বিমল মিত্র
লক্ষ্মীদির বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়েছিল দীপঙ্কর। লেভেল- ক্রসিংয়ের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। গুডস্-ট্রেন আসবে। ভূষণকেও দেখা গিয়েছিল। সেই কালো বেঁটে চেহারা। আরো বুড়ো হয়েছে এখন। অনেক দিনকার লোক। চিনতে পারলে আবার সামনে আসতো। সামনে এসে সেলাম করতো। অনেক কথা বলতো। রবিনসন সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতো।
সেই সব পুরোন দিন। যখন দীপঙ্কর ডি-টি-আই ছিল। যখন পৃথিবী আরো সহজ ছিল, যখন মানুষ আরো সরল ছিল। গাড়িটা গড়গড় করে গড়িয়ে চলেছে। আর দুদিন। দুদিন পরেই দীপঙ্কর কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে। আর দুদিন পরে এই পৃথিবী এই রকমই থাকবে, শুধু দীপঙ্করই আর থাকবে না এখানে। নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে হবে নতুন এক মফস্বলে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের সঙ্গেও আর কোনও সম্বন্ধ থাকবে না তার। বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের সঙ্গেও আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। লক্ষ্মীদির সঙ্গেও দেখা করা হলো না। না হোক। দেখা করার আর কোনও প্রয়োজনও নেই। দাতারবাবু ভাল হয়ে উঠেছে, মানস লেখাপড়া শিখেছে, লক্ষ্মীদি যা চেয়েছিল, তা পেয়েছে। এখন আর দীপঙ্করকে কিসের প্রয়োজন? এক সতী? সনাতন-বাবুর সঙ্গে সতীর একটা বোঝাপড়া করে দিতে পারলেই দীপঙ্করের বাকি কাজটা শেষ হয়ে যাবে। আর ক্ষীরোদা!
ক্ষীরোদার সঙ্গে তারপর থেকে আর কোনও কথা বলবারই সুযোগ হয়নি দীপঙ্করের। নিঃসহায় নিঃসম্বল মেয়েটিকে মা হয়ত পুত্রবধূই করতে চেয়েছিল। তাতে হয়ত মা’র প্রয়োজন মিটতো। কিন্তু তা-ই বা দীপঙ্কর কেমন করে সার্থক করে?
সংসারে তখনও ক্ষীরোদা সেই একভাবে নিঃশব্দে সব কাজ করে যায়। সেই আগেকার মত রান্না করে। সেই আগেকার মত ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে যায় সামনে তারপর নিঃশব্দে সরে যায় সামনে থেকে। কোথায় কেমন করে দিন কাটে ক্ষীরোদার, তার খবর কেউ রাখা প্রয়োজন মনে করে না। ক্ষীরোদা যেন নিজেকে আড়াল করে রাখতেই ভালবাসে। সকলের দৃষ্টির আড়ালে থেকে নিজের কাজ থেকেও যেন নিজের অস্তিত্বটুকু মুছে ফেলতে চায়। দীপঙ্কর হাজার চেষ্টা করেও ক্ষীরোদার একটুকু দুঃখ ঘোচাবার পথ খুঁজে পায় না। তবু আগে সন্তোষ-কাকা ছিল। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেও দিনটা কাটতো তার। সন্তোষ-কাকা নিজে বাক্যবাগীশ লোক। নিজে বাক্যবাগীশ, বাক্যবাগীশ লোককেই তাই ভালো লাগতো তার। কিন্তু ক্ষীরোদা হয়েছে ঠিক উল্টো। ক্ষীরোদা জানে না যে এ-সংসারে জোর করে আদায় না-করে নিলে কিছুই পাওয়া যায় না। তারপর যখন দীপঙ্কর আপিসে চলে যায়, তখন খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে নিজের অন্ধকার ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে আত্মগোপন করে। কতদিন দীপঙ্কর খুঁজেছে ক্ষীরোদাকে। দু’টো কথা বলতে চেয়েছে। অন্ততঃ দু’টো সান্ত্বনার বাঁধা বুলি। কিংবা ভবিষ্যতের কিছু পরামর্শ। কিন্তু সারা বাড়ির চারিদিকে চেয়েও কোথাও কোনও চিহ্ন পায়নি ক্ষীরোদার
এখন বদলির খবরটার পরই বেশি করে মনে পড়েছে ক্ষীরোদার কথাটা। ক্ষীরোদা কোথায় যাবে?
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়ে একলা আপিস করতেন। তিনি খবর শুনে একদিন এলেন। বললেন—কী হলো, আপনার বলির?
দীপঙ্কর বললে—আমি তো চলে যাচ্ছি, এ-বাড়ি আপনার আমি ছেড়ে দেব।
বাড়িওয়ালা দুঃখ করতে লাগলেন। বললেন—কী আর বলবো আপনাকে, আমারই কপাল—
তারপর একটু থেমে বললেন—আপনি কি সবসুদ্ধ চলে যাচ্ছেন?
দীপঙ্কর বললে—তা এখানে আর কীজন্যেই বা থাকবো বলুন, সেখানে তো বড় কোয়ার্টার পাবো—
সবসুদ্ধ কথাটার অর্থ যে কী, তা দীপঙ্কর বুঝতে পেরেছিল। ক্ষীরোদাও যাবে। যদি সেখানে যেতে আপত্তি না থাকে তো যাবে নিশ্চয়ই। কোথাও তো আর যাবার জায়গা নেই তার। কেউ যে নেই তার পৃথিবীতে। একবার জানতে ইচ্ছে হয়েছিল দীপঙ্করের, সত্যিই কি কেউ নেই ক্ষীরোদার? নিকট না হোক, দূর-সম্পর্কের কেউ! এতদিন এখানে আছে, কই, কেউ তো খোঁজ নিতেও আসেনি কখনও। এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল, তা- ও তো কোনও চিঠি এল না সমবেদনা জানিয়ে।
কাশীকেও একদিন খবর নিতে বলেছিল দীপঙ্কর। কাশী এসে বলেছিল – না দাদাবাবু, দিদিমণির কেউ নেই—
—কোনও দূরসম্পর্কের আত্মীয়?
কাশী বলেছিল—তা-ও জিজ্ঞেস করেছি। দিদিমণি বললে—কেউ নেই—
—কিন্তু বিয়ে হলে তো নিজের লোকজনদের খবরাখবর দিতে হবে, নেমন্তন্ন তো করতে হবে—
কাশী বলেছিল—এ-কথা তো জিজ্ঞেস করিনি, জিজ্ঞেস করে আসবো?
-–না, থাক্!
তারপর যখন বলি হবার কথা উঠেছিল, তখনও কাশীকে বলতে বলেছিল ময়মন- সিং-এ যেতে ক্ষীরোদার কোনও আপত্তি আছে কি না!
কাশী এসে বলেছিল—না, দাদাবাবু, কিছু বললে না দিদিমণি—
—কলকাতা ছেড়ে চিরকালের জন্য বিদেশে চলে যেতে রাজী আছে কি না জিগ্যেস করেছিলি?
কাশী বলেছিল—জিগ্যেস করেছিলুম, কিছু বললে না—
—তা তোর আপত্তি নেই তো?
কাশীর কিছুতেই আপত্তি নেই। সারাজীবন সে দীপঙ্করের কাজ করবে বলে দিয়েছে। যে প্রতিবাদ করে, যে প্রতিরোধ করে, তাকে তবু সরানো যায়, কিন্তু যে নির্বাক হয়ে শুধু নির্ভর করে তাকে নিয়েই তো মুশকিল! তবু দীপঙ্কর সকলকে নিয়েই চলে যাবে ঠিক করে ফেলেছিল। কলকাতায় তার কিছু দায়-দায়িত্ব ফেলে রেখে যাবে না। সবাই তার আপন। যে দীপঙ্করকে ত্যাগ করবে, তার কথা আর ওঠে না। সতী থাক এখানে। মিস্টার ঘোষাল থাকুক। লক্ষ্মীদি থাকুক, তারা কেউ-ই তাকে চায়নি। কিরণও হয়ত তাকে চায়নি। একে একে সবাই দূরে চলে গেল। কিম্বা হয়ত দীপঙ্করকেই দূরে ঠেলে দিলে।
তবু শেষবারের মত এবার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটা দেখে যেতে ইচ্ছে হলো। ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে নিতে বললে। রাসবিহারী এভিনিউ দিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে ডান দিকে সদানন্দ রোড। তারপর বাঁদিকে। আস্তে আস্তে চলতে লাগল ট্যাক্সি। কী ছিল জায়গাটা, আর কী হয়েছে। কত বদলে গিয়েছে। এই মোড়েই ছিল আশু কলুর তেলের ঘানিকলটা। এখানেই ছিল টিকেপাড়া। এর মাটির সঙ্গে একদিন দীপঙ্করের এই মাটির শরীরটার যোগ বড় নিবিড় হয়ে কেটেছিল। সে বড় নিবিড় যোগ। তখন ভাবতেও পারেনি, একদিন ঐ পাড়াতেই আবার ট্যাক্সি করে দেখতে আসতে হবে। বাড়ির ভেতর গাড়ি ঢোকে না এই মোড়ে। এই মোড়ে এসে দাঁড়াতো সতীদের কলেজের বাসটা। উঁচু হিল-তোলা জুতো পরে এইখানে এসেই বাসে উঠতো সতী! এইখানেই একদিন পাড়ার ছেলেরা ভিড় করে সতীদের বাড়ি চড়াও হয়েছিল। বন্দে মাতরম বলে চিৎকার করেছিল। সেদিন এই দীপঙ্কর সতীর মর্যাদা নিজের শরীরের আচ্ছাদনের মধ্যে ঢেকে রক্ষা করেছিল। এই পাড়ার রাস্তাতেই পুলিস এসে দীপঙ্করকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। বয়সই শুধু বাড়ে, মানুষ সেই শিশুই থাকে ভেতরে ভেতের। বাইরে থেকে কেউ তা বুঝতে পারে না। কেউ তা দেখতে পায় না।
ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে রইল। দীপঙ্কর দেখতে লাগলো চেয়ে চেয়ে। সেই পুরোন বাড়িটার ভগ্নাবশেষ আর কোথাও নেই। চারদিকের এলোপাতাড়ি বাড়ির মধ্যে তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অঘোরদাদুর বাড়িটা। ‘অঘোর-স্মৃতিসৌধ’। হয়ত সেই ঘরগুলোও আর নেই সেখানে। সেই উঠোনটাও নেই। সেই আমড়া গাছটাও নেই।— আর সেই কাকটাও হয়ত নেই। সে-ও হয়ত অঘোরদাদুর মত একদিন পৃথিবীর বুকের ওপর আছাড় খেয়ে মরেছে।
—এই যে দীপুদা, আপনি?
দীপঙ্করের যেন জ্ঞান ফিরে এল। একটা অচেনা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে কাছে। দীপঙ্কর চিনতে পারলে না চেহারাটা।
—এদিকে কী করতে? কোথায় এসেছিলেন?
ছেলেটার হাতে বাজারের থলি। দীপঙ্কর বললে—তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলুম না ভাই—
—আমি গোবিন্দ, ব্যায়াম সমিতিতে সেই প্যারালেল-বার প্র্যাকটিস করতুম— চিনতে পারলেন না আমাকে?
তবু মনে পড়লো না। শুধু মুখে বললে—ও—
—ফোঁটাদা বলছিল আপনার কথা—আমি আপনার বাড়িতে একদিন যেতুম-
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কেন?
—একটা যদি চাকরি করে দিতেন আমায় আপনার আপিসে, আমি বড় অভাবে পড়ে গেছি। বাবা মারা যাবার পর থেকে সংসার ঘাড়ে এসে পড়েছে। আপনি লক্ষ্মণদাকেও চাকরি করে দিয়েছেন!
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—এখন কী করছো?
—এখন তো অনেক কষ্টে এ-আর-পিতে ঢুকেছি। তাতে ঠিক চলে না। আর তা ছাড়া, এ তো পাকা চাকরি নয়, ওয়ার থেমে গেলে তো ছাড়িয়ে দেবে ওরা!
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আমি যে পরশু চলে যাচ্ছি এখান থেকে বদলি হয়ে –ট্র্যান্সফার হয়ে যাচ্ছেন?
দীপঙ্কর বললে— হ্যাঁ, তা তোমার ফোঁটাদার কী খবর?
ছিটে-ফোঁটার খবরও বললে ছেলেটা। বললে—ওঁরাই তো পাড়ার ইজ্জত রেখেছে দীপুদা, এই দেখুন না, এ-পাড়ায় তো কত ছেলেই ছিল, ওঁদের মতন ক’জন দেশের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। আমরা যখন সবাই এ-আর-পি, সিভিক গার্ডে ঢুকে গেলুম, ওঁরা এখনও সেই খদ্দর পরে দেশ নিয়ে পড়ে আছেন। এবার প্রাণমথবাবুর সঙ্গে ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে ফোঁটাদা, কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হবে শুনছি—
ট্যাক্সিটা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটাকে এড়িয়ে তাড়াতাড়ি দীপঙ্কর ট্যাক্সি চালাতে বললে। যাবার সময় বললে—আচ্ছা চলি—
সেই পাড়ার কী দশা হয়েছে নিজের চোখে তা আর দেখতে ভাল লাগলো না। হয়ত পাড়ার উন্নতিই হয়েছে সত্যি-সত্যি। কিন্তু তবু দীপঙ্করের মনে হলো সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন যেন আর ঠিক তেমন নেই। যেন কিছুটা শ্রীহীন। তখন আপিস যাবার টাইম। দলে দলে ট্রাম-রাস্তার দিকে ছুটেছে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে। শেষবারের মত প্রাণ ভরে দেখে নিতে ইচ্ছে হলো দীপঙ্করের। একবার শেষ বারের মত। এখানেই একদিন মা তাকে বুকে- পিঠে করে মানুষ করেছে। এখানে এলেই যেন মা’র কথা মনে পড়ে।
মাসীমাও সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই অসময়ে দীপঙ্করকে দেখে ভয়ও পেয়ে গিয়েছিল বোধ হয়। বললে—কী বাবা দীপু এমন সময়ে যে?
—মাসীমা, আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ময়মনসিং-এ বদলি হয়েছি—তাই যাবার আগে একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করে গেলাম—
পুলিসের দল তখনও বাড়ির সামনে বসে পাহারা দিচ্ছে। দীপঙ্কর তাদের দিকে চেয়ে বললে—এরা এখনও আছে?
—হ্যাঁ বাবা, দিনরাত পাহারা দেয়, আমার ভাল লাগে না মোটে।
দীপঙ্কর বললে—আমি আপনাকে সেখান থেকে মনি-অর্ডার করে টাকা পাঠিয়ে দেবেন, আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। এই বলতেই এসেছিলুম—
—না বাবা, টাকা তুমি আর পাঠিও না।
—কেন? কী হলো?
—আমি মরে গেলেই তো ভালো। না-খেতে পেয়ে যদি মরে যাই, সেই ভালো। তুমি এদের বলো না বাবা আমাকে মেরে ফেলতে, এদের হাতে বন্দুক আছে, লাঠি আছে, একটু চেষ্টা করলেই আমাকে মেরে ফেলতে পারে। তা-ও মারবে না, আবার পাহারাও দেবে দিনরাত—
একবার দীপঙ্কর ভাবলে কিরণের কথা বলবে মাসীমাকে। কিরণ এসেছিল কিনা, জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু পুলিসরা তখনও তাদের কথাবার্তা শুনছে মন দিয়ে। তাড়াতাড়ি বললে—যাই মাসীমা, আপিসের দেরি হয়ে গেল—
মাসীমা বললে—এসো বাবা, তোমাকে দেখলেও শান্তি পাই, তোমার মা অনেক পুণ্য করেছিল, তাই তোমার মত ছেলে গভ্যে ধরেছে—
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন