কুবের ও কন্দর্প

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

কুবের ও কন্দর্প

নিউ ইয়র্কের বুড়া অ্যান্টনী রক্ওয়াল ‘ইউরেকা’ সাবান তৈয়ার করিয়া ক্রোড়পতি হইয়াছিলেন। উপস্থিত বিষয়কৰ্ম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া ফিফ্‌থ অ্যাভিনিউ-এ প্রকাণ্ড এক প্রাসাদ নির্মাণ করাইয়া বাস করিতেছেন।

তাঁহার দক্ষিণ দিকের প্রতিবেশী বনেদী বড় মানুষ জি ভ্যান্ স্যুইলাইট সাফ্ক-জোন্স মোটর হইতে অবতরণ করিয়া ‘সাবান সম্রাটে’র প্রাচীন ইতালীয় প্রথায় তৈয়ারি জবড়জং গৃহতোরণের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া নাক সিঁটকাইয়া ঘৃণাভরে নিজের গৃহে প্রবেশ করিল। বুড়া রক্ওয়াল নিজের লাইব্রেরি ঘরের জানালা হইতে তাহা দেখিয়া দাঁত খিঁচাইয়া হাসিলেন।

‘অপদার্থ অহঙ্কেরে বুড়ো বেকুফ কোথাকার! আসছে বছর আমার বাড়ি আমি লাল-নীল-সবুজ রঙ করাবো, দেখি বুড়ো নচ্ছারের ভোঁতা নাক আরো সিকেয় ওঠে কিনা।’

ঘণ্টা বাজাইয়া চাকর ডাকা অ্যান্টনী রক্ওয়াল পছন্দ করিতেন না। তিনি ষাঁড়ের মতো গর্জন করিয়া ডাকিলেন—‘মাইক!’

চাকর আসিলে তাহাকে বলিলেন—“আমার ছেলেকে বল, বেরুবার আগে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।’

ছেলে আসিলে বৃদ্ধ খবরের কাগজখানা নামাইয়া রাখিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলেন। নিজের মাথার চুলগুলো একহাতে এলোমেলো করিতে করিতে এবং অন্য হাতে পকেটের চাবির গুচ্ছ নাড়িতে নাড়িতে হঠাৎ প্রশ্ন করিলেন—‘রিচার্ড, কত দাম দিয়ে তুমি তোমার ব্যবহারের সাবান কেনো?’

রিচার্ড মাত্র ছয়মাস কলেজের পড়া শেষ করিয়া বাড়ি ফিরিয়াছে, সে একটু ঘাবড়াইয়া গেল। ঘোর আকস্মিকতাপূর্ণ বিচিত্রস্বভাব এই বাবাটিকে সে এখনো ভাল করিয়া চিনিতে পারে নাই। বলিল—‘ছ’ ডলার করে ডজন বোধ হয়।’

‘আর তোমার কাপড়-চোপড়?’

‘আন্দাজ ষাট ডলার।’

অ্যাণ্টনী নিঃসংশয় হইয়া বলিলেন—“তুমি সত্যিকার ভদ্রলোক হয়েছ। আমি শুনেছি আজকাল ছোকরারা চব্বিশ ডলার করে সাবান কেনে, একটা পোশাকের জন্যে একশ’ ডলারের ওপর খরচ করে। নবাবী করে ওড়াবার মতো পয়সা তাদের চেয়ে তোমার কিছু কম নেই কিন্তু ভদ্রতা ও মিতাচারের নিয়ম মেনে চলে থাকো—এ থেকে বোঝা যাচ্ছে তুমি ভদ্রলোক হয়েছ। আমি অবশ্য ‘ইউরেকা’ মাখি; নিজের তৈরি বলে নয়—অমন সাবান পৃথিবীতে আর নেই। মোটকথা, দশ সেন্টের বেশী একখানা সাবানের পিছনে যে খরচ করে সে রঙকরা কাগজের বাক্স আর এসেন্সের দুর্গন্ধ কেনে। —যাক্, তুমি ভদ্রলোক। লোকে বলে তিনপুরুষের কমে ভদ্রলোক হয় না। বিলকুল মিথ্যে কথা, টাকা থাকলে একপুরুষে ভদ্রলোক হওয়া যায়—যথা তুমি। এক এক সময় সন্দেহ হয় আমিও বা ভদ্রলোক হয়ে উঠেছি। কারণ আমার পাশের প্রতিবেশীদের মতো—যাঁরা, আমি তাঁদের মাঝখানে বাড়ি কিনেছি বলে, রাত্তিরে ঘুমতে পারেন না—আমারও মাঝে মাঝে বদমেজাজ দেখিয়ে অভদ্রভাবে মুখ খারাপ করতে ইচ্ছে করে।’

রিচার্ড উদাসভাবে বলিল—‘পৃথিবীতে টাকার অসাধ্য কাজও অনেক আছে বাবা।’

বৃদ্ধ রক্ওয়াল মর্মাহত হইয়া বলিলেন—“না না, ও কথা বলো না। যদি বাজি রাখতে বল, আমি প্রত্যেকবার টাকার ওপর বাজি রাখতে রাজি আছি। বিশ্বকোষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে দেখেছি, এমন জিনিস একটাও নেই যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। আসছে হপ্তায় পরিশিষ্টটুকু পড়ে দেখতে হবে তাতে কিছু পাওয়া যায় কিনা। —আসল কথা, টাকার মতো নিরেট খাঁটি জিনিস আর কিছু নেই। দেখাও আমাকে এমন একটা কিছু যা টাকায় কেনা যায় না।’

রিচার্ড বলিল—‘এই ধর, টাকার সাহায্যে বিশিষ্ট ভদ্র সমাজে ঢোকা যায় না।’

‘অর্থমনর্থম’-এর পৃষ্ঠপোষক সগর্জনে কহিলেন—‘যায় না? কোথায় থাকতো তোমার বিশিষ্ট ভদ্রসমাজ যদি তাদের প্রথম পূর্বপুরুষদের জাহাজে চড়ে আমেরিকায় আসবার টাকা না থাকতো?’

রিচার্ড নিশ্বাস ফেলিল।

বৃদ্ধ রক্ওয়াল গলার আওয়াজ কিঞ্চিৎ প্রশমিত করিয়া কহিলেন—‘এই কথাই আলোচনা করতে চাই, সেই জন্যে ডেকে পাঠিয়েছি। দু’হপ্তা থেকে লক্ষ্য করছি তোমার মনের মধ্যে কিছু একটা গোলমাল চলছে। ব্যাপারখানা কি খুলে বল। দরকার হলে স্থাবর সম্পত্তি ছাড়া নগদ টাকা যা আমার আছে তা থেকে এক কোটি দশ লক্ষ ডলার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বার করতে পারি। কিংবা যদি তোমার লিভারের দোষ হয়ে থাকে আমার কূর্তি জাহাজ ঘাটে তৈরি আছে, দু’দিন বাহামার দিকে বেড়িয়ে এসো গে।’

রিচার্ড বলিল—‘লিভার নয় বাবা, তবে কাছাকাছি আন্দাজ করেছ।’

তীক্ষ্ণচক্ষে চাহিয়া অ্যান্টনী রক্ওয়াল বলিলেন—‘হুঁ। নাম কি মেয়েটির?’

রিচার্ড ঘরময় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহার অপরিমার্জিত বাবাটি আস্তে আস্তে তাহার প্রাণের সমস্ত কথা বাহির করিয়া লইলেন। শেষে বলিলেন—‘কিন্তু তুমি প্রস্তাব করছ না কেন? তোমাকে বিয়ে করবার নামে যে কোনও মেয়ে লাফিয়ে উঠবে। তোমার টাকা আছে, চেহারা আছে, চরিত্রও ভাল। মেহনত করে তোমার হাতে কড়া পড়েনি, অন্তত ‘ইউরেকা’ সাবানের দাগ তাতে নেই। দোষের মধ্যে কলেজে পড়েছ—তা সেটা না হয় মাফ্ করে নেবে।’

ছেলে বলিল—‘আমি যে একটাও সুযোগ পেলাম না।’

বাবা বলিলেন—‘সুযোগ তৈরি করে নাও। তাকে নিয়ে পার্কে বেড়িয়ে এসো, নাহয় মোটরে চড়ে ঘুরে এসো। চার্চ থেকে ফেরবার পথে তার সঙ্গ নাও। সুযোগ—হুঁ।’

‘সমাজের সব ব্যাপার তুমি জান না বাবা। তার প্রত্যেক মিনিটের কাজটি আগে থাকতে ঠিক হয়ে আছে। এক চুল নড়চড় হবার যো নেই। তাকে আমার চাইই চাই, না পেলে সমস্ত নিউইয়র্ক শহরটা আলকাতরার মতো কালো হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না। কি যে করি! চিঠি লিখে তো আর প্রস্তাব করতে পারি না, সে যে বড় বিশ্রী হবে।’

অ্যান্টনী কহিলেন—‘তুমি বলতে চাও এত টাকা থাকা সত্ত্বেও এই মেয়েটিকে তুমি এক ঘন্টার জন্য নিরিবিলি পেতে পার না?’

‘আমি ইতস্তত করে দেরি করে ফেলেছি। পরশু দুপুরবেলা সে দু’বছরের জন্যে য়ুরোপ বেড়াতে চলে যাবে। কাল সন্ধেবেলা মাত্র কয়েক মিনিটের জন্যে তার সঙ্গে একলা দেখা হবে। সে এখন লার্চমেন্টে তার মাসির কাছে আছে, সেখানে তো আর যেতে পারি না। কিন্তু ইস্টিশানে রাত্রি সাড়ে আটটার সময় গাড়ি নিয়ে থাকবার হুকুম জোগাড় করেছি। ইস্টিশান থেকে তাকে গাড়িতে করে ব্রডওয়েতে ‘ওয়ালক’ থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে তার মা এবং আরও অনেকে থাকবেন। মধ্যে এই ছ’সাত মিনিট সময় আমি তাকে গাড়ির মধ্যে একলা পাব। ঐটুকু সময়ের মধ্যে কি বিয়ের প্রস্তার করা যায়? তা হয় না। আর পরেই বা কখন সুযোগ পাব? না বাবা, টাকা দিয়ে এ জট ছাড়ানো যাবে না। নগদ মূল্য দিয়েও এক মিনিট সময় কেনা যায় না, তা যদি যেত তাহলে বড় মানুষেরা বেশী দিন বাঁচত। মিস ল্যান্‌ট্রী জাহাজে চড়বার আগে তাঁর সঙ্গে আড়ালে কথা কইবার কোনও আশাই নেই।’

অ্যান্টনী কিছুমাত্র দমিলেন না, প্রফুল্লস্বরে বলিলেন—‘আচ্ছা তুমি ভেবো না ডিক্, এখন তোমার ক্লাবে যাও। তোমার যে লিভার খারাপ হয়নি এটা সুসংবাদ। আর দেখ, মাঝে মাঝে ‘অর্থ-পীরের’ দরগায় একটু আধটু ধূপ ধুনো জ্বালিও। টাকা দিয়ে সময় কেনা যায় না?—হাঁ—মুদির দোকানে কাগজের মোড়কে বাঁধা অনন্তকাল বিক্রি হয় না বটে। কিন্তু তোমার ‘কাল’ মহাশয়কে আমি সোনার খনির ভিতর দিয়ে যেতে যেতে অনেকবার ন্যাংচাতে দেখেছি।’

সেই রাত্রে রিচার্ডের পিসি এলেন ভ্রাতার ঘরে প্রবেশ করিলেন। শান্ত শীর্ণ ভালমানুষ, টাকার ভারে অবনত এলেন পিসি নব প্রণয়ীদের দুঃখ দুরাশার কাহিনী আরম্ভ করিলেন।

প্রকাণ্ড হাই তুলিয়া অ্যান্টনী বলিলেন—‘ডিক্ আমাকে বলেছে। আমি বললাম ব্যাঙ্কে আমার যত টাকা আছে, সব নাও। শুনে সে টাকার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করলে। টাকায় কিছু হবে না,—দশটা কোটিপতির সাধ্য নেই সামাজিক বিধি বাঁধন একচুল নড়ায়।’

পুনরায় নিশ্বাস ফেলিয়া এলেন বলিলেন—‘দোহাই অ্যান্টনী, তুমি রাতদিন টাকার কথা ভেবো না। অকপট ভালবাসার কাছে ঐশ্বর্য কিছুই নয়। প্রেম সর্বশক্তিমান। —আর দু’দিন আগে যদি ডিক্‌ মেয়েটির কাছে প্রস্তাব করত সে কিছুতেই না বলতে পারত না। কিন্তু আর বুঝি সময় নেই। তোমার ঐশ্বর্য তোমার ছেলেকে সুখী করতে পারবে না।’

পরদিন সন্ধ্যা আটটার সময় এলেন পিসি একটি কীটদষ্ট কৌটা হইতে একটি পুরানো সেকেলে গড়নের সোনার আংটি বাহির করিয়া রিচার্ডকে দিলেন—‘বাছা, আজ রাত্রে এটি আঙুলে পরো। তোমার মা এটি আমাকে দিয়েছিলেন আর বলে দিয়েছিলেন যখন তুমি কোনও মেয়েকে ভালবাসবে তখন তোমাকে এটি দিতে। এ আংটি ভালবাসায় সুখ দেয়, সৌভাগ্য আনে।’

রিচার্ড ভক্তিভরে আংটি হাতে লইয়া নিজের কনিষ্ঠ অঙ্গুলিতে পরিবার চেষ্টা করিল। আংটি আঙ্গুলের অর্ধেক দূর পর্যন্ত গিয়া আর উঠিল না। সে তখন আংটি খুলিয়া লইয়া সাবধানে নিজের ওয়েস্ট কোটের পকেটে রাখিল দিল। তারপর গাড়ির জন্য ফোন করিল।

স্টেশনে আটটা বত্রিশ মিনিটে সে মিস ল্যান্‌ট্রীকে ভিড়ের মধ্য হইতে বাহির করিল।

মিস ল্যানট্রী বলিলেন—‘আর দেরি নয়, মা অপেক্ষা করছেন।’

কর্তব্যনিষ্ঠ রিচার্ড নিশ্বাস ফেলিয়া গাড়ির চালককে বলিল—‘ওয়ালক থিয়েটার যত শীঘ্র যেতে পারো।’

গাড়ি ব্রডওয়ের দিকে ছুটিয়া চলিল।

চৌত্রিশ রাস্তায় পৌঁছিয়া রিচার্ড হঠাৎ গলা বাড়াইয়া গাড়ি থামাইতে বলিল।

গাড়ি হইতে নামিয়া ক্ষমা চাহিয়া রিচার্ড বলিল—‘একটা আংটি পড়ে গেছে। আমার মা’র আংটি, হারিয়ে গেলে বড় অন্যায় হবে। কোথায় পড়েছে আমি দেখছি। এখনি খুঁজে আনছি, এক মিনিটও দেরি হবে না।’

এক মিনিটের মধ্যেই রিচার্ড আংটি খুঁজিয়া লইয়া গাড়িতে ফিরিয়া আসিল।

কিন্তু এই এক মিনিটের মধ্যে একখানা ‘বাস’ তাহার গাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কোচম্যান বাঁ দিক দিয়া গাড়ি বাহির করিয়া লইয়া গেল কিন্তু একটা ভারি মাল-বোঝাই ট্রাক তাহার পথের মাঝখানে আগড় হইয়া আটকাইয়া রহিল। সে গাড়ির মুখ ফিরাইয়া ডান দিক দিয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিল কিন্তু সে দিকে কোথা হইতে একটা আসবাব-ভরা প্রকাণ্ড লরী আসিয়া পথরোধ করিয়া দিল। পিছু হটিতে গিয়া কোচম্যান হাতের রাশ ফেলিয়া দিয়া গালাগালি শুরু করিল। চারিদিক হইতে অসংখ্য গাড়িঘোড়া আসিয়া তাহাকে রীতিমত অবরুদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছে।

বড় বড় শহরের রাজপথে মাঝে মাঝে গাড়ি-ঘোড়া এই রকম তাল পাকাইয়া গিয়া যানবাহনের চলাচল একেবারে বন্ধ করিয়া দেয়।

মিস ল্যানট্রী অধীর হইয়া বলিলেন—‘গাড়ি চলছে না কেন? দেরি হয়ে যাবে যে।’

গাড়ির মধ্যে উঁচু হইয়া দাঁড়াইয়া রিচার্ড দেখিল ব্রডওয়ের সিক্সথ্ অ্যাভিনিউ এবং চৌত্রিশ রাস্তার চৌমাথাটা সংখ্যাতীত গাড়ি বাস লরী ও আরও অন্যান্য নানা প্রকার গাড়িতে একেবারে ঠাসিয়া গিয়াছে। এবং আরও অগণ্য গাড়ি চারিদিকের রাস্তা গলি প্রভৃতি হইতে জনস্রোতের মতো বাহির হইয়া তাহার উপর আসিয়া পড়িতেছে। গাড়ির চাকায় চাকায় আটকাইয়া ঠেলাঠেলি হুড়াহুড়ির মধ্যে গাড়োয়ানদের চেঁচামেচি ও গালাগালিতে যেন এক ভীষণ কাণ্ড বাধিয়া গিয়াছে। নিউইয়র্কের সমস্ত চক্রযান যেন একযোগে এই স্থানে উপস্থিত হইয়া সাড়ে বত্রিশ ভাজার মতো মিশিয়া গিয়াছে। ফুটপাথে দাঁড়াইয়া হাজার হাজার লোক এই দৃশ্য দেখিতেছে—এত বড় স্ট্রীট ব্লকেড্ তাহারা আর কখনো দেখে নাই।

রিচার্ড ফিরিয়া বসিয়া বলিল—‘ভারি অন্যায় হল। ঘণ্টাখানেকের আগে এ জট ছাড়ানো যাবে বলে মনে হয় না। আমারি দোষ আংটিটা যদি পড়ে না যেতো—’

মিস ল্যান্‌ট্রী বলিলেন—‘দেখি কেমন আংটি। বেরুবার যখন উপায় নেই তখন এই ভাল। আর সত্যি বলতে কি, থিয়েটার দেখাটা নিছক বোকামি।’

সেদিন রাত্রি এগারটার সময় অ্যান্টনী রক্ওয়াল লাল রঙের ড্রেসিং গাউন পরিয়া এক বোম্বেটে সংক্রান্ত ভীষণ লোমহর্ষণ উপন্যাস পড়িতেছিলেন, এমন সময় কে তাঁহার দরজায় টোকা মারিল।

রক্ওয়াল হুঙ্কার ছাড়িলেন—‘ভেতরে এস।’

এলেন পিসি ঘরে ঢুকিলেন। তাঁহাকে দেখিলে মনে হয় যেন একটা প্রাচীনা স্বর্গলোকবাসিনীকে ভুল করিয়া কে পৃথিবীতে ফেলিয়া গিয়াছে।

মৃদুকণ্ঠে এলেন কহিলেন—‘অ্যান্টনী, ওরা বাগদত্তা হয়েছে; মেয়েটি আমাদের রিচার্ডকে বিয়ে করতে প্রতিশ্রুত হয়েছে। থিয়েটারে যেতে যেতে পথে স্ট্রীট ব্লকেড হয়েছিল তাই দু’ ঘণ্টার আগে ছাড়া পায়নি।

‘অ্যান্টনী ভাই, আর কখনো টাকার গর্ব করো না। অকপট প্রেমের একটি চিহ্ন ওর মা’র দেওয়া একটি আংটির জন্যে আমাদের রিচার্ড আজ ভালবাসায় জয়লাভ করলে। আংটিটা পড়ে গিয়েছিল তাই কুড়িয়ে নেবার জন্যে রিচার্ড গাড়ি থেকে নামে। সে ফিরে আসতে না আসতে পথঘাট সব বন্ধ হয়ে যায়। তখন নিজের ভালবাসার কথা মেয়েটিকে বলে রিচার্ড তাকে লাভ করেছে। অ্যান্টনী, দেখছ প্রেমের কাছে ঐশ্বর্য তুচ্ছ হয়ে যায়।’

অ্যান্টনী বলিলেন—‘বেশ কথা। ছোঁড়া যা চাইছিল তা পেয়েছে এটা খুব সুখের বিষয়। আমি তখনি বলেছিলাম যত টাকা লাগে আমি দেব।’

‘কিন্তু অ্যান্টনী ভাই, তোমার টাকা এখানে কি করতে পারত?’

অ্যান্টনী রক্ওয়াল বলিলেন—‘ভগিনী, আমার বোম্বেটে উপস্থিত বড়ই বিপদে পড়েছে। তার জাহাজ ডুবতে আরম্ভ করেছে কিন্তু সে বড় কড়া পিত্তির বোম্বেটে, সহজে অত টাকার মাল লোকসান হতে দেবে না। তুমি এবার আমাকে এই পরিচ্ছেদটা শেষ করতে দাও।’

গল্প এইখানেই শেষ হওয়া উচিত। পাঠকের মতো আমারও তাহাই ইচ্ছা। কিন্তু সত্যের সন্ধানে কূপের তলদেশ পর্যন্ত আমাদের নামিতেই হইবে—উপায় নাই।

পরদিন কেলী নামক একজন লোক রক্তবর্ণ এক জোড়া হাত এবং নীলবর্ণ কন্ধকাটা নেকটাইয়ের বাহার দিয়া অ্যান্টনী রক্ওয়ালের বাড়িতে উপস্থিত হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে তাহার লাইব্রেরিতে ডাক পড়িল।

অ্যান্টনী হাত বাড়াইয়া চেক্‌বইখানা লইয়া বলিলেন—‘বহুত আচ্ছা—খাসা কাজ হয়েছে। তোমাকে কত দিয়েছি—হাঁ—পাঁচ হাজার ডলার।’

কেলী বলিল—‘আরও তিনশ’ ডলার আমি নিজের পকেট থেকে দিয়েছি। খরচা হিসেবের চেয়ে কিছু বেশী পড়ে গেছে। প্রায় সব বগী গাড়িওয়ালা আর মালগাড়িগুলোকে পাঁচ ডলার করে দিতে হল। ট্রাক আর জুড়িগাড়িগুলো দশ ডলারের কমে ছাড়লে না। মোটরগুলো দশ ডলার করে নিলে আর মালবোঝাই জুড়ি ঘোড়ার ট্রাকগুলো কুড়ি ডলার করে আদায় করলে। সবচেয়ে ঘা দিয়েছে পুলিশে, পঞ্চাশ ডলার করে দু’জনকে দিতে হল আর দু’জনকে পঁচিশ আর কুড়ি। কিন্তু কি চমৎকার হয়েছিল বলুন দেখি। ভাগ্যে উইলিয়াম এ ব্ৰাডি সেখানে হাজির ছিল না, নইলে হিংসেতেই বুকে ফেটে বেচারা মারা যেত। তবু একবারও মহলা দেয়া হয়নি। বলব কি, দু’ঘণ্টার মধ্যে একটা পিঁপড়ে সেখান থেকে বেরুতে পারেনি।’

চেক কাটিয়া অ্যান্টনী বলিলেন—‘তেরশ’—এই নাও কেলী। তোমার হাজার আর তিনশ’ যা তুমি খরচ করেছ। কেলী, তুমি টাকাকে ঘেন্না কর না তো?’

কেলী বলিল—‘আমি? যে লোক দারিদ্রের আবিষ্কার করেছে আমি তাকে জুতাপেটা করতে পারি।’

কেলী দরজা পর্যন্ত যাইলে রক্ওয়াল তাহাকে ডাকিলেন—‘আচ্ছা কেলী, সে সময় একটা নাদুসনুদুস গোছের ন্যাংটো ছেলেকে ধনুক নিয়ে তীর ছুঁড়তে দেখেছিলে কি?’

কেলী মাথা চুলকাইয়া বলিল—‘কই না উহুঁ। ন্যাংটো? তবে বোধ হয় আমি পৌঁছবার আগেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল।’

হাস্য করিয়া অ্যান্টনী বলিলেন—‘আমি জানতাম সে ছোঁড়া সেদিকে ঘেঁষবে না। আচ্ছা—গুড বাই কেলী।

প্র, মাঘ ১৩৪০

O. Henry-র গল্পের অনুবাদ।

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন