অর্পিতা সরকার
ফিসফিস করে সৌভিক বলল, ম্যাডাম জল খাবেন? অসুস্থবোধ করছেন কি? হাঁপাতে হাঁপাতে রাগী চোখে সৌভিকের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা বলল, কী চান, এই ভাবে মেয়েদের মন জয় করতে চান? লজ্জা করে না আপনার? দেখে তো ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। অবশ্য দেখে আর কবেই বা কাকে বোঝা গেছে! একরাশ বিরক্তি সুরেলা গলাতে। সৌভিক দেখল, কাজল কালো চোখ দুটো এই মুহূর্তে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চোখের কোণে শ্যামলা দীঘির জল টলটল করছে। যে কোনো সময় ছাপিয়ে এসে গাল, চিবুক সব ভিজিয়ে দেবে। মেয়েটার মুখ দেখেই সৌভিক বুঝতে পেরেছিল, এর মধ্যে মারাত্মক কোনো ভাঙাগড়া চলছে। তাই ভদ্রতা করেই জলের অফার করেছিল।
জলের বোতলটা ব্যাগে ভরতে উদ্যত হতেই মেয়েটা বললো, জলে কিছু মিশিয়ে রাখেননি তো? খাবো আর অজ্ঞান হয়ে দুবাই চলে যাব?
সৌভিক জলের বোতলটা ব্যাগে ভরে নিয়ে বলল, ম্যাডাম রেহাই দিন। আপনাকে জল খেতে হবে না। তবে থ্যাংক ইউ ম্যাম ফর ইউর কমপ্লিমেন্ট। মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, কমপ্লিমেন্ট কি দিলাম আপনাকে?
সৌভিক হেসে বলল, আমার চেহারার মধ্যে নিশ্চয়ই আপনি এমন কিছু খুঁজে পেয়েছেন যাতে আমাকে আপনার দাউদের ভাই-টাই মনে হয়েছে। আসলে ক্যাবলাকান্ত শুনে শুনে আমি ফেড আপ, বিশ্বাস করুন। এই যে কেউ আমাকে দুবাইয়ের কিডন্যাপার ভাবল, এটাই অনেক বড় প্রাপ্তি। আসলে কী জানেন, প্রতি মুহূর্তে আমি নিজেকে গ্রূম করার চেষ্টা করছি। এখন বুঝতে পারলাম একটু হলেও গ্রূমিংএর কাজে আমি সফল হয়েছি।
মেয়েটা মুচকি হেসে বলল, আগে জলটা নিজে খান তারপর আমি খাব।
সৌভিক ঢকঢক করে দু-বার জলটা খেয়ে বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার প্রেসার বেড়ে গেছে কোনো কারণে, চোখ দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। তাই বললাম। মেয়েটা সৌভিকের জলটা চাতক পাখির মত নিঃশেষ করে দিয়ে ফাঁকা বোতলটা ওর হাতে ধরাতে ধরাতে বলল, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। ওই জানোয়ারটার বাবাটার জন্যই এই অবস্থা হল। শালা, মেয়েদের এরা ভাবে কী? পণ্য? আমি কি ওর ছেলেকে বিয়ে করার জন্য পড়ে আছি নাকি বে? আপনি ভাবতে পারবেন না গোটা ফ্যামিলিটা কি হারামি!
সৌভিক থতমত খেয়ে বলল, ম্যাডাম পাবলিক প্লেসে স্ল্যাং ইউজ করা কি উচিত হচ্ছে? মেয়েটা বিরক্ত হয়ে বলল, কোনটা স্ল্যাং বললাম মশাই? আমার এখন নীলাভ আর ওর বাবাটাকে কাঁচা কাঁচা দেওয়া উচিত ছিল, আমি দিইনি। নেহাত পাবলিক প্লেস বলেই জিভটাকে শাসন করলাম।
মেয়েটা সৌভিকের দিকে তাকিয়ে বলল, বাই দ্য ওয়ে আপনার নাম কী? আমার নাম, মনামী রায়।
জানালার দিকে তাকিয়ে সৌভিক বলল, সৌভিক দাশগুপ্ত।
মেয়েটা প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, আপনি নীলাভর কেমন ভাই? মুখের আদলে সামান্য মিল আছে মনে হচ্ছে! তাই তো ভাবি, এত ভালোমানুষ আজকাল আছে নাকি, মানুষ না চাইতেই জল অফার করে! আগে বলুন, নীলকমল দাশগুপ্ত আপনার কে হয়? গোটা গুষ্টি আমার পিছনে পড়ে আছেন? আমি আপনার ওই লাফাঙ্গা ভাইকে বিয়ে করব না। আমি তাকে আগেই পরিষ্কার করে বলে দিয়েছি ব্রেকআপ। তারপরেও আপনাকে পাঠিয়েছে আমায় ফলো করতে?
কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসটা এতক্ষণে একটু নড়ে উঠল। এসি থ্রি টায়ারে বসে একটু আরাম করবে ভেবেছিল সৌভিক। দিনরাত অফিসের কাজে জেরবার হয়ে থাকে ও। ট্রেনে উঠেই ভেবেছিল, এখন থেকেই হলিডে মুডে থাকবে। ডুয়ার্স পৌঁছানোর আগে থেকেই শুরু হবে ওর হলিডে। অফিস আর বাড়ি করে করে নাজেহাল হয়ে গেছে সৌভিক। তাই ইচ্ছে করেই কদিনের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। নির্ভেজাল ছুটি কাটাবে। বাবা-মা যদিও বলেছিল জামশেদপুর যেতে। কিন্তু সৌভিকের ইচ্ছে করেনি এই পাঁচদিনের ছুটিটা দেশের বাড়িতে গিয়ে নষ্ট করতে। আপাতত দুর্গাপুজোর কটা দিন ও তিলোত্তমা বা লোকালয় থেকে দূরে থাকতে চায়। কিন্তু ছুটি শুরুর আগেই এ কোন ঝামেলার সম্মুখীন হল ও।
সহযাত্রী যদি এমন হয় ওয়ান নাইট জার্নি করা তো দূর, একঘণ্টা যেতেই প্রাণপাত হয়ে যাবে। কে নীলাভ, কে নীলকমল কে মহেশ্বর এসব খুঁজতে খুঁজতেই ছুটির আমেজ ভোকাট্টা হয়ে যাবে। এসব পাগলা পাবলিককে কেন যে বাড়ির লোকজন ফাঁকা রাস্তায় ছেড়ে রাখে কে জানে?
মনামী আবার বলল, বললেন না তো, কেমন ভাই আপনার? খুড়তুতো না জেঠতুতো?
সৌভিক শান্ত গলায় বলল, আমি ক্লাস ওয়ানে এক নীলাভ পালকে চিনতাম ক্লাসমেট হিসাবে। আর তো কাউকে চিনি না। মনামীর শেষপর্যন্ত কথা শোনার ধৈর্য একেবারেই নেই। সে বলে উঠল, ওহ ছোটবেলার বন্ধু? ওই যাকে বলে বুজম ফ্রেন্ড আর কি? তবে আর কি বন্ধুকে গার্ড করতে নেমে পড়েছেন মার্কেটে।
সৌভিক বোঝার চেষ্টা করছিল এই মনামী বলে মেয়েটা বাঙলাতেই কথা বলছে তো? অসমীয়াতে নয় তো? যদি বাংলাতেই বলে তাহলে ওর মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কী করে? একটা শব্দও বুঝতে পারছে না। সৌভিক বিরক্ত হয়ে বলল, আপনাকে জল দেওয়া আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে। অত্যন্ত দুঃখিত। বাকি নীলরঙের গোটা ফ্যামিলিকে আমি চিনি না।
মনামী সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, সিঁথির মোড়ের নীলাভ দাশগুপ্ত আপনার কেউ হয় না বলছেন?
সৌভিক এতক্ষণে অসমীয়া শব্দগুলোর মানে বুঝল। বেশ দৃঢ় গলায় বলল, আরে আপনি? আপনার জেঠুর সঙ্গে পরিচয় করার বড্ড ইচ্ছে ছিল আমার। অস্কার পাওয়া মানুষ বলে কথা। আচ্ছা আপনার জেঠতুতো দাদার সঙ্গে একবার পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন? মনামী ভ্রু কুঁচকে বলল, আমার বাবা বংশের একটাই ছেলে। আমার কোনো জেঠু নেই। কী পাগলের মতো বকছেন? কে অস্কার পাওয়া?
সৌভিক বালিশটা আঁকড়ে ধরে বলল, কী মিথ্যে কথা বলছেন। মানলাম আপনারা সেলিব্রিটি ফ্যামিলি, তাই বলে এই অর্বাচীনকে একটু আলাপ করিয়ে দিতে পারেন না?
মনামী বিরক্ত হয়ে বলল, আজেবাজে লোক একটা। ভুলভাল বকছেন কেন? সৌভিক মৃদু হেসে বলল, সত্যজিৎ রায় যদি মনামী রায়ের জেঠু না হয়, তাহলে নীলকান্ত না নীলকমল দাশগুপ্তও আমার মামা,কাকা নয়। বুঝলেন মিস রায়? এবারে দয়া করে আমায় বিরক্ত করবেন না।
মনামীর সন্দেহ বোধহয় পুরোপুরি যায়নি। তাই সৌভিকের ফোনে ফোন এলেই কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছিল। সৌভিকের প্রথমে বিরক্ত লাগলেও পরে বেশ মজা লাগছিল। অফিসের কলিগ নীলাঞ্জন ফোন করেছিল একটা প্রয়োজনে। সৌভিক ইচ্ছে করেই ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ রে নীল বল। হ্যাঁ আমার পাশেই বসে আছে মেয়েটা। দেখতে সুন্দর, কিন্তু মাথা খারাপ তো!
নীলাঞ্জন বেচারা না বুঝে বলল, সৌভিকদা আমি অফিসের নীলাঞ্জন সিনহা বলছি। আমি মেডিসিন নিয়ে তোমায় কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।
নামী মেডিসিন কোম্পানিতে জব করে সৌভিক।
নীলাঞ্জনকে আরেকটু কনফিউজড করে সৌভিক বলল, হোয়াটসআপ করতে পারিস। আসলে পাশেই আছে তো তাই ঠিক বিশ্লেষণ করতে পারছি না নীল। তবে সুন্দরীরা শুনেছি একটু পাগলি টাইপ হয়। একাই যাচ্ছে তো মনে হচ্ছে।
নীলাঞ্জন কিছুই না বুঝতে পেরে বলল, ধুর, তুমি পুরো ছুটির মুডে আছ। আমি রক্তিমকে কল করে নিচ্ছি।
মনামী চোখ সরু করে তাকিয়ে বলল, আমার সন্দেহ যে ভুল নয় সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। সে আপনি আমায় সুকুমার রায়ের নাতনি বললেও নয়।
সৌভিক মুচকি হেসে বলল, বেশ এবারে বলুন দেখি আমার খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে আপনার ব্রেকআপটা হল কী কারণে? আর আপনি দাশগুপ্ত সারনেমের ওপরে এমন শার্লক হোমস গিরি চালাচ্ছেনই বা কেন?
মনামী ফর্মে ফিরে এসে বলল, কারণ এই দাশগুপ্তরা ভীষণরকমের চালাক হয়, লোভী হয়, অসভ্য হয় আরও অনেক কিছু হয়। সৌভিক শান্ত ভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, বুঝলাম। বাকি কী কী হয় সেগুলো আর বলার দরকার নেই। সত্যি বলতে কী আপনার যা মুখের ভাষা দেখলাম তাতে ভয়ে আছি। এখন বলুন দেখি, আমার ভাইটা ঠিক কী করেছে? ও যে ভীষণ ইনোসেন্ট, ও আবার কী করল?
মনামী রেগে গেলে ওর চিবুকে একটা অদ্ভুত ভাঁজ পরে। সেদিকে তাকিয়ে সৌভিক মনে মনে বলল, নীলাভ দাশগুপ্ত সত্যিই একটা আস্ত পাঁঠা, নাহলে এমন মেয়েকে কেউ চিট করে। যে মেয়ের মুখই মনের আয়না, যাকে এত সহজে প্রেডিক্ট করা যায়, তাকে নির্দ্বিধায় ভালোবাসা যায়। অন্তত মনের কোণে অন্ধকার লুকিয়ে রাখতে পারে না মনামী, ওর স্বচ্ছ দৃষ্টিই তার প্রমাণ। মেয়েটার মধ্যে একটা অসম্ভব আকর্ষণী শক্তি আছে। না হলে সৌভিকের মত মহিলাবিমুখ পুরুষকে কৌতূহলী করে তুলতে পারত না।
মনামী শান্ত গলায় বলল, আপনার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ না লাভ? আমার সঙ্গে নীলাভর অ্যারেঞ্জ প্লাস লাভ হতে চলেছিল। আমাদের পরিচয় হয়েছে মাস ছয়েক আগে ম্যাট্রিমনি সাইটে। হঠাৎই আমার বাবা ওই সাইটে আমার ছবি দিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট খোলে। তারপর সম্বন্ধ আসতে শুরু করে, ম্যাক্সিমামদের আমরাই বাতিল করি। এক শনিবারের সন্ধেতে কী মনে হতে আমি বসেছিলাম সাইটটা নিয়ে। তখনই নীলাভর হাইটা এসে ঢুকেছিল আমার চ্যাট বক্সে। তারপর কথা বলতে বলতে খেয়াল করি আমাদের রুচির ভীষণ মিল। সে মুভি থেকে সং। ফুড হ্যাবিট থেকে হবি…সব কিছুর প্রচুর মিল। আমরা মিট করি। সত্যি বলতে কি নীলাভকে প্রথম দেখেই আমার বেশ ভালো লাগে। যাকে বলে সোবার, ডিসেন্ট। নীলাভরও আমাকে ভাল লেগেছিল সেটা ও স্বীকার করেছিল অকপটে। আমরা প্রায়ই অফিস ফেরত দেখা করি বিভিন্ন ক্যাফে বা মাল্টিপ্লেক্সে। ওহ, বলিনি না, আমিও জব করি। আমি একজন পুলিশ অফিসার। এস আই। আমি জব পেয়েছি মাত্র দেড় বছর হল।
সৌভিক একটু ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, মরেছে, একেবারে পুলিশ! কিন্তু আপনাকে দেখে তো আমার কবিতার নায়িকা মনে হচ্ছিল।
মনামী চলন্ত ট্রেনের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, পুলিশরা বুঝি ইনোসেন্ট হয় না? তাদের বুঝি নরম মন থাকে না? এমন কথা আপনাদের কে বুঝিয়েছে বলবেন? সৌভিক সামলে নিয়ে বলল, কেউ বোঝায়নি ম্যাম। আসলে পুলিশের হাতের ডান্ডার বাড়ি যারা খেয়েছে তাদের বর্ণনা থেকেই ধারণা করে নিয়েছি মাত্র। যাইহোক, আপানি নীলাভ আর আপনার বিষয়টা কন্টিনিউ করুন প্লিজ।
মনামী উদাস চোখে তাকিয়ে বলল, কন্টিনিউ করার মত অবশিষ্ট আর থাকলো কোথায় বলুন? দুই বাড়িতেই বিয়ের তোড়জোড় চলছিল। কার্ড ছাপানো কমপ্লিট। আমিই ভেঙে দিলাম বিয়েটা। গত পনেরটা দিন দোলাচলে দুলতে দুলতে শেষে ভেঙে দিলাম। নীলাভ হেল ডিপার্টমেন্টে জব করে। কোনো সমস্যা ছিল না আমাদের দুই ফ্যামিলির মধ্যে, তাই বাড়ির পারমিশন নিয়েই আমাদের মেলামেশাটা শুরু হয়। কার্ড ছাপানো হয়ে যাবার ঠিক দিন দুই পরে আমার বাবা নিলাভদের বাড়িতে ইনভাইট করতে গিয়েছিল প্রথম কার্ড নিয়ে। নীলকমল দাশগুপ্ত মানে নীলাভর বাবা বলেছেন, আত্মীয়স্বজনরা নাকি ফিসফিস শুরু করেছে মেয়ে পুলিশ বলে, তাই ওনারা চান বিয়ের আগেই যেন আমি চাকরিটা ছেড়ে দিই। আমার বাবা খুব ভালো করে জানতো, আমি অনেক এক্সাম দিয়ে জবটা পেয়েছি। ইনফ্যাক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে জব করব এটা আমার স্বপ্ন ছিল। তাই বাবা কার্ডটা ওনার হাত থেকে নিয়ে বলেন, মনামীর আপনার ছেলেকে পছন্দ হয়েছিল বলেই আমি বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, নাহলে নীলাভর থেকে অনেক যোগ্য ছেলে আমরা পেতাম। আপনাদের এই মানসিকতা জানার পরে আমার মেয়েকে তো এমন ব্যাকডেটেড বাড়িতে পাঠাতেই পারি না। বাবা অপমান করে চলে আসার পরে নীলাভ আমায় ফোন করেছিল ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য। ও নাকি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলবে। বিয়ের লজ ঠিক হয়ে গেছে, সমস্ত শপিং কমপ্লিট, পনেরো দিন ধরে কথা বলার পরে শ্রীযুক্ত নীলাভ বলতে এসেছিল, পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে অন্য কোনো চাকরি হলে নাকি ওর বাবার আপত্তি নেই। আমিও স্ট্রেইট বলে দিয়েছি, তোমার বাবাকে পরিত্যাগ করে অন্য কোনো বাবা অ্যাডাপ্ট করলে আমি বিয়েতে রাজি হব। যতক্ষণ পর্যন্ত নীলকমল দাশগুপ্ত নীলাভর পিতৃপরিচয়ে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমিও বিয়ে করব না। এটা শোনার পর নীলাভ কিছুক্ষণ চুপ ছিল, তারপর বলেছে এ কেমন অস্বাভাবিক আবদার?
মনামী বলেছে, অস্বাভাবিক আবদারের বদলেই ও একটা আজব আবদার করেছে মাত্র। তারপর নীলাভর সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখেনি ও। তবুও ওদের গোটা ফ্যামিলি এখনও পড়ে আছে মনামীর পিছনে। জাস্ট বিরক্ত হয়ে গেছে ও। সেই জন্যই একা একা পুজোর ছুটিটাতে বেড়াতে চলেছে ও। বাবা-মা আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মনামী ওদের বলেছে, ওর একলা থাকার প্রয়োজন।
সৌভিক বেশ জোরেই হাততালিটা দিয়ে উঠে বলল, করেছেন কী মশাই? বিয়ের শর্ত হিসাবে পাত্রের বাবাকে বদলে ফেলতে বলেছেন? ব্রাভো। এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ মেয়ে পাত্রের বাড়ির সমস্ত শর্তে নতিস্বীকার করে, মেনে নেয় তাদের অস্বাভাবিক দাবিগুলো, সেখানে দাঁড়িয়ে আপনি তো মশাই বাঁহাতে থাপ্পড় কষিয়েছেন নীলাভ নামক মেষশাবকের গালে। না মশাই, আপনার জন্য খাঁকি ড্রেসটাই পারফেক্ট।
চারিদিকে তাকিয়ে মনামী বলল, আস্তে কথা বলুন, সবাই আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। সৌভিক নিজেকে সংযত করে বলল, সে ওদের চোখদুটোর একটু সদ্ব্যবহার করছে করুক না। এখন বলুন তো, আমার ভাইয়ের এখন ঠিক কী অবস্থা? মনামী মুচকি হেসে বলল, আমি বুঝেছি নীলাভ আপনার কেউ হয় না। অবস্থা আর কি, শপিং কমপ্লিট, কার্ড ছাপানো কমপ্লিট, এখন চায় ধরে বেঁধে আমার সঙ্গে বিয়েটা করতে। সৌভিক আনমনে বলল, তারপর মানে বিয়ের পর হয়তো প্রেশার সৃষ্টি করে আপনাকে বাধ্য করা হত জবটা ছাড়তে। এটাই তো বেশিরভাগ বাড়ির গল্প। উচ্চশিক্ষিতের বড়াই করে বাড়ির বউয়ের ওপরে সমস্ত রকম স্যাক্রিফাইজের দায় চাপানো। মনামী দৃঢ় গলায় বলল, আমিও আমার শর্ত থেকে সরিনি। নীলকমল দাশগুপ্তের ট্রান্সফার হলে তবেই আমি দাশগুপ্ত ফ্যামিলিতে এন্ট্রি নেব!
সৌভিক হো হো করে হেসে বলল, ব্রিলিয়ান্ট। দেখুন মনামী, মহিলা সম্পর্কে আমার একটা মারাত্মক এলার্জি আছে। সেটা শুরু হয়েছে নিজের মাকে দেখে। আমার মাকে দেখেছি বরাবর আমার আর বাবার মুখে সমস্ত ভালো খাবারটা তুলে দিয়ে নিজে যাহোক পড়ে থাকা অবশিষ্টটুকু দিয়ে খেয়ে নিতে। বারবার বলা সত্ত্বেও মা পরিবর্তন করেনি নিজের স্বভাবের। কেমন যেন সংসারের সর্বময় কর্তী হয়েও উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাঁচতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা! আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, মহিলারা বাঁচতে জানে না, নিজেদের যোগ্য ভাবতেই যেন তাদের বড্ড আপত্তি। এরপর বয়েজ স্কুলে পড়ে কলেজে গেলাম। সেখানে যা দু-চারটে বান্ধবী জুটল তাদের দেখলাম, নিজেদের থেকে পুরুষ বন্ধুদের বিশ্বাস করে বেশি। এই ধরুন নাইট শো দেখতে যাবে তিনজন মেয়ে মিলে, তার মাঝে দুজন ছেলে বন্ধুকে বলত, এত রাতে একা যাওয়াটা কি ঠিক, তোরাও চল। দুটো ছেলে সঙ্গে থাকলে নাকি বিপদ কম। আমি হেসে বলতাম, নিজেদের রাত্রে বেরনোর জন্য উপযুক্ত করে তোলার ইচ্ছে তো তোদের নেই দেখছি, পরগাছা হয়ে কাটিয়ে দিতেই তোরা ভালোবাসিস। একদিন ইভটিজিং করতে আসা ছেলেগুলোকে তোরা তিনজনে মিলে মেরে দেখিস তো, আর কোনোদিন তাকাবে না তোদের দিকে। কিন্তু তোরা তো তা না করে বাবা, দাদা, বন্ধু, বয়ফ্রেন্ডের ওপরে ভরসা করে থাকিস। সত্যি বলতে কী মেয়েদের উপরে এইরকম বেশ কয়েকটা কারণে ভীষণ এলার্জি। এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে সেই ইচিংটা হল না। মনে হল, মেয়েরাও পারে, চাপের মুখেও বশ্যতাস্বীকার না করে সোজা থাকতে।
মনামীর থুতনিতে সেই বিশেষ ভাঁজে চোখটা আটকে গেল সৌভিকের। মেয়েটার মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের মিশেল আছে। মেয়েলি কমনীয়তার সঙ্গে দৃঢ়তার দুর্দান্ত সামঞ্জস্য। মনামী একটু নরম গলায় বলল, সরি, আমি আপনাকে অযথা সন্দেহ করেছিলাম। আসলে দাশগুপ্ত সারনেম শুনলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ইদানীং।
সৌভিক বলল, একটা কথা বলুন তো, আপনি কি এখনও নীলাভকে ভালোবাসেন? মনামী একটু চুপ করে থেকে বলল, অনুভূতি অবশিষ্ট নেই আর, তবে এখনও ভুলিনি মানুষটাকে। এখনও মেসেজ করে চলেছে আমায়, তাই হয়তো দুর্বলতাটা কাটাতে একটু সময় লাগবে। সৌভিক স্মিত হেসে বলল, সত্যি বলার সাহস আছে আপনার। আপনি দেখছি আমার মহিলা এলার্জি কাটিয়েই ছাড়বেন! মনামী একটু হেসে বলল, বহুদিন পরে কারোর সঙ্গে এত পারসোনাল কথা শেয়ার করলাম। কেন কে জানে?
আনমনে নিজের মোবাইলটা ঘাঁটছে মনামী। শুকনো ঠোঁটদুটো বার দুয়েক জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোধহয় জলের বোতল খুঁজল। সৌভিক নিজের ব্যাগ থেকে আরেকটা জলের বোতল বের করে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটার সিল আপনিই কাটুন। আপনাকে দুবাই নিয়ে গিয়ে ট্যুর করানোর মতো টাকা আপাতত নেই আমার কাছে। মনামী বলল, ট্রেনে জল উঠবে না নাকি? আমি তাড়াহুড়োয় বোতলটা আনতে ভুলে গেছি। সৌভিক বলল, সামনেই পেয়ে যাবেন, ডোন্ট ওরি। এটা খান আপাতত। জল খাওয়ার সময়েই এক বিন্দু জল মনামীর হালকা গোলাপি ঠোঁটে পড়ে ধীরে ধীরে চিবুকের দিকে এগোচ্ছিল। সৌভিকের কেমন যেন হিংসে হচ্ছিল ওই অযাচিত জলের বিন্দুটাকে। এমন অদমনীয় সাহস যেন মেনে নেওয়া যায় না কিছুতেই। নির্নিমেষ তাকিয়েছিল সৌভিক, কিছু সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা হয় না। যেমন কঠিন শীতে কৃষ্ণচূড়ার ডালে একগুচ্ছ আবির রঙের ফুল দেখলে মনটা আচমকা খুশিতে ভরে ওঠে অথচ ব্যাখ্যা করা যায় না, যেমন তীব্র গরমের বিকেলে আবহাওয়া দপ্তরের কোনোরকম আগাম বার্তা না থাকা সত্ত্বেও তুমুল বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়ে তৃপ্তি দেয় অগ্নিদগ্ধ প্রাণকে, তেমনই কিছু প্রাপ্তির কোনো ব্যাখ্যা নেই। মনামীর সৌন্দর্যটাও ঠিক তেমনই। প্রদীপের আলোর উষ্ণতা আছে কিন্তু শিখার নীচেই আছে স্নিগ্ধতা।
মনামী কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিল। চোখ বন্ধ করে ভেসে যাচ্ছিল অন্য জগতে। সৌভিক মনে মনে হিসেব কষছিল, এতদিন পর্যন্ত ও বাড়িতে বলেছে বিয়ে ও করবে না। মায়ের আনা সব পাত্রীকে ক্যানসেল করেছে ও। বাড়ির সকলেই জানে সৌভিক বিয়ে করবে না। তবুও যেহেতু বয়সটা এখনও আঠাশের ধারে কাছে ঘোরাঘুরি করছে তাই লোকজন এখনও লড়ে যাচ্ছে ওর বিয়ের জন্য। তবুও ওদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই বুঝে গেছে এ ছেলের বিয়ে হবে না। সবেতে খুঁত বের করা সৌভিকের বিয়ে আর হবে না বলে মাও নিজের মনকে মানিয়ে নিয়েছে। এখন যদি বাড়িতে গিয়ে বলে, একটা কালবৈশাখীকে ওর পছন্দ হয়েছে, তাহলে এতদিনের এত লেকচার সব বিফলে যাবে। মানসচক্ষে সকলের মুখটা কল্পনা করে নিজের ভাবনার ইতি টানার চেষ্টা করল সৌভিক। ঠিক তখনই মনামী ওর হেডফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, নীলাভ ফোন করছে, একটু ভুলভাল কথা বলুন তো, যাতে বিরক্ত না করে আমায়। সৌভিক ঠিক কী করা উচিত না বুঝেই বলল, হাই নীলাভ, আমি সৌভিক। আমরা দুজনে ডুয়ার্স যাচ্ছি আপাতত। না না, বিয়ে এখনও করিনি, প্রি হানিমুন বলতেই পার। তুমি কি আর কিছু বলবে? কী? কবে হল আমাদের সম্পর্কটা? একটু আচমকাই হল, ঠিক যেমন বিয়ের কার্ড রেডির পরে তোমার বাবা মনামীকে জব ছাড়ার প্রস্তাব দিলেন, ওরকম আকস্মিক হয়ে গেল আমাদের রিলেশনটা। এনিওয়ে, তুমি সবটা জেনে গেলে, আর বিরক্ত করো না মনামীকে। হ্যাঁ, ওই ডেটেই আমাদের বিয়েটা হবে। গুড নাইট।
মনামী হেডফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, কে বলল আপনাকে এত বেশি বেশি বলতে? শুরু করলে আর কন্ট্রোল করতে পারেন না নাকি? প্রি হানিমুন, ওই ডেটে বিয়ে….হে ভগবান, এখন কী হবে?
সৌভিক জিভ কেটে বলল, সরি মনামী। আসলে মেডিসিনে আছি তো, তাই একটা ওষুধের মাল্টিপল অ্যাকশন বোঝাতে বেশি কথা বলে বলে অভ্যেস হয়ে গেছে। যেমন ধরুন সহজ করে বলি, প্যারাসিটামল আপনি খেতে পারবেন, জ্বর এলে, গায়ে ব্যথা হলে, হালকা ঠান্ডা লাগলে… মনামী গজগজ করে বলল, কী ভাগ্যিস বলেননি যে আমাদের সন্তানকে সাউথ পয়েন্টে ভর্তি করব ভাবছি। আজব পাবলিক তো আপনি। উপকার করার বদলে দিলেন তো সব ঘেঁটে। এই তো বাবার ফোন ঢুকছে। তার মানে নীলাভ অলরেডি আমার বাবাকে কল করে বলেছে সব। এখন কী করি আমি! একটু ইতস্তত করছিল মনামী। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে মনামীর বাবা বলল, আমি তো জানতাম তুমি একা দার্জিলিং যাচ্ছ, এই সৌভিকটা কে? তোমরা নাকি প্রি হামিমুনে যাচ্ছ? এসব কী হচ্ছে মনামী? মনামী আমতা আমতা করে বলল, আসলে নীলাভ বারবার বিরক্ত করছে ফোনে। তাই একজন অপরিচিতকে ধরে কথা বলিয়েছিলাম। বাবা একটু গম্ভীর থেকে বলল, একটাই কথা বলব, তুমি যথেষ্ট বুঝদার মেয়ে। কাউকে যদি পছন্দ করো তাহলে ক্লিয়ারলি বল, আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ঝাপসা করে রেখো না কোনো কিছু। ও সামলে নিয়ে বলল, আমি একাই যাচ্ছি বাবা।
ফোনটা রেখে দিয়ে কটমট করে তাকাল সৌভিকের দিকে। সৌভিক অসহায় মুখ করে বলল, সরি, আমি ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি আমার আপন ভাই এখনও তার না হওয়া শ্বশুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছে।
এনিওয়ে এক্সট্রিমলি সরি। সৌভিক নিজের বিছানা করে শুয়ে পড়বে বলে রেডি হচ্ছিল, মনামী বলল, সবেতে মজা করা ছেলে আমার মোটেই পছন্দ নয়। আমি একটু সিরিয়াস টাইপ মেয়ে।
সৌভিক হেসে বলল, আমি আবার একেবারেই সিরিয়াস হতে পারি না। তাই আমাদের বন্ধুত্বটা ঠিক জমল না। গুড নাইট। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল সৌভিক। মনামীর আবার ট্রেনে ঘুম হয় না। তাই আগেই জানত গোটা রাতটা জেগে কাটাতে হবে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের এখন একটাই চিন্তা, পুলিশ মেয়ের পাত্র পেলে হয়! চোর ডাকাতের পিছন পিছন বাড়ির বউ দৌড়াবে সেটাতে আপত্তি জানিয়েছে অনেক পাত্রের বাবাই। অনেকেরই মত হল, অন্য কোনো চাকরি হলে কি আর বারণ করত? কিছুজনের তো রীতিমতো ধারণা হয়ে গেছে, পুলিশে জব করলে নাকি চরিত্র বলেও কিছু থাকে না। অকারণে এসব অবুঝ, অযৌক্তিক মানুষগুলোকে বোঝাতে যায়নি ও। নীরব হয়ে গেছে। সেই জন্যই পুজোর সময়টা কলকাতায় থাকতে ইচ্ছে করেনি ওর। একপ্রকার জোর করেই ছুটি আদায় করে বেরিয়ে পড়েছে। বাবা-মায়ের অবশ্য এই একলা আসা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনামীকে ছেড়েছেন যাহোক। কলকাতায় এই বিয়ের প্রসঙ্গ নিয়ে সকলের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ও ক্লান্ত, বিধস্ত হয়ে যাচ্ছিল। কবে বিয়ে করবে? কেন করছে না? তাই নিজের সঙ্গে একলা থাকার এই বিশেষ আয়োজন ওর। চোখটা বুজতেই মনে পড়ে গেল পাত্রপক্ষের কথাগুলো। শর্ত সাপেক্ষ ছিল, ওকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে ওর কাছে, সংসার না জব? ও তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, শর্ত দিয়ে আর যা কিছু হোক ভালোবাসা হয় না। তাই সময় নিলেও উত্তর দিয়েছিল, আমার চাকরি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
পাত্রপক্ষ বিরক্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিল। ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পরেছিল জানে না মনামী।
ট্রেনের এসিতে কেমন শীত শীত করছিল, গায়ে ঢাকাটা ভালো করে টেনে নিতে গিয়ে দেখল, সৌভিক ওর নিজের জায়গায় নেই। হঠাৎই ভয় করলো মনামীর। সৌভিক গেল কোথায়? মোবাইলের ঘড়িতে দেখল রাত দুটো বাজে। এখন তো নামার স্টেশন আস্তে ঢের দেরি আছে। সৌভিক যতই ভুলভাল বকবক করুক তবুও এই প্রথম একটা মানুষ ওকে সাপোর্ট করে বলল, বেশ করেছেন। মনামী একটু ওয়েট করল, হয়তো ওয়াশরুমে গেছে, কিন্তু প্রায় মিনিট পনেরো হয়ে গেল তাও যখন ফিরল না, তখন দেখল ওর ব্যাগটাও নেই। মধ্যরাতে একটা ঠান্ডা হিমেল স্রোত বুঝিয়ে দিল, একাকীত্ব আর একাকী শব্দগুলো কাব্যিক হলেও, বাস্তবে ভীষণরকমের ভয়ংকর। সাইডের সিটে একজন অবাঙালি ঘুমাচ্ছেন। মনামী ধীর পায়ে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। কেউ নেই। ফেরার সময় দেখল, পাশের কম্পার্টমেন্টে সৌভিক বসে আছে একটা ফাঁকা সিটে।
মনামী কাছে গিয়ে ডাকতেই চমকে উঠে বলল, একি, আপনি মাঝরাতে এমন কুহেলীর নায়িকার মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? ঘুম নেই চোখে? মনামী ওর পাশে ধুপ করে বসে বলল, আপনি কেন অন্যের সিটে বসে আছেন? সৌভিক হেসে বলল, অন্যরা নেমে গেছে মধ্যরাতের স্টেশনে তাই। মনামী বলল, আপনার নিজের সিটটা ঠিক কী সমস্যা করছিল? সৌভিক ফিসফিস করে বলল, সমস্যা হচ্ছিল বলেই না পালিয়ে এলাম। আপনি যান, নিজের সিটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। মনামী সৌভিকের কানের কাছে মুখটা এনে বলল, ঘুম আসছে না, ভয় করছে তো।
মনামীর শরীরের মেয়েলি নরম গন্ধে আবার কঠিন থাকার সব হিসেবনিকেশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সৌভিকের। ঠিক এই কারণেই চলে এসেছিল ওই কুপ থেকে। সৌভিক ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় দেখেছিল, মনামীর কানের সাদা পাথরটা হালকা অন্ধকারে চিকমিক করে জ্বলছে। হিরে কিনা জানা নেই সৌভিকের। তবে ওই পাথরটার সম্মোহনী ক্ষমতার বলেই ঘুমন্ত মনামীর দিকে বেশ কিছুক্ষণ চোরের মতোই তাকিয়েছিল সৌভিক। কিছু অবাধ্য চুল এসে পড়েছিল মনামীর গালে। শাসন না মানা পাহাড়ি ঝর্ণার মতো। কানের সোনার ফুলটা যেন পাহাড়ের ধারের বুনো গাছ। ঠোঁটের কোণে লেগেছিল পাইন গাছের রহস্যময়তা।
এক অমোঘ টানে সৌভিকের সব সংযম ভেঙে যেতে বসেছিল, মনে হচ্ছিল রূপকথার এই রাজকন্যার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে। তারপর তাকে বলতে, পক্ষীরাজ নেই আমার তবুও তোমাকে চাই। ঝগড়া,অভিমানেও তোমাকে চাই, অসহ্য ভালোবাসায় তোমাকে চাই। যদি ওই রাজকন্যা জিজ্ঞেস করত, তুমি আমায় কী দেবে ভিখারি রাজা? তাহলে সৌভিক বলত, অফুরন্ত স্বাধীনতা, অনাবিল বন্ধুত্ব আর অনেকটা বিশ্বাস। তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়েছিল সৌভিক। সদ্য বিশ্বাস ভেঙে যাওয়া মেয়েটাকে আশ্বাস দিলেও সে নিতে রাজি হবে না হয়তো। তাই নিজের সংযমকে বিশ্বাস না করে অন্য কামরায় সিট খুঁজেছিল। মধ্যরাতের স্টেশনের নেমে গিয়েছিল এক সহযাত্রী। নিজের ব্যাগটা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল সৌভিক। মনে মনে বলেছিল, ট্রেনের স্মৃতিটুকু থাকুক অন্তরালে, অমূল্য হয়ে।
মনামী বলল, আরে চলুন না, নিজের সিটে চলুন। সারারাত কি বসে কাটাব নাকি? সৌভিক হেসে বলল, আমাদের রাজ্যের প্রশাসন তবে ভূতে ভয় পায়? মনামী নিস্পলক তাকিয়ে বলল, না একাকিত্বে ভয় পায়। বকবক করা, অকারণে হাসা একটা মানুষের সান্নিধ্যে মনের অন্ধকার জায়গাটা বেশ আলোকিত হয়ে যায়। এই প্রথম কোনো মানুষ নীলাভর সঙ্গে বিয়ে ভেঙে দেবার পরে আমাকে সাপোর্ট করল। সৌভিক বেশ গম্ভীর স্বরে বলল, একটা কথা বলি শুনুন, স্বামী সৌভিকানন্দের বাণী বলে মনে রাখবেন। স্বাধীনতা একান্ত নিজের জিনিস, এটা কারোর কাছে ভিক্ষা করবেন না। যেটা একান্ত আপনার সেটা কেন অন্য কেউ আপনাকে ভিক্ষে দেবে বলুন তো? তাই কেউ না দিতে চাইলে কেড়ে নেবেন। জীবনটা আপনার, যেভাবে ইচ্ছে যাপন করুন। অন্যের অনুমতি না নিয়ে।
মনামী বলল, কটা দিন থাকবেন আমার সঙ্গে? বন্ধু হয়ে? আত্মীয় বন্ধুদের চাপে আমি বিধস্ত, এই সময়টা একটু কাটাতে সাহায্য করবেন প্লিজ? সৌভিক মনে মনে বলল, কেন বাঁধতে চাইছ মনামী, আমি যে আপাদমস্তক বেঁধে ফেলছি নিজেকে! সৌভিক ঘাড় নেড়ে মজার ছলে বলল, একটাই শর্ত, আমার মহিলা অ্যালার্জি কাটিয়ে দিলে চলবে না। বিয়ে আমি করব না, ভালোও আমি বাসব না কাউকে। এই আমার শপথ।
মনামী বলল, আমার নম্বরটা রাখুন। আপনারটা না দিলেও চলবে। সৌভিক হেসে নিজের নম্বরটা বলেই বলল, আপনি এখন কোথায় যাবেন? মানে বেড়াতে কোথায় যাচ্ছেন? আমি ডুয়ার্স। রাভি নদীর তীরে হারিয়ে যাব। জঙ্গলে রাস্তা হারাব তারপর খুঁজে খুঁজে বের করব জনপদ। মনামী বলল, আমি ঠিক হারাতে যাচ্ছি না। আমরা যখন ট্রেনিং পিরিয়ডে ছিলাম তখন এক বান্ধবীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, তার অরিজিনাল বাড়ি দার্জিলিং থেকে একটু দূরে। ও আপাতত বাড়িতে আছে, তাই ওর সঙ্গেই কাটাব ছুটির পাঁচদিন।
সৌভিক বলল, যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমাকে তুমি বলতে পারেন। মনামী ঘাড় নেড়ে বলল, আপত্তি নেই। তবে একটা শর্তে, বন্ধুত্ব যখন হয়েই গেল তখন কলকাতায় গিয়েও যোগাযোগ থাকবে আমাদের।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে আলাদা হয়ে গিয়েছিল দুজনে। মাঝে দুজনেই নিজের নিজের বেড়ানোর ছবি পাঠিয়েছিল হোয়াটসআপে। সৌভিক প্রথম মনামীর ফোনটা পেয়েছিল কলকাতায় ফেরার দিন সাতেক পরে। উত্তেজিত মনামী বলেছিল, সৌভিক আর্জেন্ট দরকার আছে। নীলাভর বাড়ি থেকে বলছে, ওরা নাকি শর্ত তুলে নিচ্ছে, বিয়েটা করতে চায়, আমার কী করা উচিত?
সৌভিক নিজের ঘরে বসে মনামীর ছবিগুলোই দেখছিল ফটো গ্যালারি খুলে। একটা হলদে রঙের সোয়েটার পরে পাহাড়ের বাঁকে আলগোছে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে মনামী। ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল সৌভিক। ডুয়ার্স থেকে ফেরার পর থেকেই একটা অচেনা মনখারাপি বাতাস এসে ঘিরে ধরেছে সৌভিককে। যার সঠিক কারণ ও জানে না। শুধু এটুকুই বুঝতে পারছে না, ওই একটা ট্রেন জার্নি ওর জীবনের সমীকরণগুলোকে বদলে দিচ্ছে কী ভাবে! ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকাকালীনই মা এসে ঢুকেছিল ওর ঘরে। মনামীর ছবিটা দেখে বলেছিল, ভীষণ ভালো। এর অ্যাড্রেস দে, তোর বাবাকে নিয়ে গিয়ে পাকা কথা বলে আসি। দেখ পুটাই, গুষ্টির সকলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তোর ছাড়া।
বিল্টুরও বিয়ে ঠিক হয়েছে, ও তোর থেকে বছর দেড়েকের ছোট রে, তুই আর না করিস না।
সৌভিক মুচকি হেসে মাকে বলেছে, এই রাজকন্যা আর যারই হোক আমার বোধহয় হতে পারে না।
মনামী আবারও উত্তেজিত গলায় বলল, আরে সৌভিক শুনছ? আমি কী করব?
সৌভিক হালকা চালে বলল, নীলাভ বা নীলকমলবাবু যদি সব শর্ত মেনে থাকেন তাহলে সমস্যা কোথায়? বিয়েটা সেরে ফেল।
রাগত স্বরে মনামী বলল, হিপোক্রিট একটা। তুমিই তো বলেছিলে, ওরা চাইবে বিয়েটা দিয়ে দিতে তারপর তোমাকে প্রেশার দেবে জবটা ছাড়তে। তাহলে এখন কেন উল্টো বলছ? নাকি বন্ধুত্বের বোঝাটা ভারী লাগছে বেশি, তাই নামাতে চাইছ?
সৌভিক বলল, পুলিশ অফিসারদের বুঝি বুদ্ধি কম থাকে? কে সারাজীবনের জন্য বোঝাটা নিতে চাইছে আর কে নামাতে চাইছে সেটাও বোঝে না?
মনামী একটু থেমে বলল, আমি একটা সর্বনাশ করে ফেলেছি ঝোঁকের মাথায়। এখন তোমাকে সামলাতে হবে ব্যাপারটা। সৌভিক উঠে বসে বলল, আবার কী করা বাকি ছিল মনামী? তুমি তো শেষ পেরেক পুঁতেই বেড়াতে গিয়েছিলে! মনামী বলল, না আসলে নীলাভ আর ওর বাবা যখন এই প্রস্তাব দিল, তখন আমার বাড়িতেও সকলে প্রেশার দিচ্ছিল, তখন আমি সামলাতে না পেরে বলে দিয়েছি, আমি এনগেজড হয়েছি সৌভিকের সঙ্গে।
সৌভিক প্রায় চিৎকার করে বলল, মানে? মনামী নিরুত্তাপ গলায় বলল, আমার আর কোনো নাম মনে পড়ছিল না সেইমুহূর্তে। অগত্যা তোমার কথাই বলেছি। এখন বাবা তোমাকে দেখতে চাইছে।
সৌভিক বলল, কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি তো বলেইছি বিয়েতে আমি নেই। মনামী রেগে গিয়ে বলল, সম্ভব নয় মানে কী? তুমি জানো আমি তোমাকে অ্যারেস্ট করতে পারি? সৌভিক বলল, কীসের দায়ে? মনামী বলল, সে আমি বলব না। মোট কথা তুমি আজ বিকেলে আসছ আমাদের বাড়িতে, দ্যাটস অল।
ফোনটা রেখে দিয়েছে মনামী। সৌভিক দুশ্চিন্তায় নিজের নখ খাচ্ছে। মনে মনে বলল, জীবন তো একটাই, বাঁচার অধিকার সকলের আছে। ভুল করার অধিকারও সকলেরই আছে। আর প্রতিজ্ঞাভঙ্গ তো স্বয়ং যুধিষ্ঠির করেছিলেন, ও তো নগন্য মানুষ।
মনামী ওদের বাড়ির অ্যাড্রেস সেন্ড করেছে হোয়াটসআপে। নীচে লিখে দিয়েছে, বিকেল পাঁচটা। নাহলে এমন কেসে ফাঁসাব না, টের পাবে।
সৌভিক আর দেরি না করে মাকে গিয়ে বলল, চলো মেয়ে দেখে আসবে। মা একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি বলছিস? আশালতাদেবী যেন এতদিনে প্রাণ ফিরে পেলেন। সকলের ছেলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর পুটাইটার হচ্ছে না…এই ভাবনায় আশালতা ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকেন। যাক ছেলের মতি ফিরেছে এই ঢের।
বিকেলে যখন মনামীদের বাড়িতে পৌঁছাল সৌভিক আর ওর মা তখন ঘড়িতে পাঁচটাই বাজছে। মনামী ওকে দেখে ফিসফিস করে বলল, তুমি কি সিরিয়াসলি মেয়ে দেখতে এসেছ? মাকে নিয়ে কেন? সৌভিক ভ্রু কুঁচকে বলল, ব্যাপারটাতে বিশ্বাসযোগ্যতা আনতে। সৌভিকের মায়ের মনামীকে ভীষণ পছন্দ। আশালতাদেবী নাকি সাহসী মেয়েই পছন্দ করেন। তাই পুলিশ অফিসার শুনে আপ্লুত হয়ে গেলেন। ওদিকে মনামীর বাবা, মায়েরও সৌভিককে পছন্দ হয়ে গেল। মনামী বলল, এই বিয়েটা ক্যানসেল করা আর তো সম্ভব নয়। সদ্য একটা ভেঙেছি, এখন তোমাকে ভালোবাসি বলে নীলাভদের ফ্যামিলিকে বাতিল করলাম। তোমায় কি বলে বাতিল করব একটু বলবে? সৌভিক মনামীর ঘরটা দেখতে দেখতে বলল, দাশগুপ্ত সারনেম বলে বাতিল করতে পার, আর তো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। মনামী ঘাড় নেড়ে বলল, অসম্ভব।
সৌভিক আলতো স্বরে বলল, তাহলে বিয়েটা করেই নাও। আর কি করা যাবে! মনামী অভিমানী স্বরে বলল, কিন্তু তোমার মহিলা অ্যালার্জির কী হবে? যদি অ্যালার্জিটা ভালো হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত তখন? সৌভিক মনামীর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, আপাতত ইচিং হচ্ছে না দেখছি। তুমি এত কাছে আছ, তাও হচ্ছে না।
বিয়েটা নির্বিঘ্নেই হয়ে গেল সৌভিক আর মনামীর। মনামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে, কিছুটা দায়ে পরেই বিয়েটা করল ও। সৌভিক জানে মনামী এখনও হয়তো নীলাভকেই ভালোবাসে, নেহাত পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হল সৌভিককে। যদিও সৌভিক সেই চলন্ত কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসেই ভালোবেসেছিল মনামীকে। সত্যি বলতে কি ওকে নিজের করে পেয়ে ধন্য হয়েছে সৌভিক। কিন্তু মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছিল, মনামী ওকে মেনে নিতে বাধ্য হল বলে। বৌভাতের দিন দুপুরে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল সৌভিক, তখনই কানের খুব কাছে দুজনের ফিসফিস করে কথা বলার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল।
চোখ বন্ধ করেই গলাদুটো আইডেন্টিফাই করতে পারল সৌভিক।
আশালতা বলছে, শোন মনামী, পুটাই যদি কখনো নীলাভর বিষয়ে জিজ্ঞেস করে তাহলে তুই বলে দিবি, তুই আর ওকে মনে রাখতে চাস না। নাহলে আমার পক্ষে এখন নীলাভ খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। মনামী কৌতূহলী গলায় বলল, আরে সেদিন ট্রেনে যাকে দিয়ে ফোন করেছিলে সেটা কে ছিল? তাকে আরেকবার পাওয়া যাবে না? আশালতাদেবী গম্ভীরভাবে বললেন, না রে, সে তো পিজ্জা ডেলিভারি বয় ছিল। জোর করে ধরেপাকড়ে ওই একটাই কল করাতে পেরেছিলাম। আর শোন, তোর আর নীলাভর বিয়ের কার্ড নিয়ে যদি কথা ওঠে তাহলে বলবি, সেসব নষ্ট হয়ে গেছে। মোট কথা পুটাই যেন জানতে না পারে তোকে কাঞ্চনকন্যাতে আমিই পাঠিয়েছিলাম। আসলে কী বলত, পুটাই আর তোর টিকিটটা সেদিন আমিই কেটে দিয়েছিলাম রাজীবকে দিয়ে। মনামী ভিতু গলায় বলল, তবে যাই বলো মা, তোমার ছেলের বোধহয় এখনও সন্দেহ হয়নি, যে তুমিই এই গেমের মাস্টার। আশালতা নরম গলায় বলল, তোকে যে পছন্দ ছিল সেই কবে থেকে। তুই মিনুর মেয়ে, জানিস, মিনু আর আমি স্কুলের বন্ধু। যোগাযোগ ছিল না মাঝে বহুবছর। আবার যখন যোগাযোগ হল, তখন তোকে দেখলাম। তখনই ভেবেছিলাম, পুটাইয়ের বউ করব তোকে। কিন্তু ছেলে আমার পাগল, তাই এত প্ল্যান করে তোর সঙ্গে মিট করাতে হল। মনামী আদুরে গলায় বলল, থ্যাংক ইউ মাসিমনি, থুড়ি মা। আশালতা বললেন, হ্যাঁ রে, আমার ছেলেকে তোর পছন্দ হয়েছে? মনামী হেসে বলল, সে তো দুবছর আগে ছবি দেখেই পছন্দ হয়েছিল। তারপর তো তুমিই বলেছিলে, সৌভিক নাকি বিয়ে করবে না বলেছে। জানো, আমি ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম সৌভিককে। ও নেয়নি আমার রিকু। কি মারাত্মক অসভ্য ভাবো একবার। আশালতা হালকা চালে বলল, সেসব দোষের শাস্তি এখন থেকে দে।
তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে নামছিল মনামী, ফোনটা বেজে উঠল ওর। আননোন নম্বর। রিসিভ করতেই বলল, আমি নীলাভ দাশগুপ্ত। নীলকমল দাশগুপ্তর ছেলে… একবার ছাদে আসুন শিগগির।
মনামী রাগী গলায় বলল, ইয়ার্কির জায়গা পান না তাই না? একবার কল করেছেন তখন দরকার ছিল, এখন ভাগুন তো। নাহলে সোজা থানায় চালান করব। ছেলেটা আরও গম্ভীর স্বরে বলল, ছাদে আসুন ইমিডিয়েট।
লাল কোটা শাড়িটা সামলে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে গেল মনামী। এ আবার কোন ফ্রডের পাল্লায় পড়ল রে বাবা। নীলাভ দাশগুপ্ত বলে তো কেউ নেইই। এটা তো পুরো আশাআন্টির বানানো প্লট। এই নীলাভর তো আজকে এন্ট্রি নেবার কোনোরকম সম্ভবনা ছিল না।
ছাদে উঠেই মনামী দেখল, একজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে। মনামীর দিকে হাতটা বাড়িয়ে বলল, নীলাভ দাশগুপ্ত। মনামী রাগী গলায় বলল, কে নীলাভ? আমি এমন নামের কাউকে চিনি না।
সৌভিক পাশ থেকে বেরিয়ে এসে বলল, মনামী, উনি আজ আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন? তুমি ওনাকে বলোনি আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। মিস্টার নীলাভ আপনি তো জানেনই আমরা প্রি হানিমুন সেরে এসেছি…সৌভিককে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মনামী বলল, আরে সৌভিক, ইনি ফ্রড কেউ। নীলাভ বলে কেউ নেই। এনার কিছু বদ মতলব আছে। বিলিভ মি।
সৌভিক হেসে বলল, জানি তো আছে। কারণ ও আমার স্কুলফ্রেন্ড। আর তোমার আশাআন্টির খুব কাছের মানুষ। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে প্ল্যান করেই তোমার আশাআন্টি অমন একটা দুর্ধর্ষ প্ল্যান বানিয়েছিল নিশ্চয়ই। সেইজন্যই বোধহয় রাজীব আমায় ট্রেনে ওঠার আগেই তোমার ছবি পাঠিয়ে বলেছিল, মেয়েটা একা যাচ্ছে, একটু খেয়াল রাখিস, আমার পরিচিত। অবশ্য তোমার আশাআন্টি আর রাজীবের গোটা প্ল্যানটা আমি জানতাম না তখন। সেটা তোমাদের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম আজকে। মনামী লজ্জা পেয়ে রাজীবের দিকে একটা ছোট্ট নমস্কার ছুঁড়ে দিয়েই পালাল।
সৌভিক নিজের ঘরে ঢুকে দেখল, বিছানায় একটা সরি লেটার। আর জানালার ধারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে ওর সদ্য বিবাহিতা বউ, যার গায়ে নতুন শাড়ির গন্ধ। পুলিশের ইউনিফর্ম আর লাল শাড়ি, দুটোতেই মনামী বেস্ট। সৌভিক কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, বললে না তো নীলাভ বেশি ভালো ছিল, নাকি সৌভিক?
লজ্জায় সৌভিকের বুকে মুখটা গুঁজে মনামী বলল, তুমি। সৌভিক মনামীর মাথায় হাত রেখে বলল, আজ থেকে তোমার সব থেকে কাছের বন্ধু হবার অঙ্গীকার করলাম। হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে। তোমার চোখের লেপ্টে যাওয়া কাজলের দায়িত্ব আমার, তোমার অভিমানী মুখের দায়িত্ব আমার, তোমার কুঁচি সামলাতে না পারা শাড়ির দায়িত্বও আমার। ডিউটির জন্য রাত করে বাড়ি ফেরা অফিসারের দায়িত্বও আমার। বন্ধুত্বটা সারাজীবন বজায় রাখার দায়িত্বও আমি নিলাম। তুমি শুধু তোমার মতো থেক, পাল্টে যেও না।
মনামী বলল, ফ্রেন্ড ফর এভার।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন