অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার

অর্পিতা সরকার

মা আজ পাড়ায় কে আসছে জানো ফাংশন করতে? সিঙ্গার নীলাদ্রি রায়। উফ মা, এটা আমার কতদিনের স্বপ্ন ছিল জানো? একবার অন্তত নীলাদ্রির সামনে দাঁড়াব, একটা অটোগ্রাফ …চোখে মুখে উত্তেজনায় লালচে রং ধরেছে সমাপ্তির। আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে খুঁজছে একটা হলুদ রঙের চুড়িদার। নীলাদ্রি রায়ের সাক্ষাৎকারে দেখেছে, ওনার পছন্দের রং হলুদ। তাই সমাপ্তি আজ হলুদ পরবে।

দিদিভাইকে ফোন করে বলেছিল, আজ আসতে। কিন্তু দিদিভাইটা যেন কেমন একটা হয়ে গেছে বিয়ে হয়ে! সংসারী টাইপ। বলল…না রে, তোর জামাইবাবু রাগ করবে, লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন নিজের সংসার ছেড়ে যেতে নেই, ইত্যাদি প্রভৃতির ভিড়ে দিদিভাইটা হারিয়ে গেছে যেন।

ধুর, না আসুক দিদিভাই, সমাপ্তি আর রিতিকা দুজনেই কাফি। ওরা দুজনেই নীলাদ্রির মারাত্মক ফ্যান। দুই বন্ধু যেদিন থেকে পাড়ায় ওই পোস্টারটা দেখেছে, সেদিন থেকেই মারাত্মক এক্সাইটেড। রিতিকা অলরেডি মেসেজ করেছে, ও হলুদ কুর্তি পরবে।

মা তিলের নাড়ু পাকাতে পাকাতেই বলল, কে নীলাদ্রি রায়?

মুখে চূড়ান্ত বিরক্তি ফুটিয়ে সমাপ্তি বলল, মা প্লিজ। ভুলেও কখনো জিজ্ঞেস কোরো না, কে নীলাদ্রি? ওর নাম জানে না এমন পাবলিক কমই আছে এখন। ছেলেটা জাস্ট মাল্টি ট্যালেন্টেড বুঝলে?

বয়েস আমাদের মতোই, মেডিকেল পড়ছে, সঙ্গে দারুণ গান গায়। জাস্ট রকস আমরা তো পাগল ওর গান শুনে। আর মা ওর রেজাল্টও দারুণ। ওর বাবাও নামকরা গায়ক নীলেশ রায়। তবে ওর বাবা আধুনিক গাইলেও, ছেলে বাবাকে ছাপিয়ে গেছে পপুলারিটিতে। তুমি বুঝবে না। সারাজীবন তো এই নাড়ু, মুড়কি নিয়েই কাটিয়ে দিলে। জীবনে কার নাম তুমি জানো!

বাবার হুকুম তামিল করা জড় পদার্থ যেন! আমার ভাবতেই অবাক লাগে মা, তুমি কলেজ পাস করা শিক্ষিত একটা মেয়ে। দিদিভাইটাও হয়েছে তোমার মত। লক্ষ্মীপুজোর দিনে নিজের সংসার ছেড়ে নাকি যেতে নেই। আরে, জীবনের বাইশ-তেইশটা বছর যে সংসারে কাটাল, সেই বাড়িটা এখন পর হয়ে গেল। মাত্র তিনবছর বিয়ে হয়ে ওই বাড়িটাই নাকি ওর আপন হয়ে গেল।

অদ্ভুত আজব সব যুক্তি।

বাবা খবরের কাগজটা হাত থেকে সরিয়ে বলল, শোনো সমু, মেয়েদের বেশি স্বাধীনতা ভালো নয়। তাতে সংসার উচ্ছন্নে যায়। অলক্ষ্মীর মতো কথা বলো না। তুমিও তোমার মায়ের কাছ থেকে হাতের কাজ শিখে নাও। এসব ফাংশন, উড়ে বেড়ানো বাদ দাও।

কলেজ পাশ করলেই আমি বিয়ে দিয়ে দেব তোমার।

সমাপ্তি বরাবরই একটু ডাকাবুকো। বেশ জেদি গলায় বলল, আমায় দিদি পাওনি বাবা। আমি বিয়ে করব আমার নিজের ইচ্ছেয়। তোমার কথা বলা পুতুলকে এসব শাসন করো, আমায় করতে এলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব। ওই যে তোমার কথা বলা পুতুল গরম গুড়ে তিল ফেলে হাত লাল করে নাড়ু পাকাতে ব্যস্ত।

মা চোখ তুলে বলল, আঃ, সমু, বাবার মুখের ওপর এমন করে বলতে নেই।

শোনো মা, তোমার পতি পরমেশ্বরকে বলে দিও, আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করে, জব পেয়ে তবে বিয়ে করব।

বাবা গজগজ করতে করতেই বলল, অনুরাধা, তোমায় তো প্রতি বছর একই কথা বলি, আমি তিলের নাড়ু পছন্দ করি না। চিনির নাড়ুই আমি ভালোবাসি। কেন যে বছর বছর এই তিলের নাড়ু বানাও, কে জানে! বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত বোঝাতে পারলাম না, তিলের নাড়ু আমার নাপসন্দ।

আর তোমার আদরের মেয়েকে বলে দিও, তার এসব বেলেল্লাপনা এ বাড়িতে বসে চলবে না। এটা উমেশ দেবনাথের বাড়ি, তাই তার নিয়ম এখানে চলবে।

সমাপ্তি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, থানায় পাঠিয়ে দেব। বাবা বলে রেয়াত করব না। আমি অনুরাধা নয়, যে তুমি মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে চা করতে বললেও করে দেবে। তোমার রেলের অফিসার কলিগরাও সেদিন বাঁচাতে পারবে না। মনে রেখো আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেবার কথা কল্পনাও করো না।

আবার গানের কলিতে সুর দিতে দিতেই হালকা পায়ে এগিয়ে গেল সমাপ্তি।

উমেশ আগুনঝরা চোখে বলল, মেয়েটাকে এই মানুষ করেছ? বাবার মুখের ওপর এত কথা বলে কী করে?

উমেশ জানে অনুরাধা নিশ্চুপ। প্রায় উনত্রিশ বছরের সংসার জীবনে অনুরাধা ঠিক কটা কথা বলেছে হাতে গুনে বলে দিতে পারবে উমেশ। উমেশের যত্ন আত্তির ত্রুটি করেনি। বিছানায় উমেশ যেভাবে বলেছে সেভাবে ওকে সুখ দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ওর দুটো সন্তানের মা হয়েছে। বড় মেয়ের বয়েস প্রায় ছাব্বিশ বছর, তার বিয়ে হয়ে গেল, অনুরাধা মা থেকে শাশুড়ি হয়ে গেল তবুও কখনো নিজের ইচ্ছের কথা মুখ ফুটে বলল না। পুজোয় উমেশ যে রঙের শাড়ি এনে দিয়েছে সেই রঙের শাড়ি পরেছে। কখনো বলেনি এটা পছন্দ নয়। বিয়ের পরের দিন থেকে উমেশের মনে হয়েছে, একটা হুকুম তামিল করা কাজের লোক বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কখনো এই মানুষটা মুখ ফুটে বলতেই পারেনি, আমার কষ্ট হচ্ছে, আমার দুঃখ হচ্ছে। শুধুই হাত পা সচল একটা পুতুল যেন। উমেশের অবশ্য এমন মেয়েই পছন্দ ছিল। বেশি স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদী মেয়ে ওর দুচোখের বিষ। সেই হিসাবে পায়ে পায়ে চলা, বাধ্য অনুরাধাকে ওর মন্দ লাগেনি। ও যাই বলুক অনুরাধা ঘাড় নেড়ে সমর্থন করেছে। বড় মেয়েটাও কিছুটা মায়ের মতো ছিল। বাপকে সম্মান করত। কিন্তু ছোট মেয়েটা বড্ড দামাল স্বভাবের, একগুঁয়ে টাইপের। তাই উমেশ সমুকে মোটেই পছন্দ করে না।

আরেকবার জোর গলায় বলল, অনু তুমি কি মেয়েটাকে শাসন করবে, না করবে না? অনুরাধা একটা প্লেটে দুটো দুধ সাদা নাড়ু এনে বলল, চিনির নাড়ু, আগেই করেছি। ঠাকুরের জন্য তুলে রেখেছি, তুমি খাও।

উমেশ নাড়ুর প্লেটটা হাতে নিতে নিতে বিরক্ত মুখে বলল, কী ধাতু দিয়ে যে তৈরি তুমি!

তাপ উত্তাপও নেই। মনে হয় যেন আধমরা মানুষের সাথে কাটিয়ে দিলাম সময়টা। সাদা গোল এলাচের গন্ধ মেশানো নারকেল নাড়ুটা মুখে দিতেই ভ্রুর কোঁচকানো ভাবটা চলে গেল উমেশের। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল ও। যেতে যেতেই বলল, খাবার দাও, অফিস বেরোবো।

সমাপ্তি ভিজে গায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়েই মায়ের দিকে কটাক্ষ করে বলল, মা মাঝে মাঝে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখো, তুমি জীবিত তো? বিশ্বাস করো মা, আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবি এই মানুষটাকে তুমি দিনের পর দিন সহ্য কর কি করে! স্বার্থপর একটা মানুষ।

তুমি জানো ওই বাবা নামক মানুষটা মহিলাদের জাস্ট মেয়েছেলে ভাবে। তাদের ইচ্ছে, অনিচ্ছে থাকতে পারে… এটাও জানে না ওই মানুষটা। এর পিছনে মূল কারণ কিন্তু তুমি, তোমার এই অত্যন্ত নিরীহ নির্বিবাদী স্বভাবের জন্যই আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বাবা মেয়েদের স্বাবলম্বী ভাবতেই পারে না। প্লিজ মা, বয়েস তো অনেক হল। চুলে পাক ধরল, চোখের নিচে হাঁসের পা থাবা বসাল, এবারে অন্তত নিজের পছন্দটুকু বলতে শেখ! বুঝলাম তুমি খুব শান্ত স্বভাবের মানুষ, কিন্তু তাই বলে এতটা ভালোমানুষও ভালো নয়।

মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে অনুরাধা বলল, তিলের নাড়ু খাবি?

সমাপ্তি বিরক্ত হয়ে বলল, না, আমি কিছু খাব না।

আজ সমাপ্তির জেদ চেপে গেছে। মা নামক এই প্রস্তর প্রতিমার ঘুম ভাঙাতেই হবে। আর বাবাকে একটা সজোরে আঘাত দিতে হবে।

অনেকক্ষণ ধরেই প্ল্যান ভাঁজছিল ও।

আচমকাই মা এসে বলল, হ্যাঁ রে পাড়ার প্রোগ্রামটা আজ কেন হবে?

সমাপ্তি উচ্ছসিত হয়ে বলল, বিজয়া সম্মেলনী মা। যাবে দেখতে নীলাদ্রির গান?

মা উদাস চোখে বলল, আমি তো গান শুনি না রে।

নিজের মোবাইলের বড় স্ক্রিনে নীলাদ্রির ছবিটা দেখিয়ে বলল, মা দেখো, এই হচ্ছে নীলাদ্রি। দারুণ হ্যান্ডু বল? নীলেশ রায়ের ছেলে বলে অহংকারও বেশি। নামকরা বাবার ছেলে তো!

মা ফোনটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কখন অনুষ্ঠান?

সমাপ্তির ফাঁদে একটু একটু করে পা দিচ্ছে মা। যে মানুষটা পৃথিবীর সব ব্যাপারে চূড়ান্ত উদাসীন তাকে পর্যন্ত নীলাদ্রি রায় একটু হলেও নাড়া দিতে পেরেছে তাহলে!

মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, যাবে মা? তোমার দারুণ লাগবে।

মা হালকা হেসে বলল, সন্ধেবেলা তোর বাবা ফিরে জলখাবার পাবে না যে?

সমাপ্তি একমুখ হেসে বলল, তুমি বাবার পরোটা বানিয়ে টেবিলে চাপা দিয়ে রাখবে। আর আমি বাবার ফোনে মেসেজ করে দেব, ব্যাস মিটে গেল। পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমার কাছে চাবিটা রেখে যাব।

মা ঘাড় নেড়ে বলল, তাহলে যাব।

এই তো, জীবনে প্রথমবার বাবার পারমিশন ছাড়া মাকে বাড়ি থেকে বের করতে পারবে ও। বাবার প্রথম ঝটকা লাগবে। আর যখন শুনবে মা বাবার অনুমতি ছাড়াই ফাংশন শুনতে গেছে, তখন তো বাবার মুখটা জাস্ট লাল হয়ে যাবে। ওই মুখটা দেখার বড্ড ইচ্ছা সমাপ্তির। দিনের পর দিন মায়ের ওপরে হওয়া একপেশে অত্যাচারের জবাবগুলো দিতে হবে ওকেই। ছোট থেকে দেখেছে জ্বর গায়েও মা সংসারের কাজ করে চলেছে। কোনোদিন বাবা এসে বলেনি, আজ থাক, তুমি রেস্ট নাও।

নিজে হলদে রঙের চুড়িদার পরে চুল বাঁধতে বাঁধতে আয়নায় দেখল, মা একটা নীল পাড় অফ হোয়াইট রঙের শাড়ি পরেছে। চুলে হাত খোঁপা। গলায় একটা সরু চেন। এই স্বল্প সাজেই মাকে বড্ড সুন্দর লাগছে। সমাপ্তি মায়ের গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, আমার মিষ্টি মা।

হাতের ব্যাগে কী নিয়েছ মা?

সমাপ্তির দিকে তাকিয়ে একটু লজ্জিত ভাবে বলল, ওই কয়েকটা নাড়ু নিলাম। ছেলেটা আমাদের পাড়ায় গান গাইতে আসবে বিজয়ার পরে, তাই দেব।

কোনোমতে হাসি চেপে সমাপ্তি বলল, যদি তুমি ছেলেটার কাছে পৌঁছাতে পার, তবেই তো দেবে মা?

উপচে পড়া ভিড় থাকবে। নেহাত পাড়ার সৌপর্নদাকে বলে গোটা তিনেক টিকিট ম্যানেজ করেছি বলেই সামনে বসতে পারব।

চলো চলো দেরি হচ্ছে। রিতিকা ফোন করছে।

মা আবার বলল, বাবাকে মেসেজ করেছিস?

ঘাড় নেড়ে সমাপ্তি জানিয়ে দিল, হ্যাঁ করেছি।

যদিও মেসেজটা বাবা এখনও সিন করেনি। সমাপ্তি লিখেছে, মাকে নিয়ে ফাংশন দেখতে চললাম, চাবি পাশের ফ্ল্যাটে আর খাবার টেবিলে থাকবে। অকারণে ফোন করে বিরক্ত করবে না।

সমাপ্তি যা ভেবেছিল ঠিক তাই। বিশাল ফুটবল খেলার মাঠটা ভিড়ে ঠাসা হতে শুরু করেছে। ক্লাবের ছেলেগুলো নেহাত চেনা তাই ভিড় কাটিয়ে পৌঁছাতে পারল সামনের সিটগুলোতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নীলাদ্রি রায়ের আগমন ঘটল মঞ্চে। শ্রোতার উচ্ছ্বাসের মাঝেই মা বলে উঠল, এই বয়সেই এত নাম করেছে ছেলেটা!

তবে গান শেষ হবার পরে মা বলল, গানের সাথে এত মাথা নাড়া দেয় কেন রে? সমাপ্তি হেসে বলল, ওটা স্টাইল। তাড়াতাড়ি চলো গো, গ্রিনরুমে যদি একবার ঢুকতে পারি, তাহলে একটা অটোগ্রাফ পেলেও পেতে পারি।

মাকে টানতে টানতে ভিড় থেকে এগোচ্ছিল নীলাদ্রির দুই ভক্ত-সমাপ্তি আর রিতিকা।

গ্রিনরুমের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ক্লাবের সেক্রেটারি। রিতিকার সম্পর্কে কাকা হয়। তাই কোনোমতে ম্যানেজ করে ঢোকা গেল গ্রিনরুমে। নীলাদ্রি তখন কফিতে চুমুক দিয়েছে। গ্রীনরুম ফাঁকা, সম্ভবত উনি বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করছেন।

সমাপ্তি কিছু বলার আগেই আচমকা অনুরাধা বলে উঠল, নীলেশ এখন কেমন আছে? মাইগ্রেনের প্রবলেমটা এখনও হয়? মাঝরাতে ছটফট করে এখনও?

সমাপ্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চিরপরিচিত মারাত্মক আনস্মার্ট মায়ের দিকে।

নীলাদ্রিও সামান্য অবাক হয়েই বলল, আপনি বাবাকে পার্সোনালি চেনেন? বাবার মাইগ্রেনের প্রবলেম আছে এটা খুব কম মানুষই জানেন।

অনুরাধা বলল, পামেলা এখনও গান গায়?

নীলাদ্রি আবারও অবাক গলায় বলল, পামেলা বলে তো আমি কাউকে চিনি না আন্টি। ওহ, আপনি কি গায়িকা পামেলা মিত্রর কথা বলছেন? ওনার সাথে আমার সেভাবে পরিচয় নেই।

তোমার মায়ের নাম কী?

নীলাদ্রি মুখটা নিচু করে বলল, আমি নীলেশ রায়ের পালিত পুত্র। নিজের সন্তান নই। নীলেশ রায় তো অকৃতদার, উনি বিয়ে করেননি।

কেঁপে উঠল অনুরাধা। সমাপ্তিও একটু অবাক হয়েছে। এতদিন সব ইন্টারভিউয়ে শুনেছে নীলাদ্রি রায়ের বাবা বিখ্যাত গায়ক নীলেশ রায়, আজ শুনছে উনি পালিত সন্তান।

অনুরাধা নীলাদ্রির হাত দুটো আচমকা ধরে বলল, একবার নিয়ে যাবে তোমার বাবার কাছে? এককালে তাকে চিনতাম।

নীলাদ্রি হেসে বলল নিশ্চয়ই। চলুন আমার গাড়িতে উঠুন। বাবার বন্ধুবান্ধব তো কেউই আসে না বাড়িতে। কাজের লোকজন ছাড়া। চলুন, বাবা খুশিই হবেন।

সমাপ্তি বলতে যাচ্ছিল, মা… বাবা ফোন করেছিল চারবার। বাড়ি ফিরবে না?

অনুরাধা আলগা গলায় বলল, চলো নীলাদ্রি আমায় একটিবার নিয়ে চলো।

রিতিকা বাড়ি ফিরে গেল।

নীলাদ্রির গাড়িতে ওঠার উত্তেজনার থেকেও এখন বেশি চিন্তা হচ্ছে বাবাকে নিয়ে। সমাপ্তি ভেবেছিল রাত আটটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু এখন বেশ বুঝতে পারছে, রাত অন্তত দশটা বাজবে। বাড়িতে একটা চূড়ান্ত কুরুক্ষেত্র বাঁধবে। কি ভাবে সামলাবে সেটাই ভাবছিল ও।

নীলাদ্রি রায়ের সাথে কথা বলার উত্তেজনা এখন আশঙ্কায় পরিণত হয়েছে।

নীলাদ্রির পাঁচতলার প্রায় দুহাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে যখন ওরা পৌঁছল তখন ঘড়িতে প্রায় পৌনে নটা।

দরজায় বেল বাজাতেই একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুলে বলল, বড়বাবু তোমার জন্য ওয়েট করছেন। কিছুতেই ডিনার খেতে চাইছেন না।

নীলাদ্রি হেসে বলল, শর্মিলাপিসি তুমি বাবাকে খবর দাও, বলো তার পরিচিত একজন এসেছে।

চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। সাদা কালো চুল, টিকলো নাক, গায়ের রংটা আগের থেকে তামাটে হয়ে গেছে।

ড্রয়িংয়ে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে নীলেশ বলল, রাধা! তুমি?

সমাপ্তি কোনোদিন ওর মাকে কাঁদতে দেখেনি। বরং পাথরপ্রতিমার মতো ভাবলেশহীন মুখ দেখেছে চিরটাকাল। কোনো কিছুতেই যেন হেলদোল নেই। আজ সেই মায়ের শুকনো চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অবাধ্য নোনতা জলের রেখা।

নীলাদ্রি হালকা স্বরে বলল, সমাপ্তি, আপনি আসুন আমার রুমে। আমার বইয়ের কালেকশন দেখবেন।

সমাপ্তি যেতে যেতেই শুনল, মা বলছে, পামেলাকে বিয়ে করলে না কেন?

নীলেশবাবু ধরা গলায় বললেন, পামেলা আমার সহ গায়িকা ছিল রাধা। ওকে তো আমি কখনো ভালোই বাসিনি।

অনুরাধা একটু থেমে বলল, কিন্তু পামেলা যে সেই সন্ধেতে আমায় বলেছিল, ও তোমার সন্তানের মা হতে চলেছে!

নীলেশ আবার বললেন, পামেলা চেয়েছিল আমার গানের কেরিয়ারটা শেষ করে দিতে। আমার নামে বদনাম দিলে সেটা সহজেই সম্ভব হত। বিশ্বাস করো রাধা, আমি একবারও ভাবিনি তুমি আমায় অবিশ্বাস করতে পার! তুমি তো আমার শক্তি ছিলে, তাই পামেলা প্রথমেই তোমায় কেড়ে নিল আমার কাছ থেকে। আমিও ভেঙে গুঁড়িয়ে গেলাম। মিডিয়ার গসিপ, কিছু পত্রিকার চটকদার আলোচনায় যে আমার রাধা আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, সেটা আমি ভাবিনি গো। বেশ কিছু বছর গান থেকে বিরত ছিলাম। শুনেছিলাম তুমি বিয়ে করেছ। গিয়েছিলাম তোমার বাড়িতে। তোমার বাবা আমায় দুশ্চরিত্র বলে তাড়িয়েও দিয়েছিলেন। তখন চারিদিকে শুধু একটাই কথা.. নীলেশ রায়ের মতো দুশ্চরিত্র মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। সেদিন যদি তুমি আমার পাশে থাকতে রাধা, তাহলে আমি সোজা হয়ে সত্যের জন্য লড়াই করতাম। কিন্তু যখন দেখলাম তুমি সরে গেলে, তখন আর লড়াইয়ের ক্ষমতা ছিল না। তবে সেই কলেজ থেকে তুমি জানতে গান ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না। তাই আবার শুরু করলাম গান নিয়েই।

নীলাদ্রি আমার দূরসম্পর্কের দিদির ছেলে। ছোট থেকেই বড় ভালো গায় ছেলেটি। জামাইবাবুর আকস্মিক মৃত্যুর পরে আমি ওকে দত্তক নিয়েছি। ও আমায় ভরিয়ে দিয়েছে জানো রাধা। ওর গান শুনলে নিজের যৌবন খুঁজে পাই। মনে আছে রাধা, কলেজের ক্লাসরুমে তুমি বেঞ্চ বাজাতে আর আমি গান গাইতাম!

সমাপ্তি আর নীলাদ্রি দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল পরিচিত মানুষগুলোর স্মৃতি রোমন্থনের সময়ে।

তারপর বিস্মিত হয়ে শুনছিল ওদের টুকরো টুকরো কথাগুলো। সমাপ্তি ভাবছিল, ওদের জেনারেশন এভাবে একজনের মুখের কথা বিশ্বাস করে নিজের অধিকার ছেড়ে কোনোদিন চলে আসবে না।

নীলাদ্রি বলল, স্ট্রেঞ্জ বাবা। তুমি আন্টিকে বুঝিয়ে কেন বলো নি? তাছাড়া ডি এন এ টেস্ট করলেই তো সত্যিটা উঠে আসত…

অনুরাধা বলল, আমি কিছু শুনতে চাইনি নীলাদ্রি। তোমার বাবা চেষ্টা করেছিলেন। আমি অবুঝ অভিমানে নিজের মনের সব জানালা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। পালটে গিয়েছিল পরিচিত অনুরাধা।

সমাপ্তি বলল, আঙ্কেল আপনি কী বলছিলেন যেন…মা বেঞ্চ বাজাত?

শর্মিলাপিসি কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গিয়েছিল।

কফিতে চুমুক দিয়েই নীলেশ বলল, তোমার মা একটা গুন্ডা মেয়ে ছিল। সাইকেল চালিয়ে কলেজে এসে শুরু করত তার গুন্ডামি। ইউনিয়নের ছেলেগুলো পর্যন্ত ভয় পেত তোমার মাকে। সবাই বলত, লড়াকু মেয়ে। প্রতিবাদী কণ্ঠে তোমার মা যখন ডিবেট লড়ত, তখন সবাই সমীহ করত। তোমার মায়ের সাথে আমার মতো নিরীহ ছেলের পরিচয় হবারই কথা নয়।

মাইনে দেবার লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম একদিন। সবাই এসে আমার আগে দাঁড়িয়ে মাইনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘামছিলাম।

তোমার মা এসে বলল, কি চিপকু, তোমার পায়ে কি ফেবিকল লাগানো আছে নাকি? সবাই এগোচ্ছে, তুমি সেম জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ? হাঁদা কোথাকারের। তারপর তোমার মা হয়ে গেল আমার অলিখিত অভিভাবক। আমি কোন শিক্ষককের কাছে পড়ব, কার কাছে গান শিখব সব উনিই ঠিক করে দিতেন। একদিন নিজেই বলেছিল, এই যে এত হেল্প করছি… কেন বলত?

আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কেন?

তোমার মা একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল, তোমার সারা জীবনের দায়িত্ব নেব বলে।

নীলাদ্রি হাততালি দিয়ে বলল, মাই গড, দারুণ প্রোপোজ টেকনিক তো। আমিও ভাবছি এবারে ইন্দিরাকে এভাবেই প্রোপোজটা সেরে নেব বাবা।

সমাপ্তি নীলাদ্রির হাতটা ধরে বলল, গ্রেট আইডিয়া ব্রাদার, আমিও আমার দু-বছরের ক্রাশ অরণ্যকে এভাবেই থ্রেড দিয়ে প্রোপোজ করব।

নীলেশকে ইশারায় ভর্ৎসনা করে অনুরাধা বলল, কী হচ্ছে কী, ছেলেমেয়ের সামনে! তুমি থামবে!

নীলাদ্রি বলল, না আন্টি বাবা বলুক, আমার তো ভীষণ ইন্টারেস্টিং লাগছে।

সমাপ্তির ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল।

ও আস্তে আস্তে বলল, আঙ্কেল আমরা অন্যদিন আসব। সব গল্প শুনব তোমাদের।

মা, বাবা ফোন করছে বারবার।

অনুরাধা নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলল, রোজ সকালে উঠে বাবাকে গানে বসিয়ে দেবে, তাহলে বাবার প্রাণশক্তি বাড়বে। ওটাই তো ওর প্রথম ভালোবাসা, আমি দ্বিতীয় ছিলাম।

আর খুব ঝাল যেন না খায়, পেট রোগা মানুষ তো।

নীলেশ সমাপ্তিকে বলল, মাকে বলো, আবার যেন গানটা গায়। তোমার মাও কিন্তু খালি গলায় গানটা বেশ ভালো গাইত। আর ইলিশ মাছ খেতে বড্ড ভালোবাসে রাধা।

অনুরাধা নিজের ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট টিফিন কৌটো বের করে বলল, এত বছর একই ভাবে বানিয়ে গেছি। ওবাড়ির কেউ খায় না। তবুও তিলের নাড়ু বানাই, কেন জানো? আমার অপটু হাতের শক্ত তিলের নাড়ু খেয়ে তুমি বলেছিলে, এটাই সেরা মিষ্টি আমার কাছে।

মুখে একটা নাড়ু ভরেই নীলেশ বলল, কিন্তু রাধা এ যে নিখুঁত নাড়ু। যোগ্য গৃহিণীর হাতের নাড়ু। আমার কলেজবেলার উড়নচণ্ডী রাধার অপটু এলোমেলো হাতের শক্ত নাড়ুগুলো কই? সব হারিয়ে ফেললে দেবনাথ বাড়িতে গিয়ে?

অনুরাধা হেসে বলল, আমি এখন মারাত্মক গিন্নি গো।

চললাম, আমার সংসার অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কাল কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো, ঢের কাজ পড়ে আছে।

নীলেশ হেসে বলল, ভালো থেকো রাধা। মাঝে মাঝে ফোন করো। আমার কিন্তু সেই অগোছালো অলক্ষ্মীটাকেই বেশি পছন্দ ছিল। এমন পালটে গেলে কেন?

অনুরাধা করুণ হেসে বলল, অলক্ষ্মীটাকে ভালোবাসার, প্রশ্রয় দেওয়ার কেউ ছিল না যে, তাই অনাদরে সে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে গেল।

বেরোনোর আগে মুচকি হেসে অনুরাধা বলল, আমায় ছেড়ে যে কোনো শাঁখচুন্নিকে বিয়ে করোনি, এই আমার ঢের সুখ। এবারে শান্তিতে মরতে পারব।

নীলেশ একই ভাবে হেসে বলল, তুমি এখনও সেরকম হিংসুটে আছো।

বাড়িতে ঢোকার মুখে সমাপ্তি বললো, মা আমি তার মানে তোমার মতো হয়েছি কি বলো? তুমিও তো শুনলাম প্রতিবাদী ছিলে…

ওর কথা শেষ হবার আগেই উমেশ বেশ রাগী গলায় বলল, মাঝরাত পর্যন্ত মা, মেয়ে কোথায় ঘুরছিলে? পাড়ার ফাংশন তো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া অনু, তুমি তো আমার পারমিশনও নাওনি যাবার আগে?

অনুরাধা নিরুদ্বিগ্ন গলায় বলল, রাতের খাবার বানাতে হবে, দরজা থেকে সর। হঠাৎ আমার পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল, তাই গল্প করতে করতে দেরি হল। তোমার সংসারের ঘড়ির কাঁটা একদিন না-হয় তোমার হুকুম ছাড়াই চলল, খুব কি ক্ষতি হল তাতে?

উমেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার ঊনত্রিশ বছরের প্রায় বোবা বউটার দিকে। এই মহিলা এমন গুছিয়ে কথা বলতেও পারে!

একটু হকচকিয়েই বলল, না, আমি চিন্তা করছিলাম। তাই বারবার ফোন করছিলাম অনু।

মা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রান্নাঘরের দিকে এগোল। পালটে যাওয়া মা-টাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছিল সমাপ্তির। এই মাকেই তো ও চায়।

পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আচমকা একটা চুমু খেয়ে সমাপ্তি কানে কানে বলল, মা নীলেশ আঙ্কেল কিন্তু তোমায় আজও বেশ ভয় পায়।

অনুরাধা হেসে বলল, ছাড় পাকা মেয়ে। তোর বাবাকে খেতে দিতে হবে।

মনে মনে বলল, নীলেশ একটা পরজন্ম চাই আমার। একটা ফাঁকা ক্লাসরুম আর অনেক বড় ক্যাম্পাস। আর একটা ভিতু ভিতু নীলেশ। দেখো পরের জন্মে আর ভুল বুঝব না তোমায়।

সকল অধ্যায়

১. সুখের আড়ালে – অর্পিতা সরকার
২. সেদিন ভোরে – অর্পিতা সরকার
৩. নাম বিভ্রাট – অর্পিতা সরকার
৪. রেড স্কুটি এবং.. – অর্পিতা সরকার
৫. অগোছালো সংসার – অর্পিতা সরকার
৬. ভালোবাসার রামধনু – অর্পিতা সরকার
৭. ইছামতীর তীরে – অর্পিতা সরকার
৮. অলক্ষ্মী – অর্পিতা সরকার
৯. বিজয়িনী – অর্পিতা সরকার
১০. অবহেলা দ্য কিটু সাকসেস – অর্পিতা সরকার
১১. মনের ডুবুরি – অর্পিতা সরকার
১২. ভালোবাসা মিসিং – অর্পিতা সরকার
১৩. লোকে পাগল বলে ডাকে – অর্পিতা সরকার
১৪. নিলামে উঠেছি আমি – অর্পিতা সরকার
১৫. হঠাৎ বৃষ্টি – অর্পিতা সরকার
১৬. রুমমেট – অর্পিতা সরকার
১৭. এক টুকরো সুখ – অর্পিতা সরকার
১৮. দ্য মিস্ট্রি অফ ফ্রেন্ডশিপ – অর্পিতা সরকার
১৯. যদি কখনো অজান্তে – অর্পিতা সরকার
২০. আট নম্বর রুম – অর্পিতা সরকার
২১. ফর এভার – অর্পিতা সরকার
২২. নিশ্চুপ পিয়ানো – অর্পিতা সরকার
২৩. চলো বন্ধু হই – অর্পিতা সরকার
২৪. সূর্যমুখী – অর্পিতা সরকার
২৫. বাবা – অর্পিতা সরকার

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন