙের পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা সুতির ঝোলা ব্যাগ নিয়ে সাজগোজে নিজেকে প্রায় হাফ কবি বানিয়েই ফেলেছিল ও। এবারে শুধু বাকি আছে ওর কবিতা লেখা। বন্ধুরা উৎসাহ দিয়ে বলেছিল, কবিতা যবে লিখবি তবে লিখবি, ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের যদি কাবু করতে হয় তো সিনিয়র হিসাবে একটা কবিতা পাঠ তো করতেই পারিস নবীন বরণ উৎসবে।
নিজেকে এক সপ্তাহ ধরে ঘষে মেজে তৈরি করেছিল সুবর্ণ। ক্যাসেটে দিনরাত শুনেছিল বিখ্যাত আবৃত্তিকারদের কবিতা।
নবীন বরণের দিনে মঞ্চে উঠতেই পা কেঁপেছিল ওর। তবুও সাহসে ভর করে বলেছিল, কবিগুরুর ”ক্যামেলিয়া” কবিতাটা। হাততালি পড়েছিল শ্রোতামহলে। সুবর্ণ নিজেও বুঝেছিল যথেষ্ট ভালো আবৃত্তি করতে পেরেছে ও। কিন্তু পরক্ষণেই ওর ধারণা ভুলে পরিণত হয়েছিল। কারণ ওর পরেই মঞ্চে উঠেছিল এম.এ ফার্স্ট ইয়ারের অর্চনা ভট্টাচার্য। আবৃত্তি করেছিল, ক্যামেলিয়া কবিতাটিই। প্রতিটা উচ্চারণ, প্রতিটা শব্দ যেন অনুভূতির আকারে ঝরে পড়ছিল। শ্রোতারা একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। সুবর্ণ নিজে লজ্জিত হয়েছিল। ছি ছি ওর কবিতা আবৃত্তিটা আদৌ আবৃত্তিই হয়নি। অর্চনা নেমে আসতেই আসতেই হন্তদন্ত হয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল সুবর্ণ। হাত জোড় করে বলেছিল, অপরাধ মার্জনা করবে। তোমার আগে কবিতাবৃত্তি করার ধৃষ্টতার জন্য। অর্চনা গম্ভীর মুখে বলেছিল— সব সইতে পারি, শুধু কবিগুরুর কবিতার অপমান নয়। নীরব শান্ত অপমানে কান লাল হয়ে গিয়েছিল সুবর্ণর। তাও আবার এক ইয়ারের জুনিয়ার মেয়ের কাছ থেকে। তবুও শান্ত ছিল ও। ধীর গলায় বলেছিল, আর যদি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই তাহলে সুযোগ কী এই অধমকে দেওয়া হবে?
কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল অর্চনা। সুবর্ণ তড়িঘড়ি বলেছিল, তুমি যে শিক্ষকের কাছে কবিতাবৃত্তি শেখো সেখানে আমায় যদি একটু সুযোগ করে দাও তো বাধিত থাকব।
অর্চনা মুচকি হেসে বলেছিল, আমি এক কড়া শিক্ষকের কাছে কবিতা শিখি। তিনি এই শিক্ষাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তোমার মতো অমনোযোগী ছাত্র পেলে বৃদ্ধ বয়সে তিনি খুনের দায়ে জেলে যাবেন হয়তো। সুবর্ণ মজা করে বলেছিল, সুযোগ দিয়ে দেখতে পার একবার। যদি মরুভূমিতে ধানের চাষ করাতে পারেন তিনি তবে নিজেই সব থেকে খুশি হবেন। ছাত্রের সাফল্যে গর্বিত গুরুজিরাই হন।
অর্চনা রাজি হয়েছিল সুবর্ণকে নিয়ে যেতে ওর শিক্ষকের কাছে। সুবর্ণ দিন গুনছিল।
আচমকাই একদিন অর্চনা এসে বলেছিল, চলো আজ নিয়ে যাব।
একটু ভয় ভয়েই একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে থেমেছিল ওরা। অর্চনা বলেছিল, কী হল, দাঁড়িয়ে গেলে কেন এসো?
সুবর্ণ ওর দেখানো পথ ধরে পৌঁছেছিল একটা দারুণ সাজানো গোছানো বাড়ির ড্রয়িংরুমে। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্তের ছবি। বইয়ের শেলফেও প্রচুর বই রাখা। এক ভদ্রলোক মন দিয়ে বই পড়ছিলেন। অর্চনা ইশারায় বলেছিল, ওই যে ওনার কাছেই আমি কবিতা শিখি ছোট থেকে। যাও গিয়ে প্রণাম কর।
সুবর্ণর তখন রীতিমতো ভয় করছিল। ভদ্রলোকের ব্যক্তিত্ব দেখে পিছু হঠতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু নিরুপায় হয়েই ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলেছিল, আমি সুবর্ণ চক্রবর্তী। অর্চনার বন্ধু। ভদ্রলোক চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিলেন, ওহ তোমার কথাই অর্চনা বলেছিল। তুমি রবীন্দ্র কবিতায় জীবনানন্দের ভাব আনতে চেয়েছিলে?
সুবর্ণ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, আপনি যদি আমায় একটু শেখান তাহলে আমি কৃতার্থ হই।
ভদ্রলোক বলেছিলেন, অর্চনা ওকে বসতে দে। মাকে বল জলখাবারের ব্যবস্থা করতে তারপরে আমি ওর পরীক্ষা নেব। অর্চনা সাবলীল ভঙ্গিমায় বলেছিল, আচ্ছা বাবা, আমি বলছি।
চমকে উঠেছিল সুবর্ণ। ইনি অর্চনার বাবা! অর্চনা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল। সেই সূত্রপাত ওদের ভালোলাগার। কতযুগ আগের কথা।
প্রায় বছর তিনেক ওরা এক সঙ্গেই কবিতা শিখেছিল অর্চনার বাবার কাছে। অজিতবাবুর ব্যারিটন ভয়েসটা খুব যত্নে গড়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকর্মা। বাবার রক্ত ছিল বলেই হয়তো একই শিক্ষকের কাছে একই সঙ্গে শিখেও প্রতিটা প্রতিযোগিতায় অর্চনা পুরস্কার পেলেও সুবর্ণ জয়ী হত না সবেতে। তবুও ওদের প্রেমটা ব্যর্থ হয়নি। দুজনেই চাকরি পাওয়ার পরে দুই বাড়ির সম্মতিক্রমেই বিয়েটা করেছিল ওরা। অর্চনাও স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে।
সমস্যা হয়েছিল, অর্চনার মা হবার পরে। সুবর্ণদের যৌথ পরিবারের কেউই রাজি ছিল না বাড়িতে সদ্যজাতকে ফেলে অর্চনার চাকরি করতে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। সত্যি বলতে কী সুবর্ণ নিজেও রাজি ছিল না। অর্চনা চাকরি ছেড়ে দিল। সন্তানকে মানুষ করায় মন দিল।
এক কলি কবিতার লাইনও মুখফুটে উচ্চারণ করেনি কোনোদিন। সুবর্ণর কবিতা তখন বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলার শিক্ষক ও কবি বলেই বহু অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছিল সুবর্ণ বিচারক হয়ে বসার। অর্চনা কখনো প্রশ্ন করেনি। কোনোদিন চোখে চোখ রেখে বলেনি, কেন করলে সুবর্ণ আমার সঙ্গে এমন?
বলেনি বলেই সুবর্ণ ভিতরে ভিতরে ভয় পায়। কবে ওর সম্মুখে এসে উপস্থিত হবে এই প্রশ্নটা। এমনকী কবিতা আবৃত্তি শিক্ষার স্কুল খোলার সময়েও কোনো প্রশ্ন করেনি অর্চনা। ওরা অবশ্য যৌথ বাড়ি ছেড়ে নিজেরা বাড়ি করে উঠে এসেছে। এটা সুবর্ণর নিজের তৈরি বাড়ি। এখানে আসার পরেও অর্চনার হাতে কখনও ওর সব থেকে প্রিয় সঞ্চয়িতা বা সূর্যাবর্ত দেখেনি। মেয়ের স্কুল, পড়াশোনা, গাছের নেশা এভাবেই কাটিয়ে দিল বাকি জীবনটা। সুবর্ণর দেখে কখনো মনে হয়নি অর্চনা অখুশি আছে।
এত বছর পরে আবার সেই ইউনিভার্সিটিতে আবৃত্তি করা কবিতাটা কেন বলছে অর্চনা? কী করেই বা এই দীর্ঘ বছর অনভ্যাসের পরেও এমন নিখুঁত বলছে অর্চনা!
স্খলিত পায়ে ঘরে ঢুকল সুবর্ণ। মনটা আজ বড়ই বিষণ্ণ হয়ে আছে। কলাকুশলীর ছাত্রছাত্রীরা দুটো বিভাগেই প্রথম হতে পারেনি। আনমনে টিভির রিমোটে প্রেস করল। অন্যমনস্ক হয়েই নিউজ চ্যানেলের দিকে তাকিয়ে আছে সুবর্ণ। কদিন পরেই জেলা কম্পিটিশন। এখানে ফার্স্ট হলে তবেই রাজ্য স্তরে যেতে পারবে কেউ। দ্বিতীয়র কোনো জায়গা নেই এখানে। শুধু ফার্স্টদেরই নিয়ে যাবে রাজ্য প্রতিযোগিতায়। না, এবারে যেতে হবে সুবর্ণকে। জানতে হবে কে এই স্বয়ংসিদ্ধা! বার বার কে হারিয়ে দিচ্ছে কলাকুশলীকে?
ছেলেমেয়েদের এ কদিন কড়া শাসনে আবৃত্তি প্র্যাকটিস করালেন সুবর্ণ চক্রবর্তী। এবারে যেন কিছুতেই কোনো বিভাগের প্রথম পুরস্কার হাত ছাড়া না হয়। কাউকেই জানালেন না উনি যাবেন আজকের প্রতিযোগিতা দেখতে। আসলে চিনতে যাবেন স্বয়ংসিদ্ধা বালনকে।
যথারীতি সুকান্ত হলের একেবারে পিছনের সিটে গিয়ে বসলেন সুবর্নবাবু। বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। কেমন যেন একটা নার্ভাসনেস কাজ করছে। ঠিক যেমন করেছিল সেই ইউনিভার্সিটির নবীন বরণ উৎসবের দিনে।
কলাকুশলীর ছাত্র-ছাত্রীরা যথেষ্ট ভালো আবৃত্তি করছে। আস্তে আস্তে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে যেন।
ঠিক তখনই বিভাগ ”ক” এ একটি বছর সাতেকের ছেলে উঠল। শুদ্ধ উচ্চারণে আবৃত্তি করল ছেলেটি। সিদ্ধার্থ বালন। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল সুবর্ণ। কী অদ্ভুত বাচন ভঙ্গিমা। বালন তো অবাঙালি বলেই জানেন সুবর্ণবাবু। অথচ এমন সুন্দর বাংলা উচ্চারণ! এমন সুন্দর কবিতাবৃত্তি! উনি নিজে জাজ থাকলেও এই ছেলেটিকেই ফার্স্ট করতেন।
সর্বসাধারণের গ্রুপে অবশেষে উঠল স্বয়ংসিদ্ধা। মেয়েটাকে দেখে স্থবির হয়ে বসে রইল সুবর্ণ চক্রবর্তী। সুচিস্মিতা নিজের নাম বদলেছে কবে? কবে শিখল এমন কবিতাবৃত্তি? কে শেখাল ওকে?
চোখ বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে শুনছে সুবর্ণ।
‘যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি—
তবু মনে রেখো।
যদি জল আসে আঁখিপাতে,
এক দিন যদি খেলা থেমে যায় মধুরাতে,
তবু মনে রেখো।
এক দিন যদি বাধা পড়ে কাজে শারদ প্রাতে— মনে রেখো।
যদি পড়িয়া মনে
ছলোছলো জল নাই দেখা দেয় নয়নকোণে—
তবু মনে রেখো।’
কবিতা শেষ হয়েছে স্বয়ংসিদ্ধা বালনের। মঞ্চ থেকে নেমে আসতেই জড়িয়ে ধরলো অর্চনা।
যথারীতি দুটো বিভাগেরই প্রথম পুরস্কার জিতে নিলো স্বয়ংসিদ্ধা এবং তার ছেলে সিদ্ধার্থ।
অর্চনা নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। মেয়ের গর্বে গর্বিত মা। একমাত্র বঞ্চিত সুবর্ণ। এত বছরের বিজয়ীর মুকুটটা কবে যে অর্চনা নিঃশব্দে কেড়ে নিয়েছে বুঝতেই পারেনি সুবর্ণ। একমাত্র সন্তান সুচিস্মিতা যখন প্রসূন বালন নামের ননবেঙ্গলি ছেলেটাকে বিয়ে করে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখনই তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সুবর্ণ। কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি ওদের সঙ্গে। অর্চনাও কখনো মেয়ের কথা বলেনি ওর সামনে। অর্চনার সঙ্গে তারমানে রীতিমতো যোগাযোগ ছিল সূচীর। নাতিও তো দিদাকে ভালোই চেনে দেখা যাচ্ছে। প্রসূনও দাঁড়িয়ে আছে অর্চনার গা ঘেঁষে।
সূচীকে তারমানে অর্চনাই কবিতাবৃত্তি শিখিয়েছে। মায়ের রক্ত, মামাবাড়ির দাদুর রক্ত পেয়েছে বলেই সুচিস্মিতা এত সুন্দর কবিতা বলে। ওর কাছে কলাকুশলীর ছাত্র-ছাত্রীরা নেহাত ম্রিয়মাণ। সিদ্ধার্থের মুখটা দেখে খুব ইচ্ছে করছিল, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আর হারতে রাজি নয় সুবর্ণ। এতদিন পরে এসে অর্চনা যে এভাবে ওকে পরাজিত করবে ভাবতেই পারেনি সুবর্ণ। তাও ওরই একমাত্র সন্তানকে হাতিয়ার করে। সুচিস্মিতা নামটা সুবর্ণর নিজের দেওয়া। মেয়ে হয়েছে বলে সেকি আনন্দ হয়েছিল ওর। সূচীও বাবা অন্ত প্রাণ ছিল। সে যে বাবার অমতে ওভাবে বিয়ে করতে পারে কল্পনা করেনি সুবর্ণ। অভিমান এতটাই দৃঢ় ছিল যে গত দশ বছরে ওদের কোনো খোঁজ খবরই নেয়নি। বরং সকলকে বলেছে আমার মেয়ে মৃত।
অর্চনা কবে যে সেই শূন্যস্থান দিয়ে ঢুকে পড়েছে টের ও পায়নি সুবর্ণ।
প্রসূনের গাড়িতে চেপে বেরিয়ে গেল ওরা। গোটা দাবার ছকটা ওকে দেখে বিদ্রুপ করছে যেন। একটা চালের ভুলে এভাবে হেরে গেল সুবর্ণ। অর্চনার রক্তে বাস করে কবিতার কালো অক্ষররা। হাজার চেষ্টা করেও সুবর্ণ পারেনি অর্চনার জায়গায় পৌঁছাতে। ধীরে ধীরে অবসন্ন শরীরের ভার বহন করে বাড়ি ফিরল সুবর্ণ।
আগামীকাল নোটিশ টাঙিয়ে দেবে কলাকুশলীর দরজার সামনে। বন্ধ করে দেবে এ প্রহসন। আর শেখাবে না ও কবিতা। অর্চনা যেন ভ্রুকুটি করে হাসছে, ওর বাবা যেন আকাশ থেকে বলছেন, বুঝলি অর্চনা, সুবর্ণর দ্বারা আর যাইহোক কবিতাবৃত্তি হবে না।
অর্চনা বাড়ি ফিরে এসেছে। পোশাক বদলে ডিনার টেবিল সাজাচ্ছে। মুখে তৃপ্তির হাসি। বিজয়িনীর হাসি।
পরাজিত কবি সুবর্ণ চক্রবর্তীর দম্ভকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে অর্চনার মুখের ওই নিঃশব্দ হাসি। অর্চনা টেবিলে প্লেট সাজাতে সাজাতেই নরম স্বরে বললো, ‘কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।’
সুবর্ণ সাহসে ভর করে বলল, অর্চনা আমায় কিছু বললে?
অর্চনা ঘাড় নেড়ে বলল,
‘সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন