কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০৩

বিমল মিত্র

তারপর বছরের পর বছর হোসেনভাই কাশেমভাই-এর আপিসে প্রতি মাসে মনিঅর্ডারে টাকা এসে পৌঁছেছে। কখনও বাঁকুড়া থেকে। আবার কয়েক মাস পরে বর্ধমান থেকে। আবার কখনও হুগলী থেকে। বাঙলার নানা জেলা, নানা গ্রাম থেকে মনি-অডার করে টাকা পাঠিয়েছে দীপঙ্কর সেন। লক্ষ টাকার ঋণ। সারা জীবন ধরেই হয়ত ঋণ শোধ করে যাবে দীপঙ্কর। সতীর ঋণ সারা জীবন ধরেই শোধ করে যাবে সে। আপিসে গিয়ে একদিন সে চাকরি থেকেও বিদায় নিয়ে এসেছিল চিরকালের মত। তখন ক্রফোর্ড সাহেব চলে গিয়েছে। অন্য সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত ভালো গেজেটেড্ পোস্ট্ কেউ ছাড়ে? কিন্তু তারা তো এ-ইতিহাস জানতো না। তারা বুঝতে পারেনি। তারপর থেকেই স্কুল-মাস্টারী। অল্প মাইনের চাকরি। কোথাও আশী টাকা মাইনে, কোথাও এক শো, কোথাও দেড় শো। সেই মাইনে থেকে মাসের পয়লা কিংবা দোসরা তারিখে মনিঅর্ডার এসে পৌঁছোয়। কোনও মাসে পঞ্চাশ, কোনও মাসে চল্লিশ, কোনও মাসে ষাট। একদিন এই টাকা দিয়েই সতীর শাশুড়ীকে ঋণমুক্ত করতে চেয়েছিল দীপঙ্কর, এই টাকা দিয়েই সতীকে সুখী করতে চেয়েছিল দীপঙ্কর, এই টাকার ঘুষ দিয়েই সতীর ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে চেয়েছিল দীপঙ্কর। কিন্তু দীপঙ্কর তখন জানতো না যে, পরিবারবোধের চেয়ে বিশ্ববোধে যতই মানুষ বড় হয় ততই তাকে আত্মবিলোপ করতে শিখতে হয়। ততই বৃহৎ ত্যাগের জন্যে তৈরী হতে হয়। ঐক্যবোধের চেষ্টার মধ্যেই যে মনুষ্যত্বের সাধনা নিহিত তা যেন সতীই তাকে শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেদিন।

রাত দশটায় ট্রেন ছাড়বে। আমরা সবাই স্টেশনে গেলাম তাঁকে ট্রেনে তুলে দিতে।

কাশী জিনিসপত্র নিয়ে আগেই উঠেছিল। দীপঙ্করবাবু গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে কোনও ক্ষোভ নেই, মনে কোনও দুঃখ নেই। বললেন—তোমরা যারা এখন ছোট, তোমাদের কাছেই আমার বেশী আশা। তোমরা একদিন বড় হবে। তোমরা আমারই মত আরো জীবন দেখবে। আমারই মতন ছিটে-ফোঁটাদের দেখবে, লক্ষ্মীদি, সতীকে দেখবে, নয়নরঞ্জিনী দাসীকে দেখবে, লক্ষ্মণ সরকার, ক্ষীরোদা, কিরণ, সবাইকে দেখবে। দেখবে বিন্তী, লক্কা, লোটন, সবাইকে। আজও যদি গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং- এর সেই বাড়িতে যাও তো দেখবে সেখানে দাতারবাবু আছেন, লক্ষ্মীদি আছে। তাঁদের ছেলে মানস আজ যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করছে ইন্ডিয়ারই কোনও জেলখানায়। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে গেলে দেখবে সনাতনবাবুকে। দেখবে নয়নরঞ্জিনী দাসীর মেজাজ এখন আরো উগ্র হয়েছে। বাতাসীর মা, ভূতির মা, কৈলাস, শম্ভু আজও সেই শাসনের আওতায় জীবিকার যন্ত্রণা পাচ্ছে। রেলের আপিসে, পেট্রল কোম্পানীর আপিসে আজও ঘোষাল সাহেবরা সশরীরে শাসন-দন্ড হাতে নিয়ে বিশ্বজয় করে বেড়াচ্ছে। তাদের যদি না-ও দেখতে পাও তো তাদেরই মতন আরো অনেক লোক দেখতে পাবে। দেখবে অঘোরদাদুরা আজও বেঁচে আছে কড়ি দিয়ে সব কেনবার জন্যে। আজকের অঘোরদাদুরাও ঘরের মধ্যে দেবতার নৈবেদ্য চুরি করে পচিয়ে ফেলছে, তবু দেবতার ভোগ দেবতাকেও দিচ্ছে না, মানুষকেও খেতে দিতে অস্বীকার করছে। শুধু আমিই তোমাদের মধ্যে থেকে চলে গেলাম। আর এক জেলায়, আর এক গ্রামে আমি আবার আশ্রয় চাইবো, আবার হয়ত সেখান থেকেও আমায় চলে যেতে হবে। তবু আমি হতাশ হবো না, তবু আমি আশা, ছাড়বো না—মানুষ আমি খুঁজে বার করবোই।

আর বেশী সময় ছিল না। প্লাটফরমের ঘন্টা পড়লো।

একটু থেমে বললেন—একটা কবিতা সেদিন পড়েছিলুম, কবিতাটি বড় ভালো লেগেছিল, সেটার খানিকটা তোমাদের শুনিয়ে যাই। এক বিখ্যাত ইংরেজ কবির লেখা— তাঁর নাম ডবলিউ-এইচ-অডেন—

All that I have is a voice
To undo the foled lie,
The romantic lie in the brain
Of the sensual Man in the Street,
The lie of Authority
Whose buildings scrape the sky;
There is no such thing as the State
And no one exists alone:
Hunger allows no choice
To the citizen or the police,
We must love one another or die.

সমাপ্ত

সকল অধ্যায়

১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১
২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২
৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩
৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪
৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫
৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬
৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭
৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮
৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯
১০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০
১১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১১
১২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১২
১৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৩
১৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৪
১৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৫
১৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৬
১৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৭
১৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৮
১৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৯
২০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২০
২১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২১
২২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২২
২৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৩
২৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৪
২৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৫
২৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৬
২৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৭
২৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৮
২৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৯
৩০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩০
৩১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩১
৩২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩২
৩৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৩
৩৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৪
৩৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৫
৩৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৬
৩৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৭
৩৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৮
৩৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৩৯
৪০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪০
৪১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪১
৪২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪২
৪৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৩
৪৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৪
৪৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৫
৪৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৬
৪৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৭
৪৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৮
৪৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৪৯
৫০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫০
৫১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫১
৫২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫২
৫৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৩
৫৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৪
৫৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৫
৫৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৬
৫৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৭
৫৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৮
৫৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৯
৬০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬০
৬১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬১
৬২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬২
৬৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৩
৬৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৪
৬৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৫
৬৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৬
৬৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৭
৬৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৮
৬৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৯
৭০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭০
৭১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭১
৭২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭২
৭৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৩
৭৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৪
৭৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৫
৭৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৬
৭৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৭
৭৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৮
৭৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৯
৮০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮০
৮১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮১
৮২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮২
৮৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৩
৮৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৪
৮৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৫
৮৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৬
৮৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৭
৮৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৮
৮৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৮৯
৯০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯০
৯১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯১
৯২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯২
৯৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৩
৯৪. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৪
৯৫. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৫ উপসংহার
৯৬. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৬
৯৭. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৭
৯৮. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৮
৯৯. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৯৯
১০০. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০০
১০১. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০১
১০২. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০২
১০৩. কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০৩
১০৪. নির্ঘণ্ট : কড়ি দিয়ে কিনলাম – ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন