ভালবাসা লিমিটেড

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

ভালবাসা লিমিটেড

ভাস্করানন্দ, ললিত, বাসুদেব ও সাধুপদ—এই চারজন ছিল একাধারে লিমিটেড কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেকটার ও প্রধান অংশীদার; তাহাদের নামের আদ্য অক্ষর লইয়া কোম্পানির নামকরণ হইয়াছিল—ভালবাসা। বাকি যে সব অংশীদার বাংলাদেশের যত্রতত্র ছড়ানো ছিল তাহাদের সমষ্টিকে নির্দেশ করিবার জন্য ছিল—লিঃ।

একদা ডিরেকটারগণ সমবেত হইয়া সংকল্প করিলেন যে সিনেমার ব্যবসা করিতে হইবে। কারণ সম্প্রতি দেখা যাইতেছে উহাতেই কাঁচা পয়সা বেশী। আপাতত একটা স্টুডিও ভাড়া লইয়া ছবি তুলিলেই চলিবে, তারপর ছবির মুনাফা হইতে কুড়ি পার্সেন্ট ডিভিডেণ্ড ঘোষণা করিয়া বাকি যে কয়েক লক্ষ টাকা বাঁচিবে তাহাতে নিজস্ব স্টুডিও খুলিয়া রীতিমত ব্যবসা আরম্ভ হইবে।

ভাস্করানন্দ বলিল, ‘আমি সিনেরিও লিখব, ডায়ালগ্‌ লিখব, প্রযোজনা করব, উঃ-মাইরি! অ্যাসা একটা প্লট আমার মাথায় আছে—সে-প্লট ছবির পর্দায় উঠলে দেশের লোক বাপ্‌ বাপ্‌ বলে টিকিট কিনবে। হরদম ইয়ে—কিছু আর বাকি রাখব না, সব দেখাব।’

ললিত বলিল, ‘আমি হিরোর পার্ট নেব,’—বলিয়া আয়নার দিকে তাকাইয়া নানা ভঙ্গিতে ভ্রূ নাচাইতে লাগিল।

ভাস্করানন্দ বলিল, ‘বেশ। আর বাসুদেব নেবে ভিলেনের পার্ট—তোফা মানাবে।’

বাসুদেব চটিয়া বলিল, ‘কি! আমার চেহারা ভিলেনের মতো? তোমার চেহারা তো ছিঁচ্‌কে চোরের মতো—তুমি করো না! আমি ভিলেন হব না।’

ভাস্করানন্দ গরম হইয়া বলিল, ‘কুছ পরোয়া নেই—হয়ো না। ভিলেন ভাড়া করে আনব। বাংলাদেশে ভিলেনের অভাব নেই জেনো।’

এতক্ষণে সাধুপদ কথা বলিল। সে ডিরেকটারদের মধ্যে সবচেয়ে নিরেস; অতটা হালফ্যাশানের নয়, মাথায় ক্ষুদ্র টিকি আছে—তাই সকলে যুক্তি করিয়া তাহাকে কোম্পানির খাজাঞ্চি নিযুক্ত করিয়াছিল। সে বলিল, ‘শুধু ভিলেন নয়, হিরোইনও ভাড়া করতে হবে। তা ছাড়া আরও আছে।—অনেক খরচ।’ সে দীর্ঘশ্বাস মোচন করিল।

ললিত বলিল, ‘হোক্‌ খরচ। ভাল হিরোইন চাই। বিজ্ঞাপন দাও। খেঁদি-পেঁচী-পুঁটি চলবে না,’ —বলিয়া পুনশ্চ ভ্রু নাচাইতে লাগিল।

বিজ্ঞাপন দেওয়া হইল। তাহার উত্তরে যিনি আসিলেন তিনি একটি নবায়মানা তরুণী, তারুণ্যের প্রাচুর্যে তাঁহার তনুলতা টলমল। নাম ছলনা দেবী।

হাসি এবং কথা, নৃত্য এবং গীত—সকল ক্ষেত্রেই তিনি অনন্যপূর্বা। তিনি যখন তিনশত টাকা মাসিক বেতনের চুক্তিপত্র লিখাইয়া লইয়া নৃত্যচপল ভঙ্গিতে প্রস্থান করিলেন, তখন চারজন ডিরেকটারই কিছুক্ষণ হাস্য-বিকশিত বোকাটে মুখ লইয়া বসিয়া রহিল।

তারপর ভাস্করানন্দ লাফাইয়া উঠিয়া দেরাজের ভিতর হইতে খাতা বাহির করিয়া প্রাণপণে লিখিতে আরম্ভ করিল। হিরোইনকে দেখিয়া তাহার দারুণ প্রেরণা আসিয়াছে।

বাসুদেব জিজ্ঞাসা করিল, ‘ভিলেনকে কি করতে হবে?’

ভাস্করানন্দ লিখিতে লিখিতে বলিল, ‘নারী-হরণ—মানে নারী-হরণের চেষ্টা। হিরোর বিক্রমে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।’

ললিত আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, ‘এবং শেষ পর্যন্ত হিরোর সঙ্গে হিরোইনের মিলন হবে।’ তাহার ভ্রুযুগল তখন কপালের উপর তাণ্ডব শুরু করিয়া দিয়াছে।

বাসুদেব বলিল, ‘কুছ পরোয়া নেই, আমিই ভিলেন হব।’

সাধুপদ বলিল, ‘বাঁচা গেল। তুমি ত্রিশ টাকা মাসে হাতখরচ পাবে। ভিলেনের পক্ষে ওই যথেষ্ট।’

ললিত উদারভাবে বলিল, ‘আমার কিছু চাই না।’

পরদিন হইতে মহলা শুরু হইল। ভাস্করানন্দই ডিরেকটার। তাহার নির্দেশ অনুসরণ করিয়া হিরো এবং ভিলেন উভয়েই এমন বস্তুতান্ত্রিক অভিনয় আরম্ভ করিয়া দিল, হিরোর স্পর্শন চেষ্টা ও ভিলেনের ধর্ষণ চেষ্টা এতই জীবন্ত হইয়া উঠিল যে সকলের তাক লাগিয়া গেল। হিরোইনের কিন্তু কাহারও প্রতি পক্ষপাত নাই, তিনি নিরপেক্ষভাবে হিরোর কবল হইতে ভিলেনের কবলে এবং ভিলেনের কবল হইতে হিরোর কবলে যাতায়াত করিতে লাগিলেন।

রিহার্সাল চলিতে লাগিল। আপাতদৃষ্টিতে সকলেই খুশি। এমন কি সাধুপদর ক্ষুদ্র টিকিও মাঝে মাঝে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিতে দেখা গেল।

রিহার্সাল শেষ হইয়া ছবি তোলা আরম্ভ হইবে। স্টুডিও, ক্যামেরাম্যান, শব্দ-যন্ত্রী সব ঠিক হইয়া গিয়াছে।

একদিন রাত্রি দশটার সময় বালিগঞ্জ অঞ্চলে একটি বাড়ির দরজার সম্মুখে হিরো ও ভিলেনের মাথা ঠোকাঠুকি হইয়া গেল।

ললিত জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

বাসুদেব বলিল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

ললিত হুংকার দিয়া বলিল, ‘হুঁ, বুঝেছি।’

বাসুদেবও হুংকার দিল, ‘হুঁ—বুঝেছি।’

ফুটপাথের উপর উভয়ের হাতাহাতির উপক্রম হইল।

এমন সময় বাড়ির দরজা দিয়া বাহির হইয়া আসিল সাধুপদ। দু’জনকে চপেটাযুদ্ধে উদ্যত দেখিয়া সে বলিল, ‘একি, তোমরা এখানে লড়াই করছ কেন?’

উভয়েই নির্বাক। তারপর উভয়ে বুঝাইবার চেষ্টা করিল যে ইহা রিহার্সাল মাত্র।

সাধুপদ বলিল, ‘আমি এসেছিলুম ছলনা দেবীকে বোঝাতে, তিনি মাইনেটা যাতে কিছু কম করেন। অনেক বুঝিয়ে দেড়শ’ টাকায় রাজী করেছি।—ঐ একটা কনস্টেবল আসছে। চলো।’

পরদিন বেলা এগারোটার সময় স্টুডিওতে সকলে প্রস্তুত হইয়া আছে, ছবি তোলা আরম্ভ হইবে। কিন্তু হিরোইনের দেখা নাই। কিছুক্ষণ পরে সকলে লক্ষ্য করিল খাজাঞ্চি সাধুপদও অনুপস্থিত।

হিরো ও ভিলেন একই ট্যাক্সিতে চড়িয়া ছুটিল। ছলনা দেবীর গৃহে গিয়া দেখিল, হিরোইন ও খাজাঞ্চি একসঙ্গে উড়িয়াছে—এবং সেই সঙ্গে কোম্পানির তহবিল।

ভালবা(সা) লিঃ কুকুরের ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছে। কুক্করজাতির স্বাভাবিক চরিত্রহীনতার সুযোগ লইয়া নানাপ্রকার বর্ণসংকর কুক্কুরশাবক তৈয়ার করিয়া বিলাতী খদ্দের মহলে বিক্রয় করিতেছে। শুনা যাইতেছে ভালবা(সা) লিঃ আগামী বৎসর ½ পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড ঘোষণা করিবে। শেয়ারের দাম চড়িতেছে।

৯ পৌষ ১৩৪৩

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন