বিমল মিত্র
সেই বিয়াল্লিশ সালের আগস্ট মাসের শেষ তারিখে আবার ভোর হলো কলকাতায়। বড় নিঃসঙ্গ, বড় নির্জন, বড় নতুন ধরণের সে ভোর। সেদিন অন্য দিনের চেয়ে এক ঘন্টা আগে ভোর হলো কলকাতা শহরে। আগে বেঙ্গল-টাইম ছিল, ক্যালকাটা টাইম ছিল। তার পর স্ট্যান্ডার্ড টাইম হয়েছিল। এবার হলো নিউ-স্ট্যান্ডার্ড-টাইম। চারটের সময়েই পাঁচটা বাজবে। অর্থাৎ যাতে বিকেল চারটের সময় সবাই আপিসের কাজ থেকে ছুটি পায়। সকাল-সকাল ছুটি হলে সকাল-সকাল বাড়িতে পৌঁছোতে পারবে ক্লার্করা। রাত্রিটাতেই তো ভয়। রাত্রিতেই তো জাপানীরা আসবে। তারপর সন্ধ্যের অন্ধকারের সঙ্গে টেলিফোনের তার কেটে দেবে, ইলেকট্রিক লাইটের লাইন কেটে দেবে। ঢিল ছুঁড়বে, বোমা ছুঁড়বে মিলিটারি লরীর ওপর। তখনই বাস-ট্রাম বন্ধ হয়ে যাবে। তখন দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে বসে থাকে সবাই। কিন্তু এ তো কলকাতার কথা। কলকাতার বাইরে মেদিনীপুরেও তখন আর এক নতুন গভর্নমেন্টের রাজত্ব শুরু হয়েছে। ২১ শে আগস্ট থেকে কলকাতার সব খবরের কাগজ বন্ধ। কেউ আর কোনও খবর জানতে পারে না। আনন্দবাজার, বসুমতী, যুগান্তর, অমৃতবাজার—কলকাতার পনেরখানার মধ্যে এগারখানা খবরের কাগজ।
নেপাল ভট্টাচার্যি স্ট্রীটে মধুসূদনদের রোয়াকে আড্ডা বসে ভোর বেলা। কিন্তু খবরের কাগজ না-থাকলে আড্ডা যেন আর জমে না। দুনিকাকা বলে—শালারা এবার সবংশে নিধন হবে ভাই, শালারা নিজেরাও মরবি, আমাদেরও মারবি।
পঞ্চা বলে—মেদিনীপুরে কী হয়েছে শুনেছ তো? কংগ্রেসের ভলান্টিয়াররা নিজেরা থানা চালাচ্ছে, জেলখানা চালাচ্ছে, পোস্টাফিস চালাচ্ছে—
দুনিকাকা বলে—আর গুল মারিস নি তুই পঞ্চা, তোর পায়ে ধরছি ভাই। ও-সব আমার কাছে বলতে আসিস নি, জানিস—ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট কচি খোকা নয় রে, কচি খোকা নয়। এ রাম-টিপুনি দিলে তোদের গান্ধী বাপ্ বাপ্ বলে ককিয়ে উঠবে—
মধুসূদনের বড়দা বললেনা দুনিকাকা, আমিও আমাদের আপিসে শুনেছি— বেহারে নাকি বড় বড় সব দোকান সোল্জার আর পুলিসরা মিলে লুটপাট করেছে—
দুনিকাকা আর বেশিক্ষণ থাকতে পারতো না আড্ডায়। বলতো—সব গুল্ তোদের, সব গুল্—
সমস্ত রাত কলকাতার রাস্তাতেও হট্টগোল চলে। কিন্তু সকাল বেলা সব থমথমে ভাব। তখন কিছুক্ষণের জন্যে সবাই শেষ রাত্রের মত ঘুমোয়। নিউ স্ট্যান্ডার্ড টাইম চালু হবার পর আরো ভোরে সকাল হয়। আরো সকালে আড্ডাটা বসে রোয়াকের ওপর। খবরের কাগজ নেই—শুধু গুজবের ওপর নির্ভর করে আড্ডা চালিয়ে যেতে হয়। শরৎ বোসকে ত্রিচিনাপল্লির জেলে পুরে লাঠি পেটা করেছে, সুভাষ বোস রেডিওতে কী কী লেকচার দিয়েছে, এই সব। শ্যামাপ্রসাদ মুখুজ্জে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবে। গুজবের শেষ নেই যেন লোকের মুখে। আর জাপান? জাপানীরা তো এল বলে!
এক ঘন্টা আগে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডেও ভোর হয়। সনাতনবাবু সকালে উঠেই খবরের কাগজ পড়তে যান। কিন্তু কাগজ নেই। খবরের কাগজ নেই।
সনাতনবাবু শম্ভুকে জিজ্ঞাসা করেন—হ্যাঁরে, কাগজ আসেনি আজ?
—আজ্ঞে না তো!
ন’দিদি টেলিফোন করে—নয়ন, কেমন আছিস? নয়নরঞ্জিনী দাসী বলেন—তুমি এত সকালে যে?
—সেজবৌমার যে ছেলে হলো রে, তাই আর যেতে পারিনি তোর কাছে! এখন তোর ছেলের মতি-গতি কেমন?
নয়ন জিজ্ঞেস করে—সেই দু’দিন সবুর কর বাছা, আমি সব ঠিক করে ফেলেছি, বাগবাজারের মিত্তির-বাড়ির বড় মেয়ে. দেবে থোবে ভাল, মেয়ে লেখা-পড়া তেমন জানে না, কিন্তু একেবারে ডানা-কাটা-পরী। আমি বৌমার আঁতুড়টা তুলেই তোকে নিয়ে মেয়ে দেখতে যাবো বুঝলি, কিছু ভাবিস্ নি যেন তুই—
স্টেশন রোডেও এক ঘন্টা আগে ভোর হয়। কাশী সকাল-সকাল উঠেই বাজারে চলে যায়। যাবার সময় বার-বার সাবধান করে দিয়ে যায়। বলে—আমি না-ফিরলে যেন দরজা খুলো না, জানো—
ক্ষীরোদা মাথা নাড়ে।
কাশী বলে—মাথা তো নাড়ছো, সেদিন অত করে বলে গেলুম, আর তুমি কোথাকার কোন্ উটকো লোককে দরজা খুলে দিয়ে বসলে! যদি চোর-ডাকাত হতো?
তারপর বাইরের রোয়াকে গিয়ে বেরিয়ে বলে—দাও, খিল বন্ধ করে দাও, আমি শুনি—
ভেতর থেকে ক্ষীরোদা খিল বন্ধ করে দিলে।
কাশী বার কয়েক ঠেললে। সেই বাইরে থেকেই আবার বললে—আমি না এলে যেন দরজা খুলো না দিদিমণি, আমি এসে আমার নাম বলবো তবে দরজা খুলে দেবে, বুঝলে, খুব সাবধান—
শুধু কলকাতাই নয়। ইন্ডিয়ার সব শহরেই ভোর হলো এক ঘন্টা আগে। পাঞ্জাবের লায়ালপুর শহরে স্যার কে নাজিমুদ্দিন মুসলিম-লীগ-কনফারেন্সে বক্তৃতা দিলেন—The Pakistan scheme is not only in the interest of India as a whole, but actually the non-Muslims in the Muslim Majority provinces will be far better off than under one Central Government for the whole of India.
আর সকলের শেষে প্যালেস-কোর্টেও ভোর হলো এক ঘন্টা আগে।
প্যালেস-কোর্ট-এর পৃথিবী খবরের কাগজের পৃথিবী। টেলিফোনের পৃথিবীও বটে। সেই অত ভোরেও কিন্তু মিস্টার ঘোষাল টেলিফোন পেয়েই ঘুম থেকে উঠেছে।
—হুজুর, টিলিফোন আয়া।
মিস্টার ঘোষালের সভ্য-ভব্য আদালী অতি সন্তর্পণে বিছানার কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে ডাকলে। মিস্টার ঘোষাল স্ট্যান্ডার্ড টাইম মানে না। অনেক রাত্রে ফ্রি-স্কুল স্ট্রীট থেকে এসেছে। চোখটা খুলে বললে—কে?
—হুজুর, টিলিফোন—
মনে পড়ে গেল হঠাৎ। মিস্টার ঘোষাল ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়িয়ে নিলে। তারপর রিসিভারে মুখ রেখে বললে—কী খবর? কিছু খবর পেলে নাকি যতীন?
ওপাশ থেকে উত্তর এল—না স্যার, কোথাও পেলাম না—
বরানগরটা দেখেছ?
—আজ্ঞে বরানগর দেখেছি, টালা দেখেছি, দমদম দেখেছি—কোথাও নেই। ও- রকম চেহারার কোনও মেয়েমানুষ কোথাও নেই।
মিস্টার ঘোষাল বললে—আচ্ছা, ঠিক আছে, আরো খোঁজ, এবার বাগবাজার এরিয়াটা একবার দেখ দিকিনি খুঁজে—দেখবে গায়ের রং খুব ফরসা, আর মাথার চুলগুলো খুব কোঁকড়ানো—কালকেই আবার আমাকে এই সময়ে টেলিফোন কোর— কেমন?
আর্দালী তখন ছোট-হাজরি নিয়ে এসেছে। গরম পটের নল দিয়ে চায়ের সোনালী ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ঠুন ঠুন আওয়াজ করে চা তৈরি করে সাহেবের হাতের কাছে এগিয়ে দিলে।
আবার টেলিফোন।
মিস্টার ঘোষাল রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললে—ইয়েস্, ঘোষাল স্পীকিং—
তারপর সেই একই সাবজেক্ট। খুব ফরসা গায়ের রং, মাথার চুল কোঁকড়ানো। খিদিরপুরেও নেই? আচ্ছা ঠিক আছে, আরো খোঁজ। ভাল করে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখ। বরানগর, দমদম, ঢাকুরিয়া, কসবা, সব জায়গায় খোঁজা হচ্ছে। এই কলকাতাতেই কোথাও-না-কোথাও আছে। যাবে কোথায়? কালকেই আবার আমাকে এই সময়ে টেলিফোন কোর—রাইট্।
বলে রিসিভারটা রেখে দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলে। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বললে—পীরালি—
—হুজুর।
—পেপার।
আর্দালী বললে—আজ পেপার নেহি দিয়া হুজুর—
নেহি দিয়া! মিস্টার ঘোষালের নীল রক্ত টগ্ করে উঠলো। নেহি দিয়া। চিৎকার করে উঠলো—হোয়াট?
—পেপার নেহি দিয়া হুজুর!
এমন অভাবনীয় কান্ড প্যালেস-কোর্টের পৃথিবীতে কখনও ঘটেনি। দু’-একটা সাহেবী-কাগজ বেরিয়েছে বটে, কিন্তু দেশী হকাররা তা সাহস করে নিয়ে আসে নি। স্যার জন হারবার্ট কী করছে? লিনলিথগোটাই বা কী করছে? জেন্টলম্যানদের কি কলকাতা শহরে আর বাস করতে দেবে না? অল্ র। অল্ রাবিশ। আজ খবরের কাগজ পাওয়া যাবে না, কাল সিগ্রেট পাওয়া যাবে না, পরশু হুইস্কি পাওয়া যাবে না—এসব কী হলো ক্যালক্যাটায়। গান্ধীটাকে অ্যারেস্ট করেছে, তার চেলা জওহরলালটাকেও অ্যারেস্ট করেছে—তবু এত আরেস্ট কেন? হোয়াই? কিছু না হয় প্রেসকে গ্যাগ্ করো, পুলিসকে আলিমিটেড পাওয়ার দাও। দরকার হলে আর্মি ডাকো। অল্ র, অল্ রাবিশ—
—হুজুর!
—কে?
আর্দালী বললে—হুজুর জগন্নাথ আয়া—
—এই যে জগন্নাথ এসে গেছিস?
জগন্নাথ সামনে এসে মাথা নিচু করে প্রণাম করলে। ময়লা সার্টের ওপর পাতলা আলোয়ান গায়ে। রোগা চোয়াড়ে মুখ। দেখলেই কেমন যেন ঘেন্না হয়। তার ওপর করুণা আকর্ষণ করবার জন্যে দাঁতের পাটি বার করে হাসবার চেষ্টা করছে।
—কীরে, তুইও পেলি না?
জগন্নাথ বললে—হুজুর, দেখা পেয়েছি—
—পেয়েছিস? কোথায়? উত্তেজনায় একেবারে দাঁড়িয়ে উঠলো মিস্টার ঘোষাল।
—হুজুর, গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং-এর কাছে একটা বাড়িতে। আপনি যেমন বলেছিলেন হুজুর, তেমনি চেহারা। ফরসা টকটকে গায়ের রং, কোঁকড়ানো মাথার চুল—সব ঠিক আছে—তার দিদির বাড়িতে রয়েছে—
—আর তার দিদি? দিদি কোথায়?
—হুজুর, কলকাতায় নেই, দিল্লি চলে গিয়েছে, আর আসবে না।
মিস্টার ঘোষাল চুরুটটা ধরিয়ে জোরে ধোঁয়া ছাড়লে একবার। বললে—তোকে ধরতে পারেনি তো?
—না হুজুর, ধরতে পারবে কী করে? আমি তো পাড়ার লোকের কাছে বিকেল বেলা সব খবর-টবর নিয়ে রাত্তির বেলা গিয়েছিলুম চাঁদা চাইতে—
—কীসের চাঁদা?
জগন্নাথ সব খুলে বললে। কেমন করে আগে থেকে সমস্ত খোঁজ-খবর নিয়ে রাত্রে সে বাড়িতে হাজির হয়েছিল। কী কী কথা হয়েছির সব বললে। চেহারার বর্ণনার সঙ্গে ও মিলে গেল। বাড়ির নম্বর, ঠিকানা সবই বললে জগন্নাথ।
মিস্টার ঘোষাল সব শুনে বললে—তোর খুব বুদ্ধি আছে তো জগন্নাথ—
—আজ্ঞে, সে তো হুজুরের দয়া।
মিস্টার ঘোষাল কথাটার মানে বুঝলে। বললে — হবে, হবে, সে-জন্যে ভাবিসনি, এখন চল আমার সঙ্গে—
আর্দালীটা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে গাড়ি আনতে বললে মিস্টার ঘোষাল। জগন্নাথও বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। মিস্টার ঘোষাল ড্রেস করবে এবার। ওয়ারড্রোব্ থেকে সুট বেরোল, সার্ট বেরোল। বাথরুম থেকে মিস্টার ঘোষালের শি-এর শব্দ আসতে লাগলো। বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে লাগলো জগন্নাথ। শালা, শুয়োরের বাচ্চা। দ্বিজপদ বলেছিল ঠিক। শালার হাত দিয়ে একটা পয়সা গলে না। শালার নাল পড়তে আরম্ভ করেছে জিভ দিয়ে—মেয়েমানুষের নাম শুনলেই শালার জিভ দিয়ে নাল পড়ে।
খানিক পরেই ফিটফাট হয়ে মিস্টার ঘোষাল বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বললে—দূর থেকে আমাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিয়েই তুই গা-ঢাকা দিবি—বুঝলি—
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে—তোর বখশিশের জন্য ভাবিস নি— কাজ খতম হলে একসঙ্গে সব মিটিয়ে দেব—
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন