শ্রেষ্ঠ বিসর্জন

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রেষ্ঠ বিসর্জন

সাপ্তাহিক ‘উল্কা’র সম্পাদক সুদর্শন রায় টেবিলে বসিয়া অধীর ভাবে একটা পেন্সিলের পশ্চাদ্ভাগ চুষিতেছিলেন।

সন্ধ্যা প্রায় সাতটা; কাল সকালেই কাগজ বাহির করিতে হইবে। অথচ তাঁহার টেক্কা মার্কা রিপোর্টার অজেন্দ্র পালের এখনও দেখা নাই। সেই যে সে বেলা একটার সময় বালিগঞ্জের ন্যুডিস্ট্‌ কলোনিতে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছে—এখনও ফিরিল না।

এদিকে একটা ভারি গোপনীয় অথচ ইন্টারেস্টিং খবর সম্পাদকের কানে আসিয়াছে, সেটার সম্বন্ধে কালকের কাগজে কিছু থাকাই চাই। গোপনীয় খবর ইন্টারেস্টিং করিয়া বাহির করিবার জন্যই ‘উল্কা’র কাট্‌তি; ‘উল্কা’র পাঠকেরা ইহা ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশা করে না। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া খবরের বাজার এত মন্দা যাইতেছে যে একটা হৃদয়গ্রাহী কেচ্ছাও ‘উল্কা’য় বাহির হয় নাই। এবারে গরম গরম একটা কিছু না থাকিলেই নয়—‘উল্কা’র বদনাম রটিয়া যাইবে। বিশেষত, আজিকার এই খবরটা যদি অন্য কোনও সম্পাদক সংগ্রহ করিয়া রাতারাতি ছাপিয়া বাহির করিয়া দেয়, তবে তো ‘উল্কা’র প্রেস্টিজ্ ‌চিরদিনের জন্য ডুবিয়া যাইবে।

প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পাদকের কথা স্মরণ হইতেই সুদর্শন রায় পেন্সিলটা কড়মড় করিয়া চিবাইয়া ফেলিলেন।

কিন্তু তবু অজেন্দ্র পালের দেখা নাই।

অবশ্য ‘উল্কা’র আরও রিপোর্টার আছে; কিন্তু অজেন্দ্র পাল তাহাদের মধ্যে সেরা! দুর্দমনীয় তারুণ্যের বলে সে সর্বত্র অপ্রতিহতগতি। সে ছাড়া আজিকার এই গোপনীয় খবরের তত্ত্বোদঘাটন আর কেহ করিতে পারিবে না।

সম্পাদক ভাবিতে লাল ‘ছোঁড়া গেল কোথায়?…কোনও তরুণীর খপ্পরে পড়েনি তো?…কিংবা… শেষে ন্যুডিস্টদের ভিড়ে পড়ল নাকি!…’

দুশ্চিন্তায় সম্পাদক মহাশয় পেন্সিলটাকে একেবারে দাঁতন-কাঠি করিয়া ফেলিলেন।

ক্রমে ঘড়ির কাঁটা একপাক ঘুরিয়া গেল; প্রেসম্যান করুণভাবে দ্বারের কাছে উঁকি-ঝুঁকি মারিতে লাগিল। সম্পাদক পেন্সিলটাকে শেষ করিয়া ফেলিলেন। তারপর রাত্রি সাড়ে আটটার সময় অজেন্দ্র পাল ফিরিয়া আসিল।

তাহার চেহারা স্মার্ট; জুল্‌পি ও ঈষৎ গোঁফ আছে। পকেট হইতে একতাড়া কাগজ বাহির করিয়া বলিল, ‘এই নিন্—পাঠিয়ে দিন প্রেসে।’

ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া সম্পাদক বলিলেন, ‘কি করছিলে এতক্ষণ?’

অজেন্দ্র পাল বলিল, ‘ন্যুডিস্ট্‌ কলোনিতেই ছিলুম। সেখানে পুকুর পাড়ে উপু হয়ে বসে প্রোফেসার হরেকৃষ্ণ চট্টরাজ আর কুমারী সুনীতি মুখার্জি বৈষ্ণব সাহিত্যের আলোচনা করছিলেন, তাই নোট করে নিচ্ছিলুম। তাঁদের দু’খানা স্ন্যাপশ্‌টও তুলেছি—একখানা সামনে থেকে, একখানা পেছন থেকে।’

অজেন্দ্র ক্যামেরা ও ফিল্ম-স্পুল টেবিলের উপর রাখিল। সম্পাদক প্রীত হইয়া বলিলেন, ‘বেশ। তোমাকে এখনি আর একটা কাজে বেরুতে হবে।’

অজেন্দ্র উপবেশন করিল, গোঁফের উপর অঙ্গুলি বুলাইয়া কহিল, ‘Shoot!’

সম্পাদক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি অনীতা সোমকে চেন?’

অজেন্দ্র তৎক্ষণাৎ বলিল, ‘অবশ্য চিনি। বিখ্যাত তরুণী লেখিকা, ‘আলিঙ্গন’ নামক শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনা করেছেন।’

সম্পাদক বলিলেন, ‘হ্যাঁ তিনিই। আমি খবর পেয়েছি, তিনি আজ রাত্রে আত্মহত্যা করবেন। গোপনীয় খবর। রাত্রি দ্বিপ্রহরে সাহিত্য পরিষদের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনি প্রাণ বিসর্জন দেবেন। এ বিষয়ে পুরো রিপোর্ট চাই—তোমাকে যেতে হবে।’

অজেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, ‘এই তরুণ বয়সে তিনি কেন প্রাণ বিজর্সন দিতে চান?’

‘আজ পর্যন্ত কেউ বঙ্গ সাহিত্যের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেননি—তাই তিনি পথ দেখাচ্ছেন।’

‘ও—বেশ।’ অজেন্দ্ৰ উঠিল, ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘চল্লুম আমি। রাত্রি একটার মধ্যেই রিপোর্ট পাবেন।’

অজেন্দ্র প্রস্থান করিল। সম্পাদক ন্যুডিস্ট্ কলোনির রিপোর্ট প্রেসে পাঠাইয়া দিয়া, ফোটো ডেভেল্‌প করিতে দিলেন। তারপর নিকটবর্তী হোটেলে আহারাদি করিতে গেলেন। আজ আর বাড়ি গেলে চলিবে না।

পান ভোজন শেষ করিয়া ফিরিতে সাড়ে দশটা বাজিল। ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন ফোটো তৈয়ার হইয়া আসিয়াছে। সম্পাদক দীর্ঘকাল ধরিয়া ফোটো দুটি নিরীক্ষণ করিলেন; তারপর দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া মনে মনে বলিলেন, ‘নাঃ, এ ছবি ছাপা চলবে না। দেশে যে রকম সাধু-সন্ন্যাসীর উৎপাত, ছাপলেই ধরে জেলে পুরে দেবে।’

অতঃপর সম্পাদক অজেন্দ্র পালের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

বারোটা বাজিল, তারপর একটা; কিন্তু তথাপি অজেন্দ্রের দেখা নাই। সম্পাদক রাগিয়া উঠিতে লাগিলেন। ‘আরে বাপু, একটা ছুঁড়ি ছাদ থেকে লাফিয়ে মরবে, তার জন্যে এত দেরি কিসের? এক মিনিটের তো কাজ!’

কিন্তু যদি না মরিয়া থাকে? হয়তো শুধুই ঠ্যাং ভাঙিয়াছে—সাহিত্য পরিষদ আর কত উঁচু। সম্পাদকের রাগ আরও চড়িয়া গেল—মনুমেন্ট হইতে লাফাইলে কি দোষ ছিল? যদি আত্মহত্যাই করিতে চাস্, তবে একটু উঁচু জায়গা হইতে লাফা না কেন? যত সব—

যখন রাত্রি দুইটা বাজিয়া গেল তখন সম্পাদক উঠিয়া দুইবার সবেগে মেজের উপর পদদাপ করিলেন, তারপর ক্লান্তভাবে টেবিলের উপর মাথা রাখিয়া বলিলেন, ‘কোন্ শালা আর—’

সকালে অজেন্দ্র পাল আসিয়া দেখিল, সম্পাদক টেবিলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছেন।

অজেন্দ্র গলা খাঁকারি দিল।

আরক্তনেত্রে মাথা তুলিয়া সম্পাদক বলিলেন, ‘কোন্ শালা…এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’

অজেন্দ্র গম্ভীর ভাবে বলিল, ‘এই নিন রিপোর্ট।’

সম্পাদক বলিলেন, ‘সে ছুঁড়ি মরেছে তাহলে? মানে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে?’

অজেন্দ্র বলিল, ‘তিনি প্রাণ বিসর্জন দেননি।’

‘অ্যাঁ—তবে তুমি কি কচু রিপোর্ট এনেছ?’

অজেন্দ্র গম্ভীর মুখে বলিল, তিনি প্রাণ বিসর্জন দেননি বটে, কিন্তু তার চেয়ে বড় জিনিস বিসর্জন দিয়েছেন।’

সম্পাদক চটিয়া বলিলেন, ‘মানে—কি কচু বিসর্জন দিয়েছেন?’

অজেন্দ্র গোঁফের প্রান্তে একটু তা দিয়া সগর্বে বলিল, ‘সতীত্ব।’

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন