অর্পিতা সরকার
বললেন না তো আপনাকে আমি কোথায় দেখেছি?
ঝালমুড়িওয়ালা মন দিয়ে ঝালমুড়ি মাখতে মাখতে বলল, সেটা আপনি মনে করুন স্যার। আমি তো আপনাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এই শহরে এই জায়গায় আমি আজ প্রায় বছর চারেক ঝালমুড়ি বিক্রি করি, দেখেছেন হয়তো।
অনিকেত জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে বলল, অসম্ভব। আমি এই প্রথম পুরুলিয়া এলাম। আপনি যদি এই শহরের বাসিন্দাই হন তাহলে আপনার মুখটা আমার অত্যন্ত চেনা চেনা কেন লাগছে! আপনি কি কখনো ট্রেনে ঝালমুড়ি বিক্রি করতেন?
ও অসীম কাকা নারকেলটা দাও গো, একটা ছোট মেয়ে ঝালমুড়ির ঠোঙাটা হাতে নিয়েই চেঁচাল।
অসীম হেসে বলল, এই তো মা, এই নাও। কথা বলতে গেলে কাজে ভুল হয়ে যায়।
দুটো আঙুলের মাঝে নারকেলটা নিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় ছুঁড়ে ঠিক ওর মুড়ির ঠোঙায় দিয়ে দিল অসীম। মেয়েটা হেসে চলে গেল।
অনিকেত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝালমুড়িওয়ালা অসীমের হাতের দিকে। অন্যদের ঝালমুড়ি মাখার সঙ্গে এ ব্যক্তির কোথায় যেন একটা পার্থক্য আছে।
অভিজ্ঞ চোখে অনিকেত তাকিয়ে আছে।
অনিকেতের বয়েস ছত্রিশ। রেলে চাকরী করে। কাজের সূত্রে নয় একমাত্র শ্যালিকার শ্বশুরবাড়ি পুরুলিয়ায়, তাই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে বেড়াতে।
পাঁচ বছরের মেয়ে তিতলি, স্ত্রী পায়েলকে নিয়ে পায়ে পায়ে পুরুলিয়া ঘুরতে বেরিয়েছে বিকেলে।
কলকাতায় থাকায় আর প্রাইভেট কারে সর্বত্র যাতায়াতের কারণে রেলে চাকরি সত্ত্বেও লোকাল ট্রেনে ওঠা হয় না। পায়েলের আবার লোকাল ট্রেনে চড়তে খুব ভালো লাগে। ট্রেনের বাদাম আর ঝালমুড়ির নাকি আলাদা টেস্ট। তাই ঝালমুড়িওয়ালা দেখেই দাঁড়িয়ে পড়েছে পায়েল।
অনিকেত বলল, কিছুতেই মনে করতে পারছি না জানো, এই অসীমবাবুকে আমি কোথাও একটা আগে দেখেছি।
পায়েল কনুই দিয়ে ঠেলে বলল, উনি বিরক্ত হচ্ছেন। এক কথা বারবার বলো না। ঝালমুড়িটা নাও দিয়ে চলো।
টাকাটা দিয়ে ঠোঙা দুটো হাতে নিয়েও আরেকবার ভালো করে তাকাল অনিকেত। এতটা ভুল ওর হয় না। কলিগদের মধ্যে ওর স্মৃতিশক্তি নিয়ে রীতিমত চর্চা হয়। ব্যানার্জীদা বলেন, অনিকেতের মাথায় খান কুড়ি প্রকোষ্ঠ বেশি আছে। সেই অনিকেত মনে করতে পারছে না এটা ভেবেই যেন বিজবিজে অস্বস্তিটা আরেকটু মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তবুও পায়েলের কথা মতোই ঝালমুড়ির ঠোঙাটা নিয়ে এগিয়ে এল।
সবুজ মাঠে বসে পা ছড়িয়ে ওরা ঝালমুড়ি খাচ্ছে। পায়েল জিভে তৃপ্তির আওয়াজ করে বলল, আচ্ছা অনি বাড়িতে এত ঘটা করে মাখলেও এমন টেস্ট কেন হয় না বলত! উফ, দুর্দান্ত মেখেছে কিন্তু লোকটা।
অন্যমনস্ক অনিকেতের মাথায় তখনও ঘুরপাক খাচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে ওই অসীম নামক লোকটাকে। এত চেনা লাগছে মুখটা অথচ মনে করতে পারছে না। অনিকেত ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ ভালো লাগছে খেতে।
পায়েল বিরক্তির গলায় বলল, তুমি এখনও ওকে কোথায় দেখেছ মনে করার চেষ্টা করে চলেছ তো! আশ্চর্য লোক বটে। রাস্তাঘাটে এরা ঘুরে বেড়ায়, দেখেছ হয়তো কোথাও একটা।
অনিকেত অন্যমনস্কভাবে বলল, আচ্ছা ধরো পায়েল তুমি একজন মানুষকে রোজ ট্রেনে লজেন্স বিক্রি করতে দেখতে, আচমকা তাকে স্কুলে পড়াতে দেখলে তখন অবাক হবে না?
যদি তুমি তাকে দীর্ঘদিন পরে লজেন্স বিক্রি করতেই দেখো তাহলে কি তোমার চোখে এমন কিছু বিষদৃশ ঠেকবে?
পায়েল একটু ভেবে বলল, তার মানে তুমি ওই ভদ্রলোককে অন্য কোনো প্রফেশনে দেখেছিলে তাই তো? সে আর এমন কী কথা। কত প্রাইভেট কোম্পানির মানুষের চাকরি গেছে, তারাই অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে। সংসারটা তো চালাতে হবে।
অনিকেত বলল, একদম ঠিক। একে আমি অন্য কিছু করতে দেখেছিলাম, সেই কারণেই আমার মস্তিস্ক বলছে এই লোক এখানে ফিট করছে না। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না জানো।
পায়েল বলল, চলো ফিরতে হবে। তিতলির খিদে পেয়েছে।
অনিকেতরা ফিরে এল পায়েলের বোনের বাড়িতে।
বাড়ি ফিরতেই কোয়েল বলল, অনিদা কেমন লাগল বলো আমাদের পুরুলিয়া?
পায়েল হেসে বলল, ওরে কোয়েল তোর অনিদা তো বেরিয়ে থেকে ঝালমুড়িওয়ালার প্রেমে পড়ে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল রাস্তা দিয়ে। পুরুলিয়া আর দেখল কই?
কোয়েল হেসে বলল, কে অসীমদা নাকি?
অনিকেত আগ্রহী হয়ে বলল, তুমি ওকে চেনো নাকি কোয়েল?
কোয়েল বলল, আমরাও ওর কাছ থেকেই ঝালমুড়ি খাই। রিতমের খুব পছন্দের লোক।
অনিকেত রিতমের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা উনি কি বহুদিন ধরেই এ চত্বরে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন?
রিতম বলল, আরে না না। বছর চারেক দেখছি ওনাকে। তার আগে কোথায় থাকতেন জানি না।
অনিকেত হেসে বলল, এটাই আন্দাজ করছিলাম।
রাতে খাওয়ার পরে কোয়েলদের তিনতলার ছাদে পায়চারি করছিল অনিকেত। রাতের পুরুলিয়া তিলোত্তমার মতো ঝাঁ-চকচকে নয়। এখানে রাত একটু আগেই নামে হয়তো।
নিস্তব্ধতা মানুষের ভাবনা শক্তিকে আরও শক্তিশালী করে দেয়। একমুখী ভাবনায় সাহায্য করে।
নিশ্চুপ পুরুলিয়া, নিশ্চুপ কোয়েলের বাড়ির হুল্লোড়।
একা ছাদের কার্নিশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিকেত।
আচমকাই যেন কানে ভেসে এলো কয়েকজনের কণ্ঠস্বর। এই অনি ছাদে কী করছিস নেমে আয়, এবারের আমাদের রত্নাদীঘির বারোয়ারী পুজোর প্ল্যান নিয়ে বসতে হবে, তাড়াতাড়ি আয়।
বাড়িতে পরা বারমুডাটা বদলে একটা ফুলপ্যান্ট পরে নেমে গিয়েছিল অনিকেত। তখনও ওর জীবনে পায়েল বা তিতলির আবির্ভাব ঘটেনি। সদ্য বেকার থেকে চাকুরিজীবি হয়েছে মাত্র। পাড়ার বারোয়ারী পুজোর ভার তখন ওদের মতো কয়েকজন ইয়ং ছেলের হাতে এসেছে।
কাকু-জেঠুরা বলেছেন, পঁচিশ বছরের পুজো, তোরা যেন রুচিহীন করে ফেলিস না। পাড়ার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যটুকু অন্তত রাখিস। অনিকেতদের টিমটা পাড়ায় ভদ্র ছেলেদের টিম বলেই পরিচিত। ওরা এখনও গুরুজন দেখলে সিগারেট ফেলে দেয়। বয়স্কদের সামনে গালাগাল দিয়ে নিজেদের রুচিহীন প্রমাণ করেনি।
পুজোর দায়িত্ব পেয়ে ওরা আবেগে ফুটছিলো। বাঁধানো বারোয়ারি তলায় অনিকেত পৌঁছাতেই সুজন বলেছিল, আমাদের এবারের রত্নাদীঘির পুজোর সব দায়িত্ব দেওয়া হল অনিকেতকে। আমরা শুধু ওর কথামত কাজ করব। মানে ওই হবে আমাদের ক্যাপ্টেন।
অনিকেত সবার দিকে আলতো করে তাকিয়ে দেখেছিল, কারোর চোখে এই প্রস্তাবের কারণে বিরক্তি উৎপাদন হয়েছে কিনা! দেখেছিল সবাই বেশ হাসি মুখেই বলেছিল, একদম আমরাও সমর্থন করছি এই প্রস্থাব।
অনিকেত একটু ভয়ের সঙ্গেই বলেছিল, কিন্তু এত বড় দায়িত্ব আমি কি পারব? তোমরা বরং নীলাঞ্জনদাকে দাও। নীলাঞ্জনদা অনির কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, পাগলা আমরা সবাই তো তোর সঙ্গেই আছি।
পাঁচ দিন পাঁচটা বড় প্রোগ্রাম সেট করেছিল অনিকেত। অনেক বয়স্ক বা বাচ্চারা পাড়ার বাইরে পুজো পরিক্রমায় যেতেই পারে না। তাদের জন্যই সন্ধের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাজিয়েছিল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা যেমন গান, কবিতা নাচ করেছিল ঠিক আছে। সঙ্গে বাইরে থেকেও কয়েকজন শিল্পীকে আনা হয়েছিল। তারা যে খুব নামী তেমনটা নয়, তবে সকলেই খুব গুণের। মোট কথা সবাই একবাক্যে প্রশংসা করেছিল অনিকেতদের টিমের।
সিগারেটটা শেষ করে ঘুমাতে গেল অনিকেত।
তিতলি পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। পায়েলের ঘন নিশ্বাসের আওয়াজে ঘরের বাতাসে ঘুমের হাতছানি। তিতলির পাটা সাবধানে একটু সরিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল অনিকেত। পরশু ওরা কলকাতা ফিরবে। তার মানে হাতে আর মাত্র কালকের দিনটা। সকালে তিতলিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। পায়েলকে বলতে হবে তিতলিকে একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে যাচ্ছে। একা বেরোলেই পায়েল সন্দেহ করবে। ভাববে ও ঠিক ওই অসীমের খোঁজে বেরোচ্ছে। চোখ বন্ধ করতেই অসীমের মুখটা মনে পড়ে গেল।
চোখের সামনে পরিষ্কার ভাসছে সব কিছু। পুজো মণ্ডপের অ্যানাউন্সটাও যেন কানের কাছে বেজে উঠল।
সকাল হতেই ব্রেকফাস্ট খেয়ে তিতলিকে ঘোরানোর নাম করেই কোয়েলদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অনিকেত। রিতম বলেছিল, ও সঙ্গী হতে চায়। কিন্তু অনিকেত বলেছে, আরে না না তুমি তোমার অফিসিয়াল কাজ সারো। আমি একটু ঘুরেই চলে আসব।
অসীম যেখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করে সেখানে গিয়ে দেখল ও নেই। পাশের দোকানদাররা জানাল বিকেল চারটে থেকে রাত নটা পর্যন্ত বিক্রি করে ও। সকালে বসে না। অনেককে জিজ্ঞেস করেও অসীমের বাড়ির ঠিকানা উদ্ধার করতে পারল না অনিকেত। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার ঠিক আগেই চায়ের দোকানের একজন বৃদ্ধ আগ্রহী হয়ে বললেন, আপনি কি কোনো সংবাদপত্রের লোক? পুলিশের লোক? কে আপনি?
অনিকেত হেসে বলল, দুটোর কোনোটাই আমি নই। আমি অসীমকে চিনতাম অন্য পরিচয়ে। সেটাই ঝালাই করতে এসেছি মাত্র। না পেলে চলে যাব।
অনিকেত ফিরতি পথের দিকে পা বাড়াতেই বৃদ্ধ বললেন,
ডান দিকের রাস্তা ধরে সোজা যাবেন। একটা পুকুর পড়বে ওটাকে বাঁ হাত রেখে মোড়টা ঘুরলেই অসীম পাড়ুইয়ের বাড়ি।
তিতলির হাতে একটা আইসক্রিম ধরিয়ে বৃদ্ধের নির্দেশিত ঠিকানায় পা চালাল অনিকেত।
পাড়ার মধ্যে ঢুকে দু একজনকে জিজ্ঞেস করতেই লোকে ঝালমুড়িওয়ালার ঘর দেখিয়ে দিল।
কিন্তু অন্যদের কৌতূহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল অসীমের কাছে তেমন কেউ আসে না।
একটা ছোট্ট টালির চালের ঘরে সিঙ্গেল একটা তক্তায় বসে একদৃষ্টে বিছানায় বসে থাকা মাছিটার দিকে তাকিয়ে আছে অসীম।
অনিকেতকে ঘরের দরজায় দেখে চমকে উঠে বলল, আপনি? এখানে? কেন এসেছেন?
আমি যে বললাম, আমি আপনাকে চিনি না, তারপরেও আমার ঘর অবধি ধাওয়া করে এসেছেন কেন?
অনিকেত হেসে বলল, এত দুর্বল স্মৃতিশক্তি কোনো ম্যাজিশিয়ানের হয় বলে তো জানতাম না?
অসীম পাড়ুই। রত্নাদীঘির পুজো মণ্ডপ মনে আছে?
অসীম তীব্র ভাবে ঘাড় নেড়ে অস্বীকারের ভাঙ্গিমায় বলল, কে ম্যাজিশিয়ান? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে! আমি ঝালমুড়ি বিক্রেতা। অনিকেত দৃঢ় স্বরে বলল, না আমার ভুল হচ্ছে না। হচ্ছে না বলেই আপনি চোখের দিকে তাকিয়ে অস্বীকার করতে পারছেন না!
কেন ছেড়ে দিলেন ম্যাজিক দেখানো? সবে তো নাম করতে শুরু করেছিলেন আপনি।
এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমি সেবার পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নতুন কিছু এনে চমকে দেব। গান, নাচ আবৃত্তির বাইরে অন্য কিছু। ভাবতে ভাবতেই মনে হয়েছিল, বাচ্চা বুড়ো সকলের পছন্দের জিনিস ম্যাজিক। তখন সদ্য চাকরি জয়েন করেছি। আমরা ম্যাজিক বলতে পি সি সরকার জুনিয়ারকেই চিনি। কিন্তু তিনি শো করতে আসলে যা অর্থ নেবেন তা দেওয়াব ক্ষমতা নেই রত্নাদিঘীর বারোয়ারীর। অফিসে বলতেই আমাদের বিজনদা বললেন, আমি একজনকে চিনি, হয়তো খুব নাম করা কেউ নয়। টিভিতে শো করেননি, কিন্তু হাতের খেল দেখলে চমকে উঠতে হয়। আমি লাফিয়ে উঠলাম। তাহলে চলো আজকেই অ্যাডভান্স দিয়ে অষ্টমীর সন্ধের জন্য বুক করে রাখি।
গলাটা একটু যেন ধরে এল অসীমের। কাঁপা গলায় বলল, হ্যাঁ আমি তখন জয়রামপুরের ম্যাজিক শো করে ফিরেছি। দুজন এসে আমার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়চ্ছিল। আমার মেয়ে ঝিনুক খেলছিল উঠোনে। ধুলো পায়েই ছুটে এসে বলল, বাবা কারা জেন ডাকছে। আমার স্ত্রী জয়িতা রেগে গিয়ে বলেছিল, এই তো ঢুকলে। হাত-পা ধুয়ে চা খেয়ে তবে যাও বাইরে।
আমি জয়িতাকে বললাম, চা বসাও আসছি। দরজা খুলে দেখি দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। একজন হাতজোড় করে বলল, আমি অনিকেত। রত্নাদীঘি পুজো কমিটি থেকে আসছি। আমরা দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে একটা অনুষ্ঠান করছি। আমরা চাই আপনি অষ্টমীর সন্ধেতে ম্যাজিক শো করেন ওখানে।
আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ যাব। ছেলেটা ফট করে আমার হাতে হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল এটা অ্যাডভান্স। অসীম পাড়ুইকে তখনও পর্যন্ত কেউ অ্যাডভান্স দিয়ে বুক করেনি। শো শেষ হলেই টাকা পেমেন্ট করেছে সকলে। সেই প্রথম কেউ অসীম পাড়ুইকে আগাম বায়না করেছিল।
অনিকেত তিতলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আপনার মেয়ে এখন কোথায়? তখন তো মনে হচ্ছে তিতিলির মতোই বয়েস ছিল তাই না?
অসীম তিতলির দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ এর মতোই তখন ছিল ঝিনুক। আমি এখন আর ম্যাজিক দেখাই না। আপনি এবারে আসুন। আমায় আলুসিদ্ধ করতে হবে, লঙ্কা, ধনেপাতা, নারকেল কাটতে হবে, অনেক কাজ বাকি।
অনিকেত বলল, কিন্তু কেন অসীমদা? কেন দেখান না? আমাদের পাড়ার সকলে আপনার সুখ্যাতি করেছিল। বছর দুয়েক পরও আপনাকে আনা হবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, আমার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে দুটো ছেলে গিয়েছিল আপনার বাড়ি। কিন্তু গিয়ে শুনেছিল আপনি নাকি আর থাকেন না ওই বাড়িতে। বাড়িটা নাকি বিক্রি হয়ে গেছে।
অসীম পাড়ুই উশখুশ করে বলল, আপনার মেয়েটা বড় মিস্টি ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
অনিকেত অবাক হয়ে বলল, আপনি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে কেন যাচ্ছেন? আপনি কেন খেলা দেখানো ছেড়ে দিলেন? আপনি কি জাদুবিদ্যা ভুলে গেলেন?
উত্তেজিত হয়ে উঠল অসীম পাড়ুই। তিতলির দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুই ভুলিনি আমি। দেখবেন দেখবেন আমি ওকে ভ্যানিশ করে দেব?
একটা পুরোনো সাদা কাপড়, একটা পুরোনো ট্রাংক আর কাঠের লম্বা বাক্স সামনে নিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বলল, ভ্যানিশ করে দেব।
কাঠের বাক্সের মধ্যে ভরে দিল তিতলিকে। তিন সেকেন্ড পরে কাঠের বাক্সটা খুলে দেখাল তিতলি নেই।
বুকটা ধক করে উঠল অনিকেতের।
অসীম উদ্ভ্রান্তের মতো হেসে বলল, নাম-যশ-টাকার লোভে আমি খুন করে ফেলেছি আমার ঝিনুককে।
শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যাচ্ছে অনিকেতের।
হাউমাউ করে কেঁদে অসীমের হাতটা ধরে বললো, আমার তিতলিকে আপনি ফেরত দিন।
অসীম নিজের হাতে থুথু ছিটিয়ে বললো, মানুষ ভ্যানিশ করার খেলায় মেতেছিলাম তখন আমি। নিজের মেয়েকে নিয়ে যেতাম প্রায় সব শোতে। একবার একটা শোয়ের সময় ঝিনুককে কাঠের বক্সে ভরে দিলাম। কিন্তু ভিতরে যে চোরা বাক্সটা থাকে তার মধ্যে ছোট্ট নিশ্বাস নেওয়ার ছিদ্রটা রাখতে ভুলে গেলাম ঝিনুকের নাকের সামনে। শেষ মোচড়টা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন বক্স খুললাম তখন আমার ছোট্ট ঝিনুক মৃত। বাবার বদনাম যেন না হয় তাই সে বক্সের মধ্যে একটুও নড়াচড়া করেনি। দমবন্ধ হয়ে মরে গেলো আমার ঝিনুক। জয়িতা বলেছিল, কোনো কেস করব না আমি তোমার বিরুদ্ধে। তুমি রোজ মরবে, একটু একটু করে মরবে। জয়িতা চলে গিয়েছিল আমায় ছেড়ে বাপের বাড়ি।
আমি ওই বাড়িতে ঝিনুকের সব খেলনার সঙ্গে ছিলাম কিছুদিন। কিন্তু আর পারছিলাম না। তাই পালিয়ে এসেছিলাম এত দূরে। যাতে কেউ আমায় চিনতে না পারে। অনিকেত অসীমের পা দুটো ধরে বললো, আপনি যত টাকা চান আমি দেব, আমার মেয়েটাকে ফেরত দিয়ে দিন।
অসীম বলল, মেয়েটাকে আমায় দেবেন না বাবু? দিয়ে দিন না?
অনিকেত দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তিতলিকে বের করে দাও। নাহলে আমি পুলিশ ডাকব। কাঠের বক্সে মোচড় দিয়ে অসীম বের করে দিল তিতলিকে।
তিতলি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। অনিকেত তিতলির মুখের সামনে গিয়ে বলল, তিতলি? এই তিতলি?
তিতলি চোখ মেলে কঁকিয়ে কেঁদে উঠল। বাবা বলে গলাটা জড়িয়ে ধরল। অসীমের গাল বেয়ে জল পড়ছে। আস্তে আস্তে বলল, এ বড় ভয়ঙ্কর খেলা বাবু। তাই ছেড়ে দিলাম। যান আপনার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যান। আর কখনও এ চত্বরে আসবেন না।
অনিকেত তিতলিকে বুকে জড়িয়ে কোনোমতে বেরিয়ে এল অসীমের ঘর থেকে।
অসীম ফিসফিস করে বলল, আমিও বাবা ছিলাম। লোভী বাবা। তাই হয়তো ভগবান মেয়েটাকে কেড়ে নিল। কেড়ে নিল ঝিনুককে।
অনিকেত তিতলিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, আমায় ক্ষমা করিস তিতলি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন