আর একটু হলেই

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

আর একটু হলেই

মুশকিল হয়েছে, সত্যি কথা বললে কেউ বিশ্বাস করে না। অথচ মাঝে মাঝে সত্যি কথা না বললেই বা চলে কি করে? সুতরাং, আজ সত্যি কথাই বলব। যা থাকে কপালে।

তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। আমি থাকি বম্বে শহরের উপকণ্ঠে মালাড্‌ নামক স্থানে। মালাড্‌ আমার আদি কর্মস্থল, ১৯৪১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত বম্বে টকীজে চাকরি করেছি। তারপর যখন চাকরির মেয়াদ ফুরলো, তখনো মালাডেই থেকে গিয়েছিলাম। দরকার হলে বৈদ্যুতিক লোকাল ট্রেনে বোম্বাই যাতায়াত করতাম।

একদিন শীতের দুপুরে কি একটা কাজে বোম্বাই গিয়েছিলাম। কাজ সারতে বিকেল গড়িয়ে গেল। তাড়াতাড়ি দাদর স্টেশনে এসে ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। আজই রাত্রে আবার আমাকে দাদরে ফিরে আসতে হবে; দাদরে একটা গানের জলসা আছে তাতে যোগ না দিলেই নয়। বাড়ি ফিরে ধড়াচূড়ো ছেড়ে ধুতি পাঞ্জাবিতে বাঙালী সেজে আবার আসতে হবে।

পাথর-বাঁধানো উঁচু প্ল্যাটফর্ম। আমি প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে রেল-লাইন থেকে তিন চার হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেন এল। পাঁচটা বেজে গেছে, অসম্ভব ভিড়। থার্ড ক্লাস গাড়ির দোরের সামনে অসংখ্য যাত্রী ডাণ্ডা ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলছে।

গাড়ি তখনো থামেনি, তবে প্রায় থেমে এসেছে, এমন সময় একটা ব্যাপার ঘটল। গাড়ির দোরের সামনে যে-সব যাত্রী ঝুলছিল তাদের মধ্যে একজন প্ল্যাটফর্মের ওপর লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু তার মুখ ছিল পিছন দিকে, সে তাল সামলাতে পারল না, প্ল্যাটফর্মের ওপর পড়ে গিয়ে গড়াতে শুরু করল। গতি রেলের লাইনের দিকে।

আমি দেখছি লোকটা গড়াতে গড়াতে আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। দুটো গাড়ির মাঝখানে ফাঁক থাকে, এখনি তার মধ্য দিয়ে লাইনের ওপর পড়বে। ট্রেন তখনো থামেনি।

লোকটার একটা ঠ্যাং শুন্যে লাফিয়ে উঠল। আমি যন্ত্রচালিতের মতো হাত বাড়িয়ে ঠ্যাং ধরে টেনে নিলাম। শপথ করে বলছি আমি বয়-স্কাউট নই, দৈনিক সৎকার্য করার দিকে আমার তিলমাত্র ঝোঁক নেই। এই লোকটার প্রাণরক্ষার ব্যাপারে আমি নিমিত্তমাত্র।

লোকটা বেশ জোয়ান। গ্যাঁটাগোঁটা চেহারা। এদেশে যাদের ভৈয়া বলে সেই শ্রেণীর লোক। অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত গোয়ালা। এরা দুধের ব্যবসা করে এবং অবসর কালে গুণ্ডামি করে বেড়ায়।

লোকটা প্ল্যাটফর্মে বসে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। মনে হল তার বিশেষ চোট লাগেনি, কেবল পাগড়িটা খসে গিয়ে ঘাড়ের ওপর পড়েছে। খানিকক্ষণ বসে থাকার পর সে মাটি ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল—‘বাবু সাব—’

আর কিছু শুনতে পেলাম না। আমারো তাড়া ছিল, গুঁতোগুঁতি করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। আশ্চর্য এই যে, এতবড় একটা ব্যাপার ঘটে গেল কিন্তু স্টেশনের ছুটোছুটি হুড়োহুড়ির মধ্যে কেউ তা লক্ষ্য করল না। লোকটা রেলে কাটা পড়লে অবশ্য লক্ষ্য করত।

আমার হাত দিয়ে ভগবান এমন একটা সৎকার্য করিয়ে নিলেন কেন ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে এলাম। তারপর বেশ পরিবর্তন করে কিছু জলযোগ করে নিয়ে আবার বেরুলাম। রাত্রি আটটা থেকে গানের জলসা। কয়েকটি বাঙালী এবং অবাঙালী সিনেমা গায়ক সঙ্গীতসুধা বিতরণ করবেন।

জলসার অকুস্থল দাদর স্টেশন থেকে বেশী দূর নয়, প্ল্যাটফর্ম থেকে পুলে উঠে পুব দিকে যেতে হয়। যারা পুলে চড়তে চায় না তারা রেলের লাইন টপকে রাস্তায় গিয়ে পড়ে। কিন্তু ভিড়ের সময় লাইন ডিঙানো নিরাপদ নয়। আমি পুল পেরিয়ে গানের আসরে উপস্থিত হলাম।

সে-রাত্রে মজলিশ খুব জমেছিল। যাঁরা গাইলেন তাঁরা সকলেই তখনকার দিনের খ্যাতনামা গাইয়ে, এখনও তাঁদের মধ্যে দু’একজন অবশিষ্ট আছেন। সভা যখন ভঙ্গ হল তখন বারোটা বাজতে বেশী দেরি নেই। গানের গুঞ্জন মনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। রাত যত বাড়বে লোকাল ট্রেনের সংখ্যা তত কমতে থাকবে। বাড়ি পৌঁছতে একটা বেজে যাবে।

রাস্তা নির্জন। দাদর স্টেশন আলোগুলোকে জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। স্টেশনের এলাকায় পৌঁছে আমি ভাবলাম, পুলে উঠে কী হবে, লাইন ডিঙিয়ে প্ল্যাটফর্মে উঠি। বেশী দূর নয়, বড় জোর পঞ্চাশ গজ। লোকজন নেই, কেউ দেখতে পাবে না; পেলেও নিদ্রালু অবস্থায় হাঙ্গামা করবে না।

লাইন টপকে চলেছি, কোথাও জনমানব দেখা যাচ্ছে না। দূরে দূরে উঁচু ল্যাম্পপোস্টগুলোর মাথায় নীলাভ আলো জ্বলছে। আধাআধি রাস্তা গিয়েছি, পিছন দিকে চাপা পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকালাম। একটা লোক পা টিপে টিপে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তার হাতে হাত-খানেক লম্বা একটা লোহার ডাণ্ডা।

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল। চিন্তা করবার ফুরসৎ পেলাম না, চিৎ হয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে মাটিতে পড়ে গেলাম।

লোকটা আমার বুকের ওপর চেপে বসে লোহার ডাণ্ডা তুলল। লক্ষ্য আমার মাথা।

তারপরই তার হাত অর্ধপথে থেমে গেল। সে সজোরে নিশ্বাস টেনে বলে উঠল—‘বাবু সাব!’

ল্যাম্পপোস্টের আলোতে সে আমার মুখ চিনতে পেরেছিল। আমি তার মুখ দেখতে পেলাম না, পাগড়ির ছায়ায় মুখটা ঢাকা পড়েছিল; কিন্তু চিনতে বাকি রইল না। আজ বিকেলে যাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলাম ইনি সেই ব্যক্তি।

এইখানেই ঘটনার শেষ। লোকটা ক্ষণকাল জবুথবুভাবে আমার বুকের ওপর বসে রইল, তারপর ধড়মড় করে উঠে লম্বা দৌড় মারল। এ জীবনে তাকে আর দেখিনি।

আমি উঠে গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ভাবলাম আর একটু হলেই গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস লোকটার প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম। কিন্তু তাই বা কেন? লোকটা যদি রেলে কাটা পড়ত তাহলে তো এখন এ ব্যাপার ঘটতে পারত না। ভগবানের মতলব বুঝতে পারলাম না, মাথাটা ঘুলিয়ে গেল। আজও ঘুলিয়েই আছে।—

ওপরে যা লিখলাম নির্জলা সত্যি কথা। সাক্ষী চন্দ্র সুর্য এবং দাদর স্টেশনের সেই ল্যাম্পপোস্টটা।

৩ জুন ১৯৬৪

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন