ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

আমার বয়েস বছর ছাব্বিশ। আমার নাম অঙ্কুশ অধিকারী। আমি খোদ কলকাতার কসবার ছেলে। বুঝতেই পারছেন, দক্ষিণ কলকাতার ছেলের পক্ষে মফসসলে এসে থাকাটা কতটা কষ্টকর। কিন্তু সরকারি চাকরি তো আর অবহেলা করতে পারি না। তিনবছরের চেষ্টায় আমি বি.ডি.ও. অফিসে চাকরি পেয়েছি। সে চাকরি আমি হেলায় হারিয়ে ফেলব এমন বোকা তো আমি নই। তাই বাধ্য হয়েই চলো বাবা অঙ্কুশ, পড়ে থাক তোমার গোলপার্কের আড্ডা, পড়ে থাক ঢাকুরিয়া ব্রিজের সন্ধে নামা।

মনটা খারাপ হল জিমটার জন্য। আসলে শরীরচর্চাটা আমার একটা নেশা। সন্ধেতে ডাম্বেল না ভাঁজলে রাতে ঠিক ঘুম আসে না।

মায়ের চোখে সেই আনন্দ আর নেই। মানে আমি চাকরি পাওয়ার পরে যে আনন্দটা পাচ্ছিল বাবা-মা সেটা আর নেই। আমার পোস্টিং ব্রাহ্মণভিটা শুনেই বলল, অত দূরে? সে তো দিনাজপুর! আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম হ্যাঁ, আমার ভাড়া বাড়িটা শুনলাম ইছামতীর খুব কাছে।

আমিই ওখানের অফিসারকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম একটা ভাড়া বাড়ি আর সঙ্গে একজন রাঁধুনি টাইপো কাউকে ব্যবস্থা করে রাখতে। বেশি দিন নয়, বছর খানেক পরেই আমি ট্রান্সফারের সুযোগ পাবো, তখন কলকাতার কাছেই কোথাও নেবার চেষ্টা করব। আমার রাশভারী বাবা চোখের কোণের চিকচিকে বস্তুটাকে দমন করে মাকে বলেছিল, ছেলে বড় হচ্ছে সরলা, ওকে এবারে ছাড়তে শেখো। সামনেই শীত পড়ছে, তুমি বরং শীতের পোশাক গুছিয়ে দাও।

যাইহোক, মেলোড্রামাটিক পরিবেশে আমারও মনটা হু হু করে উঠেছিল, কসবার নিজেদের বাড়ি আর দক্ষিণ কলকাতার জন্য। JPBS মানে আমাদের যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলটার জন্যও আচমকা মন খারাপ করে উঠেছিল। যাইহোক অবশেষে আমি এসে পৌঁছলাম ব্রাহ্মণভিটায়। পাশেই ইছামতী বয়ে চলেছে। এটাকে বাড়িটা না বলে, সরকারি ছোট কোয়ার্টার বলেই শ্রেয়। এসেই বছর সতেরোর ছেলেটার সঙ্গে আলাপ হল। বরাবরই আমি নিজের কাজ নিজে করে নেওয়া পছন্দ করি। কিন্তু এই অপরিচিত জায়গায় এসে ওই ছেলেটিকে পেয়ে বেশ ভালোই লাগছিল। ছেলেটি হেসে বলল, দাদা, আমার নাম টনি। আপনিও তো দেখছি আমার মতই কম বয়সে সরকারি চাকরি পেয়ে গেছেন। আমি একটু ভড়কে গিয়েই বললাম, তুইও সরকারি চাকরি করিস নাকি? সে ছেলে নিজের রং করা চুলে আঙুল বুলিয়ে বলল, তবে! টনির মাস মাইনে বাঁধা ছয় হাজার। এখানে রান্না করে চলে যাব সোজা অফিসে। অফিসে সারাদিন চা করা থেকে শুরু করে অফিস পরিষ্কার করা সব এই টনির দায়িত্ব। আমি হেসে বললাম, তা বেশ। কম বয়সে সরকারি চাকরি পেয়ে গেছিস, আর চিন্তা নেই। এবারে বিয়ে করে ফেল। টনি লাজুক হেসে বলল, এক বছর বয়েস কম আছে আমার। আঠারো হলেই করব। প্রাণখোলা সরল ছেলেটার সঙ্গে গল্প করতে করতেই ওর বানানো পরোটা আর তরকারি খেয়ে দারুণ খিদেকে বশ করলাম।

আগামীকাল অফিস জয়েন করব। আজকে জায়গাটা ভালো করে ঘুরে দেখতে হবে বিকেলের দিকে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখল টনি। ছেলেটা বেশ কাজের। তবে দোষ একটাই বড্ড সিনেমার নেশা। সিনেমার গল্প শোনাতে শুরু করলে লাস্ট সিন অবধি শুনিয়েই ছাড়বে। এটুকু বাদ দিলে ছেলেটা খাঁটি হিরে। রোদে ফেললেই সারল্যের ছটায় ঝকঝক করে উঠবে।

বাবা-মাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি আমার পৌঁছানো খবর।

ব্যাগ থেকে সব জিনিস বের করতে করতে টনি বলল, এগুলো ডাম্বেল তাই না? তুমি ব্যায়াম করো? তাই তোমার বডি সলমন খানের মতো। আমি আবার আরেকটা ”তেরে নাম”-এ ঢুকে যাবে ভেবেই বললাম, এখানে ঘোরার জায়গা কী কী আছে?

টনি আঙুল গুনে বলতে লাগল। তার মধ্যে আমি থমকে গেলাম ব্রাহ্মণভিটা আসলে কবরস্থান শুনে।

কবরস্থান তো সাধারণত মুসলিম, ইহুদী আর খ্রিস্টানদের হয়। তার নাম ব্রাহ্মণভিটা কেন? আর একটা কবরস্থানের নামে এই জায়গাটার নামকরণ হয়েছে? ভাবনাগুলো জোট পাকিয়ে যাচ্ছিল দেখেই টনিকে বললাম, হ্যাঁ রে, এর নাম ব্রাহ্মণভিটা কেন? টনি মাথা চুলকে বলল, আমার জন্মের অনেক আগে এর নাম দেওয়া হয়েছে তো, তাই আমি ঠিক জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করে এসে বলব।

আমি হেসে জানালার ধারে দাঁড়ালাম। আমার দোতলার জানালা থেকে ইছামতীর বয়ে যাওয়া দেখা যাচ্ছে। পাশেই বাঁধ দিয়ে জলোচ্ছ্বাসকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বোধহয় বর্ষাকালের জন্যই ওই বাঁধ। কারণ শীতের শুরুতে জলের তেমন উচ্ছ্বাস নেই।

ঝুপ করে সন্ধে নামে এখানে। কুয়াশা নিজের ঘরে বেশ যত্ন করেই পর্দা টাঙিয়ে দিল বিকেল শেষ না হতে হতেই। তিলোত্তমার মতো রাত আটটা মানে সন্ধে এমন নয়। এখানে বিকেল পাঁচটাতেই কাজ সেরে ঘরে ফেরার তাড়া।

রাস্তায় বেরিয়ে ইছামতীর দিকে কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল, বিশাল পাঁচিলওয়ালা একটা বড় চত্বর। পাঁচিলটা উচ্চতায় এতটাই বেশি যে ভিতরে কী আছে সেটা দেখার অবকাশ রাখেনি। বাধ্য হয়েই সেই পাঁচিলের শেষ কোথায় দেখব বলে ইছামতীকে ডানহাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।

প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পরে একটা জংধরা গেট পড়ল। তার সামনে একজন মধ্যবয়স্ক লোক একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। হাতে একটা লাঠি। লোকটা মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার পায়ের আওয়াজে মাথাটা ওপরে করে তাকাল। আমি সামনে দাঁড়াতেই বলল, কার্ড দিন। আমি বললাম, আমি অঙ্কুশ অধিকারী। বি.ডি.ও. অফিসের নতুন এমপ্লয়ি। এটা কি? মানে এই এত বড় জায়গা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কেন?

লোকটি বিরক্ত মুখে বলল, আবার ওই অফিসের সরকারের চামচাগুলো এসেছে? এটা কী? জানেন না এটা কী? এটা হল ব্রাহ্মণভিটা কবরস্থান।

লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, সারি সারি সমাধি। পাশে ফুল গাছ, বাহারি গাছও রয়েছে কিছু।

আমি বললাম, একবার ভিতরে ঢুকতে পারি? লোকটি বলল, না পারেন না। কার্ড ছাড়া ঢোকা মানা আছে। লোকটার দৃষ্টিটা আমার সুবিধার লাগছিল না। তাই সন্ধে নামার আগেই ওই নিঝুম জায়গা থেকে চলে আসছিলাম। একজন মধ্যবয়সি মহিলা দেখলাম, একগুচ্ছ ফুল নিয়ে ব্রাহ্মণভিটাতে ঢুকতে যাচ্ছে। নিজের ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে বলল, এই যে নূরুলদা কার্ড নাও। নূরুল নামধারী ব্যক্তিটি বলল, তোমায় তো চিনি, তোমার কার্ড লাগবে না। অপরিচিতদের প্রাণ থাকতে এর ভিতরে ঢুকতে দেব না আমি। কথাটা আমাকে লক্ষ্য করেই বলল নূরুল।

আমি পায়ে পায়ে চলে এলাম ঘরে। টনি আমায় চা করে দিয়ে বলল, রাতের রান্না করে রেখেছি। আমি বাড়ি যাব। আজ একটা পুরোনো সিনেমা দিয়েছে ভাইজানের, দেখতে হবে বুঝলে দাদা।

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ঠিক আছে যা।

এই শোন, ওই ব্রাহ্মণভিটা সমাধিক্ষেত্রটাতে ঢুকতে দেয় না কেন রে?

আমার দৃষ্টি বেশ প্রখর। খাবারে চুল পড়লে আমি ঠিক দেখতে পাই। মায়ের ছুঁচে আমিই সুতো পরিয়ে দিতাম। আমি স্পষ্ট দেখলাম, টনির উজ্জ্বল মুখটা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল। কোনোমতে বলল, কার্ড দেখলেই ঢুকতে দেয়। পালাতে পারলে বাঁচে এমন ভাবেই পালাল সে।

রাতে বেশ ভালোই ঘুম হল। মফসসলের নিস্তব্ধতা বাতাসে। তিলোত্তমার কোলাহল নেই। তাই নতুন জায়গা হলেও ঘুমে তেমন ব্যাঘাত ঘটল না।

আমার বরাবরের অভ্যেস ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। যথারীতি ভোরে উঠে আমি ট্র্যাকসুট পরে ছুটতে বেরোলাম। ভেবেই নিলাম নূরুলের সম্মুখীন হব না আমি। কিন্তু অদ্ভুত এক সম্মোহনের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে গেলাম সমাধিস্থলের জংধরা গেটে। নূরুল স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। লোকটা কি সারারাত ওই চেয়ারেই বসে থাকে নাকি? কী পাহারা দেয় ও এই কবরস্থানের? এ তো আর মিশরের মমি নয়, যে এখানে মণিমুক্ত থাকবে। এ কবরস্থান নেহাতই আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বাড়ির মৃতদেহ কবর দেওয়ার জায়গা। মৃতদেহের সঙ্গে বড়জোর রবীন্দ্ররচনাবলী অথবা সঞ্চিতা আসবে। কিংবা তার হাতের আংটি বা নাকের নাকছাবিটা। সেটার জন্য মাটি খুঁড়তে আসবে কে? তার জন্য সিমেন্টিং করা সমাধিস্থলকে চব্বিশঘণ্টা পাহারা দেবার ঠিক কি অর্থ খুঁজে পেলাম না আমি।

দিনের আলোয় দেখতে পেলাম, দু-মানুষ সমান উঁচু পাঁচিলটা জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে। অসংখ্য গাছ জন্মেছে পাঁচিলের গায়ে। জরাজীর্ণ অবস্থা পাঁচিলের। মনে হচ্ছে যেন এখুনি ভেঙে পড়বে।

লোহার বড় গেট ছাড়াও পিছনের দিকে ইছামতীর একেবারে কোলে আরেকটা ছোট গেট আছে। সেখানে দিয়ে চোখ লাগিয়ে দেখলাম, সারি সারি সমাধি। ভিতরটা পরিষ্কার ঝকঝকে। একটা গাছের পাতাও পড়ে নেই সেখানে। কেউ যেন দিনরাত নিজের প্রিয়তম ঘরটির মতো পরিষ্কার করে চলেছে এই স্থানকে।

আমি আর দেরি না করে ছুটতে ছুটতে চলে এলাম। নূরুলের চোখ বাঁচিয়ে ফিরে এলাম ঠিকই, কিন্তু নূরুল মানুষটা আমাকে বড্ড টানছিল।

ঘরে ঢোকার আগেই ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। মা ফোন করছে। কি রে অঙ্কুশ, ঘুম হল বাবা! মায়ের গলাটা শুনে মনখারাপটা যেন চেপে বসতে চাইল এই নির্জন জায়গায়।

তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ মা। একরাউণ্ড ঘুরেও এলাম। লোকবসতি এদিকটাতে একটু কম। নদীর ধারেই আমার ভাড়া বাড়ি। নিরিবিলি বেশ। আর টনি তো ওস্তাদ ছেলে। হাতের রান্নাও বেশ ভালো।

টনির প্রশংসা শেষ করার আগেই বিস্কিট আর চা নিয়ে হাজির হল ও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা টনি, ওই ব্রাহ্মণভিটার সমাধিস্থলটা সব সময় পাহারা দিচ্ছে কেন একজন? ওখানে কি কোনো মূল্যবান জিনিস আছে?

টনি থমকে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওধারে একদম যাবেন না দাদা। তেনারা ঘুমিয়ে আছেন ওই কবরে। তেনাদের ঘুম ভাঙালেই বিপদ। আজ অবধি সন্ধে ছটার পরে ওই রাস্তায় কেউ হাঁটেনি। যারাই বেশি সাহস দেখাতে গেছে তারাই কোনো না কোনো বিপদে পড়েছে। ওই তো দু-মাস আগে আমাদের পাড়ার লাল্টু রাত্রিবেলা ওই রাস্তা দিয়ে শর্টকাট করতে গিয়েছিল। আমতলীর বাজার থেকে ফিরছিল। সঙ্গে এক ব্যাগ সবজি, মাংস সব ছিল। ঠিক ওই পাঁচিলের পাশ দিয়ে আসার সময় নাকি ওর মাথায় সজোরে একটা ইট পড়েছিল। মাথাটা ফেটে গিয়েছিল। তিনটে সেলাই দিতে হয়েছিল। এসব কারণেই ও ধারে কেউ যায় না। একমাত্র যাদের কার্ড আছে তারা ভিতরে ঢুকে নিজের মানুষকে ফুল দিয়ে আসে দিনের আলো থাকতে থাকতেই।

প্রথম জয়েনিং ডেট ছিল আমার। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। এসব নিয়ে পড়ে ভাববো ভেবেই আর প্রশ্ন করিনি টনিকে।

অফিসে গিয়েই জয়ন্ত রায়ের সঙ্গে দেখা করলাম। ভদ্রলোক সদা হাস্যমুখে থাকেন। বেশ দিলদরিয়া পাবলিক। এই জন্যই এ অঞ্চলের যে-কোনো মানুষ এক বাক্যে প্রশংসা করেন স্যারের। ব্লক ডেভলপমেন্ট অফিসার হিসাবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন ইনি। আমায় দেখেই হাত মিলিয়ে বললেন, আরে এ তো মেঘ না চাইতেই জল। চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে জিম করা শরীর। শোনো অঙ্কুশ, শুধু মাথার বুদ্ধি নয়, গায়ের জোরও দরকার এসব কাজে। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, স্যার জমি জরিপ করার কাজে গায়ের জোর কেন দরকার? ভদ্রলোক দু-কাপ কড়া করে চা বলে, হাসতে হাসতে বললেন, আচ্ছা আমি তোমায় তুমিই বলি। এমন হাঁটুর বয়েসি ছেলেকে আপনি বলতে বড্ড অস্বস্তি হয়। আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, নিশ্চিন্তে।

বছর পঁয়তাল্লিশের জয়ন্তদা বললেন, ধরো, তুমি দাঁড়িয়ে থেকে দু-পক্ষের বিবাদের সমাধান করে দিলে তারপর এক পক্ষের তোমার বিচার পছন্দ হল না। তখন সে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে। সে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য এমন চেহারাই দরকার। আমি একটু ভয় পেয়ে বললাম, এ কেমন আবদার স্যার? আমি নেহাতই ছাপোষা বাঙালি। তাই অফিসে বসে কলম পিষব বলেই আমার শহর ছেড়ে এখানে এসে পৌঁছলাম। এসব মারপিট করতে হবে তো আগে আমায় জানানো হয়নি।

জয়ন্ত স্যার দরাজ হেসে বললেন, সবই কি আর জানানো হয় ভাই? যখন বিয়ে করবে তখন একটা মিষ্টি মেয়ে দেখে বিয়ে করবে। রাগ, মেজাজ এসব যে ফ্রিতে আনবে তার সঙ্গে… সেসব কি আর তোমায় বলা হয়? নাকি বিয়ের দু-দিন পর থেকেই তোমার আলমারিতে তুমি উদ্বাস্তু হয়ে যাবে সে কথাও বলা হয়? অমন দু-চারটে সিক্রেট থাকে বুঝলে।

যাইহোক কাজের কথাটাতে আসি।

তোমার বাড়ির খুব কাছে ব্রাহ্মণভিটা কবরস্থান, দেখেছ তো?

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, দেখেছি। সেটা নিয়ে আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। জয়ন্ত স্যার বললেন, বেশ তোমার প্রশ্নগুলোর আগে উত্তর দিয়ে নিই, তারপর কাজের কথাতে আসব।

আমি বললাম, প্রথমত কবরস্থান বা সমাধিস্থল তো খ্রিস্টান, মুসলমান আর ইহুদিদের হয়, সেখানে হিন্দুদের ”ব্রাহ্মণ” কথাটা কেন এসেছে? মানে এমন নামকরণ কেন?

জয়ন্ত স্যার দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, টনি কিছু বলবি? আমি ঘুরে দেখলাম টনি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। টনি বলল, চায়ে মিষ্টি ঠিক আছে?

আমার ওর দৃষ্টিটা স্বাভাবিক লাগল না। চা দিয়ে চলে গেছে টেবিলে মিনিট পাঁচেক আগে, এখন জানতে চাইছে মিষ্টি ঠিক আছে? কেমন যেন রহস্যজনক ওর উপস্থিতি। স্যার ঘাড় নেড়ে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস হয়েছে চা। তুই এখন যা, পরে দরকার হলে ডেকে নেব। টনি চলে যেতেই আমি উঠে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। এই কবরস্থান নিয়ে টনিকে যতবার প্রশ্ন করা হয়েছে ততবার ও অদ্ভুতভাবে এড়িয়ে গেছে।

স্যার বললেন, সবটাই শোনা কথা। কারণ আজ থেকে হয়তো আশি-নব্বই বছর আগের কাহিনি। লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে আজও জীবিত আছে। শোনা যায় এ অঞ্চলের টোলের পণ্ডিত ছিলেন বিদ্যারতন চট্টোপাধায়। টোলের সংলগ্ন এলাকা জুড়ে ছিল তার বাড়ি এবং জমি। বাইরে থেকেও ছাত্ররা আসত তার কাছে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে। গুরুগৃহে বসবাস করত তারা। বিদ্যারতন ছিলেন খাঁটি ব্রাহ্মণ। গলায় পৈতে, পরণে গরদের ধুতি, পায়ে খড়ম। সকালে সূর্য প্রণাম…জোয়ারের সময়েও ইছামতীতে নেমে আহ্নিক করা তার নিত্যকর্তব্য ছিল। বিবাহ করেননি। সংসার বলতে ছাত্ররা। স্বপাক খাবার খেতেন দিনে দুবার।

যদি তার ব্রাহ্মণ ধর্মের ক্ষতি হয় তাই সে অন্য কারোর হাতে জলগ্রহণ অবধি করতেন না।

এমন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের যখন বয়েস প্রায় নব্বই, তখন তিনি আবিষ্কার করলেন তার সব থেকে প্রিয় ছাত্র তাকে মিথ্যে বলে শিক্ষার্জন করেছে। তিনি ব্রাহ্মণ ছাড়া কোনো ছাত্রকে শিক্ষা দিতেন না। গলায় পৈতে দেখে তবেই তাকে গুরুগৃহে থাকার অনুমতি দিতেন।

নব্বই বছর বয়সে তাঁর শরীর ভাঙল। রান্না করা বা বাকি কাজ করতে অসমর্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁর প্রিয় ছাত্র ঈশ্বরের ডাক পড়ে। গুরুর সেবায় সে নিয়োজিত হয়। বিদ্যারতন আচমকা ওই বৃদ্ধ বয়সে আবিষ্কার করলেন, তাঁর প্রিয় ছাত্রের নাম ঈশ্বর নয়, রহমান। সে পাক্কা মুসলমান।

তখন উনি মৃত্যুর দিন গুনছেন। বছরখানেক রহমানই ওনাকে দেখাশোনা করেছে।

বিদ্যারতন চমক উঠেছিলেন। তার ওপরে প্রথমে রাগও করেছিলেন, শেষে রহমানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ওনার ব্রাহ্মণত্ব ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ধর্ম খুইয়েছেন উনি মুসলমানের সেবা গ্রহণ করে। তাই মৃত্যুর পরে যেন ওনাকে চুল্লিতে না দাহ করে কবরস্থ করা হয়। ওনার বাড়ির মধ্যেই। রহমানের আরবির বদলে সংস্কৃত শেখার নেশা ছিল। তাই সে নিজের পরিবার থেকেও বিতাড়িত হয়েছিল। গুরুর মরদেহকে সে নিজের দায়িত্বে গুরুগৃহের মধ্যেই সমাধিস্থ করে। এবং উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয় গোটা জায়গাটা। পুরো জায়গাটা কবরস্থান বলে ঘোষণাও করে। সেই থেকেই ওই সমাধিস্থলের নাম ব্রাহ্মণভিটা।

আমি হাঁ করে শুনছিলাম জয়ন্তবাবুর বলা কথাগুলো। লোকমুখে অমর হয়ে গেছে ব্রাহ্মণভিটার ঘটনা। আমি বললাম, স্যার তাহলে ভিতরে ওই পণ্ডিতের বাড়িটাও আছে? স্যার ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ আছে। তবে ভেঙে গেছে। সরকার বিশেষ চেষ্টা করছে পুরো জায়গাটা সংরক্ষণ করতে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে ওই নূরুলকে নিয়ে। সে কোনো সরকারি লোককে ঘেঁষতে দেবে না। অবশ্য দোষই বা কি দেব নূরুলের। আজ বছর সাতেক ধরে যতবার সরকারি লোক ওই কবরস্থানের সারাইয়ের কাজ করতে গেছে ততবার তাদের কোনো না কোনো বিপদ হয়েছে। কারোর হাত ভেঙেছে পা পিছলে, কারোর মাথায় ঢিল পড়েছে। দেখো অঙ্কুশ, এসব অশরীরী বা আত্মায় আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু আর কেউ বিশ্বাস করবে না এমন তো নয়। বিশেষ করে মফস্বলে। তাই ওই ব্রাহ্মণভিটার পাঁচিল ভেঙে গেছে, সরকারি টাকা এসে পড়ে আছে সংস্কারের জন্য তবুও হয়ে উঠছে না।

আমি বললাম, কিন্তু ওখানে পাহারাদার কেন? মানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তো নেই ভিতরে, তাই না?

জয়ন্ত স্যার বললেন, না তা নেই। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয় তো আছে। সমাধিস্থল যাতে কেউ নোংরা, অপরিষ্কার করে না দেয় তাই পঞ্চায়েত থেকেই একজন সিকিউরিটি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কেউ রাজি হয়নি এ চত্বরের। তখন নূরুল বলেছিল, আমি পড়ে থাকব স্যার ওই কবর আগলে। সেই থেকেই ও ব্রাহ্মণভিটার গার্ড। কার্ডের ব্যবস্থা ওই করিয়েছে পঞ্চায়েতে বলে বলে। যাদের বাড়ির লোককে ওখানে কবর দেওয়া হচ্ছে একমাত্র তাদের বাড়ির মেম্বাররাই পঞ্চায়েতের দেওয়া গ্রিন কার্ড নিয়ে ওখানে ঢুকতে পারবে। যে কেউ এসে ব্রাহ্মণভিটাতে ঢুকতে পারে না। গত সাত বছর ধরে এই নিয়ম চলছে। ভিতরে নাকি অনেক ফুল গাছও লাগিয়েছে নূরুল। লোকটার সাহস আছে বটে। মধ্যরাতে ওই সমাধিস্থলে বসে থাকে।

জয়ন্ত স্যার বললেন, তবে একটা কথা শোনা যায়, নূরুলের নাকি একটিই মেয়ে ছিল, সে মারা যাবার পরে ওইখানেই কবর দিয়েছে তাকে। তাই দিনরাত পাহারা দেয় বোধহয়। সংসার ছিল বা আছে কিনা কেউ বলতে পারে না। আসলে নূরুল একেবারেই কথা বলে না।

আমি বেশ কিছুক্ষণ সবটা মন দিয়ে শোনার পরে বললাম, কিন্তু আমার এখানে কাজটা কী সেটা তো বললেন না স্যার?

জয়ন্তস্যার পেপারওয়েটটা টেবিলে এক চক্কর ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ইন্সপেকশনের কাজ। তুমি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নির্দেশ দেবে, লেবাররা কাজ করবে ব্যস। আমি একটুও না ভেবে বললাম, তার মানে ওই ব্রাহ্মণভিটা সংস্করণের কাজটার দায়িত্ব আমার ওপরে, তাই তো?

জয়ন্তস্যার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ব্রিলিয়ান্ট। না তোমার বুদ্ধির ধার আছে কিন্তু।

আমি করুণ চোখে তাকিয়ে বললাম, সদ্য নিজের শহর ছেড়ে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এসে পড়লাম, প্রথমেই এমন দুঃসাহসিক কাজ পড়ল আমার ভাগ্যে? তবে স্যার, আমি চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে ভালোবাসি। তাই এটাতে আমি রাজি। জয়ন্ত স্যার বললেন, কাল থেকেই তাহলে শুরু করে দাও। কৃষানু তোমায় এ ব্যাপারে সাহায্য করবে। ওর লেবার সাপ্লায়ারের সঙ্গেও ভালো পরিচয় আছে। আমি বললাম, কিন্তু স্যার, একটা লিখিত কাগজ না হলে নূরুল তো আমাকে ঢুকতেই দেবে না। তখন আমি কী করব? জয়ন্তস্যার কাউকে একটা ডাকলেন। দেখে মনে হল, ছেলেটা এই অফিসের পিয়োন। তাকেই আমার ব্রাহ্মণভিটায় ঢোকার পারমিশন লেটারের ব্যবস্থা করে দিতে বললেন।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম, আজ দুপুরেই আমি চত্বরটা একবার ঘুরে দেখব। এ অঞ্চলের প্রশাসনও নাকি ব্রাহ্মণভিটার ইস্যু নিয়ে একটা কথাও বলে না। বার পাঁচেক কাজ করতে গিয়ে ফিরে এসেছে লেবার এবং সরকারি কর্মচারীরা, তারপরেও প্রশাসনের হেলদোল নেই। এদিকে ওই পাঁচিল ভেঙে একজনের মৃত্যু ঘটলে তখন পুরো দোষ পড়বে আমাদের মতো সরকারি কর্মচারীদের।

আমি অফিসের খাতাপত্র একটু বুঝে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ব্রাহ্মণভিটাকে ঘুরে দেখতে। সরকারি পারমিশন লেটার আমার এখন হাতে।

আমি ব্রাহ্মণভিটার গেটে দাঁড়াতেই নূরুল প্রায় তেড়ে এল। আপাত শান্ত নির্বিবাদী মুখের আড়ালে যে এমন একটা মানুষ লুকিয়ে আছে আমার ধারণার বাইরে। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, ভিতরে ঢুকবেন? ওখানেই চিরশান্তিতে ঘুমাবেন নাকি? কী আছে ভিতরে? কেন চাইছেন ওদের ঘুম ভাঙাতে?

হিসহিসে গলাটা শুনে আমার কেমন একটা ভয় ভয় লাগল। কোনো সরকারি কাগজ আপনাকে এই পাঁচিলের মেরামত করতে দেবে না। ভাগুন এখান থেকে। নূরুল নিজের মোটা লাঠিটা উঁচিয়ে ইশারায় বলতে চাইল, ভাগুন না হলে এটা মাথায় মেরে ঘুম পারিয়ে দেব।

নূরুল যত নিষেধ করছিল আমার জেদ তত বাড়ছিল। শুধুমাত্র মৃত মেয়ের সমাধি ভিতরে আছে বলে নূরুল এমন করছে এটা ভাবতে আমার একটু কষ্ট হচ্ছিল। আমি শহরে বড় হওয়া ছেলে, ভূত, আত্মায় তেমন বিশ্বাসী নই। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল, ভিতরে নূরুল কোনো সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছে। খোঁড়াখুঁড়িতে যদি বেরিয়ে যায় তাই এমন প্রচেষ্টা। আমার মা বলে জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যারা বিবাদ করে তাদের মতো বোকা আর দুনিয়ায় নেই। নূরুলকে এখানে পুলিশরাও সমঝে চলে। আমি তো সদ্য পা দিয়েছি এখানে। তাই আমি ভেবে দেখলাম, সামনাসামনি বিরোধিতায় না গিয়ে দিন কয়েক পর্যবেক্ষণ করলে কেমন হয়?

তাই আমি শান্ত গলায় বললাম, পাঁচিলের অবস্থা খুব খারাপ। এটাকে রিপিয়ার করা দরকার। আপনি যদি এই সমাধিস্থলকে ভালোবাসেন তাহলে নিশ্চয়ই এর উন্নতি চাইবেন। আপনি কেন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন প্রতিবার?

নূরুল আগুন চোখে তাকিয়ে বলল, ওরা ঘুমাচ্ছে, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, খবরদার ওদের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করবেন না। যান ফিরে যান। ওই পাঁচিলের আড়ালে ওরা বেশ আছে। রিপিয়ার করতে গিয়ে পাঁচিল ভাঙলেই ওরা বেআব্রু হবে। তখন শেয়ালকুকুরে ছিঁড়ে খাবে। যান বাড়ি যান।

শেষের বাড়ি যানটা রীতিমতো হুমকির গলায়।

আমি এক পা দু পা করে পিছতে শুরু করলাম, সঙ্গে বাড়ল আমার আরও জেদ।

আমিও দক্ষিণ কলকাতায় বড় হওয়া ছেলে। জীবনযুদ্ধ আমিও কম দেখিনি। সন্ধের অফিস ফেরত বাসে ওঠাটাও যে আমাদের কাছে রীতিমতো যুদ্ধের সেটা ক-জন বোঝে! নূরুলের অমন হুমকিতে দমে যাবার পাত্র আমি নই।

বিকেলবেলা বাড়িতে ফিরে এসেই দেখলাম, টনি বেশ গরম গরম লুচি আর আলুরদম বানিয়েছে। দেখেই চনমনে ক্ষিদেটা আরেকটু জাঁকিয়ে বসল।

লুচি খেতে খেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা টনি, ওই ব্রাহ্মণভিটার কেয়ারটেকারের কি সাইকোলজিক্যাল কোনো প্রবলেম আছে? টনি আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম, মাথার গন্ডগোল আছে ওনার?

টনি এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বললো, আছে মানে আলবাত আছে। এ অঞ্চলের সকলেই জানে নূরুলের মাথার একটা তার কাটা আছে। তাই তো কেউ ওকে ঘাঁটায় না। আর তাছাড়া দাদা, যে যাই বলুক, আমি নিজে ওই ব্রাহ্মণভিটাতে অপদেবতাদের দেখেছি। তাই সূর্য ডুবল তো আমি আর ওধারে যাই না। শুধু আমি কেন এ চত্বরের কেউই যায় না।

আমি বললাম, অপদেবতারা সকলকে ধরে আর তার সামনে দিন রাত বসে থাকা নূরুলকে ধরে না? এ কেমন কথা?

টনি একটু ভেবে বলল, হয়তো ও ওদের শান্তির জন্য পাহারা দেয় বলেই ওকে রেহাই দিয়েছে। দাদা আর লুচি দেব?

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, না না আর নয়।

টনি বিশেষ করে সাবধান করে দিয়ে গেল, ওদিকে যেন না যাই। পাঁচিল সারানো ছাড়াও এ অঞ্চলে কাজের অভাব নেই। আমি যেন সেসব দেখাশোনা করি।

আমি ইছামতীর তীরে এসেছি আজ প্রায় সাতদিন হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী জায়গাটা নিরিবিলি হলেও আমার মন বসে গেছে। বন্ধুরা ভেবেছিল, সাতদিন কেন আমি সাতঘণ্টা পরেই কলকাতা ফেরার ট্রেন ধরব। সেই আমি তিলোত্তমা ছেড়ে সাতদিন এখানে ইছামতীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বেশ মজে আছি। টনির হাতের খাবার খেয়ে বেশ বিন্দাস আছি। কাজের চাপ তেমন নেই বললেই চলে। সকালের দিকটা গ্রামের মানুষদের কিছু অভিযোগ লিখেই চলল এ ক-দিন। কিন্তু জয়ন্তস্যারের একটা কথা মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছিল, অঙ্কুশ, লড়াইয়ের ময়দান থেকে পালিয়ে এসে সন্ধি করে জেতাটাও জেতা আবার সম্মুখ যুদ্ধটাও জয়। এবারে তুমি বলবে কোন জয়ের মুকুটটা পরতে তোমার বেশি গর্ব হবে!

ওই কথাটাই অনবরত আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ব্রাহ্মণভিটার নিস্তব্ধ পরিবেশের মধ্যে। আর নূরুলের ঠান্ডা চোখের চাউনিটা যেন বলে দিচ্ছে, এখানে অনেক রহস্য আছে। ভাবতে ভাবতেই খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলাম আমি।

চোখে পড়ল একটা খবর। এরকম অবশ্য হামেশাই হচ্ছে। তবুও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল অন্য কারণে। একটা পোড়ো মন্দিরের পিছনে জুয়ার আড্ডা চলত দীর্ঘদিন ধরে। সন্ধের দিকে লোকজন কেউ যেত না, কারণ ওখানে লোকে ভূতুড়ে কাণ্ডকলাপ দেখেছে। তাই জায়গাটাকে অপদেবতাদের জায়গা বলে চিহ্নিত করেছিল গ্রামের লোকজন। আর তার সুযোগ নিয়ে চলত জুয়ার আড্ডা। সঙ্গে কিছু বেআইনি জিনিসের কারবার। ওই মন্দিরের পিছন থেকেই উদ্ধার করেছে পুলিশ বেশ কিছু ড্রাগসের বাক্স।

আমার মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছিল, এই জন্যই কবরস্থানের চত্বরে কোনো সরকারি কর্মচারীকে দেখলেই নূরুল অস্বাভাবিক ব্যবহার করে? সন্ধের পরে কেউ আর যায় না সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে। এই আতংক সম্ভবত নূরুল তৈরি করেছে। কিন্তু কেন? নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো বড় চক্র আছে। যারা লোকচক্ষুর আড়ালে ওই পবিত্র স্থানে চালাচ্ছে তাদের বেআইনি কাজ কারবার।

রাতে দেশি মুরগির ঝোল আর ভাত খেয়ে নিলাম নটার মধ্যে। কলকাতায় থাকলে কখনো কখনো এই সময় আরেক রাউন্ড কফি খেতাম আমি, বাবা আর মা। ডিনার করতে করতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে যেত। আজ অবশ্য আমার বেশি তাড়াতাড়ি ডিনার করে নেবার উদ্দেশ্য অন্য।

বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে জোরালো চার্জার টর্চটা নিয়ে গায়ে পুলওভারটা চাপিয়ে নিলাম। কলকাতার ঠান্ডায় তো জিন্সের ফুলস্লিভস জ্যাকেট পরলেই চলে, কিন্তু এখানে বেশ ঠান্ডা রয়েছে। নদীর ধারে বলেই হয়তো অথবা কংক্রিটের জঙ্গল নয় বলেই হয়তো। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকল যেন।

খুব সাবধানে পা ফেলে এগোলাম কবরস্থানের দিকে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদটা গোল থালার মতো হয়ে আমার চার্জার টর্চকে ব্যঙ্গ করছে অনবরত। আমিও টর্চ বন্ধ করে দিলাম। চাঁদের আলোয় ইছামতীর রূপ আরও খুলেছে। ঠিক যেন সোনালি আঁচল উড়িয়ে ছুটছে কোনো যুবতী। লোকে বলে তাজমহলের ওপরে পূর্ণিমার আলো পড়লে নাকি সে মহিময়ী রমণীর রূপ ধারণ করে। আমার মনে হল, এই মুহূর্তে ইছামতীর রূপও কোনো অংশে কম নয়। নেহাত সিনেমার এক্সট্রা আর্টিস্টদের তেমন কদর নেই বলেই পূর্ণিমার রাতে ”ইছামতীর রূপ” বলে কোনো বই বেরোয়নি। লোকে তাজকে নিয়েই মেতে আছে। আমি ইছামতীর নরম তরঙ্গ দেখতে দেখতেই হাঁটছিলাম। একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎই খেয়াল করলাম আমি ব্রাহ্মণভিটার গেটের থেকে মাত্র দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি। পূর্ণিমার আলো পড়ে পিছলে যাচ্ছে পাঁচিলের ধারের লম্বা লম্বা গাছের পাতাগুলো।

গেটের সামনে কেউ একজন খুব যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে নূরুলকে। আমি পাঁচিলের আড়াল থেকে দেখছিলাম ওই দৃশ্য।

একটা ফোল্ডিং খাট পেতে বিছানা করে দিল। নূরুল শুয়ে পড়ল।। আমার ঠিক পাশ দিয়ে জোরে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল আমার খুব পরিচিত সব সময়ের সঙ্গী টনি। টনি আমায় দেখেনি, কিন্তু আমি ওকে দেখলাম। খুব কাছ থেকে দেখলাম। কে হয় টনি নূরুলের? কি সম্পর্ক ওদের দুজনের মধ্যে। টনি কেনই বা অকারণে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল? কেন কিছুতেই চাইছিল না আমি এদিকে রাতে আসি!

টনিও কি তার মানে যুক্ত এই চক্রান্তের সঙ্গে?

আমার মাথায় আরও জেদ চেপে গেল। এদের গোপন চক্রান্ত ধরার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল। আমিও ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরিটি, শার্লক হোমস পড়া ছেলে। এত সহজে আমি ছেড়ে দেব না। তবে একা যাওয়াটা ঠিক হবে কিনা সেটাই ভাবছিলাম। ভিতরে যারা আছে তারা হয়তো আর্মস নিয়ে আছে, আমি একা যদি যাই তাহলে তো বিপদে পড়ে যাব।

এদিক ওদিক তাকিয়ে আমি একটা গাছের ডাল ভেঙে নিলাম। পিছনের গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওখানের ভাঙা অংশ দিয়ে তাকালাম ব্রাহ্মণভিটার ভিতরে। সারিসারি সমাধিবেদি। ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে মানুষ ঘুমাচ্ছে ওর মধ্যে নিশ্চিন্তে। পাশে পাশে সুন্দর ফুলের গাছ। কিছু গাছে ফুল ফুটে আছে। অনেকের সমাধিবেদির ওপরে প্রিয়জনদের দেওয়া ফুল ছড়ানো আছে। আমি একাগ্র মনে লক্ষ্য করছি ভিতরটা।

আচমকাই দেখলাম, ওই ভাঙা অংশ দিয়ে দুটো চোখ সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চমকে উঠলাম আমি। একটা কালো বেড়াল ঝপ করে লাফ দিলো কবরস্থানের ভিতরে। যত সাহসীই হই আমি, পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে আমার। বেড়ালটা আবার লাফ দিল পাঁচিলের অন্য প্রান্ত দিয়ে। মিউ মিউ করে ডাকটা যেন নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।

আমি সাহসে ভর করেই টর্চটা জ্বালালাম আমার দিকে নিবন্ধ চোখ দুটোতে।

টর্চের আলো পড়তেই বুঝতে পারলাম একটা মেয়ে। সাদা চুড়িদার পরনে, অবিন্যস্ত চুল। চোখের দৃষ্টিও একটু অপ্রকৃতস্থের মত। মেয়েটা আমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ওকে ভয় খাব কি ওই আমায় ভয় খাচ্ছে!

আমি ফিসফিস করে বললাম, তোমার নাম কী?

মেয়েটা বোবার মতো গুঙিয়ে বলল, লাভলী। গলার স্বর শুনে মনে হল বহুদিন কারোর সঙ্গে কথা বলেনি। লাভলীর সঙ্গে দ্বিতীয় কথা বলার আগেই নূরুলের গলার স্বর শোনা গেল। তোকে বলেছি না, বাইরে বেরোবি না, এখন সরকারি লোকজন ঘুরছে চারদিকে। এই কবরস্থান নতুন করে ভাঙা গড়া হবে বলে। যা চুপ করে ঘরে ঢুকে গান শোন।

মেয়েটা সাদা ওড়নায় মুখ ঢেকে চলে গেল।

আমি পাঁচিলের গা ঘেঁষে আসার সময় ভিতর থেকে গান বাজার আওয়াজ পেলাম। ভিতর থেকে একটা ঢিল এসে পড়ল আমার ঠিক সামনে। আরেকটুর জন্য আমার মাথাটা বেঁচে গেল। তবে আমি বুঝতে পারলাম, ঢিলটা কেউ আমায় লক্ষ্য করে ছোঁড়েনি। কারণ আরও কয়েকটা এলোপাথাড়ি ঢিল এসে পড়ল পাঁচিলের ভিতর থেকে। নিস্তব্ধ রাস্তায় কেউ হয়তো আমার পায়ের আওয়াজ পেয়েছে, তাই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে দিল কয়েকটা। আমি পা চালিয়ে চলে এলাম ঘরে।

বাকি রাতটুকু এপাশ ওপাশ ফিরেই কেটে গেল। ঘুম বিশেষ হল না। লাভলী নামের মেয়েটার করুণ দৃষ্টিটা ভাসছিল চোখের সামনে। বয়েস কতই বা হবে মেয়েটার? একুশ-বাইশ বছর। টানা টানা চোখে যেন ইছামতীর ভরা বর্ষার ভয়।

কপালে পড়া অবিন্যস্ত চুলে ইচ্ছাকৃত অযত্ন প্রবল।

কে মেয়েটা? ওখানে কী করছে?

তবে কি নূরুল ওকে আটকে রেখেছে ভিতরে? তার মানে কি জুয়ার থেকেও বড় কোনো নোংরামি চলে ওখানে? মেয়েটাকে দিয়ে কি বিজনেস করায় ওরা? সেই জন্যই দিনরাত পাহারা দেওয়া থাকে?

আমার কাছে ভৌতিক বিষয়টা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে গেল। ওই মেয়েটাকে হয়তো রাতের অন্ধকারে দেখেছে লোকজন, আর নূরুলের ছোঁড়া ঢিলে ভয় পেয়েছে। ভিতরে গান বাজতে দেখে আর কেউ যায়নি ওই পথে।

আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আগামীকাল দিনের বেলা জয়ন্ত স্যারকে বলে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে ঢুকব ব্রাহ্মণভিটাতে। দেখি নূরুলের নোংরামি ধরতে পারি কিনা! ওখানে একজন মেয়েকে আটকে রেখে যে বদমাইসি ও করছে সেটা জানানো দরকার এলাকার লোকজনদের। আর টনি কেন ওকে সাহায্য করছে সেটাও জানতে হবে।

জয়ন্ত স্যার সবটা শুনে বললেন, সন্দেহ আমারও যে একেবারে হয়নি তা নয়। তবে নূরুলের ওই অগ্নিমূর্তিকে ভয় পেত সবাই। আর তাছাড়া কখনো কোনো খারাপ কাজের গন্ধ পায়নি পুলিশ বলেই রেড করা হয়নি। তুমি ঠিক দেখেছ তো অঙ্কুশ? ওই মেয়েটা জীবিত তো?

আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন জয়ন্ত স্যারকে!

আমি ধীর গলায় দৃঢ়ভাবে বললাম, আপনারা হেল্প না করলে আমি একাই যাব।

আমার জেদ দেখেই হয়তো জয়ন্তস্যার ফোন করলেন ওসিকে। সব শুনে ওসি বললেন, দুজন কনস্টেবলকে পাঠাচ্ছি আপনাদের সুরক্ষার জন্য। আর কোনো দায়িত্ব নিতে পারব না। কারণ ব্রাহ্মণভিটাতে কোনো বাজে কিছুর আখড়া আছে বলে খবর নেই আমাদের কাছে। তাই রেড আমরা করতে পারব না।

আমি জয়ন্ত স্যারের দ্বিধান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম, স্যার প্লিজ। একটু বিশ্বাস করুন আমায়। নূরুল একটা অ্যান্টিসোশ্যাল। তাই ওকে ধরাটা একজন নাগরিক হিসেবে আমার কর্তব্য।

দুজন পুলিশ কনস্টেবল নিয়ে আমরা যখন পৌঁছালাম তখন দেখলাম, টনি উত্তেজিত হয়ে নূরুলকে কিছু বলছে। আমাকে সামনে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। নূরুলের মুখটা আর আগের মতো হিংস্র লাগছে না। বরং একটু যেন ভয় পেয়েছেই মনে হল। আমি বললাম, ভিতরে যে মেয়েটাকে আটকে রেখেছেন, কে ও?

গেট খুলুন আমরা ঢুকব ভিতরে। নূরুল মৃদু চেষ্টা করল আটকানোর। একজন কনস্টেবল বলল, আমরা শুধু একবার ঘুরে দেখব। কিছুতে হাত দেব না।

আমরা চারজন ভিতরে ঢুকে গেলাম। সারি সারি সমাধিক্ষেত্র। পাশে বেল, জুঁই, টগর, রজনিগন্ধার গাছ। কিছু সমাধি শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা। ভিতরটা বাইরের পাঁচিলের মতো জরাজীর্ণ নয়। পরিপাটি করে কেউ যেন গুছিয়ে রেখেছে নিজের সংসারের উঠোনটুকুকে।

আমি বললাম, স্যার ওই যে ওই কুয়োর পাড়ে যে পোড়ো ঘরটা আছে ওখানেই আছে মেয়েটা। দক্ষিণ কোণে একটা টিনের চালওয়ালা ঘর রয়েছে। নূরুল পিছন থেকে বলল, যাবেন না স্যার। ওখানে আত্মা থাকে। কোনো মেয়ে নয়, সাক্ষাৎ প্রেতাত্মা।

আমি জেদ নিয়ে এগিয়ে যেতে স্যারও এলেন। ঘরে মৃদু নীলচে আলো জ্বলছে। ভ্যাপসা একটা গন্ধ। একটি মেয়ে মাটিতে বসে খাতার ওপরে ছবি আঁকছে মন দিয়ে। বিশাল একটা জঙ্গল, একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তিনজন ছেলে মেয়েটাকে ঘিরে রয়েছে। মেয়েটার পালানোর রাস্তা নেই। জয়ন্ত স্যার ফিসফিস করে বললেন, এই মেয়েটাকেই দেখেছিলে অঙ্কুশ? আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার।

মেয়েটা কী অদ্ভুত সুন্দর আঁকে, আমি সেটাই দেখছিলাম। আচমকা আমাদের ওর ঘরের সামনে দেখে চোখ কুঁচকে তাকাল মেয়েটা। তারপর আর্ত চিৎকার করে উঠল…..বাবা….

নূরুলের বুকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মেয়েটা। আমাদের দিকে হাত তুলে কিছু বলতে চাইল যেন। নূরুল কাঁদছে, ওর চোখে জল। টনি ধীর গলায় বলল, আমার দিদি। হ্যাঁ, এ চত্বরের লোকজন জানে নূরুলের মেয়েটা মারা গিয়েছিল। আসলে আমি যখন বেশ ছোট তখন দিদি একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কতগুলো ছেলে মিলে দিদিকে রেপ করেছিল। দিদি তাদের দুজনকে চিনতেও পেরেছিল। দিদি থানায় যেতে চেয়েছিল, কিন্তু বাবা দেখেছিল সেই ছেলেগুলো বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পেলেই দিদিকে মেরে দেবে। তাই আজ সাত বছর ধরে দিদিকে ওই ঘরে লুকিয়ে রেখেছে বাবা। লোককে বলেছে, মারা গেছে কবর দেওয়া আছে। মা মাঝে মাঝে ফুল হাতে এসে দেখেও যায়। লোকে জিজ্ঞেস করেছিল মাকে, মেয়ে মরল কী করে? মা বলেছিল, জলে ডুবে। সেই থেকেই বাবা মানসিক রোগী হয়ে গেছে। খায় না, ঘুমায় না, বাড়ি যায় না। আমি এসে খেতে দিয়ে যাই দুজনকেই। বাবাকে এখান থেকে নড়ানো যায় না। আমি অনেকবার বুঝিয়েছি বাবাকে, শোনেনি বাবা। কারোর সঙ্গে কথা বলে না বাবা। দিদি যাতে খুন না হয়ে যায় সেই জন্য এইখানে দিদিকে আটকে রাখতে রাখতে দিদিটাও কথা বলতে ভুলে গেছে। আতঙ্কে থাকে দিনরাত।

আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম একটা অসহায় বাবাকে। অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থা কি এরকমই? ভিকটিমকে লুকিয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সাত বছর, মৃত মানুষদের সমাধির মধ্যে! বুকের মধ্যে অচেনা যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার লাভলীর দিকে তাকিয়ে। নিষ্পাপ একটা মুখ, চোখে আতঙ্কের মাখামাখি। নূরুল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ওকে ছেড়ে দিন স্যার। আমায় অ্যারেস্ট করুন, ও কিছু করেনি।

আমি বললাম, টনি, তোমার বাবাকে একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে, তোমার দিদিকেও। টনি বলল, সে তো অনেক খরচ। আমি বললাম, প্রথম মাসের স্যালারিতে আমি এটাই করব। লাভলী আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, দাদা।

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, হ্যাঁ দাদা।

নূরুল বারবার একই কথা বলছিল, মানুষরা ওকে মেরে ফেলবে, দেখতে পেলেই মেরে দেবে।

আমি স্পষ্ট দেখলাম, নূরুলের হিংস্র চোখ দুটোতে রাগের বদলে ভয় আর ঘৃণা মিশে যাচ্ছে।

আমি বললাম, কেউ মারবে না ওকে। ওকে দিয়ে কেস করাব আমি, অপরাধীরা ধরা পড়বে। আপনারা স্বাভাবিক জীবন পাবেন। নূরুল বিজবিজ করে বলল, মেরে ফেলবে। আমি টনিকে বললাম, ডাক্তারটা দেখাও, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাবে।

লাভলী হঠাৎ খাতা নিয়ে পেন্সিল দিয়ে খচ খচ করে কিছু একটা আঁকতে শুরু করল।

কনস্টেবল দুটো চলে গেল। জয়ন্ত স্যার অফিসে ফোন করে কিছু বলছিল। টনি নূরুলকে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করছিল।

লাভলী ড্রয়িং খাতার একটা পাতা নিয়ে এসে আমার হাতে দিল। তাকিয়ে দেখলাম, পেনসিল স্কেচে নিখুঁত আমি। নীচে লেখা- ”ভালো দাদা”..

লাভলীর চোখের কৃতজ্ঞতা। ওই অন্ধকার পরিবেশ থেকে ওকে আমি উদ্ধার করেছি, তাই মেয়েটা আমাকে পুরস্কৃত করছে ওর আঁকা ছবি দিয়ে।

ইছামতীর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, আচমকাই এই মৃত মানুষদের সমাধিস্থলে এসে তৈরি হয়ে গেল একটা সম্পর্ক। আমি হয়ে গেলাম ওর ভালো দাদা।

জীবন আর ইছামতীর মধ্যে বড্ড মিল, কেউই থমকে দাঁড়ায় না, বয়ে চলে নিজের গতিতে।

ব্রাহ্মণভিটা আর অভিশপ্ত নয়, চিরশান্তি বিরাজ করছে এখানে। টনি লাভলী আর নূরুলকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। আমি ফিরে এলাম বাড়িতে, সদা বহতা ইছামতীর পাড় ধরে।

সকল অধ্যায়

১. সুখের আড়ালে – অর্পিতা সরকার
২. সেদিন ভোরে – অর্পিতা সরকার
৩. নাম বিভ্রাট – অর্পিতা সরকার
৪. রেড স্কুটি এবং.. – অর্পিতা সরকার
৫. অগোছালো সংসার – অর্পিতা সরকার
৬. ভালোবাসার রামধনু – অর্পিতা সরকার
৭. ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার
৮. অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার
৯. বিজয়িনী – অর্পিতা সরকার
১০. অবহেলা দ্য কিটু সাকসেস – অর্পিতা সরকার
১১. মনের ডুবুরি – অর্পিতা সরকার
১২. ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার
১৩. লোকে পাগল বলে ডাকে – অর্পিতা সরকার
১৪. নিলামে উঠেছি আমি – অর্পিতা সরকার
১৫. হঠাৎ বৃষ্টি – অর্পিতা সরকার
১৬. রুমমেট – অর্পিতা সরকার
১৭. এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার
১৮. দ্য মিস্ট্রি অফ ফ্রেন্ডশিপ – অর্পিতা সরকার
১৯. যদি কখনো অজান্তে – অর্পিতা সরকার
২০. আট নম্বর রুম – অর্পিতা সরকার
২১. ফর এভার – অর্পিতা সরকার
২২. নিশ্চুপ পিয়ানো – অর্পিতা সরকার
২৩. চলো বন্ধু হই – অর্পিতা সরকার
২৪. সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার
২৫. বাবা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন