ইচ্ছাশক্তি

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

ইচ্ছাশক্তি

মনস্তত্ত্বের এক প্রচণ্ড পণ্ডিত বলিলেন, ‘ইচ্ছাশক্তির দ্বারা হয় না এমন কাজ নেই। যদি মরীয়া হয়ে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে পারো, যা চাইবে তাই পাবে। কোনও কাজ করতে হবে না, স্রেফ মনের ইচ্ছাটাকে প্রবল একাগ্র দুর্নিবার করে তুলতে হবে। সেকালে মুনি-ঋষিরা কথাটা জানতেন, তাই রামায়ণ-মহাভারতে এত বর দেওয়া আর শাপ দেওয়ার ছড়াছড়ি।

পণ্ডিতের কথা সত্য কিনা পরীক্ষা করার প্রয়োজন যত না থাক, নিজের মনে একটা বাসনা লুব্ধভাবে কিছুদিন আনাগোনা করিতেছিল। এমন কিছু জোরালো বাসনা নয়—ভাসা-ভাসা একটা আকাঙক্ষা। ভাবিলাম, দেখাই যাক্ না, কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তি খরচ করিয়া যদি কাম্য বস্তু পাওয়া যায়, মন্দ কি?

কাম্য বস্তুটি অবশ্য এমন কিছু অপ্রাপ্য বস্তু নয়—একটি ফাউন্টেন পেন্‌। আমি লেখক; স্বীকার করিতে লজ্জা নাই, আমি ফাউন্টেন পেন্‌ ভালবাসি। আমার একটি ফাউন্টেন পেন্ আছে; যুদ্ধের আগে কিনিয়াছিলাম। এখনও বেশ ভালই চলিতেছে। কিন্তু যাহা ভালবাসি তাহা একটিমাত্র লইয়া কি মন ভরে? সেকালের রাজারা এতগুলি করিয়া বিবাহ করিতেন কেন? বড়মানুষেরা অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও আরও টাকা চায় কেন? আমার মন চাহিতেছিল—আর একটি কলম। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ফাউন্টেন পেনের দাম যেরূপ চড়িয়া গিয়াছে, তাহাতে আমার মতো লেখক তো দূরের কথা, হায়দ্রাবাদের নিজাম ছাড়া আর কেহ কলম কিনিতে পারে বলিয়া তো মনে হয় না।

সুতরাং জোরসে ইচ্ছাশক্তি লাগাইয়া দিলাম। মনে মনে এই আশা উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল : আমি লেখক; এমন কিছু মন্দ লিখি না; নিজামের মতো কোনও ব্যক্তি যদি আমাকে একটি ফাউন্টেন পেন্ উপহারই দেন, তবে কি এতই অপাত্রে পড়িবে?

কি করিয়া ইচ্ছাশক্তিকে একাগ্র ও দুর্নিবার করিয়া তোলা যায় তাহার প্রক্রিয়া জানা না থাকিলেও, এঁটুলির মতো তাহার গায়ে লাগিয়া রহিলাম। দিবারাত্র কলমের চিন্তা করিতেছি—কলম চাই, কলম চাই—ইহা ছাড়া অন্য চিন্তা নাই। আমি বড় একরোখা লোক; যখন ধরিয়াছি তখন ইহার শেষ দেখিয়া ছাড়িব।

কয়েকদিন এইভাবে কাটিল, কিন্তু কলমের দেখা নাই। একদিন একটা পারিবারিক প্রয়োজনে বাড়ির বাহির হইতে হইল। কিন্তু মনটা ইতিমধ্যে এমনই একগুঁয়ে হইয়া উঠিয়াছিল যে ট্রাম-বাসের গুঁতোগুঁতির মধ্যেও কলমের চিন্তা ছাড়িল না।

বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, আমার নিজের কলমটি কে কখন বুকপকেট হইতে তুলিয়া লইয়াছে।

কিছুক্ষণ হতভম্ব হইয়া রহিলাম; তারপর রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলিয়া গেল। কোথায় আমি ‘কলম দেহি কলম দেহি’ করিয়া মনে মনে মাথা খুঁড়িতেছি, আর আমার নিজের কলমটাই কোন্ শ্যালকপুত্র হাত সাফাই করিল! রাম এমন উল্টা বোঝে কেন? দুত্তোর ইচ্ছাশক্তি! মনস্তত্ত্বের পণ্ডিতটার দেখা পাইলে হয়, তাহার মাথা ফাটাইয়া দিব।

কয়েকদিন বড়ই মন খারাপ গেল। তারপর হঠাৎ এক অপরিচিত ব্যক্তির নিকট হইতে ডাকযোগে একটি পার্সেল পাইলাম।

পার্সেলের মধ্যে একটি ফাউন্টেন পেন্ ও চিঠি।

অপরিচিত ব্যক্তিটি লিখিয়াছেন যে, তিনি আমার লেখার অনুরাগী পাঠক—অনুরাগের চিহ্নস্বরূপ এই কলমটি আমাকে উপহার দিতেছেন, আমি উহা ব্যবহার করিলে ধন্য হইবেন।

কলমটি কাগজের খাপ হইতে বাহির করিয়া দেখিলাম, ঠিক আমার হারানো কলমের জোড়া! তবে নূতন—বেশ তক্‌তক্‌ ঝক্‌ঝক্ করিতেছে।

হঠাৎ মনে কেমন একটা খটকা লাগিল। অভিনিবেশ সহকারে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলাম, কলমের গায়ে একটি দাগ রহিয়াছে—যেমন আমার কলমটিতে ছিল!

ইচ্ছাশক্তির এ কিরকম রসিকতা!

আমারই চোরা কলম কোনও ভদ্রলোক সস্তায় ক্রয় করিয়া, মাজিয়া ঘষিয়া নূতন বাক্সে পুরিয়া আমাকেই উপহার দিয়াছেন।

পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা হয় নাই, হইলে জিজ্ঞাসা করিব, ইচ্ছাশক্তি এমন জুয়াচুরি করে কেন?

২৪ মাঘ ১৩৫১

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন