কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬২

বিমল মিত্র

টেম্পল চেম্বার্সের কালো ময়লা-চিট চেয়ারের ওপর এসে ধপাস করে বসে পড়লেন বউবাজারের প্রবীন উকিল বিভূতিভূষণ বসু। বললেন—কই হে, গাঙ্গুলী কোথায় গেল?

যে লোকটা এককোণে বসেছিল সে বললে—আসুন, গাঙ্গুলীবাবু হাইকোর্টে গেছেন, এখুনি এসে পড়বেন —

আলিপুর চব্বিশ পরগণার জজ কোর্ট থেকে শুরু করে শেয়ালদা ব্যাঙ্কশাল কোর্ট ঘুরে হাইকোর্টে এসে যে সার্কেলের শেষ, তার জাল ছাড়ানো আছে চারদিকে। এ- কোর্টের সঙ্গে ও-কোর্টের, এ-উকিলের সঙ্গে ও-এটর্নীর যেন নাড়ীর যোগ। একটা জাল টানলে অনেক নাড়ীতে টান পড়ে। সারা কলকাতাময় মোক্তার, মুহুরি, উকিল, ব্যারিস্টার সবাই যেন জাল ফেলে অফিস খুলে বসে আছে। বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে এ-জালে সবাইকেই আটকে পড়তে হবে। নয়নরঞ্জিনী দাসী, সনাতনবাবু, মিস্টার ঘোষাল, সতী, লক্ষ্মী কেউ ছাড়া পাবে না। দোষী-নির্দোষী কারোর মুক্তি নেই ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের দুর্ভেদ্য জাল থেকে।

বিভূতিবাবু বললেন—তাহলে তো বড় মুশকিল হলো দেখছি—

—কেন?

বিভূতিবাবু জিজ্ঞেস করলেন—কীসের কেস আবার আজকে! ব্যারিস্টার দত্তর ব্রী বুঝি?

লোকটা বললে—সেই মার্ডার কেসটার হিয়ারিং, আজকে লাস্ট ডিফেন্স উইটেনেস এসেছে কিনা—মিসেস ঘোষকে আজ তাইতো আমি গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়ি থেকে নিয়ে এলুম—

—কে মিসেস ঘোষ?

—আজ্ঞে, সেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের নয়নরঞ্জিনী দাসীর পুত্রবধূ, সনাতন ঘোষের স্ত্রী!

বিভূতিবাবু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন—তাই নাকি, আমাদের কোর্টেও যে নয়নরঞ্জিনী দাসীর একটা কেস আছে হে। বাড়ি নীলেমের নোটিস বেরিয়েছে, লাখ টাকার ডিক্রি—! এ হয়েছে বেশ একরকম। শাশুড়ী-বউ-হাজব্যান্ড সবাই আটকে পড়েছে—

—কিন্তু পুত্রবধূ তো আলাদা থাকে, জানেন না?

বিভূতিবাবু বললেন—জানি জানি, সবই জানি হে, শাশুড়ী সবই বলেছে, আজকে রাত্তিরে আসবে আমার কাছে, এখন লাখ টাকার নোটিশ পেয়েছে! একবার বলেছি, আবার আজকেও বলবো, টাকাটা যেমন করে হোক জোগাড় করতেই হবে, তোমাদের ব্যারিস্টার পালিতের কান্ড—

—আজ্ঞে ব্যারিস্টার বলছেন কেন, বলুন টাউট—

বিভূতিবাবু বললেন—আর যে-দিনকাল পড়েছে সবাইকেই টাউটগিরি করতে হবে—তারপর জাপানীরা এলে কী হবে ভগবান জানে—

তারপর বললেন—তাহলে উঠি আজ, পরে টেলিফোন করবো, গাঙ্গুলীকে বলে দিও—

বিভূতিবাবু ব্যস্ত মানুষ। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে একটা কাজে এসেছিলেন, তারপর মক্কেলের খরচায় ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে এখানে এসে কাজ সারবার মতলব ছিল। তারপর যেতে হবে রেজিস্ট্রি অফিসে। সেখান থেকে আরো অনেক জায়গায়।

কিন্তু ওদিকে সেসন্‌স জজের এজলাসে তখন হিয়ারিং শেস হয়ে গেছে। জজ সাহেব কোর্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। মিস্টার ঘোষাল য়্যাকিউজড্ বক্স-এ এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল নিশ্চল পাথরের মত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চুরোট খেতে পায়নি। অথচ মেজাজ খারাপ করবার উপায় নেই। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের চরম ধারার অক্টোপাশে আটকে পড়েছে। সতী যখন প্রথম এসে উইটনেস-বক্সে দাঁড়াল, তখনও একটু ভয় হচ্ছিল। সতীর একটা কথার ওপর নির্ভর করছে তার লাইফ। কিন্তু না, একে একে প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল সে মাথা ঠান্ডা রেখে। এক-একবার মনে হলো হয়ত এখনি ফাঁস করে দেবে সমস্ত। একবার মনে হলো সতী যেন দ্বিধা করছে, সতী যেন আকাশ-পাতাল হাতড়ে বেড়াচ্ছে। এক-একবার মিস্টার ঘোষালের মনে হলো, সতী যেন সত্যি কথাই বলে ফেলবে। কিন্তু না, মানুষের সমাজ সমস্ত মানুষ-সমাজকে এমনভাবে মিথ্যে-কথা বলতে শিখিয়েছে, এমন কৌশলে খবরের কাগজ, রেডিও, টেক্সট বুক দিয়ে তাকে গড়ে তুলেছে, যে, মিথ্যে কথা বলতে আর দ্বিধা হলো না সতীর। স্টান্ডিং কাউন্সিল-এর সমস্ত জারি-জুরি সমস্ত কলা-কৌশল, সমস্ত চ্যালেঞ্জ, সব কিছু যেন পাথরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খসে পড়ে চুরমার। হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত স্টান্ডিং কাউন্সিলও বিপর্যস্ত হলো, সতীও বিপর্যস্ত হয়ে টলে পড়লো উইটনেস-বক্সের ভেতরে।

কোর্ট শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার ঘোষালকে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে নামিয়ে নেওয়া হয়েছে। বার-এট-ল মিস্টার দত্তও চলে গেলেন তাঁর নিজের চেম্বারে। এটর্নী গাঙ্গুলীর তখন ফার্স্ট-এড-এর ব্যবস্থা করবার পালা। কিন্তু তাও বেশিক্ষণ সময় লাগেনি জ্ঞান ফিরতে। এর পরেই চোখ মেলে চারদিকে দেখে আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল সতী। এতটুকুতেই মুষড়ে পড়বার মেয়ে নাকি সে?

মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—চমৎকার বিউটিফুল মিসেস ঘোষ, ওয়েল ডান, খুব ভাল বলেছেন—

সতী বললে—মিস্টার ঘোষাল ছাড়া পাবেন তো?

মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—খুব সম্ভব, তবে জাজমেন্ট এখনও তো বেরোয়নি— এখন আপনি কেমন বোধ করছেন? বাড়ি যেতে পারবেন?

সতী বললে—হ্যাঁ—

—তাহলে চলুন! আমরা পৌঁছে দিচ্ছি আপনাকে!

মিস্টার গাঙ্গুলীর দয়া-মায়াও আছে। মক্কেলের জন্যে মিস্টার গাঙ্গুলীরা অনেক করে থাকেন। পরে সমস্ত বিল হবে মক্কেলের নামে। তাড়াতাড়ি নিজের চেম্বারে বসালেন সতীকে! মাথার ওপর পাখাটাকে আরো জোরে চালিয়ে দিলেন। তারপর এক কাপ কফি এনে দিলেন সামনে। বললেন—আপনার খুব স্ট্রেন হয়েছে বুঝতে পারছি, এটা খেয়ে নিন—ততক্ষণে ট্যাক্সি আসছে—

তারপর মিস্টার গাঙ্গুলী পাশের ঘরে চলে গেলেন। কার সঙ্গে যেন কী সব কথা বলতে লাগলেন।

খানিক পরে এসে বললেন—চলুন, আপনার ট্যাক্সি এসে গেছে—

সতী উঠলো। মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—এক্ষুনি একটা খবর পেলাম ফোনে-

—কী খবর?

—একটা খুব ক্রাইসিস চলছে আপনার শ্বশুর-বাড়িতে—

সতী হঠাৎ ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়েও থেমে গেল। মুখ ফিরিয়ে বললে—আমার শ্বশুরবাড়িতে? কীসের ক্রাইসিস? কারোর অসুখ?

মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—না, আলিপুর কোর্টে আপনার শাশুড়ী নয়নরঞ্জিনী দাসীর নামে একটা কেস-এর ডিক্রী হয়ে গেছে, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটা নীলেম হবে কোর্টে, আপনার শাশুড়ী আমাদের এক বন্ধু-উকিলের কাছে যাতায়াত করছেন—

—কেন? নীলেম হবে কেন?

মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—শুনলাম, অনেক দিন আগে তিনি এক গুজরাটি ভদ্রলোকের কাছে কিছু টাকা ধার করেছিলেন, সেই টাকা এখন সুদে-আসলে এক লাখে দাঁড়িয়েছে, টাকা দিতে পারছেন না তাই বসত বাড়ি নীলেম হচ্ছে—

সতী যেন মনে মনে কী ভাবলে। তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছে ডালহৌসী স্কোয়ার দিয়ে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। শীতকালের সন্ধ্যে। অল্পতেই অন্ধকার হয়ে যায় চারিদিকে। সতীর মনে হলো এ আর এক দুরূহ পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেন অতিক্রম করতে হচ্ছে তাকে।

মিস্টার গাঙ্গুলী অনেক কথা বলছিলেন। বেশির ভাগই মিস্টার ঘোষালের কথা। নির্দোষ মানুষকে কেমন করে অকারণে আইনের কবলে পড়তে হয়। এইসব এটর্নী আর বার-এট-ল আছে বলেই এখনও কলকাতার লোকের গায়ে আঁচ লাগছে না।

সতী হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে—কটা বাজলো?

মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—সাতটা, কেন?

সতী আর কোনও কথা বললে না।

মিস্টার গাঙ্গুলী বললেন—আপনি মিস্টার ঘোষালের জন্যে কিছু ভাববেন না, জাজমেন্ট বেরোলেই আমি আপনাকে খবরটা দেব! আপনি এক্সমাসের ছুটিতে কোথাও যাচ্ছেন নাকি?

নানা অদ্ভুত সব প্রশ্ন করতে লাগলেন মিস্টার গাঙ্গুলী। বেশ বয়েস হয়েছে। যে- বয়েসে চার-পাঁচ ছেলের বাবা হওয়া যায়, মিস্টার গাঙ্গুলীর সেই বয়েস। সতী চুপ করে শুনছিল কথাগুলো। শেষকালে আর পারলে না। বললে—দেখুন মিস্টার গাঙ্গুলী, মিস্টার ঘোষাল ছাড়া পান বা না-পান, তাতে আমার কিছুই আসে যায় না—

—তার মানে?

যেন অবাক হয়ে গেলেন মিস্টার গাঙ্গুলী।

সতী বললে—হ্যাঁ, মিস্টার ঘোষালের ফাঁসি হয়ে গেলেও আমার কিছু যায় আসে না—

মিস্টার গাঙ্গুলী যেন এবার একটু কাছ ঘেঁষে বসলেন। বললেন—আমি কিন্তু অন্যরকম শুনেছিলুম—

—কার কাছে শুনেছিলেন? যার কাছেই শুনে থাকুন, সত্যি কথাটা আমার কাছে শুনে রাখুন, আমি মিস্টার ঘোষালের কেস নিয়ে মোটেই ইন্টারেস্টেড নই—

—অথচ তার জন্যে আপনি আজ এত কষ্ট করলেন?

সতী বললে—কেন যে কষ্ট করতে গেলুম তাও ঠিক জানি না। অথচ তার ফাঁসি হলেই আমি মনে মনে খুশী হতুম বোধ হয় —

মিস্টার গাঙ্গুলী আরো কাছ ঘেঁষে বসলেন। বললেন-আমি আপনার কথা সব শুনেছি, আপনার জন্যে সত্যিই আমার দুঃখ হয় মিসেস ঘোষ—

সতী কিছু উত্তর দিলে না।

মিস্টার গাঙ্গুলী আবার বলতে লাগলেন—আপনার ম্যারেড লাইফ বড় কষ্টকর, সত্যিই আপনার মত মেয়ের জন্যে নতুন করে আইন করা উচিত, কত হিন্দু মেয়ে যে এইভাবে সাফার করছে, আমি তাদের অবস্থা যত দেখছি—মনে মনে তত কষ্ট পাচ্ছি —

সতীর ক্রমেই ভয় করতে লাগলো। একটু সরে বসলো পাশের দিকে। মিস্টার গাঙ্গুলীর স্পর্শের সান্নিধ্য বাঁচিয়ে। একেবারে দরজার গা ঘেঁষে। কিন্তু আর সরে বসবার জায়গা নেই। এতক্ষণে যেন সত্যিই আতঙ্ক হতে লাগলো। তারপর হঠাৎ বললে—আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন আপনি—এখানেই নামবো আমি—

—কোথায়? এখানে কোথায় নামবেন এই সময়ে? এ তো ভবানীপুর।

সতী বললে—হ্যাঁ, এই ভবানীপুরের নামবো, আমি আমার শ্বশুরবাড়িতেই যাবো, প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে—

তবু যেন মিস্টার গাঙ্গুলী বিশ্বাস করতে চাইলেন না। বললেন—আপনি সত্যিই আপনার শ্বশুরবাড়িতে যাবেন?

সতী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলে। বললে—কেন? আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?

—কিন্তু এত কান্ডের পরেও আপনি এখানে যাবেন! মিস্টার ঘোষালের কাছে যে আমি সব শুনেছি আপনার সম্বন্ধে!

সতী বললে—আপনি মিছে কথা শুনেছেন-মিস্টার ঘোষাল একজন মিথ্যেবাদী, লায়ার—আপনাকে সব মিথ্যে কথা বলেছেন—

যেন প্রকান্ড একটা চড় এসে পড়ল মিস্টার গাঙ্গুলীর গালে।

সতী আবার বললে—আমার স্বামীর নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে আপনার কাছে, আমার স্বামীকে আপনি চেনেন না, ও-রকম স্বামী কোনও মেয়ে পায় না—তা জানেন? মিস্টার গাঙ্গুলী যেন কেঁচোর মত কুঁকড়ে গেলেন এক মুহূর্তে। এতদিন কেস চলছে, এতদিন এই কেস-এর সূত্রেই মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে নানা কথা শুনে এসেছেন মিস্টার গাঙ্গুলী ভেবেছিলেন এই সুযোগে হয়ত একটু ঘনিষ্ঠতা হবে মিসেস ঘোষের সঙ্গে। কলকাতা শহরে এরকম অনেক মিসেস ঘোষ আছে। মিস্টার গাঙ্গুলীরাই সেইসব মিসেস ঘোষদের ভরণ-পোষণ করে আসছেন। কিন্তু এ যেন অন্য রকম। এ মিসেস ঘোষ যেন আলাদা জাতের। মিস্টার গাঙ্গুলী ভয়ে ট্যাক্সির মধ্যে শিঁটিয়ে উঠলেন। যে মিসেস ঘোষ কোর্টে সাক্ষী দেবার সময় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সেই মিসেস ঘোষ যেন নয় এ। এ যেন ফণাওয়ালা কেউটে।

—এখানে গাড়িটা দাঁড় করান। দাঁড় করান—

মিস্টার গাঙ্গুলী আর প্রতিবাদ করলেন না। ট্যাক্সি থামাতে হলো হাজরা রোডের মোড়ে। ইঁদুরের গর্ত মনে করে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখন ছোবল খেতে হয়েছে নিজের দোষে। বললেন-আচ্ছা নমস্কার—

রাস্তার অন্ধকারে মিসেস ঘোষকে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর সতীও চলে যাওয়া ট্যাক্সিটার দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ! লোকটা যেন ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে গেল! নিজের ওপরও রাগ হলো সতীর। তার ওপরে কেন এতখানি সাহস পায় সবাই! তার সিঁথিতে সিঁদুর জ্বল জ্বল করছে, তবু এতখানি অপমান করবার দুঃসাহস কেমন করে হয় ওদের! এর জন্যে কে দায়ী? সে না তার স্বামী!

পায়ে পায়ে অনেকখানি চলে এসেছিল প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ভেতরে। রাস্তাটা এই শীতের অন্ধকারে জনবিরল হয়ে এসেছে। এত অপমানের পরেও কেন সে যাচ্ছে আবার? কেন যাচ্ছে এমন কাঙালের মত? হয়ত এখানে নামবার দরকারই হতো না তার। হয়ত সোজাই চলে যেত সে গড়িয়াহাটের বাড়িতে! হয়ত মিস্টার গাঙ্গুলী অমন ব্যবহার না করলে এখানে নেমে পড়বার প্রয়োজনীয়তা এমন অনিবার্য হয়ে উঠতো না। তা হোক, ভালোই হলো। মন্দের ভালো! সতী মনে মনে ধন্যবাদ দিলে মিস্টার গাঙ্গুলীকে। মন্দের মধ্যেও এমনি করে মাঝে মাঝে ভালোর উদয় হয় হয়ত।

—বৌদিমণি!

যেন ধরা পড়ে গেছে এমনি করে ছিটকে উঠলো সতী! কৈলাস! কৈলাস দৌড়ে এসেছে কাছে। এসেই গড় হয়ে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলে।

—কী খবর তোমাদের, কৈলাস?

—তুমি কখন এলে বৌদিমণি? বাড়িতে ঢুকেছিলে?

সতী বললে—না, একটা কাজে এসেছিলাম এদিকে, এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি! তোমরা সব ভালো? শম্ভু কোথায়?

কৈলাস বললে—শম্ভু তো মা-মণির সঙ্গে উকিলবাড়ি গেছে, এইবার ফিরে আসবে, আপনি চলুন না, দাদাবাবু আছেন ভেতরে—

সতী বললে—না, এখন রাত হয়েছে অনেক, আর ভেতরে যাবো না—

কৈলাস বললে—শুনেছেন তো আমাদের এ-বাড়ি নীলেম হয়ে যাচ্ছে, এক লাখ টাকার দায়ে, মা-মণি উকিলবাড়ি আর ঘর করছে কেবল!

—কিন্তু কেন নীলেম হচ্ছে, তা কিছু জানো তুমি?

কৈলাস বললে—আপনাকে কত হেনস্থা করেছে মা-মণি তা তো আমরা জানি বৌদিমণি, মাথার ওপর ভগমান বলে তো একজন আছে, বাতাসীর-মা বলছিল, ভগমানের দিষ্টিতে কিছুই এড়ায় না রে, কিছুই এড়ায় না। চিত্তগুপ্তের খাতায় সব লেখা থাকে—

সতী বললে—তুই থাম্, ভগবান বলে কেউ নেই কোথাও, ও-সব বাজে কথা— কৈলাস আঁতকে উঠলো। বললে—তুমি বলো কি বৌদিমণি, ভগমান না-থাকলে আজকে মা-মণির এই দশা হয়? মা-মণির মুখের চেহারাটা তো তুমি আর দেখ নি! পেয়াদা যখন নীলেমের নুটিশ নিয়ে এল, তখন আমরা সব্বাই দেখিচি—! তুমি চলো, একটিবার দাদাবাবুর সঙ্গে দেখা করবে চলো—

সতীর তবু যেন কেমন দ্বিধা হতে লাগলো। বহুদিন আগে আর একবার এমনি ভেতরে ঢুকে কী বিপর্যয় ঘটেছিল, তাও মনে ছিল। কৈলাস বললে—বাতাসীর-মা কী বলে জানো বৌদিমণি?

—কী বলে কৈলাস?

—তুমি পালাগান শুনেচ বৌদিমণি? রামায়ণের পালাগান?

—হ্যাঁ, কালিঘাটে যখন থাকতুম শুনেছি। কেন?

—বাতাসীর-মা বলে বৌদিমণি আমাদের সেই জনক-নন্দিনী সতীলক্ষ্মী সীতা!

সতী এবার হেসে ফেললে। কৈলাসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললে— বাতাসীর-মা আমাকে ভালবাসে কি না তাই এই কথা বলেছে! কোথায় সীতা আর কোথায় আমি! দূর! ভগবান নিয়ে ও-সব কথা বললে পাপ হয়, জানিস না?

কৈলাস বললে—সত্যি বৌদিমণি, তোমার নামে যখন সব্বাই দোষ দেয়, তখন আমাদের তাই-ই মনে হয়—

—কে দোষ দেয় রে আমার নামে?

—কে আবার দেয় না, সব্বাই দেয়! সেদিন তোমার আপিসের একজন সাহেব এসে তোমার নামে যাচ্ছেতাই করে বদনাম দিয়ে গেল।

সতী বুঝতে পারলে না। বললে—কে? কী বললে সে?

—বললে, তুমি নাকি দীপুবাবুর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছো, তোমাকে ফুলিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে দীপুবাবুকে নাকি পুলিসে ধরেছে, এই সব কথা!

সতী আবার জিজ্ঞেস করলে-কে বললে রে এ-সব কথা? আমাদের আপিসের ঘোষাল-সাহেব?

—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই নামই হবে। কী সব মিথ্যে কথাই গড় গড় করে শুনিয়ে গেল মা- মণিকে। মাথার ওপর ভগমান নেই ভাবছো? নিশ্চয়ই আছে বৌদিমণি, নিশ্চয়ই আছে, নইলে আদালত থেকে কেন নুটিশ আসে মা-মণির নামে? সতী-লক্ষ্মীর নামে বদনাম দিলে ভগমান কদ্দিন সইবে? ভগমানের তো সহ্যের একটা সীমে আছে বৌদিমণি!

হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল সতী! কেন মিস্টার ঘোষাল এসেছিল তার নামে কলঙ্ক রটাতে এখানে! যার জন্যে আজ কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দিয়ে এল, যার প্রাণ বাঁচিয়ে এল, সেই মিস্টার ঘোষাল এসেছিল এখানেও? এখানে এসে তার সর্বনাশ করতে চেয়েছিল?

—তুমি ঠিক জানো ঘোষাল-সাহেব এসেছিল? কী রকম চেহারা বলো তো?

কৈলাস চেহারাটার যেমন বর্ণনা দিলে, ঠিক তেমনি। মিস্টার ঘোষালের চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল।

—তুমি ঠিক বলছো কৈলাস? মিস্টার ঘোষাল আমার নামে এইসব কথা বলে গেল এখানে এসে?

কিন্তু কৈলাস হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। বললে—ওই মা-মণি আসছে বৌদিমণি। উকীলবাড়ি থেকে মা-মণি আসছে—সরে এসো ইদিকে। সরে এসো, বুড়ী দেখতে পাবে তোমাকে—

সেই অন্ধকার ব্ল্যাক-আউটের রাত্রে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের গলির ভেতর দাঁড়িয়ে, সতী আর কৈলাস একটা বাড়ির পাঁচিলের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করলে। আর ট্যাক্সিতে পেছনের সীটে বসে ছিল নয়নরঞ্জিনী দাসী, আর সামনের সীটে শম্ভু। গাড়িটা সোজা গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়লো।

কৈলাস বললে—আজ মা-মণির পুণ্যিমের নিশিপালন কি না, তাই সন্দেশ কিনতে গিয়েছিলুম, বুড়ীর এদিক্ নেই ওদিক্ আছে কিন্তু —

সতীর বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। এখানেও এসেছিল মিস্টার ঘোষাল? এখানে এসেও তার নামে অপবাদ দিয়ে গিয়েছে। এখুনি যার প্রাণ বাঁচিয়ে এল আজ, নিজের চরিত্রে চরম অপবাদ টেনে নিয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যাকে নির্দোষ বলে ঘোষণা করে এল, সে? সে-ই এখানে এসেছিল? সেই মিস্টার ঘোষাল?

খালি ট্যাক্সিটা প্যাসেঞ্জার নামিয়ে আবার গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় এসে পড়লো। তারপর মোড় ঘুরে হাজরা রোডের দিকে চলে গেল নিঃশব্দে। সতী আর কৈলাস আড়াল থেকে বেরিয়ে এল।

সকল অধ্যায়

১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১
২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২
৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩
৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪
৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫
৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬
৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭
৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮
৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯
১০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০
১১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১১
১২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১২
১৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৩
১৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৪
১৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৫
১৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৬
১৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৭
১৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৮
১৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৯
২০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২০
২১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২১
২২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২২
২৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৩
২৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৪
২৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৫
২৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৬
২৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৭
২৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৮
২৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৯
৩০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩০
৩১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩১
৩২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩২
৩৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৩
৩৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৪
৩৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৫
৩৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৬
৩৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৭
৩৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৮
৩৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৯
৪০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪০
৪১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪১
৪২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪২
৪৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৩
৪৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৪
৪৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৫
৪৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৬
৪৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৭
৪৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৮
৪৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৯
৫০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫০
৫১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫১
৫২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫২
৫৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৩
৫৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৪
৫৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৫
৫৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৬
৫৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৭
৫৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৮
৫৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৯
৬০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬০
৬১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬১
৬২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬২
৬৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৩
৬৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৪
৬৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৫
৬৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৬
৬৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৭
৬৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৮
৬৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৯
৭০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭০
৭১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭১
৭২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭২
৭৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৩
৭৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৪
৭৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৫
৭৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৬
৭৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৭
৭৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৮
৭৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৯
৮০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮০
৮১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮১
৮২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮২
৮৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৩
৮৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৪
৮৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৫
৮৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৬
৮৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৭
৮৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৮
৮৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৯
৯০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯০
৯১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯১
৯২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯২
৯৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৩
৯৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৪
৯৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৫ উপসংহার
৯৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৬
৯৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৭
৯৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৮
৯৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৯
১০০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০০
১০১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০১
১০২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০২
১০৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০৩
১০৪. নির্ঘণ্ট : কড়ি দিয়ে কিনলাম – ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন