অর্পিতা সরকার
শাড়িটা ঠিক করে পরো মৌরি। ওরা তোমায় দেখতে আসছেন, তোমার ক্লিভেজ নয়। বাবার দিকে অপলক তাকাল মৌরি। মানুষটার কোনো পরিবর্তন হল না। না, পুলিশে কাজ করলেই তার মুখের এমন ভাষা হবে এটা নয়। ওর বান্ধবী তনয়ার বাবাও পুলিশে আছে। এত ভদ্র ব্যবহার কাকুর যে মনে হয় কত আপন। মৌরি যতবার তনয়াদের বাড়িতে যেত ততবার কাকু কি মিষ্টি করে বলত, খেয়ে যাবি পাগলি। তোর কাকিমা সকাল থেকে গন্ধ ছুটিয়েছে রান্নাঘরে। মৌরির বাবার মতো দিনরাত স্ল্যাং ইউজ তো পাড়ার মাতাল পঞ্চুও করে না। মৌরির বাবা মহেশ দত্ত মানুষটা যেন কি অদ্ভুত রকমের! যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ চিৎকার, অসভ্যতামি করে যায় মায়ের সঙ্গে। সব সময় যেন একটা আক্রোশ মৌরি আর ওর মায়ের ওপরে।
সেই কোন স্কুল লাইফ থেকে ও দেখেছে মা বড্ড ভয় পায় বাবাকে। নিজে একজন শিক্ষিত মহিলা হয়েও বরাবর মৌরিকে বলে এসেছে, বাবা যতক্ষণ বাড়িতে আছে ততক্ষণ একটু চুপ করে থাকিস মা। সেই ছোটবেলা থেকে বাবা নামক লোকটার ওপরে একটা তীব্র ঘৃণার পরত জমতে জমতে কেমন যেন কঠিন হয়ে গেছে।
মৌরি এখন জানে, বাবা নামক মানুষটা অত্যন্ত স্বার্থপর আর স্বেচ্ছাচারী। ছোট মৌরি বুঝতে শিখেছিল, বাবা বাড়িতে থাকাকালীন চেঁচাতে নেই, খেলতে নেই। একরাশ আতঙ্ক বুকের মধ্যে চেপে রেখেই বড় হচ্ছিল মৌরি।
কি হলো শুনতে পেলে না তুমি? শাড়িটা ঠিক করে পরো! মায়ের মতো চরিত্রহীন তৈরি হয়েছো। যেমনি শুনলে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে অমনি শাড়ির আঁচল খসিয়ে রেডি।
মৌরি এসব কথায় অভ্যস্ত। যে মা কোনোদিন বাড়ির বাইরের চৌকাঠ ডিঙাল না, তার নাকি চরিত্রের দোষ! মৌরি নির্বিকার হয়ে শাড়ির পিন আটকে নিল। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতেই ভাবছিল, মৌরির যদি বিয়ে হয়ে যায় তাহলে মা এবাড়িতে একা থাকবে…
এখন তো তবুও মৌরির সঙ্গে দুটো কথা বলে মনের ভার হালকা করে।
মা সকাল থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত। পাত্রপক্ষের জন্য রান্না করে চলেছে। বাবার এত আগ্রহের কারণটা ঠিক কি সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে মৌরি। বাবা হঠাৎ মৌরির ভালোর জন্য সুপাত্রের বন্দোবস্ত করেছে এটা মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে মৌরির।
বাবা নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পাও চলে না।
ভালো করে সেজে নাও, মনে রেখো এই পাত্র যদি তোমায় পছন্দ না করে তাহলে কিন্তু তোমার বিপদ আছে। তাই যেমন করে সাজগোজ করে এত দিন ছেলে পটাতে বেরোতে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে তেমন করেই সাজগোজ করে নাও।
মৌরির এসব কথা কানে ঢুকছে না। ও শুধু ভেবে চলেছে এর পিছনে নিশ্চয়ই মহেশ দত্তের কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে। কী সেটা! পুরুষ মানুষ দেখলেই কেমন একটা ভয় হয় মৌরির। বিজবিজে অস্বস্তিটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু মনে হয় এই ছেলেটা ওর বাবার মতো নয় তো!
বাবারও নাকি কর্মক্ষেত্রে খুব নামডাক। পাড়াতেও লোকজন জানে মহেশ দত্ত পরোপকারী লোক। মুখোশের আড়ালের মহেশ দত্তকে একমাত্র মৌরি আর ওর মা চেনে।
মা ঘেমে নেয়ে ঢুকল মৌরির ঘরে। কি রে রেডি হয়েছিস? আমি কিছু হেল্প করব?
বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিও সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে বসে পড়। মা, মেয়ে দুজনকেই বলছি ইন্দ্রনীল গুপ্তের ছেলের মৌরিকে পছন্দ হওয়া চাই।
বলেই ধপধপ পা ফেলে মৌরির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বাবা।
মৌরি কৌতূহলী হয়ে বলল, মা তুমি জানো ঠিক কেন বাবা আচমকা এই পাত্রের সন্ধান নিয়ে এল?
মা নির্লিপ্ত গলায় বলল, তোর বাবার বস এই ইন্দ্রনীল গুপ্ত। সম্ভবত এস পি হয়ে এসেছেন। তোর বাবা ওনার আন্ডারে আছে। নিজের প্রমোশন বা অন্য কোনো সুবিধার কথা ভেবেই নাকি….
তাছাড়া শুনলাম নাকি ইন্দ্রনীল গুপ্ত নিজেই তোর বাবার কাছে তার ছেলের বিয়ে দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এ সুযোগ যে তোর বাবা হাতছাড়া করবে না এটা তো জানা কথাই। মৌরি আতঙ্কিত হয়ে বলল, মা আবার সেই পুলিশের পরিবার!
ধুর বোকা তনয়ার বাবার কথা মনে নেই?
সেই যে তুই আর আমি ফুলনগর থেকে ফেরার সময় গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সেখানে একজন পুলিশ আমাদের কতটা হেল্প করেছিল তোর মনে আছে মৌ? এসব ভাবিস না। বরং এটা ভাব যে এই জেলখানা থেকে তোর মুক্তি হবে। বাইরে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল….
আমি যাই
মা চলে যেতে মৌরি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। স্কুল কলেজে সকলের কাছে তাদের কিশোরী বেলার গল্প শুনেছে মৌরি। ঠিক যেন রূপকথা। তাদের বাবারা কত ভালোবাসে। ঠিক যেন রাজকন্যা। এতগুলো বছর এই মানুষটার সঙ্গে এক ছাদের নীচে থাকতে থাকতে ইদানীং কেমন যেন মনে হয়….মনে হয় মৃত্যু বড্ড কাঙ্ক্ষিত। মৃত্যু বড় মুক্তির।
মৌরির ইচ্ছে ছিল, সায়েন্স নিয়ে পড়ার। মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্টও করেছিল মৌরি। বাবার ইচ্ছেতেই আর্টস নিতে হয়েছিল। মৌরির ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু বাবার ইচ্ছেতেই ইংরাজি নিয়ে মেয়েদের কলেজে পড়তে হয়েছে। আসলে মহেশ দত্ত মেয়েদের স্বাধীনতায় মোটেই বিশ্বাসী নয়। তার মতে মেয়েরা ঘর সামলাবে, বাধ্য থাকবে। এত উচ্ছৃঙ্খলতা নাকি মেয়েদের মানায় না!
মৌরির ইচ্ছে ছিল মাস্টার্স কমপ্লিট করে আরও হায়ার স্টাডি করবে। কিন্তু মহেশ দত্ত বলে দিয়েছে, মাস্টার্স হয়ে গেছে, অনেক দূর অবধি পড়তে দিয়েছেন তিনি। আর নয়। এবারে বিয়ে করে সংসার করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশ যে মৌরিকে মেনে নিতে হবে সেটা ও জানে।
মৌরির এই রুক্ষ জীবনেও প্রেম এসেছিল। কিন্তু মহেশ দত্তের কথা ভেবেই মৌরি সে বসন্ত বাতাসের দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছিল নির্মমভাবে। ও জানতো মহেশ দত্তর মেয়ে প্রেম করতে পারে না।
বাবা এসে হন্তদন্ত হয়ে বলল, শিগগির এস।
ভদ্রভাবে কথা বলবে ওনাদের সঙ্গে। উনি কে জানো? সুপারিন্টেন্ডেন্ট অফ পুলিশ।
অগ্নিপরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে মৌরি। ওকে যদি পাত্রপক্ষের পছন্দ না হয় তাহলে ওরা চলে যাবার পর থেকেই চলবে মৌরির ওপরে অকথ্য নির্যাতন। হয়তো আজ মৌরিকে খেতে দেওয়া হবে না অথবা ওর ঘরের ইলেকট্রিক কানেকশন বন্ধ করে দেওয়া হবে অথবা..ওর বিছানায় ঢেলে দেওয়া হবে ঠান্ডা জল অথবা… আর ভাবতে পারছে না মৌরি।
মায়ের হাত থেকে চায়ের ট্রে টা নিয়ে কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেল মৌরি। মাও কানে কানে বলে দিয়েছে, মনে রাখিস আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তোর মামার বাড়িতে তিনদিনের বেশি থাকলেই বউদি জিজ্ঞেস করে…কবে বাড়ি যাবে তোমরা? তাই তোকে ওদের পছন্দ না হলে হয়তো রাস্তায় বের করে দেবে তোর বাবা। মৌরির কান্না এল। এই কঠিন পরীক্ষায় যদি ও হেরে যায় মাকেও ছেড়ে দেবে না বাবা।
সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক ওকে দেখেই নরম গলায় বললেন, এসো মা। ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আর ওনাদের মেয়ে। মেয়েটি সম্ভবত মৌরির থেকে বছর দুয়েকের ছোটই হবে। না পাত্র আজ অনুপস্থিত।
মৌরি চায়ের ট্রেটা রেখে ভদ্রলোককে প্রণাম করতে এগিয়ে যেতেই ভদ্রলোক বললেন, না না মা। আমি কারোর প্রণাম নিই না। প্রতিটি মানুষের অন্তরে ভগবানের বাস।
তুমি বোসো। আমরা একটু গল্প করি।
মৌরি বসতেই ভদ্রমহিলা বললেন, আমি স্বপ্নীলের মা। ও আমার মেয়ে স্বর্ণালী। স্বপ্নীল আজ আসত, কিন্তু হঠাৎই অফিসের একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেনি।
মেয়েটি আচমকা বলে বসল, তোমার অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার এত ব্রাইট তুমি পিএইচডি না করে বিয়ে করছ কেন?
মৌরি কিছু বলার আগেই বাবা বলল, চোর ডাকাত নিয়ে কাজ। এই নিয়ে বার চারেক বদলি হলাম। আবার কোথায় যাব জানি না। তাই ভাবলাম, মেয়ের বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হই।
ইন্দ্রনীলবাবু সহাস্যে বললেন, আরে সোনা ও তো আমাদের বাড়িতে গিয়েও পড়াশোনা করতে পারবে। মৌরি কৃতজ্ঞভাবে তাকাল ভদ্রলোকের দিকে। সত্যিই ইনি ওকে পড়াবেন? ইদানীং মানুষের কথা বিশ্বাস করতে বড্ড ভয় করে। মনে হয় আরেকজন মহেশ দত্তর মুখোশ পরিহিত রূপ।
ইন্দ্রনীলবাবু বললেন, মেয়ে আমাদের পছন্দ মহেশবাবু। ভারী মিষ্টি মেয়ে আপনার। তো মৌরি, বাবার কাছে শুনলাম তুমি খুব ভালো গান গাও… আমাদের একটা শোনাও প্লিজ। আসলে আমার ছেলের আবার ভীষণ রকমের গানের নেশা। নিজে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলে কি হবে গানটা ও নিজেও খুব ভালো গায়। আসলে মহেশবাবু যখন বলেছিলেন, ওনার মেয়ে ভালো গান গায় তখনই আমি ভেবেছিলাম আমার স্বপ্নীলের সঙ্গে ভালো মানাবে।
চমকে উঠল মৌরি। বাবার দিকে তাকাল..বাবা হেসে বলল, লজ্জার কি আছে একটা গেয়ে দে না। তুই তো আর কম্পিটিশনে গাইছিস না!
সামনে এতগুলো মানুষ বসে আছে অথচ মৌরির মনটা ছুটে গেল সেই ক্লাস সেভেনে অজিত স্যারের গানের ক্লাসে। ছোট্ট থেকেই এই একটা জিনিসের প্রতি ওর বড্ড ঝেঁক- গান। কোথাও গান বাজলে ও স্থির থাকতে পারত না। গুনগুন করে আপনমনে গেয়ে উঠত দুকলি। টিভিতে গানের অনুষ্ঠান শুনে নিখুঁত তুলে ফেলত গানগুলো।
মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, তুই বোধহয় আমার মা এসেছিস। আমার গলায় সুর নেই ঠিকই, কিন্তু তোর দিদা বড় সুন্দর ভজন গাইত জানিস।
মা মারা যাবার মাস খানেকের মধ্যেই তুই আমার গর্ভে এসেছিলিস। আমার মায়েরও তোর মতো জোড়া ভ্রু ছিল আর ছিল গলায় মায়াবী সুর। মায়ের মতো গুণের আমরা ভাই বোনেরা কেউ নই।
তুই একমাত্র মায়ের গলাটা পেয়েছিস। মামার বাড়িতেও সবাই বলত, মৌ দিদার মতো হয়েছে।
মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল মৌরি গান শিখুক।
মৌরির গলায় ভগবান দত্ত সুর ছিল।
ক্লাস সেভেনে ও মায়ের হাত ধরে গিয়েছিল পাশের পাড়ায় অজিত স্যারের গানের স্কুলে। তখন অবশ্য ওরা এখানে থাকত না। রায়গঞ্জে পোস্টিং ছিল বাবার।
মা ভর্তি করে দিয়ে এসেছিল মৌরিকে। স্যার ওর গলা শুনে বলেছিলেন, স্বয়ং বীণাপাণির বাস মৌরির গলায়।
স্যারের কাছে যত ছাত্র-ছাত্রী ছিল সকলে একবাক্যে স্বীকার করেছিল, মৌরির দেবদত্ত সুর।
বছরখানেক গান শিখেছিল মৌরি। তারপরে একদিন সন্ধেতে রেওয়াজে বসেছিল ও, বাবা হঠাৎ রেগে গিয়ে বলেছিল, বাইজি বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করেছি তাই নিজের মেয়েকেও সে গান বাজনা শিখিয়ে বাইজি তৈরি করছে।
আচমকা মৌরির চোখের সামনে ভেঙে দিয়েছিল ওর হারমোনিয়ামটা। মা আর মৌরি থরথর করে কেঁপেছিল। সারারাত কেঁদেছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
ওইটুকু ছোট্ট মৌরি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল ও আর কোনোদিন গান গাইবে না।
বন্ধুদের সঙ্গে অন্তক্ষরি অবধি খেলেনি কোনোদিন মৌরি।
আজ সেই বাবা কি অবলীলায় বাইরের লোকজনের সামনে মিথ্যে বলছে!
দাঁতে দাঁত চেপে মৌরি বলল, আমি তো গান গাইতে পারি না আঙ্কেল। বাবা তো জানে সেটা!
ইন্দ্রনীলবাবু অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, সেকি মহেশবাবু আপনি মিথ্যে বললেন?
আমার তো স্বপ্নীলের জন্য গান জানা মেয়ে চাই, এ আমি সকলকেই বলেছি। আপনিও জানতেন। আপনি বললেন, আপনার মেয়ের নাকি গানের গলা ভারী মিষ্টি। দারুণ গান গায়…
মহেশ দত্তকে এই প্রথম অপ্রস্তুত হতে দেখল মৌরি। অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছিল ওর। জীবনে এই প্রথমবার লোকটা অপ্রস্তুতে পড়েছে। এতকাল তো বাবার জন্য মৌরি আর মৌরির মা সর্বত্র অস্বস্তিতে পড়েছে। আজ যাহোক লোকটাকে প্যাঁচে ফেলতে পেরেছে মৌরি।
মনের মধ্যে বহুদিনের জমে থাকা লাভা যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। মনে পড়ে যাচ্ছে, অজিত স্যার বাড়িতে এসেছিলেন কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। প্রায় মিনতির গলায় বলেছিলেন, মৌরি গানটা ছেড়ে দিস না মা। আমি তোকে বিনামূল্যে শেখাব।
বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিল, মাস্টারমশাই আপনি এখন আসুন। এসব ব্যবসা এখানে চলবে না। আমার মেয়েকে আমি বাইজি বানাব না। মৌরির মুখে সেদিন একটা কথা ফোটেনি। চোখ দুটো রাগে আক্রোশে লাল হয়ে গিয়েছিল। তবুও শুকনো মরুভূমি থেকে একফোঁটা জল পড়েনি।
মাস্টারমশাই ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে অপমানিত হয়ে মুখ নিচু করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
আজ তার প্রতিশোধ তুলল মৌরি।
ইন্দ্রনীলবাবুর স্ত্রী বললেন, এভাবে আমাদের মিথ্যে বলার কি অর্থ বুঝলাম না মহেশবাবু।
স্বর্ণালী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল, বাবা আমার না সব কিছু কেমন গোলমেলে ঠেকছে। মৌরিদির অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার এত ভাল তারপরেও ওকে হায়ার স্টাডি না করিয়ে বিয়ে দিতে চাইছে। ও গান জানে না জেনেও মিথ্যে করে বলা হচ্ছে গান জানে।
মহেশ দত্ত হাত জোড় করে বললেন, স্যার আমি মিথ্যে বলিনি। সত্যিই মৌরি দুর্দান্ত গান গাইত।
কাঁচুমাচু মুখ করে মহেশ বলল, আমিই ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আসলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে ভেবেই….মৌরি জানে ইন্দ্রনীলবাবুর চলে গেলেই আজ মৌরির গালে থাপ্পড় পড়বে তবুও আজ যেন কেমন নেশায় পেয়ে বসেছে ওকে। এতদিনের জমা লাভা তরল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পুড়িয়ে দিতে চাইছে ওই মিথ্যে অহংকারকে।
মৌরি হেসে বলল, আসলে আঙ্কেল বাবার মনে হয় গান শিখলে বাইজি হয়ে যায়। তাই ক্লাস সেভেনে মাত্র বছরখানেক শিখেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।
ইন্দ্রনীল বাবুর স্ত্রী বললেন, ছি ছি মহেশবাবু, আপনি একজন দেশের রক্ষাকর্তা। শিক্ষিত মানুষ। আপনার এমন ভাবনা হলে সাধারণ মানুষ কী শিখবে! বাবা তখন ঊর্ধ্বতন অফিসারকে তৈলমর্দনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। স্যার আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু আরেকটা সুযোগ দিন প্লিজ।
মৌরি তাকিয়ে দেখল, মায়ের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেছে। মা বোধহয় এজন্মে মহেশ দত্তকে ভুল হওয়ার জন্য হাত জোড় করতে দেখবে কখনও ভাবেনি।
মৌরির মনের মধ্যে একটা তীব্র বিরক্তি কাজ করছে। মিথ্যেবাদী, অসভ্য, স্বার্থপর একটা মানুষ। নিজের প্রোমোশনের জন্য সব কিছু করতে পারে।
ইন্দ্রনীলবাবু আর বছর খানেকের মধ্যেই রিটায়ার করবেন। বাবার চাকরি এখনও বছর পাঁচেক আছে। তাই এই সুযোগে নিজের মেয়েকে ব্যবহার করে নিতে বিবেকে বাধছে না! বিবেক? মৌরি আবার কীসব ভাবছে, এই মানুষের কাছে বিবেক আশা করাও তো অলীক কল্পনা।
মহেশ গদগদ হয়ে বলল, আমাকে ছয়টা মাস সময় দিন। আমি যদি ওকে গানে তৈরি না করতে পেরেছি তবে আমি চাকরি ছেড়ে দেব স্যার। পাঁচ-ছয়মাস গান শিখলেই ও দুর্দান্ত গাইবে আমি জানি।
ইন্দ্রনীলবাবু একটু থমকে বললেন, বেশ। মেয়ে আমাদের পছন্দ। কিন্তু গান না জানলে আমার ছেলে তাকে বিয়ে করবে না।
খাওয়া-দাওয়া করে মৌরির সঙ্গে আরেকটু গল্প করে ইন্দ্রনীলবাবুরা চলে গেলেন।
ওরা চলে যেতেই বাড়ির মধ্যে তাণ্ডব শুরু করল মহেশ। কেন মৌরি এসব বলল স্যারকে সেই নিয়েই চিৎকার। মৌরি হেসে বলল, বাবা আয়নার সামনে দাঁড়াতে তোমার এত ভয়?
মৌরির গালে সজোরে থাপ্পড়টা দিয়ে মহেশ দত্ত বলল, আগামীকাল থেকে গান শিখতে যাবে। আমি হারমোনিয়াম কিনে আনব কালকেই।
মৌরি জেদ ধরে বলল, না আমি গান গাইব না।
আরেকটা থাপ্পড় ওর গালে পড়ার আগেই মা বলে উঠল, ও শিখবে শিখবে। আমি বুঝিয়ে বলব।
বাবা ধপধপ করে পা ফেলে বেরিয়ে গেল।
মৌরির মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলল, কী দরকার ছিল এসব বলার?
মৌরি নিজের হাত দুটো পাখনার মত মেলে বলল, খাঁচাটা খুব কাটতে ইচ্ছে করছিল মা।
রাতে নিজের ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিল মৌরি। হঠাৎই হোয়াটসআপে একটা মেসেজ ঢুকল, খাঁচায় বন্দি পাখিকে যদি আচমকা খোলা আকাশে উড়তে দেওয়া হয়, তাহলে কি সে উড়তে পারবে, নাকি ডানা ঝাপটা দিয়ে আবার ফিরবে বন্দি জীবনে?
ডিপিতে কোনো ছবি নেই। অপরিচিত নম্বর দেখলেই মৌরি ব্লক করে দেয়।
কিন্তু এমন একটা মেসেজ দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠল মৌরি। কে আপনি?
ও ওর বেস্টফ্রেন্ড সুচেতনার কাছেও কখনো বলেনি, ও কতটা মানসিক টানাপোড়েনে থাকে। ওর বাবা কেমন ব্যবহার করে সেটাও সঠিক জানে না সুচেতনা। সেখানে একজন অপরিচিত ব্যক্তি কীভাবে জানল যে পরাধীনতা ওকে কষ্ট দেয়?
মৌরি আনমনে টাইপ করল, বহুদিনের অনভ্যাসে ডানা দুটো ক্লান্ত হয়ে আসবে….তাই হয়তো…
ওপর পক্ষে লিখলো, ক্লান্ত হলে গাছের ডালে বিশ্রাম নিয়ে নিক সে। কিন্তু বন্দি জীবনে ফিরে আসাটা কি উচিত?
মৌরি সম্বিৎ ফিরে বলল, কে আপনি? আমি কি চিনি আপনাকে?
অপরপক্ষ থেকে উত্তর এল, আপাতত একই আকাশের চাঁদ দেখছি আমরা। একই বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। তাই অপরিচিত বলি কী করে? নিশ্চয়ই চেনেন। আমি একজন পুরুষ মানুষ।
নামটা আপনি কল্পনা করে নিতে পারেন। বয়েস সাতাশ হবে।
মৌরি বলল, আমাকে আপনার ঠিক কি প্রয়োজন?
ছেলেটা দুটো স্মাইলি পাঠিয়ে বলল, এই তো ভুল করলেন ম্যাডাম… শুধু প্রয়োজনের জন্য যদি মানুষ মানুষকে চিনতে চায় তাহলে কি সম্পূর্ণ চেনা হয়?
জানেন ম্যাডাম আমার খুব ইচ্ছে একটা আস্ত নদী কিনব। সেই নদীর ভাঙা গড়ার খেলা দেখব। যখন জোয়ার আসবে তখন আগ্রাসী স্রোতে ভেঙে দেবে দুকূল। আবার ভাটার টানে মেরামতির কাজ সেরে নেবে। তখন শুধু পলি সঞ্চয়ের খেলা। সেই নদীটা শুধু আমার হবে। আমার সঙ্গে গল্প করবে তার বয়ে আসা নগর প্রান্তরের কত ঘটনা।
মৌরি আজ বড্ড অন্যমনস্ক। তাই আনমনে লিখল, আমার আবার পাহাড় কেনার ইচ্ছে ভারী। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট মানুষগুলোকে দেখব। ওই মানুষগুলো ছুঁতে পারবে না আমায়। আমার ইচ্ছের ডানায় পরাতে পারবে না কোনো লাগাম। ওই ভিড়ে মিশে থাকবে স্বয়ং মহেশ দত্ত। দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকবে আমায়। কিন্তু ছোঁয়ার সাহস থাকবে না।
ছেলেটি বলল, আমি কিন্তু আপনাকে চিনি মৌরি।
আপনি আমায় খেয়াল করেননি। তাই হয়, ধ্রুবতারার কর কারণ থাকবে নাবিককে মনে রাখার। বরং নাবিকেরই গরজ থাকবে ধ্রুবতারাকে খুঁজে বের করার। নাহলে সে যে দিকভ্রষ্ট হবে।
মৌরি বলল, ভারী সুন্দর কথা বলেন তো আপনি।
কিন্তু আমি যে অপরিচিত কারোর সঙ্গে কথা বলি না।
ছেলেটি বলল, পরিচিত সকলকে কি নিশ্চিত চেনেন মৌরি?
আপনি নিশ্চিত তারা মুখোশ পরে নেই?
মৌরি বলল, আপনি তো আমার নামও জানেন দেখছি। আপনার নামটা বলুন তবে।
ছেলেটি বলল, নীল।
আমরা কি বন্ধু হতে পারি? নির্ভেজাল বন্ধুত্ব। কোনো কল নয়, ভিডিও কল নয়, কোনো সেক্সি ছবি চাইব না। এমনকি লাভ ইউ বলে বলে বিরক্তও করব না আপনাকে। শুধু বন্ধুত্ব চাই।
মৌরি একটু থমকাল। এভাবে স্ট্রেট যে কেউ কথা বলতে পারে ও ভাবতেও পারেনি।
কী হল? বলুন আপত্তি আছে এমন বন্ধুত্বে?
মৌরি বলল, না নেই। একটা অদ্ভুত জেদ চেপেছে আজ মৌরির মাথায়। আজকে প্রথম মহেশ দত্তকে ভয় পেতে দেখে মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
মৌরি বলল, ওপরের শর্তগুলো মেনে চললে বন্ধুত্বে আপত্তি নেই।
দিন পনেরো নীলের সঙ্গে কথা বলে মৌরি বুঝেছে, একে নির্দ্বিধায় নিজের সমস্যার কথা বলা যায়। নীল কী সুন্দর করে সমাধান বলে দেয়। ইদানীং মৌরি অপেক্ষা করে থাকে কখন নীল হোয়াটসআপ করবে। নীল হোয়াটসআপ করেই প্রথমে লেখে, আজকে রাগের কারণ কী জানতে পারে এই অর্বাচীন?
মৌরি বলে, কী করে জানলে আমি রেগে আছি?
এই যে ঘনঘন হোয়াটসআপ চেক করেনি কেউ। নিজের ডিপি উড়িয়ে মরুভূমির ডিপি বসেছে। এসব থেকেই বোঝা যায় মাই লর্ড আজকে বড়সড় ঘটনা ঘটেছে।
মৌরি বলেছে, ওর জীবনের ছোট ছোট না পাওয়ার কথা। গান থেকে ওকে দূরে করার কথা। আবার এখন শুধুমাত্র বিয়ের জন্য গান শেখাতে চাইছে বাবা। হারমোনিয়াম কিনে এনেছে। মৌরি শিখবে না কিছুতেই।
নীল সবটা শুনে বলেছে, আমি একটা বুদ্ধি দেব মৌরি?
তুমি এক কাজ করো সুরকে আবার আপন করে নাও। প্রাণ ঢেলে চর্চা করো। ওদের দুর্দান্ত গান শুনিয়ে দাও। তারপর বিয়েটা ক্যানসেল করে দাও। দেখো এতে তোমার দুটো লাভ।
এক- গান শেখা তোমার স্বপ্ন ছিল। সেটা পূরণ হল।
দুই- বাবার স্বেচ্ছাচারিতার জবাব দেওয়া হল বিয়েটা বাতিল করে দিয়ে।
এতদিনে কেউ একজন মৌরিকে বুঝেছে।
নীলের কথা মতোই মৌরি ভর্তি হয়েছে সংগীত একাডেমিতে। এত বছর পরে হারমোনিয়ামে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলেছে মৌরি। নিজেকে সংবরণ করার শক্তি ছিল না ওর। অনুরাধাদি প্রথম দিনেই বলেছেন, মৌরি গানটা তোর রক্তে আছে রে। তুই শুধু রক্তটাকে একটু উষ্ণতা দে।
ইদানীং ঘুম থেকে উঠেই বাবা হাঁকডাক করে, মৌ গানের রেওয়াজে বসতে পারিস না! কিসের এত ঘুম?
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। এই মানুষটাই একদিন বলত, আমার বাড়িতে ওসব বাজনা বাজবে না। এটা কোনো বাইজি বাড়ি নয়।
সেই মানুষটার মধ্যে কী অকল্পনীয় পরিবর্তন!
শুধু তাই নয়, সেদিনের পর থেকে মৌরিকে একটু সমঝে চলে মহেশ দত্ত।
শর্ত মতো এখনও কোনো ফোন কল করেনি নীল। কিন্তু ইদানিং মৌরির খুব ইচ্ছে করে নীলের গলাটা শুনতে। নীলকে একবার দেখতে!
ওর সব সমস্যায় গত একমাস ধরে পাশে থাকা মানুষটাকে ও চেনে শুধু কালো অক্ষরের মাধ্যমেই। কিন্তু নীল ওর দেওয়া কথা মেনে কোনোরকম ফোন করেনি ওকে। মৌরির বলতে লজ্জা করছিল যে ও কথা বলতে চায়। তাই আজ চ্যাট শুরু করতেই মৌরি বলল, নীল আজ হাতে ব্যথা, টাইপ করতে বড্ড সমস্যা হচ্ছে। ফোনে কথা বলা সম্ভব?
নীল টাইপ করল, মৌরি তোমার দেওয়া শর্তের বাধা তুমিই ওপেন করতে পার একমাত্র। কল মি প্লিজ।
মৌরির বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক লাবডুব শব্দের অনুরণন। অজানা অনুভূতিতে সিক্ত হতে হতেই কল করল মৌরি। ওপ্রান্তে নিশ্চুপ। মৌরি বার দুই হ্যালো বলার পরে নীল বলল, স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে আজ সেই মানবীর কণ্ঠ শুনলাম…আরেকটু কিছু বল মৌরি। শুধু হ্যালো নয়।
নীলের গলার আবেশ জড়িয়ে ধরছে মৌরিকে। অবশ করে দিচ্ছে ওর সচল অনুভূতিগুলোকে।
মৌরি বলল, নীল আমি তো একজনের বাগদত্তা। যদিও আমি তাকে দেখিনি সামনে। তবুও তার উদ্দেশ্যেই আমার আবার গানের জগতে ফিরে আসা। ছয় সাত মাস পরে আমি যখন আবার গান গাইব তখনই বাবা তো সেই ছেলেটিকে নিয়ে আসবে আমার সামনে। আমার কী করা উচিত নীল?
নীল বলল, যদি তোমার ছেলেটিকে ভালো লাগে তবে বিয়ে করে নেবে। আর যদি মনে হয় এ তোমার যোগ্য নয় তাহলে বাতিল করবে। খুব সিম্পল।
মৌরি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, এই ছয়মাসের মধ্যে যদি আমি অন্য কারোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি, তখন?
নীল সচেতন হয়ে বলল, তখন যার প্রতি আসক্ত হচ্ছো দায় তার। সেই তোমাকে উদ্ধার করবে ওই পরিস্থিতি থেকে।
মৌরি বলল, আর যদি এ দুর্বলতা একতরফা হয় তখন?
নীল বলল, সেটা তো তবে জেনে নিতে হয়। সে পক্ষেরও তোমার প্রতি দুর্বলতা আছে কিনা!
জানার উপায় কী নীল?
মৌরি তুমি এক কাজ করো, আচমকা তাকে বলে ফেলো…তুমি তাকে ভালোবাসো। যদি সেও বাসে তাহলে সে স্বীকার করবে। আর যদি না বাসে তাহলে তোমাকে বিদায় জানাবে।
মৌরি বলল, না না। তাকে আমি হারাতে পারব না নীল।
না, মৌরির নীলকে বলা হয়নি, তার এই অচেনা অনুভূতির কথা। বলা হয়নি নীলকে সে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেছে। বলতে ভয় পেয়েছে। যদি নীল ওর হাতটা ছেড়ে দেয়। বড্ড দিশেহারা হয়ে পড়বে ও।
বাবা ওয়ার্নিং দিয়ে গেছে…তোমাকে লতা মঙ্গেশকর হতে হবে না। দুখানা গান গাইলেই চলবে। সেটা নিশ্চয়ই ছয়মাস সময়ে তুমি রেডি করতে পারবে মৌরি। আর যদি না পারো তবে কিন্তু…
শাস্তিটা উহ্য রেখেছে মহেশ দত্ত।
দিনের মধ্যে প্রায় পাঁচঘণ্টা গানকে ভালোবেসেই কাটায় মৌরি। তাই দুখানা কেন দশখান গান ও শুনিয়েই দিতে পারবে এখন। কিন্তু কেন কে জানে…ইন্দ্রনীল আঙ্কেলের সামনে আর বসতে ইচ্ছে করবে না ওর। ইন্দ্রনীল আঙ্কেলের ছেলেকে গান শোনাতে মোটেই মন চাইবে না মৌরির। ওর গোটা মন জুড়ে এখন শুধুই নীল। অদেখা একটা ছেলে যে ওর অস্তিত্ব ঘিরে বাস করবে ভাবতেই পারেনি মৌরি।
নীলের সঙ্গে এখন ফোনে কথা হয় রোজ। একটা নির্দিষ্ট টাইমে মৌরি অপেক্ষা করে নীলের ফোনের জন্য। এটা ওর অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। নীল কী করে, কেমন দেখতে, কেমন ছেলে এসব যেন কোনো কিছুই জানার প্রয়োজন নেই ওর। শুধু নীলের এই দূর থেকে উপস্থিতিটুকুই অনেকটা মৌরির জন্য। এমন করে মৌরিকে এর আগে কেউ কখনো চেনেনি।
মৌরিদের কলাবতী সংগীত একাডেমির বার্ষিক অনুষ্ঠান আজকে। মৌরিকে ভীষণ ইচ্ছে নীল আজকে উপস্থিত থাকুক ওর অনুষ্ঠানে। ও এত বছর পরে আবার কোনো স্টেজে উঠবে। সেই ক্লাস সেভেন একটা গানের কম্পিটিশনে নাম দিয়ে ফার্স্ট হয়েছিল। তার প্রাইজটা এখনও আছে মৌরির কাছে সযত্নে।
মৌরি নীলকে আবদারের গলায় বলেছিল, ছয় মাস অতিক্রান্ত। আমার অগ্নিপরীক্ষায় দিন বাবা ঘোষণা করে দিয়েছে। পাখিটা আবার ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সেই খাঁচাটার মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছে।
নীল বলল, সেটা তো স্বেচ্ছায় তাই না মৌরি?
তুমি তো বিয়েটা ক্যানসেল করে দেবে বাবার মুখের ওপর এটাই কথা হয়েছিল আমাদের।
মৌরি বলল, জানো নীল, এই বিয়েটা যদি আমি না করি আমার মায়ের ওপরে রোজ অত্যাচার করবে বাবা। মা আর কত সহ্য করবে বলত?
তুমি বরং মুক্ত বিহঙ্গকে একবার দেখে যাও। যে জোর গলায় গান গাইবে মঞ্চে। এত লোকের সামনে।
আসবে নীল?
নীল বলল, যাব…
আমি তোমায় চিনব কী করে নীল?
নীল বলল, চেনার তো দরকার নেই মৌরি। আমি শুনে আসব তোমার গান।
মৌরি বেশ বুঝতে পারছে নীল একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে ওর থেকে। এখন বরং বেশি করে বলে স্বপ্নীলের কথা। কেমন দেখতে স্বপ্নীলকে?
কবে বিয়ে হবে ওদের? বিয়েতে কী নীলকে নিমন্ত্রণ করবে মৌরি?
একরাশ প্রশ্ন থাকে নীলের। মৌরি দু একটার উত্তর দেয়। একটা মনখারাপি বাতাস দিনরাত ওকে ঘিরে ধরে। নীলের থেকে একটু একটু করে আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে থাকে।
আগামী সপ্তাহেই ইন্দ্রনীলবাবুরা আসবেন। যাদের জন্য বাবা গান আবার শুরু করাল তারা আসছেন। মৌরিকে রোজই মা বলে, আর তো হয়ে এল রে মৌ।
একটু যে নার্ভাস লাগছিল না তা নয় মৌরির। তবুও গান ওর সব থেকে ভালোবাসার জায়গা, অভিমান করার জায়গা বলেই হয়তো মঞ্চ থেকে নামার পরে অনুরাধাদি ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, স্বয়ং দেবীর বাস তোর কণ্ঠে।
মৌরির চোখ দুটো নীলকে খুঁজছিল ক্রমাগত। কিন্তু হলের প্রতিটা চেয়ার খুঁজেও কোনটা নীল বুঝতে পারল না ও।
হোয়াটসআপে মেসেজ ঢুকল, একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন-জলে সহসা কে এলে গো এ তরী বাইবে বলে….
গানটা আমারও খুব প্রিয় গান মৌরি। তুমি খুব ভালো গাইলে। আর নীল রঙের শাড়িতে তোমাকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছিল। নীল আমারও খুব প্রিয় রং।
মৌরি ব্যাকুল গলায় বলল, আমার কি কোনো অধিকার নেই তোমাকে দেখার নীল?
এ তো একতরফা বন্ধুত্ব হয়ে গেল!
নীল বলল, আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল গানটা তুমি শেখো। এটাকেই প্রফেশন বানাও। সে উদ্দেশ্যে আমি আজ সফল। এখন তুমি ভাবো গান নিয়ে তুমি বাঁচবে কিনা, নাকি শুধুমাত্র পরীক্ষায় উতরানোর জন্য শিখলে, এগজাম শেষ হলেই আবার ভুলে যাবে একে!
মৌরি আমার দৃঢ় ধারণা মাত্র ছয়মাসের প্রিপারেশনে তুমি ইন্দ্রনীলবাবুর কাছে লেটার মার্কস পাবে। আর তার ছেলে হয়ত আরও নম্বর দেবে।
দুদিন ধরেই নীলের ফোন সুইচড অফ। কোনো যোগাযোগ নেই মৌরির সঙ্গে। কেন এমন কালবৈশাখীর মতো এলো নীল! আর এই ছয়মাসে মৌরির ভাবনাচিন্তাগুলোকে ওলটপালট করে দিয়ে চলে গেল? অস্থির লাগছিল মৌরির। আজ ইন্দ্রনীলবাবুরা আসছেন। বাড়িতে সাজো সাজো রব। মৌরির দুই পিসিমনি এসেছে। মাকে সাহায্য করছে। বাবার মুখে হাসি ধরে না। বার কয়েক বলেই ফেলল, তবে, আমার মেয়ের বিয়ে হবে এসপির ছেলের সঙ্গে। এরপর আমায় পায় কে!
মৌরি ঘুরে ফিরে বারবার চেক করছে হোয়াটসআপটা। ফোন করেও দেখেছে সুইচড অফ। তার মানে নীল চিরতরে হারিয়ে গেল মৌরির জীবন থেকে! অবাধ্য জলের ফোঁটা দুটো গাল বেয়ে নেমে এল।
ইন্দ্রনীলবাবু এবং ওনার স্ত্রী মৌরির গান শুনে মোহিত। বলল, ভাবতেই তো পারছি না এই কদিনে নিজেকে এভাবে বদলে ফেলেছে মৌরি!
এমন গলার অধিকারী হয়ে কিনা গান ছেড়ে দিয়েছিলে?
মহেশবাবু বললেন, এ বিয়ে আমি পাকা ধরে নিই স্যার?
ইন্দ্রনীলবাবু কিছু বলার আগেই মৌরি বলল, দুঃখিত আঙ্কেল। আমি এ বিয়ে করতে পারব না। আমি একজনকে ভালোবাসি!
ঘরে যেন বজ্রাঘাত হল। মহেশ দত্ত লোকজন ভুলে তেড়ে এল মেয়ের দিকে। কী, ভালোবাসো? ইয়ার্কি হচ্ছে স্যারের সামনে?
না স্যার, ও কাউকে ভালোবাসে না। ওর সে সাহস নেই। ওকে আমি কোনো ছেলের সঙ্গে মিশতে দিইনি কোনোদিন। গার্লস স্কুলে, গার্লস কলেজে পড়িয়েছি। ইউনিভার্সিটিতেও নজরে রেখেছিলাম। ও মিথ্যে বলছে। উত্তেজিত মহেশ দত্ত টেবিল চাপড়ে বলল, আমি বলছি ও মিথ্যে বলছে।
এই মৌ তুই কাকে ভালোবাসিস? কোথায় বাড়ি ছেলেটার? কী নাম তার?
মৌরি নির্লিপ্ত গলায় বলল, ওর নাম নীল। এছাড়া আমি আর কিছুই জানি না ওর সম্পর্কে। আমি ওকে কোনোদিন দেখিনি। কিন্তু আমি জানি ওকে আমি ভালোবাসি।
মহেশ দত্ত হেসে বলল, বুঝুন স্যার বুঝুন। ও মিথ্যে বলছে…
ইন্দ্রনীল গুপ্ত হেসে বললেন, মিথ্যে তো আমিও বলেছিলাম মহেশবাবু। আসলে আমার কোনো ছেলেই নেই। এই আমার একমাত্র মেয়ে স্বর্ণালি।
মহেশ দত্ত ধপ করে বসে পড়ে বলল, মানে?
তবে যে আপনি বললেন, ছেলের বিয়ে দিতে চাই ভালো পাত্রীর খোঁজ করছেন? এগুলো তবে মিথ্যে!
ইন্দ্রনীলবাবু হেসে বললেন, শোনো হে…প্রেমে আর যুদ্ধে মানুষকে মিথ্যে বলতে হয়।
মৌরির মাথায় হাত রেখে বললেন, স্বপ্নীল বড্ড ভালো ছেলে। তোমায় ভীষণ ভালোবাসে মা।
মৌরি কিছুই বুঝতে পারছে না। কে স্বপ্নীল…ইন্দ্রনীলবাবুর কোনো ছেলেই নেই…তাহলে স্বপ্নীল কে?
ইন্দ্রনীলবাবু বললেন, স্বপ্নীলকে আমি খুব স্নেহ করি। এস আই স্বপ্নীল ব্যানার্জী। বেসুরো গান গায় বলে বাবার কাছে বড্ড পিটুনি খেয়েছিল ছেলেটা। আরেকটা মেয়ে সুরে গায় বলেও মার খেয়েছিল বাবার কাছে। স্বপ্নীল চেয়েছিল, বাবার সামনে তুমি গলা তুলে প্রতিবাদ করতে শেখো। এই যে আজকে তুমি তোমার বাবার আনা পাত্রকে ক্যানসেল করার সাহস দেখালে এটুকুই চেয়েছিল স্বপ্নীল।
মৌরি বোকার মতো বলল, কে স্বপ্নীল আঙ্কেল?
ইন্দ্রনীলবাবুর স্ত্রী বললেন, তোমার সঙ্গীত শিক্ষক অজিত ব্যানার্জীর ছেলে। তুমি গান ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরে অজিতবাবু কেঁদেছিলেন। এমন একজন ছাত্রীকে হারিয়ে ফেললেন বলে। আরেকটি ক্লাস ইলেভেনের ছেলেও সেদিন তোমাদের বাড়িতে এসেছিল, যেদিন অজিত স্যারকে তোমার বাবা অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। আর তুমি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে কষ্ট পেয়েছিলে। ওইটুকু ছেলে সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছিল, বাবার ওই অপমানের শোধ সে নেবে। আর তোমাকে দিয়ে গান গাওয়াবে।
আমাদের বাড়িতে স্বপ্নীল প্রায় আসে। স্বর্ণালি ওকে ভাইফোঁটা দেয়। আমার নিজের ছেলের মতো।
স্বর্ণালি ফিসফিস করে বলল, হোয়াটসআপটা দেখো…দাদাভাই মেসেজ করেছে।
মৌরি হকচকিয়ে গিয়ে হোয়াটসআপটা খুলল, নীল লিখেছে…শুধু এই দিনের অপেক্ষায় কাটিয়েছি এতগুলো বছর। তুমি তোমার বাবার স্বেচ্ছাচারিতার জবাব দেবে। আজ ডানা দুটো মেলে ধরো মৌরি চলো উড়ে যাই সেই আমাদের পুরোনো শহরে। বাবা এখন আর গান শেখায় না। তবে গান শোনে। বাবার স্কুলটা নতুন করে খুলবে তুমি মৌরি?
মৌরি ছুটে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।
কল করে বলল, এতগুলো বছর শুধু আমাকে গান গাওয়াবে বলে লড়াই করে গেছ?
স্বপ্নীল বলল, আমার পুলিশে জয়েন করার উদ্দেশ্যও মহেশ দত্তর সঙ্গে যোগাযোগ করা। এক্ষেত্রে আমার কপাল ক্লিক করেছে বলতে পার, ইন্দ্রনীল কাকু আমায় ভীষণরকমের হেল্প করেছেন। তোমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের খবর আমি নিতাম মৌরি। কলকাতার হোস্টেলে পড়াকালীন তোমার কলেজের সামনে বহুদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। দূর থেকে দেখেছি তোমায়। তবে ভালো তো বেসেছিলাম সেই ক্লাস সেভেনের ভীতু ভীতু মেয়েটাকে। যার সামনে দাঁড় করিয়ে আমার বাবা বলেছিলেন, দেখে শেখো, তোমার গলা দিয়ে তো কাকের ডাক ছাড়া আর কিছু বেরোয় না। আর এটুকু মেয়ে কেমন সরগম ভাঁজছে দেখো।
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়েছিল, ভয়ে ভয়ে। তারপর আমার মুখ দেখে ফিক করে হেসে দিয়েছিল। মনে পড়ে মৌরি?
মৌরি বলল, পড়ে…খুব আবছা মনে পড়ল।
মহেশ দত্ত দরজায় এসে ধাক্কা দিল।
দরজা খুলতেই তেড়ে এসে বলল, এসব গানের মাস্টারের ছেলের সঙ্গে আমি তোর বিয়ে দেব না মৌ।
মৌরি নির্বিকার গলায় বলল, তাহলে পাড়া শুদ্ধু লোকে জানবে মহেশ দত্তর মেয়ে পালিয়ে গেছে। দেখো, কোনটা বেশি সম্মানের।
গজগজ করতে করতে আহত বাঘ যেন ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। নীল বলল, মৌরি প্রতিবাদ করতে শেখো, মেনে নিতে নিতে নিজের ইচ্ছেটাকেই তো ভুলে যাবে তুমি! বাইরে বেরিয়ে এস, আমি বাইরে ওয়েট করছি তোমার জন্য।
মৌরি জানলা দিয়ে দেখল, বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীল। প্রথম দেখার উত্তেজনাটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা না করেই ছুটে গেল মৌরি।
বাইকে চাপতেই নীল বলল, স্বপ্নীল ব্যানার্জী, এস আই, বেহালা থানা। বাবা অজিত ব্যানার্জী। বাড়ি রায়গঞ্জ। থোবড়াটা চলনসই। হাইট-৫”১০ ইঞ্চি। গান গাইলে কুকুর তেড়ে আসে। আর কি পরিচয় চাও বলো…
মৌরি ফিসফিস করে বলল, প্রেমিকার নামটা উহ্য রইল যে…
বাইকটা স্পিড নিল…হাওয়ায় ঘুরতে ঘুরতে নিজের নামটা শুনতে পেল মৌরি।
‘কিছু স্বপ্ন, কিছু মেঘলা।
চোখে চোখ রাখা এক রত্তি।
কিছু ইচ্ছে সাড়া দিচ্ছে।
মনে ইতিউতি তিন সত্যি।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন