বেড়ালের ডাক

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

বেড়ালের ডাক

রাত্রি তখন একটা কি দু’টা হইবে। ইজিচেয়ারে শুইয়া বোধ হয় তন্দ্রা আসিয়া পড়িয়াছিল। কেরাসিনের ল্যাম্পটা ঠিক মাথার শিয়রে সতেজে জ্বলিতেছিল। এমন সময় স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে চমকিয়া জাগিয়া উঠিলাম;—‘ওগো, দূর করে দাওনা আপদটাকে। আবার ডাকছে।’

ঠিক যে বিছানার উপর খোকা জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান অচৈতন্য হইয়া পড়িয়াছিল তাহার মাথার দিকের বদ্ধ জানালার ওপারে বসিয়া বিড়ালটা ডাকিতেছিল। ডাকটা ঠিক স্বাভাবিক বিড়ালের মতোই। কিন্তু তাহার মধ্যে যেন একটা বিরস পরিশ্রান্ত কান্নার রেশ ছিল। সেই ক্ষিন্ন পীড়িত কান্নার সুরটা একেবারে বুকের মধ্যে গিয়া লাগে এবং মনে হয় এটা শুভ নয়।

জানালা খুলিয়া তাড়া দিতেই বিড়ালটা লাফাইয়া সরিয়া গিয়া অন্ধকারে মিশাইয়া গেল।

মফস্বলের ছোট শহর—চাকরি উপলক্ষ্যে বদলি হইয়া প্রায় বছরখানেক হইল এই বাড়িটায় আমি বাস করিতেছি। কিন্তু বিড়ালের উপদ্রব এতদিন ছিল না। মাসখানেক পূর্বে হঠাৎ কোথা হইতে একটি শীর্ণ মড়াখেকো বিড়াল আসিয়া জুটিল। তাহার গায়ের রং নোংরা পাঁশুটে এবং মাঝে মাঝে লোম উঠিয়া গিয়া অত্যন্ত কদাকার মূর্তি ধারণ করিয়াছে। তাহার উপর ঐ ডাক!—ঠিক যেন মূর্তিমান অমঙ্গল আমাদের বাড়ির চারিপাশে প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিতে লাগিল।

প্রথম দিনই স্ত্রী বলিলেন, ‘বেড়ালের কান্না—ভারি অলক্ষণ। আমার অজু-বিজয় ভাল থাকলে হয়।’

শব্দটা আমাকেও কোথায় যেন আঘাত করিয়াছিল। কিন্তু স্ত্রীলোকে যাহা সহজে স্বীকার করে আমরা তাহা করি না, তাই বলিলাম, তুমিও যেমন—’

তারপর প্রত্যহ এইরূপ চলিতে লাগিল। দিন পাঁচ-ছয় পরে স্ত্রী আবার সশব্দে বলিলেন, ‘ওগো, আমার ভারি ভয় কচ্চে। বাড়িতে রোজ রোজ এরকম বেড়াল কান্না ভাল নয়। তাড়ালেও তো যায় না। তুমি লক্ষ্মীছাড়া জন্তুটাকে গুলি করে মেরে ফেল।’

ইতস্তত করিতে লাগিলাম। শুধু কাঁদিয়া বেড়ানোর অপরাধে একটা জীবকে মারিয়া ফেলিতে হাত উঠে না। কিন্তু কি উপায়ে যে তাহাকে বাড়িছাড়া করিব তাহাও বুঝিতে পারিলাম না। বামুন ঠাকুরকে ধরিতে আদেশ করিলাম। ফলে বামুন ঠাকুর দুই ঘণ্টাকাল একটা ধামা লইয়া তাহাকে তাড়া করিয়া বেড়াইল। রুগ্ন বলিয়া বিড়ালটার পালাইবার ক্ষমতা কম নয়। সে ধরা দিল না।

তখন বাড়িতে জারি করিয়া দিলাম—যে বিড়াল ধরিতে পারিবে তাহাকে একটাকা বকশিশ দিব। বাড়িসুদ্ধ চাকরবাকর উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেল। এমন কি আমার বড় ছেলে অজয়—তাহার বয়স আট বৎসর—সে পর্যন্ত তাহাকে ধরিবার জন্য নানাপ্রকার ফন্দি-ফিকির আঁটিতে লাগিল। কিন্তু আশ্চর্য ধূর্ত ওই বিড়ালটা। সকলের ষড়যন্ত্র অবহেলে ব্যর্থ করিয়া দিয়া সে বাড়ি প্রদক্ষিণ করিয়া বেড়াইতে লাগিল। এবং তাহার কান্নার সুর যতই মর্মভেদী হোক না কেন, সে যে আমাদের মিলিত প্রয়াস বিফল করিয়া দিয়া বেশ আমোদ উপভোগ করিতেছে তাহা বুঝিতে পারিয়া আমাদের উত্তেজনা আরও বাড়িয়া গেল।

এক এক সময় তাহার নির্জীব ক্ষুধাক্লিষ্ট নিতান্ত শ্রীহীন চেহারাটা দূর হইতে দেখিয়া ভাবিতাম—কি চায় ও? কিসের জন্য এই অতৃপ্ত বুভুক্ষিত রোদন? এ পর্যন্ত একদিনও সে রান্নাঘরে পদার্পণ করে নাই এবং খাদ্যের প্রলোভনে তাহাকে ধরিবার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়াছে। তবে কেন—? কিন্তু তখনও জানিতে পারি নাই কি বিরাট ক্ষুধা লইয়া সে আমার বাড়িতে দেখা দিয়াছিল।

একদিন সন্ধ্যাবেলা চাকর ছেলেদের লইয়া বেড়াইতে গিয়াছিল, ছোট ছেলে বিজয় এক গা কাদা মাখিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ফিরিয়া আসিল। চাকর অপরাধ-কুণ্ঠিত কণ্ঠে জানাইল যে রাস্তার পুলের উপর খেলা করিতে করিতে খোকাবাবু হঠাৎ নীচে পড়িয়া গিয়াছেন; তবে শরীরে আঘাত লাগে নাই—কাদার মধ্যে পড়িয়াছিলেন এই ভাগ্য। ভাগ্যের কথা শুনিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল। কারণ সেই পুলটার নীচে দিয়াই শহরের গলিত দুর্গন্ধ নালা গিয়াছে। বিজয় তাহারি কাদার মধ্যে পড়িয়া গিয়াছিল।

পরদিন একটু জ্বর এবং দিন-তিনেকের মধ্যে টাইফয়েড রোগের কোনও লক্ষণই অপ্রকাশ রহিল না। স্ত্রী অশ্রুপূর্ণ চক্ষে আমার পানে তাকাইলেন—বুঝিলাম তিনি সেই অপয়া বিড়ালটার কথা ভাবিতেছেন।

ভাবনার বস্তুটি তখন দ্বিগুণ উৎসাহে বাড়িময় কাঁদিয়া বেড়াইতেছিল।

যে রাত্রির কথা লইয়া আরম্ভ করিয়াছি সে রাত্রি কাটিল। কাটিবে বলিয়া আশা করি নাই কিন্তু সত্যই যখন কাটিল তখন আমি হাত-মুখ ধুইয়া নীচে নামিয়া গেলাম। ডাক্তার ডাকিতে পাঠাইয়া এবং তাড়াতাড়ি এক পেয়ালা চা গলাধঃকরণ করিয়া রোগীর ঘরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি, ছেলেটা আরও বেশী ছটফট করিতেছে। জ্ঞান আছে কিনা বুঝিতে পারিলাম না। মাঝে মাঝে চিৎকার করিয়া উঠিতেছে। আমি ঘরে প্রবেশ করিবামাত্র সে তাহার মার গলাটা সজোরে জড়াইয়া ধরিয়া নিজেকে বাহুর জোরে তাহার বুকের কাছে টানিয়া আনিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ‘মা, ওই বেড়াল! আমি যাব না।’

স্ত্রী দু’হাতে ছেলেকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, কিন্তু তখনি আবার দাঁত দিয়া ঠোঁট চাপিয়া কান্না নিরোধ করিলেন। সেই মুহূর্তে নীচে হইতে বিড়ালের ডাক শোনা গেল।

আমি আর সেখানে দাঁড়াইলাম না—দাঁতে দাঁত চাপিয়া নিজের ঘরে গিয়া বন্দুকটা তুলিয়া লইলাম। টোটা ভরিয়া ভিতরের বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলাম।

শীতের সকাল। রোদ উঠিয়াছে কিন্তু কুয়াশা সম্পূর্ণ দূর হয় নাই। মস্ত উঠানের অন্য প্রান্তে একটা অনুচ্চ বাঁশের মাচা ছিল—পুঁইডাঁটা এবং আরও কি কি লতা দিয়া মাচাটা আগাগোড়া ঢাকা। তাহারি উপর বসিয়া জন্তুটা আরামে অঙ্গ লেহন করিতেছিল। বন্দুক তুলিয়াই ফায়ার করিলাম। বোধ হয় অত্যধিক উত্তেজনায় হাত কাঁপিয়া গিয়াছিল—বিড়ালটা লাফাইয়া অদৃশ্য হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাচার অপর পারে একটা গুরুভার পতনের শব্দ হইল।

বন্দুক সেইখানে ফেলিয়া দ্রুত নীচে নামিয়া গেলাম। দেখি, আমার বড় ছেলে অজয় মাচার পাশে পড়িয়া আছে। বন্দুকের গুলিটা ঠিক তাহার রগের ভিতর দিয়া মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়াছে। দেহে প্রাণ নাই—মরিবার পূর্বে একটা ক্ষুদ্র কাতরোক্তি করিবারও সে অবসর পায় নাই। একটা ছোট চুপড়ি তাহার হাতের কাছে পড়িয়া আছে।

তারপর আর কি? ছোট ছেলে বিজয় বাঁচিয়া উঠিয়াছে। চিকিৎসা বা সেবার গুণে নয়—তাহার পরমায়ু ছিল বলিয়া।

যে বিড়ালটাকে ক্ষুধিত অবস্থায় হাজার চেষ্টা করিয়াও তাড়াইতে পারি নাই আজ ক্ষুধার অবসানে সে আপনিই চলিয়া গিয়াছে।

১৯২১

সকল অধ্যায়

১. প্রেতপুরী
২. বিজ্ঞাপন বিভ্ৰাট
৩. উড়ো মেঘ
৪. বেড়ালের ডাক
৫. প্লেগ
৬. রূপসী
৭. কবি-প্রিয়া
৮. রক্ত-খদ্যোত
৯. টিকটিকির ডিম
১০. দৈবাৎ
১১. অন্ধকারে
১২. বিজয়ী
১৩. করুণাময়ী
১৪. দুই দিক
১৫. শীলা-সোমেশ
১৬. কুলপ্রদীপ
১৭. মরণ-ভোমরা
১৮. ইতর-ভদ্র
১৯. রূপকথা
২০. কর্তার কীর্তি
২১. কালকূট
২২. অশরীরী
২৩. ব্রজলাট
২৪. সন্ধি-বিগ্রহ
২৫. উল্কার আলো
২৬. অরণ্যে
২৭. মেথুশীলা
২৮. মনে মনে
২৯. সবুজ চশমা
৩০. নারীর মূল্য
৩১. আলোর নেশা
৩২. বহুবিঘ্নানি
৩৩. ট্রেনে আধঘণ্টা
৩৪. গ্রন্থকার
৩৫. কুবের ও কন্দর্প
৩৬. মরণ দোল
৩৭. অমরবৃন্দ
৩৮. আঙটি
৩৯. তিমিঙ্গিল
৪০. ভেনডেটা
৪১. ভল্লু সর্দার
৪২. বিদ্রোহী
৪৩. স্বখাত সলিল
৪৪. অভিজ্ঞান
৪৫. জটিল ব্যাপার
৪৬. আদিম নৃত্য
৪৭. একূল ওকূল
৪৮. প্রতিদ্বন্দ্বী
৪৯. কেতুর পুচ্ছ
৫০. শালীবাহন
৫১. বরলাভ
৫২. প্রেমের কথা
৫৩. ভালবাসা লিমিটেড
৫৪. মায়ামৃগ
৫৫. সন্দেহজনক ব্যাপার
৫৬. তন্দ্রাহরণ
৫৭. বহুরূপী
৫৮. হাসি-কান্না
৫৯. প্রণয় কলহ
৬০. ধীরে রজনি!
৬১. ন্যুডিসম-এর গোড়ার কথা
৬২. শুক্লা একাদশী
৬৩. মন্দ লোক
৬৪. দন্তরুচি
৬৫. প্রেমিক
৬৬. স্বর্গের বিচার
৬৭. মায়া কানন
৬৮. প্রতিধ্বনি
৬৯. অযাত্রা
৭০. কুতুব-শীর্ষে
৭১. টুথব্রাশ
৭২. নাইট ক্লাব
৭৩. নিশীথে
৭৪. রোমান্স
৭৫. যস্মিন দেশে
৭৬. পিছু ডাক
৭৭. গোপন কথা
৭৮. অপরিচিতা
৭৯. ঘড়ি
৮০. গ্যাঁড়া
৮১. মাৎসন্যায়
৮২. লম্পট
৮৩. আরব সাগরের রসিকতা
৮৪. এপিঠ ওপিঠ
৮৫. ঝি
৮৬. অসমাপ্ত
৮৭. শাপে বর
৮৮. ইচ্ছাশক্তি
৮৯. পঞ্চভূত
৯০. ভাল বাসা
৯১. আধিদৈবিক
৯২. বাঘিনী
৯৩. ভূতোর চন্দ্রবিন্দু
৯৪. সেকালিনী
৯৫. দিগদর্শন
৯৬. মুখোস
৯৭. আণবিক বোমা
৯৮. স্মর-গরল
৯৯. ছুরি
১০০. আকাশবাণী
১০১. নিষ্পত্তি
১০২. শাদা পৃথিবী
১০৩. ভাগ্যবন্ত
১০৪. মেঘদূত
১০৫. পরীক্ষা
১০৬. বালখিল্য
১০৭. পূর্ণিমা
১০৮. নূতন মানুষ
১০৯. স্বাধীনতার রস
১১০. ও কুমারী
১১১. যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ
১১২. ধীরেন ঘোষের বিবাহ
১১৩. দেহান্তর
১১৪. ভূত-ভবিষ্যৎ
১১৫. ভক্তিভাজন
১১৬. গ্রন্থি-রহস্য
১১৭. জোড় বিজোড়
১১৮. নিরুত্তর
১১৯. অলৌকিক
১২০. সন্ন্যাস
১২১. তা তা থৈ থৈ
১২২. আদায় কাঁচকলায়
১২৩. বনমানুষ
১২৪. বড় ঘরের কথা
১২৫. শ্রেষ্ঠ বিসর্জন
১২৬. অষ্টমে মঙ্গল
১২৭. কল্পনা
১২৮. তাই নে রে মন তাই নে
১২৯. কানু কহে রাই
১৩০. চরিত্র
১৩১. দেখা হবে
১৩২. গীতা
১৩৩. গুহা
১৩৪. শরণার্থী
১৩৫. শূন্য শুধু শূন্য নয়
১৩৬. মধু-মালতী
১৩৭. চিরঞ্জীব
১৩৮. মায়া কুরঙ্গী
১৩৯. ঘড়িদাসের গুপ্তকথা
১৪০. সতী
১৪১. অপদার্থ
১৪২. এমন দিনে
১৪৩. কালো মোরগ
১৪৪. নখদর্পণ
১৪৫. সাক্ষী
১৪৬. হেমনলিনী
১৪৭. পতিতার পত্র
১৪৮. সেই আমি
১৪৯. মানবী
১৫০. প্রিয় চরিত্র
১৫১. স্ত্রী-ভাগ্য
১৫২. সুত-মিত-রমণী
১৫৩. কা তব কান্তা
১৫৪. প্রত্নকেতকী
১৫৫. সুন্দরী ঝর্ণা
১৫৬. চিড়িকদাস
১৫৭. চিন্ময়ের চাকরি
১৫৮. মুষ্টিযোগ
১৫৯. ছোট কর্তা
১৬০. মালকোষ
১৬১. গোদাবরী
১৬২. ফকির-বাবা
১৬৩. অবিকল
১৬৪. কিসের লজ্জা
১৬৫. বোম্বাইকা ডাকু
১৬৬. চলচ্চিত্র প্রবেশিকা
১৬৭. আর একটু হলেই
১৬৮. কিষ্টোলাল
১৬৯. পিছু পিছু চলে
১৭০. কামিনী
১৭১. জননান্তর সৌহৃদানি
১৭২. হৃৎকম্প
১৭৩. পলাতক
১৭৪. ভাই ভাই
১৭৫. প্রেম
১৭৬. রমণীর মন
১৭৭. মটর মাস্টারের কৃতজ্ঞতা
১৭৮. বুড়ো বুড়ি দুজনাতে
১৭৯. কালস্রোত
১৮০. অমাবস্যা
১৮১. বক্কেশ্বরী
১৮২. নীলকর
১৮৩. ডিকটেটর
১৮৪. গল্প-পরিচয় – শোভন বসু

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন