আণবিক বোমা

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

আণবিক বোমা

রাখাল নিতাইকে একটা চড় মারিল।

চড়ের কারণ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন নাই; হয়তো কারণ একটা ছিল। কিন্তু চড়টাই আসল।

নিতাই রোগা-পট্‌কা লোক, সে রাখালের চড় ফিরাইয়া দিতে পারিল না, ছুটিয়া গিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। রাখাল দম্ভভরে বুক ঠুকিয়া আস্ফালন করিতে লাগিল।

কিছুক্ষণ পরে নিতাই প্রকাণ্ড এক লাঠি ঘুরাইতে ঘুরাইতে বাহির হইয়া আসিল এবং রাখালকে আক্রমণ করিল। রিক্তহস্ত রাখাল লাঠির বেগ সহ্য করিতে লারিল না, দ্রুত পলায়ন করিয়া নিজের ঘরে ঢুকিল। নিতাই এবার বুক ফুলাইয়া আস্ফালন করিল।

তারপর রাখাল বাহির হইল ইয়া লম্বা এক তলোয়ার লইয়া। দেখিয়াই নিতাই রণে ভঙ্গ দিয়া নিজ কোটরে ঢুকিয়া দ্বার বন্ধ করিল।

এইভাবে চলিতে লাগিল। প্রথমে চড়ের প্রতিক্রিয়া চক্রবৃদ্ধির আকারে বাড়িয়া চলিল। রাখাল বন্দুক বাহির করে তো নিতাই কামান বাহির করে। তখন রাখাল বাধ্য হইয়া ট্যাঙ্ক আবিষ্কার করে। নিতাই অমনি বোমারু বিমান বাহির করিয়া তাহার জবাব দেয়। কিন্তু দু’জনের মধ্যে বাহুবলের সাম্য কিছুতেই স্থির হয় না।

মাঝে মাঝে এক পক্কড় লড়াই হইয়া যায়—কখনও এপক্ষ হারে, কখনও ওপক্ষ। তারপর আবার গৃহে ফিরিয়া গিয়া নূতন অস্ত্র আবিষ্কারের মতলব আঁটে। এইভাবে দু’জনে দু’জনের অনিষ্ট চিন্তা করিতে করিতে অনেকদিন কাটিয়া যায়।

ইতিমধ্যে দুইটা দল সৃষ্টি হইয়াছে; একদল নিতাইয়ের পক্ষে, একদল রাখালের পক্ষে। পক্ষপাতহীন দু’ একজন লোক মাঝে মাঝে ক্ষীণ কণ্ঠে বলে—ঝগড়া মিটাইয়া ফেল, হিংসার দ্বারা হিংসার ক্ষয় হয় না, বৃদ্ধি হয়। কিন্তু কে তাহাদের কথা শোনে!

অবশেষে একদিন রাখাল আবিষ্কার করিল—আণবিক বোমা! সিংহনাদ করিয়া বলিল, নিতাইকে তো সাবাড় করিবই, দলকে দল একটি বোমায় পোড়াইয়া মারিব, বাতি দিতে কাহাকেও রাখিব না।

বোমার ক্রিয়া দেখিয়া সকলেই থরহরি। শত্রু মিত্র সকলেই শঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া উঠিল—এবার তো আর কেহ বাঁচিবে না! যে সকল ধর্মপরায়ণ লোকের ধর্মজ্ঞান সুপ্ত ছিল, বিষবাষ্প হাউই বোমা পর্যন্ত যাঁহাদের বিবেককে জাগাইতে পারে নাই—তাঁহারা সত্রাসে চিৎকার করিয়া উঠিলেন—না না, এটা উচিত হবে না। আণবিক বোমা ছুঁড়িলে ধর্মযুদ্ধ হয় না।

আশ্চর্য! ষণ্ডা রাখাল যখন দুর্বল নিতাইকে চড় মারিয়াছিল তখন ধর্মযুদ্ধের কথা কেহ তোলে নাই; বরং বীরভোগ্যা বসুন্ধরা বলিয়া বাহুবলের বাহবা দিয়াছিল। এখন তাহারাই বাহুবলের চরম পরিণতি দেখিয়া সবচেয়ে উগ্র ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়িতে লাগিল। যুদ্ধের সম্পর্কে ধর্মের কথা কিছু নূতন নয়; কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, ইন্দ্রজিৎ যখন মেঘে লুকাইয়া যুদ্ধ করিয়াছিল তখনও বাল্মীকি মুনি তাহার দোষ ধরিতে পারেন নাই। সরলমতি বৃদ্ধ মুনি বোধ হয় ভাবিয়াছিলেন যে, যুদ্ধটাই যখন ন্যায়সঙ্গত বলিয়া স্বীকার করিয়া লওয়া হইয়াছে তখন তাহার ভঙ্গিবিশেষে আপত্তি করা চলে না।

যাহোক, রাখালের তর্জন গর্জন শুনিয়া নিতাই ভয় পাইয়া গেল; গলায় কাপড় দিয়া সে রাখালের ক্ষমা ভিক্ষা করিল।

যুদ্ধ শেষ হইয়াছে। সকলেই আনন্দিত, রাখালের তো কথাই নাই। অপদস্থ এবং নিগৃহীত নিতাই ভাবিতেছে কতদিনে এমন অস্ত্র বাহির করিতে পারিবে যাহার দ্বারা সে এই পৃথিবীটাকে সমুদ্রের জলে চটকাইয়া তাল পাকাইয়া সূর্যের আগুনে পোড়াইয়া ঝামা করিতে পারিবে, এবং তারপর সেই ঝামা ভগবানের রগ লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া মারিবে।

৮ ভাদ্র ১৩৫২

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন