অর্পিতা সরকার
কি রে সায়ন্তন, তুই অফিস যাবি না? উঠে পর বাবা, চাটা খেয়ে নে। এরপর কখন ভাত খাবি আর কখন রেডি হবি? সায়ন্তনের ঘন চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে মা বলল, বড্ড ক্লান্ত হয়ে যাস, তাই না রে? কত কাজ তোর? অফিস তো আর এমনি মাইনে দেয় না! সায়ন্তন আদুরে গলায় বলল, কতগুলো যে কনফারেন্স কল করতে হয় সারাদিনে, তোমায় কি বলব মা? বাবা কোথায়? বেরিয়ে গেছে নাকি?
মাধবীদেবী শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিয়ে বললেন, তোর জন্য ইলিশ নিয়ে এল বাজার থেকে, তারপর অফিসে বেরোলো।
সায়ন্তনের বাবা একটা প্রকাশনা সংস্থায় এডিটরের চাকরি করেন। উচ্চশিক্ষিত হলেও মাইনে বিশেষ পান না। তাই পড়ে পড়ে জ্ঞান বাড়লেও মাইনে তেমন বাড়ে না। সুরজিৎ রায় অবশ্য তাতে কুণ্ঠিত নন, বরং নিজের কাজটাকে বেশ মনোযোগ দিয়েই করে এসেছেন এতকাল। ওই কম মাইনের থেকেই সংসার চালিয়েছেন গুছিয়ে। দুই ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। ওইজন্যই সায়ন্তন আজ বড় কোম্পানিতে চাকরি করছে। মাস গেলে অনেকগুলো টাকা মাইনেও পায়। মাধবী আর সুরজিৎ জানত যে সায়ন্তন একদিন তাদের মুখ উজ্জ্বল করবেই। ছোট থেকেই সায়ন্তন পড়াশোনায় মেধাবী ছিল। সত্যি বলতে কি পড়াশনা নিয়েই কাটিয়ে দিত দিনের বেশিরভাগ সময়টা। স্কুলের শিক্ষকরা রাস্তায় সুরজিৎকে দাঁড় করিয়ে বলতেন, সায়ন্তনকে ভালো করে দেখাশোনা করতে, ও একদিন সকলের মুখ উজ্জ্বল করবে।
তখন থেকেই মাধবী আর সুরজিৎ যত্ন করতে শুরু করেছিল সায়ন্তনের। সেই আদর যত্ন আজও একইরকম ভাবে অব্যাহত।
সায়ন্তন গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আর দাদা কোথায় গেল? সেও কি মহান কার্যে বেরিয়ে পড়েছে? জানো মা, আমারও তো একটা সম্মান আছে, তাই সৌরিশকে দাদা বলতে আমার সম্মানে বাধে মা। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে তোর দাদা এখন কী করছে? কোন প্রফেশনে আছে? কী বলব বলত মা, টিউশন করে? বলতে লজ্জা করে যে। তাও আবার হিস্ট্রির টিচার। মানসম্মান আর থাকল না বুঝলে? মাধবীদেবী চিন্তান্বিত স্বরে বললেন, তোর বাবা তো বলেছিল, ওই প্রকাশনাতেই একটা চাকরি জোগাড় করে দেবে, তো কে শোনে কার কথা! আমারও কি শান্তি আছে ছাই! সেই কোন ছোট থেকে জ্বালিয়ে মেরে দিল। যা বলতাম সব উলটো করতো ওই ছেলে। মাধ্যমিকের রেজাল্টের পরে তোর বাবা কত বলল সায়েন্স নিয়ে পড়তে, কিছুতেই শুনল না। তার ওই এক কথা, যে ছেলেটা অতীতকে জানতে চায় সে কেন ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি নেবে বলত? শুধু স্টার পেয়েছে বলে? কোন কথাটা আমাদের শুনেছে সৌরিশ বল! তোর বাবা, আমি কেউ তো ওকে অবহেলা করিনি। তাহলে তোর হল আর ওর নয় কেন?
ঘরের সামনে দিয়ে যেতে যেতে মুচকি হাসল সৌরিশ। মা বোধহয় অবহেলা শব্দের সঠিক অর্থ জানে না। অথবা যত্নের বিপরীত অর্থ অবহেলা বলেই জানে। অবহেলা যে কতভাবে করা যায় সেটা কেউ এসে বরং সৌরিশকে জিজ্ঞেস করুক। সৌরিশ বুঝিয়ে দেবে, মাত্র দেড় বছরের বড় ছেলেকে ক্লাস ওয়ান থেকেই শুনতে হয়েছে, ভাইকে যত্ন করতে হয় জানিস না? নিজের প্রিয় গাড়ি, রং পেনসিল সব ভাইকে দিয়ে দিতে হয় অক্লেশে, নাহলেই বাবার মুখে শুনতে হয়, বড় দাদা হয়ে হিংসা করছিস? মাঝে মাঝে সৌরিশেরও ইচ্ছে করত মা ওকে স্কুলে যাবার সময় মাছ বেছে ভাত খাইয়ে দিক। প্রতিদিন একই দৃশ্য চোখে পড়ত সৌরিশের। ওর ভাতের থালাটা নামিয়ে দিয়েই সায়ন্তনকে কোলের কাছে বসিয়ে খাইয়ে দিত মা। স্কুলে যাওয়ার সময়েও ওকে দায়িত্ব দেওয়া হত, ভাইকে যেন যত্ন করে স্কুলে নিয়ে যায় সৌরিশ। মাত্র দেড় বছরের বড় হওয়াটাই কি ওর সব থেকে বড় অপরাধ হয়েছিল! তাই ছোট থেকেই বাবা, মা, ঠাম্মা সকলের আদর একচেটিয়া সায়ন্তন পেতো! সৌরিশ পেত মাথা ভর্তি দায়িত্ব। ভাইয়ের খেলতে গিয়ে যেন না লাগে, ভাই যেন ঠিক করে টিফিন খেয়ে নেয় ইত্যাদি প্রভৃতি দেখার কাজ পেয়ে গেল মাত্র বছর পাঁচের সৌরিশ। ভুলভ্রান্তি হলেই বকুনি আর মার বরাদ্দ ছিল। তখন থেকেই ওর ছোট্ট মনের মধ্যে একটা নিজস্ব কুঠুরি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই কুঠুরিটা ওর একান্ত নিজের। আচমকা কোনো আনন্দ বা অনেকটা তরল কষ্টকে ও ভরে রাখত ওই কুঠুরির মধ্যে। আর চাবিটা সযত্নে লুকিয়ে রাখতে শুরু করেছিল সকলের থেকে। সৌরিশকে দেখে সকলের ধারণা হয়েছিল, ছেলেটা ভীষণ রকমের মুখচোরা। আর সায়ন্তন হল মিশুকে, উচ্ছল। সৌরিশ কাউকে বলতেই পারেনি ওরও কথা বলতে ইচ্ছে করে। অনেক এলোমেলো কথারা ওর মাথার মধ্যে বুদবুদ কাটে, কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না শ্রোতার অভাবে। ওরও ভাইয়ের মতো বাবা-মায়ের মাঝখানে ঘুমাতে মন চায়। ঠাম্মার পাশে শুয়ে রোজই ভাবত মা নিশ্চয়ই ভাইকে গল্প বলে ঘুম পাড়াচ্ছে! পরে অবশ্য ভাবনার গতিবেগ দিক পরিবর্তন করেছিল সৌরিশের। কলেজে যাওয়ার পরে অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন হয়েছিল ওর মধ্যে। তরল কষ্টগুলো কবে যেন জমাট বেঁধে কঠিন বরফে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ওই বরফ থেকে আর চুঁইয়ে চুঁইয়েও জল ঝরত না।
সুরজিৎ রায় আর মাধবী রায়ের একমাত্র লক্ষ্য ছিল সায়ন্তন। ওকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে এই যেন ওদের একমাত্র চিন্তা। আরেকটা ছেলে যে এই রায় পরিবারেই জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠছিল সেটা বোধহয় ভুলে যেতে বসেছিল ওরা। মনে অবশ্য সৌরিশও করাতে চায়নি। নীরবেই চলছিল তার পড়াশোনা, তার বেড়ে ওঠা। কিশোর থেকে যৌবনে পা রাখার মুহূর্তগুলোতে সৌরিশ দু-চোখ ভরে দেখেছে, বাবা ওর জন্য পুরোনো বই জোগাড় করে এনে দিয়েছে। আর ভাইয়ের বইয়ে নতুনের গন্ধ। সৌরিশ লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইয়ের বইগুলোর গন্ধ নিয়েছে প্রাণ ভরে। মনে মনে ভাবতো, বাবা তো সৌরিশের জন্য নতুন বই কিনে আনতে পারত, সেগুলোই পরের বছর ভাই পড়তে পারত। পরক্ষণেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল ও। দাদার ব্যবহৃত পুরোনো বই কোনোদিন সায়ন্তন ব্যবহার করবে না। তার যে সবকিছুই বড় গুরুত্বপূর্ণ। ভাইয়ের বইয়ে গাড়ির স্টিকারে লেখা থাকত সায়ন্তন রায়, রোল নম্বর-১।
সৌরিশ বইয়ের ভিতরেই লিখে রাখত, সৌরিশ, একাদশ শ্রেণি, রোল নম্বর-১৩। না, পিছনের তিনটাকে হটিয়ে দেবার কোনো ইচ্ছাই কোনোদিন ছিল না সৌরিশের। ওর পড়তে ভালো লাগত। শুধু পড়ার বই নয়, বিভিন্ন বই। তাই তো বিকেলগুলো যখন সকলে মাঠে কাটাতো, ও কাশীনাথ পাঠাগারে বসে বই উলটে যেত।
সায়ন্তনের বড় হওয়াটা সকলের নজরে মধ্যে হচ্ছিল। বড় হচ্ছিল সৌরিশও, নরম গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছিল ওর ঠোঁটের ওপরেও, কিন্তু সবটাই সকলের অগোচরে যেন। সৌরিশের খুব ইচ্ছে হত মাকে জড়িয়ে ধরতে, খুব ইচ্ছে হত বাবাও বছরের প্রথম ফলটা বাড়িতে এনে বলুক, এটা সৌরিশকে দিও। না কোনোদিন এটা ঘটত না। বরং বাজারের ব্যাগটা নামাতে নামাতে বাবা প্রায় প্রতিদিন বলতো, সায়ন্তন ভালোবাসে বলে তালশাঁস আনলাম, ওকে দিও। অথবা সায়ন্তন ভালোবাসে বলে ইলিশ আনলাম, ভালো করে রেঁধে দিও। সৌরিশ জানে ভাইয়ের প্রিয় ফল আঙুর, তালশাঁস তো সৌরিশ বেশি ভালোবাসে। বাবা-মা ভুলেই গিয়েছিল সৌরিশের পছন্দগুলো। খাবার পাতে সৌরিশও সব খাবার পেতো ঠিকই, কিন্তু ওই বিশেষ আদরটা নয়।
তাই সাদা চোখে অবহেলা বলা চলে না ঠিকই কিন্তু সৌরিশ জানতো, ছোটবেলায় ওই একটু আদর পাওয়ার জন্য ও কত ছটফট করত। কলেজে যাওয়ার পর থেকে অবশ্য আর কখনো ছটফট করেনি ও। নিজের জগৎটাকে গুছিয়ে নিয়েছিল নিজের না পাওয়া আর ব্যর্থতা দিয়ে। চোখের সামনেই দেখত ভাইয়ের প্রতি মায়ের মারাত্মক দুর্বলতা কিন্তু কষ্ট হত না ওর। এতদিনের অভ্যস্ত চোখে সহ্য হয়ে গিয়েছিল সবটুকু। বরং ধীরে ধীরে একটা জেদ তৈরি হয়েছিল সৌরিশের মধ্যে। কেউ যেন ওকে নিয়ে এক ফোঁটাও গর্ব করতে না পারে। তাই ওর আঁকা ছবি ফার্স্ট হলেও ও প্রাইজ আনতে যেত না ক্লাবে। ওর লেখা কবিতা স্কুল ম্যাগাজিনে বেরোত ছদ্মনামে। সবাই বলত, সৌরিশ আর সায়ন্তন দুই ভাই হলেও আকাশ পাতাল তফাত। সায়ন্তন হল পাড়ার গর্ব আর সৌরিশ?… না চোখে পড়া ব্যক্তিত্ব।
মনে মনে খুব খুশি হত সৌরিশ। কোনোভাবেই কারোর কোনো অ্যাটেনশন যেন না পড়ে ওর দিকে সেটাই ছিল ওর লক্ষ্য। এভাবেই চলছিল সৌরিশের জীবন। কিন্তু কীভাবে যেন বনানীর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল কোনো ভূমিকা ছাড়াই।
বনানী বসু। সায়ন্তনের ক্লাসমেট। না শুধু ক্লাসমেট নয়, সায়ন্তনের প্রেমিকা বলাই শ্রেয়। কারণ সৌরিশ ওদের দুজনকে একসঙ্গে ঘুরতে দেখেছে বহুবার। বনানী আর সায়ন্তন একই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্টুডেন্ট। সৌরিশ যখন হিস্ট্রি থার্ড ইয়ারে পড়ে তখনই একদিন বনানী এসে হাজির ওদের বাড়িতে। সায়ন্তন তখনও বাড়ি ফেরেনি, বাবাও অফিসে, মা বোধহয় মিনু মাসির বাড়ি গিয়েছিল। সৌরিশ একাই বসে বই পড়ছিল। বেলটা বাজতে দরজা খুলতেই বনানী স্ট্রেট ঢুকে এসেছিল ড্রয়িংরুমে। কোনো ভূমিকা না করেই বলেছিল, আপনিই তো সায়ন্তনের দাদা তাই না? একটা কথা বলুন তো, সায়ন্তন কি অসুস্থ? হসপিটালাইজড? সৌরিশ একটু চমকে গিয়েই বলেছিল, না তো। ওতো সকালে কলেজে গেল। অসুস্থ তো নয়। বনানী ধপ করে বসে পড়েছিল ওদের মান্ধাতার আমলের পুরোনো কাঠের সোফাটাতে।
চোখের জল হয়তো বনানীর অজান্তেই ওর গাল বেয়ে চিবুক ছুঁয়েছিল। সৌরিশ কিছু না বুঝেই বলেছিল, কি হয়েছে, কাঁদছ কেন?
বনানী থরথর করে কাঁপছিল। সোফার একটা হাতলকে চেপে ধরে বলেছিল, আপনি ভাবতে পারবেন না সৌরিশদা, ও আমার সঙ্গে কত বড় প্রতারণা করেছে। আমাদের সম্পর্কটাকে ও মূল্যহীন করে দিয়েছে। বনানী ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছিল। সৌরিশ বলতে পারেনি সায়ন্তনের প্রথম প্রেম বনানী নয়, এর আগেও ক্লাস ইলেভেনে পাড়ার রম্ভার সঙ্গে ওর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যদিও সে সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সৌরিশ শুধু বলেছিল, সায়ন্তন মিথ্যে বলেছে তোমায় বনানী। ও অসুস্থ নয়, কলেজে গেছে অথবা কোন কোচিংয়ে। বনানী ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ও তিনদিন কলেজে আসেনি।
আমাদের একই ক্লাস, তাই ও এলে আমি দেখতে পেতাম। আমার ফোনটা হঠাৎ করেই ব্লক করে দিয়েছে। এমনকী হোয়াটসআপ, ফেসবুক সব জায়গায় ব্লক করে দিয়েছে। কারণটা আমিও বুঝতে পারিনি। আজ একটা বন্ধু বলল, সায়ন্তনকে নাকি দেখা গেছে আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ের সঙ্গে। আমার একটা বন্ধু সায়ন্তনকে ফোন করলে ও বলেছে ও নাকি হসপিটালাইজড। আমি ভয়ে ছুটতে ছুটতে এসেছিলাম আপনাদের বাড়িতে। এসে দেখলাম আমি একটা মিথ্যের পিছনে ছুটছি।
বনানী ভেঙে পড়েছিল সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কষ্টে, দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল ওর শরীরটা। সৌরিশ কিছু না ভেবেই আলতো করে হাত রেখেছিল বনানীর মাথায়। বলেছিল, এভাবে ভেঙে পড়তে নেই। জীবনটা অনেক বড়, প্রতিটা বাঁকে লুকিয়ে আছে অজানা রহস্য, তাই শান্ত থাকতে হবে, পরের বাঁকটার জন্য।
ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়িতে ঢুকেছিল সায়ন্তন। হাত তালি দিয়ে বলেছিল, ওহ, বনানী…এই তাহলে আসল রহস্য। কলেজে আমার সঙ্গে আর আমার আড়ালে বাড়িতে দাদার সঙ্গে!
বনানী ছিটকে উঠেছিল। তারপর দৃঢ় গলায় বলেছিল, হ্যাঁ এটাই রহস্য। সায়ন্তন আগুন চোখে তাকিয়ে বলেছিল, লুজার। সারাজীবনে বাবা-মায়ের প্রিয় হতে পারিসনি, নিজেকে প্রমাণ করতে পারিসনি এখন আমার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে জিততে চাইছিস? তাহলে ভালো করে শুনে নে, বনানীকে আমি নিজেই ছেড়ে দিয়েছি। রিজেক্টেড জিনিস নিয়েই তোকে থাকতে হবে আজীবন। আমার পুরোনো রংপেনসিল, আমার আধখাওয়া খাবার খেয়েছিস সারাটা জীবন, এখন আমার রিজেক্টেড গার্লফ্রেন্ড নিয়ে প্রেম কর।
লজ্জায় মাথা নিচু করে বসেছিল সৌরিশ। বনানীর গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল অপমানে।
সায়ন্তন আবার ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। সৌরিশের কেন কে জানে বারবার মনে হচ্ছিল এত বড় একটা আঘাতের পরে হয়তো বনানী ভালোমন্দ কিছু একটা করে বসবে। তাই বনানীকে সেদিন বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে এসেছিল সৌরিশ।
তারপর থেকে কি করে যেন বনানী একটু একটু করে ঢুকে পড়েছিল সৌরিশের ওই গোপন কুঠুরিতে। যার হদিশ কেউ কখনো পায়নি সেই ঘরের চাবিটাই কখন যেন হাতিয়ে নিয়েছিল বনানী।
একটু একটু করে ওই বন্ধ কুঠুরির মধ্যে ঢুকেছিল বনানী। তারপর সৌরিশের কঠিন কষ্টগুলোকে ধীরে ধীরে তরল করেছিল। নিজের হাতে মুছে দিয়েছিল সৌরিশের নোনতা জলের ধারাদের।
অনবরত কানের কাছে বলত, সৌরিশ তুমি সকলের থেকে আলাদা। বড় চাকরি করতে হবে এমন নয়, তুমি যা ইচ্ছে সেইভাবেই কাটাও জীবন, আমি কোনোদিন হাত ছাড়ব না তোমার। বনানীর উৎসাহেই আবার রংতুলি তুলে নিয়েছিল সৌরিশ। ম্যাগাজিনে সৌরিশ রায়ের গল্পও ছাপা হয়েছিল বনানীর উদ্যোগেই।
হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করে পড়াশোনাতে ইতি টেনেছিল সৌরিশ। না, নিষেধ করেনি বনানী। বলেছিল, সৌরিশ আমি বিশ্বাস করি তোমায়। আমি জানি তুমি ইউনিক। আর এমন ব্যতিক্রমী যারা হয় তাদের সকলে অন্য চোখেই দেখে। বনানীর মুখে নিজেকে ব্যতিক্রমী শুনে শুনে তিন চার বছরে সৌরিশেরও বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, সত্যিই ও পারবে নিজেকে প্রমাণ করতে।
সায়ন্তনের গলা ভেসে এল আবারও। জানো তো মা, দাদা যেটা করল সেটা জাস্ট মেনে নেওয়া যায় না। তুমিই বলো, বনানীর মতো একটা বাজে মেয়েকে কিনা দাদা বিয়ে করবে কথা দিয়ে দিল? কোনো মানে হয়? আরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের চারটে বছর তো আমরা ব্যাচমেট ছিলাম। আমি জানি ও কত ছেলেকে যে ফাঁদে ফেলেছে! সবাই ওর ফাঁদ কেটে বেরোতে পারলেও তোমার গুণধর বড় ছেলে আর বেরোতে পারল না। মা, বনানী কি এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে নাকি? দাদার লজ্জা করবে না, নিজে টিউশনি করে আর বনানী চাকরি করে, বউয়ের টাকায় খেতে তো লজ্জা পাওয়া উচিত। মাধবী একটু চিন্তিত স্বরে বললেন, সৌরিশ বিয়ে করবে? কই আমি তো জানিনা রে। অবশ্য ওর বিয়ের কথা আমরা ভাবিওনি। তোর বাবা বরং বলছিল, সায়ন্তনকে জিজ্ঞেস করে দেখো ওর পছন্দের যদি কেউ থাকে তাহলে বলতে, নাহলে নাকি সম্বন্ধ দেখবে। সায়ন্তন নরম গলায় বলল, কি যে বলো মা। আমি আবার মেয়ে পছন্দ করে রাখবো? ও তোমরা যা ঠিক করবে সেটাই আমার পছন্দ। সৌরিশ মনে মনে হাসছিল। হিপোক্রেসির একটা লিমিট থাকে! সায়ন্তন বোধহয় তার বাইরে। তার মানে সুনয়নার সঙ্গে রিলেশনটাও আর নেই। সুনয়না সায়ন্তনের অফিস কলিগ। কদিন আগেও কোচিং সেন্টার থেকে ফিরছিল সৌরিশ, দেখেছিল মেয়েটার সঙ্গে। আর ফোনে কথা বলতেও শুনেছিল সুনয়নার সঙ্গে। অন্তত গোটা পাঁচেক রিলেশন ত্যাগ করে এখন সায়ন্তন অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করবে।
সায়ন্তন বলল, মা একটা কথা আছে। দেখো, আমি এখন যে পজিশনে আছি তাতে এই বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি একটা ভালো ফ্ল্যাট বুক করছি। তারপর আমরা সবাই মিলে ওখানেই থাকব। না, দয়া করে তোমার বড় ছেলেকে নিয়ে যেতে বলো না ওখানে প্লিজ।
মা গদগদ হয়ে বলল, আমারও খুব ইচ্ছে করে ভালো একটা বাড়িতে থাকি। গোটা জীবনটা কি এখানেই কাটিয়ে দেব নাকি? সায়ন্তন আদুরে গলায় বলল, আমি তো আছি মা।
সৌরিশ বরাবরই রায় পরিবারের অতিরিক্ত ব্যক্তি। কোনো আলোচনাতেই ও অংশগ্রহণ করতে পারে না। বাবা-মায়ের ফোনে বলা কথা থেকেও মাঝে মাঝে কানে আসে সৌরিশের, সুরজিৎ রায় বেশ আক্ষেপের সুরে বলেন, না গো সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়? ছোটটা ইঞ্জিনিয়ার, ভালো চাকরি করে। বড়টা তো ইতিহাস নিয়ে পড়ল, তারপর কোচিং সেন্টার খুলেছে। না, চাকরির পরীক্ষায় বসেনি সে। মায়ের গলাতেও একই আক্ষেপ শুনতে পায় সৌরিশ। যদিও মাস গেলে একটা মোটা টাকাই ও মায়ের হাতে তুলে দেয়। হয়তো সেটা সায়ন্তনের অঙ্কের থেকে কম, তাই মায়ের মুখে হাসি দেখেনি কখনো।
বনানী সৌরিশের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলেছে, আমি একজন পুরুষকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম, আমি সেটা পেয়েছি। যে ইঁদুর দৌড়ে না ছুটে নিজেকে স্বতন্ত্র করে রাখতে পারে। গঙ্গার ধারের দামাল হাওয়ায় বনানীর চুল এলোমেলো হয়েছে। সেদিকে অপলক তাকিয়ে সৌরিশ বলেছে, আমি কি তোমার সত্যিই যোগ্য? তুমি ইঞ্জিনিয়ার, ভালো জব করো, সুন্দরী আর আমি….
ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বনানী বলেছে, তুমি ছাত্রদের চাকরির স্বপ্ন দেখাও। জীবনে চলার পথ নির্দেশ করে দাও। তুমি বড্ড ব্যতিক্রমী। সৌরিশকে জড়িয়ে ধরে বনানী কানে কানে বলছে, ভালোবাসি, ভালোবাসি কারণ না বেসে থাকতে পারব না যে।
বনানীর বাড়িতে অবশ্য সৌরিশকে পছন্দ নয়। সেটাই স্বাভাবিক। তাদের একমাত্র সন্তানকে কেন তারা এমন ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত! সৌরিশ দোষ দেয়নি বনানীর বাবা-মাকে কিন্তু বনানীর জেদের কাছে হার মেনেছে ওর পরিবার। সৌরিশেরও এই একটা মাত্রই জায়গা আছে যেখানে ও প্রাণখুলে বলতে পারে সবকিছু। ছোট্ট সৌরিশের কষ্টের কথা থেকে আজকের সৌরিশের যন্ত্রণার কথা মন দিয়ে শোনে বনানী। তারপর সৌরিশের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় মধ্যে নিয়ে বলে, ভাগ্যিস সেদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তাইতো বুঝলাম ভালোবাসা আর মোহের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
সৌরিশ নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে বনানীর কাছে, বনানীও যত্নে আগলে রেখেছে সৌরিশের ছোট ছোট ভালোলাগাগুলোকে।
সায়ন্তন বলল, মা আমি প্রোমোটার দেখছি। এই বাড়িটা বিক্রি করে দেব। তারপর আরও অনেক টাকা দিয়ে একটা বড় ফ্ল্যাট কিনব শহরের প্রাণকেন্দ্রে। সৌরিশ দরজার বাইরে থেকেই বলতে যাচ্ছিল, কেন বেচবি রে? এখানে আমাদের শৈশব আছে, বাবা, মায়ের স্মৃতি আছে….
কিন্তু ও জানে এই কথাটা বলতে গেলেই মা রে রে করে উঠে বলবে, তুই চাস না আমি একটা ভালো বাড়িতে থাকি! আসলে মা দিনরাত ভাইয়ের দোষ ঢাকতে ব্যস্ত। বনানী একদিন বলছিল, জানো সৌরিশ কিছু পুত্র সন্তানের মায়েরা হল আসল ধর্ষক। তারাই সন্তানদের শাসন না করে করে ধর্ষক তৈরি করে। এই যে সায়ন্তন এভাবে দিনের পর দিন একটা গ্ল্যামারাস রেজাল্ট আর নামি চাকরির দোহাই দিয়ে অন্যায় করে চলেছে এটা কি তোমার মা জানেন না? কিন্তু অন্ধ স্নেহে চোখ বন্ধ করে আছেন। তাই তো সায়ন্তন একটার পর একটা মেয়ের সঙ্গে ব্রেকআপ ব্রেকআপ খেলা খেলছে।
সৌরিশের নিজেরও মনে হয়, মা দিনরাত সায়ন্তনকে আড়াল করতেই ব্যস্ত। কিছু না বলেই জুতোটা পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে এল সৌরিশ। মা ভাইকে চা আর ভাত এক সঙ্গে খাওয়ানোর তদ্বির করছে। এদিকে সৌরিশ খালি পেটে বের হয় বেশিরভাগ দিনই। কোচিং ক্লাস সেরে ফেরে সেই দুপুর বারোটায়। ব্রেকফার্স্ট সেরে নেয় নয়নের মিষ্টির দোকানে। এটাই সৌরিশের রুটিন। সায়ন্তনকে একটা কারণেই হিংসা হয় সৌরিশের, চিরটাকাল বাবা,মা, আত্মীয়দের সমস্ত ভালোবাসাটুকু নিংড়ে নিল ও। একফোঁটাও ফেলে রাখল না সৌরিশের জন্য।
সৌরিশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েই ফোন করল বনানীকে। সবটা শুনে বনানী বলল, বাড়িটা আমরা কিনে নেব সৌরিশ। তারপর নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেব। ওই বাড়িতে আচমকা দেখা হয়েছিল আমাদের। ওই বাড়ির সব ফার্নিচার চেঞ্জ হলেও সোফাটাকে রেখে দেব আমার বেডরুমে। সৌরিশ হেসে বলল, তুমি এখনও বড্ড ইমোশনাল বনানী। সেই একইরকম পাগলি।
বানানী একটু থেমে বলল, সে আমি একজনের প্রশ্রয়ে একটু আদুরে থাকি বইকি। সৌরিশ প্রশ্রয়ের গলায় বলল, আমার তো এইটুকুই আছে তোমায় দেবার মতো।
দিনসাতেক পরে বাবা আর মা দুজনেই অসময়ে সৌরিশের ঘরের সামনে হাজির। ওদের উপস্থিতিই বলে দিচ্ছিল ওরা কেন এসেছে! বাবাই প্রথম বলল, সৌরিশ, এই বাড়ি আমরা বেচে দেব ভেবেছি। একটা ফ্ল্যাট কিনবে সায়ন্তন। আসলে বাবা-মাকে ভালো রাখতে চায় ও। তুই কী করবি ঠিক করেছিস? মানে কোনো বাড়ি ভাড়া করে থাকবি কিনা ভেবে দেখ। সৌরিশের খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, এ বাড়িতে তো আমারও অধিকার আছে, তাহলে আমার ভাগটার কি হবে? কিন্তু সেই ছোট থেকেই সৌরিশ ওর বলতে চাওয়া কথাগুলো কণ্ঠনালীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। উচ্চারিত হতে গিয়েও সংকোচে থমকে গেছে শব্দগুচ্ছগুলো। মনে মনে ভেবেছে ভালোবাসা আর অধিকার দুটোই জোর করে আদায় করা যায় না। হয়তো সায়ন্তন এর যোগ্য তাই ও পেয়েছে অনায়াসে। বারংবার পিছিয়ে এসেছে সৌরিশ ওর নরম অনুভূতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে। এবারেও একইভাবে বলা হয়ে উঠল না তেমন কিছুই। শুধু বলল, সামনের মাসে আমি আর বনানী রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করছি, তোমরা উপস্থিত থাকলে বনানীর ভালো লাগত।
মা একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল, মাথার ওপরে ছাদ নেই, চাকরি নেই, বিয়ের শখ? বাবা মাকে থামিয়ে বলল, লোকজন নিমন্ত্রণ বা কোনো অনুষ্ঠান হবে নাকি? আমার হাতে কিন্তু এই মুহূর্তে টাকা নেই।
সৌরিশ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না ওসব কিছু হবে না। শুধু বনানীকে একটু আশীর্বাদ করো তাহলেই হবে।
বাড়ি ছেড়ে দেবার কথাটা এত অনায়াসে সৌরিশ মেনে নেবে এটা বোধহয় ওরা ভাবেনি, তাই কিছুটা তৃপ্ত হয়েই বাবা বলল, বেশ, সে আশীর্বাদ করব।
বুকের বাম দিকে একটা যন্ত্রণা হয় সৌরিশের। অবহেলার যন্ত্রণা। লোকে বলে, বাবা-মায়ের কাছে নাকি সব সন্তান সমান হয়। হাতের পাঁচটা আঙুলই নাকি সমান! তাই কি? প্রশ্নটা বড্ড জ্বালায় সৌরিশকে। ভালোবাসা, আদর, যত্ন শব্দগুলো একাকার হয়ে একটাই শব্দ তৈরি হয়, অবহেলা।
সৌরিশ আর বনানী রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছে। মাস দুয়েক পরে একটা পার্টি রাখবে এমনই ভেবেছে বনানী। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে সৌরিশ আর বনানী। পুরোনো বাড়িতে আর যে থাকতে পারবে না ও সেটা বেশ বুঝতে পারছিল। বিশেষ করে বনানীকে দেখলে সায়ন্তন যে অসভ্যতামি করবে সেটাও বুঝতে পারছিল সৌরিশ। কারণ ওদের বিয়ের দিনেও সায়ন্তন হেসে বলেছিল, বুঝলে মা, এঁটো খাওয়ার অভ্যেসটা দাদার এই বয়সেও গেল না। সেই যে ছোটবেলায় আমার আধখাওয়া খাবার ফেলে না দিয়ে তুমি ওকে দিয়ে দিতে আর ও আনন্দের সঙ্গে খেয়ে নিত, সেই স্বভাবটা বেশ বজায় রেখে দিয়েছে কিন্তু। সৌরিশ জানে বনানীকে ক্ষণে ক্ষণে অপমানিত হতে হবে সায়ন্তনের কাছ থেকে। তাই ফ্ল্যাটটা ওরা আগেই ভাড়া নিয়েছিল।
নিজের টুকিটাকি সামান্য জিনিস গুছিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল সৌরিশ। শুরু হয়েছিল ওদের পুতুল পুতুল সংসার। মাধবীদেবীর মতো গোছানো সংসার না হলেও বনানীর সংসারে সৌরিশ রেগুলার টিফিনটুকু অন্তত পাচ্ছিল সময় মতো। ওকে খালিপেটে কোচিংয়ে যেতে হত না। দুপুরে ফিরেও দেখত খাবার ঢাকা দেওয়া আছে। রাতের রান্নাটার দায়িত্ব নিয়েছিল সৌরিশ নিজেই। অফিস থেকে ফিরে বনানীর ওপরে যেন আর প্রেসার না পড়ে তাই। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হলেও ইদানিং ডিনার টেবিলে বসে বনানীর আঙুল চাটা দেখেই সৌরিশ বুঝে গেছে এখন সে বিশ্বের অন্যতম শেফ হয়ে গেছে।
বেশ চলছিল ওদের সংসার। গুটি গুটি পায়ে একমাস দুমাস করে এগোচ্ছিল সংসার পর্বের সময়গুলো। ওদিকের সব খবরই পায় সৌরিশ। কয়েকজন আত্মীয়রাই দায়িত্ব নিয়ে সৌরিশকে জানায় সায়ন্তনদের খবর। ওদের পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে সায়ন্তন, বনানীর পাঠানো প্রোমোটারকে। বেশ ভালো টাকাই নিয়েছে সায়ন্তন। বনানীকে লোন নিতে হয়েছে।
সায়ন্তন বড় ফ্ল্যাট কিনেছে। সামনেই নাকি ওর বিয়ে। বিয়েতে হয়তো নিমন্ত্রণ পাবে না সৌরিশ। প্রাইভেট টিউটর দাদাকে দাদা হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা করে, সেটা বারবার বলেওছে সায়ন্তন। তাই সে আশা সৌরিশ করে না।
মাঝে একবার বাবা ফোন করেছিল, সায়ন্তনের নতুন ফ্ল্যাটটা নাকি খুব সুন্দর। মা ভীষণ খুশি। এমন ছেলের জন্ম দিয়েছিল বলেই নাকি এত সৌভাগ্য জুটেছে ওদের কপালে।
সৌরিশ শুনে খুশিই হয়েছিল, যাক সায়ন্তন অন্তত বাবা-মাকে ভালো রেখেছে।
দিন গড়িয়ে গেছে। বনানী আর সৌরিশ ওদের পুরোনো বাড়িটাকে একটু একটু করে নতুন করে সাজিয়েছে। এখনও ওদের বেডরুমের দক্ষিণ কোণে সেই মান্ধাতার আমলের পুরোনো সোফাটা রেখে দিয়েছে বনানী, যেটায় ও প্রথম বসেছিল এই বাড়িতে এসে।
সায়ন্তন বিয়ে করেছে। বেশ জাঁকজমক করেই বিয়ে হয়েছে ওর। সমস্ত আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিল অনুষ্ঠানে। ব্রাত্য ছিল শুধু সৌরিশ আর বনানী।
সৌরিশের এখন আর কষ্ট হয় না। বনানী ওকে সব দিক দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে। ওর সব জমাট কষ্টকে তরল করে মিশিয়ে নিয়েছে নিজের মধ্যে।
সেদিনও সৌরিশ কোচিং ক্লাস শেষ করে ঘরগুলোতে চাবি দিয়ে বেরোচ্ছিল। হঠাৎই দুজন ছেলে ঘাড়ে ক্যামেরা নিয়ে এসে হাজির।
ঘটনার আকস্মিকতায় সৌরিশ একটু চমকেই গিয়েছিল। ঘটনার কথা বলাও হয়নি বনানীকে।
বনানীই ”প্রথম প্রহর” খবরের কাগজটা খুলে টেবিলে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে ছবি বেরোলে কি লোকে নিজেকে সেলিব্রিটি ভাবে নাকি? যে বউকে বলার প্রয়োজন অনুভব করে না? বনানী ঠোঁট ফোলাল। সৌরিশ অস্বস্তির গলায় বলল, জীবনে তো তেমন কিছুই করতে পারিনি, তাই এটা আর কী বলব বলত?
বনানী কাগজটা সামনে নিয়ে পড়তে শুরু করল,
সৌরিশ রায়। বয়েস বত্রিশ। হিস্ট্রিতে মাস্টার্স।
ভদ্রলোক জীবনে কোনোদিন কোনো চাকরির পরীক্ষায় বসেননি। অথচ বছর বছর ওনার কাছ থেকে এক ঝাঁক ছেলে মেয়ে চাকরি পাচ্ছে।
ব্যাংক থেকে রেল, পুলিশ থেকে শিক্ষক গড়ছেন উনি মন দিয়ে। ওনার কোচিং সেন্টারের নাম ”স্বপ্ন উড়ান”। ভদ্রলোক জানালেন, দশটা-পাঁচটা নিয়ম মাফিক চাকরি উনি পছন্দ করেন না। ওনার ইচ্ছে ছিল নিজের পরিচয় গড়বেন নিজের চেষ্টায়। ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে মুখে ওনার নাম ঘোরে। অনেকেই বলে, সৌরিশ স্যারের কাছে না পড়লে নাকি হাতের মুঠো থেকে চাকরি বেরিয়ে যায়।
সৌরিশ রায় দুর্দান্ত ছবি আঁকেন। টুকটাক লেখালিখি করেন। এই মুহূর্তে উনি WBCS এক্সামের জন্য একটা বই লিখছেন।
ভদ্রলোকের সমস্ত বিষয়েই দারুণ নলেজ। শুধু নিজের সাবজেক্ট নয়, উনি প্রায় সব সাবজেক্টেই পারদর্শী। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটানোর ফলাফল এটা। সৌরিশবাবুকে শেষে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সাকসেসের চাবিকাঠি কী?
উনি অদ্ভুতভাবে উত্তর দিলেন, অবহেলা। কেউ যদি অবহেলা পায় তার সাকসেস অবধারিত।
উনি জানালেন, ওনার লাইফলাইন ওনার ওয়াইফ বনানী বসু।
পড়তে পড়তে বনানীর গলাটা একটু কেঁপে গেল। মুখে ভেংচি কেটে বলল, ন্যাকা। লাইফলাইনকেও নাকি এতবড় একটা খবর বলতে ওনার অস্বস্তি হয়েছে!
সৌরিশ রায় বলেছেন, চাকরি পাওয়াটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, শুধু লক্ষ্যটা স্থির রাখতে হবে।
”প্রথম প্রহরের” তরফ থেকে এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বকে কুর্নিশ জানাই।
নিজস্ব সংবাদদাতা।
কাগজটা পাশে সরিয়ে রেখে সৌরিশকে জড়িয়ে ধরে বনানী বলল, বলেছিলাম না, তুমি ইউনিক। আমি আজ সবথেকে খুশি হয়েছি। এভাবেই সবাই তোমার খবর জানবে সৌরিশ।
কিছুক্ষণ পরেই দরজায় বেল শুনে তড়িঘড়ি করে দরজাটা খুলল বনানী। আজ দুজনেই ছুটি নিয়েছে। নিজেদের মতো করে সেলিব্রেট করবে আজকের দিনটা। রান্নাঘর থেকে খাসির মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। সৌরিশ বার দুয়েক উঁকি দিয়ে বলেছে, বনানী ক্ষিদে পাচ্ছে তো।
দরজা খুলেই বনানী একটু চমকেই গেছে। ওরা যে এই বাড়িতে আছে এটা তো আত্মীয়দের মধ্যে তেমন কেউ জানে না। তাহলে সৌরিশের বাবা-মা জানলো কী করে? হয়তো কোনো প্রতিবেশী মারফত খবর পেয়েছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুরজিৎ আর মাধবী। বনানীকে বলল, বউমা, সৌরিশ আছে বাড়িতে? আজ কাগজে এই খবরটা দেখে আর থাকতে পারলাম না। চলেই এলাম।
বনানী আলতো করে বলল, আসুন, ও ভিতরে আছে। মাধবীদেবী বাড়িতে ঢুকেই বললেন, বিমলাদিই কদিন আগে ফোনে বলল, তোমরা নাকি এই বাড়িতে এসে আছ। খুব ভালো করেছ বউমা, এ তো সৌরিশের জন্মস্থান। এটা যে তোমরা কিনে নিয়েছ, শুনেই আমরা খুব খুশি হয়েছি।
বাড়ির ভিতরের ডেকোরেশন দেখে সুরজিৎবাবু আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন, এ তো দারুণ হয়েছে। চেনাই যাচ্ছে না এটা আমাদের সেই পুরোনো বাড়ি।
বাবা-মায়ের গলা পেয়ে সৌরিশ বাইরে বেরিয়ে এসেছে। স্থির গলায় বলল, বৃদ্ধাশ্রম থেকে এখুনি এলে? মাধবীদেবী সামলে নিয়ে বললেন, বৃদ্ধাশ্রম থেকে আসব কেন, সায়ন্তনকে বললাম, তোর দাদার এমন একটা ভালো খবর বেরিয়েছে তাই দেখা করে আসি। ও গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেল।
সৌরিশ হেসে বলল, মা, তুমি হয়তো জানো না, তোমাদের গত ছয়মাসের বৃদ্ধাশ্রমের টাকাটা আমিই পাঠাই। কারণ সায়ন্তন ওই আশ্রমে তোমাদের অ্যাড্রেসে আমার কোচিংয়ের ঠিকানা দিয়েছিল। তাই প্রতিমাসে ওখান থেকে বিলটা আমার নামেই ওরা পাঠাত।
মাধবীদেবী আর সুরজিৎবাবু ধপ করে বসে পড়লেন বনানীর কেনা দামি সোফাটাতে। মাধবী বললেন, হ্যাঁ, সায়ন্তন আমাদের ওই আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওর বিয়ের পর আমাদের সঙ্গে ওর অ্যাডজাস্ট করতে অসুবিধা হচ্ছিল।
সুরজিৎবাবু বললেন, জানিস সৌরিশ জীবনে অনেক গল্পের বই এডিটিংয়ের কাজ করেছি। কিছু গল্প পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, ধুর এগুলো গল্পই, এ কখনো বাস্তবে হয় না। যেদিন সায়ন্তন আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, সেদিন বুঝলাম, বাস্তবেও সবই সম্ভব।
বনানী বলল, আপনাদের ঘরটা আমি সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছি, আপনারা আজ থেকে ওখানেই থাকবেন।
মাধবীদেবী সৌরিশের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তুই ঠিকই বলতিস, অস্তগামী সূর্য না দেখে বিচার করা উচিত নয় দিনটা মেঘলা ছিল, নাকি উজ্জ্বল!
সৌরিশ উদাসী সুরে বলল, মা তোমরা এই বাড়িতেই থাক, কিন্তু প্লিজ আমাকে আদর করতে এসো না নতুন করে। অনভ্যস্ত মনে অকারণ চাপ পড়বে, এত ভালোবাসা সইতে পারব না।
মাধবীদেবী আর সুরজিৎবাবু মুখ নিচু করে নিজেদের ঘরে ঢুকে গেলেন।
বনানী বলল, নিজের ছোটবেলার না পাওয়াগুলো যদি এখন পাও, কেন নেবে না সৌরিশ?
সৌরিশ হাসি মুখে বলল, অভ্যাস নেই যে, বদহজম হয়ে যাবে। তাছাড়া বললাম না, অবহেলাই আমার আসল শক্তি, আদর নয়। সৌরিশকে বদলাতে বোলো না প্লিজ।
বনানী, আমি আমার সন্তানকে আদর-যত্ন দিয়েই মানুষ করব কিন্তু অন্ধ হয়ে নয়।
সায়ন্তন শুধু নিতে শিখেছে দিতে নয়। আর সৌরিশ দিতে জানে, ছিনিয়ে নিতে নয়। তাই বাবা-মায়ের অযত্ন হবে না, তবে আর নতুন করে ওদের থেকে আমি কিছু নিতে চাই না।
বনানী সৌরিশের হাতটা চেপে ধরে বলল, আমার ব্যতিক্রমী পুরুষ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন