শুক্লা একাদশী

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

শুক্লা একাদশী

আকাশের চন্দ্র ও পাঁজির তিথিতে কোনও মতভেদ ছিল না—আজ শুক্কা একাদশীই বটে।

রাত্রির আহারাদি শেষ করিয়া বিনয় তাহার বাঁশের বাঁশিটি লইয়া ছাদে উঠিয়াছিল। আকাশে শুক্লা একাদশীর চন্দ্রকুহেলি, চারিদিকে কলিকাতার সংখ্যাহীন ছাদের চক্রব্যুহ। বিনয় পরিতৃপ্ত মনে পাশের বাড়ির ছাদের দিকে তাকাইয়া বাঁশিতে ফুঁ দিয়াছিল। বাঁশি মুগ্ধ কূজনে বাজিতেছিল—

আজি শুক্লা একাদশী,

হের তন্দ্রাহারা শশী,

স্বপ্ন পারাবারের খেয়া

একেলা চালায় বসি।

পাশের বাড়ির ছাদে কিছুদিন যাবৎ একটি মেয়ের আবির্ভাব হইতেছিল। দুই ছাদের মাঝখানে একটি অতলস্পর্শ সংকীর্ণ গলির ব্যবধান; তবু আলিসার পাশে দাঁড়াইয়া হাত বাড়াইলে হাতে-হাতে ছোঁয়া-ছুঁয়ি হইতে পারে। মেয়েটি পাশের বাড়িতে সম্প্রতি আসিয়াছে; তাহার বোধ হয় রাত্রে শয়নের পূর্বে ছাদে বেড়ান অভ্যাস। দুই জনের অভ্যাস সমকালীন হওয়ায়, প্রথমে দেখাসাক্ষাৎ ও পরে আলাপ হইয়াছিল। মেয়েটির নাম বিনতা।

বিনতার বয়স কতই বা হইবে? বিনয়েরই সমবয়সী, কিংবা দু’এক বছরের ছোট। চাঁদের আলোতেই বিনয় তাহাকে দেখিয়াছিল। চোখ দুটি বড় বড়, মখমলের মতো নরম আর কালো; গায়ের রং কুমুদের মতো সাদা। ঘন চুলের মাঝখানে সিঁথির সূক্ষ্ম রেখাটি নিষ্কলঙ্ক।

বলিয়া রাখা ভালো যে বিনয়ের ইতিপূর্বে একটিও মহিলা বন্ধু ছিল না; তাই অপ্রত্যাশিতভাবে ছাদের উপর একটি বন্ধু পাইয়া সে পরম এই যত্নে এই তত্ত্বটি সকলের কাছে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। এমন কি পাশের বাড়িতে খোঁজ খবর লইয়া বন্ধুটির পরিপূর্ণ পরিচয় পাইবার চেষ্টাও করে নাই। তাহাদের পরিচয় শুধু শয়নের পূর্বের ঐ অল্প সময়টুকুর মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল।

প্রথমে মেয়েটি নিজেই উপযাচিকা হইয়া বিনয়ের সহিত আলাপ করিয়াছিল। বিনয় ক’দিন ধরিয়া একটা গানের সুর লইয়া বাঁশির সহিত ধস্তাধ্বস্তি করিতেছিল; কিন্তু বাঁশিও বাঁকিয়াছিল—কিছুতেই তাহার অভীষ্ট স্বরটি বাহির করিতেছিল না। শেষে বিনয় যখন হতাশ হইয়া হাল ছাড়িয়া দিবার উপক্রম করিয়াছে, তখন পাশের ছাদ হইতে আওয়াজ আসিল, ‘আপনি তিলক কামোদ বাজাবার চেষ্টা করেছেন—কিন্তু বেরুচ্ছে কেদারা। কড়ি মধ্যম দেবেন না, তা হলেই ঠিক হবে।’

ইহাই সূত্রপাত। তারপর বিনয় কড়ি-মধ্যম বর্জন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু সমর্থ হয় নাই। মেয়েটি তখন অধীরভাবে বলিয়াছিল, ‘দিন আমাকে বাঁশি, দেখিয়ে দিচ্ছি।’

অতঃপর একটি শুক্ল পক্ষ ও একটি কৃষ্ণ পক্ষ কাটিয়া গিয়া আজ আবার শুক্লা একাদশী আসিয়াছে। এই রাত্রির কয়েকটি মিনিট লইয়া আমাদের গল্প; তবু দুঃখ এই যে জীবনের মিনিটগুলি বিচ্ছিন্ন নিরাসক্তভাবে আসে না, তাহাদের পশ্চাতে অনাদিকালের উদ্যোগ সঞ্চিত হইয়া থাকে। ‘কত লক্ষ বরষের তপস্যার ফলে, ধরণীর তলে ফুটিয়াছে আজি এ মাধবী—’

গান ও কবিতার সহিত প্রেমের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলিয়াই আমরা জানি। কিন্তু আশ্চর্য, বিনয় এতদিন তাহার এই গোপন বন্ধুটির গোপনতার রসই সমস্ত দেহ মন দিয়া উপভোগ করিয়াছে; ইহার গভীরতর সম্ভাবনার ছায়া তাহার মনকে স্পর্শ করে নাই। অন্যপক্ষ হইতেও একটি সহজ সহৃদয়তা ছাড়া আর কিছুর ইঙ্গিত আসে নাই। দু’জনেই গান ভালোবাসে, গান লইয়াই আলোচনাই বেশী হইয়াছে। সমাজ, সংস্কার, নীতি, স্ত্রী-স্বাধীনতা প্রভৃতি অবান্তর কথাও মাঝে মাঝে উঠিয়াছে; কিন্তু তাহা ক্ষণিকের জন্য। মোট কথা, এই দুইটি তরুণ তরুণীর মধ্যে প্রণয়ঘটিত কোনও কথাই হয় নাই। হয়তো কেহ বিশ্বাস করিতেছেন না; কি করিব আমি নিরুপায়।

কিন্তু এইবার বিশ্বাস করা বোধ হয় কঠিন হইবে না, কারণ—‘আজি শুক্লা একাদশী—’

খাদ্যের সহিত প্রেমের কি কোনও সম্বন্ধ আছে? চিংড়ি মাছের কাট্‌লেট কি অন্তরে প্রণয় পিপাসা জাগাইয়া তোলে? নিষিদ্ধ অণ্ড কি উদরে প্রবেশ করিয়া ব্রহ্মাণ্ডের আদিমতম সত্যের ইশারা করিতে থাকে? পাঁঠার মাংস কি অজ, নিত্য এবং শাশ্বত জীবধর্ম উদ্বুদ্ধ করিয়া তোলে? কে জানে? কিন্তু বিনয় আজ উক্ত তিনটি খাদ্যই প্রচুর পরিমাণে ভক্ষণ করিয়াছিল; এবং এই জন্যই বোধ করি তাঁহার বাঁশির গদ্‌গদ কূজনের সহিত সে মনে মনে বলিতেছিল—

আজি শুক্লা একাদশী—বিনতাকে আমি ভালোবাসি—

হের তন্দ্রহারা শশী—তার অধর-ছোঁয়া এই বাঁশি—

মখমলের মত কালো নরম তার চোখ দুটি—

সিঁথির সরু রেখায় নেই সিঁদুরের চিহ্ন—

ভালোবাসি—ভালোবাসি—ভালোবাসি।

চিংড়ি মাছ, ডিম্ব ও পাঁঠার আশ্চর্য ক্ষমত। বিনয় তন্দ্রাতুর চোখে পাশের বাড়ির ছাদের দিকে তাকাইয়া বাঁশি বাজাইতেছে—তাহার হৃদয় উদ্বেল হইয়া উঠিয়াছে। বাঁশির সুর বদলাইয়া গেল—

সেহ কোকিল অব লাখ ডাকউ

লাখ উদয় করু-চন্দা;

পাঁচ বাণ অব লাখ বাণ হউ

লাখ পবন বহু মন্দা।

পাশের ছাদ হইতে হাসির শব্দ আসিল, ‘তাল কেটে যাচ্ছে যে!’

বাঁশি ফেলিয়া বিনয় আলিসার পাশে গিয়া দাঁড়াইল।

‘বিনতা—!’ উদগত কথাটা হঠাৎ আটকাইয়া গেল।

‘কি?’

বিনয় সামলাইয়া লইয়া আবার আরম্ভ করিল, ‘বিনতা, আজ শুক্লা একাদশী।’

‘হ্যাঁ।’ একটু হাসিয়া বিনতা চাঁদের দিকে মুখ তুলিল।

তাহার উন্নমিত মুখের পানে চাহিয়া বিনয়ের কণ্ঠাগত কথাটি বাধা পাইয়া থামিয়া গেল। বিনতার মুখখানি শুষ্ক, চাঁদের পরিপূর্ণ আলো পড়িয়া যেন অত্যন্ত ফ্যাকাসে দেখাইল।

‘বিনতা, তোমার মুখ এত শুকনো কেন? যেন সমস্ত দিন খাওনি।’

বিনতা আবার একটু হাসিল, ‘সত্যিই আজ সমস্ত দিন খাইনি। আজ যে একাদশী।’

২২ অগ্রহায়ণ ১৩৪৪

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন