মায়া কুরঙ্গী

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়া করঙ্গী

জংলীবাবা যে সত্যকার একজন সাধুলোক, ঠক-দাগাবাজ নন, তাহার দুইটি প্রমাণ পাইয়াছিলাম। প্রথমত, অনুরাগী ভক্তেরা তাঁহার কাছে আসিতেছে দেখিলেই তিনি তারস্বরে এমন অশ্লীল গালিগালাজ শুরু করিতেন যে, রীতিমত গণ্ডারের চামড়া না হইলে কেহ তাঁহার কাছে ঘেঁষিতে সাহস করিত না। দ্বিতীয়ত, তিনি এক মুষ্টি যবের ছাতু ছাড়া আর কিছু ভিক্ষা লইতেন না। প্রভাতে সর্বাগ্রে যে ভিক্ষা দিত তাহার ভিক্ষা লইতেন, আর কাহারও ভিক্ষা লইতেন না।

মহারাষ্ট্র দেশে বহু সাধু-সন্ত জন্মিয়াছেন; জ্ঞানেশ্বর একনাথ রামদাস তুকারাম সাঁইবাবা। বর্তমানেও বহু সাধু-সন্ত আছেন, সন্দেহ নাই, কিন্তু তাঁহারা সহজে দেখা দেন না। মানুষের বর্তমান জীবনধারা যে-পথে চলিয়াছে সাধু-সজ্জনেরা সে-পথ সযত্নে পরিহার করিয়া চলেন। আর আমরা, যাহারা প্রতীচ্য-সভ্যতার কৃপায় সিনেমা পাইয়াছি, টেলিভিশন পাইয়াছি, হাইড্রোজেন বোমা পাইয়াছি, নেংটি-পরা সাধুতে আমাদের কি প্রয়োজন?

আমি নিতান্তই সংসারী মানুষ; জানামি ধর্মং ন চ মে প্রবৃত্তিঃ। তবু সাধু-সন্ন্যাসীর খবর পাইলে মনটা চঞ্চল হয়। একদিন শুনিলাম শহরের উপকণ্ঠে এক সাধু আসিয়াছেন, নাম জংলীবাবা; প্রকৃতি নামের অনুরূপ অর্থাৎ একেবারে বন্য। জংলীবাবাকে দর্শন করিবার জন্য মন উশখুশ করিতে লাগিল। জানি, সাধু-সন্ন্যাসীকে দর্শন করিলেই ইষ্টলাভ হয় না; কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়েরাও তো জানে, সিনেমার দেবদেবীদের দর্শন করিলে চতুর্বর্গ লাভ হয় না, কিন্তু তাই বলিয়া তাহাদের ঠেকাইয়া রাখা যায় কি? ওটা একটা বায়ুঘটিত রোগ।

একদিন অপরাহ্নে সাধু-দর্শনে বাহির হইলাম। পুণা হইতে যে পথটি শোলাপুরের দিকে গিয়াছে সেই পথের ধারে নির্জন প্রান্তে সাধুর আস্তানা। মাইল দেড়েক গিয়া দেখিলাম, রাস্তার ধারে কয়েকটি দামী এবং চকচকে মোটর দাঁড়াইয়া আছে। মোটরের আরোহীরা—সকলেই মেদপুষ্ট মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি—রাস্তার এক ধারে কাতার দিয়া দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া আছেন। বুঝিলাম, তাঁহারা যেদিকে তাকাইয়া আছেন সেইদিকেই সাধুর আড্ডা। তাঁহারা এ-পর্যন্ত আসিয়া বাকী পথটুকু অতিক্রম করিতে সাহস করিতেছেন না। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম সাধুর ঢিল ছোঁড়া অভ্যাস আছে।

যাহা হউক, এতদূর যখন আসিয়াছি তখন ভয় করিয়া লাভ নাই। রাস্তা হইতে পঞ্চাশ-ষাট গজ দূরে একটি খর্জুরকুঞ্জ। মোটরওয়ালাদের পিছনে ফেলিয়া সেই দিকে চলিলাম। চারিদিকে বড় বড় পাথরের চাঁই ছড়ানো খর্জুরকুঞ্জে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, মাঝখানে কয়েকটি পাথরের চাঙড় মিলিত হইয়া কুলুঙ্গির মতো একটি কোটর রচনা করিয়াছে; সেই কোটরের মধ্যে ঘিয়ে-ভাজা ডালকুত্তার মতো রক্তচক্ষু লেলিহজিহ্ব জংলীবাবা বসিয়া আছেন।

বাবাকে দেখিলে ভক্তির চেয়ে ভয় বেশী হয়। আমি নত হইয়া প্রণাম করিলাম।

বাবা রাষ্ট্রভাষায় আমাকে বড়কুটুম্ব সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “কী চাস? কবে নোবেল প্রাইজ পাবি তাই জানতে এসেছিস?”

অবাক হইয়া বাবার পানে চাহিলাম। সাধু-সন্ন্যাসীরা তো সংসারের কোনও খবরই রাখেন না, বাবা নোবেল প্রাইজের কথাও জানেন!

আমি কোটরের বাহিরে উপবেশন করিয়া জোড়হস্তে বলিলাম, “না বাবা, আমি ও-সব কিছু জানতে চাই না। আমি শুধু শ্রীচরণ দর্শন করতে এসেছি।”

বাবা বলিলেন, “কবে তোর বৌ মরবে, কবে নতুন বিয়ে করবি তাও জানতে চাস না?”

“না বাবা।”

বাবা ঘোর বিস্ময়ে আমাকে কিয়ৎকাল নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর ঘাড় তুলিয়া দূরস্থিত ভক্তদের উদ্দেশে অকথ্য মুখখিস্তি করিলেন। অবশেষে আমাকে বলিলেন, “শ্রীচরণদর্শন তো হয়েছে, এবার যা, দূর হ।”

কৃতাঞ্জলিপুটে বলিলাম, “বাবা, আপনি সিদ্ধপুরুষ, অন্তর্যামী, আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন। আমিও নেহাত বোকা নই, বুঝতে পেরেছি আপনার অগ্নিশর্মারূপ একটা ছদ্মবেশ, আমার মতো হতভাগ্য সংসারীদের দূরে রাখতে চান।”

বাবা মিটিমিটি চাহিয়া বলিলেন, “তুই দেখছি একটা বিচ্ছু। কী চাস বল।” বাবার কণ্ঠস্বর যেন একটু নরম হইয়াছে।

বলিলাম, “বাবা, সারাজীবন ধরে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। কোথাও উত্তর পাইনি। আপনি কৃপা করে অধমের অজ্ঞানমসী দূর করুন।”

“ভণিতা ছাড়, কী প্রশ্ন বল।”

“বাবা, পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে, সকলের ভিত্তি হচ্ছে জন্মান্তরবাদ; অর্থাৎ আত্মা অমর, দেহের বিনাশ হলেও আত্মা বেঁচে থাকে। এই জন্মান্তরবাদ বা আত্মার অমরত্ব যদি সত্যি না হয়, তাহলে কোনও ধর্মেরই কিছু থাকে না। এখন কথা হচ্ছে, আত্মা যে বেঁচে থাকে তার কোনও প্রমাণ আছে কি?”

“কী প্রমাণ চাস?”

“শাস্ত্রে দু’ রকম প্রমাণের উল্লেখ আছে, প্রত্যক্ষ আর অনুমান। এর যেটা হোক একটা পেলেই সব সন্দেহ দূর হবে।”

বাবা বলিলেন, “হিন্দু ন্যায়শাস্ত্রে আর একটা প্রমাণ আছে, তাকে বলে আপ্তবাক্য।”

সক্ষোভে বলিলাম, “আজকাল আপ্তবাক্যে কেউ বিশ্বাস করে না বাবা, হেসে উড়িয়ে দেয়। বলে, বুদ্ধদেব যীশুখ্রীষ্ট সবাই গাঁজা খেতেন। তবে কি বাবা, সত্যিকার প্রমাণ কিছু নেই?”

জংলীবাবা কিছুক্ষণ তৃষ্ণীভাব ধারণ করিয়া রহিলেন। তারপর বলিলেন, “প্রমাণ আছে। কিন্তু তোরা অন্ধ, দেখাব কী করে?”

বলিলাম, “আপনি মহাপুরুষ, জ্ঞানাঞ্জনশলাকা দিয়া আপনি যদি অন্ধের চক্ষুরুন্মীলন না করেন, তবে কে করবে?”

বাবা আবার তেরিয়া হইয়া উঠিলেন, পাঁচ মিনিট ধরিয়া আমার চৌদ্দ পুরুষান্ত করিয়া শেষে বলিলেন, “নিজের পূর্বজন্ম স্বচক্ষে দেখলে তোর বিশ্বাস হবে?”

জোড়হস্তে বলিলাম, “হবে বাবা।”

“তবে যা, রাত্রিবেলা ঘরে দোর দিয়ে বসবি, একটা মোমবাতি জ্বেলে একদৃষ্টে সেই দিকে চেয়ে থাকবি। যতক্ষণ মোমবাতি পুড়ে শেষ না হয়ে যায় ততক্ষণ চেয়ে থাকবি। এমনি রোজ করবি। যদি বাপের পুণ্যি থাকে একদিন দেখতে পাবি!—যা, এখন বেরো।”

আমি উঠিবার উপক্রম করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “মোমবাতির দিকে চেয়ে থাকবার সময় কী ভাবব বাবা?”

“কিছু ভাববি না, মন শূন্য করে ফেলবি। যা ভাগ।”

সেই দিনই সন্ধ্যার পর এক বাণ্ডিল মোমবাতি কিনিয়া আনিলাম এবং আমার লেখা-পড়ার ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া বসিয়া গেলাম। বাড়ির সবাই জানে এ-সময়ে আমি একান্ত মনে লেখাপড়া করি, তাই কেহ বিরক্ত করে না।

জ্বলন্ত মোমবাতির পানে চাহিয়া বসিয়া থাকা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়, কিন্তু মনকে নির্বিষয় করাই প্রাণান্তকর।

পতঞ্জলি বলিয়াছেন, ধ্যানং নিবিষয়ং মনঃ। গীতা বলেন, মনকে আত্মসংস্থ করিয়া ন কিঞ্চিদীপ চিন্তয়েৎ। কথাগুলি জানা আছে। সুতরাং চেষ্টার ত্রুটি করিলাম না। কিন্তু মন প্রমাথী এবং বলবদ্দৃঢ়। একদিক পরিষ্কার করি তো অন্যদিক হইতে পঙ্গপালের মতো চিন্তা ঢুকিয়া পড়ে। ঝাঁটা হস্তে মনের এদিক হইতে ওদিক ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইতেছি, কিন্তু কোনও ফল হইতেছে না। এ-যেন মশক-পরিবৃত স্থানে কেবল চড়-চাপড় চালাইয়া মশা তাড়াইবার চেষ্টা।

প্রথম দিন বৃথা গেল, দ্বিতীয় তৃতীয় দিনও তাই। মোমবাতি পুড়িয়া শেষ হইয়া যাইতেছে, কিন্তু আমার পূর্বজন্মের ‘আমি’র দেখা পাইতেছি না।

ক্রমে হতাশ হইয়া পড়িতে লাগিলাম।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার মন বোধ হয় শূন্যতার দিকে অগ্রসর হইতেছিল, আমি জানিতে পারি নাই।

পঞ্চম দিনে ফল পাইলাম।

মোমবাতি জ্বালিয়া সবেমাত্র বসিয়াছি, মনটা নিস্তরঙ্গ হইয়া আসিতেছে, দেখিলাম মোমবাতির শিখা ঘিরিয়া অভঙ্গ রামধুনর মতো একটি সপ্তবর্ণের মণ্ডল রচিত হইয়াছে। ক্রমে মণ্ডলের ভিতর দিয়া ঘরের যে অংশ দেখা যাইতেছিল, তাহা অদৃশ্য হইয়া গেল, শুধু মণ্ডলের মধ্যবর্তী মোমবাতির পীতাভ স্নিগ্ধ শিখাটি রহিল…তারপর শিখাটিও অদৃশ্য হইয়া গেল। মণ্ডলের মধ্যে রহিল অচ্ছাভ শূন্যতা।

এইবার ধীরে ধীরে মণ্ডলমধ্যবর্তী শূন্যতা চিহ্নিত হইতে লাগিল। একটা মুখ ছায়াছবির পটের উপর আলোকচিত্রের মতো ফুটিয়া উঠিল। জীবন্ত মুখ; চোখের দৃষ্টিতে প্রাণপূর্ণ সজীবতা। পুরুষের মুখ; মস্তক এবং মুখ মণ্ডিত, একটু শীর্ণ অস্থিসার গঠন, কণ্ঠের অস্থি উচ্চ। মুখখানা যেন চিন্তায় মগ্ন হইয়া আছে। চক্ষু উন্মীলিত রহিয়াছে বটে, কিন্তু বাহিরের কিছু দেখিতেছে না, নিজের মনের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া আছে।

এই মুখখানার দিকে চাহিয়া চাহিয়া আমার বুকের মধ্যে একটা অব্যক্ত উদ্বেগ বদ্ধ কক্ষে ধূমকুণ্ডলীর মতো তাল পাকাইতে লাগিল। কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল। মনে হইল ওই মুখখানা আমারই মুখ, এই মুখের অন্তরালে যে চিন্তার ক্রিয়া চলিতেছে, তাহা আমারই চিন্তা; জানি না কতকাল পূর্বে কোথায় বসিয়া আমি এই চিন্তা করিয়াছিলাম। ক্রমে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিল; আমার বর্তমান সত্তা ধীরে ধীরে ওই অতীত সত্তার সহিত মিশিয়া অভিন্ন হইয়া গেল।—

এইখানে একটা কথা বলিয়া রাখি। বর্তমানে আমি আয়নায় নিজের যে-মুখ দেখিতে পাই তাহার সহিত ওই মুখের বিশেষ সাদৃশ্য নাই; কিন্তু একেবারে বিসদৃশও নয়। ভ্রূর হাড় উঁচু, কান বড়, চিবুক ছোট; এই রকম সাধারণ মিল আছে। একই বংশের দুইজন মানুষের মধ্যে এইরূপ সাদৃশ্য থাকা সম্ভব।

আমি কে, কোথায় আছি, কী করিতেছি তাহা জানি। কিন্তু কত দিন আগেকার কথা তাহা জানি না। অব্দ সম্বতের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এইটুকু বলিতে পারি, অজন্তায় মাত্র পাঁচটি গুহা তখন খোদিত হইয়াছিল।

অজন্তার একটি গুহার মধ্যে আমি বসিয়া আছি। গভীর রাত্রি। আমার দুই জানুর পাশে দুইটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। সেই আলোতে গুহা-প্রাচীরের কিয়দংশ দেখা যাইতেছে। আমি একাকী বসিয়া ছবি আঁকিতেছি।

গুহায় আর কেহ নাই, আমি একা।

দিনের বেলা অনেক ভিক্ষু শ্ৰমণ এখানে কাজ করে। কেহ পর্বতগাত্র কাটিয়া গুহা রচনা করে, কেহ মূর্তি গড়ে, কেহ গুহা-প্রাচীরের চিত্র আঁকে। সন্ধ্যার সময় তাহারা পর্বতপৃষ্ঠ হইতে উপত্যকায় নামিয়া যায়।

দুই সমান্তরাল পাহাড়ের মাঝখান দিয়া উপলবন্ধুর অগভীর জলপ্রবাহ গিয়াছে, সেই নির্ঝরিণীর কূলে আমাদের মৃৎকুট্টির। সেখানে রাত্রি কাটাইয়া প্রভাতে আমরা আবার উপরে উঠিয়া আসি, সারাদিন কাজ করি। ইহাই আমাদের জীবন। সংসারের একান্তে গিরিসঙ্কটের নির্জনতায় গোপন স্বর্লোক রচনা করিতেছি, ভগবান বুদ্ধের অলৌকিক মহিমার শিল্প-কায়া গঠন করিতেছি। আমরা যখন থাকিব না, আমাদের অনামা কীর্তি তখনও অবিনশ্বর হইয়া থাকিবে।

আমার নাম পুণ্ডলীক। কলিঙ্গ দেশে এক ক্ষুদ্র জনপদের অধিবাসী ছিলাম। কিন্তু স্বদেশে আমার সহজ শিল্প-কৃতিত্বের আদর হইল না। কুড়ি বৎসর বয়সে আমি সংসার ছাড়িয়া বৌদ্ধ সঙ্ঘে প্রবেশ করিয়ালম।

বুদ্ধের সঙ্ঘ-বিহারে শিল্পের আদর আছে। শীঘ্রই আমার শিল্পক্রিয়া গুণিজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। শিল্পাচার্য গোতমশ্রী আমাকে শিষ্য করিয়া লইলেন।

তারপর চৌদ্দ বৎসর কাটিয়াছে।

গুরুর সঙ্গে বহু দেশ ভ্রমণ করিয়া বেড়াইয়াছি, বহু সংঘারাম স্তূপ চৈত্য অলঙ্কৃত করিয়াছি।

নিভৃত গিরিসঙ্কুল প্রদেশের পর্বতগাত্রে গুহা খোদিত করিয়া শিল্প-মন্দির রচনার রীতি দাক্ষিণাত্যের রাজারা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। দুই তিন শত বৎসর করিয়া এই রীতি প্রচলিত আছে। রাজারা অর্থদান করেন, শিল্পীরা পাষাণপটে তথাগতের অলৌকিক জীবনকথার রূপদান করে।

গত তিন বৎসর আমরা অজন্তায় কাজ করিতেছি। আচার্য গোতমশ্রীর সঙ্গে আমরা দশজন প্রতিমা-শিল্পী ও দশজন চিত্রশিল্পী আছি। আমি চিত্রশিল্পী। আরও অনেক শ্ৰমণ আছে, তাহারা শ্রমসাধ্য কাজ করে।

আজ গভীর রাত্রে অন্ধকারে গুহামধ্যে প্রদীপ জ্বালিয়া আমি চিত্র আঁকিতেছি। চিত্র প্রায় সম্পূর্ণ হইয়াছে, কেবল স্থানে স্থানে একটু রঙের স্পর্শ, একটু ব্যঞ্জনার সংস্কার করিতে হইবে। কাল মহারাজ বাণদেব চিত্র পরিদর্শন করিতে আসিবেন। তৎপূর্বেই চিত্র প্রস্তুত থাকা চাই।

প্রদীপ তুলিয়া ধরিয়া চিত্রটিকে পরীক্ষা করিলাম। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে চারি হস্ত পরিমাণ চিত্র। আশেপাশে উপরে জাতক হইতে অন্য চিত্র আঁকিয়াছি, সকলের মধ্যস্থলে এই চিত্রটি। চিত্রের বিষয়বস্তু—সিদ্ধার্থ ও গোপার বিবাহ। চারিদিকে বহু পরিজন, কেন্দ্রস্থলে গোপার পাণিগ্রহণ করিয়া বরবেশী সিদ্ধার্থ।

চিত্রটি শিল্পশাস্ত্রানুযায়ী হইয়াছে, আচার্য গোতমশ্রী দেখিয়া তুষ্ট হইয়াছেন। সামান্য অঙ্কনের ত্রুটি যেটুকু আছে তাহা আজ রাত্রেই সংশোধন করিব।

কিন্তু—এই চিত্রের মূলে যে বিপুল প্রতারণা আছে তাহা কেবল আমি জানি; আর কেহ তাহা দেখিতে পায় নাই। গোপার যে-মূর্তি আঁকিয়াছি তাহা দেবীমূর্তি নয়, আমার কামনার রসে নিষিক্ত লালসাময়ী স্ত্রীমূর্তি।

আমি ভিক্ষু, আমার জীবন নারীহীন। কিন্তু নারীর জন্য কোনও দিন তীব্র আকাঙক্ষা অনুভব করি নাই। আমার শিল্পই আমার জীবন।

বহু নারী আঁকিয়াছি।—দেবী মানবী অপ্সরী কিন্নরী গন্ধর্ববধূ, নির্লিপ্ত নিরাসক্ত চিত্তেই আঁকিয়াছি। এইভাবে চৌদ্দ বৎসর কাটিয়াছে। তারপর সহসা আজ হইতে তিন মাস পূর্বে আমার অন্তর্লোকে বিপ্লব ঘটিয়া গেল।—

তিন মাস পূর্বে প্রতিষ্ঠান নগর হইতে পরমসৌগত শ্রীমন্থহারাজ বাণদেব আসিয়াছিলেন; সঙ্গে ছিলেন রানী কুরঙ্গিকা।

নবীন রাজা নবীনা রানী।

একটি গুহায় উচ্চ পাষাণ-চৈত্য আছে, রাজারানী সেই চৈত্যমূলে স্বর্ণমুষ্টি রাখিয়া পূজা দিলেন। তারপর রাজা আচার্য গোতমশ্রীকে বলিলেন, “আমার ইচ্ছা একটি গুহাপ্রাচীরে সিদ্ধার্থ ও গোপার পরিণয়-দৃশ্য অঙ্কিত করা হয়।”

গোতমশ্রী দেখিলেন, রাজা ও রানীর নূতন বিবাহ হইয়াছে, নব-অনুরাগের মাদক রসে উভয়ের মন মজ্জিত হইয়া আছে; তাই সিদ্ধার্থ ও গোপার বিবাহ-চিত্র অঙ্কিত করাইতে তাঁহাদের এত আগ্রহ।

গোতমশ্রী আমাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। আমি তাঁহার প্রধান শিষ্য, রাজাদিষ্ট চিত্র আমিই আঁকিব।

সেই রানী কুরঙ্গিকাকে প্রথম দেখিলাম।

রাজা বাণদেবও অতিশয় সুপুরুষ: যৌবন-ভাস্বর দেহ, বুদ্ধি-দীপ্ত প্রসন্ন মুখমণ্ডল। কিন্তু আমি যেন তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। তাঁহার পাশে, একটু পিছনে রানী কুরঙ্গিক নতমুখে লীলাকমলের দল নখে বিদ্ধ করিতেছিলেন; আমি কেবল তাঁহাকেই দেখিলাম।

রানী কুরঙ্গিকার রূপের বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শিল্পীর বিশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়া আমি তাঁহার রূপ দেখি নাই, দেখিয়াছিলাম অন্ধ আবেগের আশ্লেষণী দৃষ্টি দিয়া। মুহূর্তমধ্যে আমার দেহ-মন উন্মথিত করিয়া এক মদান্ধ রসোচ্ছ্বাস উত্থিত হইয়াছিল।

আমার চৌত্রিশ বছর বয়স হইয়াছে। আমি জানি, আমার অন্তরে যে রসোচ্ছ্বাস উত্থিত হইয়াছে তাহা অমৃতের উৎস নয়, তীব্র গরলের ধারা। আমার মনের গরলের সহিত রানী কুরঙ্গিকার কোনও সংস্রব নাই, ইহা একান্তভাবে আমার মনের গরল। কোথায় এতদিন লুক্কায়িত ছিল, দেহের কোন গূঢ়-গহন গুহায় আত্মগোপন করিয়াছিল; আজ সহসা অগ্নুৎপাতের মতো বাহির হইয়া আসিয়াছে।

বাহির হইয়া আসিয়াছে বটে, কিন্তু তবুও বাহিরে উহার প্রকাশ কেহ লক্ষ্য করে নাই।

গোতমশ্রী কিছু জানিতে পারেন নাই, রাজাও না। আশ্চর্য মানুষের মুখ! আমরা শিল্পী, মানুষের মুখ আঁকিয়া মানুষের মনের কথা প্রকাশ করিবার চেষ্টা করি। কিন্তু বাস্তবজীবনে মুখ দেখিয়া মনের কথা কতটুকু জানা যায়? মানুষের মনে অনেক পাপ। তাই ছদ্ম-সাধুতা তাহার সহজাত সংস্কার।

গোতমশ্রী রাজার প্রস্তাব আমাকে শুনাইলেন।

আমি চিত্র আঁকিতে সম্মত হইলাম।

প্রাচীরের কোন্‌ স্থানে চিত্র অঙ্কিত হইবে তাহা স্থির হইল। নূতন গুহার প্রাচীরে অধিকাংশ স্থান এখনও শুন্য; মনোমত স্থান নির্বাচনের অসুবিধা নাই। পুরাতন গুহাগুলির সকল স্থান ভরিয়া গিয়াছে।

অজন্তার নিকট দিয়া প্রতিষ্ঠান নগর হইতে সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত দীর্ঘ বাণিজ্যপথ আছে, সেই পথে বহু সার্থবাহ মহার্ঘ পণ্য লইয়া যাতায়াত করে। তাহারা দৈবতুষ্টির জন্য চৈত্যে পূজা দিয়া যায়, গুহা-প্রাচীরে আপন মনোমত চিত্র আঁকাইয়া লয়। এইভাবে গুহাগুলি একে একে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

রাজা বাণদেব অঞ্জলি ভরিয়া নানা বর্ণের রত্ন আমার সম্মুখে ধরিলেন, বলিলেন, “ভিক্ষু, এই রত্নগুলি আপনি নিন। এদের চূর্ণ করে যে বর্ণ হবে সেই বর্ণ দিয়ে চিত্র আঁকবেন। যেন যুগ-যুগান্তরেও চিত্রের বর্ণ মলিন না হয়।”

রাজা বাণদেব কবি এবং প্রেমিক।

আমার চক্ষু তাঁহার মুখ হইতে দেবী কুরঙ্গিকার দিকে ফিরিল। তিনি আমার পানে কুরঙ্গ-নয়ন তুলিয়া মৃদু হাসিলেন। যেন স্বামীর নির্বন্ধের সহিত নিজের আগ্রহ যোগ করিয়া দিলেন।

আমার অন্তরের মধ্যে একটা আর্ত আকুতি চিৎকার করিয়া উঠিল—‘দেবি, আমার মনকে ক্ষমা কর, আমার মনের পঙ্ক যেন তোমাকে স্পর্শ করতে না পারে।’

রত্নগুলি নিজ অঞ্জলিতে লইয়া মহারাজ বাণদেবকে বলিলাম, “তাই হবে আর্য।”

বিদায় গ্রহণের পূর্বে বাণদেব আমাকে আড়ালে লইয়া গিয়া বলিলেন, “ভিক্ষু, শিল্পীকে উপদেশ দেবার স্পর্ধা আমার নেই। কিন্তু দেবদেবীর আলেখ্য রচনার সময় মানুষী মূর্তিরই আশ্রয় নিতে হয়।”

ইঙ্গিতের তাৎপর্য—আমি যেন রাজা বাণদেব ও রানী কুরঙ্গিকার আদর্শে সিদ্ধার্থ এবং গোপার চিত্র অঙ্কন করি।

বলিলাম, “অবশ্য। আমার স্মরণ থাকবে।”

তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কতদিনে চিত্র প্রস্তুত হবে।”

বলিলাম, “তিন মাস লাগবে!”

তিনি বলিলেন, “ভাল। তিন মাস পরে এই কৃষ্ণা নবমী তিথিতে আবার আসব, আপনার শিল্পকলা দেখে যাব।”

তারপর রত্নগুলির বর্ণনানুসারে পৃথক্‌ভাবে চূর্ণ করিয়া তাহার সহিত অন্য রসায়ন মিশাইয়া রঙ প্রস্তুত করিয়াছি, গুহা-প্রাচীরের গাত্র মসৃণ করিয়া করিয়া তাহার উপর চিত্র আঁকিয়াছি।

সিদ্ধার্থের চিত্রে কালায়ত লোকসিদ্ধ আকৃতির সহিত বাণদেবের আকৃতি মিশাইয়াছি। আর গোপাকে আঁকিয়াছি রানী কুরঙ্গিকার প্রতিচ্ছবি করিয়া। নীলকান্ত মণির চূর্ণ দিয়া তাঁহার কেশ আঁকিয়াছি, ভ্রূ আঁকিয়াছি, নেত্রতারা আঁকিয়াছি। পদ্মরাগের গুঁড়া দিয়া আঁকিয়াছি তাঁহার অধর। পীত পুষ্পরাগ-চূর্ণের সহিত শঙ্খচূর্ণ মিশাইয়া রচিয়াছি তাঁহার দেহবর্ণ। আর—তাঁহার সমস্ত দেহে লেপিয়া দিয়াছি আমার মনের গলিত-তপ্ত লালসা।

কেন এমন হইল?

যাহাকে চিনিতাম না, জানিতাম না, যাহার মনের পরিচয় পাই নাই, তাহার দেহটা এমন করিয়া কেন আমার মন জুড়িয়া বসিল! আমি নারী-লোলুপ লম্পট নই, শুদ্ধাচারী ভিক্ষু। যৌবনের সীমান্তে আসিয়া আমার এ কী হইল?

গোপার চিত্র আঁকিতে আঁকিতে আমি যে দুরন্ত হৃদয়াবেগ অনুভব করিয়াছি তাহা পূর্বে কখনও অনুভব করি নাই। কখনও অলৌকিক উল্লাসে মন ভরিয়া উঠিয়াছে; কখনও মনের অশুচিতায় নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মিয়াছে। এত আনন্দ এবং এত কলুষ যে আমার মধ্যে ছিল, তাহা আমি নিজেই জানিতাম না!

চিত্র শেষ হইয়াছে, আমার সঙ্গে চিত্রের সম্বন্ধও ফুরাইয়া আসিতেছে। কাল রাজা বাণদেবের নিকট এই চিত্র সমর্পণ করিয়া আমি নিষ্কৃতি পাইব।

আমার গুরু এবং সতীর্থগণ চিত্র দেখিয়া অকুণ্ঠ প্রশংসা করিয়াছেন, আমি লজ্জায় অন্তরের মধ্যে আরক্তিম হইয়া উঠিয়াছি। কেবল একটি সান্ত্বনা আমার আছে—আমার মনের কথা কেহ জানিতে পারে নাই। গোপর মুখে যে দেবীভাব না ফুটিয়া মানুষী ভাব ফুটিয়াছে তাহা রসজ্ঞের চক্ষে বিবাহকালীন বিভ্রমের স্বাভাবিক ব্যঞ্জনা বলিয়া গৃহীত হইয়াছে। শিল্পীর মনের লালসা-কলুষ যে চিত্রিতার অঙ্গে লিপ্ত হইয়াছে তাহা কেহ ধরিতে পারে নাই।

রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে। গুহার মুখের কাছে অস্পষ্ট চন্দ্রালোকের আভা ফুটিয়াছে।

আমি প্রদীপ ধরিয়া গোপার আলেখ্য তিল তিল করিয়া নিরীক্ষণ করিলাম। অধরে আরও একটু লালিমা যোগ করিয়া দিলাম, কটিতে ত্রিবলীর রেখা নীল বর্ণ দিয়া একটু স্পষ্ট করিলাম। তারপর দীপ নিভাইয়া গুহার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম।

বাহিরে গুহা হইতে গুহান্তরে যাইবার সংকীর্ণ পথ, তাহার অন্য ধারে গভীর উপত্যকার খাদ। উপত্যকার পরপারে রোমশ পাহাড়ের মাথায় ভাঙা চাঁদ মুখ তুলিয়াছে।

চারিদিক স্বপ্নাচ্ছন্ন।

বহিঃপ্রকৃতির বিপুল স্তব্ধতার পানে চাহিয়া চাহিয়া মনে হইল আজিকার রাত্রি আমার জীবনের শেষ রাত্রি; আমার বাঁচিয়া থাকার প্রয়োজন শেষ হইয়াছে।—

দ্বিপ্রহরের কিছু পূর্বে রাজা বাণদেব আসিলেন। কিন্তু রানী কুরঙ্গিকা তাঁহার সঙ্গে আসেন নাই, রাজা বাণদেব একাকীই আসিয়াছেন।

চিত্রের সম্মুখে সারি সারি দীপ জ্বালিয়া দেওয়া হইয়াছিল, কারণ দিবাভাগেও গুহার অভ্যন্তর ছায়াচ্ছন্ন।

রাজা বাণদেব দীর্ঘকাল দাঁড়াইয়া চিত্রটি দেখিলেন। তাঁহার মুখে নানা ভাবের ব্যঞ্জনা পর্যায়ক্রমে ফুটিয়া উঠিতে লাগিল; কখনও সংবৃত গাম্ভীর্য, কখনও ভঙ্গুর হাস্য। রসিক ব্যক্তি পরম রসবস্তু পাইলে এমনই আত্মসমাহিত হইয়া যায়।

অবশেষে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া আমার পানে চক্ষু ফিরাইলেন।

তাঁহার চোখের দৃষ্টি দেখিয়া আমার অঙ্গ সহসা হিম হইয়া গেল। তিনি বুঝিয়াছেন: আর কেহ যাহা অনুমান করিতে পারে নাই, তিনি তাহা বুঝিয়াছেন। তিনি শুধু চিত্রই দেখেন নাই, চিত্রকরের অন্তরও দেখিয়াছেন।

প্রেমের চক্ষুকে ফাঁকি দেওয়া যায় না, তাই এই তরুণ যুবকের চক্ষে আমি ধরা পড়িয়া গিয়াছি।

বাণদেব মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, “ভিক্ষু, ধন্য আপনার প্রতিভা।—একবার এদিকে আসুন, আপনাকে আড়ালে দুটি কথা বলতে চাই।”

গোতমশ্রী ও অন্য শিল্পীরা গুহামধ্যে রহিলেন, রাজা গুহার বাহিরে গেলেন। আমি তাঁহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। সম্মুখেই অতলস্পর্শ খাদ; তাহার তলদেশে উপলচপলা নির্ঝরিণী রবিকরে ঝিকমিক করিতেছে।

রাজা কণ্ঠস্বর নিম্ন করিয়া বলিলেন, “ভিক্ষু, আপনার কলানৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু—”

কম্পিতস্বরে বলিলাম, “কিন্তু কী আর্য?”

রাজা বলিলেন, “বুদ্ধের সংঘ আপনার প্রকৃত স্থান নয়। আপনার অন্তরের তৃষ্ণা এখনো দূর হয়নি। আপনি আসুন আমার সঙ্গে, সংসারে ফিরে চলুন—”

রাজা বাণদেব যদি তরবারি দিয়া আমার শিরচ্ছেদ করিতেন তাহা হইলে পলকমধ্যে আমার লজ্জার অবসান ঘটিত। কিন্তু তাঁহার শান্ত সংযত বাক্যে সমস্ত পৃথিবী আমার চক্ষে লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিল। কণ্ঠ দিয়া শব্দ বাহির হইল না।

বাণদেব বলিয়া চলিলেন, “ভোগেরও সার্থকতা আছে। সংযত ভোগে ধাতু শুদ্ধ হয়, শিল্পীর পক্ষে ভোগের প্রয়োজন আছে। যে-শিল্পীর ধাতু প্রসন্ন হয়নি সে রসলোকে উত্তীর্ণ হতে পারে না। আপনি চলুন আমার সঙ্গে, আমার সভায় প্রধান শিল্পীর আসন অলঙ্কৃত করবেন—”

আর সহ্য হইল না। আমার মস্তিষ্কের মধ্যে যেন একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটিয়া গেল।

চিৎকার করিয়া বলিলাম, “মহারাজ, আমি ধর্মভ্রষ্ট ভিক্ষু, আদর্শভ্রষ্ট শিল্পী—পৃথিবীতে আমার স্থান নাই।”

উন্মত্তের মতো আমি খাদে লাফাইয়া পড়িলাম।

আত্মস্থ হইয়া দেখিলাম, মোমবাতিটা দপ্‌দপ্‌ করিয়া নিভিয়া যাইতেছে।

পরদিন প্রাতঃকালেই জংলীবাবার আস্তানায় গেলাম। দেখি কোটর শূন্য, বাবা অন্তর্হিত হইয়াছেন।—

আমার জীবনে এই যে একটা আষাঢ়ে ব্যাপার ঘটিয়া গেল, এই লইয়া মাঝে মাঝে চিন্তা করি। যখনই চিন্তা করি, মনের মধ্যে দুইটি প্রতিপক্ষ মাথা তোলে। এক পক্ষ নির্বিচারে বিশ্বাস করে, সে-রাত্রে যাহা দেখিয়াছিলাম তাহা আমার পূর্বজন্মেরই একটি দৃশ্য। যদি কোনও দিন অজন্তা দেখিতে যাই, নিশ্চয়ই নিজের হাতে আঁকা ছবি দেখিতে পাইব। অন্য পক্ষ বলে, জংলীবাবা সম্মোহন বিদ্যা দেখাইয়াছেন।

মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয়, আবার মোমবাতি জ্বালাইয়া বসি। যে তীব্র মনঃপীড়া একবার পাইয়াছি তাহা আর দ্বিতীয়বার অনুভব করিতে চাই না।

তবে একটা লাভ হইয়াছে। আমি যে ছবি আঁকিতে পারি তাহা এতদিন জানিতাম না, চেষ্টাও করি নাই। এখন চেষ্টা করিয়া দেখিলাম, ছবি আঁকা আমার পক্ষে সহজ। সুদূর অতীত কালের একটি কুরঙ্গনয়না যুবতীর মুখ ইচ্ছা করিলেই আঁকিতে পারি।

১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৪

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন