কেতুর পুচ্ছ

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

কেতুর পুচ্ছ

ডাক্তার অমিতাভ মিত্রের বয়স আটাশ বৎসর। মাত্র দুই বৎসর হইল সে কলেজ ছাড়িয়া ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে, কিন্তু ইহারই মধ্যে শহরে বেশ পসার জমাইয়া তুলিয়াছে। শহরটি বেশ বড় এবং তাহাতে বহুমারী প্রবীণ চিকিৎসকের অভাব নাই—তবু—

ইহাকেই বলে ভাগ্য।

অমিতাভ বেশ চটপটে; নাকে মুখে কথা। চেহারাও মন্দ নয়, বলিষ্ঠ দোহারা লম্বা—মাথায় কোঁকড়া চুল। ঠোঁটের গড়ন এমন যে মুহূর্তমধ্যে চটুল ঠাট্টার ভঙ্গি হইতে গভীর সমবেদনায় নতপ্রান্ত হইয়া পড়িতে পারে। চোখের দৃষ্টি বুদ্ধিতে প্রখর, নাকের ডগা হঠাৎ একটু উঁচু হইয়া গিয়া মুখখানাতে একটা ধৃষ্ট ডেঁপোমির ভাব আনিয়া দিয়াছে।

শহরের ঈর্ষাপরবশ শতমারীরা তাহাকে ‘ডেঁপো ছোঁড়া’ বলিয়া উল্লেখ করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। রোগীর অভিভাবকরা তাহার কথা শুনিয়া অর্ধেক উদ্বেগ ভুলিয়া যাইতেন; শয্যাশায়ী রোগী তাহাকে দেখিয়া পাংশুমুখে হাস্য করিত।

সুতরাং বলা যাইতে পারে, কেবলমাত্র ভাগ্যের জোরেই অমিতাভ দুই বৎসরের মধ্যে শহরে পসার জমাইয়া তুলে নাই।

সেদিন সকালে আটটার সময় নিজের ডিসপেন্‌সারির খাস কক্ষে প্রবেশ করিয়া অমিতাভ দেখিল এক ভীমকান্তি বিরাট উদরবিশিষ্ট রোগী অত্যন্ত মচ্ছিভঙ্গভাবে বসিয়া আছেন। রোগীটি অমিতাভের পরিচিত; প্রায় প্রত্যহই প্রভাতে আসিয়া নিজ দেহের নানা বিচিত্র লক্ষণ সকল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যক্ত করিয়া ব্যবস্থা লইয়া গিয়া থাকেন। ইনি জাতিতে স্বর্ণকার।

অমিতাভ বলিল, ‘এই যে বিশ্বম্ভরবাবু! আজ কেমন আছেন?’

মুমূর্ষকণ্ঠে বিশ্বম্ভরবাবু বলিলেন, ‘বড় খারাপ। আমি বোধ হয় আর বাঁচব না ডাক্তারবাবু।’

অমিতাভ মুখখানা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করিয়া চেয়ারে উপবেশন করিল। বলিল, ‘তাই তো! আপনাকে আজ যেন কেমন একটু রোগা-রোগা দেখছি। কি হয়েছে বলুন তো! আবার কান কট্‌কট্ করছে নাকি?’

অত্যন্ত বিমর্ষভাবে বিশ্বম্ভরবাবু মাথা নাড়িলেন, ‘না। কাল রাত্রে দু’বার ঢেকুর উঠেছে; একবার এগারোটা বেজে সাত মিনিটে, আর একবার দু’টো বাজতে উনিশ মিনিটে।’

‘বলেন কি! এ তো ভাল কথা নয়। দেখি আপনার নাড়ি।’

বিষন্নমুখে বিশ্বম্ভরবাবু তাঁহার বজ্রমুষ্টি অগ্রসর করিয়া দিলেন। নাড়ি দেখিয়া অমিতাভ বলিল, ‘হুঁ। কাল রাত্রে কি খেয়েছিলেন?’

কাতরকণ্ঠে বিশ্বম্ভরবাবু আহারের যে ফর্দ দিলেন তাহা শ্রবণ করিলেই সহজ মানুষের অজীর্ণরোগ জন্মে। অমিতাভ কিন্তু তিলমাত্র বিচলিত না হইয়া বলিল ‘তাই তো! এমন কিছু গুরুভোজন তো হয়নি, যার জন্যে রাত্রে দু’বার ঢেকুর উঠতে পারে। তবে কেন এমন হল?’

বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমি কি সত্যিই বাঁচব না?’

ঈষৎ হাসিয়া অমিতাভ বলিল, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আপনার মতো লোক যদি অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহলে আমরা আছি কি জন্যে? একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সেইটে খাবার পর দু’বেলা ব্যবহার করুন। ওষুধটা অবশ্য দামী—’

‘কত দাম?’

‘সাড়ে তিন টাকা পড়বে।’

‘বেশ, লিখে দিন। প্রাণের কাছে সাড়ে তিন টাকা আর কি বলুন!’ বলিয়া বিশ্বম্ভর গভীর দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিলেন।

টাকাডায়েস্‌টেস্, অ্যাকোয়া টাইকোটিস্ সহযোগে একটি হজমি প্রেস্‌ক্রিপশান লিখিতে লিখিতে অমিতাভ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আজকাল আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’

বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘বেশ ভালই আছে।’

‘কাশিটা এখনো যায়নি?’

‘কাশে মাঝে মাঝে। কিন্তু সে কিছু নয়।’

‘সন্ধ্যেবেলা জ্বর আসত, সেটা এখনো আসে নাকি?’

অনিচ্ছাভরে বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘আসে হয়তো, ঠিক বলতে পারি না। আর মেয়েমানুষ—বুঝলেন না? অমন একটু আধটু—’

‘সে তো বটেই!’ প্রেস্‌ক্রিপশান বিশ্বম্ভরকে দিয়া অমিতাভ বলিল, ‘তবে আমার মনে হয় তাঁকে কয়েকটা ক্যালসিয়াম ইন্‌জেকশান দেওয়া দরকার। অবশ্য আপনার তুলনায় তাঁর অসুখ কিছুই নয়—তবু—’

বিশ্বম্ভর একটু গম্ভীরভাবে বলিলেন, ‘নিজের অসুখের চিকিচ্ছে করতে করতেই লম্বা হয়ে গেলাম ডাক্তারবাবু, তার ওপর আবার যদি—’

অমিতাভ জানিত বিশ্বম্ভরের লম্বা হইতে এখনও অনেক বিলম্ব আছে, তবু সে বলিল, ‘আচ্ছা, তাঁকে আপনি এখানে নিয়ে আসবেন, আমি এমনি ইন্‌জেকশান দিয়ে দেব। ওষুধের দামটা খালি দিতে হবে।’

বিশ্বম্ভরবাবু অপ্রসন্নমনে কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া শেষে বলিলেন, ‘আচ্ছা দেখি। —ডাক্তারবাবু, আপনি দৈব ওষুধে বিশ্বাস করেন?’

অমিতাভ তৎক্ষণাৎ বলিল, ‘হ্যাঁ করি বৈকি। তবে সামান্য অসুখে দৈব ওষুধ তেমন কাজ করে না। আপনি বরঞ্চ নিজে ব্যবহার করতে পারেন, আপনার যে ব্যাধি তাতে দৈব ওষুধ অব্যর্থ কাজ করবে। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারি ওষুধ খাওয়া চাই।’

বিশ্বম্ভর স্ত্রীর জন্যই দৈব ঔষধের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, কিন্তু ডাক্তার যখন দৈব চিকিৎসায় বিশ্বাস জ্ঞাপন করিল তখন তাঁহার নিজের জন্যও লোভ হইল। দৈব ঔষধের মূল্য কম অথচ উহা মনকে শান্তি দিতে পারে। তিনি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এমন কাউকে জানেন ডাক্তারবাবু, যে মাদুলি-টাদুলি দিতে পারে? তাহলে হয়তো—’

এই সময় টেবিলের উপর টেলিফোন ক্রিং ক্রিং করিয়া বাজিয়া উঠিল। ফোন তুলিয়া লইয়া অমিতাভ বলিল, ‘কে আপনি?…আরে বিন্দা! কি খবর?…যেতে হবে? কি হয়েছে?…মীনা ভাল আছে তো? যাক, আমি ভেবেছিলুম মীনার বুঝি অসুখ করেছে…’

বিশ্বম্ভরবাবু মাদুলির কথা ভুলিয়া এই একতরফা আলাপ শুনিতে লাগিলেন।

‘…সার্জারি কেস! কার ওপর অস্ত্র করতে হবে?…অ্যাঁ…কেতু? মীনার—কি বললে—ছেলে?…ও বুঝেছি। তা বেশ। আট টাকার কমে আমি ছুরি ধরি না, কিন্তু এ কেসে ডবল ফী চার্জ করব। রাজী আছ?…বেশ! মীনা কোথায়?…ঘরেই আছে? তাকে ফোন ধরতে বল।…ভাল আছ মীনা? তোমার ছেলের—অর্থাৎ কেতুর—বয়স কত হল? দু’ মাস?…অ্যাঁ! কি বললে ভাল শুনতে পেলুম না। আমার মনে হল, তুমি বললে—ধ্যেৎ!…যা হোক, এই মাসেই তোমার বিয়ে, তার আগে তোমার ছেলের রোগ সারিয়ে দিতে হবে—কেমন? কোনও ভয় নেই; অপারেশানটা অবশ্য গুরুতর কিন্তু আমি সারিয়ে তুলব।…ভাল কথা, তোমার ভাবী পতিদেবতা শুনলুম একজন তরুণ ডাক্তার;—লোকটি বেশ উদার প্রকৃতির দেখছি…অভিনন্দন জানাচ্ছি, আশা করি তোমরা সুখী হবে। পরমেশ্বরের কাছে দম্পতির দীর্ঘ জীবন কামনা করি…না না রাগ নয়,—সে তো এর পরে সারা জীবন ধরেই আছে…কিন্তু রবিবাবুর সেই কবিতাটা মনে আছে তো—‘খ্যাতির ক্ষতি পূরণ-প্রতি দৃষ্টি রাখি হরিণ আঁখি।’ আমিও এখন থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে রাখছি।…কিসের ক্ষতি! বল কি! যদি এখানকার লোক জানতে পারে যে ন্যায্য অধিকারীকে বঞ্চিত করে আমি এই অপারেশান করছি, তাহলে কি রক্ষে থাকবে? প্রফেশনাল এটিকেট আছে তো। আচ্ছা, এখন যাচ্ছি। তোমার বিয়েতে কি উপহার দেব ভাবছি; কি দিলে ভাল হয় বল তো? একটা কুমিরের চামড়ার সুটকেস? —না! এক সেট চায়ের বাসন?—তাও না! তবে?…অ্যাঁ! একটা আস্ত মানুষ চাই!…আচ্ছা মীনা, তুমি দূর থেকে তো বেশ কথা কইতে পারো, মুখোমুখি হলে আর মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না কেন?…লজ্জা! হুঁ—‘আমার হৃদয় প্রাণ সকলি করেছি দান কেবল সরমটুকু রেখেছি’…আহাহা—কবিতা বললে অমন চটে যাও কেন?…যাচ্ছি, পনেরো মিনিটের মধ্যে গিয়ে পৌঁছুব…কেতুর বাবাকে আমার ভালবাসা দিও—’ অপরপ্রান্ত হইতে টেলিফোনের তার কাটিয়া গেল

ফোন রাখিয়া দিয়া অমিতাভের চেতনা হইল যে বিশ্বম্ভরবাবু এতক্ষণ একাগ্র মনে তাহার কথা শুনিতেছিলেন। সে চট্ করিয়া মুখখানাকে গম্ভীর করিয়া ফেলিল, বলিল, ‘আমাকে এখনি বেরুতে হবে, একটা শক্ত অপারেশান আছে।’

বিশ্বম্ভরবাবু কৌতুহল নিবারণ করিতে পারিলেন না, জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কোথায় যেতে হবে?’

‘বিনোদবাবু জমিদারের বাড়ি। তাঁর একটি ভাগ্নে—দু’মাসের বাচ্ছা—তার মেরুদণ্ডের কয়েকটা হাড় কেটে বাদ দিতে হবে। —আপনি তাহলে ঐ ওষুধটা আপাতত চালান—’

অপারেশানের অস্ত্রাদি ব্যাগে লইয়া অমিতাভ তাহার দশ-মডেল অস্টিন গাড়িতে চড়িয়া প্রস্থান করিল। বিশ্বম্ভরবাবু কিছুক্ষণ হতভম্ব হইয়া বসিয়া রহিলেন। জমিদার বিনোদবাবুর পরিবারস্থ সকলকেই তিনি চেনেন,—কেবল ভ্রাতা আর ভগিনী, আর কেহ নাই। উভয়েই অবিবাহিত। সম্প্রতি ভগিনীর বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইয়াছে—এই সূত্রে বিশ্বম্ভরবাবু প্রায় পনেরো হাজার টাকার গহনা সরবরাহ করিবার ফরমাস পাইয়াছেন।

অথচ—।

বিনোদ বলিল, ‘ডাক্তারই বল আর গো-বদ্যিই বল, তুমি ছাড়া মীনার কারুর ওপর বিশ্বাস নেই।’

বিনোদের পড়ার ঘরে বিনোদ ও অমিতাভ মুখোমুখি বসিয়াছিল, মীনা দাদার চেয়ারের পিছনে দাঁড়াইয়াছিল। ছোটখাটো মেয়েটি, বয়স সতেরো কি আঠারো; সুন্দর চোখ দুটিতে আশঙ্কার ছায়া স্বাভাবিক লাজুকতার সহিত মিশিয়া তাহাকে যেন আরও ছেলেমানুষ করিয়া দিয়াছে।

অমিতাভ তাহার দিকে চোখ তুলিয়া মৃদুহাস্যে বলিল, ‘একেই বলে পূর্বরাগ। ডাক্তারের কথা ছেড়ে দিলুম, কিন্তু গো-বদ্যির চেয়েও আমার ওপর বেশী বিশ্বাস,—খাঁটি ভালবাসা না হলে এমন হয় না।’

মীনা উত্তপ্ত মুখে অন্যদিকে তাকাইয়া রহিল। অমিতাভ যদিও তাহার দাদার কলেজের বন্ধু, (উভয়ে একসঙ্গে আই-এস্‌সি পড়িয়াছিল) তবু অমিতাভের সান্নিধ্যে আসিলে সে কেবলই ঘামিতে থাকে। ফোনে যদি বা তাহার দু’একটা ঠাট্টার জবাব দিতে পারে, চোখাচোখি হইলে একেবারে বোবা হইয়া যায়।

অমিতাভ বলিল, ‘বিন্দা, দেখছ মীনার কি রকম লজ্জা হয়েছে! তোমার সামনে প্রেমের কথা উত্থাপন করা আমার উচিত হয়নি। প্রেম হচ্ছে ভারি গোপনীয় জিনিস, দাদার সামনে তা নিয়ে আলোচনা অতি গর্হিত, আড়ালে আবডালে চুরি করেই প্রেমের কথা বলতে হয়। অতএব ও-কথা এখন থাক। এখন তোমার সংসারের খবর কি মীনা? তোমার বিলিতি ইঁদুরগুলি বেশ মনের আনন্দে আছে? রূপী বাঁদরটির স্বাস্থ্যের কোনও রকম ব্যাঘাত হয়নি?’

বিনোদ হাসিয়া ফেলিয়া বলিল ‘আঃ, অমি, ওকে আর জ্বালাতন করিসনি। এমনিতেই বেচারা কাল থেকে দুর্ভাবনায় শুকিয়ে উঠেছে। এখন যা, কাজটা সেরে আয়।’

‘তথাস্তু।’ অমিতাভ ব্যাগ হাতে করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল মীনা। বিন্দা, তুমি আসবে না?’

‘না, এখনি একজন লোক আসবার কথা আছে।’

‘উঃ—কি পাষণ্ড! ভাগ্নের চেয়ে লোক বড় হল!’ অমি হৃদয়বিদারক নিশ্বাস ত্যাগ করিল, ‘বেশ! বেশ! চল মীনা।’

অন্দরের একটি রুদ্ধদ্বার ঘরের সম্মুখে আসিয়া মীনা দাঁড়াইল, অমিতাভের মুখের দিকে কাতর চোখ তুলিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, ‘বাঁচবে তো?’

চমকিত হইয়া অমি বলিল, ‘কে?’

ভর্ৎসনাপূর্ণ চোখে মীনা বলিল, ‘কেতু।’

অমি তাহাকে আশ্বাস দিয়া বলিল, ‘কোনও ভয় নেই, আমার অস্ত্রাঘাতে আজ পর্যন্ত কেউ মরেনি। একবার একটা হুলো বেরালকে লাঠি মেরেছিলুম, সে আজ পর্যন্ত বেঁচে আছে। —এই ঘরে কেতু আছে তো? তুমিও এস না।’

মীনা শিহরিয়া উঠিল, ‘আমি ও চোখে দেখতে পারব না।’ বলিয়া চোখে আঁচল দিল।

অমি বলিল, ‘আচ্ছা, তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাক; এক মিনিটে কাজ শেষ হয়ে যাবে। —কিন্তু ক্ষতিপূরণের কথাটা মনে আছে তো? তোমার দাদা অবশ্য ডবল ফী দেবে বলেছে, কিন্তু বিন্দাকে বিশ্বাস নেই; শেষ পর্যন্ত হয়তো ফাঁকি দেবে। তখন কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি ক্ষতিপূরণ আদায় করব।’

আঁচলের ভিতর হইতে মীনা বলিল, ‘যাও।’

অমি একবার চারিদিকে তাকাইয়া দেখিল, কেহ কোথাও নাই।

‘অগ্রিম কিছু আদায় করে নিই।’—অমি চট্ করিয়া তাহার সিঁথি-মূলে একটা চুম্বন করিল, তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

রক্ত করবীর মতো রাঙা মুখ দু’হাতে চাপিয়া মীনা দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল। ছি ছি—একটু লজ্জাও কি নাই! বিয়ের আগে—

ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা। পাঁচ মিনিট কাটিয়া গেল। মীনা উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতে লাগিল। কেতু কি—?

তারপর সহসা ঘরের ভিতর হইতে তারস্বরে চিৎকার উঠিল—কেঁউ কেঁউ কেঁউ।

ক্রমশ কুক্কুর শাবকের কাতরোক্তি ক্ষীণ হইয়া থামিয়া গেল। মিনিট দুই তিন পরে অমি বাহিরে আসিতেই মীনা ব্যাকুল বিস্ফারিত চক্ষে তাহার পানে তাকাইল।

অমি নিজের মুঠি তাহার দিকে বাড়াইয়া বলিল, ‘এই নাও।’

না বুঝিয়া মীনা হাত পাতিল। কেতুর কর্তিত পুচ্ছটি তাহার হাতে দিয়া অমি বলিল, ‘অপারেশান সাক্‌সেসফুল। রোগী এখন নিদ্রা যাচ্ছেন।’

মীনা ল্যাজটি ছুঁড়িয়া মাটিতে ফেলিয়া দিল; তারপর ঘরে গিয়া ঢুকিল। অতর্কিতে অমির পিঠে একটি কিল মারিয়া দরজায় খিল লাগাইয়া দিল।

অমি কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর ক্ষুদ্র পুচ্ছাংশটি পকেটে পুরিয়া মৃদু হাসিতে হাসিতে বাহিরের দিকে চলিল।

বাহিরের ঘরে আসিয়া অমি দেখিল বিশ্বম্ভরবাবু বিনোদের কাছে বসিয়া আছেন। বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘একি! বিশ্বম্ভরবাবু, আপনি এখানে যে?’

বিনোদ বুঝাইয়া দিল যে বিশ্বম্ভরবাবু মীনার বিবাহের সমস্ত গহনা গড়ার ভার লইয়াছেন, সুতরাং তাঁহার এ বাড়িতে যাতায়াত বিচিত্র নয়।

অমিতাভ কিছুকাল অপলক দৃষ্টিতে বিশ্বস্তুরবাবুর দিকে তাকাইয়া রহিল; তারপর অঙ্গুলি সঙ্কেতে তাঁহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘এদিকে একবার শুনে যান, একটু কথা আছে।’

বিশ্বম্ভরকে আড়ালে লইয়া গিয়া অমি বলিল, ‘আপনি আজ মাদুলি ধারণের কথা বলছিলেন না? হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমার কাছে ভাল দৈব ওষুধ আছে।’

বিশ্বম্ভর উৎসুক নেত্রে চাহিয়া রহিলেন।

অমি গম্ভীর মুখে বলিল, ‘কেতু গ্রহই আপনার অনিষ্ট করছে; কেতুর মাদুলি ধারণ করলেই আর কোনও রোগ থাকবে না।’

সাগ্রহ স্বরে বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘কি করতে হবে?’

পকেটে হাত পুরিয়া কেতুর পুচ্ছটি নাড়িতে নাড়িতে অমি বলিল, ‘একটি বেশ বড় দেখে সোনার মাদুলি তৈরি করে কাল আপনি আমার কাছে নিয়ে যাবেন, আমি তাতে দৈব ওষুধ ভরে দেব। মাদুলিটি অন্তত তিন ইঞ্চি লম্বা হওয়া চাই, আর সেই অনুপাতে মোটা। সেটি গলায় ধারণ করতে হবে।’

হাত ঘষিতে ঘষিতে বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘যে আজ্ঞে।’

‘আর আপনার স্ত্রীকেও সেই সঙ্গে নিয়ে যাবেন, ইন্‌জেকশান দিয়ে দেব।’

ঈষৎ ম্লান হইয়া বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘আচ্ছা।’

‘আপনি যখন এ বাড়ির স্যাকরা তখন ওষুধের দামটা আর আপনাকে দিতে হবে না।’

পুনরায় উৎফুল্ল হইয়া বিশ্বম্ভর বলিলেন, ‘যে আজ্ঞে।’

৩০ চৈত্র ১৩৪২

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন