কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৫

বিমল মিত্র

ট্যাক্সির মধ্যে সতী চুপ করে বসেছিল। সার্কুলার রোড, ল্যান্সডাউন রোড পেরিয়ে হাজরা রোড। সতী যেন হাজরা রোডটা চিনতে পেরেছে। এই হাজরা রোডের পশ্চিম প্রান্তেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। বড় ঘন হয়ে বসেছে সতী। বাইরে অন্ধকার, জোলো হাওয়া। মাঝে মাঝে আকাশে এরোপ্লেনের পরিক্রমা আর ট্যাক্সির ভেতরে নীরব সান্নিধ্য। সতী হঠাৎ কথা বললে—এটা কোন্ রাস্তা দীপু? হাজরা রোড, না?

দীপঙ্কর শুধু বললে—হ্যাঁ—

হাসপাতাল থেকেই ট্যাক্সি করে নিয়েছিল। সতীর দুর্বল স্বাস্থ্য যেন এই একদিনেই আরো দুর্বল হয়ে গেছে। দীপঙ্কর নিজে হাত ধরে তুলে নিয়েছিল। বড় দুর্বল, বড় পাতলা হাত দু’টো সতীর। এই ক’দিন চাকরি করেই এত দুর্বল হয়ে গেছে ভাবতে পারা যায় না। প্রথমটায় অনেকক্ষণ কোনও কথাই বলেনি সতী। বাবার মৃত্যুর খবরটা দিতেই সতী যেন শিশুর মত কাতর হয়ে উঠেছিল। তারপর বলেছিল—ওঁকে তুমি নিজে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে নাকি দীপু

—কাকে?

প্রশ্নটা করেই দীপঙ্কর বুঝতে পেরেছিল। বলেছিল—সনাতনবাবুর কথা বলছো? তিনি হতাশ হননি। তিনি হতাশ হন না কখনও—

—আচ্ছা সত্যি বলো তো দীপু, উনি অমন কেন?

—কী রকম?

—আচ্ছা, তুমিই বলো তো, একটু সাধারণ হতে পারেন না উনি? অত অসাধারণ স্বামী হলে মেয়েমানুষের ভাল লাগে, তুমিই বলো? একটু হাসি-ঠাট্রা-গল্প এসব কি করতে পারেন না কখনও? একটু কি আমার সঙ্গে বসে সাধারণ রসিকতা করতে পারেন না? আমি কি ওঁর তুলনায় এতই ছোট?

দীপঙ্কর বললে—তা বলে সনাতনবাবুকে তুমি ভুল বুঝো না সতী!

—কিন্তু এত লোক তো পৃথিবীতে আছে, আর কেউই তো ওঁর মত নয়। মুখটা সব সময় গম্ভীর-গম্ভীর, যেন অনেক উঁচু জগতে বাস করেন উনি, অনেক উঁচু স্তরের মানুষ আমার কথা ভাববারই যেন সময় নেই ওঁর—

দীপঙ্কর সান্ত্বনা দিয়েছিল। বলেছিল—ও তোমার নিজের মনের ভুল! ওঁকে বাইরে থেকে দেখে বিচার করতে যেও না তুমি—

—কিন্তু বাইরেটাই কি মিথ্যে হলো দীপু? বাইরেটাই কি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিতে পারে মানুষ?

তারপর সেই কথার জের টেনেই সতী বলে যেতে লাগলো—আমি নিজে তো একজন সাধারণ মেয়েমানুষ, তাই আমি একজন সাধারণ স্বামীই চেয়েছিলুম দীপু, আমি তো শো-কেসে সাজিয়ে রাখবার জন্যে বিয়ে করিনি—আমি চেয়েছিলুম আমার স্বামীকে আমি ভালবাসবো, স্বামী নিয়ে নাড়বো-চাড়বো, তাঁকে নিয়ে হাসবো-কাঁদবো, স্বামী হবে আমার রোজকার ব্যবহারের সামগ্রী—

দীপঙ্কর বললে—তুমি জানো না সতী, তোমার স্বামী সেই সাধারণ মানুষই, অসাধারণ নয়। তোমার জন্যে তাঁরও দুঃখ হয়, তোমার জন্যে তাঁরও ভাবনা হয়, তোমার জন্যে তাঁরও মনে অশান্তি হয় —

—কিন্তু কই, আমি বকলে তিনি তো রাগ করেন না?

—রাগ করা তো সহজ সতী, রাগ তো সবাই করতে পারে।

—সেই সবাই যা পারে তা উনি পারেন না কেন? কেন উনি অন্য সকলের মত হতে পারেন না? যেমন আর পাঁচজন। কেন উনি আলাদা?

দীপঙ্কর এ কথার জবাব দিতে পারলে না। সতী আবার বললে—তুমিও তো একজন পুরুষ-মানুষ দীপু, কেন উনি তোমার মতও হতে পারলেন না?

দীপঙ্কর বললে—আমার কথা ছেড়ে দাও সতী, আমি কেউ না—

এরপরই হঠাৎ হাজরা রোডটা আসতে সতী জিজ্ঞেস করলে—এটা হাজরা রোড, না?

দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—এইদিকেই সনাতনবাবুর বাড়ি, যাবে তুমি?

সতী বললে—না, প্রার্থনা করো দীপু, যেন এ জীবনে আর কখনও ও-বাড়িতে না যেতে হয়—যেন ওঁদের মুখ দেখতে না হয় কখনও—

গাড়িটা ল্যান্সডাউন রোড পেরিয়ে রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে পড়লো। সতী একবার দীপঙ্করের দিকে চেয়ে দেখলে। বললে—কথা বলছো না যে দীপু? কী ভাবছো?

দীপঙ্কর বললে—ভাবছি আমার এক বন্ধুর কথা—তুমি তাকে চেনো—

—কে?

—কিরণ। সনাতনবাবুর মত তাকেও কেউ চিনলে না। তাকেও বাইরে থেকে দেখে সবাই বিচার করেছে। তার বাবা চিনতে পারেনি, তার মা চিনতে পারেনি। পাড়ার লোকেরাও কেউ চিনতে পারেনি। তোমরাও তাকে ঘেন্না করেছ। কাকাবাবুও তাকে দেখতে পারতেন না। অথচ আমি তো জানি সে কী! সে গরীব, সে লেখাপড়া জানে না ভালো, ম্যাট্রিকও পাশ করেনি। অথচ দেখো, আমাদের বাড়িতে সেই ছিটে-ফোঁটা থাকতো—তারাই আজ দেশের মস্ত গণ্যমান্য লোক হয়ে উঠেছে—! মানুষকে বাইরে থেকে বিচার করার মত ভুল আর নেই, এইটেই আমি সারা জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি—

সতী কিছু কথা বললে না। অন্ধকার ব্ল্যাক-আউট ভেদ করে গাড়িটা গড়িয়ে চলেছে। গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর কাছে আসতেই। সতী বললে—তার চেয়ে তোমার বাড়িতেই নিয়ে চলো আমাকে দীপু—আমি তোমার কাছেই আরামে থাকবো—

দীপঙ্কর কিছু প্রতিবাদ করলে না। শুধু মুখে বললে—ছি—

তারপর হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই সতী অবাক হয়ে গেল। কোন্ বাড়িটা? এইটে নাকি?

বাড়িটার বাইরে আলো নেই। ব্ল্যাক-আউটের গরজে বাইরে থেকে অন্ধকার। তবু বোঝা যায় নতুন ডিজাইনের ফ্যাশানেবল বাড়ি। জানালা, দরজা, গ্রিল, পেন্টিং, এলিভেশন সবই চমৎকার। সতী অবাক হয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো! এত বড় বাড়ি? এত বড় বাড়ি লক্ষ্মীদির? এ কেমন করে হলো? কার টাকায় হলো? লক্ষ্মীদির এত টাকা? এত টাকা কী করে উপায় করলে লক্ষ্মীদি? কীসের ব্যবসা?

দীপঙ্কর বললে—নেমে এসো সতী—

সতী তখনও চেয়ে চেয়ে দেখছে অবাক হয়ে। বললে—এত টাকা লক্ষ্মীদির কী করে হলো দীপু?

দীপঙ্কর বললে—পরে বলবো, তুমি এসো—

সকল অধ্যায়

১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১
২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২
৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩
৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪
৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫
৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬
৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭
৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮
৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯
১০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০
১১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১১
১২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১২
১৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৩
১৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৪
১৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৫
১৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৬
১৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৭
১৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৮
১৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৯
২০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২০
২১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২১
২২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২২
২৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৩
২৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৪
২৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৫
২৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৬
২৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৭
২৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৮
২৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৯
৩০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩০
৩১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩১
৩২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩২
৩৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৩
৩৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৪
৩৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৫
৩৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৬
৩৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৭
৩৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৮
৩৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৯
৪০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪০
৪১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪১
৪২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪২
৪৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৩
৪৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৪
৪৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৫
৪৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৬
৪৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৭
৪৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৮
৪৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৯
৫০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫০
৫১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫১
৫২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫২
৫৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৩
৫৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৪
৫৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৫
৫৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৬
৫৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৭
৫৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৮
৫৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৯
৬০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬০
৬১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬১
৬২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬২
৬৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৩
৬৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৪
৬৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৫
৬৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৬
৬৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৭
৬৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৮
৬৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৯
৭০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭০
৭১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭১
৭২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭২
৭৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৩
৭৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৪
৭৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৫
৭৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৬
৭৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৭
৭৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৮
৭৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৯
৮০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮০
৮১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮১
৮২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮২
৮৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৩
৮৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৪
৮৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৫
৮৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৬
৮৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৭
৮৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৮
৮৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৯
৯০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯০
৯১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯১
৯২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯২
৯৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৩
৯৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৪
৯৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৫ উপসংহার
৯৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৬
৯৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৭
৯৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৮
৯৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৯
১০০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০০
১০১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০১
১০২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০২
১০৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০৩
১০৪. নির্ঘণ্ট : কড়ি দিয়ে কিনলাম – ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন