অর্পিতা সরকার
কি রে এবারেও তোকে হারিয়ে বেরিয়ে গেল পৃথা?
স্বপ্নেশ আক্ষেপের সুরে বলল অভিষেককে।
ক্লাস নাইনের অভিষেক সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে বলল, জানিস পৃথার বড্ড অহংকার। ক্লাস এইট পর্যন্ত আমিই ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম। নাইনে উঠে হাফ-ইয়ারলি আর অ্যানুয়াল দুটো এক্সামেই আমাকে বিট করল। স্বপ্নেশ মুখে চিকচিক আওয়াজ করে বলল, টিউশনের মেয়েগুলো আমার লেগপুলিং করল রে। বলল, মেয়েদের কাছে হেরে গেলি!
হ্যাঁ রে অভি তুই কি নাইনে ফাঁকি দিয়েছিলি? আমাদের ক্লাসের স্ট্যাম্প মারা ফার্স্ট বয় তুই। সেই তুই কি না এভাবে প্রায় ছয় নম্বরের ব্যবধানে সেকেন্ড হয়ে গেলি?
অভিষেক আক্ষেপের গলায় বললো, ফাঁকি দেওয়া দূরে থাক বরং বেশি ট্রাই করেছিলাম। তবে একটা বিষয় খেয়াল করেছিস, পৃথা ক্লাসের কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলে না। স্বপ্নেশ বলল, এটা আমিও খেয়াল করেছি। মেয়েটা কেমন অন্যদের থেকে আলাদা। বড্ড চুপচাপ স্বভাবের। কারোর সঙ্গে কথা বলে না। এমনকি টিফিন টাইমেও নিজের বই খুলে বসে থাকে। কেন রে!
অভিষেক নরম হেসে বলল, আমার কাছেও তো রহস্য রে। এই জন্যই বয়েজ স্কুলে পড়া দরকার বুঝলি। এই টিউশনে গিয়ে শুনতে হবে মেয়ের কাছে হেরে গেলি!
কেন রে বাবা, ছেলে বলে কি এক্সট্রা দুটো মাথা আছে? নাকি মেয়েদের ফার্স্ট হতে নেই! কে বুঝবে কার কথা। টিউশনে ঢুকলেই শুরু হবে লেগপুলিং। অবশ্য এসব বেশিদিন চলবে না। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে এবারে তো একটু খোঁজ লাগাতে হচ্ছে রে স্বপ্নেশ পৃথা কার কাছে টিউশন পড়ে!
অভিষেকের বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাকাউন্টসে আছে। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি ঠিকই কিন্তু ছেলের পড়াশোনায় কোনো কার্পণ্য ছিল না বাবার। বাবার ইচ্ছে অভিষেক বড় হয়ে শিক্ষকতা করুক। মা নেহাতই সাধাসিধে মানুষ। অভির আর ওর বাবার যাতে কিছুতেই অসুবিধা না হয় সেটা দেখাই যেন মায়ের একমাত্র লক্ষ্য। নিজের ছোট্ট সংসারটা নিয়ে বড্ড সুখী থাকে মা। অভিষেক ওর বাবা-মায়ের মধ্যে কোনোদিন মনোমালিন্য দেখেনি।
সুখী পরিবার ওদের। অভিষেকের ধ্যানজ্ঞান পড়াশোনা করা। পড়াশোনা করতে ওর ভালো লাগে। কাউকে জোর করে বলতে হয় না পড়তে বোস।
সেই নার্সারী থেকে ওকে কেউ সেকেন্ড করতে পারেনি। এই প্রথম ক্লাস নাইনে এসে ওর পজেশন চেঞ্জ হয়ে গেল। ও সেকেন্ড হয়ে গেল।
অভি জানে ওর বাবা-মা ওকে এজন্য বকবে মারবে না। তবুও মনখারাপি বাতাসটা কেবল ওকে ঘিরেই ঘোরাফেরা করছে। আর মনের মধ্যে তীব্র জেদ কাজ করছে, পৃথাকে হারাতেই হবে টেস্টে।
পৃথার মুখে হাসির রেখা দেখতে পায়নি। প্রথম হওয়ার জন্য চোখে কোনো গর্বের চিহ্নও যেন নেই। নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় রিপোর্ট কার্ডটা নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো ক্লাস থেকে। ও বেরিয়ে যাবার পরেই সবাই কানাঘুষো করছিল, বাপরে কী অহংকার পৃথার। ফার্স্ট হওয়াটা যেন কোনো ব্যাপারই নয় ওর কাছে! তাই মুখের কোনো রেখায় উচ্ছ্বাসটুকু পর্যন্ত নেই। ওদের নেতাজী ইনস্টিটিউশন থেকে যে সমস্ত স্টুডেন্টরা স্ট্যান্ড করে বেরোয় তারা একেকজন জুয়েল। এটা এ অঞ্চলের সকলে জানে। অন্য স্কুলের স্টুডেন্টরা এই স্কুলের স্টুডেন্টদের একটু সমীহর চোখেই দেখে। সেখানে পৃথার এমন নিরুত্তাপ মুখ দেখে সকলের মনেই একটাই কথা এসেছে, মেয়েটি বড্ড অহংকারী। ক্লাস ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত পৃথা দশের মধ্যে থাকত ঠিকই কিন্তু তাই বলে একেবারে প্রথম!
চুপচাপ বলেই ক্লাসের কেউ ওকে সেভাবে কোনোদিন নোটিশও করেনি। ভিড়ে মিশে যাওয়া একেবারেই সাধারণ চেহারার মেয়ে ও।
কিসের যে এত অহংকার কে জানে! কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব নেই, অদ্ভুত একলা থাকা স্বভাবের মেয়ে।
অভি মনে মনে ভাবল, মেয়েটার ডিটেলস জানতে হবে। কতক্ষণ পড়ে, কোন টিউশনের কাছে পড়ে সব। তার জন্য বন্ধুত্ব করাটা খুব জরুরি।
স্বপ্নেশকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে হাওয়ার বেগে এগিয়ে গেল অভি। স্কুল গেট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে পৃথা। সম্ভবত সুভাষনগরের দক্ষিণ পাড়ায় থাকে ও। দক্ষিণপাড়ায় যাওয়ার ওটাই শর্ট কাট রাস্তা।
দুপাশে রাধাচূড়া গাছের সারি। একা রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পৃথা। পরণে মিলিটারি পাড় সাদা শাড়ি। এটাই ওদের স্কুলের পোশাক। ক্লাস নাইন থেকে শাড়ি পরতে হয় মেয়েদের। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। দুদিকে চুল বাঁধা।
পৃথাকে দেখতে পেয়েই ওর এতক্ষণ জোরে প্যাডেল করা পা দুটো থমকে গেল।
কী বলবে ও পৃথাকে? বন্ধুত্ব করতে চাই?
যদি পৃথা মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলে আমি একলাই বেশ ভালো আছি.. তাহলে!
কী করা উচিত অভিষেকের? ফিরে চলে যাওয়া উচিত? নাকি…ভাবতে ভাবতেই দায়িত্বটা মাথা থেকে মনের ওপরে অর্পণ করে দিল ও।
মন অবলীলায় পৃথার পাশে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে বলল, হিস্ট্রিতে কত হল তোমার?
কথাটা বলে ফেলার পরেই আবার মাথাটা কাজ করল অভির। কিন্তু ততক্ষণে মুখের কথা হাতের ঢিলের মতোই ওর কবজায় নেই।
আনমনে রাস্তা হাঁটছিল পৃথা। আচমকা পিছন থেকে এমন প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়াল পৃথা।
ঘাড় ঘুরিয়ে অভিষেককে দেখতে পেয়ে বলল, ৮৯ হয়েছে হিস্ট্রিতে। তোমার তো ৮২ তাই না?
পৃথাকে অন্য বন্ধু-বান্ধবীদের মত তুই করে ডাকতে পারল না অভি। নয়না, সোনালি, সঞ্জনা এদের তো তুই বলে ও। তাহলে ক্লাসমেট হিসাবে পৃথাকে কেন তুই বলে সম্বোধন করতে পারল না কে জানে!
অভিষেক ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল। পৃথা হেসে বলল মন খারাপ? সেকেন্ড হয়েছ বলে?
অভিষেক কিছু বলার আগেই পৃথা অদ্ভুত হেসে বলল, মন খারাপ করো না। ফার্স্ট সেকেন্ড তো একটা সংখ্যা মাত্র। পড়তে ভালোলাগাটাই আসল।
বইয়ের অক্ষরে কত রহস্য লুকিয়ে আছে বলতো, সেগুলো আবিষ্কার করাটাই তো আসল মজা।
অভিষেক বলল, তুমি কোন টিউশনে পড়? সঞ্জীব স্যার না অরুণ স্যারের কাছে?
পৃথা আচমকা বলল, আমি আসছি, দেরি হয়ে যাচ্ছে। পরে গল্প করব।
জোরে পা চালাল পৃথা। অভিষেক একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবল, এত হিংসুটে মেয়েটা!
স্বপ্নেশ বোধহয় ঠিকই বলেছিল, পৃথা কাউকে কিছু বলবে না বলেই চুপচাপ থাকে ক্লাসে।
ক্লাস টেনে ওঠার পরে পড়াশোনা নিয়ে সকলেই একটু বেশি তৎপর হয়ে উঠল। অভিষেক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল এবারে পৃথাকে হারাতেই হবে।
মেয়েটার বড্ড অহংকার।
সেদিনও স্কুল থেকে বেরিয়ে আনমনে হাঁটছিল পৃথা। ওকে দেখে একটু জোরেই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিল অভিষেক। আর কোনোদিন ওই মেয়েটার সঙ্গে কথা বলবে না ও। কোনোদিন না।
আচমকাই ওর চোখের সামনে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ল পৃথা। সাইকেলে ব্রেক কষে দাঁড়াল অভিষেক। পৃথার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হল পড়ে গেলে কী করে?
নিজের হাতটা বাড়িয়ে বলল, ওঠো।
পৃথা অভিষেকের বাড়ানো হাতটা ধরতেই ও অনুভব করল মেয়েটার গায়ে প্রবল জ্বর। চোখদুটোও বেশ লাল।
অভিষেক বলল, একি পৃথা তোমার তো জ্বর এসেছে। স্কুলে জ্বর নিয়েই বসে ছিলে তুমি?
পৃথা আরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ও কিছু না। কমে যাবে একটু পরেই। তুমি এসো। আমি চলে যাচ্ছি।
অভিষেক চিন্তান্বিত স্বরে বলল, তাই হয় নাকি? চলো আমার সাইকেলে বসো আমি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। পৃথার দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই, সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অভিষেকের সাইকেলের রডে কোনোমতে বসে বলল, আমায় বাড়ির একটু আগে নামিয়ে দিও বেশ। বাবা দেখলে বকবে। অভিষেক হেসে বলল, তাই হবে।
পৃথা জড়ানো গলায় বলল, তোমায় আমি কয়েকটা জিনিস চাইব দেবে?
অভি দ্বিধা না করেই বলল, বলো না কি চাও।
পৃথা বলল, সব সাবজেক্টের রেফারেন্স বুকসগুলো আমায় কয়েকদিনের জন্য ধার দেবে প্লিজ?
অভি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, আমার দুটো করে পাবলিশারের রেফারেন্স বুক আছে। আমি তোমায় একটা করে দেব কয়েকদিনের জন্য।
পৃথা ওর উষ্ণ হাতটা অভির হাতের ওপরে রেখে বলল, থ্যাংক ইউ। কেউ কখনও আমাকে এতটা বিশ্বাস করেনি।
ওর বাড়ি কোনটা জানা হল না অভির। আচমকাই পৃথা বলল, এখানে নামিয়ে দাও প্লিজ।
অভি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে পৃথার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবল, মেয়েটা কি সত্যিই অহংকারী নাকি একটু বেশিই চুপচাপ। যে দুদিন কথা বলল, তখন তো খুব ভালো করেই কথা বলছিল। কে জানে মেয়েটা আসলে কী!
কয়েকটা বাচ্চা জোরে ফুটবলটা ছুঁড়ল অভির দিকে। পৃথাদের পাড়ার পাশেই একটা ফুটবল খেলার মাঠ। আপাতত সেখানে কিছু পুচকে একটা ফুটবল নিয়ে ছোটাছুটি করছে। অভি সাইকেল থেকে নেমে ফুটবলটাতে জোরে শট মারল।
ছেলেগুলো হাততালি দিয়ে উঠল।
পিছন ফিরে দেখল, একটা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে পৃথাও হাততালি দিল।
লজ্জা পেয়েই জোরে সাইকেল চালাল অভি।
কি করে যেন গোটা ক্লাসের কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব না হলেও অভির সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল পৃথার। ক্লাসে ঢুকেই পৃথার চোখদুটো অভিকে খুঁজত। বন্ধুরা অভিকে আড়ালে বলত, কী রে প্রেমে পড়েছিস নাকি!
প্রেম, ভালোবাসার কথা জানত না অভি। শুধু বুঝত পৃথার বলা ওই নরম শব্দগুলো ওর মন জুড়ে অনুরণন করে। আলতো একটা অচেনা অনুভূতি ছুঁয়ে যায় ওকে।
এত ভারী ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যেতে পারবে পৃথা?
সব রেফারেন্স বইয়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে পৃথা বলেছিল, না পারলে কি পৌঁছে দিয়ে আসবে?
সেদিনও অভির সাইকেলের রডে বসে বাড়ি ফিরেছিল পৃথা। রাস্তার দুধারে রাধাচূড়া গাছের হলদে ফুল গন্ধবিহীন। তাহলে অভির নাকে এসে যে হালকা নরম গন্ধটা ঝাপটা দিচ্ছে সেটা কীসের গন্ধ?
পৃথা কি আজ শ্যাম্পু করেছে?
পৃথা ভূমিকা না করেই বলে বসল, বহু বহু বছর পরে যদি আমার সঙ্গে তোমার দেখা হয় কোনো ভিড় রাস্তার মোড়ে, সেদিন আমায় চিনতে পারবে অভি?
নাকি পাশ কাটিয়ে চলে যাবে!
মেয়েরা কি ছেলেদের থেকে একটু বেশিই বুদ্ধিমতী হয়? কে জানে! কিন্তু পৃথার বলা কথার অর্থ না বুঝতে পেরেই অভি বলল, তোমার সঙ্গে তো কালকেই দেখা হবে। আর প্রবীর স্যারের লাইফ সায়েন্স ক্লাসে আমি খুব বকা খাব দেখো। পড়া হয়নি আমার। দেখি বাড়ি ফিরে আগে পড়তে বসতে হবে।
পৃথা আলতো হাত রাখল অভির হাতের ওপরে। শান্ত গলায় বলল, গোটা ক্লাস হয়তো ভুলে যাবে আমায় অভিষেক। কিন্তু প্লিজ তুমি মনে রেখো আমায়। মনে রেখো আমি ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়ার জন্য পড়ি না। শুধু কালো অক্ষরদের ভালোবেসে পড়াশোনা করি।
বললে না তো, বহু বছর পরে যদি হঠাৎ দেখা হয় কোনো বৃষ্টি ভেজা পথের বাঁকে আমায় চিনতে পারবে অভি?
অভি অবাক গলায় বলল, কেন চিনতে পারব না। নিশ্চয়ই পারব। ভুলে যেতে যাবই বা কেন?
লাল-সাদা ডুড়ে সুতির ছাপা শাড়ি পরা শ্যামলা রঙের বউটা বলে উঠল, তোদের হেড মাস্টারমশাই ক্লাস নাইনে ইতিহাসে ৮২ পেয়েছিল বলে তার ভারী গোঁসা হয়েছিল জানিস তো জিনিয়া! চমকে তাকালো অভিষেক সেনগুপ্ত।
পলাশপুরের রাজা রামমোহন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিষক সেনগুপ্ত। বছরখানেক হলো এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে এসেছে ও। নিজের বাড়ি সুভাষনগর থেকে মাত্র একটা স্টপেজ পরেই পলাশপুর, তাই বাড়ি থেকেই নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারে ও। নিজের ইচ্ছেতেই সন্ধের দিকে পলাশপুরের লাইব্রেরি রুমে একটা কোচিং সেন্টার খুলেছে ও। রাজা রামমোহন বিদ্যালয়ের ব্রিলিয়ান্ট ছেলেমেয়েদের বিনামূল্যে কোচিং দেবে বলে।
ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিষেকের সদুদ্দেশ্য দেখে আরও জনা পাঁচেক লোকাল শিক্ষক-শিক্ষিকাও এগিয়ে এসেছেন।
ক্লাস নাইনের ফার্স্ট গার্ল জিনিয়া রায় মুচকি হেসে বলল, তাই নাকি স্যার? সত্যি?
অভিষেক অবাক গলায় বলল, উনি কে জিনিয়া?
জিনিয়া মেয়েটা বেশ স্মার্ট ভঙ্গিমায় বলল, আমার মা। জানেন স্যার এতদিন পর্যন্ত আমার মা আমাকে সব পড়াত। মা খুব ভালো অঙ্ক পারে।
অভিষেক লাইব্রেরি রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল জিনিয়ার মায়ের সামনে।
মুখের আদলে একটু মিল খুঁজে পেলেও চেহারা বদলেছে আমূল। কত ঝড় বয়ে গেছে যেন এই শরীরের ওপর দিয়ে। বিয়াল্লিশ বছর দেখে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেছে কবেই। চোখের পাতায় অনেক ঘুম জমে আছে। ঠোঁটের করুণ হাসিতে অনেকটা ক্লান্তি জমাট বেঁধেছে। অভিষেক বলল, তুমি কি পৃথা?
পৃথা গায়ে কাপড়টা আরেকটু জড়িয়ে লজ্জা জড়ানো গলায় বলল, কথা দিয়েছিলে ভিড় রাস্তার মোড়ে দেখলেও চিনতে পারবে। পারলে কই?
গত এক বছর ধরে রোজ নিজের বাড়ির এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেতাম তুমি বাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতে। দুদিন তো মুখোমুখিও হলাম আমরা। চিনতে পারলে কই অভি?
গলাটা ধরে এল পৃথার।
অভিষেক অভিমানী গলায় বলল, কথা তো অনেকেই অনেক কিছু দিয়েছিল পৃথা, কেউ কি রেখেছে?
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনলাম সোনালির কাছে.. তুমি নাকি পরীক্ষা দিতে আসনি। প্রতিদিনই সোনালির কাছে খবর নিয়েছি, তুমি এলে না। এগজামটা দিলে না। তোমাদের পাড়ায় পরীক্ষার পরে বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে। বেপাড়ার ছেলে দেখে বেশ কয়েকজন মিলে খুব বকেছিল।
এমন ভাবে নিজেকে লুকিয়ে নেবার কথা কি তুমিই দিয়েছিলে পৃথা?
পৃথা মুচকি হেসে বলল, তুমি আমার থেকে কম পাবে জেনেই এগজাম দিইনি। বুঝলে!
অভিষেক কথা বলার আগেই পৃথা বলল, গোঁফ রেখেছ? এই গোল্ডেন ফ্রেমের চশমাতে তোমাকে ভারী মানিয়েছে।
আর তোমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন? সেটার কি হল পৃথা?
পৃথা উত্তর না দিয়েই বলল, ফাঁকিবাজ স্যার বলবে তোমায় তোমার স্টুডেন্টরা। যাও ক্লাসে যাও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল অভিষেক সন্ধে সাতটা বাজে। বেশিরভাগ স্টুডেন্ট এসে গেছে।
ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে এল অভিষেক। একরাশ প্রশ্নের ঝুলি মাথার মধ্যে অনবরত আঘাত করতে লাগল। জিনিয়া পৃথার মেয়ে? পৃথা কেন এভাবে হারিয়ে গিয়েছিল ওদের স্কুল থেকে!
পৃথাকে দেখে মনে হল খুব নিম্নবিত্ত অবস্থার মধ্যে আছে।
জিনিয়াকে কিছু প্রশ্ন করতে সাহস হল না অভিষেকের। যদি তেমন কোনো সত্যি উঠে আসে ওর সামনে! বরং থাক স্মৃতির হলদে পাতায় চুপটি করে।
অভিষেক জিনিয়ার খাতায় দেখল, সেই পরিচিত হাতের লেখা। লালকালিতে প্রশ্ন আর নীলকালিতে উত্তর লেখা আছে। বড্ড গোছানো খাতা। এমন করেই সব শর্ট কোশ্চেনের উত্তরগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে অভিষেককে দিয়েছিল পৃথা। বলেছিল, এই নাও তোমার রেফারেন্স বুকগুলো ফেরত দিলাম। আর এই যে সব সাবজেক্টের আলাদা আলাদা খাতা। মন দিয়ে পড়বে। অভি তুমি যদি বড় হয়ে শিক্ষক হও তাহলে আমার একটা কথা রাখবে?
তুমি গরিবদের বিনামূল্যে টিউশন দিও।
বাড়ি এসে খাতাগুলো দেখে চমকে উঠেছিল অভি।
সুন্দর হাতের লেখায় খুব গুছিয়ে প্রশ্ন আর উত্তর লেখা রয়েছে।
খাতাগুলো দেখতে দেখতে বাংলা খাতার শেষ পাতায় চলে গিয়েছিল অভি।
বার দুইয়েক অভিষেক নামটা লিখে কেটে দিয়েছে পৃথা। হয়তো আরও কিছু বলার ছিল ওর। সঙ্গে ছিল ভাঁজ করা একটা ছোট্ট চিঠি।
খুব ভালো করে পরীক্ষা দিও। স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করো। শেষ হয়ে যাওয়া পথের শেষে নিশ্চয়ই দেখা হবে একদিন।
সেদিন ওই চিঠির মানে কিছুই বোঝেনি অভিষেক। শুধু বুঝেছিল অনেক যত্ন করে দিনরাত এক করে এই খাতাগুলো রেডি করেছে পৃথা ওর জন্য।
টেস্টের পরে আর তেমন দেখা হয়নি পৃথার সঙ্গে। যে যার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল।
তারপর পরীক্ষা দিতে গিয়ে শুনেছিল, পৃথা পরীক্ষা দিতে আসেনি।
অভিষেকের জীবন থেকে বড্ড আচমকা হারিয়ে গিয়েছিল পৃথা। কিন্তু ওই খাতাগুলো যত্ন করে রেখে দিয়েছিল ও।
টুয়েলভ পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিল অভিষেক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথা নামের মেয়েটা মুছে গিয়েছিল মন থেকে। আজ কতদিন পরে আবার দুজনে দুজনের সম্মুখীন হল। পৃথার কথা শুনে মনে হল এই যে গতকাল ওরা স্কুলের ক্লাস করে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজ আবার দেখা হয়েছে। কোনো সংকোচ নেই ওর গলায়। কিন্তু অভিষেক কেন সহজ হতে পারছিল না ওর সামনে!
আসলে পৃথা হারিয়ে যাবার আরও বছর খানেক পরে অভি বুঝতে পেরেছিল, পৃথা ওকে ভালোবেসেছিল। তাই খাতার পিছনে ওর নাম নিয়ে কাটাকুটি খেলা খেলেছিল।
হয়তো একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অভিষেক। দিব্যেন্দু বলে ক্লাস ইলেভেনের ছেলেটা সাগ্রহে বলে উঠল, স্যার এবারে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে কি আগেরবারের মতোই প্যান্ডেল হবে স্কুলের মাঠে?
আর তো বেশিদিন নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
অভিষেক ঘাড় নেড়ে বলল, হবে। আগের বারের মতোই হবে।
নেতাজী ইন্সটিটিউশনের মাঠে প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছিল। অভিষেকরা সেদিন পাঞ্জাবি পরে স্কুলে এসেছিল। আড়চোখে দেখেছিল মঞ্চের সামনে একমনে আল্পনা দিচ্ছিল পৃথা।
অভিষেক আর স্বপ্নেশ এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, হেল্প করব?
পৃথা স্বপ্নেশকে বলেছিল, চক শেষ হয়ে এসেছে, অফিস থেকে একটু এনে দিবি?
স্বপ্নেশ ছুটেছিল।
অভিষেকও স্বপ্নেশের পিছু নিতেই পৃথা বলেছিল, চক কি খুব ভারি হয় নাকি? ও একাই আনতে পারবে। অভিষেক বোকার মতো দাঁড়িয়ে বলেছিল, তাহলে আমি কী করব?
কবিগুরুর কটা লাইন বলো ….আল্পনার মাঝে লিখব।
অভিষেক বলেছিল
‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কী পাও?
তারি রথ নিত্য উধাও।
জাগিছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন
চক্রে পিষ্ট আধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু…..’
লাইনগুলো লিখতে লিখতে সেদিন পৃথা বারবার তাকিয়েছিল অভিষেকের দিকে।
তারপর নিজেই বলেছিল, শোনো এই দুটো লাইন কেমন লাগবে বলতো..
‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
এবার হৃদয়-মাঝে লুকিয়ে বোসো, কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।’
অভি হেসে বলেছিল, একদিন কবিতা লড়াই হবে তোমার সঙ্গে আমার।
পৃথা আনমনে লিখেছিল….’সময় কোথা সময় নষ্ট করবার। আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই; দূরে যাবে তুমি’…
স্যার আবার পরশু দিন ক্লাস নেবেন?
অভিষেক ওদের দেওয়া হোমওয়ার্কের খাতাগুলো চেক করতে করতে বলল, আগামীকাল শুভেন্দু স্যারের ক্লাস আছে। কেউ কামাই করবে না।
ক্লাস থেকে বেরিয়েই অভিষেকের চোখ দুটো উদ্ভ্রান্তের মত খুঁজছিল পৃথাকে।
জিনিয়া ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল…
অভিষেক ডেকে বলল, জিনিয়া তুমি কি একাই ফিরবে বাড়িতে? মা আসেননি?
জিনিয়া একটু ইতস্তত করে বলল, না মা তো আর আসবে না। মা আজ আপনার সঙ্গে আলাপ করবে বলেই এসেছিল। আমার বাড়ি এই পলাশপুরেই। খুব দূরে নয়। চলে যাব।
অভিষেক বলল, আমার বাইকের পিছনে বোসো। আমি তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি।
স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বাইকে বসতে ভয় পাচ্ছিল জিনিয়া। অভিষেক বলল, ভয় নেই, বোসো।
জিনিয়ার বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল অভিষেকের বাইকটা।
পৃথাকে যতবার স্কুল থেকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে অভি কোনোদিন পৃথা ওর বাড়ির হদিস দেয়নি। এই প্রথম ওর বাড়িতে এল অভিষেক। যদিও এটা ওর পুরোনো ঠিকানা নয়। শ্বশুরবাড়ি বোধহয়। সুভাষনগরে ওদের বাড়িটা ঠিক কোথায় ছিল, আজও জানা হল না অভিষেকের। এটা ছোট্ট একতলা বাড়ি। টিনের চালের দুটো ঘর। সামনে একটুকরো উঠোন।
জিনিয়া বলল, স্যার আসুন ভিতরে আসুন। মা ভিতরে আছে।
অভিষেক বলল, তোমার মাকে আগে জিজ্ঞেস করে এসো, সে যদি যেতে বলে তবেই যাব।
ওদের কথার মাঝেই পৃথা এসে সামনে দাঁড়াল। চমকে উঠে বলল, তুমি? তুমি কেন এলে এখানে?
অভিষেক অপলক তাকিয়ে বলল, সহপাঠী ছিলাম। ভালো বন্ধু ছিলাম তবুও কেন বলে উঠতে পারলে না পৃথা? এভাবে নিজেকে বলি দেবার আগে একবার তো বলতে পারতে?
পৃথা বলল, এসো ভিতরে এসো।
তুমি এই পৃথাকে দেখো এটা আমি চাইনি অভি। তুমি কেন গোটা ক্লাসের কেউ জানুক সেটাই তো চাইনি।
একটা চেয়ারে বসে অভিষেক বলল, দরিদ্রতা কি তোমার দোষ পৃথা?
পৃথা আনমনে বলল, উঁহু, গরিবদের স্বপ্ন দেখা পাপ। স্কুলের ফার্স্ট গার্ল হওয়া পাপ। দামি টিফিন না নিয়ে স্কুলে যাওয়া পাপ। ভালো রেফারেন্স বুক, টিউশন না থাকা পাপ।
আর সব থেকে বড় পাপ কী জানো? যার বাবা নিয়ম করে মদ খেয়ে এসে তার দুই সন্তানকে আর তাদের জন্মদাত্রীকে সারারাত পিটিয়ে হাতের সুখ করে সেটা প্রকাশ পেয়ে যাওয়া! এত বড় বড় অন্যায় থাকা সত্ত্বেও অক্ষরকে ভালোবাসা সব থেকে বড় ভুল।
আমার বাবা লরি ড্রাইভার ছিল। রোজগার খারাপ করত না। কিন্তু নেশার টানে কিছুই টিকল না। এমনকি আমিও বিক্রি হয়ে গেলাম। যে বাড়িতে ধার নিয়েছিল, সেই বাড়িতে বাসন মাজার কাজে লাগিয়ে দিল বাবা আমাকে। তারপরেও মাধ্যমিক দেব ভেবেছিলাম জানো অভি। কিন্তু ঠিক ওইসময় বাবা জেলে গেল চুরির দায়ে। তাই আর পরীক্ষাটা দেওয়া হল না। লোকের বাড়িতে কাজ করতে করতে তারাই একদিন বিয়ের ব্যবস্থা করল।
আমার স্বামী মানুষটা খারাপ ছিল না জানো। দিনরাত পরিশ্রম করত। আমাকেও ভালোবাসতো খুব। কিন্তু আচমকাই একটা অ্যাক্সিডেন্টে তার একখানা পা গেল। তারপর থেকে কাজ করে, কিন্তু সেভাবে পারে না। ইদানিং সেই জন্য একটুতেই রেগে যায় মানুষটা। আমিই রাখী তৈরি করি, সেলাই করি। এসব করে চলে যায়। তবে জিনিয়ার বাবা মানুষটা আমাকে বোঝে জানো।
অভিষেক বুঝতেই পারেনি সেই স্কুলের অহংকারী তকমা দেওয়া মেয়েটা আসলে নিজের দারিদ্রতাকে ঢেকে রাখতে আপ্রাণ লড়াই চালাচ্ছিল।
ওরা সবাই ভাবত কেন পৃথা কারোর সঙ্গে মেশে না। আসলে পৃথা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইত।
হঠাৎই বলে উঠল, অভিষেক কী বুঝছো বলো, আমার মেয়ের পড়াশোনা হবে? জিনিয়াকে আমি বলে দিয়েছি, ক্লাস নাইনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। খবরদার সেকেন্ড বয়ের প্রেমে পড়বি না। বলেই মুচকি হেসে বলল, চা খাবে? দাঁড়াও করে আনছি।
চা খেতে খেতে অভিষক বলল, আমার স্ত্রী রেলে জব করে। কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। আমার ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওরা কলকাতাতেই থাকে। আমি ছুটিতে যাই, ওরাও আসে।
পৃথা বলল, তোমার স্ত্রীকে আমি দেখেছি। তোমার পাশে ভারী মানিয়েছে জানো।
অভিষেক বলল, পৃথা আমার একটা শর্ত আছে। বন্ধু হিসাবে এটুকু দাবি আমি করতেই পারি তোমার কাছে। তোমার নোটস পড়ে মাধ্যমিকে আমি জেলার সেরা হয়েছিলাম। তাই কিছু দায়িত্ব আমারও থেকেই যায়।
পৃথা হেসে বলল, আমি পরীক্ষাটা দিইনি তাই তুমি জেলার সেরা হতে পেরেছিলে। হিংসুটে কোথাকার। দুবার সেকেন্ড হয়ে গিয়েছিলে বলে কি রাগ!
অভিষেক হেসে বলল, হ্যাঁ সেটাই। সব বিষয়ে তুমি আমায় হারিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাবে এটা তো হতে পারে না!
তোমায় আবার পড়তে হবে পৃথা। জিনিয়া আর তুমি একই সঙ্গে পরীক্ষায় বসবে। পৃথা নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমী হাত দুটো দিয়ে মুখটা ঢেকে বলল, এটুকুই বাকি আছে। মেয়ের সঙ্গে পড়তে বসা। তুমি সত্যিই এখনও বড় হলে না। অভি, তুমি না স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এই তোমার বুদ্ধি!
অভিষেক অভিমানী গলায় বলল, সে আমার বুদ্ধি নাই থাকুক। সে আমি একজনের কাছে বোকাই নাহয় রয়ে গেলাম। কিন্তু আমার এ আব্দারটা তোমায় রাখতেই হবে।
পৃথা বলল, কিন্তু পড়ার সময় পাব কখন? জিনিয়ার বাবা যদি কিছু বলে?
অভিষেক বলল, তুমি তো ফার্স্ট সেকেন্ড হবে বলে পড়তে না পৃথা। তুমি তো পড়তে অক্ষরকে ভালোবেসে। হেরে যাওয়ার অনেক অজুহাত থাকে জানো তো। সাফল্যের কোনো অজুহাতের প্রয়োজন হয় না। সে শুধুই মাথা তুলে বলে আমি জিতেছি। জিততে চাও না পৃথা?
পৃথার ঘরের অল্প আলোয় ওর শ্যামলা মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলল, চাই। নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করা বাকি রয়ে গেছে। আমি চাই অভি।
অভিষেক বলল, আজ থেকে তোমার পড়ার সব দায়িত্ব আমার। আর সব নোটস আমি পাঠিয়ে দেব জিনিয়াকে দিয়ে। সন্ধেবেলা ফ্রি কোচিং সেন্টারে যেন তোমায় অনুপস্থিত না দেখি।
আর তোমায় প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবার সব ব্যবস্থা করে দেব আমি। কি রাজি তো?
পৃথা বলল, ইয়েস স্যার। তখন তোমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা ছিল, এখন জিনিয়ার সঙ্গে করব। জিনিয়া মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি মা…তুমি আবার পড়বে? আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।
পৃথা ভরাট গলায় বলল, আমি পারব তো অভি?
অভিষেক নিশ্চিন্ত গলায় বলল, আমার বিশ্বাস নেতাজী ইন্সটিটিউশনের ফার্স্ট গার্ল সব পারবে।
স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করছি পৃথা। জিনিয়াকে একটা কবিতা শিখিয়ে দিও। ওই যে সেই কবিতাটা…
পৃথা বলল, ওটা কবিতা ছিল না স্যার। ওটা ছিল প্রবন্ধ। যেটা আমি পাঠ করেছিলাম স্কুলে।
অভিষেক বলল মনে আছে…
‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় অনেক তফাত আছে, কিন্তু ঝটকরিয়া সে তফাত ধরা যায় না।
বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকি। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালোবাসার পোশাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালোবাসা তাহা সয় না’
অভির বলা শেষ হতেই পৃথা বলল, অভি তুমি তখন আমার ভালোবাসা ছিলে বোধহয়। তাই তোমার কাছে নিজের দীনতা দেখাতে লজ্জা পেয়েছি। আজ আর লজ্জা নেই, সংকোচ নেই। বুঝলাম, এতদিনে তুমি আমার বন্ধু হলে।
আশাকরি তোমার এই বন্ধুত্বের মর্যাদা আমি রাখতে পারব। আমি আবার পড়ব অভি, আবার বইয়ের গন্ধ নেব প্রাণ ভরে।
অভি বলল, আমি জানি তুমি পারবে। মায়েরা হেরে যায় না জানো। ঠিক জিতে যায়। তুমি তো এখন জিনিয়ার মা। তাই জয় তোমারই হবে।
পৃথা হাসিমুখে বলল, জিনিয়া আমার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার অবলম্বন।
অভিষেক ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় বলল, সময় কোথা সময় নষ্ট করবার….আমি থাকব তোমার পাশে, তোমাকে যেতে হবে বহুদূর।
অভিষেক বেরিয়ে গেল বাইক নিয়ে।
পৃথা মনে মনে বলল,
‘আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু-বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না
তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে—
তাই ব’লে হাল ছেড়ে দিয়ে ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না।।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন