অর্পিতা সরকার
স্কুটিটা দাঁড় করিয়ে জিন্সের পকেট থেকে কুড়ি টাকার নোটটা নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটার হাতে দিয়ে বলল, খবরদার বিড়ি, সিগারেট খাবে না বলে দিলাম। আমার কাছে খবর আছে, তুমি ইদানীং ওসব খাচ্ছ। পাগলাটা জিভ বের করে হাসল। স্কুটিতে আবার স্পিড তুলল অস্মিতা। না সমাজসেবী ও নয়। বরং নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে সচেতন। এই চত্বরে যারাই সকাল দশটার মধ্যে যাতায়াত করে তারাই তারানাথ পাগলকে চেনে। ধূলি ধুসরিত জামাকাপড়, মাথার চুলে বহুদিন চিরুনি পড়েনি। আর পাঁচজন বাহ্য জ্ঞানশূন্য মানুষের মতোই এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকে সবজি বাজারের এক কোণে। তারানাথের সঙ্গে অন্য পাগলদের একটা পার্থক্য আছে। অস্মিতা ওর তেইশ-চব্বিশের বছরের জীবনে কখনো তারানাথকে রাস্তার জিনিস কুড়াতে দেখেনি। বরং আরেকটা অদ্ভুত বিষয় দেখেছে, তারানাথ ঘষাঘষ করে ইংরেজিতে দরখাস্ত লিখে দেয় শিক্ষিত, অশিক্ষিত লোকেদের। আর চোখটা শিবনেত্রর মতো উলটে উঁচু ক্লাসের অংক কষতে থাকে নির্দ্বিধায়। বাজারের লোকজন গরম কচুড়িতে কামড় দিয়ে বলে, তারানাথ নাকি কুসুমপুরের ভট্টাচার্য বাড়ির ছেলে। ভট্টাচার্যদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় অনেকেই তারানাথকে পাটের কাপড় পরে পুজোর উপাচার সংগ্রহ করতে দেখেছে কিছু বছর আগে। তখন নাকি তারানাথ তরতাজা ছাব্বিশের যুবক।
আবার এমনও শোনা যায়, তারানাথ নাকি কোন কলেজের অঙ্কের লেকচারার ছিল। কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গন্ডগোল করে বেরিয়ে এসেছিল।
আবার কেউ বলে তারানাথের নাকি ভরা সংসার ছিল কুসুমপুরে, অল্প বয়সে বউ আর এক সন্তান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল বলেই নাকি তারানাথ পাগল হয়ে যায়। তারানাথ যে কি করে পঞ্চাশ কিমি দূরের বর্ধিষু� গ্রাম কুসুমপুর থেকে এই বেলেঘাটায় এল, সেটার হদিস অবশ্য বাজারের কারোর কাছে নেই।
চণ্ডীময়রার দোকানের সামনে একজন বছর চল্লিশ-বিয়াল্লিশের লোককে শুয়ে থাকতে দেখে দোকান বউনির সময় চণ্ডী ময়রা সরে বসতে বলেছিল, তাতে নাকি সেই পাগল ইংরেজিতে খুব ডায়লগ ঝেড়েছিলো। চণ্ডী তার বিন্দুবিসর্গ না বুঝেই বলেছিল, এ আমার বাপ-ঠাকুরদার ব্যবসা, তখন থেকেই এই ঘর আমার। কোনো সরকারেও পারবে না এই ঘর থেকে আমায় বিদেয় করতে। তুমি যদি চৌধুরীদের ছেলে হও তাহলে বলি, আমি কিন্তু ন্যায্য ভাড়া পাঠাই চৌধুরীদের সেজো কর্তাকে। তারানাথ কিসব কাগজপত্র বের করায় চণ্ডী ভয়েই বলেছিল, বেশ বেশ এ যেহেতু তোমার বাপ-ঠাকুরদার সম্পত্তি, তাই সকালের টিফিনটুকু আমার কাছেই খেও, আর আমার দোকানের ওই চাতালেই থেকো। কথিত আছে চৌধুরীদের কোন ছেলে নাকি ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিল দূরপাল্লার ট্রেন যাত্রার সময়। অনেকেই বলে, সে ছেলে ফিরে এসে ঠিক নিজের ভাগ বুঝে নেবে। আদৌ তারানাথ কে সেটা না জেনেই ওকে ঠাঁই দিয়েছিল ধর্মভীরু চণ্ডী ময়রা। সেই থেকেই তারানাথের ঘর-বাড়ি এই মিষ্টির দোকানের চাতাল। চণ্ডীময়রার চাতালে তারানাথ আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে নাকি কুড়ি কিলো ছানার কাজ বেড়ে গেছে ওর। তাই পাগলাকে পয়া ভাবে চণ্ডী। আসলে বাসস্ট্যান্ড জায়গা পরিবর্তন করে সবজি বাজারের গা ঘেঁষে হয়েছে। তাই এই চত্বরের সব দোকানেরই বিক্রি বেড়ে তিনগুন হয়েছে। তারানাথ ভিক্ষে চায় না। তবুও অনেকে ওর হাতে পাউরুটি বা দশ-বিশ টাকা গুঁজে দেয়। যারা গুঁজে দেয় তারাও অনেকের মতোই উপকার পেয়েছে তারানাথের কাছ থেকে।
অস্মিতার সঙ্গে তারানাথের প্রথম পরিচয় হয়েছিল ও যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। মাধ্যমিকে অঙ্কে লেটারমার্ক নিয়ে পাশ করে সায়েন্স নিয়েছিল অস্মিতা। কিন্তু ইলেভেনে উঠে সৌরেন্দ্রনাথ দে আর কেসি নাগ দেখে মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিল।
তারানাথকে তার আগেও বহুবার দেখেছে চণ্ডীময়রার দোকানের চাতালে। পথচলতি মস্তিকবিকৃত মানুষদের দলে ভেবেই আলাদা করে আগ্রহ প্রকাশ করেনি কখনো। শুধু দেখতো লোকটা মোটা খাতা নিয়ে কী যেন করছে।
সেদিন স্কুলের ক্লাসে ম্যাথ স্যার খুব অপমান করেছিল অস্মিতাকে। পরের পিরিয়ডে টিফিন ছিল। অস্মিতা স্কুল ব্যাগ পিঠে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে পাশের বড় মাঠটার পুকুরের ধারে বসে কাঁদছিল।
নতুন স্কুলে, নতুন বন্ধুদের সামনে অপমানিত হয়ে খুব কষ্ট হচ্ছিল ওর। অঙ্কের টিউশন ক্লাসেও সবাই হাসছিল লেটারমার্ক পাওয়া মেয়ের পরিণতি দেখে। স্যারেরা যাই বোঝাচ্ছিল সবটাই অস্মিতার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছিল। পুকুরের দিকে তাকিয়ে ছিল স্থির চোখে। বুকের মধ্যে অপমানের জ্বালাটা উষ্ণতা তৈরি করেছিল। ভাবছিল সায়েন্স ছেড়ে আর্টস নিয়ে ভর্তি হয়ে যাই, কিন্তু কেমিস্ট্রি ওর বড্ড পছন্দের সাবজেক্ট, তাই তাকে ছেড়ে যেতেও পারছিল না। আচমকা তারানাথ সামনে এসে দাঁড়িয়ে বেশ বকুনির ভঙ্গিমায় বলেছিল, এই মেয়ে, ফাঁকিবাজ মেয়ে…স্কুলের ড্রেস পরে ক্লাস কেটে বাইরে বসে আছো? ফাঁকিবাজ কোথাকারের! অন্য সময় হলে অস্মিতা রেগে গিয়ে বলত, তাতে তোমার কী? কিন্তু কে জানে কেন তখনও অস্মিতার মনের ভিতরের কষ্টগুলো তরল হয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। তাই স্বভাববিরুদ্ধ ভাবেই বলেছিল, অঙ্ক এত শক্ত কেন? আমি পারি না কেন? কিছুতেই মাথায় ঢোকে না।
তারানাথ নিজের গোঁফ দাঁড়ির মধ্যে দিয়ে রহস্যময় ভাবে হেসে বলেছিল, সব চেয়ে মজার সাবজেক্ট হল অঙ্ক। যে অঙ্ক পারে না সে বোকা! অস্মিতা রেগে গিয়ে বলেছিল, বেশ আমি বোকা, তুমি চালাক তাই তো? দেখাও দেখি এই অঙ্কটা করে। স্কুল ব্যাগ থেকে বই-খাতা আর পেন বের করে ধরেছিল তারানাথের সামনে।
তখনও অবশ্য তারানাথের নাম জানত না অস্মিতা। কী বলে সম্বোধন করবে বুঝতে না পেরে পাগল মানুষটাকে কাকু বলেছিল অস্মিতা। তারানাথ চোখ বড় বড় করে বলেছিল, খবরদার, কাকু বলবি না আমায়। আমার নাম তারানাথ ভট্টাচার্য। আমায় টি.ভিও বলবি না, আমায় তারানাথ বলে ডাকবি। ভয়ে ভয়ে অস্মিতা বলেছিল বেশ তাই ডাকব।
তারানাথ নিশ্চিন্তের হাসি হেসে বলেছিল, দে অঙ্ক দে। চোখের জলের সঙ্গে মুচকি হেসে বইটা খুলে ধরেছিল অস্মিতা। যে চ্যাপ্টারটা সব থেকে শক্ত, ওর মাথায় কিছুই ঢোকেনি, যেটার জন্য ও আজ টিফিন টাইমে বেরিয়ে এসেছে স্কুল থেকে সেই লেসনটা খুলে বলল, করো দেখি তারানাথবাবু।
তারানাথ মিটিমিটি হেসে করে যেতে লাগল একের পর অঙ্ক। অস্মিতা উত্তর মিলিয়ে দেখছিল সব ঠিক হচ্ছে। হঠাৎ ওর কাছ থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে তারানাথ বলল, এই মেয়ে তুই অঙ্ক শিখবি না উত্তর মেলাবি? অঙ্ক করার পরে জানবি অবশ্যই ঠিক হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাই উত্তর মেলানোর কোনো দরকার নেই। অস্মিতা বিস্মিত হয়ে দেখছিল ঝড়ের গতিতে পুরো চ্যাপ্টারের বত্রিশটা অঙ্ক শেষ করে ফেলল তারানাথ।
অস্মিতা দুঃখ করে বলেছিল, তুমি এত ভালো অঙ্ক পারো তাও তুমি পাগলের মতো কেন ঘোরো? তুমি একটা কোচিং সেন্টার জয়েন করতে পারো তো? তারানাথ রেগে গিয়ে বলেছিল, এই পাকা মেয়ে, আমায় নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই বরং ভাব, তুই কি করে শিখবি অঙ্ক?
প্রতিটা অঙ্ক ধরে ধরে জলের মত করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল তারানাথ। তারপরেই বলছিল, এবারে কষে দেখা শিগগির।
অস্মিতা কষে দেখিয়েছিল নির্ভুলভাবে। অস্মিতা তারানাথের ধুলো মাখা হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমায় অঙ্ক শেখাবে তারানাথ? তারানাথ বলেছিল শেখাব, কিন্তু আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোকে। অস্মিতা বলেছিল কী কাজ? তারানাথ পুকুরের সবজে জলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল সে বলব পরে। শোন, ফাঁকিবাজি করলে আমি চণ্ডাল। রোজ যতগুলো অঙ্ক করাব সবগুলো অন্তত তিনবার করে প্র্যাকটিস করা চাই। না হলে রইলো তোর অঙ্ক। তুই ফেলুরাম হয়ে থাকিস। চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল তারানাথ। অস্মিতা ওর শার্টের বোতাম ছেঁড়া হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, প্লিজ তারানাথ, যেও না। আমি করব প্র্যাকটিস। সেই শুরু হয়েছিল ওদের অঙ্ক শেখা। অস্মিতা তারানাথকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিল, চেয়েছিল মাইনে দিতে কিন্তু সে কোনোটাই শুনবে না। এই পুকুর পাড়েই স্কুলের পরে সে অঙ্ক শেখাবে ওকে। শিখলে ভালো, নাহলে ভাগ।
অস্মিতার বাবা শুনে বলেছিল, ম্যাথের আরেকজন টিচার বাড়িয়ে দিচ্ছি, কিন্তু এসব পাগলকে বিশ্বাস নেই। তাছাড়া তারানাথ মানুষটা কেমন সেটা এই চত্বরের কেউ বুঝতেই পারলো না এত বছরে! পাগল অথচ ব্যবহার করে যেন কত বিজ্ঞ! এর কাছে আমার মেয়ে বিনামূল্যে অঙ্ক শিখছে জানলে পাড়ায় মানসম্মান বলে কিছু থাকবে না আমার। অস্মিতার মাও ভয়ে ভয়ে বলেছিল যদি কামড়ে দেয়! অস্মিতা রেগে গিয়ে বলেছিল হয় আর্টস নিয়ে পড়বে নাহলে তারানাথের কাছেই অঙ্ক করবে ও। বাবা-মা আর কথা বাড়ায়নি। মেয়ের জেদের সঙ্গে তারা বেশ পরিচিত ছিল। মা ভয়ে ভয়ে বলেছিল ওই পুকুর ধারে না পড়ে যদি আমাদের বাগানে বসে পড়তিস, তাহলে কিন্তু মন্দ হতো না। লোক জানাজানিও কম হত। অস্মিতা হেসে বলেছিল, মা পাগল হলেও সকলেরই একটা নিজস্ব মতামত আছে। তারানাথ কারোর বাড়িতে আসবে না।
সেই শুরু হয়েছিল অস্মিতার সঙ্গে তারানাথের অসম বন্ধুত্ব। প্রায় বছরখানেক পরে অস্মিতা বুঝেছিল অঙ্ক ওকে ভয় খাচ্ছে। স্কুলের অনেকেই ততদিনে জেনে গেছে অস্মিতার মাথাটা পুরো খারাপ হয়ে গেছে, তাই ও স্কুলের ম্যাথটিচার রণজিৎ স্যারের কাছে টিউশন ছেড়ে দিয়ে ওই পাগলাটার কাছে ম্যাথ শিখছে। রণজিৎ স্যার ইলেভেনের এক্সামের সময় ওই জন্যই হয়তো অস্মিতাকে অঙ্কে ৯৯ দিয়ে রেখেছিল আর ওনার ছাত্রী বিদীপ্তা পেয়েছিল ১০০। সে নিয়ে অস্মিতার কোনো আক্ষেপ ছিল না। কিন্তু তারানাথ রেজাল্ট দেখে বলেছিল, ওই এক নম্বর লুকিয়ে রাখে, সবাই হিংসে করে, ষড়যন্ত্র করে। গভীর ষড়যন্ত্র। বাবা-মা মেয়ের অঙ্কের নম্বর দেখেই বুঝেছিল কতটা ইম্প্রুভ করেছে ও। বাবা নতুন শার্ট-প্যান্ট পাঠিয়েছিল তারানাথের জন্য। মাও দুরকম রান্না করে পাঠিয়েছিল। তারানাথ নতুন জামা-প্যান্ট পেয়ে খুব খুশি হয়ে বলেছিল, তুই হলি মা দুর্গা। তুই এলি তাই আমি নতুন জামা পরলাম। অস্মিতাকে সামনে বসিয়ে গড়গড় করে দুর্গামন্ত্র আউড়ে গিয়েছিল তারানাথ। ক্লাসের অনেকেরই আগ্রহ ছিল অস্মিতা ম্যাথে কত পাবে জানার জন্য। নম্বর দেখেই গুটিগুটি পায়ে তারা এসেছিল তারানাথের কাছে। দূর থেকে ভয়ে ভয়ে বলেছিল তারাও অঙ্ক শিখতে চায়। যা মাইনে নেবে তাই দেবে। তারানাথ থান ইট নিয়ে তাড়া করেছিল। মর্জির ওপরে চলা তারানাথকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করানো যে সম্ভব নয় সে অস্মিতা ভালোই বুঝেছে এই এক বছরে।
তারানাথ দুর্দান্ত ইংরেজি বলে, লেখে। অস্মিতাকে অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে ইংরাজিও শেখায় তারানাথ।
অস্মিতা ভালো অঙ্ক পারলে তারানাথ নির্দ্বিধায় অস্মিতাকে বুকে টেনে নেয়। আঠেরোর সদ্য যৌবনা অস্মিতা এই ছোঁয়ার অর্থ বোঝে। তারানাথের স্পর্শে ও নিজের বাবার অনুভূতি পায়। বাবা যখন ওকে আদর করে, ঠিক যেমন অনুভূতি হয় ওর তারানাথ যখন ওকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তখন ও বেশ বুঝতে পারে সে ছোঁয়ায় কোনো কালিমা নেই, আছে সকালের সূর্যের মতো স্বচ্ছতা।
অস্মিতাও কম শাসন করে না তারানাথকে। ও পরিষ্কার বলে দিয়েছে, রোজ সাবান দিয়ে স্নান না করলে ও কিছুতেই পড়বে না তারানাথের কাছে। তাই তারানাথ এখন রোজ স্নান করে, আগের মতো গায়ে ধুলো লেগে থাকে না।
বাবা মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল অস্মিতা জয়েন্টে বসুক। কিন্তু অস্মিতা ওদের সে ইচ্ছেতে জল ঢেলে দিয়ে অঙ্ক নিয়ে পড়তে শুরু করেছে। তারানাথ ওকে এমন মজা পাইয়ে দিয়েছে এই সাবজেক্টে যে সাবজেক্টটাকেই ও ভালোবাসে এখন।
তারানাথকে হাজার বলেও চণ্ডীময়রার চাতাল ছাড়িয়ে নিজের বাড়িতে আনতে পারেনি অস্মিতা। তারানাথ বিজবিজ করে বলে, বাড়ি, ঘর, সংসার এ আমার জন্য নয়। আমার যোগ্যতা নেই। আমি শুধু সংখ্যায় বাঁচি।
বেশিরভাগ সময় অন্যমনস্ক থাকত তারানাথ, অস্মিতার সঙ্গে কথা খুব কম বলত কখনো কখনো। কখনো আবার শুধুই পাতার পর পাতা অঙ্ক করে যেত। কখনো পাগলের মতো অনেকগুলো পেপার নিয়ে কিসব ভাবত। অস্মিতা বলেছিল, তারানাথ তোমার পেন আর খাতার খরচ আমার। তারানাথ খসখস করে ইংরেজিতে অ্যাপ্লিকেশন লিখে দিতে পারত এখবর কিছুদিনের মধ্যেই বেলেঘাটায় ছড়িয়ে পড়ায় পাড়ার নেতা থেকে কলেজ স্টুডেন্টরা এসে ধর্না দিত তারানাথের সামনে। তারানাথের মন হলে লিখে দিত একসঙ্গে পাঁচজনকে। আবার ইচ্ছে না হলে চেঁচিয়ে ভাগিয়ে দিত।
অস্মিতা কলেজ থেকে ফিরে প্রায় দিনই যেত তারানাথের কাছে। তারানাথ অস্মিতার সমস্যাগুলো মন দিয়ে দেখে বলত, তোকে পারতে হবে। ইউনিভার্সিটি টপার হতে হবে তোকে!
অস্মিতা দেখত তারানাথের ঘোলাটে চোখে দপ করে জ্বলে উঠত আশার স্বপ্ন। মুহূর্তেই নিষ্প্রভ হয়ে যেত সেই চোখ দুটো। আবার বিজবিজ করে বলত, যা খুশি কর, বেরো এখান থেকে। অস্মিতার বাবা বলেছিল, মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলে হয় না? অস্মিতা অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, কী দরকার বাবা, দু-একজন যদি মানসিক ভারসাম্যহীন হয় তাহলে দোষ কোথায়? মানসিকভাবে সুস্থ মানুষগুলোকে তো দেখলাম, রাস্তাঘাটে ইভটিজিং, নয়তো আড়ালে সমালোচনা, মুখোশের আড়ালে আরেকটা রূপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের তুলনায় তারানাথের মত নির্বিবাদী মানুষ, যারা অন্যের কোনো ক্ষতি করে না, তারা অনেক বেশি সেফ বাবা। ওকে ওর মতো থাকতে দাও। কী দরকার টানাহেঁচড়া করার। তাছাড়া ডাক্তার, ওষুধ এসব ওর ধাতে নেই। ওকে জোর করলে হয়তো পালাবে বেলেঘাটা ছেড়ে।
অস্মিতার রেজাল্টটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেলেছিল তারানাথ। আমার স্টুডেন্ট ইউনিভার্সিটি টপার। এবারে বলুক সবাই তারানাথ চোর, তারানাথ মিথ্যুক!
অস্মিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তারানাথ তার হলদে দাঁত বের করে চওড়া করে হেসে বলেছিল, এবারে আমার একটা কাজ তোকে করে দিতে হবে। এই নে এই পেপারগুলো তুই নে। সব কমপ্লিট হয়ে আছে। তুই তোর নামে জমা দিবি সব। এম এসসি কমপ্লিট হলেই জমা দিবি। অস্মিতা দেখেছিল, অ্যাপ্লায়েড ম্যাথের ওপরে থিসিস পেপার। গবেষণার গভীরতা দেখে চমকে গিয়েছিল অস্মিতা। বিস্মিত হয়ে ও বলেছিল, এগুলো কার তারানাথ? তারানাথ ফিসফিস করে বলেছিল এগুলো আমার! সব পুড়িয়ে দিয়েছিল ওরা, আমি আবার সব তৈরি করেছি। সব রেডি করেছি আমি। কিন্তু এগুলো তুই জমা দিবি ইউনিভার্সিটিতে। তারানাথ মরে গেছে। তাই অস্মিতার গবেষণার ফল এগুলো। অস্মিতা ভয়ে ভয়ে বলেছিল, কিন্তু তারানাথ এগুলো তো অন্যায়! তারানাথ ফুঁসে উঠে বলেছিল, কীসের অন্যায়! আমি কোনো খুন করিনি, কোনো অন্যায় করিনি। তাও আমায় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সব পুড়িয়ে দিয়েছে। অস্মিতা ওর ওলটপালট কথার মানে বুঝতে পারেনি। অস্মিতা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশনার অতিরিক্ত সময় তারানাথের রিসার্চ পেপার নিয়ে বসে থেকেছে। একটু একটু করে বুঝেছে এর গভীরতা। মধ্যরাতে ডুবে থেকেছে তারানাথের তৈরি রিসার্চ পেপার নিয়ে। বুঝতে পেরেছে তারানাথ তার নিজস্ব ঘরানাতে নিরস সংখ্যাদের গায়ে পরিয়েছে রহস্যের জামা। অস্মিতা আপ্রাণ চেষ্টা করে সে পেপারের শেষটুকু শেষ করেছে। কারণ অদ্ভুতভাবে তারানাথ আগ্রহ হারিয়েছিল পেপারগুলোর প্রতি। অস্মিতার হাতে সমর্পণ করার পর থেকে বুকে জড়িয়ে রাখা কাগজের দিস্তাটার প্রতি মোহমুক্তি ঘটেছে যেন।
তারানাথ এখন ভীষণ রকমের চুপচাপ। ফ্যালফ্যাল করে হাসে একটু। অস্মিতা বকলে বলে, চলে যাব এবারে। অনেক দূরে চলে যাব। অস্মিতা আজও মানুষটাকে জোর করে নিজের বাড়িতে অবধি নিয়ে যেতে পারেনি। ইদানীং তার একটাই দাবি সিগারেট খাবে, তাই খুচরো টাকা চাই। অস্মিতা দেখেছে, তারানাথ সিগারেট খায় যত না তার থেকে বেশি তাকিয়ে থাকে জ্বলন্ত আগুনটার দিকে। ধোঁয়া উড়ে যায় ঠোঁটের সামনে, কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঢেকে দেয় তারানাথের ঠোঁটের কোণের অব্যক্ত কষ্টটুকু। অস্মিতার কাছে ওই একটাই আবদার করে তারানাথ, কিছু খুচরো টাকার।
অস্মিতা এখন ভীষণরকমের ব্যস্ত। এম এসসি কমপ্লিট। তারানাথ আর ওকে গাইড করে না। কেমন যেন হয়ে গেছে। গোছা গোছা খাতা দিয়ে এসেছিল অস্মিতা। দু-সপ্তাহ পরে গিয়ে দেখেছে সেই খাতা একইরকম ভাবে পড়ে আছে। মাথার লালচে চুলগুলো সাদা রং ধরেছে। তারানাথ তোমার বয়েস কত? জিজ্ঞেস করলে বলে, ছেলের বিয়ের বয়স হয়ে গেল। লোকে হেসে বলে, পাগলে কী না বলে! অস্মিতা লক্ষ্য করেছে, তারানাথ আর অঙ্ক করে না, দরখাস্ত লেখে না, শুধু সিগারেটের আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
অদ্ভুত সে দৃষ্টি। উদাসীনতা আর কষ্টের মিশেল।
থিসিসের কাজ যেটুকু বাকি ছিল মোটামুটি কমপ্লিট করে ফেলেছে অস্মিতা। জমাও দিয়ে দিয়েছে সময় মতো। এখন শুধু রেজাল্টের অপেক্ষা।
ফেরার পথেও দেখল, তারানাথ একইভাবে বসে আছে চণ্ডীময়রার চাতালে।
অস্মিতা হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমার পেপার জমা পড়ে গেছে। অ্যাপ্রূভাল পেলেই জানাব তোমায়। তারানাথ ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, খবরদার, আমার পেপার নয়। তারানাথ ভট্টাচার্য মারা গেছে। ওটা অস্মিতার রিসার্চ পেপার।
তারানাথ ফিসফিস করে বলল, প্রফেসর হবি তুই।
অস্মিতা ওর হাতদুটো ধরে বলেছিল, চলো না আজকে আমাদের বাড়িতে, তোমাকে অনেক কিছু খাওয়াব। তারানাথ নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলেছিল, সয় না যে। অস্মিতা হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে যাচ্ছিল। তারানাথ বলল, তোকে একটা জিনিস দেব, তুই নিবি? অস্মিতা হেসে বলেছিল, আমাকে আর কত দেবে? তারানাথ করুণ হেসে বলেছিল, তোকেই দেব। কাউকে বলবি না কিন্তু। অস্মিতার ফোনটা বাজছিল। মা ফোন করেছিল।
বাড়ি ফিরেই খাওয়া দাওয়া করে মেল চেক করতে গিয়ে দেখল, তারানাথের থিসিস পেপার ইউনিভার্সিটিতে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছে। অস্মিতাকে ওর প্রফেসর ফোন করে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট পেপার!
অস্মিতার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। খবরটা কাল সকালে গিয়ে তারানাথকে দিতে হবে আগে। এটা তো ওরই কৃতিত্ব, ওরই পরিশ্রমের ফসল। অস্মিতা তো শুধু একটু পালিশ করেছে মাত্র।
সকাল দশটায় একেবারে রেডি হয়ে বেরুলো, ইউনিভার্সিটি যেতে হবে, তার আগে তারানাথের সঙ্গে দেখা করতে হবে। বাজারে ঢুকেই দেখলো বেশ ভিড় জমেছে। চণ্ডীময়রার দুয়ারের সামনে লোকের ভিড়। তাদের কাটিয়ে ভিতরে উঁকি মারতেই আকস্মিক আঘাতে হতভম্ব হয়ে গেল অস্মিতা। তারানাথ বসে আছে স্থির হয়ে, চোখ দুটো লাল। বিজবিজ করে বলছে, আমি চোর নই, চুরি করিনি। লোকজন দাঁড়িয়ে মজা দেখছে। তারানাথ তো বেশি টাকা দিলেই ফেরত দিয়ে দেয়, সে হঠাৎ চুরি কেন করবে? তারপর বুঝল, আপনমনে বলে চলেছে তারানাথ। সম্বিৎ নেই যেন। অস্মিতা ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখল, ওর গায়ে বেশ জ্বর।
পরিচিত দু-একজনের সাহায্যে তারানাথকে লোকাল হসপিটালে ভর্তি করল ও। তারানাথ ফিসফিস করে বলল, ওই ব্যাগটা তুই নিবি।
অস্মিতা বলল, গবেষণা পত্রগুলো সাড়া ফেলে দিয়েছে তারানাথ। তুমি কিছু বলবে না? তারানাথ বলল, জানতাম, আমি চোর নই, জানতাম। দুটো চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কাঁচা পাকা দাঁড়ির মধ্যে মিশে গেল উত্তপ্ত জলের ফোঁটাগুলো।
অস্মিতা বলল, ঠিক হয়ে যাবে তুমি। আবার সুস্থ হয়ে যাবে। এবারে আমি ডক্টরেট হয়ে যাব, তোমায় অঙ্ক শেখাব ওই পুকুরের পাড়ে। গোঁফের ফাঁক দিয়ে মুচকি হাসল তারানাথ। আমি মরে গেলে আমায় চন্দন কাঠে পোড়াবি? ভটচায বাড়ির সকলকে চন্দন কাঠে পোড়ায়।
হসপিটালের বাইরের ওয়েটিং রুমে বসে ব্যাগটার চেন খুলল অস্মিতা। মিলিটারি রঙের ডায়রিটা খুলল প্রথম। এই ডায়রিটা কোনোদিন ছুঁতেও দেয়নি তারানাথ। উচ্চমাধ্যমিকের আগে একদিন ভুল করে এই ডায়রিটাতে হাত দিয়ে ফেলেছিল অস্মিতা। তারানাথ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল। তারপর ভয়ে আর ওদিকে তাকায়নি অস্মিতা।
ডায়রির প্রথম পাতায় লেখা আছে তারানাথ ভট্টাচার্য। কুসুমগ্রাম। ফোন নম্বর লেখা আছে একটা। ল্যান্ড নম্বর। বাড়ির অ্যাড্রেস দেওয়া আছে।
লিখতে শুরু করেছে তারানাথ।
সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল, কলেজে যেতে বারণ করেছিল কস্তুরী। টিপাই খেলা করছিল বাইরের বারান্দায়। সেও বেরোনোর আগে বলেছিল, বাবা আমার আজ ছুটি, তুমি আজ ছুটি নাও না! কস্তুরীর চোখেও ছিল আকুতি। সেও বলল, আমার স্কুলেও আজ রেনিডে। তারানাথ হেসে বলেছিল, ও তোমাদের প্রাইমারি স্কুলের বাচ্চাদের দুদিন বৃষ্টিতে ভিজে খিচুড়ি খেলেই মজা। আমার কি সে উপায় আছে? আজ কলেজ যেতেই হবে। একদিন আগেই সেমিস্টারের রেজাল্ট বেরিয়েছে, বেশ কয়েকজন খুব খারাপ নম্বর পেয়েছে। কার কিসে সমস্যা হচ্ছে আগে জানতে হবে তো।
কলেজে ঢুকে ভেবেছিল আজ না এলেই হত। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী আসেনি। তবুও যে জনা দশেক ছিল তাদের নিয়েই ক্লাস শুরু করেছিল তারানাথ। উত্তেজনায় ফুটছিল তখন ও। গত দু-বছরের পরিশ্রম জমা দেবার তারিখ আজকে। কলেজের ক্লাস সামলে, সংসার সামলে রিসার্চ করা মুখের কথা নয়। দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়েছে ওকে। শান্তিনিকেতনী ব্যাগের মধ্যে ছিল ওর রিসার্চ পেপার। মনের আনন্দে স্টুডেন্টদের পড়াতে শুরু করেছিল ও। তারানাথকে ভালো স্টুডেন্টরা পছন্দ করলেও মিডিয়ামেরা কোনদিনই পছন্দ করত না।
তারানাথ একটু কড়া ধাঁচের। পরিশ্রম না করে নম্বর নেবে, সেটি হচ্ছে না।
পিছন ফিরে বোর্ডে অঙ্ক লিখছিল তারানাথ, হঠাৎ দেখল টেবিলের ওপর থেকে ওর ব্যাগটা নেই।
তাকিয়ে দেখল, রুমে দশজন নেই। দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা বলল, স্যার আপনি আমাদের সেকেন্ড পেপারটাতে বড্ড কম নম্বর দিয়েছেন। রীতিমতো ফেল করিয়ে দিয়েছেন স্যার। ওই নম্বরটা একটু বাড়িয়ে দিতে হবে স্যার। মাত্র ছয়জনের নম্বর বাড়ালেই হবে। তারানাথ তীক্ষ্ন স্বরে বলেছিল, এসবের মানে কী? মেয়েগুলো হাসতে হাসতে বলেছিল, তবে কি স্যার আপনার নামে কোনো মিথ্যে বদনাম দেব?
একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল তারানাথ, কিন্তু তারপরেও রাগত গলায় বলেছিল, তোমাদের যা ইচ্ছে করো, আমি একটা নম্বরও বাড়িয়ে দেব না তোমাদের।
চোখের সামনে জ্বলছিল ওর দু-বছরের রিসার্চ পেপার। একজন ক্লাসের বাইরে সিগারেটের আগুন দিয়ে ধরিয়ে দিল পেপারগুলো। জ্বলে গিয়েছিল ওর স্বপ্ন।
বাড়ি ফিরে এসেছিল তারানাথ। দুদিন কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। আচমকা দুদিন পরে কস্তুরী বলেছিল, বেরিয়ে যাও তুমি এই বাড়ি থেকে। এ বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়, এ বাড়ির ছোটছেলে চোর, মিথ্যেবাদী? কিছু বুঝতে পারেনি বিধস্ত তারানাথ। কস্তুরী দেখিয়েছিল খবরের কাগজে বেরিয়েছে, এক প্রফেসরের রিসার্চ পেপার চুরি করে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যায় তারানাথ ভট্টাচার্য। তারপর প্রমাণ লোপাট করতে নিজেই আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেই পেপারে। যে প্রফেসরের পেপার সে নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। পুলিশ খতিয়ে দেখবে ব্যাপারটা।
সেই ছবিও ছাপা হয়েছে কাগজে। তারানাথ দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসরুমের বাইরে, ওর সামনে জ্বলছে পেপারগুলো। ওর স্টুডেন্টরা হয়তো আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল। কিন্তু ওরা যেটা জানে না সেটা হল, ওই আগুনে সত্যিই পুড়ে গেল তারানাথের রিসার্চ পেপার। ওরা হয়তো স্যারের ব্যাগের কতগুলো কাগজ জ্বালিয়ে ছবি তুলতে চেয়েছিল, নাম দিত রিসার্চ পেপারের। কিন্তু ওগুলো ছিল তারানাথের হৃৎপিণ্ড। কস্তুরীর ভর্ৎসনার পরে ভট্টাচার্য বাড়ি থেকে চলে এসেছিল তারানাথ। তারপর ওর চোখের সামনে অঙ্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। রাস্তাঘাট সব এক লাগত। আর কিছু লেখেনি তারানাথ। বাকি ডায়রির সব পাতায় শুধু লেখা আমি খুনি নই, চোর নই। বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথায় কোথায় গিয়েছিল সম্ভবত আর তারানাথের মনে নেই। এই ডায়রিটাতে যে তারিখ দেওয়া আছে সেটা প্রায় বছর বারোর আগেকার। তারমানে বারো বছর আগে তারানাথ বাড়ি ছেড়েছে। নাকি আরও আগে? হয়তো এটা লিখেছে আরও পরে। ধীরে ধীরে ওর স্মৃতি থেকে সব লোপ পেয়েছে, পড়ে আছে শুধু সংখ্যাতত্ত্বের জটিল হিসেবনিকেশ।
অস্মিতা আর দেরি না করেই তারানাথের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ল্যান্ডনম্বরে ফোন করে দেখল ভ্যালিড নেই নম্বরটা। কুসুমপুরে পৌঁছে শুনল, ভট্টাচার্য বাড়ি আছে, কস্তুরী আর টিপাই নেই সেই বাড়িতে। বাড়ির বেশিরভাগ মেম্বার নাকি কলকাতাতে বাড়ি কিনে আছে। এবাড়িতে ওই পুজোর সময় আসে। এখন খুড়তুতো জেঠতুতোরা রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তারানাথের কথা বলতেই দুজন নাক কুঁচকে বলল, ওর জন্যই তো এই বাড়ির বদনাম হয়েছিল। শুনেছি পাগলা হয়ে কোথায় ঘুরে বেড়ায়। তার বউ কস্তুরী কলকাতায় বাস করে, বিয়ে করেছে। তারানাথ তো চুরি করে কলেজ থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাই বাড়ি ছেড়েও পালিয়েছে। বেঁচে আছে কিনা কে জানে!
অস্মিতা আনমনে ভাবছিল, একটা মিথ্যে বদনাম কীভাবে শেষ করে দিল তারানাথের গোছানো সংসারটাকে। মানুষটা নিজের অস্তিত্ব ভুলে গেল, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল ক্রমাগত আঘাতে।
হসপিটালে পা দিতে ডক্টর বললেন, আপনার পেশেন্ট ঠিক আছে, নিয়ে যান। তবে মানসিকভাবে কিন্তু উনি অসুস্থ। অস্মিতা হেসে বলল, সে বেশ ভালো। ওনার ভাগ্যিস সব মনে নেই তাই এতদিন বেঁচে আছেন, নাহলে হয়তো নিজেকে শেষ করে দিতেন। প্রতারিত হয়েছেন যে বড্ড!
তারানাথকে দেখে প্রথমে চিনতে পারছিল না অস্মিতা। দাঁড়ি, চুল কেটে একেবারে অন্য মানুষ যেন। অস্মিতাকে দেখে হেসে বলল, কি রে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলিস? ভেবেছিলিস তো তারানাথ মরে গেলে কে তোকে অঙ্ক শেখাবে? স্কুলে খুব মার খাবি তাই না? অস্মিতা বুঝলো, মানুষটা আবার অনেক কিছু ভুলে গেছে।
এমনিতে খুব শান্ত ভাবে কথা বলছে, কিন্তু বাকি সব ভ্যানিশ স্মৃতি থেকে। তাই অস্মিতা নিজের বাড়িতে নিয়ে আসায় আর কোনো আপত্তি করেনি। বাবা বলেছিল, ওনাকে নিয়ে কী করবি কিছু ভাবলি? যদি বলিস তো আমি ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করি কোনো মানসিক হাসপাতালে।
অস্মিতা হেসে বলেছিল, তারানাথের অঙ্কের ম্যাজিক নামে একটা কোচিং খুলব। তুমি শুধু দেখবে, ম্যাজিকের মতো করে তারানাথ অঙ্ক শেখাবে সবাইকে।
তারানাথ এখন ভীষণ শান্ত। কালো বোর্ডে অঙ্ক কষতে কষতে বলল, ম্যাজিক। এই অঙ্কটার তিনটে উত্তর বেরোবে, তিনটেই ঠিক।
অস্মিতা দেখল, ওদের বাইরের ঘরে বেশ জমিয়ে বসেছে তারানাথের অঙ্কের ম্যাজিক ক্লাস। স্টুডেন্ট বেশ ভালোই হচ্ছে।
অস্মিতা কানে কানে বলল, এবারে একটা বই লেখো তারানাথ। সহজে অঙ্ক শেখার উপায়।
তারানাথ যেন স্মৃতির পর্দা সরিয়ে বলল, লিখেছি তো, একটা বই লিখেছি আমি। আমার ব্যাগ কোথায়?
অস্মিতার মা বলল, ওই নোংরা ব্যাগটা তো সিঁড়ির তলায় আছে। অস্মিতা ব্যাগটা বের করে এনে দেখল, একটা মোটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি।
কতরকম প্রসেসে অঙ্ক করা যায় তার উপায় শিখিয়েছে তারানাথ।
বইটা এখন কলেজ স্ট্রিটের অনেক দোকানেই পাওয়া যায়। পরিচিত স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের প্রফেসর অস্মিতা বসু প্রায়ই সাজেস্ট করেন এই বইটা কেনার জন্য।
তারানাথ কালো বোর্ডে এখনও এঁকে চলে সংখ্যাতত্ত্বের জাদু। ওর ঠোঁটে লেগে থাকে দুনিয়া জয় করার খুশি।
অস্মিতা ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, কিছু মানুষ থাকুক মানসিক ভারসাম্যহীন নামেই। তবুও সরলতা আছে ওর মধ্যে। এই জটিল পৃথিবীতে এটুকুই থাকুক একেবারে আদিম, চূড়ান্ত বন্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন