অর্পিতা সরকার
কী গো আজকেও কী তোমার লেট হবে? কখন আসবে ওই ঘরে? আমার একা একা ভালো লাগছে না যে। অফিস থেকে ফিরে আবার পড়েছ লেখালিখি নিয়ে। আমি তাহলে কী করব সারাদিন? আদুরে গলায় কথাটা বলল, স্বাগতমা। মাত্র মাস আষ্টেক বিয়ে হয়েছে ওদের। রিতেশের সঙ্গে মানালি হানিমুনে গিয়েছিল স্বাগতমা। ওখানে গিয়েও এই এক সমস্যা। অবসর পেলেই রিতেশ লিখতে শুরু করে। ওদের অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ। সত্যি বলতে কী স্বাগতমা যখন শুনেছিল, রিতেশ চ্যাটার্জীর সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে ওর বড় পিসি তখন একটু হলেও গর্বিত হয়েছিল ও। রিতেশ আইটি সেক্টরের বড় পোস্টে আছে। কিন্তু এটুকু পরিচয় ওর জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। রিতেশ চ্যাটার্জী এই মুহূর্তের একজন শক্তিশালী কলম। রিতেশের বয়েস বত্রিশ বছর হলে কী হবে ওর লেখনীকে সম্মান জানাচ্ছেন অনেক নামী সাহিত্যিকরাও। বেশ কয়েকটা বইও প্রকাশিত হয়েছে ওর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশ পায় ওর লেখা। সাহিত্যসভা থেকে ডাকও আসে। মোটকথা রিতেশ রীতিমতো ব্যস্ত থাকে সারাদিন।
বাড়িতে দুজন পরিচারিকা থাকায় স্বাগতমার কাজও বলতে গেলে কিছুই নেই। এই ফ্ল্যাটটা রিতেশ কিনেছিল বিয়ের বছর খানেক আগেই। স্বাগতমা বিয়ে হয়ে এসে মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে ওদের দুজনের ছোট্ট সংসারটাকে। রিতেশের বাবা নেই। মা থাকেন ওর বড়দার বাড়িতে। মোটের ওপরে এই ছয়তলার ওপরের ফ্ল্যাটের ঘরে বলতে গেলে স্বাগতমা একাই। ফোনে নিজের বাবা,মায়ের সঙ্গে টুকিটাকি গল্প করা। আর পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গে ফোনে আড্ডা দেওয়া ছাড়া কাজ তেমন কিছুই নেই। একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াতো স্বাগতমা বিয়ের আগে। বিয়ের পরে রিতেশ হাসি মুখেই বলেছিল, আমি অফিসে যাব আর তুমি স্কুলে…সারাদিন পরে দুজনে বাড়ি ফিরে ক্লান্ত হয়ে যাব, তাহলে প্রেমটা কখন করব আমরা?
রিতেশের যা ইনকাম তাতে স্বাগতমার চাকরি করার প্রয়োজনও তেমন নেই। তাছাড়া স্কুলটা ওদের এই ফ্ল্যাট থেকে বাসে প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। কেউ ওকে ঠিক জোর করেনি, তবে রিতেশের অপছন্দ বলেই স্কুলের চাকটিটা ছেড়ে দিয়েছিল স্বাগতমা।
প্রথম তিনমাস আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে, বন্ধুরা ওদের ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করে বেশ কাটছিল সময়টা, হইহুল্লোড় করে। তাছাড়া রিতেশের আদরে ওষ্ঠাগত হতে হতে স্বপ্নরাজ্যেই বিচরণ করছিল স্বাগতমা। কলেজের ফ্রেন্ডরা অনেকেই সাহিত্যিক রিতেশ চ্যাটার্জীর সিগনেচার চায়, তাই মিডিলম্যানের কাজ করতে বেশ গর্ববোধ করছিল স্বাগতমা। সত্যি বলতে কি স্বামী গর্বে গরবিনি ও। শুধু যে ও রিতেশকে নিয়ে গর্ব করে তা নয়, ওর বাবা-মাও যথেষ্ট খুশি রিতেশকে জামাই হিসাবে পেয়ে। আসলে মধ্যবিত্ত বাড়িতে রিতেশের মতো জামাই পাওয়া ভাগ্যের কথা।
কিন্তু ইদানীং বড্ড একা লাগছে স্বাগতমার।
এক আলমারি শাড়ি, নতুন নতুন গয়না, সাজানো ফ্ল্যাট, লাইব্রেরিতে অনেক বই, হোম-থিয়েটারে নতুন গান-তবুও বড্ড যেন একলা লাগে ওর।
মাত্র আট মাসেই হাঁপিয়ে উঠেছে ও।
কী গো আমি যে তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, শুনতে পাচ্ছো না? তুমি কী ওই ঘরে যাবে?
রিতেশ অন্যমনস্ক হয়ে ল্যাপটপে টাইপ করছিল।
ওর উপন্যাসের নায়িকা ইন্দ্রাণী তার প্রেমিককে বলছে… ‘আসলে কী জানো শোভন অবহেলা করাটা যেমন একটা অভ্যেস, তেমনই অবহেলা সহ্য করাটাও একটা অভ্যেস। দীর্ঘদিন ধরে নিজের গান নিয়ে আমাকে যেভাবে অবহেলা করে গেছো তুমি তাতে আমিও অভ্যেস করে ফেলেছি। ইদানীং আর কষ্ট হয় না জানো। বরং আমার প্রতি তোমার বেশি আগ্রহ দেখলেই অস্বাভাবিক মনে হয়। আসলে আমরা বলি বটে অনন্ত অপেক্ষা, কিন্তু অপেক্ষারও একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে। সেই সীমা অতিক্রম করলে অপেক্ষাও ক্লান্ত হয়ে বিদায় নেয়। তখন কী পড়ে থাকে জানো? একটা হাড়কঙ্কাল বেরোনো অস্থি সর্বস্ব সম্পর্কের ধ্বংসাবশেষ। ওই ধ্বংসাবশেষে পুনরায় আবেগ, অনুভূতি, আদর পর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষণ করলেও তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কিছুতেই জীবন্ত হয়ে ওঠে না ওই মৃত সম্পর্কটা।’
উফ, কেন বিরক্ত করছ তমা? তুমি না বুঝলে আর কে বুঝবে আমায়? বড় পাবলিকেশন থেকে বইটা আসছে। সারাদিন অফিস করে এইটুকু সময় যদি আমি না লিখি তাহলে কী করে কমপ্লিট করব বলো? তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো সোনা। আমি আরেকটু লিখে চলে যাব। রাগ করে না, সোনা মেয়ে।
স্বাগতমার কষ্ট হচ্ছে। বুকের বাম দিকে একটা অজানা চিনচিনে ব্যথা উঁকি দিচ্ছে। নীলচে অপমানবোধ ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে ওর নরম মনটাকে। সেই কলেজের স্বতঃস্ফূর্ত মেয়েটাকে নিজের ঘরের বেলজিয়াম গ্লাসে আরেকবার দেখার চেষ্টা করল স্বাগতমা।
না, এই কমাসেই সেই চনমনে ভাবটা বিতাড়িত ওর চোখ মুখ থেকে। সেই বাঁধন ছাড়া কুমারীর বেণীর মতো উচ্ছলতাও নেই ওর ঠোঁটের কোণে। বরং একটু যেন কষ্ট উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কিসের কষ্ট ওর? ওর তো সব আছে। রুচিশীল, দায়িত্ববান সুদর্শন স্বামী, নামী কমপ্লেক্সে সাজানো ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, নিজেও যথেষ্ট সুন্দরী। ইদানীং গাড়ি ছাড়া পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ওঠাই ছেড়ে দিয়েছে ও। রিতেশ বলেছে, মাথা খারাপ নাকি তোমার? আরে তুমি সাহিত্যিক রিতেশ চ্যাটার্জীর স্ত্রী। তুমি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গেলে আমার সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে যে। গাড়ি করেই এক্সপেন্সিভ শপিংমলে যায় ও শপিং করতে। দামি স্পাতে গিয়ে আরও নজরকাড়া করে ফেলে নিজেকে। রিতেশের মুগ্ধ দৃষ্টিতে বারংবার হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এত সুখ ঐশ্বর্যের মাঝেও কেন যে বারংবার মনে হয় নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে! প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছে স্বাগতমা কিছু যেন একটা হারিয়ে ফেলেছে ও। কী হারিয়ে ফেলেছে সেটাই অনবরত খুঁজে চলছে। কিছুতেই হদিস পাচ্ছে না তার।
মুখে নাইটক্রিম মাখলো যত্ন করে, নাইট স্যুট পরে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিল ও। সারাদিন কোনো পরিশ্রম নেই বলেই হয়তো ক্লান্তি নেই চোখের পাতায়। আগে বিছানায় শুলেই চোখ দুটো জুড়িয়ে যেত ওর। কিন্তু এখন তার বিপরীত। তাই রীতিমতো সাধনা করতে হবে ঘুমের জন্য বুঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুব দিলো। কে যেন বলেছিল, গরিবি আর ঘুম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আর বড়লোকদেরই নাকি ইনসমনিয়া হয়। কে জানে স্বাগতমা কী শেষে ধনী হয়ে গেল নাকি!
ফেসবুক খুলল ও, এই এক অদ্ভুত জগৎ। ঠিক যেন রাতের ঝকঝকে তিলোত্তমা।
সকলের মুখে হাসি। রঙিন, সুন্দর পোশাক পরে সকলে খুশি মুখে ছবি পোস্ট করেছে। ফেসবুকের ডিপি দেখলে মনেহয় দুঃখ নামক কোনো বস্তুই নেই এই পৃথিবীতে। যদিবা কেউ দু-চারলাইন যন্ত্রণার কথা লিখে পোস্ট করেছে, তারাও নীচে ব্রাকেটে লিখে দিয়েছে— শুধুই কবিতা ভাবুন। আমার জীবনের সঙ্গে রিলেট করতে যাবেন না।
সকলে যেন দুঃখ কষ্ট ঢাকতে ব্যস্ত।
একটা হালকা খুশির জগৎ। স্ক্রল করতে করতেই চোখে পড়ল, অনুভা আর ওর হাজবেন্ডের হাসি মুখের ছবি। অনুভা লিখেছে, ‘তিনটে বছর আমায় সহ্য করে নিলে আরও ত্রিশ বছর সহ্য করতে হবে আমার পাগলামি।’
কমেন্টে অনেকেই লিখেছে— হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।
নাইস জড়ি।
ধুর, অনুভা ওর স্কুলের বেস্টফ্রেন্ড ছিল। তাকে কমেন্ট বক্সে উইশ করাটা বড্ড দৃষ্টিকটু দেখায়। মেসেঞ্জারে গিয়ে পিং করল স্বাগতমা।
কী রে কেমন আছিস? একটু মুটিয়েছিস মনে হচ্ছে প্রশান্তদার আদরে আদরে। হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।
অনুভা লিখল, আমাকে একটা মেসের অ্যাড্রেস দিতে পারবি রে, লেডিস মেস। খুব দরকার রে।
একটু হকচকিয়ে গিয়েই স্বাগতমা বলল, লেডিস মেস কী হবে… কার জন্য?
অনুভা লিখল, ধরে নে আমার জন্যই। খোঁজ থাকলে প্লিজ জানাস। অবহেলা মেনে নেবারও একটা লিমিট আছে, আর পারছি না।
স্বাগতমা আর লিখল না, কেন রে এই যে তুই সন্ধেবেলা হ্যাপি কাপলের ছবি পোস্ট করেছিস, তাহলে আচমকা একলা হতে চাইছিস কেন?
লেখা হলো না কিছুই। কারোর যন্ত্রণার জায়গায় আঘাত করতে বড় কষ্ট হয় ওর। তাই লিখল, খোঁজ পেলে জানাব। সাবধানে থাকিস।
কলেজের বন্ধু মানসকে অনলাইন দেখে পিং করল স্বাগতমা। মানস ওর নতুন বাড়ির গৃহ প্রবেশের অনেক ছবি লোড করে লিখেছে— স্বপ্নপূরণ হল।
কী রে, নতুন বাড়ি করলি আর আমাদের নিমন্ত্রণ করলি না?
মানস লিখল, আসবি? চলে আয়। এক পেগ খেয়ে যা আমার সঙ্গে। তোর পছন্দ হয়েছে আমার বাড়ি?
স্বাগতমা লিখল, ভীষণ সুন্দর হয়েছে রে।
না রে পারলাম কই। রনিতার পছন্দ হলো না জানিস। এত পরিশ্রমের পরে বাড়িতে পা দিয়েই বলল, যেমন রুচি তেমনি পছন্দ। আসলে অটোচালকের ছেলে তো। তাই আমার রুচিটাই নাকি উন্নত হয়নি। রনিতার পছন্দ হল না। সন্তুষ্ট করতে পারলাম না জানিস।
ঝকঝকে ফেসবুকের উইন্ডোটা অফ করে দিল স্বাগতমা।
নীল নাইট ল্যাম্পের আলোয় নিজের মনের গভীরে ডুব দিল ও। আজ খুঁজে বের করতেই হবে ওর হারিয়ে যাওয়া জিনিসটাকে।
রিতেশ এসে মাথায় হাত রাখল। কী গো ঘুমিয়ে গেলে?
স্বাগতমা বলল, না ঘুমাইনি খুঁজে চলেছি। জানো কদিন ধরে আমার সবসময় মনে হচ্ছে আমি কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি। কী যে হারিয়েছি সেটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
রিতেশ শান্তভাবে বলল, তোমার কিছু লাগবে কী? আমাকে বলতে দ্বিধা করো না প্লিজ। আমার একটা কার্ড তোমার কাছে রেখে যাব। যেটা ইচ্ছে হবে কিনে নিও। হারিয়ে গেছে বলে অত মনখারাপ করার কিছু নেই। চলো ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কাল ভোরে উঠে আমায় উপন্যাসের শেষটুকু লিখতেই হবে। এমনিতেই প্রকাশনার তরফ থেকে বার দুয়েক তাগাদা দিয়েছে।
গভীর চিন্তায় মগ্ন রিতেশ। বোধহয় উপন্যাসের সমাপ্তিতে কী চমক দেবে এটাই ভাবছে।
স্বাগতমা গলা জড়িয়ে ধরে বলল, এই রিতেশ আমায় নিয়ে একটা গল্প লিখবে? আমি তোমার গল্পের নায়িকা হতে চাই। রিতেশ স্বাগতমার ঠোঁটে ঠোঁটটা ডুবিয়ে বলল, পাগলি…তোমার জীবনে বৈচিত্র কী আছে যে তোমায় নিয়ে গল্প হবে?
তমা, আমার গল্পের নায়িকারা সাধারণ নয় মোটেই। সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করল, হাজবেন্ডের টাকায় শপিং করতে গেল, পার্লারে গিয়ে নিখুঁত করে সাজগোজ করলো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিলো আবার রাতে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ল, এমন বৈচিত্রহীন জীবনের গল্প আমি লিখি না। আমার গল্পের নায়িকারা প্রতিবাদী হয়, তারা স্বাধীনতা প্রিয়, নিজেদের ইচ্ছানুসারে অতিবাহিত করে তাদের জীবন। মোটকথা একটা স্ট্রাগল থাকে তাদের জীবনে। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে যেকোনো ভাবে। স্বাগতমা হেসে বলল, আমি তোমার গল্পের নায়িকা হবারও যোগ্য নই তাই না গো? শুধুই তোমার গর্বে গরবিনি স্ত্রী হবার যোগ্য, তাই না?
রিতেশ নিজের বুকের মধ্যে ওকে টেনে নিয়ে বলল, তোমার কী কিছুর অভাব আছে যে তুমি আচমকা এমন ভ্রাম্যমাণ জীবন খুঁজবে?
স্বাগতমা উত্তেজিত গলায় বলল, ইউরেকা। আমি খুঁজে পেয়ে গেছি আমার হারিয়ে যাওয়া জিনিসটাকে। থ্যাংক ইউ রিতেশ।
রিতেশ কিছুই না বুঝে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই রিতেশ দেখল স্বাগতমা বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আড়মোড়া ভেঙে রিতেশ বলল, কী গো আজও বাপের বাড়ি যাবে নাকি? তোমার কী আমার জন্য এতটুকু মনখারাপ করে না? শুধু বাবা-মায়ের জন্যই করে।
আজ অফিস ছুটি নিয়েছি। উপন্যাসটা দুর্দান্তভাবে শেষ করতে হবে বুঝলে? তুমি কী আজ ওবাড়িতেই থাকবে নাকি রাতে ফিরবে?
স্বাগতমা বেড-টির ট্রেটা নামিয়ে দিতে দিতে বলল, বাপের বাড়ি যাচ্ছি না। ফিরে আসব।
রিতেশ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, সঞ্জয়কে কল করেছ? ওকে গাড়ি বের করতে বলেছ?
স্বাগতমা কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে বলল, আজ গাড়ি করে যাব না। বড় দৃষ্টিকটু লাগবে। তাছাড়া গাড়িটা তোমার, আমার উপার্জনের অর্থে কেনা নয়।
রিতেশকে হতবাক করে দিয়ে বেরিয়ে গেল স্বাগতমা।
বিকেলের দিকে নিজের লাইব্রেরি রুমেই বসে বসে উপন্যাটা আরেকবার পড়ে নিচ্ছিলো রিতেশ। ছোটখাটো ভুলও যেন চোখ এড়িয়ে না যায় সে চেষ্টাই করছে।
রিতেশের অফিস কলিগ বিবেক কল করছে দেখে ফোনটা রিসিভ করল ও।
বিবেক উত্তেজিত হয়ে বলল, টিভি খুলে দেখো রিতেশ। তোমার ওয়াইফ বাইট দিচ্ছে।
হতবাক হয়ে গেল রিতেশ। তমা টিভি চ্যানেলে কী করছে?
তমার মতো অতি শান্ত, আদুরে মেয়ে আচমকা টিভি চ্যানেলে কী করছে? তবে কী দিদি নম্বর ওয়ান নাকি সব অনুষ্ঠান হয় ওতে অডিশন দিয়েছিল?
ড্রয়িংরুমে ঢুকেই টিভিটা চালাল। প্রায় গোটা তিনেক চ্যানেলে দেখাচ্ছে তমাকে। কপালটা কেটে গেছে সম্ভবত। রক্ত বেরোচ্ছে।
‘আমিও একজন SSC প্রার্থী। পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি দীর্ঘদিন। একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াতাম আগে। কদিন আগেই আমরা মেসেজ পাই। যুব অধিকার মঞ্চ থেকে। আমরা ৮ই ও ৯ই ভারত বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। সমস্ত বেকার যুবক-যুবতীরা শামিল হবে এই আন্দোলনে। আজ আমাদের এই প্রতিবাদ মিছিলের ওপরেই পুলিশ লাঠিচার্জ করে। কিন্তু এত এত মানুষ বেকারত্বের জ্বালায় জ্বলছে। তাই এ লড়াই চলবে। নিয়োগ হোক শূন্যপদে। SSC পরীক্ষার্থীরা অনেক আন্দোলনের পর বুঝেছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। তাই আমাদের এ প্রতিবাদ মিছিলকে এত সহজে ভেঙে ফেলা যাবে না।’
দৃপ্ত কণ্ঠস্বর, সাহসী বক্তব্য- এ কোন স্বাগতমাকে দেখছে রিতেশ!
প্রাইভেট স্কুলের চাকরিটা যখন ছেড়েছিল তমা তখনই বলেছিল, SSC-তে কিন্তু আমার রিটেন পাশ হয়ে আছে। ওটা পেলে ছাড়ব না কিছুতেই। শিক্ষিকা হওয়া আমার জীবনের প্যাশন। রিতেশ ভেবেছিল, কিছুদিন পরে এই চাকরির ভূত এমনিই নেমে যাবে তমার। সুখে থাকতে থাকতে বাসে ট্রেনে ডেলিপ্যাসেঞ্জারির কথা কল্পনাই করতে পারবে না তমা।
ঘণ্টাখানেক পরে বাড়ি ফিরল স্বাগতমা। কপালে দুটো ব্যান্ডেড লাগানো রয়েছে।
ব্যাগটা রেখে ওয়াশরুমে ঢুকল ও।
রিতেশ অপেক্ষা করছিল। বাইরে বেরোতেই বিরক্তির স্বরে বললো, লোক না হাসালেই চলছিল না তোমার? কিসের অভাব তোমার তমা? আমার স্ত্রী চাকরির জন্য রাস্তায় ধর্মঘট করছে! কলিগরা কল করে বলছে আমায়। আমার সম্মানটুকুর কথা যদি একটু খেয়াল করতে তমা!
বললে না তো, কিসের অভাব তোমার?
স্বাগতমা হিমশীতল গলায় বলল, পরিচয়ের অভাব। শুধু সাহিত্যিক রিতেশ চ্যাটার্জীর স্ত্রী নয়, শুধু সিনিয়র ম্যানেজার রিতেশ চ্যাটার্জীর বেটারহাফ নয়, আমার নিজের পরিচয়ের অভাব অনুভব করছিলাম আমি। তাই মধ্যবিত্ত একটা বাড়ির মেয়ে হয়ে যখন এক্সামে বসেছিলাম, সেই চাকরিটা যাতে পাই সেই চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম।
রিতেশ বিরক্ত হয়ে বললো, কিন্তু আমি তো তোমায় সবরকম স্বাধীনতা দিয়েছিলাম তমা।
স্বাগতমা মুচকি হেসে বললো, ধুর পাগল তুমি আমায় স্বাধীনতা দেবার কে? ওটা আমি নিয়েই জন্মেছি এই স্বাধীন দেশে। তোমায় যেমন আমি স্বাধীনতা দেবার কেউ নই, তেমনি তুমিও আমারটা দিতে পারো না বা কেড়ে নিতেও পারো না।
জানো রিতেশ, আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বাসে পাঁচ টাকা খুচরো দিয়ে ঝুলতে ঝুলতে কলেজ গেছি। কলেজ ক্যান্টিনে সবাই মিলে ভাগ করে খেয়েছি দুপ্লেট ঘুগনি। বাড়ি ফিরে মায়ের আদরে আর বাবার প্রশ্রয়ে ভাসতে ভাসতে সেরেছি রাতের খাবার। ইউনিভার্সিটি, বিএড কলেজ,
ভিড় বাস, জ্যাম রাস্তা, কোলাহল, ভিড় ঠাসাঠাসি, ঘেমো গন্ধ…প্রাইভেট স্কুলের চাকরিতে মাসের শেষে ছয়হাজার টাকায় কী কী কিনবো প্ল্যান করতাম আমি আর মা। বাবার চাকরির টাকায় স্বচ্ছলভাবে সংসার চলতো কিন্তু চূড়ান্ত বিলাসিতা কাকে বলে এটা আমি দেখলাম তোমার কাছে এসে। তাই কয়েকমাসেই এই বিলাসী জীবন কাটাতে কাটাতে মনে হচ্ছিল সামথিং মিসিং। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না জানো ওই হারিয়ে ফেলা জিনিসটা।
তারপরে বুঝতে পারলাম, ঠিক সাড়ে দশটা বাজলেই ক্লাসে ঢুকে ওই ”প্রেজেন্ট ম্যাডাম” শব্দগুচ্ছটা খুঁজছিলাম আমি। টিচার্স রুমে ঢুকেলেই রুমিদি বলত, এই যে মিস স্বাগতমা ব্যানার্জী তোমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা খোঁজ করছিল তোমার। এগুলো হারিয়ে এই আটমাসে আমি হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম রিতেশ।
আমি ওই স্কুলের বড়দিকে কল করেছিলাম। উনি আমার আবার স্কুল জয়েন করতে বললেন সামনের মাস থেকেই। আর এদিকে চলুক আমাদের আন্দোলন।
রিতেশ বলল, এই সব অযৌক্তিক স্ট্রাগলের কী খুব দরকার আছে তমা?
স্বাগতমা হেসে বলল, এত বড় পোস্টে থেকেও তোমার ঠিক কী দরকার আছে রিতেশ লেখালিখি করার? রিতেশকে নিশ্চুপ দেখে স্বাগতমা বলল, তোমার নায়িকাদেরই বা কী দরকার আছে এত স্ট্রাগল করার? তারাও তো হাজবেন্ডের টাকায় আয়েশেই কাটিয়ে দিতে পারত জীবনটা, তাই না?
রিতেশকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই ঘরে ঢুকে গেল স্বাগতমা।
রিতেশ আরেকটা নতুন ছোটগল্প লিখতে শুধু করল,
”সুখের চাবিকাঠি”
স্বাগতমা তখনও বুঝতে পারেনি তার জীবনটা এত সুখের হয়েও কেন সে সুখী হতে পারছে না?
ওহ আমার পাঠকদের সঙ্গে তো এখনও পরিচয়ই করিয়ে দেওয়া হয়নি আমার গল্পের নায়িকা স্বাগতমা ব্যানার্জীর সঙ্গে। তিনি একজন নামী সাহিত্যিকের স্ত্রী…
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন