বিমল মিত্র
একই গাড়িতে অনেকগুলো লোক আসছিল। তা ন’দিদির গাড়িটা বেশ বড়ই। নয়ন বসেছে, ন’দিদি বসেছে, মিত্তির-গিন্নী আর মিত্তির-গিন্নীর মেয়ে। আর ড্রাইভার তো আছেই—
ন’দিদিই কথা বলছিল বেশি। বললে—আগে বিয়ে হোক, কুটুম কর, তখন বুঝবি কেমন বউ করে দিলুম—
মিত্তির-গিন্নী বললে—আমার তো এই একই মেয়ে দিদি, আমার সাধ-আহ্লাদ সব এই মেয়েকে নিয়েই,
ন’দিদি বললে—কিন্তু তত্ত্ব-তাবাস ভালো করে করতে হবে, এই এখন থেকে বলে রাখছি, শেষকালে নয়ন যেন বলতে না পারে ন’দিদি এমন সম্বন্ধ করলে যে কুটুম তত্ত্ব করতে জানে না!
নয়ন বললে—তত্ত্ব তো আমার নিজের জন্যে নয় দিদি, তোমাদের দশজনের জন্যেই তত্ত্ব করা। তোমরা দশজনে দেখেশুনে ভালো বললেই ভালো—আমার আর কী!
মিত্তির-গিন্নীর মেয়ে এতক্ষণ মা’র কোল ঘেঁষে বসে ছিল। সবই তার কানে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পরে ঘেমে নেয়ে উঠেছে মেয়ে। মিত্তির-গিন্নী নিজের আঁচল দিয়ে মেয়ের কপাল মুছিয়ে দিলে।
ন’দিনি বললে—কী রে, ভয় করছে নাকি তোর? ভয় কী? এমন ঘরে তোকে বিয়ে দিচ্ছি যে তখন বলবি ন’মাসীমা শাশুড়ী করে দিয়েছিল বটে!
মিত্তির-গিন্নী বললে—ওর ভাগ্যি আর তোমার হাত-যশ দিদি—
ন’দিদি বললে—হাত-যশ ফাত-যশ কিছু নয়, যার হাঁড়িতে যার চাল মাপা আছে, তা কেউ রদ করতে পারে না, আমি তো নিমিত্ত মাত্তর—
এতক্ষণে গাড়ি এসে পৌঁছেছে হাজরা রোডের মোড়ে। হাজরা রোড থেকে বাঁয়ে ঘুরে প্রিয়নাথ মল্লিক রোড। গাড়ি প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে ঢুকলো। চেনা রাস্তা। তারপর ঘোষ-বাড়ি। ঘোষ-বাড়ির গেট বন্ধ ছিল। শম্ভু গাড়ির বাজনা শুনেই দৌড়ে গেট খুলে দিয়েছে।
গাড়ি এসে বাগানে ঢুকলো। ন’দিদি মিত্তির-গিন্নীকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো। মিত্তির-গিন্নীর মেয়েও নামলো। নয়নরঞ্জিনী দাসীও নামলো। শম্ভুকে বললে— দাদাবাবু কোথায় রে তোর?
ভেতর-বাড়িতে ততক্ষণে খবর পৌঁছে গেছে। কৈলাস তাড়াতাড়ি গিয়ে বাতাসীর- মাকে খবরটা দিলে। বললে—বাতাসীর-মা সব্বনাশ হয়েছে, মা-মণি এসে গেছে—
ভূতির-মা আঁচলটা মাটিতে পেতে একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল। বললে—সে কী রে কৈলাস, মা-মণি?
বাতাসীর-মা বললে-বউদিমণি কোথায়?
কৈলাস বললে—বউদিমণি তো দাদাবাবুর ঘরে—
বাতাসীর-মা বললে—বুড়ী আর সময় পেলে না, মরতে ঠিক এই সময়েই হাজির হলো গা!
—কী হবে বাতাসীর-মা? এবার তো আর রক্ষে থাকবে না!
ন’দিদি তখন মিত্তির-গিন্নীকে সমস্ত দেখাচ্ছে। এই বাড়ি, এই ভবানীপুরে এত বড় বাড়ি আর কারো নেই। কর্তাদের আমলে এ-বাড়ির চেহারা আরো ভালো ছিল। আর এখন কার জন্যেই বা বাড়ি সাজাবে বল? ছেলে আর মা—এই তো সংসার। আর যে- বউ ছিল আগে, সসে তো ঘর করলে না এখানে! বর্মার মেয়ে তো, তাদের বাপু শিক্ষা- দীক্ষাই আলাদা। সেবার ছেলের বিয়ে দেবার সময় তো নয়ন আমাকে জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলে আমিই বারণ করতুম।
নয়ন বললে—চলো ন’দিদি ভেতরে চলো—
ন’দিদি বললে—তোর ছেলে কোথায়?
নয়ন বললে—শুনছি তো ওপরের ঘরে গিয়েছে—
ন’দিদি বললে—তবে যে বলেছিলে ছেলে দিনরাত পড়াশোনা করে, বই মুখে দিয়ে থাকে?
মিত্তির-গিন্নী গলা নিচু করে বললে—ছেলে বুঝি বই মুখে দিয়ে থাকে দিনরাত? ন’দিদি বললে—বউ নেই তো, তাই বই নিয়েই আছে কেবল, এবার বউ এলেই আবার সব বদলে যাবে! জোয়ান বয়েস ছেলের, বউ-এর জন্যে বিবাগী হয়ে যায়নি, তাই-ই যথেষ্ট।
নয়ন একতলার ঘরগুলো দেখালে। এই হচ্ছে সরকারের ঘর, এই ঘরে বসে সরকারবাবু স্টেটের কাজ-কর্ম করে। এইটে হচ্ছে লাইব্রেরী ঘর—ছেলে পড়াশোনা করে এখানে। এর পেছন দিকে রান্নাঘর, কল-বাথরুম। আর এই হলো সিঁড়ি। সেকালে এই মোজেইকের সিঁড়ি করতেই সাত হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। তখন আমার শরীর- গতিকও ভাল ছিল, সংসারে আঠাও ছিল, ভাবতাম এই সব নিয়ে থাকলেই সুখ হবে। তা এবার আমি ছেলের বিয়ে দিয়েই কাশী চলে যাবো ভাই। যে-ক’টা দিন বাঁচি, বাবা বিশ্বনাথের নাম করেই বাঁচবো। ছেলে-বউ রইলো। তারা সব গুছিয়ে চালাতে পারলেই চলবে এ-সব আর নয়ত সব পুড়ে-ঝুড়ে যাবে। আমি তখন দেখতেও আসবো না এ- সব।
একে একে দোতলার ঘরগুলো দেখালে নয়ন। তারপর তেতলা।
ন’দিদি, মিত্তির-গিন্নী, মিত্তির-গিন্নীর মেয়ে সবাই পেছন-পেছন আসছিল। এমন চমৎকার বাড়ি, এমন খোলা হাওয়া। এখানে মেয়ে বউ হবে, এ তো ভাগ্যের কথা।
হঠাৎ সোনার ঘরের দিকে গেল নয়ন। বললে—এই হচ্ছে আমার ছেলের শোবার ঘর—
ন’দিদি বললে—ছেলে ঘরে আছে নাকি?
নয়ন বললে—হ্যাঁ, শুনছি তো আছে—
বলে নয়নরঞ্জিনী দাসী ছেলের ঘরের দরজাটা ঠেলতেই দশ হাত পেছিয়ে এসেছে। সতী ততক্ষণে সনাতনবাবুর পাশ থেকে সরে এসে সোজা হয়ে বসেছে।
মা-মণি বললেন—তুমি যে? তুমি যে এসেছ হঠাৎ? তুমি কী করতে এসেছ এ- বাড়িতে?
এতখানি মুখোমুখি হয়ে যাবার কল্পনাও করেনি সতী! প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এতগুলো লোক একসঙ্গে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের শাশুড়ী ছাড়াও ন’মাসীমা আছেন। আরো দুজন সঙ্গে। কী করবে, কী বলবে,—এতগুলো চোখের দৃষ্টির কৌতূহল কেমন করে মেটাবে সে। সতী সনাতনবাবুর দিকে একবার চাইলে। সনাতনবাবু চেয়ে আছেন বাইরে সকলের দিকে। তাঁর দৃষ্টির অর্থ খুঁজে পাওয়া ভার। সতীর মনে হলো সে একলা। একলাই এই অভিযোগের মুখোমুখি হবে। কারো সাহায্যই আর দরকার নেই তার!
—বলো, আবার কেন ঢলানি করতে এসেছো এখানে?
সতীর জবাব দিতে বোধহয় একটু দেরি হচ্ছিল। ন’দিদি তার আগেই ফোড়ন কাটলেন—সত্যিই তো বৌমা, তুমি কোথাকার কোন্ ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়ে গিলে, ঝঞ্ঝাট চুকে গেছলো। তা আবার কেন আসতে গেলে বাছা? এ-সংসারে কি আর তোমার ঢোকা উচিত? এ হলো গেরস্থ-বাড়ি—কাজটা কি ভালো করলে বাছা তুমি?
মা-মণি তালে তাল মিলিয়ে বলতে লাগলেন—বাড়ি থেকে আমি একটু বেরিয়েছি, আর সেই ফাঁকে তুমি ঢুকে পড়েছ? তোমার আক্কেল তো খুব!
ন’দিদি বললে—তক্কে তক্কে ছিলে বোধ হয় যে শাশুড়ী যেই বেরোবে, ওমনি ঢুকে পড়বো! অনেক মেয়েমানুষ দেখিছি বৌমা, আমারও নিজের মেয়ে-বউ আছে, আমিও বেটা-বেটারবৌ নিয়ে ঘর করি। কিন্তু এমন তো কখনও দেখিনি গা—
মা-মণি বললেন—তবে আর বলছি কী ন’দিদি, সাধে কি আর আমার এমন উড়োন-চন্ডী দশা হয়েছে! এই বউ আসার পর থেকেই আকাল পড়েছে আমার সংসারে। তুমি তো জানো কী ছিল আমার আর কী ছিল না?
মিত্তির-গিন্নী ঘোমটা দিয়ে এপাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল আর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সব দেখছিল। পাশেই জড়সড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তার মেয়ে। লীলারাণী দাসী।
মেয়ে আর কৌতূহল দমন করতে পারলে না। চুপি চুপি মা’র কানের কাছে মুখ রেখে জিজ্ঞেস করলে—ও কে মা? কাদের বাড়ির?
মিত্তির-গিন্নী চাপা-গলায় ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো—তুমি চুপ করো। অমন হাঁ করে দেখতে নেই ওদিকে—
—কিন্তু ওকে বকছে কেন মা সবাই?
মিত্তির-গিন্নী মেয়ের হাতটা টিপে দিয়ে বললে—আবার কথা বলে, তুমি আমার পেছনে এসো—
তারপর মিত্তির-গিন্নী ন’দিদির কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। ইচ্ছে ছিল ন’দিদিকে জিজ্ঞেস করবে—এই কি সেই বউ নাকি? কিন্তু তার আগেই ন’দিদি সামনে এগিয়ে গেছে। বললে—সে-সব কথা এখন থাক্ বৌমা, তুমি এখন যাও, আমার বোন ভালমানুষ শাশুড়ী তাই যো পেয়েছিলে! পড়তে আমার হাতে মা তো তোমার দাঁতের গোড়া আমি ভেঙ্গে দিতুম—। যাও বৌমা, ভালোমানুষের মত বলছি, তুমি এখন বিদেয় হও, আপদের শান্তি হোক—
মা-মণি এতক্ষণ ন’দিদির জোরে জোর করছিলেন। কিন্তু ন’দিদিকেও যেন নির্ভর করতে পারলেন না আর। মনে হলো ন’দিদিও যেন হেরে যাচ্ছে। বললেন—কথা বলছো না কেন? ভেবেছ বোবার শত্রু নেই? মুখে কথা না বেরোয় তো বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে—যাও—
ন’দিদি অন্যপন্থা ধরলে এবার। সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে বললে-বাবা সোনা, তুমি বাবা এ-ঘর থেকে একটু বেরোও তো, তুমি থাকলে তোমার বউকে শায়েস্তা করা যাবে না—
এতক্ষণে সনাতনবাবুর মুখ দিয়ে কথা বেরোল। বললেন-শায়েস্তা নাই বা করলে ন’মাসীমা, না-হয় ক্ষমাই করলে তোমাদের বউমাকে—
—কী বললে?
মা-মণি আর সহ্য করতে পারলেন না। বললেন—কী বললে সোনা? ওই বউকে আমি খোশামোদ করবো?
ন’দিদি বললে—তুমি বিবেচক ছেলে হয়ে এই কথা বলছো বাবা? তোমার মত লেখা-পড়া জানা ছেলের মুখ থেকেও এই কথা শুনতে হলো আজ আমাদের? ছি ছি ছি….
মা-মণি বললেন—দেখ ন’দিদি, তুমিই দেখ। এতদিন তুমি আমারই দোষ দেখতে, এখন দেখ কী রকম ছেলে গভ্যে ধরেছি আমি—
সনাতনবাবু বললেন—ন’মাসীমা, তুমি মা’কে একটু বুঝিয়ে বলো তো, এত হৈ চৈ না করে ধীরে সুস্থে সব জিনিসটার একটা মীমাংসা করা কি ভালো নয়? তোমরা সবাই এমন উত্তেজিত হলে চলবে কী করে? যা বলবার ধীরে সুস্থে বলো না!
মা-মণি বললেন-ধীরে সুস্থে কথা বলবার লোক বটে! বলো না ন’দিদি, বলো না, চুপ করে রইলে কেন? বাড়ি থেকে একটু বেরিয়েছি আর ওমনি সর্বনাশী ফাঁকা বাড়ি পেয়ে ঢুকে পড়েছে—
ন’দিদি বললে—তা তো বটেই, তুমি যে বাবা আজ বউ-এর হয়ে সাফাই গাইছো, গেরস্থ-বাড়ির কোনও মা কি কোনও বউ-এর এই কীর্তি সহ্যি করতে পারে, না পারা উচিত?
সনাতনবাবু বললেন—তোমাদের প্রশ্ন তো শুধু এই? না, আরো আছে?
মা-মণি কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, ন’দিদি তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললে —হ্যাঁ ধরো, এইটেই আমাদের কথা, এর কী উত্তর দেবে তুমি দাও?
সনাতনবাবু হাসলেন। বললেন-এর উত্তরও তোমাদের জানা—
তারপর একটু থেমে বললেন—আর তোমার যদি জানা না-ও থাকে তো মা-মণির তো জানতে বাকি নেই!
ন’দিদি বললে—কী যে বাবা বলো, তোমার হেঁয়ালি-কথা আমরা কিছুই বুঝতে পারিনে, আমাদের অত লেখাপড়া জানা নেই তোমার মত, আমরা মেয়ে-মানুষ একটু সহজ করে বলো!
সনাতনবাবু বললেন—ন’মাসীমা, তুমি আসলেই ভুল করলে! সমস্যাটা যদি সহজ হতো তো তার সমাধানটাও সহজ হতো। আসলে যে গোড়াতেই আমরা সব জটিল করে ফেলেছি, সবটা তো তুমি জানো না!
মা-মণি আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন, ন’দিদি আবার তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললে-তোমার কথা তো বুঝলাম, কিন্তু বাবা আমি একটা কথা তোমাকে বলি, তুমি হলে বেটাছেলে, লেখাপড়া জানা বিবেচক বেটাছেলে, তুমি মেয়েদের ব্যাপারে কথা বলবে এটা কি ভালো দেখায় বাবা? ওই দেখ, বাইরের একজন হবু-কুটুম দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওরা সব শুনে কী ভাবছে বলো তো! তোমার বাপ-পিতেমোরাও তো আগে একদিন ঘর-সংসার করেছেন, তাঁরা তো কখনও এ-সব মেয়েলি ব্যাপারের মধ্যে থাকেতেন না! আমার বেটারাও তো রয়েছে। আমার বেটার বউদের ব্যাপারেও তারা তো কেউ কখনও মাথা ঘামায় না। আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ আমার কোনও ছেলে আমার মুখের ওপর কিছু বলুক দিকি! মুখ একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব না—
তারপর হঠাৎ থেমে সুর বদলে সনাতনবাবুর হাতটা আস্তে আস্তে ধরে বললে— তুমি বাবা ভালো ছেলের মত এখান থেকে যাও তো! যাও! তুমি তোমার লেখা-পড়া নিয়ে থাকো গে,–শাশুড়ী-বউতে কথা হচ্ছে এর মধ্যে বেটাছেলের থাকতে নেই— যাও—লক্ষ্মীটি—
সনাতনবাবু হাসলেন আবার। সেই বরাবরের মৃদু হাসি। যে-হাসি দেখে সতীর বরাবর গা-জ্বালা করতো। সনাতনবাবু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। এক পাও নড়লেন না। বললেন—না, ন’মাসীমা, আমি তো তেমন বেটাছেলে নই,
ন’দিদি গালে হাত দিলে। বললে—ওমা, বলছো কী বাবা তুমি? তুমি বংশ-ছাড়া নাকি?
—হ্যাঁ ন’মাসীমা, আমি হয়ত তাই!
মা-মনি হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন। বললেন—ওমা, কী সব্বনেশে কথা বলে গো, আমি একটুখানি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, এরই মধ্যে এত? এমন করে আমার ছেলেকে বশ করে ফেলেছে গা? এমন বউও আমি ঘরে এনেছিলাম মরতে, এমন হেনস্থাও আমার কপালে ছিল?
মিত্তির-গিন্নী আর তার মেয়ে এতক্ষণ সব ব্যাপার দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারা এমন অবস্থার মধ্যে পড়বে এ যেন কল্পনাও করতে পারেনি। মিত্তির-গিন্নী এক ফাঁকে ন’দিদির কাছে এসে গায়ে টোকা দিলে। বললে—ও কে ন’দিদি? এ-সব কী কান্ড?
এতক্ষণে ন’দিদিরও যেন খেয়াল হলো। গায়ে টোকা লাগতেই পেছন ফিরেছে। পেছন ফিরে মিত্তির-গিন্নীকে দেখেই সব খেয়াল হয়েছে। বললে—ওমা, নয়ন, কী কান্ড দ্যাখ, এরা এখানে রয়েছে। তুই এদের বসাস্ নি এখনও?—তোর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসা এদের—
মা-মণি তখন উগ্র মূর্তি। বললেন—তা দেখুক না ওরা, আমার বউ-এর কান্ডটা দেখুক একবার। কেন আমার ছেলের বিয়ে দিচ্ছি আবার, তা নিজের চোখেই দেখে যাক্, আমার তো কিছু লুকোন-ছাপানো নেই, সবই দেখে যাক্—
ন’দিদি বললে—না ভাই এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি, চল্ তোরা বসবি চল্, তোদের বসিয়ে রেখে আসি, একেবারে ঘেমে নেয়ে উঠেছে দুজনে—
মিত্তির-গিন্নী বললে—না না ন’দিদি, তাতে কী হয়েছে, আমাদের কিছু কষ্ট হচ্ছে না। তোমরা কথা সেরে নাও।
—আরে, আমাদের কথা কি এমনি শেষ হবে, আজ এর একটা হেস্ত-নেস্ত করে তবে আমি বাড়ি যাবো—আমি আবার বাড়িতে আঁতুড় ফেলে এসেছি, কত ভাবনা আমার, তার মধ্যে আবার এই সব হ্যাঙ্গামা জুটেছে—
তারপর সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে বললে—তাহলে তুমি বাবা নিজের মা’র কথা শুনবে না? তোমার গর্ভধারিণী মা, সে-ও পর হলো তোমর বউ-এর কাছে—?
সনাতনবাবু হাসলেন আবার। বললেন—ন’মাসীমা, তুমি বোধহয় বাড়ি চলে গেলেই ভালো হয়, তোমার অনেক ভাবনা—
ন’দিদি বললে—ঠিক বলেছ বাবা, ভাবনা আমার চিরকাল থাকবে। কিন্তু আমি নয়নের ভাবনাও নিজের মাথায় ঢুকিয়েছি। তোমরা সুখে শান্তিতে থাকো, এটাও যে আমি চাই! আর নয়ন আর আমি কি আলাদা বাবা?
সনাতনবাবু বললেন—আলাদা যে নও, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, আলাদা হলে এত কথা আমাকে বলতেও না তুমি! আর আমাকেও এত কথা বলতে হতো না।
ন’দিদি কথাগুলোর অর্থ কী বুঝলো কে জানে। বললে—তা তো বটেই বাবা, তোমাকে তো বরাবর মুখচোরা লাজুক ছেলে বলেই জানতুম, তোমার এই ব্যাভার দেখে আমিও তো তাই অবাক হয়ে গেছি—
মা-মণি বললেন—অবাক হবার কিছু নেই ন’দিদি, আমি একটুখানি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, আর সেই ফাঁকে ঢুকে পড়েছে এখানে। এত বড় হারামজাদী বউ—
—ছি!
সনাতনবাবুর গম্ভীর গলার ‘ছি’ শব্দটা যেন হঠাৎ মা-মণির মুখের ওপর ছিকে পড়লো। সবাই চেয়ে দেখলে সনাতনবাবুর মুখের দিকে। সনাতনবাবুর মুখের সেই হাসিটা যেন এতক্ষণে মুখ থেকে অন্তর্ধান করেছে। ব্যঙ্গ নয়, তিরস্কার নয়, প্রতিবাদ ও নয়। এমন কি বিদ্রোহও নয়। আসলে কিছুই নয়। একটি সহজ-সরল ছি-ছিৎকার যেন এতদিনকার সব অভিযোগ-অনুযোগের একমাত্র প্রতিষেধক হয়ে সকলের কানে গিয়ে খট্ করে বাজলো। এতদিন যেন এ-লোকটাকে চিনতে পারা যায়নি। সেই চিরদিনের বই মুখে দেওয়া মানুষটার অন্তরে যে এতখানি ধিক্কার জমা হয়ে থাকতে পারে, তাও যেন কেউ কল্পনা করতে পারেনি। যেন আজ সবাই নতুন করে আবিষ্কার করলে সনাতনবাবুকে।
সনাতনবাবু বলতে লাগলেন—শ্রদ্ধা দিয়ে যে মানুষকে জয় করা যায়, ভালবাসা দিয়েও যে-মানুষকে আকর্ষণ করা যায়, তোমরা সেই সামান্য কথাটাও ভুলে গেছ ন’মাসীমা—
মা-মণি কিন্তু এক মুহূর্তেই সামলে নিয়েছিলেন। বললেন—তা এতই যদি তোমার বউ-এর ওপর দরদ তো, এ-বাড়িতে তুমিও থাকতে পারবে না, এও আমি বলে দিচ্ছি, এও আমার বাড়ি, আমার শ্বশুরের ভিটে—
ন’দিদি মা-মণির মুখে হাত চাপা দিলে। বললে—তুই থাম্ তো নয়ন, কাকে কী বলছিস। রাগের মাথায় তার ঠিক নেই-দেখছিস্ বাইরের লোক রয়েছে—
—কেন বলবো না শুনি? আমি কি ছেলের ভাত খাই, না ছেলের পরি? আমার নিজের ছেলে যাকে আমি বুকে পিঠে করে মানুষ করেছি, সেই ছেলে আমাকে উপদেশ দিতে আসবে, এত বড় বুকের পাটা?
ন’দিদি আবার মুখে হাত চাপা দিতে গেল। বললে—তুই থাম্ নয়ন—
মা-মণি ন’দিদির হাত সরিয়ে দিয়ে বললে—না আমি কেন থামবো? আমার বউ বেশ্যা হয়ে বেরিয়ে যাবে পাড়ার ছোঁড়ার সঙ্গে……
সতী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কোনও রকমে। থর থর করে কাঁপছিল। তার দিকে এতক্ষণ কারো নজর ছিল না। হঠাৎ আর সহ্য হলো না। সে টলে পড়ে যাচ্ছিল, সনাতনবাবু তাকে ধরে ফেললেন।
—ওমনি মূর্ছো গেল। অমন মূর্ছো যেতে আমরাও জানি গো, আমরাও জানি। বেহায়াপনা করবার সময় তখন তো ঘোমটার ঠিক থাকে না, সত্যি কথা শুনে মূর্ছো যাবার ঢংটা শিখেছে খুব। ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়—
সনাতনবাবু এর একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ শম্ভু ঘরে ঢুকলো। একেবারে সকলের ভিড় কাটিয়ে মা-মণির সামনে এসে বললে—মা-মণি, দারোগাবাবু এসেছে—
—দারোগাবাবু? কে দারোগাবাবু?
—আজ্ঞে, ভবানীপুর থানার দারোগাবাবু। আগে, অনেক দিন আগে কয়েকবার এসেছিলেন এ-বাড়িতে, সেই তিনি—
মা-মণি ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। বললেন—দারোগাবাবু আবার কে আসবে আমার কাছে? ভবানীপুরের দারোগাবাবু এ-বাড়িতে কী করতে?
তবু জিজ্ঞেস করলেন শম্ভুকে—কাকে ডাকছে? আমাকে?
—হ্যাঁ মা-মণি আপনাকে ডাকতে বললেন। সঙ্গে পুলিস কনেস্টোবল আছে দু’জন।
নয়নরঞ্জিনী দাসী একটু ভেবে নিলেন। তাঁর কাছে পুলিস কী জন্যে আসতে পারে!
বললেন—তুই যা গিয়ে তাদের সরকারবাবুর ঘরে বসতে বল্। আমি আসছি—
শম্ভু চলে গেল। সিঁড়ির মাথায় বাতাসীর-মা, ভূতির-মা, কৈলাস, সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ মজা দেখছিল। এতক্ষণ তারা আর কৌতূহল চাপতে পারে নি। সবাই জানতে চায় কী হয়। এতদিন পরে বৌদিমণি এসেছে, মা-মণিও এসে পড়েছে, এবার একটা কিছু ফাটাফাটি হবেই।
ভূতির মা বললে—তা ঠিক এই সময়েই কি পুলিস আসেত হয় বাছা! আর একটু দেরি সইল না গো!
বাতাসীর-মা মুখ ঝামটা দিলে। বললে—তুই চুপ কর তো ভূতির-মা, মাগী শুনতে পাবে আবার—
ভূতির-মা এমনিতেই ভীতু মানুষ। বললে—তা শুনলে আর কী করবে মাগী, তাড়িয়ে তো আর দিতে পারবে না, লাথি-ঝ্যাঁটা মারুক আর যাই করুক, এমন গতর খাটা মিনি-মাইনের ঝি তো আর পাবে না—
—তবে বক্ বক্ কর তুই, আমি চললুম এখেন থেকে—
কিন্তু মা-মণি ততক্ষণে সিঁড়ির দিকে আসছে। হুড়মুড় করে নেমে গেল বাতাসীর- মা। ভূতির-মা কৈলাস—তারাও সরে পড়েছে সঙ্গে সঙ্গে।
সতী তখনও সনাতনবাবুর গায়ে হেলান দিয়ে মুখ লুকিয়ে ছিল।
মা-মণি হঠাৎ যেন বাধা পেয়ে ন’দিদিকে বললেন—তুমি তা হলে এ-দিকটা সামলাও, দেখি ওদিকে থানার দারোগা এসেছে কেন আবার—
ন’দিদিও পুলিস-দারোগার নাম শুনে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বললে—তা পুলিস-দারোগা আবার তোর কাছে এল কেন নয়ন? কে কী করলো?
মা-মণি বললেন—আমার কি একটা জ্বালা ন’দিদি, আমার শতেক জ্বালা ন’দিদি, আমার শতেক জ্বালা। সেই উকীল-ব্যারিস্টারের মামলা নিয়ে তো আমি নাজেহাল হবার জোগাড়, বোধ হয় সেই ব্যাপারেই এসেছে, আমার সঙ্গে আবার দারোগার আর কী সম্পর্ক থাকবে? তুমি সামলে রেখো দিদি, আমি চলি—
মিত্তির-গিন্নী একেবারে নতুন মানুষ এ-বাড়িতে। এখানে এসে এমন ব্যাপারে আটকে পড়বে, তা জানলে আর আসতো না। একদিকে শাশুড়ী-বউ-এর ঝগড়া, আর একদিকে দারোগা-পুলিস–সমস্ত যেন কেমন বেনিয়মের সংসার বলে মনে হলো। ন’দিদির কাছে এগিয়ে এসে বললে-পুলিস-দারোগা কীসের ন’দিদি?
ন’দিদি বললে—ও কিছু না, বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে সংসার করতে গেলে পুলিস- দারোগা উকীল-মোক্তার ছাড়া কী চলে বাছা? তোকে বরং পাশের ঘরে বসিয়ে রেখে আসি! দ্যাখ্ দিকিনি, আনন্দ করতে এসে এ কী ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়ে গেলুম—
বলে মিত্তির-গিন্নীকে পাশের ঘরে রেখে আসতে গেল ন’দিদি।
সনাতনবাবু সতীর কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দেখলেন। মনে হলো যেন তার জ্বর এসেছে। আস্তে আস্তে সতীর মুখের কাছে নিচু হয়ে বললেন—তুমি বিছানায় শুয়ে পড়ো একটু—
.
সরকারবাবুর কাছারি-ঘরে ভবানীপুরের থানার দারোগা বসেছিলেন। কনস্টেবল দুজন বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। তাদের হাতে ফাইলপত্র।
মা-মণি হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসতেই দারোগাবাবু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন- আপনাকে বিরক্ত করলুম মিসেস ঘোষ, আমি সেই মিস্টার পালিতের কেস-এর জন্যে এসেছিলাম। আপনার মিস্টার পালিত ধরা পড়েছেন—
—ধরা পড়েছে? তাহলে টাকাগুলো সব পাওয়া যাবে?
দারোগা সাহেব বাঙালী ভদ্রলোক। খাকি কোট প্যান্ট ক্রস-বেল্ট আঁটা। হাসলেন একটু। বললেন—এখানে তো ধরা পড়েননি, সব খবরও এখন আমার কাছে পুরো এসে পৌঁছোয়নি।
—কোথায় ধরা পড়েছে?
—ধরা পড়েছে করাচীতে। করাচীর এক হোটেলে হাজব্যান্ড-ওয়াইফ দুজনে অন্য নামে থাকতো। সব জায়গাতেই তো ওয়্যার পাঠানো হয়েছিল, এ ক’বছর সব জায়গা থেকে আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছিল—নো ট্রেস। কোনও সন্ধান নেই। হঠাৎ ক’দিন আগে করাচী থেকে খবর এসেছে—মিস্টার পালিতকে পাওয়া গেছে। আমি নিজেই সেখানে গিয়েছিলুম ইনভেস্টিগেশন করতে। আমাদের ফটোগ্রাফের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল—এখন আন্ডার অ্যারেস্ট—
মা-মণি বললেন—কিন্তু আমার অতগুলো টাকা?
—টাকার কথা তো পরে। আগে আইডেন্টিফিকেশন হবে, তবে তো?
—কিন্তু তুমি জিজ্ঞেস করলে না কেন বাবা, যে নয়নরঞ্জিনী দাসীর অতগুলো টাকা মেরে যে পালিয়ে এলে তার কী করলে? সে-টাকাগুলো কবে ফেরত দেবে?
দারোগা সাহেব বললেন—কিন্তু আমাদের পুলিসেরও তো একটা আইন-কানুন আছে, আর মিস্টার পালিতও তো একজন ব্যারিস্টার—
মা-মণি বললেন—ছাই, ছাই-এর ব্যারিস্টার বাবা, ওর বাবা আমাদের কাজকর্ম করতেন, তিনি আমার শ্বশুরের আমলের লোক, তাই আমি তাঁরই ওপর সব বিশ্বাস করে তাঁর ছেলেকে ওকালত-নামা দিয়েছিলুম। আজ আমার এই যে হাল হয়েছে, আমার গাড়ি ছিল ড্রাইভার ছিল, বাগানে মালী ছিল, আজ পাঁচ বছর বাড়িতে চুন-বালি পড়েনি, বাড়ি ভেঙে পড়ছে, গেটে দরোয়ান পর্যন্ত নেই একটা, চোর-ডাকাত যে-ইচ্ছে ঢুকে পড়তে পারে—এ তো ওই সব্বনেশে ব্যারিস্টারের কাজ—তুমি জিজ্ঞেস করলে না কেন?
দারোগা সাহেব বললেন—আপনি সব কথা ঠিক বুঝতে পারবেন না, আপনার ছেলে কোথায়? মিস্টার ঘোষ?
—ছেলের কথা আর বোল না বাবা, সে আর এক পন্ডিত। এই সব পন্ডিত নিয়েই আমাকে এতদিন চালাতে হয়েছে বাবা, আমার জ্বালা ঠিক তোমরা কেউ বুঝতে পারবে না। যা বলবার, ছেলেকে না বলে আমাকেই বলো, আমিই শুনবো— জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সব কিছু আমাকেই করতে হবে—
দারোগা সাহেব বললেন—তাহলে শুনুন।
বলে দারোগা সাহেব সব কাহিনীটা বললেন। সে এক আজব কাহিনী। করাচীর প্রিন্সেস হোটেলে গিয়ে উঠলো এক জোড়া মানুষ। একজন হাজব্যান্ড আর একজন ওয়াইফ। মিস্টার এন লাহিড়ী আর মিসেস লাহিড়ী। এসেছে দিল্লী থেকে। কিন্তু মিস্টার লাহিড়ী আর মিসেস লাহিড়ীর জন্যে প্রিন্সেস হোটেলের বয়, বাবুর্চি, খানসামা, স্টুয়ার্ড সবাই নাজেহাল। সবাই তটস্থ।
মিস্টার লাহিড়ী ডাকে—বোয়—
বয় দৌড়ে আসে। সামনে এসেই বকুনি খায়। জল ঠিক গরম হয়নি। কিম্বা চায়ে ঠিক ফ্লেবার হয়নি। কিম্বা ডিনারের কফি ঠান্ডা। একটা-না-একটা খুঁত ধরা পড়বেই মিস্টার লাহিড়ীর কাছে আর মিস্টার লাহিড়ী যদিই বা ক্ষমা করেন তো মিসেস লাহিড়ী আরো এক-কাঠি বাড়া।
মিস্টার এন্ড মিসেস লাহিড়ী আসবার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের ইনকাম বেড়ে গেল রাতারাতি। যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে সাউথ-ইস্ট-এশিয়া কম্যান্ডের মিলিটারি অফিসারে হোটেল ভরে গেছে। মেজর, ক্যাপ্টেন, লেফটেন্যান্ট হরদম আসছে যাচ্ছে। তাদের মিস্টার লাহিড়ী পার্টি দেন। এক-এক দিনে দু তিন হাজার টাকা ইনকাম হয় হোটেলের।
মিস্টার লাহিড়ী সকলকেই বলে—কায়রো যাচ্ছিলাম, হঠাৎ এসে দেখি রুট বন্ধ হয়ে গেছে—
যদি কেউ জিজ্ঞেস করে—কায়রোতে আপনার কী কাজ?
মিস্টার লাহিড়ী বলে—বিজনেস ট্রিপ—
এক-একদিন ভোর থেকে ট্যাক্সি এনগেজ করে মিস্টার লাহিড়ী। সারা দিন ধরে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েই থাকে। কেউ আসে না, কেউ নামে না হোটেল থেকে। শেষকালে রাত দশটার সময় ফুল ওয়েটিং চার্জ দিয়ে ট্যাক্সি বিদায় দেওয়া হয়। বলা হয়-নেহি, সাহাব নেহি যায়েঙ্গে—
এমনি প্রায়ই। প্রায়ই এমনি হয়। অথচ ভেতরে তখন মিস্টার লাহিড়ী আর মিসেস লাহিড়ী ব্যালকনিতে বসে অ্যারেবিয়ান ওস্যান-এর ভিউ দেখছেন। পাশে বসে আছে মিলিটারি মেজর—টম ডিক হ্যারি—
উনিশ শো বেয়াল্লিশের আগস্ট পেরিয়ে গেছে। অ্যাক্সিস পাওয়ার্স সিঙ্গাপুর, রেঙ্গুন, আকিয়াব পর্যন্ত এসে গেছে। আর ঠিক সেই সময় বাঙালী-সন্তান মিস্টার লাহিড়ী করাচীর প্রিন্সেস হোটেলের ব্যালকনিতে বসে টম-ডিক-হ্যারির মনোরঞ্জন করছে।
তারপর একদিন এক কান্ড ঘটলো।
হোটেলের বয় যথারীতি রাত্রে ঘরে কফি দিতে গিয়ে দেখে মিস্টার লাহিড়ী চিৎকার করছে—ব্লাডি সোয়াইন, সান-অর্-এ-বিচ
এ-এক অবাক কান্ড! হোটেলসুদ্ধ লোক সন্ত্রস্ত। বয়রা ছুটে এল, বাবুর্চি ছুটে এল, খানসামা ছুটে এল, স্টুয়ার্ড, বিল-ক্লার্ক, অ্যাকাউন্টেন্ট সবাই ছুটে এল। অন্য সব বোর্ডাররাও ছুটে এল বাইরে। সামথিং রং ইন দি স্টেট অব ডেনমার্ক।
—কী হয়েছে?
—হোয়াটস্ আপ?
—কেয়া হুয়া?
—হোয়াটস্ রং দেয়ার?
হোটেলসুদ্ধ লোকের ওই এক প্রশ্ন। চারদিকে হৈ চৈ। রুম নাম্বার ওয়ানের বোর্ডার সামনে যা পাচ্ছে তাই ভাঙছে। গ্লাস ভাঙছে, বাল্ব ভাঙছে, টী-পট ভাঙছে। সব ভেঙে চুরমার করছে। মিস্টার লাহিড়ী চীৎকার করছে—ব্লাডি সোয়াইন, সান-অব্-এ-বিচ—
খবর গেল পুলিসের কাছে। পুলিস এল। পুলিসের ডাক্তার এল। ততক্ষণে মিস্টার লাহিড়ী কান্ত হয়ে পড়ছে। অকারণ চীৎকারে গলা ভারি হয়ে গেছে। ডাক্তার পরীক্ষা করলে অনেকক্ষণ। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রায় দিলে—এ কেস অব ইনস্যানিটি। পাগল হয়ে গেছেন মিস্টার লাহিড়ী। হঠাৎ শক পেলে এরকম হয়। তবে সারলে সারতেও পারে। অনেক দিন অবজারভেশনে থাকতে হবে।
কিন্তু আশ্চর্য! মিসেস লাহিড়ীকে আর সেদিন থেকে পাওয়া গেল না কোথাও। হাজব্যান্ডের অসুখের পরেও অনেক দিন তার কোনও ট্রেস নেই। খবর পাওয়া গেল ঘটনার আগের দিন মিসেস লাহিড়ীকে সাউথ-ইস্ট-এশিয়া কম্যান্ডের আমেরিকান মেজর ওয়াটকিনস-এর সঙ্গে দেখা গিয়েছিল। মেজর ওয়াটকিনস ফ্লাই করে চলে গেছে সেইদিন। তার সঙ্গে মিসেস লাহিড়ীকে দেখা গেছে কিনা কেউ জানে না।
দারোগা সাহেব বললে—আসলে আমাদের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ-এর লোক তখন খবর পেয়ে আমাদের ওয়্যার করে। আমরা গিয়ে দেখি—যার নাম মিস্টার লাহিড়ী তার নামই মিস্টার পালিত—! আমাদের আইডেন্টিফিকেশন ফোটোগ্রাফের সঙ্গে হুবহু মিলে গেল—
—এখন তাহলে কোথায় আছে সে বদমাইশটা?
দারোগা সাহেব বললেন-সেই করাচীতে, এবার এখানে আনলে আপনি আইডেন্টিফাই করবেন—তখন যা হয় হবে! আর পাগলের এগেনস্টে কেস করেই বা কী করবেন?
—কিন্তু আমার অতগুলো টাকা? সে-টাকা পাওয়া যাবে না! সব মিলিয়ে যে তিরিশ লক্ষ টাকার মত হবে!
দারোগা সাহেব বললেন—টাকার একটা ব্যবস্থা করা যাবে যাহোক, তবে কোথায় যে অতটাকা রেখেছে তাও জানি না, এখনও ট্রেস পাওয়া যায়নি। হোটেলের রুম নাম্বার ওয়ানটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সামান্য কয়েকটা টাকা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি।
মা-মণি বললেন—অত টাকা তো আর কাছে রাখে না কেউ, নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কে-ট্যাঙ্কে রেখেছে কোথাও লুকিয়ে।
দারোগা সাহেব বললেন—ব্যাঙ্কে রাখবার ছেলেই নয় মিস্টার পালিত। বিশেষ করে ব্ল্যাক টাকা! আমার মনে হয় মিসেস পালিতই সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। মেজর ওয়াটকিনসেরই ভোগে লাগবে হয়ত—
মা-মণি বললেন—তা তাদেরই না-হয় ধরবার ব্যবস্থা করো—বিধবার অতগুলো টাকা নষ্ট হবে, আর তোমরা থাকতে কিছু করবে না বাবা?
দারোগা সাহেব বললেন—তা তো সম্ভব নয় মিসেস ঘোষ। বিশেষ করে এই ওয়ারের সময়, এখন তার আর কোনও ট্রেস পাওয়া যাবে না—
—তাহলে আমার কী হবে?
কীযে হবে তাই-ই যদি তিনি জানবেন তো তিনিই বলে দিতেন। খানিক পরে বললেন—কী হবে জানি না, তবে পানিশমেন্ট যা-হবার তা তো হয়েই গেল। আমরা পানিশমেন্ট দেবার আগেই ভগবান শাস্তি দিয়ে দিলে—
মা-মণি রেগে গেলেন। বললেন—ভগবানের নাম কোর না আর বাবা তুমি! ভগবান থাকলে আমার এই দুর্দশা হয়? ভগবান থাকলে এই অনাথা বিধবার টাকাগুলো এমন করে নয়-ছয় হয়ে যায়? তুমি এত বুদ্ধিমান হয়ে ভগবানের নাম করছো? অন্য কেউ ভগবানের নাম করলে…..
বলতে বলতে মা-মণি যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তাঁর স্থূল-শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগলো রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে। তাঁর এতদিনের ক্ষমতা যেন হঠাৎ তাঁর হাত থেকে অন্য হাতে চলে যেতে বসেছে। তাঁর গৌরব যেন ধূলোয় গুঁড়িয়ে যেতে বসেছে! আরো যেন তিনি কী সব বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁর মুখের কথা মুখেই আটকে গেল। ন’দিদি হাঁফাতে হাঁফাতে এসে হাজির হলো ঘরের মধ্যে। বললে—ওরে নয়ন, ওদিকে যে সর্বোনাশ হয়েছে—
—কী সর্বোনাশ ন’দিদি?
মা-মণি পেছন ফিরে ন’দিদিকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন! বললে—কী হলো?
—তোর বউ যে নাটক করছে রে!
—নাটক?
—হ্যাঁ রে, নাটক। বউ যে তোর ভিরমি গেছে! বিছানায় শুয়ে চোখ উল্টে পড়েছে—
মা-মণি বললেন—ও ছেনালী ন’দিদি, ওদিকে চোখ দিও না। তোমরা চোখ দিলে আরো বাড়িয়ে তুলবে—ও ছেনালী আমি অনেক দেখেছি—
ন’দিদি বললে—কিন্তু শেষকালে যদি একটা বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে যায়, তখন কেলেঙ্কারী হবে যে। তখন পুলিসে এসে তোকেই ধরবে যে—
দারোগা সাহেব জিজ্ঞেস করলেন—কী হয়েছে?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন