বুড়ো বুড়ি দুজনাতে

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বুড়ো বুড়ি দু’জনাতে

পুণায় আমার বাড়ির খুব কাছেই পেশোয়া পার্ক। পশুপক্ষী আছে, বাচ্চাদের জন্যে নকল রেলগাড়ি আছে, আর গাছপালার নীচে সিমেন্টের বেঞ্চি আছে। যারা শহরের ছোট ছোট বাড়ির ছোট ছোট ঘরে বাস করে, তারা সন্ধ্যের সময় এখানে এসে খোলা জায়গায় একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

আমিও প্রায় প্রত্যহ সন্ধ্যেবেলা পেশোয়া পার্কে যাই; মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তু নিরীক্ষণ করি। পার্কের এক কোণে ঝোপঝাড়ের আড়ালে একটি নিরালা বেঞ্চি আছে, সেখানে কিছুক্ষণ বসে অন্ধকার হলে বাড়ি ফিরে আসি।

কিছুদিন থেকে কিন্তু একটু অসুবিধে হয়েছে। একদিন ইতর প্রাণীদের পরিদর্শন শেষ করে নিজের বেঞ্চিটিতে বসতে গিয়ে দেখি, এক জোড়া বুড়ো-বুড়ি সেখানে বসে আছে এবং বিজবিজ করে গল্প করছে। বুড়োর বয়স আন্দাজ সত্তর, লম্বা রোগা পাকানো চেহারা; বুড়ির বয়স পঁয়ষট্টির কম নয়, গোলগাল ছোটখাটো গড়ন, পাকা চুল পিছন দিকে গিটবাঁধা। বুঝতে কষ্ট হয় না, এরা স্বামী-স্ত্রী। এতখানি স্বচ্ছন্দতা পরনারী বা পরপুরুষের সঙ্গে হয় না। সম্ভবত ওদের বাড়িতে অনেক ছেলেপুলে নাতি-নাতনী, সেখানে মন খুলে কথা বলার সুবিধে নেই, তাই ওরা সন্ধ্যোবেলা এখানে এসে বসে। এতদিন হয়তো অন্য কোথাও বসতো, এখন আমার নিরিবিলি বেঞ্চিটি আবিষ্কার করেছে।

পার্কের বেঞ্চির ওপর আমার অবশ্য মৌরুসী পাট্টা নেই, তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতদিনেও যদি তোমাদের দাম্পত্য প্রেম ফুরিয়ে না গিয়ে থাকে, অন্য কোথাও গিয়ে প্রেম কর না বাপু, আমার বেঞ্চির ওপর নজর কেন! জ্বালাতন!

তারপর দু’দিন পেশোয়া পার্কে যাওয়া হয়নি। তৃতীয় দিন গিয়ে দেখি বুড়ো-বুড়ি ঠিক বসে আছে। বুড়ি বুড়োর মুখের সামনে হাত নেড়ে কি বলছে, আর বুড়ো ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নাড়ছে। অর্থাৎ বুড়ি যা বলছে সবতাতেই বুড়ো রাজী। এমন অস্বাভাবিক বুড়ো-বুড়ি জন্মে দেখিনি।

এর পর যতবার আমার বেঞ্চিতে বসতে গেছি, দেখেছি বুড়ো-বুড়ি হাজির, নট্‌ নড়নচড়ন। আমি হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি।

এইভাবে মাসখানেক কাটবার পর একদিন সিংহমিথুনের খাঁচার সামনে বিমর্ষভাবে দাঁড়িয়ে আছি, ধুরন্ধরের সঙ্গে দেখা। সুধীর ধুরন্ধর আধুনিক কালের মারাঠী ছেলে, ভারি ফুর্তিবাজ এবং ফাজিল; আমি বাঙালী বলেই বোধহয় আমার প্রতি তার একটু আকর্ষণ আছে। মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসে, তার হাসি-গল্পের স্রোতে মন পরিষ্কার হয়ে যায়। আমাকে দেখে বলল—‘একি, আপনার মুখ শুকনো কেন? বক্কেশ্বরীর শরীর ভাল আছে তো?’

বক্কেশ্বরী ওরফে বকুরানী আমার টিয়াপাখির নাম। জানালাম বক্কেশ্বরীর স্বাস্থ্য ভালই আছে। তারপর নিজের দুঃখের কথা বললাম। বেঞ্চি বেদখলের কথা শুনে ধুরন্ধর বলল—‘তাই নাকি! চলুন তো দেখি কেমন বুড়ো বুড়ি।’

তাকে বেঞ্চির দিকে নিয়ে গিয়ে আঙুল দেখালাম। বুড়ো-বুড়িকে দেখে ধুরন্ধর খিলখিল করে হেসে উঠল—‘আরে এ যে—! আপনি একটু দাঁড়ান, আমি এখুনি আসছি।’

আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ধুরন্ধর বুড়ো-বুড়ির কাছে চলে গেল। দেখলাম হাত নেড়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। পাঁচ মিনিট পরে যখন সে ফিরে এল, তার কান থেকে নাক অবধি হাসি লেগে আছে। বলল—‘গুরুতর ব্যাপার। ওদের বেঞ্চি থেকে হটানো যাবে না।’

‘তুমি ওদের চেনো দেখছি।’

‘চিনি বৈকি। বুড়োর নাম কেশোরাও দেশমুখ, আর বুড়ির নাম শান্তা মোরে।’

‘অ্যাঁ! ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়।’

‘স্বামী-স্ত্রী হতে যাবে কোন্‌ দুঃখে। বুড়ো বিপত্নীক, আর বুড়ি বিধবা।’

‘বল কি? তাহলে—’

‘পুরাকালে—অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর আগে শান্তা বাঈ-এর সঙ্গে কেশোরাও-এর বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল। বোধ হয় একটু ভালবাসাও ছিল। কিন্তু বিয়ে হলো না। অন্য লোকের সঙ্গে বিয়ে হলো। শান্তা বাঈ-এর একঘর ছেলেপুলে নাতি-নাতনী হলো, কেশোরাও-এরও তাই। দু’জনেই পুণার স্থায়ী বাসিন্দা, দেখাশুনো হয়। তারপর কেশোরাও বিপত্নীক হলেন, আর শান্তা বাঈ হলেন বিধবা। ব্যস, লাইন ক্লিয়ার!’

‘লাইন ক্লিয়ার মানে! বুড়ো-বুড়ি প্রকাশ্য পার্কে বসে ঢলাঢলি করছে কেউ কিছু বলে না।’

‘বলবে কি করে! ওরা যে নাতি-নাতনীর বিয়ের পাকা কথা কইছে।’

‘সেটা কি রকম?’

‘বুড়োর একটি বিয়ের যুগ্যি নাতনী আছে, আর বুড়ির নাতি মুকুন্দ সবেমাত্র ডাক্তারি পাস করে বেরিয়েছে। তাই বুড়ো-বুড়ি উঠে পড়ে লেগেছে তাদের বিয়ে দেবার জন্যে। নিজেদের বিয়ে হয়নি তাই নাতি-নাতনীর বিয়ে দিয়ে শোধ তুলতে চায়।’

‘যাঃ, এ সব তোমার বানানো গল্প। তোমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা তো নিজেরাই বর-বৌ খুঁজে নেয়, ঘটকালির তোয়াক্কা রাখে না। তবে যদি নাতি-নাতনী পরস্পরকে পছন্দ না করে তো আলাদা কথা।’

‘পছন্দ খুবই করে। ব্যাপার বুঝলেন না? বুড়ো-বুড়ি এই ছুতো করে পুরনো প্রেম ঝালিয়ে নিচ্ছে।’

‘তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলা তোমার স্বভাব।’

‘বিশ্বাস হচ্ছে না! আসুন তাহলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিচ্ছি। এই কিছুক্ষণ আগে পার্কে মুকুন্দ আর কান্তাকে দেখেছি।’

পার্কের অন্য প্রান্তে এক জোড়া যুবক-যুবতী ঘাসের ওপর বসে তন্ময় হয়ে গল্প করছে, আমরা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চকিতে মুখ তুলে চাইল। ধুরন্ধর তর্জনী নেড়ে যুবককে বলল—‘মুকুন্দ, তোমাকে সাবধান করে দিতে এসেছি। এইমাত্র দেখে এলাম তোমার দিদিমা তাঁর বয়-ফ্রেন্ডকে নিয়ে বেঞ্চির ওপর ঘেঁষাঘেঁষি বসে আছেন।’

মুকুন্দ মুখ গম্ভীর করে কান্তার পানে চাইল, বলল—‘দিদিমার বয়ফ্রেন্ডকে আমি চিনি। বুড়োর মতলব ভাল নয়। আমি দিদিমাকে সাবধান করে দেব।’

কান্তা মুচকি হেসে বলল—‘আমার ঠাকুর্দা কারুর বয়-ফ্রেন্ড নয়। শান্তা বাঈ আমার ঠাকুর্দার গার্লফ্রেন্ড হবার চেষ্টায় আছেন। বুড়ির মতলব ভাল নয়। কোন দিন বুড়োকে নিয়ে ইলোপ করবেন।’

হরি হরি! কোথায় ঠাকুর্দা আর দিদিমার কার্যকলাপে লজ্জায় অধোবদন হবে, তা নয় ঠাট্টাতামাশা শুরু করে দিয়েছে—যেন ভারি মজার ব্যাপার। আজকালকার ছেলেমেয়েদের মনে গুরুজনের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা কি কিছুই নেই। কালে কালে এসব হচ্ছে কি?

১৮ অক্টোবর ১৯৬৮

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন