প্রিয় চরিত্র

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রিয় চরিত্র

বড় মুশকিলে পড়িয়াছি। জনৈক সম্পাদক জানিতে চাহিয়াছেন, আমার সৃষ্ট চরিত্রের মধ্যে আমি কোন্‌টিকে বেশী ভালবাসি।

এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কি সহজ? ত্রিশ বছর ধরিয়া গল্প লিখিতেছি। কত চরিত্র ছায়াবাজির মতো চোখের সামনে দিয়া চলিয়া গিয়াছে; তাহাদের মধ্যে দুই চারিটিকে কাগজের উপর কালির আঁচড় কাটিয়া ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু ভালবাসিবার অবকাশ পাইলাম কৈ? ভালবাসিতে হইলে দু’চার দিন একসঙ্গে থাকিতে হয়, জীবনের শীত-গ্রীষ্ম শরৎ-বসন্ত একসঙ্গে ভোগ করিতে হয়, হাসি-কান্নার ভাগ লইতে হয়। তারপর, ভালবাসা যদি বা জন্মিল, ভালবাসা কতদিন থাকে? সাবানের বুদ্বুদের মতো নানা রঙের খেলা দেখাইতে দেখাইতে হঠাৎ এক সময় ফাটিয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। আমার হৃদয়েও কত বুদ্বুদ ফাটিয়াছে তাহার কি হিসাব রাখিয়াছি? অতীতে কাহাকে ভালবাসিয়াছিলাম, এবং এখন কাহাকে বেশী ভালবাসি তাহা কেমন করিয়া বলিব!

আমার অপবাদ আছে আমি গজদন্ত স্তম্ভের চূড়ায় বাস করি। যাঁহারা আমাকে এই অপবাদ দিয়া থাকেন, তাঁহাদের চোখে যদি ধূম্র কাচের চশমা না থাকিত তাহা হইলে তাঁহারা দেখিতে পাইতেন, স্তম্ভটা গজদন্তের নয়, চুনকাম করা ইটপাথরের। বেশ মজবুত স্তম্ভ, পাকানো সিঁড়ি দিয়া ইহার ডগায় উঠিলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তবে স্তম্ভের মাথায় যাহারা বাস করে তাহাদের জীবনে সঙ্গী-সাথী বেশী জোটে না, আমার জীবনও একটু নিঃসঙ্গ।

একদা রাত্রিকালে আমি স্তম্ভশীর্ষে বসিয়া নিজের মুশকিলের কথা চিন্তা করিতেছি, মৃৎপ্রদীপটি মিটিমিটি জ্বলিতেছে, এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। বিস্মিত হইলাম; দিনের বেলাই আমার কাছে কেহ আসে না, রাত্রে কে আসিল!

রোগাপানা একটি লোক। চেহারা দেখিয়া বয়স অনুমান করা যায় না; চল্লিশ বছর হইতে পারে, আবার চার হাজার বছরও হইতে পারে। আমার সম্মুখে আসিয়া বসিল; একদৃষ্টে আমার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আমাকে চিনতে পারছেন না?’

দ্বিধাভরে মাথা নাড়িয়া বলিলাম, ‘চিনি চিনি মনে হচ্ছে বটে— কিন্তু—’

সে বলিল, ‘আমি জাতিস্মর।’

মাথা চুলকাইয়া বলিলাম, ‘জাতিস্মর! হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকদিন আগে তোমার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছিল, মনে পড়েছে; তুমি রেলের কেরানী ছিলে—’

জাতিস্মর তীব্রস্বরে বলিল, ‘রেলের কেরানী ছিলাম এই কথাটাই মনে রেখেছেন। সোমদত্তাকে ভুলে গেছেন! উল্কাকে ভুলে গেছেন!’

উল্কা—বিষকন্যা উল্কা—যাহাকে ভালবাসিয়াছিল তাহাকে দেহ দিতে পারে নাই। সোমদত্তা— নিজের ধর্ম দিয়া স্বামীর প্রাণ বাঁচাইয়াছিল। তাহাদের অনেকদিন আগে চিনিতাম, এক সময় উহারা আমার মন জুড়িয়া বসিয়াছিল। কিন্তু উহাদের ভালবাসিয়াছিলাম কি? ভালবাসিলে কি ভুলিয়া যাইতে পারিতাম?

বলিলাম, ‘আসল কথাটা কি জানো—’

জাতিস্মর লোকটার মাথায় ছিট আছে, সে লাফাইয়া উঠিল দাঁড়াইল, তর্জনী তুলিয়া বলিল, ‘আপনি উল্কাকে ভুলে গেছেন, সোমদত্তাকে ভুলে গেছেন, রুমাকেও মনে নেই। আপনারা— এই লেখক জাতটা বড় লঘুচিত্ত, ভালবাসতে জানেন না। শুধু কুৎসা রটাতে জানেন। ছিঃ।’

জাতিস্মর ধিক্কার দিয়া চলিয়া গেল।

বসিয়া বসিয়া তাহার কথাই ভাবিতে লাগিলাম। সে জন্মে জন্মে বারবার বহু নারীকে ভালবাসিয়াছিল। আমি যদি একই জন্মে পর্যায়ক্রমে বহু নারীকে ভালবাসি তবে তাহা ভালবাসা হইবে না, অতি নিন্দনীয় কার্য হইবে। কেন? একটি নারীকে সারা জীবন ধরিয়া ভালবাসিব তবেই তাহা ভালবাসা হইবে— এমন কি কথা আছে! প্রাণে ভালবাসা থাকিলেই তো হইল।—

পায়ের শব্দ শুনিতে পাই নাই, চোখ তুলিয়া দেখি একটি যুবতী আমার সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। আনন্দময়ী মূর্তি কিন্তু বিহুলতা নাই। সর্বাঙ্গে সোনার গহনা, রূপের বুঝি অবধি নাই। বিদ্যাপতির শ্লোক মনে পড়িয়া যায়— ‘নব জলধরে বিজুরি রেখা দন্দ পসারি গেলি।’ গলায় আঁচল দিয়া আমাকে প্রণাম করিল, তারপর পায়ের কাছে বসিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘আমি চুয়া।’

বলিলাম, ‘পরিচয় দিতে হবে না, তোমাকে দেখেই চিনেছি। এত সুন্দর মেয়েকে কি ভোলা যায়!’

চুয়া লজ্জারুণ মুখে জড়সড় হইয়া বসিয়া রহিল। প্রশ্ন করিলাম, ‘চন্দন বেনে কেমন আছে?’

চুয়া শঙ্কাভরা চোখ তুলিয়া বলিল, ‘তিনি আবার সাগরে গেছেন।’

তাহাকে ভরসা দিবার জন্য বলিলাম, ‘বেনের ছেলেরা সাগরে যাবে না? দু’দিন পরেই ফিরবে, ভয় কি। —নিমাই পণ্ডিতের খবর ভাল?’

চুয়া একটি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘ঠাকুর সন্ন্যাস নিয়েছেন। উনি তো আর মানুষ ছিলেন না, দেবতা ছিলেন। কতদিন সংসারে থাকবেন।’

‘আর মাধাই?’

‘তার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে মা বলে ডেকেছেন।’

আমিও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম— ‘বেশ বেশ। সব খবরই ভাল দেখছি। তা তুমি আমার কাছে এলে কেন বল দেখি। তোমাকে ভালবাসি কি না জানতে চাও?’

সে একটু নীরব থাকিয়া বলিল, ‘আপনি আমাকে সর্বনাশের মুখ থেকে উদ্ধার করেছিলেন তাই আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি।’

সে আবার গলায় আঁচল দিয়া আমাকে প্রণাম করিল। বলিলাম, ‘চিরায়ুষ্মতী হও, পাকা মাথায় সিঁদুর পর। তোমাকে উদ্ধার করেছিল চন্দন আর নিমাই পণ্ডিত। কিন্তু আমিও তোমাকে ভালবাসি। আচ্ছা এস।’

চুয়া চলিয়া গেল।

ঘুরিয়া ফিরিয়া মাধাই-এর কথা মনে আসিতে লাগিল। মহাপাষণ্ড মাধাই মহাপুরুষের চরণস্পর্শে উদ্ধার হইয়া গেল। আমার জীবনে এমনি কোনও মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটিবে কি? মনে তো হয় না। মহাপুরুষেরা বাছিয়া বাছিয়া অতি বড় পাষণ্ডদেরই কৃপা করেন, ছোটখাটো পাষণ্ডদের প্রতি তাঁহাদের নজর নাই।

আরে ব্বাস্ রে! ব্যাপার কি? একসঙ্গে অনেকগুলি লঘুক্ষিপ্র পদধ্বনি; তারপর এক ঝাঁক যুবতী আমার স্তম্ভগৃহে ঢুকিয়া পড়িল এবং আমাকে ঘিরিয়া বসিল।

প্রদীপ উস্কাইয়া দিয়া একে একে সকলের মুখ দেখিলাম। কেহ আনারকলি, কেহ রজনীগন্ধা, কেহ অপরাজিতা। সকলেরই মুখ চেনা, কিন্তু সকলের নাম মনে নাই। বলিলাম, ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তোমরা সবাই ভাল। গুরুদেবের কথার প্রতিবাদ করতে চাই না, কিন্তু তোমাদের কী মতলব বল দেখি। রাত্তির বেলা একজোট হয়ে নিরীহ ব্রাহ্মণকে আক্রমণ করেছ কেন?’

একটি মুখফোড় মেয়ে বেণী দুলাইয়া বলিল, ‘আপনি মোটেই নিরীহ ব্রাহ্মণ নয়, খালি খোঁচা দিয়ে কথা বলেন।’

তাহার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলাম, ‘তোমাকে চিনেছি। তুমি করবী। কিন্তু খোঁচা দিয়ে কথা কখন বললাম? তোমাদের ঐ দোষ সত্যি কথা সইতে পার না। —যাক, বিমলা কেমন আছে? সুহাসকে দেখছি না!’

করবী বলিল, ‘বৌদি এলেন না, তাই হাসি-দি’ও এল না। আমাদেরও আসতে দিচ্ছিল না, বলছিল কেন ভদ্রলোককে জ্বালাতন করবি। আমরা জোর করে চলে এলুম।’

বলিলাম, ‘তোমাদের মধ্যে দু’একজনের সুবুদ্ধি আছে তাহলে। কিন্তু এসেছ ভালই করেছ। এখন বল মতলবটা কি?’

এবার অন্য একটি মেয়ে কথা বলিল; কালো মেয়ে, চোখের কুলে কুলে হাসি খেলা করিতেছে, বলিল, ‘আমরা জানতে এলুম কেন আপনি আর আমাদের ভালবাসেন না, কেন আমাদের নাম পর্যন্ত ভুলে গেছেন।’

বলিলাম, ‘তোমার নাম ভুলিনি। তুমি, রুচিরা।’

আর একটি মেয়ে বলিল, ‘আর আমি? আমার নাম বলুন দেখি।’

অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলাম। মেয়েটি চুয়ার মতো সুন্দরী নয়, কিন্তু ভারি সুশ্রী…মনে হয় যেন ছেলেবেলায় স্নানযাত্রার মেলায় হারাইয়া গিয়াছিল, এক মধ্যবিত্ত দম্পতি তাহাকে কুড়াইয়া পাইয়া মানুষ করেন…তারপর?…বড়মানুষের একটা খেয়ালী ছেলে… একটা তোৎলা…

মেয়েটি ম্লান হাসিয়া বলিল, ‘বলতে পারলেন না তো! আমি কেয়া।’

মনে দুঃখ হইল। সত্যই তো, মানুষ কেন ভুলিয়া যায়? হে মহাকাল, তুমি তো কিছু ভোল না, আমাদের অস্থি-মজ্জায় তোমার অভিজ্ঞান অঙ্কিত আছে; তবে আমরা ভুলি কেন? আমাদের ক্ষুদ্র হৃদয়ে একটি বৈ দু’টি ভালবাসার স্থান নাই, তাই বুঝি একটিকে ঘরে আনিবার সময় আগেরটিকে বিদায় দিতে হয়!

করবী আবেগ-প্রবণ কণ্ঠে বলিল, ‘বলুন, কেন আপনি আমাদের ভুলে গেছেন, কেন আর ভালবাসেন না!’

ক্ষীণকণ্ঠে বলিলাম, ‘দ্যাখো, তোমাদের সকলকেই তো আমি একটি একটি ভালবাসার পাত্র জুটিয়ে দিয়েছি, তবে আবার আমার ভালবাসা চাও কেন? মেয়ের বাপ মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্দি হয়, মেয়ে নিজের স্বামী নিয়ে মনের সুখে ঘরকন্না করে। তখন আর বাইরের ভালবাসা চায় না। কিন্তু তোমাদের এ কি? ভালবাসায় কি তোমাদের অরুচি নেই?

সকলে মুখ তাকাতাকি করিয়া হাসিয়া উঠিল। একজন বলিল, ‘অমৃতে নাকি অরুচি হয়? আপনি হাসালেন।’

করবী বলিল, ‘কিন্তু আপনার ভালবাসার ওপর আমাদের দাবি আছে।’

বলিলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তা আছে বৈকি। তোমাদের কাউকেই আমি ভুলিনি, সবাই আমার অবচেতনার তোষাখানায় জমা হয়ে আছো। তবে কি জানো, চোখের আড়াল প্রাণের আড়াল। তোমরাও তো এতদিন আমাকে ভুলে ছিলে; আজ মাসিক পত্রে প্রশ্ন উঠেছে, আমার প্রিয় চরিত্র কোনটি, তাই আমাকে মনে পড়েছে।’

একটি মেয়ে, তার নাম বোধহয় আলতা, বলিল, ‘মোটেই না, আপনার দিকে আমাদের বরাবর নজর আছে। আপনি যে-কাণ্ড করে চলেছেন! আজ রট্টা যশোধরা, কাল কুহু-গুঞ্জা-শিখরিণী, পরশু বীরশ্রী-যৌবনশ্রী-বান্ধুলি। আরও কত মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন কে জানে। —গা জ্বলে যায়।’

আমার অবস্থা খুব কাহিল হইয়া পড়িল। ভালবাসায় যাহাদের দুর্নিবার লোভ, অথচ অন্যকে ভালবাসি দেখিলে যাহাদের গা জ্বলিয়া যায়, তাহাদের সহিত তর্ক করিয়া লাভ নাই। কি বলিয়া ইহাদের ঠাণ্ডা করিব ভাবিতেছি, হেনকালে পিছনদিকে পুরুষকণ্ঠের স্নিগ্ধ-মধুর হাসি শুনিতে পাইলাম। তারপরই সংস্কৃত ভাষায় সম্বোধন, ‘অয়মহং ভো!’

ঘাড় ফিরাইয়া দেখি, তেজঃপুঞ্জকান্তি এক পুরুষ দাঁড়াইয়া আছেন। একালের মানুষ নয় তাহা বেশবাস দেখিয়া বোঝা যায়। ক্ষৌরিত মাথাটির মাঝখানে পরিপুষ্ট শিখা, স্কন্ধে মুঞ্জোপবীত, গলায় শুভ্র দুকূলের উত্তরীয়, নিম্নাঙ্গে হাঁটু পর্যন্ত বস্ত্র; মুখখানি স্মিতহাস্যোজ্জ্বল, চক্ষুদুটি ভ্রমরের ন্যায়। মেয়েদের মুখের উপর পরিভ্রমণ করিতেছে।

মেয়েরা পুরুষকে দেখিয়া ক্ষণেকের জন্য যেন সন্ত্রস্ত হইয়া রহিল, তারপর এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো ছুটিয়া পলাইল।

ঘর শূন্য হইয়া গেলে আমি যুক্তকরে পুরুষকে বলিলাম, ‘আসুন কবিবর, আপনার চরণস্পর্শে আমার স্তম্ভ পবিত্র হল।’

কালিদাস উপবিষ্ট হইয়া এদিক ওদিক চাহিলেন, বলিলেন, ‘খাসা স্তম্ভটি। আমার যদি এমন একটি স্তম্ভ থাকত, আরও অনেক লিখতে পারতাম। রাজসভার হট্টগোলে কি লেখা যায়?’

বলিলাম, ‘কবি, সাতটি গ্রন্থ লিখে আপনি সপ্তলোক জয় করেছেন। কী প্রয়োজন?’

কবি একটু বিমনা হইয়া বলিলেন, ‘তা যেন হল। কিন্তু মেয়েগুলো আমাকে দেখে পালালো কেন বল দেখি।’

অপ্রতিভভাবে কাশিয়া বলিলাম, ‘হেঁ হেঁ— কি জানেন, স্ত্রীলোকঘটিত ব্যাপারে আপনার একটু—ইয়ে—দুনাম আছে কিনা— তাই—’

পরম বিস্ময়ভরে কবি বলিলেন, ‘তাই নাকি! কিন্তু সেকালে তো কোনও দুনাম ছিল না। উজ্জয়িনীর প্রধানা নগরনটী প্রিয়দর্শিকার সঙ্গে আমার ভাব-সাব ছিল, মালিনীকেও ভালবাসতাম; এমন কি রানী ভানুমতীও আমার প্রতি প্রীতিমতী ছিলেন। কিন্তু সেজন্যে আমাকে দুনম তো কেউ দেয়নি। আর তরুণীরাও আমাকে দেখে ছুটে পালাত না, বরং ছুটে এসে ঘিরে ধরত।’

কবিকে ক্ষুব্ধ দেখিয়া আমি বলিলাম, ‘একালের মেয়েরা আগের মতো সাহসিনী নয়, ভারতবর্ষে যবন আক্রমণের পর থেকে আর্যনারীরা বড়ই ভীরু হয়ে পড়েছে। উপরন্তু আপনার নামে নানারকম গল্প শুনেছে—’

কবিবর উত্তপ্ত হইয়া বলিলেন, ‘এ তোমাদের কাজ। তোমরাই বানিয়ে বানিয়ে আমার নামে মিথ্যে গল্প রচনা করেছ। তাই সুন্দর সুন্দর মেয়েরা আমাকে দেখে পালিয়ে যায়।’

বলিলাম, ‘তা কি করব? আপনি নিজের সম্বন্ধে একটি কথাও লিখে যাননি, কাজেই আমাদের বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখতে হয়। আপনার সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহলের যে অন্ত নেই কবি।’

কবি একটু প্রসন্ন হইলেন, বলিলেন, ‘আমার জীবনের সব তথ্য জানা থাকলে কি এত কৌতূহল থাকত? কিন্তু ওকথা যাক। তুমি এ কি কাণ্ড করেছ?’

‘কী কাণ্ড করেছি?’

‘আমাকে নিয়ে দুটো গল্প বানিয়েছ। একটাতে পরম সুশীলা কুন্তল-রাজকুমারীর সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছ। অন্যটিতে আমার স্ত্রীকে করেছ এক দজ্জাল খাণ্ডার মেয়েমানুষ। দুটোই কি করে সম্ভব হয়?’

‘কেন সম্ভব হবে না? কুন্তলকুমারী কালক্রমে দজ্জাল খাণ্ডার হয়ে উঠতে পারেন। এমন তো কতই হয়।’

কবি মিটিমিটি হাসিয়া বলিলেন, ‘তোমার অভিসন্ধি বুঝেছি। অন্ধকারে দুটো ঢিল ছুঁড়েছ, যেটা লেগে যায়। কেমন?’

আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, ‘তাহলে একটা ঢিল লেগেছে।’

কালিদাস মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘উঁহু, এই ফাঁকে সত্য কথাটা জেনে নিতে চাও। সেটি হচ্ছে না। আমি উঠলাম।’ বলিয়া উঠিবার উপক্রম করিলেন।

আমি করজোড়ে বলিলাম, ‘কবিবর, আর একটু বসুন। আপনি কেন এই দীনের কুলায়ে শুভাগমন করেছেন তা তো বললেন না। আপনিও কি জানতে চান আমি আপনাকে ভালবাসি কিনা? তাহলে মুক্তকণ্ঠে বলছি, আমি আপনাকে ভালবাসি, আমার যতটুকু ভালবাসার ক্ষমতা আছে সব দিয়ে আপনাকে ভালবাসি।’

কবি বলিলেন, ‘কথাটা পরিষ্কার হল না। আমাকে ভালবাস, না আমার কাব্যকে ভালবাস?’

বলিলাম, ‘আপনার কাব্য আর আপনি কি আলাদা? আপনাকে আপনার কাব্যের মধ্যেই পেয়েছি, আর তো কোথাও পাইনি। আমি আপনার যে চরিত্র গড়েছি সে তো আপনার ভাবমূর্তি, আপনার কাব্যের মধ্যেই সে-মূর্তি পেয়েছি। —কবি, বলুন আমার আঁকা সে-মুর্তি যথার্থই কিনা।’

কবি বলিতে গিয়া থামিয়া গেলেন, মৃদু হাসিয়া বলিলেন, ‘আর একটু হলেই বলে ফেলেছিলাম। তুমি বড় ধূর্ত। নাঃ, আর নয়, এবার আমি উঠি।’

কিন্তু তাঁহার ওঠা হইল না, দ্বারের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। আমি ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলাম ব্যোমকেশ বক্সী দাঁড়াইয়া আছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হইতেই সে আসিয়া আমার সম্মুখে মহাকবির পাশে বসিল। তাঁহার প্রতি একটি তীক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, ‘অনেক পুরনো লোক মনে হচ্ছে। শীলভদ্র নাকি? না, গলায় পৈতে আছে, বৌদ্ধ নয়। দীপঙ্করও নয়। তবে কি মহাকবি কালিদাস?’

কবিবর ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিলেন। আমি তখন পরিচয় করাইয়া দিলাম। বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ বক্সী একজন সত্যান্বেষী। পরের গুপ্তকথা খুঁচিয়ে বার করা ওর কাজ। কবিবর, আপনার জীবনে যদি কোনও গুপ্তকথা থাকে, সাবধান থাকবেন।’

কবি তড়িৎস্পৃষ্টবৎ উঠিয়া দাঁড়াইলেন, ‘আরে সর্বনাশ! আমার জীবনটাই তো একটা গুপ্তকথা। এখানে আর বেশীক্ষণ থাকলে সব ফাঁস হয়ে যাবে। আমি চললাম। এ রকম লোক তোমার কাছে আসে জানলে—। আচ্ছা, স্বস্তি স্বস্তি।’

আমি দ্বার পর্যন্ত কবিকে পৌঁছাইয়া দিয়া বলিলাম, ‘নমস্কার কবি। পুনশ্চ ভূয়োপি নমোনমস্তে।’

কবি দ্রুত সিঁড়ি দিয়া নামিয়া অদৃশ্য হইলেন।

ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশকে ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। তাহার সহিত আমার পরিচয় প্রায় ত্রিশ বছর। সে বিবাহ করিবার পর ষোল-সতরো বছর তাহাকে কাছে ঘেঁষিতে দিই নাই, তারপর আবার আসিয়া জুটিয়াছে। লোকটাকে আমি পছন্দ করি না। এত বুদ্ধি ভাল নয়।

প্রশ্ন করিলাম, ‘তোমার ল্যাংবোট কোথায়?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত? সে আপনার ওপর অভিমান করেছে, তাই এল না।’

‘অভিমান কিসের?’

‘আপনি তাকে ক্যাবলা বানিয়েছেন তাই। বেচারা সাহিত্যিক মহলে কলকে পায় না, সবাই তাকে দেখে হাসে।’

‘হুঁ। তোমাকে দেখে কেউ হাসে না এই আশ্চর্য। তোমরা দু’জনেই সমান। একজন বুদ্ধির জাহাজ, অন্যটি ক্যাবলা। দু’চক্ষে দেখতে পারি না।’

ব্যোমকেশ সিগারেটে লম্বা টান দিয়া বাঁকা হাসিল, বলিল, ‘আমাদের তাহলে আপনি ভালবাসেন না? মানে, আমরা আপনার প্রিয় চরিত্র নই।’

দৃঢ়স্বরে বলিলাম, ‘না, তোমরা আমার প্রিয় চরিত্র নও। এ কথাটা ভাল করে বুঝে নাও।’

ব্যোমকেশ নির্বিকার স্বরে বলিল, ‘আমি আগে থেকেই জানি। এবং আপনার প্রিয় চরিত্র কে তাও জানি।’

চকিত হইয়া বলিলাম, ‘তাই নাকি! কে আমার প্রিয় চরিত্র? কার কথা বলছ?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘যে আপনার প্রত্যেক লেখার মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে, যাকে বাদ দিয়ে আপনি এক ছত্রও লিখতে পারেন না, তার কথা বলছি।’

‘কিন্তু লোকটা কে? নাম কি?’

‘শুনবেন?’ ব্যোমকেশ আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া চুপিচুপি একটা নাম বলিল।

চমকিয়া উঠিলাম। মনের অগোচর পাপ নাই, ব্যোমকেশ ঠিক ধরিয়াছে। কিছুক্ষণ মুখ-ব্যাদান করিয়া থাকিয়া বলিলাম, ‘তুমি কি করে জানলে?’

ব্যোমকেশ অট্টহাস্য করিয়া উঠিল, বলিল, ‘আপনার প্রশ্নটা অজিতের প্রশ্নের মতো শোনাচ্ছে!’

আত্মসংবরণ করিয়া তাহার পানে কটমট তাকাইলাম, দ্বারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিলাম, ‘তুমি এবার বিদেয় হও।’

ব্যোমকেশ হাসিতে হাসিতে উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘ধরা পড়ে গিয়ে আপনার রাগ হয়েছে দেখছি। আচ্ছা, আজ চলি। আর একদিন আসব।’

সে চলিয়া গেলে দ্বার বন্ধ করিয়া দিলাম। আজ আর কাহাকেও ঢুকিতে দিব না। অনর্থক সময় নষ্ট।

প্রদীপটিকে কাছে টানিয়া খাতা পেন্সিল লইয়া লিখিতে বসিলাম। পূজা আসিয়া পড়িল। পূজার সময় একটা ব্যোমকেশের রহস্য-কাহিনী না লিখিলেই নয়।

২ আষাঢ় ১৩৬৭

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন