বিজয়ী

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বিজয়ী

ননীগোপালের অন্তর্জীবনের গোপন ইতিহাসটি উদঘাটিত করিতে গিয়া কেবলি ভয় হইতেছে, তাহার ভিতর ও বাহিরের এই বৈষম্য লোকের বিশ্বাসযোগ্য হইবে কিনা। প্রসন্ন হ্রদের গূঢ় তলদেশে যে সকল ভীষণ নক্র ঘুরিয়া বেড়ায় তীরে দাঁড়াইয়া তাহাদের কোনও সন্ধানই পাওয়া যায় না। ননীগোপালের সুন্দর বলিষ্ঠ দেহ ও সুশ্রী কিশোর মুখখানা দেখিয়াও কেহ সন্দেহ করিত না যে কি দুর্জ্ঞেয় দুর্বলতার সহিত সে অহরহ যুদ্ধ করিতেছে।

যে নক্রটি ননীগোপালের দেহ-মনের মধ্যে অটল আসন গাড়িয়া বসিয়াছিল তাহার নাম—ভয়। আহার, নিদ্রা, ভয় ইত্যাদি কয়েকটি বৃত্তি জীবমাত্রের পক্ষেই স্বাভাবিক বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। ইহাদের কবল হইতে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি পাইতে বড় একটা কাহাকেও দেখা যায় না। কিন্তু ননীগোপালকে ঐ ভয় বস্তুটি ছেলেবেলা হইতে একটু বিশেষ করিয়া চাপিয়া ধরিয়াছিল।

কি করিয়া কখন ইহার প্রথম উন্মেষ হইল তাহা বলা শক্ত। শিশু কখন তাহার একান্ত সহজ নির্ভীকতা বিসর্জন দিয়া বিড়াল দেখিয়া বা অন্ধকারে ভয় পাইতে আরম্ভ করে তাহা বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা নিশ্চয় বলিতে পারিবেন। আমার বিশ্বাসী ননী মাতৃস্তন্য ও পিতৃরক্তের সহিত এই পরম পদার্থটি উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করিয়াছিল। সে যাক্‌। শুধু ননীর মাতাপিতার অকারণ গ্লানি করিলে চলিবে কেন?

ননীর যখন সাত বৎসর বয়স তখন তাহাদের শহরে একটা সার্কাস আসিয়াছিল। ননীর পরম বন্ধু বিশু আসিয়া চুপিচুপি বলিল, ‘ননে, বাঘ দেখতে যাবি? সার্কাসে অনেক বাঘ এসেছে। এক পয়সা দিলেই দেখতে দেয়। তোর মা’র কাছ থেকে দুটো পয়সা নিয়ে আয়—দু’জনে দেখব।’

ননী উৎসাহে লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, ‘আচ্ছা, এক্ষুনি আন্‌ছি।’

বিশু সাবধান করিয়া দিল, ‘বাঘের নাম করিসনি, তাহলে যেতে দেবে না। বলিস কাটি-বরফ খাব।’

পয়সা লইয়া দুই বন্ধু বাহির হইল। তারপর যথাসময়ে কাঁদিতে কাঁদিতে ননী একাকী বাড়ি ফিরিয়া আসিল। জননী ননীর কাপড়-চোপড়ের অবস্থা দেখিয়া প্রথমটা তাহাকে খুব ঠেঙাইলেন, তারপর সেই সন্ধ্যাবেলা স্নান করাইয়া দিলেন। জেরায় প্রকাশ পাইল যে একটা বাঘ ননীকে দেখিয়া গাঁক্‌ করিয়া শব্দ করিয়াছিল—তাহাতেই এই বিপত্তি।

ননীর জীবনে এই শেষ প্রকাশ্য লাঞ্ছনা, ইহার পর সে ভয় গোপন করিতে শিখিল।

কিন্তু ননীর প্রাণে আর সুখ রহিল না। যত তাহার বয়স বাড়িতে লাগিল ভীতিপ্রদ বস্তুর সংখ্যাও জগতে ততই অগণ্য হইয়া উঠিতে লাগিল। ক্রমে এমনি হইল যে গুরুজনের সম্মুখে যাইতে তাহার পা কাঁপে, হেডমাস্টার মহাশয়ের মুখের পানে চোখ তুলিতে প্রাণ শুকাইয়া যায়। যে দিকে সে চোখ ফিরায় সেইদিকেই যেন একটা বিভীষিকা হাঁ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

যখন তাহার বয়স দশ বৎসর তখন একদিন সে স্কুল হইতে একাকী বাড়ি ফিরিতেছিল, এমন সময় পিছন হইতে কে তাহাকে ডাকিল। ননী ফিরিয়া দেখিল রতন। রতন ছেলেটা ননীর অপেক্ষা উঁচু ক্লাসে পড়ে বটে, কিন্তু সে প্যাঁকাটির মতো রোগা এবং অত্যন্ত পাজী। ননীর সহিত তাহার বড় সদ্ভাব ছিল না, তাহাকে আসিতে দেখিয়া তাহার বুকের ভিতরটা ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ করিতে লাগিল। একবার ভাবিল দৌড়িয়া পালায়। কিন্তু ভয়ের বাহ্য বিকাশ সে অনেকটা দমন করিয়াছিল, তাই পলাইল না, কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

রতন কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া সটান বলিল, ‘তোর এরোপ্লেনটা দে।’

ননী অনেক পরিশ্রম করিয়া বিস্তর মাথা খাটাইয়া একটি পিজ-বোর্ডের ছোট্ট এরোপ্লেন তৈয়ার করিয়াছিল। সেটিকে ছুঁডিয়া দিলে ঘুরিতে ঘুরিতে উপরে উঠিত, আবার চক্রকারে নামিয়া আসিত। এটির নির্মাণকার্য শেষ করিয়া আজ প্রথম সে স্কুলে আনিয়াছিল এবং চমৎকৃত বন্ধুবর্গের সম্মুখে এই অদ্ভুত যন্ত্রটির অত্যাশ্চর্য ক্রিয়াকলাপ দেখাইয়া নিরতিশয় ঈর্ষা ও প্রশংসার পাত্র হইয়া উঠিয়াছিল।

ননীকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া রতন দাঁতমুখ খিঁচাইয়া বলিল, ‘দিবিনে? শিগ্‌গির দে বল্‌ছি।’

প্রবল রোদনোচ্ছাস সম্বরণ করিয়া ননী বলিল, ‘আমি তৈরি করেছি, আমি তোমাকে দোব কেন?’

‘দিবিনে? আচ্ছা, দাঁড়া তবে—’ বলিয়া রাস্তা হইতে একমুঠা ধুলা তুলিয়া লইয়া বলিল, ‘এক্ষুনি চোখে ধুলো দিয়ে দোব, কানা হয়ে যাবি। ভাল চাস তো দে বলছি।’

ননী এরোপ্লেনটা রাস্তার উপর ফেলিয়া দিয়া বিকৃত কণ্ঠে কহিল, ‘এই নে—ভারী তো জিনিস! আবার আমি আর একটা তৈরি করে নোব।’

সেটা তুলিয়া লইয়া দাঁত বাহির করিয়া রতন বলিল, ‘খবরদার বল্‌ছি, জিভ টেনে বার করব ফের যদি এরোপ্লেন তৈরি করিস। আমি একলা এরোপ্লেন ওড়াব আর কাউকে ওড়াতে দেব না!’—এই বলিয়া কাটির মতো হাত-পা অঙ্গভঙ্গি সহকারে নাড়িতে নাড়িতে শিস্‌ দিতে দিতে রতন চলিয়া গেল।

ননী বাড়ি ফিরিয়া বইগুলা ফেলিয়া দিয়া বিছানায় মুখ গুঁজিয়া শুইয়া পড়িল। শুধু যে এরোপ্লেনের শোকেই সে কাতর হইয়া পড়িয়াছিল তাহা নয়, দুর্বৃত্তের হাত হইতে নিজের সম্পত্তি রক্ষা করিবার জন্য অন্যান্য ছেলের মতো লড়াই করিবার ক্ষমতাও যে তাহার নাই, এই লজ্জাটাই তাহাকে সবচেয়ে বেশী পীড়া দিতে লাগিল।

এই সমস্ত ছোটখাটো ব্যাপার ছাড়াও ননীর পক্ষে সবচেয়ে ভয়ানক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল—সাহেব। কি করিয়া এই ভয়ের সৃষ্টি হইল বলা যায় না কিন্তু লাল মুখ কিংবা সাদা চামড়া দেখিলেই ননীর মুখ শুকাইয়া তুলসীপাতা হইয়া যাইত, অকারণে বুকের ভিতর দুরদুর করিতে থাকিত। ননী নিজেকে বুঝাইবার চেষ্টা করিত ভয়ের কিছু নাই—সাহেব তাহাকে খাইয়া ফেলিবে না, কিন্তু কোনই ফল হইত না। কোন্ নীলকরের আমলের পূর্বপুরুষের রক্ত তাহার সমস্ত যুক্তিতর্ক ও বুদ্ধিবিবেচনাকে ভাসাইয়া দিত।

স্কুলের হেডমাস্টার যখন ননীর বাবাকে লিখিলেন,—ননীর মতো শান্ত শিষ্ট নিরীহ ছেলে আমার স্কুলে আর নাই—আমি এ বৎসর উহাকে গুড্‌কন্‌ডক্ট প্রাইজ দিব,—তখন ননী লজ্জায় ও আত্মগ্লানিতে যেন মরিয়া গেল। এই প্রাইজ যে তাহার আন্তরিক শিষ্টতার জন্য নয়, তাহার ভীরুতার, দুষ্কৃতি করিবার অক্ষমতার পুরস্কার, তাহা পরিষ্কার করিয়া না বুঝিলেও উহার সুতীক্ষ্ণ লজ্জা তাহার বুকের মধ্যে বিঁধিয়া রহিল। নিজের যে দুর্বলতাকে সে অতিযত্নে লোকচক্ষু হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে, এই প্রাইজটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে উহা সকলের কাছে প্রকট হইয়া পড়িবে, কাহারও জানিতে বাকি থাকিবে না, তাহা ভাবিয়া তাহার নিজের মাথাটা দেয়ালে ঠুকিয়া ছেঁচিয়া ফেলিবার ইচ্ছা হইল। সহিংসভাবে একটা কথা কেবলি তাহার মনে আনাগোনা করিতে লাগিল যে, প্রাইজ না পেয়ে যদি রত্‌নার মতো মিশন স্কুলের ছেলেদের ঢিল মারার জন্যে বেত খেতুম তাহলে কত ভালই না হত?

এইভাবে ভয়সঙ্কুল ম্রিয়মাণ দিনগুলি ননীর কাটিতে লাগিল।

ননীর ষোল বছর বয়সে এমন একটা ঘটনা ঘটিল যাহাতে তাহার জীবনের উপর ধিক্কার জন্মিয়া গেল। আবার শহরে সার্কাস আসিয়াছে। এবার আর বাঘ দেখা নয়, স্কুলের ছেলেরা মিলিয়া আসল সার্কাস দেখিতে গেল। সেদিন ম্যাটিনে, স্কুলের ছেলেদের কনশেসন্‌ ছিল, তাই ননীরা কয়েকজন আট আনার টিকিট কিনিয়া এক টাকার চেয়ারে গিয়া বসিল। ননী একটা ভাল জায়গা দেখিয়া দল ছাড়িয়া একটু আলাদা হইয়া বসিল।

সার্কাস আরম্ভ হইতে আর দেরি নাই, দর্শকদের বসিবার স্থান সব ভরিয়া গিয়াছে, এমন সময় একজন ছোকরা সাহেব প্যান্টালুনের পকেটে দুই হাত পুরিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে ননীর নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ‘এই, ওঠ। এটা আমার জায়গা।’

ননী ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাহার মুখের পানে তাকাইয়া রহিল। সাহেব চেয়ারের পিঠে একটা নাড়া দিয়া বলিল, ‘শুনতে পাচ্ছ? এটা আমার চেয়ার—ওঠ।’

ননীর মুখে তবু কথা নাই; তাহার গলা শুকাইয়া কাঠ হইয়া গিয়াছে।

সাহেব তখন ঘাড়ের জামা ধরিয়া ননীকে তুলিয়া দিয়া নিজে চেয়ারটা অধিকার করিয়া বসিল।

সমস্ত পৃথিবী ননীর চক্ষে অন্ধকার হইয়া গেল। আচ্ছন্নভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া সে হোঁচট খাইতে খাইতে বাহিরের দিকে চলিল।

সার্কাসসুদ্ধ লোক চক্ষু মেলিয়া এই দৃশ্যাভিনয় দেখিতেছিল। বিশু ননীর কামিজ ধরিয়া টানিয়া চাপা গলায় বলিল, ‘ছেড়ে দিলি—কিছু বল্লি নে? আমি হলে—’

বিমল নিজের চেয়ারের একপাশে সরিয়া বসিয়া বলিল, ‘আয় ননী, এইখানে বস।’

ননী অতিকষ্টে গলা হইতে আওয়াজ বাহির করিল, ‘না, আমি বাড়ি যাই।’

সে-রাত্রে ননী ঘুমাইতে পারিল না। গভীর রাত্রে একবার তাহার ইচ্ছা হইল, চিৎকার করিয়া কাঁদে। কিন্তু বালিশ কামড়াইয়া অনেক কষ্টে সে ইচ্ছা রোধ করিল। হঠাৎ একবার বিছানা হইতে লাফাইয়া উঠিয়া ঘরের কোণ হইতে হকি-স্টিকখানা তুলিয়া লইয়া দুই হাতে মড়াৎ করিয়া ভাঙিয়া দু’খানা করিয়া ফেলিল। নিজের মনে পাগলের মতো বলিতে লাগিল, ‘কেন আমি এমন—কেন আমি এমন? ভীতু—ভীতু! উঃ! সব্বাই দেখলে। সব্বাই হাসলে! কাল স্কুলে যাব কি করে?

এই ঘটনার পর ননী যেন কেমন এক রকম হইয়া গেল, যেন কচ্ছপের মতো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটাইয়া ফেলিল। বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা হাসি-গল্প প্রায় বন্ধ করিয়া দিল। সর্বদা একলা ঘুরিয়া বেড়ায় এবং নিজের মনে বিজবিজ করিয়া কি বকে!

বিমল একদিন লক্ষ্য করিয়া বলিল, ‘দ্যাখ্‌, ননেটা কি রকম হয়ে গেছে—কথাও কয় না।’

বিশু বিজ্ঞভাবে বলিল, ‘একজামিনের পড়া পড়েছে, তোর মতো ফাঁকিবাজ তো নয়! ওরা বাবা বলেছেন ফার্স্ট হয়ে সেন্ট আপ্‌ হতে পারলে একটা সোনার রিস্ট ওয়াচ দেবেন!’

বিশুর অনুমান কিন্তু সর্বৈব ভুল। ননী রিস্ট ওয়াচের লোভে পড়া মুখস্থ করিত না। সে বিড়বিড় করিয়া কেবলি বকিত—আমি ভীতু নই! আমার সাহস আছে! আমি কাউকে ভয় করি না। এবার যে আমার সঙ্গে চালাকি করবে তাকে দেখে নেব। ইত্যাদি। যেন খাঁচার পাখি। নিরন্তর ব্যগ্র ব্যাকুল হইয়া খোলা আকাশের মুক্তি-মন্ত্র জপ করিতেছে।

মাসখানেক পরে একদিন বিশু আসিয়া বলিল, ‘ননী, মাঠে চল্‌, আজ মিশন স্কুলের সঙ্গে আমাদের ম্যাচ আছে।’

জনসঙ্ঘ বা যেখানে অনেক লোকের সমাবেশ সেখানে যাইতেও ননী মনে মনে ভয় পাইত। তাই সে জোর করিয়া বলিল, ‘আচ্ছা, চল।’

মাঠে ভীষণ ভিড়। অন্যান্য দর্শক ছাড়াও দুই স্কুলের ছেলেরা দলে দলে আসিয়া মাঠ ঘিরিয়া দাঁড়াইয়াছে। ফুটবল খেলায় এই দুই স্কুলে চিরদিন ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলিয়া আসিতেছে। কোন্‌ স্কুল বেশী ভাল খেলে তাহার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আজ পর্যন্ত হয় নাই এবং শেষ পর্যন্ত কবে হইবে তাহা বলিবার ক্ষমতা বোধ করি ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের পর্যন্ত নাই।

খেলা আরম্ভ হইল। দুই পক্ষের দর্শকই নিজ নিজ খেলোয়াড়দের কখনো ভর্ৎসনাপূর্ণ উগ্রকণ্ঠে, কখনো মিনতিভরা করুণসুরে উৎসাহিত করিতে লাগিল। কিন্তু যুযুৎসু দুই দলই সমান দুর্ধর্ষ—কেহই গোল দিতে পারিল না। খেলা দেখিতে দেখিতে দর্শকবৃন্দ ভীষণ উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত হইয়া উঠিল।

শেষে খেলা সমাপ্ত হইতে যখন আর মিনিট পাঁচেক বাকি আছে তখন ননীদের স্কুল একটা গোল দিল। ‘গোল’ ‘গোল’ শব্দে আকাশ বিদীর্ণ করিয়া ছাতা জুতা প্রভৃতির উৎক্ষেপ দ্বারা এই বিজয় কাণ্ডের আনন্দ নির্ঘোষিত হইল।

ননী যেখানে দাঁড়াইয়া খেলা দেখিতেছিল, তাহারই পাশে একটা বছর আটেকের ছেলে লাফাইয়া নাচিয়া ডিগ্‌বাজি খাইয়া চিৎকার করিতেছিল,—‘গোল! গোল! হুররে! আমার দাদা গোল দিয়েছে। হুররে! গোল! গোল!’ খেলা আবার আরম্ভ হইয়া গিয়াছে, তখনো ছেলেটা অক্লান্তভাবে চেঁচাইয়া চলিয়াছে।

তাহার কাছে দাঁড়াইয়া মিশন স্কুলের একটি ফিরিঙ্গি ছেলে খেলা দেখিতেছিল। গোল খাইবার পর সে বিশেষ একটু মুষড়িয়া গিয়াছিল, তাহার উপর এই পুঁটে ছেলেটার উৎকট আনন্দ তাহার অসহ্য বোধ হইল। সে ছেলেটার চুলের মুঠি ধরিয়া নাড়িয়া দিয়া বলিল, ‘এই, চুপ কর্‌—পাজি কোথাকার!’

ছেলেটা তাহার উদ্দাম উল্লাসে হঠাৎ বাধা পাইয়া আরও জোরে চেঁচাইয়া উঠিল, ‘অ্যাঁ—অ্যাঁ—আমায় মারছে—’

ফিরিঙ্গি ছেলেটি আচ্ছা করিয়া তাহার কান মলিয়া দিয়া বলিল, ‘চুপ কর্‌—নইলে এক কিক্‌ মেরে তোকে ঐ গাছের ডগায় তুলে দেব।’

পুঁটে ছেলেটার সাঙ্গপাঙ্গ বোধ হয় সেখানে কেহ ছিল না, তাই সে ননীকে দেখিতে পাইয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘ও ননীদা, দেখ না, আমায় মারছে—’

ননীর মনে হইল, তাহার গলাটা যেন কে চাপিয়া ধরিয়াছে—বুকের ভিতর অসম্ভব রকম ধড়ফড় করিতে লাগিল। মুখ একেবারে ছাইয়ের মতো সাদা হইয়া গেল।

সে কম্পিতস্বরে বলিল, ‘ওকে ছেড়ে দাও—ঐটুকু ছেলেকে মারছ কেন?’

ফিরিঙ্গি ছেলেটি মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, ‘ঐটুকু ছেলে? পাজি বজ্জাত রাস্কেল কোথাকার!’ বলিয়া ছেলেটার মাথায় এক গাঁট্টা বসাইয়া দিল। ছেলেটা তারস্বরে কান্না জুড়িয়া দিল।

খেলার দিকেই তখন সকলের বাহ্যেন্দ্রিয় নিবিষ্ট হইয়াছিল, এদিকের এই পার্শ্বাভিনয় কেহ লক্ষ্য করিল না।

ননী অস্বাভাবিক একটা তর্জন করিয়া কহিল, ‘ছেড়ে দাও বলছি, নইলে ভাল হবে না।’

রোদন-রত ছেলেটাকে ছাড়িয়া দিয়া ফিরিঙ্গি ছেলেটি ননীর মুখের খুব কাছে মুখ আনিয়া বলিল, ‘লড়তে চাও? আচ্ছা—চলে এস!’

কি করিয়া যে এই দ্বন্দ্বযুদ্ধ আরম্ভ হইল তাহা ননীর ঠিক মনে নাই। হঠাৎ সে দেখিল সে ফিরিঙ্গি ছেলেটির সহিত দারুণ লড়াই শুরু করিয়া দিয়াছে।

মুহূর্ত মধ্যে তাহাদের ঘিরিয়া একটা চক্র রচনা হইয়া গেল এবং যাহারা ফুটবল খেলা দেখিতেছিল, তাহাদের মধ্যে অনেকে এই নূতন খেলা দেখিতে আরম্ভ করিয়া দিল।

ফিরিঙ্গি ছেলেটি বোধ হয় মুষ্টিযুদ্ধ কিছু কিছু জানিত, তাই প্রথম হইতেই ঘুষি চালাইয়া ননীর নাক মুখ ভাঙ্গিয়া দিবার উপক্রম করিল। ননী কিন্তু মরিয়া হইয়া লাগিয়া রহিল। দু’জনের বয়স প্রায় সমান—শরীরও সমান বলবান বলিয়া বোধ হয়। লড়াই বেশ জমিয়া উঠিল।

ননী একবার লেঙ্গি দিয়া প্রতিপক্ষকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার বুকের উপর চাপিয়া বসিল এবং তাহার মুখে মাথায় অপটু হস্তে কিল মারিয়া তাহাকে কাবু করিবার চেষ্টা করিল। ফিরিঙ্গি ছেলেটি কিন্তু ননীকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিল এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া দুই হাতে ঘুষি চালাইয়া ননীর পেট ও মুখ থেঁতো করিয়া দিতে লাগিল। ননীর অবস্থা যায় যায় হইয়া উঠিল!

কিন্তু ননীর মনে ভয়ের লেশমাত্র নাই—সে তখন যুদ্ধের উল্লাসে মাতিয়া উঠিয়াছে! হারজিত যে অতি গৌণ ব্যাপার,—যুদ্ধটাই যে চরম সার্থকতা—এই মহৎ সত্য ননীর শিরায় শিরায় তখন নৃত্য শুরু করিয়া দিয়াছে।

হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড লাফ দিয়া ননী ফিরিঙ্গি ছেলেটির একেবারে ঘাড়ের উপর গিয়া পড়িল এবং দুই হাতে তাকে ভাল্লুকের মতো চাপিয়া ধরিয়া পিষিতে আরম্ভ করিল। ধৃতরাষ্ট্র যেমন করিয়া লৌহভীম চূর্ণ করিয়াছিল এ যেন কতকটা তাই!

ফিরিঙ্গি ছেলেটি আর ঘুষি চালাইতে না পারিয়া প্রাণপণে ননীর আলিঙ্গনমুক্ত হইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কিন্তু ননী তখন তাহার সর্বাঙ্গে আঠার মতো নেপ্‌টাইয়া গিয়াছে। তাহার বাহুবন্ধন ক্রমেই দৃঢ়তর হইতেছে।

ক্রমশ ফিরিঙ্গি ছেলেটির মুখ নীলবর্ণ হইয়া উঠিল। সে বন্ধনমুক্ত হইবার একটা শেষ চেষ্টা করিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ‘হয়েছে, এবার ছেড়ে দাও—pax—শান্তি!’

ননী ছাড়িয়া দিতেই দু’জনে মাটিতে বসিয়া পড়িয়া হাঁপাইতে লাগিল।

প্রথমে ফিরিঙ্গি ছেলেটি হাত বাড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘তোমার গায়ে খুব জোর তো! বক্সিং জান্‌লে কোন্ কালে তুমি আমায় হারিয়ে দিতে।’

ননী তাহার সহিত শেকহ্যান্ড করিয়া উৎফুল্ল ভাবে বাংলা ইংরাজীতে মিশাইয়া বলিল, ‘তুমি খুব ভাল বক্সিং জানো—না? উঃ, কি কিলটাই মেরেছ—এই দেখ ঠোঁট কেটে গেছে।’

ফিরিঙ্গি ছেলেটি হাসিয়া বলিল, ‘তুমি শিখবে? আমি ভাল জানি না বটে কিন্তু তোমাকে শেখাতে পারব।’

ননী মহা আগ্রহে বলিল, ‘হ্যাঁ, শিখব। কাল থেকেই তাহলে—হ্যাঁ—কি বল?’

“আচ্ছা।’

‘তোমার নাম কি? আমার নাম—ননী গাঙ্গুলী।’

‘আমার নাম ডিক্‌—ডিকি ফ্রাঙ্ক্‌লিন।’

ডিক্‌ চলিয়া গেলে পর ননীর বন্ধুবান্ধব ননীকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। ফুটবল ম্যাচ তখন শেষ হইয়া গিয়াছে।

বিশু সগর্বে তাহার পিঠ ঠুকিয়া বলিল, ‘সাবাস খলিফা, হিম্মৎ দেখিয়েছিস বটে! আমি বরাবরই জানি ননেটা চুপচাপ থাকে বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে ও একটা আসল গুণ্ডা! এঃ-ননী, চোখটা একেবারে বুজে গেছে যে!’

ননী একটিমাত্র দৃষ্টিক্ষম চক্ষু ও পটলের মতো স্ফীত ওষ্ঠপুট লইয়া একগাল হাসিয়া বলিল, ‘ও কিছু নয়—কালই সেরে যাবে। ডিক্‌ কিন্তু বেশ ছেলে—না?’

সেদিন হল্লা করিতে করিতে, গান গাহিতে গাহিতে বাড়ি ফিরিবার পথে ননী জীবনে প্রথম পরিপূর্ণ মুক্তির আস্বাদ পাইল। যে রাক্ষসটা এতদিন তাহাকে মুঠির মধ্যে পিষিয়া মারিবার উপক্রম করিয়াছিল, আজ স্বহস্তে সেই রাক্ষসকে বধ করিয়া যেন বিজয়ীর ললাটিকা পরিয়া সে বাড়ি ফিরিল।

১৩৩৮

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন