কবি-প্রিয়া

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

কবি-প্রিয়া

পুরাকালে আমাদের দেশে এক কবি ছিলেন। নবপ্রভাতের অরুণচ্ছটায় তিনি জন্মেছিলেন এবং মধ্যাহ্নের জ্বলজ্জ্যোতিশিখার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তাই তাঁকে সকল দেশের এবং সকল যুগের কবি বলে আমরা চিনতে পেরেছি। নব-প্রভাতের অরুণচ্ছটা আর মধ্যাহ্নের জ্বলৎ-জ্যোতি শিখা তাঁকে আমাদের প্রাণের মধ্যে অমর করে রেখেছে।

কবির ধারণায় কেবল একটি মাত্র সুর ছিল, সেটি আনন্দের সুর। তাঁর গানে বেদনা ছিল না, নৈরাশ্য ছিল না, বৈরাগ্য ছিল না—ছিল শুধু আশা উল্লাস আর আনন্দ। তিনি সকলকে ডেকে বলতেন—দুঃখের কাছে হেরে যেও না ভাই; দুঃখটা মিথ্যা, আনন্দ তাই দিয়ে তোমার পরীক্ষা করছেন। যদি হেরে যাও—আনন্দের বর পাবে না। দুঃখের আঘাতে আঘাতে তোমার বুকের বর্ম থেকে আনন্দের আগুন ঠিকরে পড়ুক—

ব্যথা এসে ধরবে যবে কেশে

দুঃখ যখন হানবে বুকে বাণ

কাঁদিস নেরে, উচ্চ হাসি হেসে

কণ্ঠে তুলিস সুখের জয় গান।

অবিশ্বাসীরা বলত—কিন্তু কবি, মৃত্যুকে তো আনন্দ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সে তো একদিন আসবেই, মরতে তো একদিন হবেই।

কবি হেসে জবাব দিতেন—তোমায় কোনও দিন মরতে হবে না বন্ধু, শুধু একটু সরতে হবে; চৈত্রের তরুপল্লবের মতন শুধু ঝরতে হবে; যারা আসছে, তোমার আনন্দ যাদের সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্যে একটু জায়গা করে দিতে হবে। তারা যে তোমার আনন্দের উত্তরাধিকারী; তাদের মধ্যে তুমিই যে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে থাকবে বন্ধু!

ক্রমে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাস হতে লাগল; দেশের লোক কবির আনন্দ-মন্ত্র গ্রহণ করতে লাগল। শেষে রাজা একদিন কবিকে ডেকে পাঠালেন। বললেন—কবি, তোমার বাণী আমার রাজ্য থেকে দুঃখকে নির্বাসিত করেছে—তুমি ধন্য। আমার কণ্ঠের মালা তোমার কণ্ঠে উঠে ধন্য হোক।

কবি বললেন—রাজন, আনন্দের বাণী আমার নয়। বিশ্বপ্রকৃতির। আমি বিশ্বপ্রকৃতির দূত। আমার গানে যদি একজনেরও আনন্দ মন্ত্রে দীক্ষা হয়ে থাকে, আমার দৌত্য সার্থক।—এই বলে কবি ঘরে ফিরে গেলেন।

তারপর ক্রমশ যখন দেশসুদ্ধ লোক কবির গানে মেতে উঠেছে, তখন একদিন কবি তাঁর স্ত্রীকে বললেন—সকলকে আনন্দের মন্ত্র শোনালাম, শুধু যিনি আমার অন্তরের আনন্দ-স্বরূপা, তাঁকে সে মন্ত্র দেবার অবসর পেলাম না। মানুষকে দিলাম বিশ্বপ্রকৃতির বাণী, আর তোমাকে দিলাম কেবল ভালবাসা। যিনি আমার সকলের চেয়ে আপনার তিনিই বঞ্চিত হলেন।

কবি-প্রিয়া কোনও উত্তর দিলেন না, স্বামীর মুখের পানে চেয়ে একটু হাসলেন। মনে হল সে হাসির দীপ্তিতে কবির আনন্দ-মন্ত্রও ম্লান হয়ে গেল।

তারপর একদিন বিনামেঘে বজ্রাঘাত হল, যৌবনের অন্তিম সীমা অতিক্রম না করতেই কবির মৃত্যু হল। দেশসুদ্ধ লোক হাহাকার করতে লাগল; সেদিনকার মতো কবির উপদেশও কারুর মনে রইল না।

রাজা শোকে অধীর হয়ে কবির গৃহে গেলেন—শেষবার তাঁকে দেখবার জন্য। সঙ্গে অমাত্যরা গেলেন।

কবির গৃহের সম্মুখে বিশাল জনতা। সবাই আক্ষেপ করছে, দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করছে, অশ্রুমোচন করছে, রাজা শোক-কাতর জনতার ভিতর দিয়ে কবির অঙ্গনে প্রবেশ করলেন।

প্রবেশ করে বাষ্পাচ্ছন্ন চক্ষু মুছে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন যে কবি-প্রিয়া মৃত স্বামীর মস্তক ক্রোড়ে করে বসে বসে হাসছেন।

রাজার মনে হল, তাঁর সেই হাসির অম্লান দীপ্তিতে রাজ্যসুদ্ধ লোকের শোক পাংশু হয়ে গেছে।

১৩৫০

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন