কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪১

বিমল মিত্র

বাজারের জিনিসপত্রের দাম চড়া। কাশীকে নতুন করে হাঁড়ি-কলসী-বাসন কিনতে হলো আবার। সকাল বেলাটাই যা বাজার বসে। বিকেলের বাজার উঠে গেছে। বিকেল থেকেই দোকান-পাট সব বন্ধ হয়ে যায়। তখন মিলিটারি লরী ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়। হাতে ব্রেন- গান উঁচিয়ে ধরে থাকে রাস্তার দিকে। যে কেউ সামনে আসবে তাকে গুলী করে মারবে বেপরোয়া। ছেলে-বুড়ো বাদ নেই। নতুন গাড়ি উঠেছে একরকম। সামনে লম্বা ছিপের মতন একটা লোহার শিক দাঁড় করানো। কোথাও গোলমালের খবর পাওয়া মাত্র ওয়ারলেসে খবর পাঠাবে হেড-কোয়াটার্সে। এতটুকু অসতর্ক হলেই ইন্ডিয়া বেদখল হয়ে যাবে। জাপানীরা যদি এখানে আসেই তো যেন উপোস করে মরে। চাষীদের কাছে ধান চাল যা উদ্বৃত্ত আছে সব কেড়ে নাও। মিলিটারি আর সরকারী অফিসারদের খাবার জোগাবার জন্যে এজেন্ট রাখা হয়েছে। সেই এজেন্টরাই আবার সরকারের তরফে মাল কিনবে। কিনে গুদাম বোঝাই করবে। দরকার হলে সেই মাল চালান যাবে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনে। এমন কি সোভিয়েট রাশিয়াতেও দরকার হলে চাল গম পাঠাতে হতে পারে। ইন্ডিয়া সকলকে খাওয়াবে। সকলকে খাইয়ে ইন্ডিয়ায় যদি কিছু পড়ে থাকে তো তখন খাবে ইন্ডিয়ানরা। শ’ওয়ালেস, ইস্পাহানী এন্ড কোং, মির্জা আলী আকবর, এইচ এন দত্ত এন্ড সন্স, স্টীল ব্রাদার্স-এমনি সব কত এজেন্ট। তারা বাজার থেকে ছ’ টাকা চার আনা দরে চাল কিনে মিলিটারিকে বেচে এগার টাকা দরে। ফজলুল হক সাহেব তখন পুরো দমে রাজত্ব করে চলেছে। ব্ল্যাক-আউটের তলায় তখন আর এক ব্ল্যাক-আউট চলেছে। বাজারে গিয়ে লোকে চোখে সর্ষে ফুল দেখে।

কেউ বলে—এ কি মশাই, পনেরো দিন আগে চাল নিয়ে গেছি ছ’টাকা দরে আর আজ হলো আট টাকা—?

দোকানদার হাসে। বলে—আজ আট টাকায় পাচ্ছেন, কাল হয়ত টাকা দিলেও পাবেন না—

—সে কি মশাই, চাল না পেলে খাবো কী?

—আপনার খাবার জন্যে তো গভর্নমেন্টের ভারি মাথা-ব্যথা মশাই—। আমরা থাকলেই বা কী, আর মরে গেলেই বা কী!

—কেন মশাই, আমরা ট্যাক্স দিই না? গভর্নমেন্ট কি ওমনি খাওয়াচ্ছে?

দোকানদারের আর কথা জোগায় না। খদ্দেররা বলে—এ শালা, গভর্নমেন্টের বারোটা বেজে এসেছে—

কিন্তু লোকে যাই বলুক, যার টাকা আছে তার কোনও ভাবনাই নেই। চালের দর বারো টাকাই হোক আর চার-বারোং আটচল্লিশ টাকাই হোক, তাদের কী! যত গন্ডগোল আপনার আর আমার। এই আমরা, যারা গরীব লোক। যারা হিসেব করে মাস চালাই। ইস্পাহানী সাহেবের কীসের ভাবনা? ফজলুল হক সাহেবেরই বা ভাবনা কী! এইচ এন দত্ত কোম্পানীরই বা ভাবনা কী? তারা গাড়ি চালাচ্ছে, সিনেমা দেখছে, রেস খেলছে। চাল কিনতে না-পাওয়া যায়, কেক খাবে তারা!

কাশী কথাগুলো শুনছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মনে পড়লো বাড়ির কথা। মনে পড়তেই বললে—আমাকে তাড়াতাড়ি দিয়ে দেন, আমার কাজ আছে—

—দাঁড়া না বাবা, তোরই কেবল কাজ আছে, আর আমাদের নেই?

কাশী একটু নরম হলো। বললে—আমাদের বাড়িতে কেউ নেই, দিদিমণিকে একলা রেখে এসেছি, এই এখন চাল-ডাল নিয়ে যাবো তবে রান্না চড়বে—

—কোন্ বাড়ি তোমাদের? কোথায় থাকো?

—আজ্ঞে এ স্টেশন রোডে।

এতক্ষণে সবাই চাইলে কাশীর দিকে।

—আরে তোমাদের বাড়িতেই বুঝি কালকে মিলিটারি পুলিশ এসেছিল? শুনলুম দু’জনকে ধরে নিয়ে গেছে? বোমা-টোমা সব পেয়েছে?

কাশী বললে—আমার বাবুকেও ধরে নিয়ে গেছে—বাড়িতে কেউ নেই সকাল থেকে। একলা মেয়েমানুষকে রেখে চলে এসেছি বাজার করতে—সব জিনিসপত্র ভেঙে তচ-নচ করে দিয়েছে তারা—

আরো অনেক কিছু খবর শুনতে চেয়েছিল তারা। না-পেয়ে একটু যেন হতাশ হলো। অথচ বাজারে অনেক রকম গুবজ রটে গেছে। জাপানীরা আসছে কলকাতায়। এসে পড়লো বলে। তা আসুক মশাই। জাপানী আসুক আর জার্মানীই আসুক আমাদের যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন। আমরা যে আঁধারে সেই আঁধারে।

—শুনেছেন, বিহারের কংগ্রেস মিনিস্টার জগুলাল চৌধুরী কি করেছে? সারণ জেলায় একটা পুলিসের থানা পুড়িয়ে দিয়ে থানার দারোগাকে থলের ভেতরে পুরে গন্ডকের জলে ভাসিয়ে দিয়েছে?

—আর মশাই, যেসব কান্ড হচ্ছে তা শুনলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে। চাম্পারণ ডিস্ট্রিক্টে কী হয়েছে জানেন? সবাই ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করেছে।

দোকানদার হাতে কাজ করছে আর মুখে কথা বলছে।

—কিন্তু এত টাকা আসছে কোত্থেকে মশাই? কে দিচ্ছে বলুন তো?

একজন বললে—বিড়লারা দিচ্ছে—

—কেন, বিড়লার স্বার্থ কী মশাই? হঠাৎ মাড়োয়ারীরা এত সাধু হয়ে গেল কেন বলুন তো?

—আছে মশাই আছে, মতলব আছে।

কিন্তু তখন কাশীর দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি মালপত্র নিয়ে দু’হাতে ঝুলিয়ে নিলে। বেশী দূর নয়। লাইনটা পেরিয়ে একটু হাঁটলেই বাড়িটা। ভদ্রলোকরা তখনও আলোচনা করতে লাগলো। আজকাল এই রকম সারাক্ষণই আলোচনা হয় পথে ঘাটে। দু’তিনজন লোক জড়ো হলেই আলোচনা চলে। জিনিসপত্রের দাম নিয়েই প্রথমে শুরু হয়। তারপর ওঠে যুদ্ধের কথা। তারপর ওঠে কংগ্রেসের কথা। তারপর ওঠে সুভাষ বোসের কথা। সুভাষ বোস নাকি রেডিওতে লেকচার দিয়েছে। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। কিন্তু বিশ্বাস করতেই সকলের ভালো লাগে। এ মিনিস্ট্রি আর সহ্য হয় না মশাই। এরা দু’হাতে টাকা লুঠছে, আর আমাদের বেলায় দেখাচ্ছে মিলিটারি। কেউ বলে-কিন্তু এত চাল কোথায় গেল মশাই?

—সব মিলিটারির পেটে যাচ্ছে—

—আপনি ছাই জানেন। খবরের কাগজ পড়ে আপনি ওই কথা বলছেন। দেখে আসুন গিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। বিরাট বিরাট সব গো-ডাউন করে চাল জমাচ্ছে— লক্ষ লক্ষ মণ চাল—

—কেন?

—আর কেন, জাপানীদের ভয়ে। জাপানীরা এসে পাছে ধান-চাল পেয়ে যায়, তাই সব জড়ো করে গুদামে রাখছে। যেই তারা এসে পড়বে আর ওমনি সব চাল গঙ্গায় ফেলে দেবে হুড় হুড় করে—

বাড়ির কাছে আসতেই কাশী অবাক হয়ে গেল। ব্যাপার কী? বাড়ির সদর দরজা হাঁ হয়ে রয়েছে। হন হন করে ঘরে ঢুকেই কাশী চেয়ে দেখলে অচেনা এক ভদ্রলোক চুপ করে বসে আছে বাইরের ঘরে।

—কে আপনি? কাকে চাই?

—দীপঙ্করবাবু আছেন?

কাশীর রাগ হয়ে গেল। বললে—আপনি বাড়িতে ঢুকলেন কেন না বলে কয়ে? কে আপনাকে দরজা খুলে দিলে?

—আমি এসেছিলুম দীপঙ্করবাবুর সঙ্গে দেখা করতে।

–দেখা করতে এসেছেন তো, বাড়িতে কেন? আপিসে যেতে পারেন না? বাড়িতে তো দেখা করেন না আমার বাবু।

কাশী হাতের জিনিসপত্রগুলো মেঝের ওপর রাখলে। বড় ভারি লাগছিল। বললে — আপনি এখন যান, বাবু বাড়িতে নেই—

—কিন্তু বাড়িতে তাঁর সঙ্গে নিরিবিলি একটা কথা বলবার ছিল।

কাশী বলল—আচ্ছা মুশকিল তো, বলছি বাবু বাড়িতে নেই—

—বাড়িতে নেই তো কোথায় গেছেন? আমি তো আপিস থেকেই আসছি। আজকে তো আপিসে যাননি তিনি।

কাশী জিজ্ঞেস করলে-আপনি কি বাবুর আপিসে চাকরি করেন?

হ্যাঁ, আমার নাম লক্ষ্মণ সরকার। আমার নাম বললেই তোমার বাবু চিনবেন, তুমি গিয়ে বলো আমি একটা বিশেষ কাজে এসেছি—

কাশী বললে—আমি বলছি তো বাবু বাড়িতে নেই—

—কোথায় গেছেন?

কাশী একবার ভাবলে। সব কথা বাইরের লোককে বলা নিরাপদ কি না তাও ভেবে দেখলে। তারপর বললে—তা সব কথাই কি আপনাকে বলতে হবে?

লক্ষ্মণ সরকার বললে—তাহলে তিনি বাড়ি এলে বোল, আমি এসেছিলুম, আমার নাম লক্ষ্মণ সরকার। আমার চাকরি তোমার বাবুই করে দিয়েছিলেন। এখন মুশকিল হয়েছে বড়বাবুরা আমার ক্ষতি করবার চেষ্টা করছে। কে-জি-দাশবাবু বলে এক ভদ্রলোক আমার বড়বাবু, তিনিই পেছনে লেগেছেন, সেই সব কথাই বলতে এসেছিলাম আর কি!

এতক্ষণে কাশীর বিশ্বাস হলো। বললে—তাহলে আপনাকে খুলেই বলি, বাবুকে পুলিসরা ধরে নিয়ে গেছে—

—সে কী? কেন? বাবু কী করেছিলেন?

কাশী বললে—তা জানি না, শেষ-রাত্তিরে দিকে বাবু চলে গেছেন, একটা টাকা- পয়সা নেই হাতে, হাঁড়ি-কুঁড়ি সব ভেঙে দিয়েছে, তাই এখন এই সব কিনে আনছি, আমি বাড়িতে বলে গিয়েছিলুম কেউ ঠেললেও যেন দরজা না-খোলে—

লক্ষ্মণ সরকার বললে-আমি তো এসব জানতুম না, আমি ঠিকানা নিয়ে বাড়ি খুঁজে এসে দরজার কড়া নেড়েছি। অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর তবে দরজা খুলেছে। বাবুকে পুলিসে ধরলে কেন?

কাশী বললে—তা কী করে জানবো?

—তোমার বাবু তো খুব ভালো লোক। তাকে কেন ধরতে গেল পুলিশ।

কাশী বললে—একজন স্বদেশী লোক আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল তাকে ধরেছে, তাই বাবুকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে-বাড়িতে এখন আমি আর দিদিমণি ছাড়া কেউ নেই—

—দিদিমণি?

লক্ষ্মণ সরকার অবাক হয়ে গেল। বললে—দীপঙ্করের তো ভাই-বোন কেউ ছিল না। ও তো মায়ের এক ছেলে ছিল। এ কোন্ দিদিমণি তোমার?

কাশী বললে—আপনি চিনবেন না, বাবুর নিজের কেউ নয়, দেশের একজন আত্মীয়—আমাদের এখানেই থাকেন—

লক্ষ্মণ সরকার বললে—আমি তো বুঝতে পারিনি, ওঁকে কিছু মনে করতে বারণ কোর, আমি এসে দরজা ঠেলতে উনিই খুলে দিলেন, উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন— আমি কে, তাই আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম—উনি কে! তারপর হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, আর আমি সেই থেকে চুপ করে বসে আছি। কাকে ডাকবো বুঝতে পারছিলাম না, এমন সময় তুমি এলে—

কাশী বললে—আপনি এখন উঠুন বাবু, আমি এই বাজার করে আনলুম, এখন রান্না-বান্না হবে তবে খাওয়া-দাওয়া করবো আমরা-কাল রাত থেকে আমরা না খেয়ে আছি—

অপরাধীর মত লক্ষ্মণ সরকার উঠলো। বললে—তাহলে আমি উঠি এখন—

—হ্যাঁ, আপনি যান—

আরো যেন অনেক কথা বলবার ছিল লক্ষ্মণ সরকারের। কিন্তু আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল ঘরের বাইরে। বাইরে আসতেই কাশী সশব্দে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলে। লক্ষ্মণ সরকার ট্রামে উঠেও ভাবতে লাগলো দীপঙ্করকে ধরলে কেন পুলিসে! কী কারণ থাকতে পারে? ঘোষাল-সাহেবের মত দীপঙ্করও কি ঘুষ নিয়েছিল।

আপিসে ঢুকেই যাকে সামনে পেলে তাকেই বললে—শুনেছেন পুলিনবাবু, আমাদের সেন-সাহেবকে পুলিস ধরেছে?

পুলিনবাবু টিফিন-রুমের দিকে যাচ্ছিল। বললে-বলেন কী? কে বললে? লক্ষ্মণ সরকার বললে—এই তো, এখনি শুনে এলাম—

কথাটা রটতে রটতে সারা আপিসে ছড়িয়ে গেল। পুলিনবাবুর কাছ থেকে হরিশবাবু। হরিশবাবুর কাছ থেকে গোবিন্দবাবু। গোবিন্দবাবুর কাছ থেকে সুধীরবাবু। এক সেকশান থেকে আর এক সেকশানে। এক আফিস থেকে আর এক আফিসে। ট্র্যাফিক আপিস থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং-এ। ইঞ্জিনীয়ারিং আপিস থেকে অডিট আপিসে। কোনও আপিস আর বাদ গেল না। কন্ট্রোলার-অব-স্টোরস, টেলিগ্রাফ, সর্বত্র এক আলোচনা। মিস্টার ঘোষাল অ্যারেস্ট হবার পর যেমন হয়েছিল ঠিক তেমনি। কেউ বললে—তিন হাজার টাকা ঘুষ নিতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে—

গোবিন্দবাবু বললে—তিন হাজার টাকা কে বললে? আমি শুনলাম সাত হাজার-–

সাত হাজার শেষে দশ হাজারে গিয়ে পৌঁছুলো।

লক্ষ্মণ সরকার নিজের সেকশানে চুপ করে বসে ছিল। কবে সে একদিন কালিঘাটের পাড়ায় বখাটে ছেলের দলে মিশে নিজেও বখাটে হয়ে গিয়েছিল। আজ সেই পুরোন ক্লাশফ্রেন্ড দীপঙ্করের দয়াতেই তার চাকরি হয়েছে। কে-জি-দাশবাবু বার বার তাকে আপিসের সকলের সামনে অপদার্থ প্রমাণ করতে চাইছে। এই সময় দীপঙ্করও যদি তার পুরোন অপমানের কথা মনে রেখে তার চাকরি খতম করে দেয়, তখন আর তার কোনও গতিই থাকবে না। সেই কথা বলতেই লক্ষ্মণ সরকার গিয়েছিল দীপঙ্করের বাড়িতে।

কে-জি-দাশবাবু হঠাৎ ডাকলে। বললে—লক্ষ্মণবাবু এদিকে একবার আসুন তো-

লক্ষ্মণ সরকার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বললে—আমাকে ডাকছিলেন?

কে-জি-দাশবাবু বললে—আপনি তো সেন-সাহেবের লোক?

লক্ষ্মণ বললে—হ্যাঁ—

—আপনি শুনেছেন বোধহয় যে সেন-সাহেবকে অ্যান্টি-করাপশন ডিপার্টমেন্ট থেকে ধরে নিয়ে গেছে। মিস্টার ঘোষালের যে গতি হয়েছে, সেন-সাহেবেরও সেই গতি হবে! যদি বিশ্বাস না-হয় ট্রানজিট সেকশানের পুলিনবাবুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসুন—

লক্ষ্মণ সরকার কিছু কথা বললে না।

কে-জি-দাশবাবু আবার বলতে লাগলো-বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? তা বিশ্বাস হবে কেন? আপিস-সুদ্ধ সবাই সেন-সাহেবের নাম করতে অজ্ঞান—নাকি অমন অনেস্ট সাহেব হয় না। এখন কোথায় রইল অনেস্টি?

লক্ষ্মণ সরকার বললে—তা আমাকে এসব কথা বলছেন কেন?

—তা আপনাদের বলবো না তো কাকে বলবো? আপনারাই তো সব সেন- সাহেবকে নিয়ে মাথায় তুলেছিলেন, বলতেন, বড় ট্রুথফুল লোক, রেলের আপিসে অমন সৎ লোক কখনও আসেনি, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। এখন হলো তো? বিশ্বাস না হয় পুলিনবাবুকে জিজ্ঞেস করে আসুন—তিনি নিজের চোখে দেখে এসেছেন, পুলিস ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছে। মার্চেন্টদের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নগদ ঘুষ নিচ্ছিল—

কালিদাসবাবু বললে—সত্যি? দশ হাজার টাকা?

—আরে এতদিন রেলে কাজ করেছি আর রেলের অফিসারদের চিনবো না? এই আপনি যেখানে বসছেন, ওইখানেই তো বসতো সেন-সাহেব। নিজে আমি হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছি, ড্রাফট লিখতে শিখিয়েছি, এক বর্ণ ইংরিজি জানতো না, তাও লিখতে শিখিয়েছি—আমি চিনবো না সেন-সাহেবকে? যান না, পুলিনবাবু আপিসে আসবার সময় নিজের চোখে দেখে এসেছে—তার মুখেই শুনে আসুন গিয়ে, সত্যি বলছি না মিথ্যে বলছি আমি—

লক্ষ্মণ সরকার হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটবেলায় সেও বদমায়েশি করেছে, অতিষ্ঠ করে তুলেছে পাড়ার লোকদের, কিন্তু রেলের আপিসের এ জিনিসের নমুনার সাক্ষাৎ এই-ই তার প্রথম। লক্ষ্মণ সরকার যে লক্ষ্মণ সরকার—সেও নির্বাক হয়ে রইল। একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বেরোল না।

.

আর বিংশ শতাব্দীর মাঝপথে এসে হঠাৎ যুগটা যেন বড় জটিল হয়ে উঠলো। এ বিশ্বাসের যুগও বটে, আবার অবিশ্বাসের যুগও বটে। গড়ারও যুগ, আবার ভাঙারও যুগ ঘর-সংসার-পরিবার-রাষ্ট্র সব ভেঙে চুরে একাকার হবার জোগাড়। আবার ঘর-সংসার- পরিবার-রাষ্ট্র যেন নতুন আকার নেবার জন্যেও অস্থির। নতুন করে যেন সব নবরূপ নেবে, তাই ভাঙার জন্যে এত উন্মুখ। পরিবারের শান্তি নিশ্চিহ্ন হয়েছে, মানুষের সম্পর্কে গ্রন্থি বেঁধেছে, অর্থনীতির মানদন্ডে মনুষ্যত্বের বিচার হচ্ছে। যে স্ত্রী, সে আর স্ত্রী নয়, যে স্বামী সে আর স্বামী নয়, যে মনিব তার মনিবত্ব ঘুচে গেছে, যে মানুষ, সে পশুত্ব বরণ করেছে। বড় জটিল যুগের আবর্তে এরা জড়িয়ে গেল—এই দীপঙ্কর, এই লক্ষ্মীদি, এই মিস্টার ঘোষাল, এই সনাতনবাবু, এই নয়নরঞ্জিনী দাসী, এই ছিটে-ফোঁটা, এই সুধাংশু, এই দাতারবাবু, আর সকলের শেষে এই সতী!

রাত্রে সতীর ঘুম হয়নি। সমস্ত রাত। সেই হাসপাতাল থেকে আসার পরই এ বাড়িতে এসে সমস্ত কিছু দেখে কেমন হতচকিত হয়ে গেছে। সব তার মনে পড়েছে। সেই পুরোন অতীত থেকে আজকের বর্তমান পর্যন্ত সমস্ত। বাইরে থেকে হাসির টুকরো আর সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে এসেছে আর একে একে সমস্ত অতীতটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কী চমৎকার ঘর। দামী জানালা-দরজা। দামী ফার্নিচার, দামী পর্দা। সমস্ত কিছু দামী।

লক্ষ্মীদি বলেছিল—তুই একটু ঘুমো এখন, ভোর বেলা দীপু এলে তখন ডাকবো তোকে—

তারপর লক্ষ্মীদি চলে যাবার পর ঘুমোতে চেষ্টা করেছিল সতী, কিন্তু কোথা থেকে যেন কী এসে সব ঘুম পন্ড করে দিয়েছিল।

রাত বোধহয় তখন তিনটে, তখনই অনেক গাড়ির শব্দ হলো বাইরে। মিস্টার হস্রাজ এল, মিস্টার মাধো এল, মিস্টার লালচাঁদ এল। মিস্টার সিংও এল। লক্ষ্মীদিও বোধহয় কোথাও বেরিয়েছিল তাদের সঙ্গে—সেও ফিরে এল। কয়েক ঘন্টার জন্যে বাড়িটা একটু শান্ত হয়েছিল একটু নিস্তব্ধ। আবার হাসি-কথা-গল্পের আওয়াজ কানে এল। আবার মালপত্র সরানোর শব্দ। শব্দের তরঙ্গের আঘাতে সতীর মনের শান্তি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল এক মুহূর্তে।

রাত চারটের সময় সতীর দরজার কড়া নড়ে উঠলো।—সতী! সতী!!

সতী তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিয়েছে। সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল লক্ষ্মীদি। লক্ষ্মীদিও যেন সারা রাতই ঘুমোয়নি সতীর মত। লক্ষ্মীদির চোখের কাজল তখন যেন আরো কালো হয়েছে। লক্ষ্মীদির ঠোঁটের রং যেন আরো গাঢ় হয়েছে।

—রাত্রে ঘুম হয়েছিল তো তোর?

সতী বললে—না।

—বুঝতে পেরেছি, নতুন জায়গায় তো ঘুম হবেই না। এখন চারটে বেজেছে, আমরা তৈরি হয়েছি—

সতী বললে—দীপু এসেছে?

লক্ষ্মীদি বললে—না, এখনও আসেনি, এইবার বোধহয় এসে পড়বে। তা তুই কিছু ভাবিসনি, আমার তো সব রইল এখানে—এই দ্যাখ,—তুই দেখে যা—

সেই রাত্রেই লক্ষ্মীদি সতীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে সব দেখালে। কোথায় রান্নাঘর, কোথায় বাথরুম, কোথায় স্টোর।

—চাল, ডাল, সব কিছু রয়েছে, এখন কয়েকদিন তোকে কিছুই কিনতে হবে না। আর তোর কাছে টাকা আছে তো?

সতী বললে-না—

—তাহলে এই টাকা ক’টা রাখ তোর কাছে, এই নে—

বলে পার্স খুলে কয়েকটা নোট দিলে সতীর হাতে। বললে—বাবার টাকা তো কলকাতার ব্যাঙ্কে রয়েছে, পরে হিসেব করে নেবখন—আর আমি তো আসছি ই মাসখানেক পরে—

—তুমি আবার আসবে?

—আসবো না? তুই বলছিস কী? কলকাতা ছাড়লে আমার চলে? কলকাতাতেও তো আমার বিজনেস রয়েছে রে। তা ছাড়া বাবার সাকসেশন সার্টিফিকেট নিতে হবে না কোর্ট থেকে! সব টাকা তো আমাদের দু’ বোনের। দাঁড়া আমি আসছি—

লক্ষ্মীদি বড় ব্যস্ত। বাড়িতে অনেক গেস্ট জড়ো হয়েছে।

তারপর পাঁচটা বাজল ঘড়িতে। বাইরে আকাশ পাতলা হয়ে এল। লক্ষ্মীদির গাড়ি তৈরি। সকলের গাড়িই তৈরি। যাবার আগে লক্ষ্মীদি আবার এল। সতী বললে—দীপু তো এল না—

লক্ষ্মীদি বললে—আসবে আসবে! তার জন্যে তুই অত ভাবছিস কেন? আর রঘু তো রইলই, আমার বহুদিনের পুরোন চাকর। দীপু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমার তো আর ওয়েট করা চলবে না ভাই—দীপু এলে বলিস আমি চলে গেছি, একটা সাকসেশন সার্টিফিকেট যেন জোগাড় করবার ব্যবস্থা করে, আমাকে চিঠি লিখলেই আমি কাগজপত্র সই করে পাঠিয়ে দেব—

তারপর একটু থেমে বললে-যা, তোকে আর বাইরে আসতে হবে না—রঘু দরজা বন্ধ করে দেখেন—

সকলের সদলবলে চলে যাবার শব্দটাও কানে এল তারপর। অনেকগুলো গাড়ি এক সঙ্গে স্টার্ট দিলে। ঘরের ভেতর থেকে সতীর কানে এল সমস্ত। এইবার হয়ত দৌড়তে দৌড়তে দীপু আসবে! হয়ত দীপু ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে তো জাগিয়ে দেবার কেউ নেই। হয়ত এসেই দেরি করার জন্যে ক্ষমা চাইবে!

জানালার বাইরে আরো সকাল হলো। ছটা বাজলো। সাড়ে ছ’টা।

বাইরে যেন কোথায় সদরে দরজা খোলার শব্দ হলো একটা। তারপর জুতোর আওয়াজ। তারপর…….

তারপর সতীর ঘরের দরজার কড়া নড়ে উঠলো।

ওই দীপু! ওই দীপু এসেছে।

সতী ভেতর থেকে বললে—কে?

তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে।

দীপু নয় রঘু। রঘু বললে—চা করে দেব দিদিমণি?

সবে ভোর হয়েছে। সতীর মনে হলো যেন তার জীবনেরও নতুন করে ভোর হলো। এমন করে লক্ষ্মীদির বাড়িতে এসে তাকে আবার এ-ভাবে জীবন শুরু করতে হবে তা সে কোনওদিন কল্পনা করতে পারে নি।

সতী বলে—দীপঙ্করবাবুকে তুমি চেন?

রঘু বললে—হ্যাঁ, তিনি দুএকবার এসেছেন এ-বাড়িতে—

—তাঁর বাড়ি চেনো?

রঘু বললে—না—

সতী বললে—সেই বাবুর আসবার কথা আছে এখানে। যদি আসেন তো আমার ঘরে নিয়ে এসো তাঁকে—

আজো দীপঙ্করের মনে আছে সতীর সেই কথাগুলো। আর শুধু সতীর কথাই বা কেন? দীপঙ্করের জীবনের সঙ্গে যতগুলো জীবন জড়িয়ে গিয়েছিল, সকলের সব কথাই মনে আছে। এই সনাতনবাবু, এই মিস্টার ঘোষাল, ওই ছিটে-ফোঁটা, ওই ক্ষীরোদা, নির্মল পালিত, ওই প্রাণমথবাবু, সকলের জীবনের জটিল জালে দীপঙ্কর যে জড়িয়ে গিয়েছিল। ওরা যেন এক-একজন ব্যক্তি নয়, ওরাই যেন সমস্ত কলকাতা। ওরাই যেন কলকাতার চলমান যুগ। ওদের বাদ দিলে যেন কলকাতার ভূগোলও বাদ দিতে হয়, কলকাতার ইতিহাসকেও বাদ দিতে হয়। ওদের মধ্যেই যেন কলকাতার প্রাণধর্মের মানচিত্র স্পষ্ট রূপ পেয়েছিল।

নিঃসঙ্গ নিরিবিলি বাড়িটা। একদিন এই বাড়িটাকেই পাড়ার লোকে বাইরে থেকে কত উচ্ছল দেখেছে। আবার এই বাড়িটাই হঠাৎ নিঝুম হয়ে গেল রাতারাতি। আগে কোথা থেকে কত গাড়ি আসতো, বাড়ির সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ভেতরের নরম আলোর নিচেয় যৌবনের উন্মাদ ফোয়ারা ছুটতো, টাকার অকৃপণ ঔদার্য পুঞ্জীভূত হয়ে উঠত। সব যেন আবার হঠাৎ স্তিমিত হয়ে এল।

প্রথম দিকে একটু অসুবিধে হয়েছির সতীর। প্রথম প্রথম ট্রেনের শব্দ, ইঞ্জিনের হুইসল্, খান্ খান্ করে ভেঙে চুরমার করে দিত সতীকে। তারপর আস্তে আস্তে সব সহ্য হয়ে এল। শব্দও সহ্য হয়ে এল, নিঃসঙ্গতাও সহ্য হয়ে এল। একদিন শুরু হয়েছিল কোথায় কোন্ সমুদ্রপারের কোন্ একটা নির্জন নিরিবিলি শহরে। তারপর অনেক শব্দ – তরঙ্গ পরিক্রমা করে যেন আবার সেই শৈশবের নিঃসঙ্গগতায় ফিরে এসেছিল।

সতী বলেছিল—প্রথম প্রথম বড় কষ্ট হতো দীপু, মনে হতো আমার যেন দ্বীপান্তর হয়েছে—অনেক অপরাধের শাস্তি হিসেবে এখানে আমি একা-একা দ্বীপান্তর-বাস করছি, আজীবন যেন দ্বীপান্তর-বাসই করতে হবে এমনি করে—কিন্তু তারপর সমস্ত সহ্য হয়ে এল, মনে হলো এই নিঃসঙ্গতাই বুঝি আমার দরকার ছিল।

দীপঙ্কর বলেছিল—এবার আমি বাড়ি যাই সতী, অনেক রাত হলো—

সতী বলতো—আমার জন্যে না-হয় একটু রাতই করলে—

দীপঙ্কর বলতো—আমি তো রোজই আসি, আবার কালই তো আসবো–

সতী বলতো—জানি, তবু মনে হয় আমার যেন কিছুই বলা হলো না-

—কিন্তু আর কী করবার আছে বলো?

সতী আপন মনে একটু ভাবতো। কেমন যেন দ্বিধা করতো একটু। তারপর বলতো—উনি কেমন আছেন?

কথাটা বলেই সতী যেন কেমন লাল হয়ে উঠতো। সমস্ত শরীরে কেমন এক লজ্জা জমে উঠতো হঠাৎ। আর দীপঙ্কর সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে উঠতো। বলতো—আমি এখনি যাচ্ছি, তাঁকে নিয়ে আসছি তোমার কাছে, এখুনি—এ-কথা আগে বলো নি কেন?

আর প্রতিবাদের সুরে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতো সতী। বলতো—না দীপু, না না–তোমার পায়ে পড়ছি, এখানে তাঁকে এনো না—কখনও এনো না—

কোথায় কেমন করে সব বিলীন হয়ে যায়। কেমন করে জীবনের নদী মৃত্যুর সমুদ্রে গিয়ে মেশে কে বলতে পারে! একদিন যে-জীবন আনন্দে, আকাঙ্খায়, যন্ত্রণায় উচ্ছল হয়ে ওঠে, সেই জীবনই আবার এক-এক সময় কেমন স্থির, শান্ত, নিরুদ্বেগ হয়ে আসে। উচ্ছলতার যেমন কোনও কারণ থাকে না, প্রশান্তিরও তেমনি কোনও ব্যাখ্যা মেলা ভার হয়ে ওঠে। সব হারিয়ে সব পাওয়ার কথাটা তো দর্শনের কথা। ওটা বইতে পড়তে ভালো। কিন্তু জীবনে যে সমস্ত হারায় তার কাছে সান্ত্বনা কোথায়? কার কাছে সে হাত পাতবে? কিন্তু তবু কোথা থেকে যে শান্তি এসেছিল মনে কে বলবে? কারোর কাছে সে কিছু চায়ও নি, কিছু পায়ও নি। তাই কোথাও, মনের কোনও কোণেও যেন তার কোনও অভাব নেই। অভাব নেই বলে অভিযোগও ছিল না সে ক’দিন।

প্রথম দিনটা এমনি করেই কাটলো। ট্রেনগুলো লাইনের ওপর দিয়ে যায় আর আসে। আসে আর যায়। বাড়ির কাছাকাছি এলে শব্দটা একটু প্রখর হয়। মাটি কাঁপে। তারপর আবার সব স্থির হয়ে আসে। দুপুরবেলা রাস্তা দিয়ে মিলিটারি লরীগুলো যায়। ধুলো ওড়ে। আবার সব শান্ত। তখন দু-একটা লোক পায়ে হেঁটে যায় এধার থেকে ওধারে। আর জানালার ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে তাকালে দেখা যায় দু’জোড়া রেল- লাইন খোয়া বিছোন সমতল মাটির ঢিবির ওপর এঁকে বেঁকে শুয়ে আছে। আর তার ওধারে শুধু মাঠ, শুধু গাছ আর চিক্ চিক্ করা জল। জল আর জল।

বিকেল বেলাটা সেই জায়গাটাই আবার ঝাপসা হয় আস্তে আস্তে। সূর্যটা ডুবে যায় একেবারে আকাশ লাল করে। তখন আর কিছু দেখা যায় না। আশে-পাশের ঝোপ-ঝাড় থেকে ঝিঁ ঝিঁ ডাকতে শুরু করে। শেষবারের মত জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে আর একবার দেখে নিলে। কে যেন ব্ল্যাক-আউটের ভেতরে হন্ হন্ করে হেঁটে আসছে না! দীপু নাকি! দীপুই হয়ত। হয়ত সকালবেলা সময় পায়নি। কিম্বা হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সতী ডাকলে—রঘু—

রঘু রান্নার জোগাড় করছিল। কাছে আসতেই সতী বললে—রঘু, দীপঙ্করবাবু আসছে, সদর দয়জাটা খুলে দাও তো তাড়াতাড়ি—

দীপঙ্কর ততক্ষণ অনেক এগিয়ে এসেছে। লেভেল-ক্রসিংটা পেরিয়ে একেবারে হাতের কাছে। একেবারে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলো সতী। কিন্তু কাছে আসতেই মনে হলো—কই, এ তো দীপঙ্কর নয়! এ তো অন্য লোক। বাড়ির সামনে দিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেল।

—ছোটদিদিমণি, কই দীপঙ্করবাবু তো আসেনি।

সন্ধ্যেবেলায় খাবার সময় সতী জিজ্ঞেস করলে—তুমি ভবানীপুর চেনো রঘু?

—ভবানীপুর? নাম শুনেছি ভবানীপুরের, ওদিকে যাইনি তো কখনও?

—প্রিয়নাথ মল্লিক রোড?

—না দিদিমণি।

সতী বললে—আচ্ছা, তোমায় যদি আমি জায়গা বলে দিই তুমি যেতে পারবে? কোথা দিয়ে কোথা দিয়ে যেতে হবে বলে দিলে তুমি যেতে পারবে না?

রঘু বললে—আমি হারিয়ে যাবো ছোটদিদিমণি। রাস্তা হারিয়ে যাবো।

সতী জিজ্ঞেস করলে—তুমি এতদিন এ-বাড়িতে কাজ করছো, আর এখনও কলকাতা চেনো নি?

রঘু বললে—আমি তো কেশবের লোক, কেশব আমাকে দেশ থেকে আনিয়েছে। আমার বাড়ি বালেশ্বর—

রাত্রিবেলা শুতে যাবার আগে হঠাৎ দরজার কড়া নড়ে উঠলো। ওই!

—রঘু, ওই দীপঙ্করবাবু এসেছে—

তাড়াতাড়ি সতী বিছানা ছেড়ে উঠলো। দেয়ালের আয়নাতে একবার মুখটা দেখে নিলে। তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছেও নিলে। চুলটা খোঁপাটা ঠিক করে নিলে। তারপর শাড়িটা গুছিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে বেরোল। এই এত রাত করে আসতে হয়! যদি সতী ঘুমিয়ে পড়তো। হয়তো আপিসের কাজে বড় ব্যস্ত ছিল। কিন্তু একদিন আপিস না-গেলে কী হতো!

রঘু ফিরে এসে বললে—আপনাকে একজন ডাকছেন ছোটদিদিমণি—

—আমাকে? কে? দীপুবাবু?

রঘু বললে—না, দীপুবাবু নয়, এ অন্য লোক—

—তা আমার সঙ্গে তার কীসের দরকার? আমাকে চেনে?

রঘু বললে—তা জানি না, বললে তোমার দিদিমণিকে ডেকে দাও—

সতী একটু অবাক হয়ে গেল। সতী যে এখানে আছে তা কে আর জানে! একমাত্র দীপু ছাড়া আর কার জানবার সুযোগ হয়েছে! তবে হয়ত দীপু নিজে না আসতে পেরে লোক পাঠিয়েছে খবর দিয়ে।

সতী সদর দরজার সামনে গিয়ে বললে-কাকে চাই?

ময়লা সার্টের ওপর পাতলা একটা আলোয়ান গায়ে। রোগা, চোয়াড়ে মুখ। দেখলেই কেমন যেন ঘেন্না হয়। তার ওপর দয়া আকর্ষণ করবার জন্যে দাঁতের পাটি বার করে হাসবার চেষ্টা করছে। সতীর মুখের দিকে সোজা চেয়ে আছে হাবার মত।

সতী আবার জিজ্ঞেস করলে—কাকে চাই তোমার?

লোকটা বেশ নিচু হয়ে নমস্কার করলে হাত-জোড় করে। তারপর বললে—আর একজন দিদিমণি ছিলেন, তিনি কোথায়?

সতী বললে—তিনি নেই, তিনি দিল্লি চলে গেছেন, কী চাই তোমার?

—আজ্ঞে, আমি গরীব লোক, বড় অভাব, তিনি আমাকে মাঝে মাঝে সাহায্য করতেন, তিনি আমাকে আসতে বলেছিলেন—

—কীসের জন্যে আসতে বলেছিলেন?

লোকটা বললে—মাঝে মাঝে দু-পাঁচ টাকা দিয়ে তিনি আমাকে সাহায্য করতেন— –তা তিনি তো নেই এখানে, তিনি দিল্লি চলে গেছেন।

—কবে আসবেন?

সতী বললে—তার কোনও ঠিক নেই। একমাস পরেও আসতে পারেন, আবার কখনও নাও আসতে পারেন,—

লোকটা কী যেন ভাবলে মনে মনে। তারপর একটু দ্বিধা করে বললে—তাহলে আপনি কিছু সাহায্য করুন না, আমি খুব গরীব লোক, আমার মা’র অসুখ, আমার নাবালক দুই ভাই আছে, এ বোনের বিয়ে দিতে হবে………সেই দিদিমণি সব জানতেন আমার কথা।

সতী বললে—আমি কিছু দিতে পারবো না —

—যদি দিতেন বড় উপকার হতো!

সতীর তখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। বললে—বেশি বিরক্ত কোর না তুমি, এখন যাও, এখন শুতে যাবো আমরা—

লোকটা তখনও অনুনয় করতে লাগলো। বললে—দেখুন, আমি অনেক দূর থেকে আসছি, অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে এখানে আসছি, তাই এত দেরি হয়ে গেছে, এখন আবার সেই টালিগঞ্জে ফিরে যেতে হবে—

সতী আরো রেগে গেল। বললে—বার বার বলছি, তবু শুনছো না কেন! বলছি এখানে হবে না, অন্য জায়গায় দেখো—

তারপর আর কথা না-বাড়িয়ে রঘুকে দরজা বন্ধ করতে বলে নিজের ঘরে চলে এল সতী। রঘু আসতেই সতী জিজ্ঞেস করলে—তুমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছ তো ভালো করে?

আশ্চর্য! এই ব্ল্যাক-আউটের রাতে যাকে তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়াই কি ঠিক! আবার অন্ধকারে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে সতী বিছানায় শুয়ে পড়লো। সমস্ত দিনের প্রতীক্ষার ক্লান্তিতে একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়েছে সে! সেই উনিশ-শো বিয়াল্লিশের একটা তারিখের অর্ধ প্রহর রাতে একটি মানুষ নিঃসম্বল, নিরাশ্রয় হয়ে উঠেছিল পরের বাড়িতে। সংসারের কোনও মানুষের ওপরই তার কোনও অধিকারের মোহ তখন ছিল না আর। যেটুকু অধিকার-বোধ তখনও অবশিষ্ট ছিল, তা-ও যেন তখন নিঃশেষ হয়ে গেল। একদিন কত স্বপ্ন, কত কল্পনা ছিল তার। কত অনুরাগ ছিল, কত রোমাঞ্চ। কখনও অভিমান করেছে, কখনও অনুযোগ। তার মধ্যেকার আসল মানুষটাকে কেউ দেখতে চাইল না, কেউ জানতেও চাইল না, কেউ জেনেও বুঝতে চাইল না।

মানুষকে কত বিচিত্র অবস্থার মধ্যে জীবন কাটাবার প্রয়োজন হয়। কে জানতো একদিন এই নির্বান্ধব নিঃসঙ্গ আশ্রয়ের মধ্যেই তাকে আজ আত্মগোপন করতে হবে! কোথায় গেল সেই সমুদ্র-পারের খোলা আকাশ আর কোথায় সেই কালিঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অন্ধ সঙ্কীর্ণতা। ঠিক তারপরেই সেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের অদৃষ্ট বিধাতাপুরুষ একদিন নিজের হাতেই বুঝি খাঁচার দরজাটা দয়া করে খুলে দিলেন। আর সে উড়তে উড়তে একেবারে ব্যাধের বন্দুকের নাগালের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। সেখান থেকেই বা কে তাকে উদ্ধার করলে? সে-ও কি তার বিধাতা-পুরুষ?

বাবা বলতো—আমি তো একদিন বুড়ো হবো মা, একদিন আমিও আর থাকবো না সংসারে, সেদিন তোমাদেরই তো সব দেখতে হবে এসব—তোমাদের দুই বোনকেই তো সব দেখতে হবে—

আজ যদি বাবা দেখতে পেতেন! আজ যদি অন্য সকলের মত বাবা কলকাতায় এসে পৌঁছোতেন! বিয়ের দিনও বাবা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। তখন বেনারসী শাড়ি পরে শ্বশুর-বাড়ি যাবার লগ্ন। স্বামী পাশে রয়েছেন। গাঁটছড়া বাঁধা। কাকাবাবুকে প্রণাম করেছিল, কাকীমাকে প্রণাম করেছিল, শেষে কাঁদতে কাঁদতে বাবাকেও প্রণাম করেছিল সতী।

বাবা বলেছিলেন—চিরসুখী হও মা—

বাবারও তখন হয়ত গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল। কিন্তু ওইটুকুই যথেষ্ট! ওইটুকু কথা বলতেও যেন বাবার সমস্ত অন্তরাত্মা হাহাকার করে উঠেছিল সেদিন! বাবা, তোমার কোনও দোষ নেই। তুমি আমাকে সৎপাত্রের হাতেই তুলে দিয়েছিলে। সদ্বংশেই তুমি আমার বিয়ে দিয়েছিলে। তুমি আমার জন্যে চেষ্টার কোনও ত্রুটি করোনি। এমন সংসারে কম মেয়েরই বিয়ে হয়। আপন মায়ের চেয়েও মমতাময়ী শাশুড়ী পেয়েছিলাম। তুমি কোনও অন্যায় করোনি। আমারই কপালের দোষ বাবা। আমার কপালেই অত সৌভাগ্য সইল না। আমার কপালে কষ্ট থাকলে তুমি কী করবে বাবা! আমাকে তুমি ক্ষমা করো!

—দিদিমণি! দিদিমণি!

হঠাৎ রঘুর ডাকে চমকে উঠলো সতী। খট্ করে বারান্দাটায় আলো জ্বলতেই সতী চেয়ে দেখলে। দরজাটা খোলা! দরজাটা খুলেই শুয়ে পড়েছিল নাকি? তাড়াতাড়িতে দরজাটা বন্ধ করেনি সে। আলোর রেখাটা বারান্দা থেকে সোজা ঘরের মেঝের ওপর এসে পড়েছে। রঘু দাঁড়িয়ে ছিল কাছে। তার ছায়াটাও ঘরের মেঝেতে পড়েছে। কিন্তু তার পাশেই আর একটা ছায়া।

কে?

রঘু বললে—দীপুবাবু এসেছে—

দীপঙ্কর সঙ্কোচের সঙ্গে ঘরে ঢুকলো।

—ওমা, এ কি? তুমি? এত রাত্তিরে?—সতী তাড়াতাড়ি গায়ের কাপড়টা গুছিয়ে নিয়েছে।

দীপঙ্কর সোজাসুজি ঘরের মধ্যেখানে এসে অন্যদিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছে। বললে—বড়ড়ো রাত হয়ে গেল সতী, এদিকে এমন আটকে পড়েছিলাম যে কিছুতেই আর তোমার কাছে আসতে পারছিলাম না—

সতীও তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। দীপঙ্কর বললে—পাছে তুমি খুব ভাবো, তাই শুধু একবার দেখা করে গেলাম, কাল সকালে আবার আসবো—তুমি শুয়ে পড়ো—

সতী বললে—কিন্তু দীপু, তুমি কী বলো তো? আমাকে যদি এমনি করে একলাই ফেলে রাখবে তো কেন এখানে আনলে? আমি তো সেই প্যালেস-কোর্টেই ছিলাম ভালো! কেন আনলে এখানে?

দীপঙ্কর কিছু উত্তর দিতে পারলে না। জবাব দেবার যেন তার কিছু নেইও। সতী বলতে লাগলো—আজ সারা দিনটা কী করে কেটেছে জানো? এমন করে একলা-একলা মানুষ থাকতে পারে? আমার যে সারাদিন দম আটকে আসছিল। আমি যে এতক্ষণ গলায় দড়ি দিইনি কেন, এইটেই আশ্চর্য—

দীপঙ্কর বললে—এমন করে বলো না তুমি সতী, তাতে আমার আরো কষ্ট হবে—

—কিন্তু কেন তুমি এখানে আনলে আমাকে, তাই আগে বলো? আমি তোমার কোনও কথা শুনবো না।

দীপঙ্কর বললে—প্রথম দিন একটু কষ্ট হবে বৈ কি, কিন্তু আমি তো তোমার ভালোর জন্যেই তোমাকে এখানে এনেছি! তোমার ভালো ছাড়া আমার আর কী স্বার্থ থাকতে পারে, বলো?

সতী বললে—আমার ভালোর কথা দয়া করে তোমাকে আর ভাবতে হবে না দীপু। তুমি আমার যথেষ্ট ভালো করেছ—

দীপঙ্কর বললে—এমন অভিমানী হলে কি চলে সতী? সংসার কি এত অভিমানের দাম দেয়—?

—না দেয় না দেবে, তাতে আমার কী? আমি কারো দয়ার দান নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই না!

দীপঙ্কর বললে—একে তুমি দয়া বলছো কেন সতী?

সতী বললে—সারাদিন তোমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকবো, আর তুমি এই মাঝ- রাত্তিরে এক মিনিটের জন্যে একটু দেখা করে যাবে, একে দয়া বলবো না তো কী বলবো?

দীপঙ্কর বললে—তুমি খুব রাগ করেছ বুঝতে পারছি—

—মিথ্যে কথা!

সতী এবার ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো। বললে—মিথ্যে কথা, তোমার ওপর রাগ করবো এমন আহাম্মক আমি নই, আমাকে তুমি এখনও চিনতে পারোনি তাহলে—

দীপঙ্কর এবার হাসলো। হেসে সামনে এগিয়ে এল আরো। বললে—এখনও তুমি সেই এক-রকমই রয়ে গেলে সতী! কিন্তু নিজেকে তুমি আর কতদিন এমনি করে কষ্ট দেবে?

সতী গম্ভীর হয়ে পেছিয়ে গেল আরো। বললে—দেখ, আমাকে তোমরা ঘেন্না করো, আমাকে তোমরা ধরে দু’ ঘা চাবুক মারো তা-ও আমার সহ্য হবে, কিন্তু দয়া করে আমাকে আর সহানুভূতি দেখিও না—

দীপঙ্কর বললে—আজ বুঝতে পারছি কেন এত সুখ থাকতেও শ্বশুরবাড়ি তোমার ভালো লাগলো না—

–দেখ দীপু, আর যাই বলো তুমি, ও-বাড়ির নাম তুমি আর মুখে এনো না—

দীপঙ্কর বলতে লাগলো—কিন্তু চিরকাল কি তুমি এখানে এমনি করেই থাকবে? এই বাড়িতে একলা কাটিয়ে দেবে?

—যদি কাটাই-ই, তাতে কার কি ক্ষতি শুনি?

দীপঙ্কর বললে—ক্ষতি আবার কার, তোমারই ক্ষতি!

সতী বললে—যাক, আমার ক্ষতির কথা তোমাকে আর ভাবতে হবে না—

–কিন্তু, বা রে, আমি ভাববো না তো কে ভাববে?

সতী তখন পেছিয়ে বিছানার ওপর বসে পড়েছে। বললে—কাউকেই ভাবতে হবে না, ভাবতে হলে আমি নিজেই ভাববো, আমার জন্যে কারো কিছু ভাববার দরকার নেই—

দীপঙ্করও এসে বিছানার পাশে বসলো। বললে—রাগ দেখছি তোমার ষোল আনাই আছে—এতটুকু কমেনি এখনও—

সতী এবার সত্যিই রেগে গেল। বললে—তুমি যাও দীপু, অনেক রাত হয়েছে, যাও—

দীপঙ্কর তবু গেল না, পাশে বসে রইল তার দিকে চেয়ে।

সতী বললে—কী দেখছো, কী? যাও—

দীপঙ্কর কিছু কথা বললে না। চুপ করে বসে রইল তখনও—

সতী চিৎকার করে উঠলো। বললে—যাও—

দীপঙ্কর আর বসলো না। আস্তে আস্তে উঠে বাইরের দিকে গেল। কিন্তু সতীর নিজের চিৎকার হঠাৎ নিজেরই ঘুম ভেঙে গেছে তখন। অন্ধকার ঘর। অল্প-অল্প আৰ্‌ছা আলো আসছে দক্ষিণের জানালা দিয়ে। একবার এদিকে একবার ওদিকে চাইলে। কোথাও কেউ নেই। খিল-বন্ধ দরজা। একলা। বিছানার ওপর চুপ করে শুয়ে আছে সে। আর ঠান্ডা মাঝ-রাত্রে সমস্ত শরীরটাই ঘামে ভিজে গেছে। আস্তে আস্তে উঠলো সতী। ঘরের আলোটা জ্বাললে। সত্যিই কেউ কোথাও নেই। কেউ কোথাও থাকবেই বা কী করে! ঘরে ঢুকবে কী করে! দরজা তো খিল-বন্ধই রয়েছে!

এবার দরজার খিলটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। নির্জন অন্ধকার বারান্দা। আশে- পাশের দরজা-জানালা সব ভালো করে বন্ধ করেছে রঘু। নতুন জায়গায় শোওয়া। এমন জায়গায় তো কখনও আগে রাত কাটায় নি। কেমন যেন একটা খস্ খস্ শব্দ হচ্ছে কোথাও। বারান্দার লাইটা জ্বালিয়ে এধার থেকে ওধার পর্যন্ত দেখে নিলে। কেউ কোথাও নেই। যে-লোকটা শোবার আগেই এসেছিল তাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে তবে রঘু খিল দিয়েছিল। একটা ইঁদুর পায়ের কাছ দিয়ে সুড় সুড় করে চলে গেল। গিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো।

সতী জোরে ডাকলে—রঘু,—রঘু,—

রঘু সারাদিনের পরিশ্রমের পর অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। দু’-একবার ডাকতেই ঘড়-ফড় করে উঠে এল সামনে।

সতী বললে—লোকটা চলে যাবার পর তুমি ভালো করে দরজা বন্ধ করেছিলে তো?

রঘু বুঝতে পারলে না। বললে—কোন্ লোকটা?

সতী বললে—সেই যে, যে-লোকটা রাত্তিরে এসেছির সাহায্য চাইতে?

রঘু বললে—হ্যাঁ ছোটদিদিমণি, আমি তো তাকে দরজার বাইরে বার করে দিয়ে তবে খিল বন্ধ করে দিয়েছি—

সতী বললে—আচ্ছা, তুমি শোও গে যাও—

রঘু আবার শুতে যাচ্ছিল। সতী আবার ডাকলে—আর একটা কথা, আর কেউ দরজা ঠেলেছিল? আমি ঘুমিয়ে পড়বার পর?

রঘু বললে—না তো ছোটদিদিমণি, আর কেউ তো দরজা ঠেলেনি!

আর কেউ আসেনি! কিন্তু এমন তো হতে পারে সারাদিন আপিসে কাজে ব্যস্ত থাকবার পর হয়ত দীপু এসেছিল, রঘু টের পায়নি। হয়ত দরজাও ঠেলেছিল। দরজা ঠেলে ঠেলে কারোরই সাড়া পায়নি। রঘু অঘোরে ঘুমোচ্ছে, আর এদিকে সতীও হয়ত তখন খানিকণের জন্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর কারোর সাড়া না-পেয়ে হয়ত ফিরে গেছে আবার। কিংবা হয়ত আসেই নি মোটে। তারই মনের ভুল! যেমন মিথ্যে স্বপ্ন দেখেছিল, তেমনিই মিথ্যে সব কিছু!

রঘু তখন আবার ঘুমোতে চলে গেছে। তার নিঃশ্বাস নেবার শব্দ আসছে দূর থেকে। আলোটা নিবিয়ে দিলে সতী। নিবিয়ে দিতেই ইঁদুরটা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে তার পায়ের কাছ ঘেঁষে বাইরে চলে গেল আবার। সতী ঘরে ঢুকে আবার নিজের দরজায় খিল এঁটে দিলে।

সকল অধ্যায়

১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১
২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২
৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩
৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪
৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫
৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬
৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭
৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮
৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯
১০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০
১১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১১
১২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১২
১৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৩
১৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৪
১৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৫
১৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৬
১৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৭
১৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৮
১৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৯
২০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২০
২১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২১
২২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২২
২৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৩
২৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৪
২৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৫
২৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৬
২৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৭
২৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৮
২৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৯
৩০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩০
৩১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩১
৩২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩২
৩৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৩
৩৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৪
৩৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৫
৩৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৬
৩৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৭
৩৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৮
৩৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৯
৪০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪০
৪১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪১
৪২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪২
৪৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৩
৪৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৪
৪৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৫
৪৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৬
৪৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৭
৪৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৮
৪৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৯
৫০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫০
৫১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫১
৫২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫২
৫৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৩
৫৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৪
৫৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৫
৫৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৬
৫৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৭
৫৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৮
৫৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৯
৬০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬০
৬১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬১
৬২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬২
৬৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৩
৬৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৪
৬৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৫
৬৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৬
৬৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৭
৬৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৮
৬৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৯
৭০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭০
৭১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭১
৭২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭২
৭৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৩
৭৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৪
৭৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৫
৭৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৬
৭৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৭
৭৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৮
৭৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৯
৮০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮০
৮১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮১
৮২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮২
৮৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৩
৮৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৪
৮৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৫
৮৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৬
৮৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৭
৮৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৮
৮৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৯
৯০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯০
৯১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯১
৯২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯২
৯৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৩
৯৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৪
৯৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৫ উপসংহার
৯৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৬
৯৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৭
৯৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৮
৯৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৯
১০০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০০
১০১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০১
১০২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০২
১০৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০৩
১০৪. নির্ঘণ্ট : কড়ি দিয়ে কিনলাম – ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন