মায়া কানন

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

মায়া কানন

‘অতি বিস্তৃত অরণ্য। অরণ্যমধ্যে অধিকাংশ বৃক্ষই শাল, কিন্তু তদ্ভিন্ন আরও অনেক জাতীয় গাছ আছে। গাছের মাথায় মাথায় পাতায় পাতায় মিশামিশি হইয়া অনন্ত শ্রেণী চলিয়াছে। বিচ্ছেদশূন্য, ছিদ্রশূন্য, অলোকপ্রবেশের পথমাত্র শূন্য; এইরূপ পল্লবের অনন্ত সমুদ্র, ক্রোশের পর ক্রোশ, ক্রোশের পর ক্রোশ, পবনে তরঙ্গের উপর তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত করিতে করিতে চলিয়াছে…।’

বনের মধ্যে কিন্তু অন্ধকার নাই। ছায়া আছে, অন্ধকার নাই। চন্দ্ৰসূর্যের রশ্মি প্রবেশ করে না, তবু বন অপূর্ব আলোকে প্রভাময়। কোথা হইতে এই স্বপ্নাতুর আলোক আসে কেহ জানে না। হয়তো ইহা সেই আলো যাহা স্বর্গ মর্ত্যে কোথাও নাই—The light that never was on Land or Sea—

এই বনে একাকী ঘুরিতেছিলাম। মানুষের দেখা এখনও পাই নাই, কিন্তু মনে হইতেছে আশেপাশে অনেক লোক ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছে। একবার অদৃশ্য অশ্বের দ্রুত ক্ষুরধ্বনি শুনিলাম, কে যেন ঘোড়া ছুটাইয়া চলিয়াছে। পিছনে রমণীকণ্ঠ গাহিয়া উঠিল—‘দড় বড়ি ঘোড়া চড়ি কোথা তুমি যাও রে!’

অশ্বারোহী ভারী গলায় উত্তর দিল—‘সমরে চলিনু আমি হামে না ফিরাও রে।’

ক্ষুরধ্বনি মিলাইয়া গেল।

বনের মধ্যে পায়ে হাঁটা পথের অস্পষ্ট চিহ্ন আছে; তাহার শেষে একটা ভাঙা বাড়ি। ইটের স্তুপ; তাহার উপর অশথ বাব্‌লা আরও কত আগাছা জন্মিয়াছে।

বহুদিন আগে হয়তো ইহা কোনও অখ্যাত রাজার অট্টালিকা ছিল। এই ভগ্নস্তুপের সম্মুখে হঠাৎ একজনের সহিত মুখোমুখি দেখা হইয়া গেল। মজবুত দেহ, গালে গালপাট্টা, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, হাতে মোটা বাঁশের লাঠি। বিস্মিত হইয়া বলিলাম—‘একি, দাড়ি বাবাজী! আপনি এখানে?’

দাড়ি বাবাজীর চোখে একটা আগ্রহপূর্ণ উৎকণ্ঠা। তিনি বলিলেন—‘দেবীকে খুঁজতে এসেছিলাম। এটা দেবীর পুরানো আস্তানা।’

‘দেবী চৌধুরাণী?’

‘হাঁ। দেবী নেই। দিবা নিশিও কোথাও চলে গেছে।’ রঙ্গরাজের কণ্ঠস্বর ব্যগ্র হইয়া উঠিল,—‘তুমি জানো দেবী কোথায়? তাঁকে বড় দরকার। ত্রিস্রোতার মোহানায় বজ্‌রা নোঙর করা আছে। তাঁকে এখনি যেতে হবে। তুমি জানো তিনি কোথায়?’

নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলাম—‘দেবী মরেছে। প্রফুল্ল ছিল, সেও ব্রজেশ্বরের অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছে। আর তাকে পাবে না।’

‘পাব না?’ রঙ্গরাজের রাঙা তিলকের নীচে চক্ষু দুটা জ্বলিয়া উঠিল—‘নিশ্চয় পাব। দেবীকে না হলে যে চলবে না। তাঁকে চাইই। যেমন করে হোক খুঁজে বার করতে হবে। ত্রিস্রোতার মোহনায় বজ্‌রা অপেক্ষা করছে। ব্রজেশ্বরের সাধ্য কি মা’কে ধরে রাখে।’

রঙ্গরাজ চলিয়া গেল। শুধু নিষ্ঠা এবং একাগ্র বিশ্বাসের বলে দেবীকে সে খুঁজিয়া পাইবে কিনা কে বলিতে পারে।

কিশোর কণ্ঠের মিঠে গান শুনিয়া চমক ভাঙিল। কয়েকটি বালিকা কাঁখে কলসী লইয়া মল বাজাইয়া চলিয়াছে—

চল্‌ চল্‌ সই জল আনিগে জল আনিগে চল্‌।

সকৌতুকে তাহাদের পিছু পিছু চলিলাম। কোন্ জলাশয়ে ইহারা জল আনিতে চলিয়াছে জানিতে ইচ্ছা হইল। আঁকিয়া বাঁকিয়া পায়ে হাঁটা পথে তাহারা স্বচ্ছন্দ চরণে চলিয়াছে, গানও চলিতেছে—

বাজিয়ে যাব মল।

অবশেষে তরুবেষ্টিত উচ্চ পাড়ের ক্রোড়ে একটি প্রকাণ্ড সরোবর চোখে পড়িল। নীল জল নিস্তরঙ্গ, দর্পণের মতো আলোক প্রতিফলিত করিতেছে। মনে প্রশ্ন জাগিল, এ কোন্‌ জলাশয়? যে-দিঘির নিকট ইন্দিরার পালকির উপর ডাকাত পড়িয়াছিল সেই দিঘি? রোহিণী যাহার জলে ডুবিয়া মরিতে গিয়াছিল সেই বারুণী জলাশয়? কিংবা শৈবলিনী যাহার জলে দাঁড়াইয়া লরেন্স্‌ ফস্টরকে মজাইয়াছিল সেই ভীমা পুষ্করিণী?

ঘাটের উপর দাঁড়াইয়া বালিকাদের আর দেখিতে পাইলাম না। বিস্তৃত ঘাটের অগণিত সোপান ধাপে ধাপে নামিয়া জলের মধ্যে ডুবিয়াছে।

ঘাটের শেষ সোপানে জলে পা ডুবাইয়া একটি রমণী বসিয়া আছে, পরিধানে শুভ্র বস্ত্র, রুক্ষ কেশরাশি পৃষ্ঠ আবৃত করিয়া মাটিতে লুটাইতেছে। বর্মাবৃত শিরস্ত্রাণধারী এক পুরুষ তাহার পাশে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিতেছেন—‘মনোরমা, এই পথে কাহাকেও যাইতে দেখিয়াছ?’

‘দেখিয়াছি।’

‘কাহাকে দেখিয়াছ? কিরূপ পোশাক?’

‘তুর্কির পোশাক।’

হেমচন্দ্র সবিস্ময়ে বলিলেন—‘তুমি তুর্কি চেন? কোথায় দেখিলে?’

মনোরমা ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল; তাহার মুখে বিচিত্র হাসি। আমি পা টিপিয়া টিপিয়া সরিয়া আসিলাম, তাহাদের কথাবার্তা অধিক শুনিতে ভয় হইল।

সেখান হইতে সরিয়া গিয়া বনের যে অংশে উপস্থিত হইলাম তাহা উদ্যানের মতো সুন্দর। লতায় ফুল ধরিয়াছে, বৃহৎ বৃক্ষের শাখা হইতে ভাস্বর আলোকলতা ঝুলিতেছে। একটা কোকিল বুক-ফাটা স্বরে ডাকিতেছে—কুহু কুহু—

একি সেই কোকিলটা, ঘাটে যাইতে যাইতে রোহিণী যাহার ডাক শুনিয়া উন্মনা হইয়াছিল?

এক তরুতলে দুইটি রমণী রহিয়াছে। রূপের তুলনা নাই, তরুমূল যেন আলো হইয়াছে। একটি ক্ষুদ্রকায়া তন্বী, মুকুলিত যৌবনা; ফোটে ফোটে ফোটে না। অন্যটি বিশালনয়না, পরিস্ফুটাঙ্গী রাজেন্দ্রাণী, শান্ত অথচ তেজোময়ী। উভয়ের বক্ষে জরির কাঁচুলি; সূক্ষ্ম মলমলের ওড়না চন্দ্রকিরণের মতো অনিন্দ্য সুন্দর তনুলতা বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে।

আয়েষা বলিলেন—‘ভগিনী, তুমি বিষপান করিলে কেন? আমিও তো মরিতে পারিতাম কিন্তু মরি নাই, গরলাধার অঙ্গুরীয় দুর্গপরিখার জলে নিক্ষেপ করিয়াছিলাম।’

দলনীর গোলাপ কোরকের মতো ওষ্ঠাধর কম্পিত হইতে লাগিল, সে বলিল—‘আয়েষা, তুমি জানিতে তোমার হৃদয়েশ্বরকে পাইবে না, কোনও দিন পাইতে পার না। তোমার কত দুঃখ? কিন্তু আমি যে পাইয়াছিলাম, পাইয়া হারাইয়াছিলাম—’ মুক্তাবিন্দুর মতো অশ্রু দলনীর গণ্ড বহিয়া ঝরিয়া পড়িল। এখান হইতে পা টিপিয়া টিপিয়া সরিয়া গেলাম।

অনতিদূরে আর একটি বৃক্ষতলে এক রমণী মাটিতে পড়িয়া কাঁদিতেছে। রোদনের আবেগে তাহার দেহ ফুলিয়া উঠিতেছে, পৃষ্ঠে বিলম্বিত কৃষ্ণবেণী কাল ভুজঙ্গিনীর মতো তাহাকে দংশন করিতেছে। রমণীর বাষ্পবিকৃত কণ্ঠ হইতে কেবল একটি নাম গুমরিয়া গুমরিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে,—‘হায় মোবারক! মোবারক! মোবারক!’

বসুধালিঙ্গনধূসরস্তনী।

বিললাপ বিকীর্ণর্মুদ্ধজা।

এই বেদনাবিধুর উপবনে শব্দ করিতে ভয় হয়। বাতাস যেন এখানে ব্যথাবিদ্ধ হইয়া নিস্পন্দ হইয়া আছে। আমি এই অশ্রুভারাতুর উদ্যান ছাড়িয়া যাইবার চেষ্টা করিলাম।

পুষ্পোদ্যান প্রায় উত্তীর্ণ হইয়াছি, একটি লতানিকুঞ্জ হইতে হাসির শব্দে সেইদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল। দুইটি স্ত্রীপুরুষ যেন রঙ্গ তামাসা করিতেছে, হাসিতেছে, মৃদুকণ্ঠে কথা কহিতেছে। চাবির গোছা, চুড়ি, বালা ঝঙ্কার দিয়া উঠিতেছে।

বড় লোভ হইল; চুপি চুপি গিয়া লতার আড়াল হইতে উঁকি মারিলাম। লবঙ্গলতার আঁচল ধরিয়া রামসদয় টানাটানি করিতেছেন। লবঙ্গলতা বলিতেছেন—‘আঁচল ছাড়, এখনি ছেলেরা দেখতে পাবে। বুড়ো মানুষের অত রস কেন?’

রামসদয় বলিলেন—‘আমি যদি বুড়ো, তুমিও তবে বুড়ি।’

লবঙ্গ বলিল—‘বুড়োর বৌ যদি বুড়ি হয়, ছুঁড়ির বরও তবে ছোঁড়া।’

রামসদয় আঁচল টানিয়া লবঙ্গলতাকে কাছে আনিলেন, বলিলেন—‘সে ভাল। তুমি বুড়ি হওয়ার চেয়ে আমিই ছোঁড়া হলাম। এখন ছোঁড়ার পাওনাগণ্ডা বুঝিয়ে দাও।’ বলিয়া তাহার মুখের দিকে মুখ বাড়াইলেন।

আমার পিছন হইতে কে বলিয়া উঠিল—‘আ ছি ছি ছি—’

লজ্জা পাইয়া সরিয়া আসিলাম। কে ছি ছি বলিল দেখিবার জন্য চারিদিকে চাহিলাম কিন্তু কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না।

দূর হইতে একটা শব্দ আসিল—মিউ!

বিড়াল! এ বনে বিড়ালও আছে। মিউ শব্দ অনুসরণ করিয়া খানিকদূর যাইবার পর দেখিলাম, ঘাসের উপর একটি বৃদ্ধগোছের লোক বসিয়া ঝিমাইতেছে; গলায় উপবীত, গালদুটি শুষ্ক, চক্ষু প্রায় নিমীলিত। একটি শীর্ণকায় বিড়াল তাহার সম্মুখে বসিয়া মাঝে মাঝে মিউ মিউ করিতেছে।

বৃদ্ধ বলিল—‘মার্জার পণ্ডিতে, তোমার কথাগুলি বড়ই সোশ্যালিস্টিক্‌। আমি তোমাকে বুঝাইতে পারিব না, তুমি বরং প্রসন্ন গোয়ালিনীর কাছে যাও। সে তোমাকে দুগ্ধ দিতে পারে কিংবা ঝাঁটাও মারিতে পারে। তা দুগ্ধ অথবা ঝাঁটা যাহাই খাও তোমার দিব্যজ্ঞান জন্মিবে। আর যদি তুরীয়-সমাধি লাভ করিয়া পরব্রহ্মে লীন হইতে চাও, আমার কাছে ফিরিয়া আসিও—এক সরিষা ভর আফিম দিব। এখন তুমি যাও, আমি মনুষ্যফল সম্বন্ধে চিন্তা করিব।’

বিড়াল নড়িল না। তখন কমলাকান্ত বলিলেন—‘দেখ, বঙ্গদেশে সম্পাদক জাতীয় যে জীব আছে, ফলের মধ্যে তাহারা লঙ্কার সহিত তুলনীয়। দেখিতে বেশ সুন্দর, রাঙা টুক্‌টুক্‌ করিতেছে; মনে হয় কতই মিষ্টরসে ভরা। কিন্তু বড় ঝাল। দেখিও, কদাপি চিবাইবার চেষ্টা করিও না, বিপদে পড়িবে। সম্পাদকের কোপে পড়িলে, আর তোমার রক্ষা নাই, বড় বড় ঝাঁঝালো লীডার লিখিয়া তোমার দফারফা করিয়া দিবে।

অনেকগুলি সম্পাদকের সহিত সদ্ভাব আছে, তাই আমি আর সেখানে দাঁড়াইলাম না; কি জানি তাঁহারা মনে করিতে পারেন কমলাকান্ত চক্রবর্তীর মতামতের সহিত আমার সহানুভূতি আছে!

একজন শীর্ণাকৃতি লোক দীর্ঘ পা ফেলিয়া আসিতেছে আর মাঝে মাঝে পিছন ফিরিয়া তাকাইতেছে; কেহ যেন তাহাকে তাড়া করিয়াছে। লোকটির বগলে পুঁথি, অদ্ভুত সাজ-পোশাক—হিন্দু কি মুসলমান সহসা ঠাহর করা যায় না। আমাকে দেখিয়া সে বলিল—‘খোদা খাঁ বাবুজীকে কুশলে রাখুন। ঘৃতভাণ্ডকে এদিকে দেখিয়াছেন?’

অবাক হইয়া বলিলাম—‘ঘৃতভাণ্ড?’

সে বলিল—‘বিমলা আমার ঘৃতভাণ্ড। মোচলমান বাবারা যখন গড়ে এলেন, আমাকে বললেন, আয় বামুন তোর জাত মারি—’

‘ও—আপনি বিদ্যাদিগ্‌গজ মহাশয়!’

‘উপস্থিত শেখ দিগ্‌গজ’—পিছন দিকে তাকাইয়া শেখ সভয়ে বলিলেন—‘ঐ রে, বুড়ি আসিতেছে, এখনি রূপকথা শুনাইবে—’ সুদীর্ঘ পদযুগলের সাহায্যে গজপতি নিমেষ মধ্যে অন্তর্হিত হইলেন।

ক্ষণেক পরে বুড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। হাতে জপের মালা, বুড়ি আপনমনে বিড়বিড় করিয়া কথা বলিতেছে—‘সাগর আমার চরকা ভেঙে দিয়েছে। বামুনকে দুটো পৈতে তুলে দিতাম—তা যাক—’ আমাকে দেখিয়া বুড়ির নিষ্প্রভ চক্ষুৰ্দয় ঈষৎ উজ্জ্বল হইল—‘বেজ দাঁড়িয়ে আছিস! প্রফুল্ল ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে বুঝি? তোর যেমন বাগ্‌দিনী না হলে মন ওঠে না—বেশ হয়েছে। তা আয়, আমার কাছেই না হয় শো—’

কি সর্বনাশ! বুড়ি আমাকে ব্রজেশ্বর মনে করিয়াছে। পলাইবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু ব্রহ্ম ঠাকুরাণীর হাত ছাড়ানো কঠিন কাজ।—‘রূপকথা শুন্‌বি। তবে বলি শোন্, এক বনের মধ্যে শিমুল গাছে—’

শেষ পর্যন্ত শুনিতে হইল। ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প শুনিয়া কিন্তু আশ্চর্য হইয়া গেলাম। বস্তুতন্ত্র একেবারে নাই। এত চমৎকার গল্প গত দশ বৎসরের মধ্যে কেহ লেখে নাই হলফ্‌ লইয়া বলিতে পারি।

ব্ৰহ্ম ঠাকুরাণীর নিকট বিদায় লইয়া আবার চলিয়াছি। বন যেন আরও নিবিড় হইয়া আসিতেছে। এ বনের শেষ কোথায় জানি না। শেষ আছে কি? হয়তো নাই, জগৎব্রহ্মাণ্ডের মতো ইহাও অনন্ত অনাদি, আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ।

গাছপালায় ঢাকা একটি ক্ষুদ্র কুটিরের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। মাটির কুঁড়ে ঘর, কিন্তু তক্‌তক্ ঝক্‌ঝক্‌ করিতেছে। একটি সতেরো আঠারো বছরের মেয়ে হাসিমুখে আমার সম্বর্ধনা করিল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—‘নিমাইমণি, জীবানন্দ কোথায়?’

নিমাইমণির হাসিমুখ ম্লান হইয়া গেল, চোখ ছলছল করিয়া উঠিল। ‘দাদা নেই; শান্তিও চলে গেছে। সেই যে সিপাহিদের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল তারপর থেকে আর তারা আসেনি। ঐ দ্যাখো না, শান্তির ঘর খালি পড়ে রয়েছে।’

শান্তির ঘর দেখিলাম। পাখি উড়িয়া গিয়াছে, শূন্য পিঞ্জরটা পড়িয়া আছে। বুকের অন্তস্তল হইতে একটা দীর্ঘশ্বাস বাহির হইয়া আসিল। নিমাইমণি চোখে আঁচল দিয়া বলিল—‘সেই থেকে রোজ তাদের পথ চেয়ে থাকি। হ্যাঁগা, আর কি তারা আসবে না?’

আমিও তাহাই ভাবিতেছিলাম। আর আসিবে কি? জীবানন্দের ন্যায় পুত্র, শান্তির ন্যায় কন্যা বঙ্গজননী আর গর্ভে ধরিবে কি?

‘জানি না’ বলিয়া বিষগ্নচিত্তে ফিরিয়া চলিলাম।

পিছন হইতে নিমাইমণির করুণ স্বর আসিল—‘কিছু খেয়ে গেলে না? গেরস্তর বাড়ি থেকে না খেয়ে যেতে নেই—’

জীবানন্দ গিয়াছে, শান্তি গিয়াছে; দেবীকে রঙ্গরাজ খুঁজিয়া পাইতেছে না। তবে কি তাহারা কেহই নাই, কেহই ফিরিয়া আসিবে না? সীতারাম রাজসিংহ মৃন্ময় চন্দ্রচূড় ঠাকুর—ইহারা চিরদিনের মতো চলিয়া গিয়াছে?

বনের অনৈসর্গিক আলো ক্রমে নিভিয়া আসিতে লাগিল। প্রথমে ছায়া, তারপর অন্ধকার, তারপর গাঢ়তর অন্ধকার। সূচীভেদ্য অন্ধকারে কিছু দেখিতে পাইতেছি না। মহাপ্রলয়ের কৃষ্ণ জলরাশির মধ্যে আমি ডুবিয়া যাইতেছি। চেতনা লুপ্ত হইয়া আসিতেছে।

সহসা এই প্রলয় জলধি মথিত করিয়া জীমূতমন্দ্রকণ্ঠে কে গাহিয়া উঠিল—বন্দে মাতরম্!

আছে আছে—কেহ মরে নাই। ঐ বীজমন্ত্রের মধ্যে সকলে লুক্কায়িত আছে। দেবী আছে, জীবানন্দ আছে, সীতারাম আছে—

আবার তাহারা আসিবে—ঐ বীজমন্ত্রের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করিতে যেটুকু বিলম্ব। আবার আসিবে। আমিও ক্ষীণ দুর্বলকণ্ঠে সেই অমাতমস্বিনী রাত্রির মধ্যে চিৎকার করিয়া উঠিলাম—বন্দে মাতরম্।

৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন