অর্পিতা সরকার
কি গো বউমা কোনো ব্যবস্থা করতে পারলে?
নন্দিনী কান থেকে ফোন নামিয়ে বলল, এখনও পারিনি মা। ওর ফোনটা তো আমার কাছেই আছে, ভাবছি ওর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটা পোস্ট দেব। যতই হোক ও একজন নামী কবি। ভক্তের সংখ্যা তো নেহাত কম নেই। তারা নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা করবে। আমিও আমার কলিগদের বলছি। অক্সিজেন লেভেলটা যে কখন এমন নেমে গেলো বুঝতে পারলাম না। গতকালও ৯৫ ছিল।
নন্দিনী পায়চারি করছে।
দীপালি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, টেমপারেচার কিন্তু তেমন নেই বউমা।
নন্দিনী সতর্কভাবে বলল, মা প্লিজ আপনি ডিস্ট্যান্স মেইনটেইন করুন। সম্ভবত অব্যয়ের এখন কোভিড পজেটিভ। আমি অক্সিজেনের ব্যবস্থা করি আগে। যদি নার্সিং হোমেতে একটা বেড ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় তো….
অব্যয় রায়চৌধুরী। বয়স পঁয়ত্রিশ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও এত কম বয়সেই সে নিজের একটা অন্য পরিচয় তৈরি করে নিয়েছে।
অব্যয় রায়চৌধুরী নামটা এই মুহূর্তে বেশ পরিচিত ও বহুউচ্চারিত নাম। নামী-দামী পত্রিকা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অব্যয়ের কবিতা পড়েনি এমন মানুষ কমই আছে। বিশেষ করে কলেজস্টুডেন্টরা তো পাগল অব্যয়ের কবিতার জন্য। ওর কবিতার লাইন অনেকেরই হোয়াটসআপের স্ট্যাটাস রূপে ব্যবহৃত হয়। সুপুরুষ অব্যয় এই গ্ল্যামারটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।
বউমা, বৃষ্টিটা জোরে নামল তো! এখন কী হবে? এই পরিস্থিতিতে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়াও তো মুস্কিলের।
নন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলল, মা প্লিজ প্যানিক করবেন না। আমি তো ট্রাই করছি।
নন্দিনী একটার পর একটা ফোন করে যাচ্ছিল পরিচিতদের। সকলের একই কথা, এই মুহূর্তে বেড পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
বাধ্য হয়ে অব্যয়ের অ্যাকাউন্ট থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট করে দিল নন্দিনী।
কবি অব্যয় রায়চৌধুরী হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অক্সিজেন ও বেডের বিশেষ প্রয়োজন।
লক্ষাধিক মানুষ লিখতে শুরু করল, গেট অয়েল সুন স্যার।
অনেকেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ফোন নম্বর দিল। সব জায়গায় ফোন করে ক্লান্ত হয়ে গেল নন্দিনী একই কথা শুনতে শুনতে….বেড নেই।
অব্যয়ের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। নন্দিনীর পাগল পাগল লাগছিল।
একটার পর একটা ফোন আসছে…কোনটাতেই সুবিধে হচ্ছে না।
বেলটা বাজছে দেখে ছুটে গিয়ে দরজা খুলল নন্দিনী।
পিপিই পরে দাঁড়িয়ে আছে একটা বেঁটে মতো লোক।
উত্তেজিত গলায় বলল, নবু কোথায়? ওকে এখুনি নিয়ে যেতে হবে নন্দিনী।
নন্দিনীর সমস্ত মানসিক শক্তি তখন তলানিতে ঠেকেছে। প্রনিং করিয়ে অব্যয়ের শ্বাসকষ্টটা একটু কমেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু সেটা আর কতক্ষণের জন্যই!
লোকটি তৎপর হয়ে বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না। তাড়াতাড়ি চলো। বাইরে অ্যাম্বুলেন্স আছে।
অব্যয়কে নিয়ে গিয়ে তোলা হল অ্যাম্বুলেন্সে।
অক্সিজেন স্টার্ট করা হতেই একটু যেন রিলিফ পেল অব্যয়। নন্দিনী ঘামছিল। চিন্তায়-ভাবনায় দিশেহারা ও। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে।
অব্যয়কে ”আপনজন” নামের একটি নার্সিং হোমে এডমিট করা হল। অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারই সব ব্যবস্থা করে দিল। নন্দিনী শুধু যন্ত্রচালিতের মতো পেমেন্ট করছিল বিভিন্ন জায়গায়।
নন্দিনী মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না? আপনি যেভাবে আমাদের উপকার করলেন..
ভদ্রলোক বললেন, আমি নবুর ছোটবেলার বন্ধু। ফেসবুকে ওকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। ও অ্যাকসেপ্ট করেনি। আমি ওর ফলোয়ার হয়েই রয়ে গেছি। পোস্টটা দেখেই ছুটেছি। এই নার্সিংহোমের অ্যাম্বুলেন্স চালাই। তাই বলে কয়ে একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি।
নন্দিনী হাত জোর করে নমস্কারের ভঙ্গিমা করতেই নিজের চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা অস্পষ্ট মুখ।
বছরদুয়েক আগের কথা। একটা রবিবারে বাড়িতে সাহিত্য আসর বসার কথা ছিল। অব্যয়ের লেখা একটা কবিতা পাঠ করবে নন্দিনী এমনই ঠিক ছিল। নন্দিনীর খোঁপায় সেদিন ছিল একগুচ্ছ জুঁইয়ের মালা। অব্যয়ের কবিতার বই ”ডাকটিকিট” পুরস্কার পাওয়ার পরই বেশ কিছু কবি ও লেখক বন্ধুর আবদারে সেদিনের সাহিত্যবাসর।
নন্দিনী নিজেও স্কুল টিচার। বাড়িতে এই একটা দিনই থাকার সুযোগ পায়। তাই ভোর থেকেই গোছগাছ শুরু করেছিল ও। ড্রয়িংরুমেই সকলের বসার আয়োজন করেছিল। ফুলদানিতে টাটকা রজনীগন্ধা। কাচের পাত্রে জলের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল গোলাপের পাপড়ি।
বাঙালির আইকন রবি ঠাকুরের ছবিতে উঠেছিল একটা মোটা মালা। সামনের ধূপদানিতে দুটো ধূপ।
অব্যয় হাঁকডাক শুরু করেছিল, কোন পাঞ্জাবিটা পরবে খুঁজে পাচ্ছিল না বলেই ডেকে চলেছে নন্দিনীকে।
নন্দিনী তখন নামী রেস্তোরাঁয় দামি খাবার অর্ডার করতে ব্যস্ত অতিথিদের জন্য।
ঠিক তখনই বেলটা বেজে উঠেছিল। চমকে উঠেছিল নন্দিনী! সাহিত্যসভা শুরু হবার কথা ছিল সন্ধে ছটায়। এখন মাত্র পাঁচটা পনেরো বাজে। কবি-সাহিত্যিকরা একটু দেরি করেই আসেন বলে শুনেছে নন্দিনী। তাহলে এখন আবার কে এল?
নিজের শাড়িটা গুছিয়ে নিয়ে দরজা খুলতেই একটা অপরিচিত লোক একমুখ হেসে বলল, নবু আছে?
নবু অব্যয়ের ডাক নাম।
লোকটি যে সাহিত্য জগতের কেউ নয় সেটা ওর পোশাক-আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। লোকটির ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা বড্ড বোকা বোকা।
নন্দিনী ভিতরে বসার আহ্বান না করেই বলল, দাঁড়ান আমি ডেকে দিচ্ছি অব্যয়কে।
অব্যয়কে ডাকতে হল না। পিছন ফিরতেই নন্দিনী দেখল অব্যয় বিরক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রুর মাঝে বিরক্তি আর অবজ্ঞার মেলবন্ধন।
নন্দিনী ইশারায় জিজ্ঞেস করল, কে?
নন্দিনীকে কোনো উত্তর না দিয়েই অব্যয় বলল, তুই এখানে? বাড়ি চিনলি কী করে?
লোকটি বিগলিত গলায় বলল, আরে আমাদের রমেশ বলল, তুই এ পাড়ায় বাড়ি কিনেছিস। বলল, কবি অব্যয় রায়চৌধুরীর বাড়ি বললেই দেখিয়ে দেবে।
এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম একটা কাজে। ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা করে যাই। আমাদের সেই নবু এখন নাকি বড় কবি। তোর মনে আছে নবু আমরা বৃষ্টির দিনে কাদা মেখে ফুটবল খেলতাম। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে তাই আমাদের ভারী মজা হত।
অব্যয়ের গলায় স্পষ্ট অস্বস্তি। ফোন করতে পারতিস তন্ময়, একেবারে না জানিয়ে বাড়িতে চলে এলি?
তন্ময় আড়চোখে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বউ? আর কাকিমা কোথায় রে?
অব্যয় বলল, হ্যাঁ নন্দিনী। আমার স্ত্রী। ও স্কুল শিক্ষিকা। আর মা এখন বোনের বাড়িতে গেছে।
তন্ময় বলল, চল বসে একটু গল্প করি, কতযুগ পরে তোকে দেখলাম।
ফুড ডেলিভারি এল সেই সময়ে। নন্দিনী ব্যস্ত হয়ে পড়ল সব রান্নাঘরে রাখতে।
অব্যয় বলল, আজ হবে না রে। আজ আমার কিছু কবি, সাহিত্যিক বন্ধু আসবে। এখুনি হয়তো এসে পড়বে। পরে বরং একদিন…
তন্ময় ঘাড় নেড়ে বলল, ওহ অসময়ে এসে পড়েছি। আমিও তো তোর বন্ধু, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টটা নিবি না আমার?
নন্দিনী ডাকল, অব্যয় প্লিজ হেল্প মি।
অব্যয় বলল, হ্যাঁ নেব।
তন্ময়ের মুখের সামনেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল অব্যয়।
নন্দিনী সেদিন বলেছিল, ভাগ্যিস একটু আগে এসেছিল। গেস্টরা এসে গেলে তাদের সামনে অপ্রস্তুত হতে হত। অব্যয় এরা তোমার বন্ধু?
প্লিজ নিজের স্ট্যান্ডার্ডটা একটু মেইনটেইন করো। এখন আর তুমি আর পাঁচজনের মতো সাধারণ নও বুঝলে!
সেদিন সাহিত্যবাসরে নন্দিনী অব্যয়ের লেখা একটা কবিতা বলে সকলের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছিল….
‘তুই আমার দুঃখের সঙ্গী হবি…
নিশীথ রাতের কান্নার নোনতা জল হবি?
তুই আমার ছোটবেলার ঝালমুড়ির ভাগিদার হবি?
তুই আমার ব্যর্থতার নীলচে কষ্ট হবি?
তুই আমার হেরে যাওয়ার সঙ্গী হবি?
তুই আমার স্কুল পালানো বন্ধু হবি?’
অব্যয় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। নন্দিনী ওকে বলেনি তন্ময়ের কথা। তন্ময়ের ওইদিন ঈশ্বরের মতো এগিয়ে আসার কথা ইচ্ছে করেই বলেনি। এই সময় ডিপ্রেশন হওয়া স্বাভাবিক। হয়তো পুরোনো ব্যবহার মনে করে খারাপ লাগা তৈরি হবে অব্যয়ের, তাই…
অব্যয়ের সাহিত্য মহলের সকলেই ওর তাড়াতাড়ি সুস্থতা কামনা করেছেন। অনেকেই অব্যয়ের কবিতার লাইন আর ওর ছবি দিয়ে পোস্ট করেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অব্যয়ের কলিগরা ফোনে খোঁজ নিয়েছে প্রত্যেকে। অব্যয় এখন অনেকটাই সুস্থ।
দুপুরে একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল নন্দিনীর।
ড্রয়িংরুমে জোরে জোরে হাসির আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে পড়ল।
হাউসকোটটা গায়ে গলিয়ে পায়ে পায়ে বেরিয়ে গিয়ে দেখল, অব্যয় হাসছে। হো হো করে হাসছে। এমন হাসতে নন্দিনী তো কোনোদিন দেখেনি অব্যয়কে। বরাবরই বড্ড মার্জিত কথা, আর সংক্ষেপে হাসতেই দেখেছে ওকে।
হাসতে হাসতেই বলল, আর আমাদের সেই প্রাইমারি স্কুলের ছোট গেটটার ধারে যে আমগাছটা ছিল ওটার আম বোধহয় কোনোদিন বাড়ির মালিক খেতে পারেনি আমাদের অত্যাচারে।
তন্ময় বলল, আমরা তো কুশি থেকে শুরু করতাম, পাকার সুযোগ পেতো কোথায় রে?
নন্দিনী ট্রে করে চা আর স্ন্যাকস টেবিলে নামিয়ে দিয়ে বলল, আপনার বন্ধু যে এত হাসতে পারে জানতাম না তো?
অব্যয় হেসে বলল, সেদিন অসুস্থ অবস্থায় তন্ময়ের ওই চিন্তাকাতর গলাটা চিনতে আমার ভুল হয়নি নন্দিনী। তাই ভাবলাম, এখন তো সুস্থ আছি… ওকে ডেকে একটু আড্ডা দেওয়া যাক।
তন্ময় একটা প্যাকেট নন্দিনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এতে ওর পছন্দের ফল আছে, ওকে দিও।
নন্দিনী দেখল, জামরুল উঁকি দিচ্ছে ভিতর থেকে। পাঁচ বছর সংসার করেও নন্দিনীর জানা হয়নি অব্যয়ের প্রিয় ফল কি!
সব সময় ভালো কোয়ালিটির ফলই কিনে এনেছে নন্দিনী, কিন্তু জানা হয়নি অব্যয় ঠিক কোনটা খেতে ভালোবাসে।
তন্ময় চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, সে তুই এখন বড় কবি হয়েছিস…বড় চাকরি করিস…কিন্তু বাতাবী লেবু আর জামরুল তোর অপছন্দের হয়ে গেছে এটা আমি মানব না। কম চুরি করে খেয়েছি খোকন কাকার বাগান থেকে?
অব্যয় বলল, তুই আমার স্কুল পালানোর সঙ্গী হবি?
তুই আমার বাতাবি ফুলের গন্ধ হবি?
মুখোশবিহীন একলা দুপুরের একাকীত্বের ভাগ নিবি?
তন্ময় একটু বোকা বোকা হাসল। ওর হাসিতে যেন বাউল গানের সরল সুর। অব্যয়ের মনটা নিমেষে ছুটে গেল সেই স্কুলবেলাতে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন