প্রেমের কথা

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রেমের কথা

পৃথিবীতে যেদিকে দৃষ্টি ফিরাই, দেখি নর-নারী, পশু-পক্ষী, কীট-পতঙ্গ কেবল অহরহ প্রেম করিতেছে। আশ্চর্য ব্যাপার!—বাংলাদেশেও নিস্তার নাই; যুবক-যুবতীদের মধ্যে নিরন্তর প্রেম চলিতেছে—ট্রামে, বাসে, কলেজে প্রেম জন্মগ্রহণ করিতেছে। এই প্রেম দীর্ঘজীবী নয়, অধিকাংশই আঁতুড় ঘরে পেঁচোয় পাইয়া পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইতেছে। তবু বিরাম নাই। প্রেমের জন্মনিরোধ করিবার বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া কেহ আবিষ্কার করিতে পারিল না।

কিন্তু তবু নিয়ম মাত্রেরই ব্যতিক্রম আছে। কলিকাতা শহরেই এইরূপ দুইটি ব্যতিক্রম বাস করিতেছিল। হঠাৎ এক চিত্র-প্রদর্শনীতে উভয়ের সাক্ষাৎ ঘটিয়া গেল। বলা বাহুল্য, ব্যতিক্রম দুটির একটি যুবক, অপরটি যুবতী।

প্রাচ্যকলার প্রদর্শনী। সুতরাং কলার সঙ্গে সঙ্গে বেল, তাল, নারিকেল, এমন কি কাঁঠাল পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রদর্শিত হইতেছিল।

যুবতীটি এইরূপ একটি ফলভারপীড়িত চিত্রের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, যুবক ঘুরিতে ঘুরিতে তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। ছবির নাম—প্রেমালসা! যুবতী সেইদিকে ঘৃণাপূর্ণ তর্জনী নির্দেশ করিয়া কহিল, ‘কী কুৎসিত!’

যুবক বলিল, ‘বীভৎস।’

এই প্রথম আলাপ।

উভয়েরই উভয়ের কথা ভাল লাগিল। যুবক যুবতীর দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘নরকের চিত্র কি প্রেমের চিত্রের চেয়েও বীভৎস? সম্ভব নয়…আপনার নাম কি?’

যুবতী বলিল, ‘কখনই না।…আমার নাম কলিকা।’

‘কলিকা! কিসের—গাঁজার?’

‘তা হলেও দুঃখ ছিল না—আপনার নাম কি?’

‘হুতাশন।’

‘বেশ হয়েছে। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় গাঢ় হওয়া কর্তব্য।’

‘আমি কিন্তু প্রেম মানি না।’

‘আমিও না।’

‘বেশ, তবে চলুন—চা খাওয়া যাক্‌।’

উভয়ের মধ্যে পরিচয় গাঢ় হইল।

হুতাশন একদিন বলিল, ‘দেখ কলিকা, এ জগতে প্রেমই হচ্ছে যত অনিষ্টের মূল, যে প্রেম করছে সেই মরেছে। সংসারে বিবাহের একটা রীতি আছে—কিন্তু সে কি জন্যে? প্রেমের জন্যে নয়, কম খরচে জীবনযাত্রা নির্বাহ করবার জন্যে। যারা বিয়ে করে, তারা সেই কথাটা ভুলে গিয়ে প্রথমেই বৌয়ের সঙ্গে প্রেম করতে শুরু করে দেয়। ন্যক্কারজনক কাণ্ড! আমি ব্যয়-সংক্ষেপের জন্যে বিবাহ বরদাস্ত করতে রাজী আছি, কিন্তু প্রেম আমার অসহ্য।’

কলিকা বলিল, ‘আমারও। আচ্ছা, প্রেম যদি না থাকত পৃথিবীটা কি সুন্দর জায়গা হত বলুন দেখি!’

‘চমৎকার। ঠিক গার্ডেন অফ্‌ ইডেনের মতো। কাপড়-চোপড় কিছু দরকার হত না, খরচ অনেক কম হত। কিন্তু প্রেমরূপী কালসর্প ঢুকেই সব মাটি করে দিয়েছে। সাবধান, এই কালসর্পের কুহকে ভুলে যেন আপেল খেয়ে ফেলো না।’

‘সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন | —আচ্ছা, আপনি তো অনেক খবর রাখেন, প্রেমের লক্ষণ কি—বলুন তো?’

হুতাশন ভাবিয়া বলিল, ‘প্রেমের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে বিরহ। অর্থাৎ বেশীক্ষণ দেখতে না পেলে দেখতে ইচ্ছে করে, মন ছটফট করে—এইটেই সবচেয়ে গুরুতর লক্ষণ।’

‘আর?’

‘আর—নিজের ক্ষতি করে তার ভাল করবার চেষ্টা।—যেমন ধরো, তুমি বই পড়তে ভালবাসো—কেউ যদি নিজের সিগারেটের পয়সা কেটে তোমাকে বই কিনে দেয়—বুঝবে সে তোমার প্রেমে পড়েছে—’

‘বুঝেছি। আমি বই পড়তে ভালবাসি, কিন্তু বাড়তি পয়সার অভাবে কেনা হয় না। কেউ উপহারও দেয় না।’

‘সেটা তোমার সৌভাগ্য। জগতে পয়সার বড় অভাব—আমার বাড়তি পয়সা নেই, তোমারও নেই। —এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার।’

অতঃপর পুরা এক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। হুতাশন ও কলিকা পরস্পরের প্রেমে পড়ে নাই—যদিও পড়িলে কেহই বিস্মিত হইত না। তাহারা একই বাড়িতে বাস করিতেছে, পাশাপাশি ঘরে শয়ন করিতেছে—এবং তাহাদের হাঁড়িও অভিন্ন। এরূপ অপূর্ব ব্যাপার বাংলাদেশে আর কখনও ঘটে নাই।

কিন্তু অস্বাভাবিক ব্যাপার কখনও চিরস্থায়ী হইতে পারে না। হুতাশন সাধারণত বেলা চারটের সময় কর্মস্থান হইতে ফিরিত; একদিন সাড়ে পাঁচটার সময় সে চোরের মতো চুপি চুপি বাড়িতে ঢুকিল। তাহার বগলে একটি প্যাকেট।

বাড়ি ঢুকিতেই কলিকা ছুটিয়া আসিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিল, বলিল, ‘এত দেরি করলে কেন? উঃ—ভেবে ভেবে আমি’—বলিয়া সহসা তাহার হাত ছাড়িয়া দিল।

হুতাশন ভগ্নস্বরে বলিল, ‘কলিকা, সর্বনাশ হয়েছে।’

শঙ্কিত কণ্ঠে কলিকা বলিল, ‘কি হয়েছে?’

‘আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। এই দেখ—সিগারেটের পয়সা খরচ করে তোমার জন্যে বই কিনেছি।—এখন উপায়!’—হুতাশন চেয়ারে বসিয়া পড়িল।

কলিকার মুখেও বিষণ্ণতার ছায়া পড়িল, সে বিমনা হইয়া হুতাশনের কাঁধের উপর হাত রাখিল; অন্যমনস্কভাবে হাত দুটি হুতাশনের কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিল। কলিকা বলিল, ‘আমিও—আমিও বোধ হয় তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।’

চমকাইয়া হুতাশন তাহাকে নিজের কোলের কাছে টানিয়া আনিল, উৎকণ্ঠিতভাবে বলিল, ‘তাই নাকি। কি করে জানলে?’

কলিকা তাহার কোলের উপর হতাশভাবে বসিয়া পড়িয়া বলিল, ‘বিরহ। তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছিল—তাই—’

দু’জনেই গভীর নিশ্বাস ত্যাগ করিল।

হুতাশন বলিল, ‘কলি, পাছে প্রেমে পড়ি এই ভয়ে গোড়াতেই তোমাকে বিয়ে করেছিলুম—কিন্তু সব ফস্কে গেল। যে বইটা এনেছি, তার নাম কি জানো? চুম্বন।—এসো।’

হুতাশন ও কলিকার মাঝখানে প্রেমরূপী গঞ্জিকার উদ্ভব হইয়া ব্যাপারটাকে অকস্মাৎ অত্যন্ত মাদকতাপূর্ণ করিয়া তুলিল।

১ পৌষ ১৩৪৩

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন