নারীর মূল্য

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

নারীর মূল্য

বৈরাগ্য সাধনের পক্ষে শংকর-ভাষ্যের চেয়ে পদার্থ-বিজ্ঞান বেশী উপযোগী। মাসিক পত্রিকার সম্পাদক হইয়া অবধি এই কথাটা আমি বেশ ভাল করিয়া বুঝিয়াছি।

বৈরাগ্য-শতকের কবি লিখিয়াছেন বটে—স্তনৌ মাংসগ্রন্থী (আধুনিক লেখকগুলা একথাটা জানে না—মাংসপেশী লেখে), কিন্তু বিজ্ঞানের কাছে তাহা কিছুই নয়। মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা ও বৈরাগ্য-সাধনা একসঙ্গে চালাইতে গিয়া এ বিষয়ে আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মিয়াছে।

এই দেখুন না, আজ সকালবেলা আমার পত্রিকার আপিসে আসিয়া খবরের কাগজ খুলিতেই দেখিলাম,—একজন বৈরাগী-বৈজ্ঞানিক লিখিয়াছেন যে, মানুষের শরীরের—সুতরাং সেই সঙ্গে নারীর শরীরের—সমস্ত মাল-মশলা আলাদা করিয়া দাম কষিলে তাহার মূল্য দাঁড়ায় মোটে আঠারো টাকা। বেশীর ভাগ জিনিসই বাজে—বাজারে চলে না; মূল্যবান পদার্থের মধ্যে—ফস্‌ফরাস্! অতএব ইহার পর, তরুণী সুন্দরী লেখিকা হাসিহাসি মুখে কবিতা লইয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত হইলে আর আমার ভয় কি? সম্পাদকদের মধ্যে যাঁহাদের বয়স কাঁচা তাঁহাদের সকলকেই আমি পদার্থ-বিজ্ঞান পড়িতে বলি। রামানন্দবাবু না পড়িলেও ক্ষতি নাই।

হিসাবের কড়ি বাঘে খায় না; বৈরাগী-বৈজ্ঞানিক মহাশয় যোগ করিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন মেয়েমানুষের মূল্য ঠিক আঠারো টাকা,—অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তাহাই পড়িতেছি, এমন সময় পর্দা সরাইয়া একটি হাসি-খুশি মুখ ঘরে প্রবেশ করিল।

এক নজরে সমস্ত চেহারাখানা আগাগোড়া দেখিয়া লইলাম। বয়স সতেরো-আঠারো, পায়ে হাই-হীল জুতা, বাঁ হাতের কজি হইতে ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিতেছে, বাঁকা সিঁথি, আর চোখ মুখ গড়ন—

এক কথায়, ঘোর সুন্দরী। বুঝিলাম, বিপদ উপস্থিত—এবং কবিতা।

বৈরাগ্যের প্রথম সোপান স্ত্রীজাতির প্রতি রূঢ়তা। আমি তাহাকে বসিতে না বলিয়া কঠোর স্বরে কহিলাম, ‘আপনার মূল্য আঠারো টাকা।’

যুবতী ফিক্‌ করিয়া হাসিয়া সম্মুখের চেয়ারে বসিয়া পড়িল, বলিল, ‘আঠারো টাকা? মোটে!…’

বাংলাদেশে এরূপ স্ত্রী-কবি কখনো দেখি নাই, কথাটা যেন গায়েই মাখিল না। তাই আরো তীব্রভাবে বলিলাম, সতেরো টাকাও হতে পারে। কারণ আপনি তন্বী—মানে, আপনি রোগা, শরীরে বেশী মাল নেই। তাছাড়া, আপনার চামড়ায় পিগ্‌মেন্টের অভাব—যেহেতু আপনি ফরসা। এই দুই দফায় এক টাকা কাটা গেল। আপনার দাম সতেরো টাকা।’

যুবতী কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া স্মিত-মুখে বলিল, ‘তাই তো, তবে উপায়? মোটা হলে দাম বাড়তে পারে কি?’

বুঝিলাম, রসিকতা করিতেছে। রসিকার বিরুদ্ধে বৈরাগ্য রক্ষা করা অতিশয় কঠিন, তাই আমি কণ্ঠস্বরে তীক্ষ শ্লেষ মিশাইয়া বলিলাম, ‘আপনার শরীরে যে লোহা আছে তা থেকে একটি মাত্র পেরেক তৈরি হয়।’

যুবতীর চোখে দুষ্টু হাসি নৃত্য করিয়া উঠিল, সে বলিল, ‘আর বঁড়শি?’

আমি বলিলাম, ‘তা জানি না, কাগজে কিছু লেখেনি। আরো শুনুন, আপনার মধ্যে যে গন্ধক অর্থাৎ সালফার আছে তা দিয়ে মাত্র পাঁচটি দেশলাইয়ের কাঠি তৈরি হতে পারে—তার বেশী নয়।’

যুবতীর গাল হাসির আবেগে টোল খাইয়া গেল, সে মুখ টিপিয়া বলিল, ‘এতখানি আগুন যে আমার মধ্যে আছে তা আমি নিজেই জানতুম না!’

আমি বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিলাম; স্ত্রী-কবিরা তো এমনভাবে কথা বলে না, তাহারা কেবলই গলিয়া নেতাইয়া পড়িতে চায়। এ কিরূপ স্ত্রী-কবি? বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করিলাম, ‘আপনি কি রকম তরুণী? আপনার কি আত্ম-সম্মান জ্ঞান নেই? আমার কথা শুনে আপনার রাগ হচ্ছে না? এখনো চলে যাচ্ছেন না কেন?’

যুবতী চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়া বসিয়া বলিল, ‘আপনার মাথায় ছিট আছে আমি জানি।’

আমার মাথায় ছিট আছে! না, আর শুধু বৈরাগ্যে শানাইবে না, এই যুবতীটাকে ভাল রকম শিক্ষা দিতে হইবে। হাত বাড়াইয়া চাপা গর্জনে বলিলাম, ‘দেখি, বার করুন আপনার কবিতা।’

‘কবিতা!’—যুবতী ঈষৎ বিস্ময়ে ভ্রূ তুলিল।

‘হ্যাঁ-কবিতা! আপনি কবিতা আনেননি?’

যুবতী মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘না, একটা লিখব ভেবেছিলুম, কিন্তু হয়ে ওঠেনি।’

‘তবে আপনি চান কি!’

‘আমার দাদার বিয়েতে আপনাকে নেমন্তন্ন করতে চাই।’

‘আপনার দাদা!’

‘হ্যাঁ—আমার দাদা। কেন, আমার কি দাদা থাকতে নেই?’

মনে মনে ভাবলাম, দাদা যদি বা থাকে সে অতি অপদার্থ দাদা। এমন সাংঘাতিক একটা ভগিনীকে অম্লানবদনে লোক সমাজে ছাড়িয়া দিয়াছে!

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনার দাদা কে?’

সে বলিল, ‘আমার দাদার নাম সৌরীন্দ্রনাথ—’

আমি লাফাইয়া উঠিলাম, ‘অ্যাঁ! সৌরীন আপনার—তোমার দাদা? তার মানে—তার মানে—তুমি পলা!’

সে বলিল, ‘হ্যাঁ আমি পলা, মানে প্রমীলা দেবী। চিনতে পেরেছেন?’

আমি মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলাম, ‘না। অনেক দিন আগে দেখেছি প্রায় সাত-আট বছর। সৌরীনটা কোথায়? সে কলকাতায় এলো কবে?’

‘আমরা সবাই কাল এসেছি। আজই বিয়ে, তাই তিনি আসতে পারলেন না, তাঁর বদলে আমি এসেছি। ভেবেছিলুম আমাকে চিনতে পারবেন।’

আমি ক্ষুব্ধভাবে বলিলাম, ‘আমার সন্দেহ হয়েছিল তুমি একজন স্ত্রী-কবি।’

পলা বলিল, ‘আপনাকে কিন্তু আমি দেখেই চিনেছিলুম, আপনি ঠিক তেমনি আছেন।’

আমি একটু ভ্রূকুটি করিয়া বলিলাম, ‘আমার মাথায় কিন্তু ছিট নেই।’

পলা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘চললুম। আজ নিশ্চয় যাবেন তাহলে।’

আমি গোঁ ধরিয়া বলিলাম, ‘আমার মাথায় কিন্তু ছিট নেই।’

পলা হাসিয়া বলিল, ‘আচ্ছা নেই। তাহলে যাবেন তো?’

‘যাব।’

বাড়ির ঠিকানা দিয়া পলা দ্বার পর্যন্ত গিয়াছে, আমার বৈরাগ্য আর একবার চাগাড় দিয়া উঠিল, ডাকিলাম, ‘শোনো।’

পলা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাসিমুখে বলিল, ‘আবার কি হল?’

আমি আঙুল তুলিয়া বলিলাম, তোমার শরীরে যে লোহা আছে তা থেকে একটি মাত্র পেরেক হয়, যে সালফার আছে—’

‘মনে আছে, পাঁচটি দেশলাইয়ের কাঠি।’

আমি বলিলাম, ‘স্ত্রী-কবি না হলেও তোমার দাম সতেরো টাকা—একথা ভুলো না।’

‘আচ্ছা—বেশ!’

মাস তিনেক পরে, একদিন রাত্রে একটি পুষ্পাকীর্ণ বিছানার পাশে বসিয়া পলা আমাকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিল, ‘সতেরো টাকার জন্যে বৈরাগ্য বিসর্জন দিলে?’

আমি মাথা চুল্‌কাইয়া বলিলাম, ‘আমার হিসেবে ভুল ছিল; একটা জিনিস বাদ পড়ে গিয়েছিল।’

‘কি?’

‘তুমি।’

৭ আশ্বিন ১৩৪০

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন