বিমল মিত্র
কলকাতার সেই ছোটবেলাকার জীবন, সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের শিশুটি যেন এতদিনে এত বয়েস হবার পরেও তার পরম শিশুত্বটিকে জোর করে আঁকড়ে ধরে আছে। গাড়িতে সনাতনবাবুর সঙ্গে যেতে যেতে দীপঙ্করের হঠাৎ সেই কথাই মনে হলো! এক-এক সময় এমন অদ্ভুত কথাও মনে উদয় হয়! ছোটবেলায় দীপঙ্করের মা’র পয়সা ছিল না। খেলনা কিনে দিতে পারেনি তাকে। পরের ছেলেদের খেলনার দিকে উৎসুক চোখে চেয়ে থাকতো দীপঙ্কর। চন্ডীবাবুর নাতি খেলনা নিয়ে চাকরের সঙ্গে বিকেল বেলা পার্কে বেড়াতে যেত। হাতে থাকতো বল্। কখনও লাট্টু, কখনও গুতি, কখনও ঘুড়ি। এক পয়সার একটা একতেল ঘুড়ি। তাও মা কখনও কিনে দেয়নি। কিরণ আর দীপঙ্কর সেদিকে শুধু হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দেখেছে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
কিন্তু তবু কি খেলনা পায়নি দীপঙ্কর?
তখন দীপঙ্করের খেলনা ছিল আকাশের মেঘ, আকাশের চাঁদ, আকাশের তারা। তারাপর খেলনা হলো কালীঘাটের রেলগাড়ি, ভবানীপুরের হলদে রং-এর ট্রাম, সোনার কার্তিকের ঘাটের সাধু, কালীবাড়ির ঠাকুর, আর তারপর বয়েজ ওন্ লাইব্রেরী। এমনি কত খেলনা দীপঙ্কর নিজেই খুঁজে নিয়েছে। দিনে রাতে কত খেলনাই বুকে আঁকড়ে ধরেছে। চন্ডীবাবুর নাতির মতন কত কল্পনা কত ভাবনার খেলনাই না বুকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা তক্তপোশের ওপর মা’র পাশে শুয়ে রাত কাটিয়েছে। একটা পয়সাও খরচ হয়নি মা’র। চন্ডীবাবুর নাতির মত একটা খেলনাও তার ছিঁড়ে যায় নি, ভেড়ে যায় নি, হারায়নি! সব মনের আলমারির তাকে থাকে-থাকে সাজানো আছে।
আর তারপরেই এসেছে লক্ষ্মীদি! লক্ষ্মীদিও তো তার জীবনে আর এক রকমের এক খেনা!
আর শুধু লক্ষ্মীদিই বা কেন? সতীও তো একটা খেলনা তার। সতী লক্ষ্মীদিকে নিয়ে সে তো এখনও এক বিচিত্র খেলাই খেলে চলেছে। এই যে সনাতনবাবুকে নিয়ে চলেছে, এও তো এক খেলা! ছোটবেলায় খেলনা পায়নি বলেই কি বড় বয়স পর্যন্ত খেলনা নিয়ে মেতে আছে সে না কি ছোটবেলার খেলানার অভাবের খেসারত এমনি করেই শোধ করছে? কে জানে!
কিন্তু হঠাৎ মনে হলো—না, তা তো নয়! তাও তো নয়।
ট্যাক্সিটা তখন হু হু করে ছুটে চলেছে রাসরিহারী এভিনিউ ধরে। সনাতনবাবু চুপ করে বসে আছেন সামনের দিকে চেয়ে। দীপঙ্কর তাঁর দিকে চেয়ে দেখলে! সে-মুখে কোথাও উদ্বেগ নেই, কোনও কৌতূহল নেই, কোনও অভাববোধ নেই। এমন কি কোনও অভিযোগও নেই। বড় রাগ হলো দীপঙ্করের। বড় ঘৃণা হলো সনাতনবাবুর ওপর। এ কী অদ্ভুত মানুষ। তাহলে যত উদ্বেগ, যত অভাববোধ যত অভিযোগ কি সবই দীপঙ্করের একলার! হঠাৎ দীপঙ্করের ইচ্ছে হলো এখনি সে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ে। সনাতনবাবু, সতী, লক্ষ্মীদি যেখানে ইচ্ছে যাক, যা কিছু করুক, জাহান্নমে যাক্, তাতে দীপঙ্করের কিছু এসে যায় না।
দীপঙ্কর চীৎকার করে উঠলো—থামাও, ট্যাক্সি থামাও—
কেন এত ভাবনা সে একলা ভাবতে যাবে? কীসের দায় তার? কে সে? নয়নরঞ্জিনী দাসীর বাড়ি যদি নীলেমই হয়ে যায় কোর্টে, যদি তাদের রাস্তায়ই এসে দাঁড়াতে হয়, তাতে তার কী? যদি ফোঁটা সত্যি-সত্যিই একদিন কালীঘাটের কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টই হয়ে যায় তাতে তারই বা কী ক্ষতি? যদি কিরণের ফাঁসিই হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত, তাতে দীপঙ্করের কীসের লোকসান? সন্তোষ-কাকার মেয়ের বিয়ে হলো বা না-হলো তাতে তার তো কিছু এসে যায় না। আর মিস্টার ঘোষাল যদি কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে আবার আপিসে এসে ডি-টি-এস হয়েই বসে, তাতেই বা তার কী? সে এত ভাবনা ভাবতে যাবে কেন? সবাই ব্ল্যাক-মার্কেট করুক, সবাই জোচ্চোর মিথ্যেবাদী জালিয়াৎ হোক, পৃথিবী রসাতলে যাক্, তার এত ভাবনা ভাববার কীসের দায়? ইন্ডিয়া স্বাধীন হোক না-হোক তাতে তার কি এল-গেল?
—থামাও, ট্যাক্সি থামাও—
দীপঙ্কর হঠাৎ যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো। সে এই সারাদিন আপিসে অক্লান্ত খাটুনির পর কেন চলেছে সতীর কাছে? সনাতনবাবুর সঙ্গে সতীর বিবাদ মিটিয়ে দিয়ে কোন্ উপকারটা হবে তার? কেন সে এল এমন করে?
দীপঙ্কর আবার চীৎকার করে উঠলো—সনাতনবাবু, সনাতনবাবু —
কিন্তু আশ্চর্য, সনাতনবাবু তেমনি নির্বিকার, তেমনি উদ্বেগহীন, অভিযোগহীন দৃষ্টি দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছেন। ট্যাক্সি-ড্রাইভারও একমনে গাড়ি চালিয়ে চলেছে। কেউ তার কথা শুনতে পাচ্ছে না। কেউ তার কথায় কান দিচ্ছে না। সে যেন সকলের কাছে একজন বয়স্ক শিশু। কেউ তার কথায় আমল দিচ্ছে না। এই সংসার, এই কলকাতা শহর, এই বাঙলা দেশ, এই পৃথিবী, এই গ্রহ নক্ষত্র সব কিছু এই ট্যাক্সিটার মতই দুর্দম বেগে ছুটে চলেছে সামনের দিকে। দীপঙ্করের এত বাধা-নিষেধ সাবধান-বাণীতে কেউ কান দিচ্ছে না। কেউ কান দেবেও না যেন। দীপঙ্করের ইচ্ছে সত্ত্বেও সব কিছু এমনি করেই যেন অনন্তকাল ধরে চলবে!
হঠাৎ ট্যাক্সি-ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলে—এবার কোন্ দিকে যেতে হবে স্যার?
দীপঙ্করের হঠাৎ খেয়াল হলো, না, সে তো চুপ করেই বসে আছে গাড়িতে। সে তো কই ডাকেনি কাউকে। সনাতনবাবুকেও ডাকেনি, ট্যাক্সি-ড্রাইভারকেও ট্যাক্সি থামাতে বলেনি। তবে কি এ তার মনের ভুল! মনের উত্তেজনা! কেন সে এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল! কেন সে এমন অদ্ভুত আচরণ করেছিল মনে মনে! সেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড থেকে বেরিয়ে সে তো এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি কারোর সঙ্গে। সনাতনবাবুও বলেন নি। সমস্ত সময়টা তো এতক্ষণ নিঃশব্দেই কেটেছে।
আর তারপরেই দীপঙ্করের হাসি পেতে লাগলো! আশ্চর্য! এতদিন কথাটা সে তো ভাবেওনি। সতী, লক্ষ্মীদি, সনাতনবাবুই শুধু তার খেলনা নয়! কিরণ, ছিটে-ফোঁটা, সন্তোষকাকা, মিস্ মাইকেল, ক্ষীরোদা, গাঙ্গুলীবাবু, প্রাণমথবাবু, নির্মল পালিতকে নিয়ে সে একলাই শুধু খেলেনি। দীপঙ্কর নিজেও যেন আর একজন দীপঙ্করের অপরিহার্য খেলনা। আর একজন অদৃশ্য দীপঙ্কর যেন এই আকাশের সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে দীপঙ্করকেও তার এক খেলনা বানিয়ে নিয়েছে। দীপঙ্করের মত সেই অদৃশ্য দীপঙ্করও যেন বড় নিঃস্ব, নিঃসহায়, নিঃসম্বল। তারও কেউ নেই, কিছু নেই। সব কিছু থেকেও সেই অদৃশ্য অসহায় দীপঙ্কর যেন খেলনা ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাই উঠতে বসতে দীপঙ্করকে নিয়ে এত নাড়া-চাড়া করে। কখনও বুকে তুলে নেয়, কখনও লাথি মারে, কখনও আনন্দ পায়, কখনও আবার নিজে খেলনা ভেঙে ফেলে নিজেই হাহাকার করে ওঠে!
হঠাৎ লেভেল-ক্রসিং-এর গেটটা বন্ধ হয়ে গেল।
টিং টিং করে একনাগাড়ে ঘন্টি বেজে চললো।
গুমটি-ঘরের জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ভূষণ বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে গেটটা ঠিক পড়েছে কি না। লাল বাতিটা ঠিক জ্বলছে কি না। সাউথ কেবিন থেকে কেবিনম্যান করালীবাবু সিগন্যালটা ঠিক ফেলেছে কি না। আপ ট্রেন আসছে। থাট্টি-থ্রি আপ। হুঁশিয়ার! হুঁশিয়ার সবাই!
সনাতনবাবু আর দীপঙ্করকে নিয়ে ট্যাক্সিটা সোঁ সোঁ করে এসে বদ্ধ গেটটার সামনে ব্রেক কষলো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন