শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
তারপর মাসখানেক পূর্ণ উদ্যমে কোর্টের কাজ চললো। কতরকমের মানুষ আসে আমাদের চেম্বারে। আমি অবাক হয়ে তাদের দেখি। কোর্টে যাই। সেখানে ও বৈচিত্র ও চমকের ছড়াছড়ি। তবে আজকাল মানুষ দেখেই বিভোর হয়ে থাকি না। তহুরীর জন্য মক্কেলদের উপর চাপ দিই। এটর্নিদের সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করি, “চেকটা আজ আনতে যাবো নাকি, স্যার?”
তারপর আবার ছুটি। বড়োদিন, নববর্ষ মিলিয়ে প্রায় সপ্তাহ খানেক কোর্ট বন্ধ। ছুটিতে এটর্নিরা সাধারণত কাজ বন্ধ রাখেন না। খ্রীস্টমাসের দিনটি ছাড়া
সায়েবও ক্লাবে বসে-বসে কাজ করেন।
এই ছুটিতে এটর্নি বৈদ্যনাথ চক্রবর্তী যে মেয়েটিকে সায়েবের কাছে এনেছিলেন, তাকে আমি একটুও ভুলিনি। তার নাম আরতি রায়। কিন্তু আরতি রায়ের কথা লিখতে সঙ্কোচ বোধ করছি। হাইকোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একদিন আরতির মা আমার দুটি হাত ধরে বলেছিলেন, “বাবা এসব যেন কাগজে বার না হয়।” আমি বলেছিলাম, “আপনি চিন্তা করবেন না। কেসটা যাতে কাগজে না বার হয়, তার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।” রিপোর্টাররা এই ধরনের মামলার গন্ধ পেলে আর রক্ষে নেই। সে-খবর কাগজে বেরোবেই। তাদের সন্ধানী দৃষ্টি থেকে আরতি রায়ের কেস কী ভাবে আড়াল করে রেখেছিলাম, তা না বললেও চলবে। কিন্তু সে জন্য যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল বলাই বাহুল্য। এক- একবার ভেবেছি, আমার এত চেষ্টা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বেচারা আরতি রায়ের সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। আদালতের অসংখ্য লোকের কৌতূহলী চোখের সামনে দিনের পর দিন তাকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। খবরের কাগজে তার প্রকাশ ও প্রচার অনেকটা কাটাঘায়ে নুনের ছিটের মতো হবে।
এখন লিখতে বসে তাই দ্বিধা আসছে। আরতি রায়কে জগতের সামনে প্রচার করা উচিত হবে কিনা ভাবছি। কিন্তু মন বলছে, সময়ের ব্যবধানে সংবাদের গুরুত্ব কমে যায়। আরতি রায়কে তুমি যখন কোর্টে দেখেছিলে, তারপর অনেক শীত ও বসন্ত তার দেহে ডাক দিয়ে গিয়েছে। তাছাড়া আরতি রায়ের মতো ঘটনা বাংলাদেশের সবার জানা উচিত। আর আরতি রায় তো মেয়েটির আসল নাম নয়। এ আমার একটা মনগড়া নাম। সুতরাং বিবেকের কাছে কোনো দোষ করছি না।
প্রথম যেদিন এটর্নি বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে আরতি এসেছিল, তার পিছনে ছিলেন এক মধ্যবয়সী বিধবা ভদ্রমহিলা। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি মিস্টার চক্রবর্তীর আসার কারণ এই সদ্যযৌবনা নিষ্পাপদৃষ্টি মেয়েটি। কুমারী মেয়ে। দুধের মতো গায়ের রং। টানা-টানা চোখের ভুরু দুটি যেন কোনো নিপুণ চিত্রকরের সূক্ষ্ম তুলিতে আঁকা। নরম তুলতুলে সিল্কের শাড়ির উপর ফারকোট পরা আরতি অবাকদৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাচ্ছিলো। ইংরেজের বাড়িতে সম্ভবত তার এই প্রথম পদার্পণ।
আরতির-মাও বয়সকালে নিশ্চয় সুন্দরী ছিলেন। গরদের চাদরের ভিতর হাত দুটি লুকিয়ে আছে। প্রথমে বুঝিনি, পরে লক্ষ্য করলাম তাঁর এক হাতে গেরুয়া রঙের একটা ছোট্ট থলে। তারই ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে তিনি মালা জপছেন, সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট নড়ছে।
তাঁদের বসতে দিয়ে বললাম, সায়েব এখনি আসছেন। আরতির মা চারদিকে তাকাতে লাগলেন। টেবিলের উপর ভগবান বুদ্ধের ধ্যানস্থ মূর্তি। পাশেই পিতলের নটরাজ—‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে’। দরজার পর্দায় অঙ্কিত চীনা ড্রাগনের ছবি; প্রাচীন চীনা শিল্পকর্মের সুন্দর সাদৃশ্য থেকে যে কেউ বলতে পারে ওরা ভাইবোন।
আরতির মা ডাকলেন, “দেখ চাঁদু, এরা হিন্দু নয়, কিন্তু ঘর সংসার কেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে।” চাঁদু আমার উপস্থিতিতে সঙ্কোচ বোধ করছিল। উত্তর না দিয়ে সে মাকে ইঙ্গিতে থামতে বললে। এমন সময় সায়েব ঘরে ঢুকলেন। সকলে চুপ।
আরতির-মা হাত জোড় করে কাঁদো-কাঁদো স্বরে বাংলায় বললেন, “বাপ- মরা মেয়ে, ওর কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না। আপনাকে রক্ষে করতেই হবে।”
সায়েব বুঝতে না পেরে বৈদ্যনাথবাবুর দিকে তাকালেন। “কি হয়েছে? খুন জখমের মামলা নাকি?”
বৈদ্যনাথবাবু উত্তর দিলেন, “খুন-জখমের মামলা নয়। মামলা এই মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে হচ্ছে। বিবাহ-ঘটিত গোলযোগ।”
সায়েবের সঙ্গে আমিও চমকে উঠে আরতির দিকে চাইলাম। সিঁথিতে সিঁদুর নেই, কে বলবে বিবাহিতা!
আরতির মা কান্নায় ভেঙে পড়া অবস্থায় বললেন, “সিঁদুর কপাল থেকে মুছে দিয়েছি। ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে ভাবতেই বুকটা মুচড়ে ওঠে।”
সায়েবের সঙ্গে তার মায়ের কথাবার্তার দিকে আরতির লক্ষ্য নেই। সে তখন দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখছে।
গোপন কিছু আলোচনা হবে বুঝতে পেরে আমি বেরিয়ে গিয়ে সায়েবের শোবার ঘরে বসলাম। দরজা ভেজানো। ভিতরে কথা চলছে। মাঝে-মাঝে দু’একটা শব্দ বিক্ষিপ্ত হয়ে ভেসে আসছিল।
মিনিট কুড়ি পরে সায়েব আমাকে ডাকলেন। বললেন, “ভিতরে এসো।”
ঘরে ঢুকতেই শুনলাম, সায়েব বলছেন, “আরতিকে এখানে রেখে আপনারা সবাই পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করুন।” বৈদ্যনাথবাবু একটু ইতস্তত করছিলেন। সায়েব তাঁকেও চলে যেতে বললেন।
ওঁরা চলে গেলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “দোভাষীর কাজ করতে পারবে?”
আমি অবুঝের মতো চেয়ে রইলাম। দূরে সোফার এক কোণে আরতি মুখ নিচু করে বসে আছে।
“আত্মীয়স্বজন সামনে থাকলে নিজের মনের কথা খুলে বলতে পারে না অনেকে। তাই ওঁদের বার করে দিলাম। মেয়েটির নিজের মুখ থেকে সব শোনা প্রয়োজন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “বৈদ্যনাথবাবু চলে গেলেন কেন?”
“প্রশ্ন করলে মক্কেলের হয়ে উনিই উত্তর দিয়ে দেন। এই স্বভাব আরও বিপজ্জনক। যাক, পারবে দো’ভাষীর কাজ করতে?”
“কখনও যে দো’ভাষীর কাজ করিনি।”
সায়েব বললেন, “সেজন্য চিন্তা নেই। আমি যা জিজ্ঞাসা করবো, তোমাদের ভাষায় আরতিকে তা বুঝিয়ে দাও। তারপর ওর উত্তর বাংলা থেকে ভাষানুবাদ করে আমাকে শোনাও, ভাবানুবাদ নয় কিন্তু।”
“আরতি”, সায়েব ডাকলেন।
আরতি যেন ভয় পেয়েছে। লজ্জাবতী-লতার মতো সে সঙ্কুচিত হয়ে উঠলো। তার দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ।
“আরতিদেবী, আপনি ইংরেজি জানেন কিনা সায়েবকে বলুন।”
আমি বাংলাতে বললাম।
আরতি আমার মুখের দিকে করুণভাবে তাকালো। বাঙালী ঘরের মেয়ে, তার অসহায় অবস্থা খানিকটা বুঝতে পারি। শেষে খুব আস্তে সে বললে “না, সায়েবদের ইংরেজী বুঝি না।”
“বাঃ এই তো কথা ফুটেছে,” সায়েব সানন্দে বললেন। “ইস্কুলে পাঠায়নি মা?” তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
“হ্যাঁ, ক্লাশ নাইন।” আরতির উত্তর আমাকে অনুবাদ করতে হলো না।
সায়েবের নির্দেশে আরতিকে বললাম, “সায়েব বলছেন, মোটেই লজ্জা করবেন না। আপনার মা, ভাই, কেউ এখানে নেই। সুতরাং আপনার মনের ঠিক কথাটি সায়েবকে বলুন, তা হলে সায়েবের পক্ষে কেস করা সহজ হবে।”
আরতি চুপ করে রইলো।
“Is her husband a beautiful person? Did she love him after the marriage?” সায়েব আমাকে অনুবাদ করতে বললেন।
আরতিকে প্রশ্নটি বাংলায় জিজ্ঞাসা করতে আমার নিজের সঙ্কোচ বোধ হচ্ছে। অনেক নিষিদ্ধ আলোচনা সহজেই ইংরেজিতে করা যায়, কিন্তু নিজের মাতৃভাষায় এক অপরিচিতা যুবতীকে জিজ্ঞাসা করতে কেমন বাধোবাধো ঠেকছে।
সায়েব জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। “কি হলো? গো অন্, গো অন্। সময় নষ্ট করো না।”
আর এক মুহূর্ত নষ্ট হলেই তিনি রেগে উঠবেন। যথাসম্ভব গাম্ভীর্য রক্ষা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আরতিদেবী আপনার স্বামীটি দেখতে কেমন? বিয়ের পর তাঁকে পছন্দ হয়েছিল?”
আরতি মাটিতে মিশিয়ে যেতে চাইলো। লজ্জা ও ভয়ের সংমিশ্রণে তার চোখ লাল হয়ে উঠলো। রুমালে সেন্ট ছিল, তাই চোখ মোছার সময় তার গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সে উত্তর দিল না।
“বলুন লজ্জা কী? সায়েব আপনার দাদুর বয়সী।” আমি বললাম।
আরতি তবুও নিরুত্তর। বেচারা শেষে কান্নায় ভেঙে পড়লো। “মা কোথায়? আমি মায়ের কাছে যাবো।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সায়েব বললেন, “আজ তা হলে এই পর্যন্ত থাক। এখনই মিসেস বোস্টন নামে একজন নতুন মক্কেলের আসবার কথা আছে।”
আরতির-মা শনিবারে আসবেন বলে বিদায় নিলেন।
.
একটু পরেই মিসেস বোস্টন এলেন। বছর পঁচিশের রূপসী ও স্বাস্থ্যবতী এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে, ক্লান্ত মুখশ্রী। হাতের ভ্যানিটি ব্যাগ দোলাতে-দোলাতে তিনি ঘরে ঢুকলেন।
“গুড্ ইভিনিং মিসেস বোস্টন। সোজা আপিস থেকে আসা হচ্ছে নাকি?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
“হ্যাঁ, বাড়ি ঘুরে আসতে হলে পাছে দেরি হয় সেই জন্য সোজা চলে এলাম।”
“তাহলে চা মন্দ লাগবে না।”
ধন্যবাদান্তে মিসেস বোস্টন জানালেন, চা পানে আপত্তি নেই।
চায়ের কাপ সামনে রেখে কথা আরম্ভ হলো। মিসেস বোস্টনের কথায় ও ভাবে জড়তা নেই। কে বলবে তাঁর সঙ্গে সায়েবের এই প্রথম সাক্ষাৎ।
“বৈবাহিক ব্যাপারে আপনার উপদেশ প্রয়োজন” মিসেস বোস্টন বেশ সহজ অথচ দৃঢ়ভাবে বললেন। সায়েবের পাশে বসে আমি ভাবছিলাম, মিনিট কয়েক আগে যে মেয়েটিকে দেখেছি তার সঙ্গে মিসেস বোস্টনের কত পার্থক্য!
মিসেস বোস্টন বললেন, তিনি এক মার্চেণ্ট আপিসের টেলিফোন অপারেটর। স্বামী পোর্ট পুলিশের সার্জেন্ট, বর্তমানে বিপথগামী ও দুশ্চরিত্র। অর্ধেক দিন বাড়ি ফেরেন না। মিসেস বোস্টন অবিচলিতভাবে বললেন, স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করা সম্ভব নয়।
মিসেস বোস্টন আইনের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি জানেন। তাঁকে কোনো প্রশ্ন করতে হলো না, নিজেই বললেন, “চরিত্রহীনতার প্রমাণ আমি পূর্বেই সংগ্রহ করে রেখেছি। তার জন্য অসুবিধা হবে না। ছেলেকেও আমার কাছে রাখতে চাই।”
মিসেস বোস্টনের সঙ্গে আরতির তুলনা করছিলাম। দু’জনেই প্রায় এক সমস্যা নিয়ে এসেছে। অথচ একজন নিঃসঙ্কোচে সব বলে যায়; আর একজন প্রশ্ন করলেও নীরব থাকে এবং ফুঁপিয়ে কাঁদে।
.
কয়েক দিন পরের কথা। চেম্বারে আমার কাজ ছিল। তাই সায়েব আমাকে রেখে আগেই ক্লাবে ফিরে গেলেন। সন্ধ্যার একটু পরে যখন আমি ক্লাবে গেলাম তখন দেখি আরতির মা সোফায় বসে রয়েছেন। সায়েব ও আরতির মধ্যে খুব ভাব জমে গিয়েছে। সায়েব খুব স্পষ্ট উচ্চারণ করে ইংরেজি বলছেন, আরতিও ভাঙা ইংরেজীতে বেশ কথা বলে যাচ্ছে।
“এ বাচ্চা মেয়েটি কে?” দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে আঙুল দিয়ে আরতি আব্দারের স্বরে জিজ্ঞাসা করলো।
“আন্দাজ করো দেখি,” সায়েব বললেন।
“আপনার মেয়ে?”
“উঁহু, হলো না। আমার মেয়ে বা ছেলে কিছুই নেই।”
“বলুন না কে,” আরতি ছাড়বে না।
“মেয়েটি এখন অনেক বড়ো হয়েছে। কিন্তু আমি যখন তাকে প্রথম দেখি, সে এইরকম ছোট্ট ছিল। তখন থেকে আমাদের দু’জনের খুব ভাব। ও আমার বউ।”
সায়েবের কথা শুনে আরতি ও চন্দ্রশেখর দু’জনেই হাসিতে লুটিয়ে পড়লো। কে বলবে ওরা মামলা করতে এসেছে।
“তোমার বোন চেষ্টা করলে তোমার থেকে অনেক ভালো ইংরেজি বলতে পারবে,” সায়েব চন্দ্রশেখরকে বলছিলেন। কিন্তু আমাকে দেখে কথা বন্ধ করে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। বললেন, “আর গল্প নয়। এই ভদ্রলোক আমাকে কাজ করতে না দেখলে ভয়ঙ্কর রেগে যান।”
কাজ আরম্ভ হয়। আরতির ভয় কেটে গিয়েছে। যদিও সে চুপচাপ বসে থাকে, তবুও প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। আরতির মা বলে যান। চন্দ্রশেখর মাঝে- মাঝে যোগ দেয়। ওদের দ্রুত-কথনের সঙ্গে আমার দ্রুত-লিখনের পাল্লা চলে। ওরা বলে যায়, আমি খাতায় শর্টহ্যাণ্ডের ইকড়িমিকড়ি টানি।
একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রেখে আরতির বাবা রসময় মুখুজ্যে অসময়ে চোখ বুজলেও তাদের প্রতিপালনের মতো অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। একডালিয়া রোডের বাড়িটাও খুব ছোটো নয়। কিছুদিন আগে মা বললেন, নিচে রাস্তার ধারের ঘর দুটো দোকানঘর করে ভাড়া দিলে হয়। কাগজে বিজ্ঞাপন বার হয়। যারা বিজ্ঞাপনের উত্তর দিলো, তাদের মধ্যে অমল রায়ও ছিল। চোখে কালো চশমা ও দামী আদ্দির পাঞ্জাবি পরে অমল রায় দোকানঘর দেখতে এলো। ঘরটা নিজের জন্য নয়, তার এক বন্ধুর জন্য প্রয়োজন। ভাড়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
বন্ধুর দোকানে প্রায়ই আসতো অমল। চাঁদুর সঙ্গে তার খুব ভাব। দেখা হলেই বলে, এই যে চাঁদু, ভালো তো? মা কেমন আছেন?”
“চলুন না ভিতরে, একটু চা খেয়ে আসবেন,” চাঁদু একদিন বললে। এবং সেদিন থেকেই বাড়ির ভিতর তার অবাধে যাওয়ার অনুমতি মিললো। আরতির মা বললেন, “সময় পেলেই এদিকে এসো বাবা।”
নিঃসঙ্গ অভিভাবকহীন পরিবারে অমলের আসা-যাওয়াকে আরতির মা আশীর্বাদ মনে করলেন।
ছেলেটি খুব, বুদ্ধিমান। সে একদিন বললে, “মাসিমা, আপনাদের সমস্ত বাড়িটা রাখবার প্রয়োজন কি? নিচের আরও দু’খানা ঘর ভাড়া দিয়ে দিন, কিছু টাকা আসবে।”
“সত্যি বাবা, তোমার বুদ্ধি আছে। এমন সুন্দর মতলব আমার মাথায় আসেনি।”
“না না মাসিমা, ওসব বলে লজ্জা দেবেন না। বাবার চার পাঁচটা বাড়ি রয়েছে, উনি দিনরাত ওইসব করছেন। তাই দেখে খানিকটা শিখেছি। কিন্তু বাবার তুলনায় আমি তো কিছুই জানি না। ওঁর অদ্ভুত কর্মশক্তি। আপিস থেকে ফিরেই বিষয়-সম্পত্তির কাজ নিয়ে ডুবে থাকেন।’
“উনি কী করেন?”
“ওহো, বলতে একদম ভুলে গিয়েছি, বাবা ইঞ্জিনীয়ার।”
আরতির মা যা বলেছিলেন, আমি ঠিক তাই এখানে লিখে যাচ্ছি। ঝুলির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মালা জপতে জপতে তিনি বলছেন। আমার কিন্তু ঘেমে ওঠার মতো অবস্থা। তিনি বাংলায় যা বললেন, তা ইংরেজিতে সায়েবকে শোনাতে হচ্ছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে নোটবুকে লিখে নিতে হচ্ছে। সায়েব গম্ভীরভাবে আরতির মায়ের দিকে চেয়ে আছেন। আর মাঝে-মাঝে বলছেন, “আপনি একটু সংক্ষেপে বলুন, অতো দীর্ঘ বিবরণ দরকার নেই।”
সামান্য জিনিসকে অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ করে বলার ক্ষমতা এই ভদ্রমহিলার। একই কথা তিনবার বলবেন। আবার জিজ্ঞাসা করবেন, আমি সব কথা সায়েবকে বলছি কিনা। অমল কবে কী খেয়েছে, কতরকমের নিরামিষ তিনি রাঁধতে পারেন, কিছু বলতে বাদ রাখবেন না। তাই এখানে বর্ণনাটা তাঁর মুখ দিয়ে করাচ্ছি না। আরতির মা ক্রমশ অমলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কর্পোরেশন ট্যাক্স জমা দিতে হবে। কে যাবে? অমল। ভাড়াটিয়ারা কোর্টে মামলা করেছে। অমল উকিলের কাছে যায়। কোর্টে সাক্ষ্য দেওয়া? সেও অমল।
“জানেন মাসিমা, আরতিকে আমি স্নেহ করি। অথচ ও ভালো করে কথা বলে না। মুখ গোমড়া করে থাকে।”
মা ডাক ছাড়েন। “আরতি এদিকে একবার আয় তো।”
“কী মা?”
“অমল এসেছে। আমাকে পুজোর বাসনপত্র মাজতে হবে। বেচারা চুপচাপ বসে থাকবে কেন? চায়ের জল চাপা।”
অমল আবার আসে। আরতির মা জিজ্ঞাসা করেন, “কি বাবা মাসখানেক যে দেখা নেই।”
“পরীক্ষার পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিলাম। আবার যা-তা পরীক্ষা নয়, এম. এ.। গাদা-গাদা বই মাসিমা, পড়ে শেষ করা যায় না।”
“লেখাপড়ার কথা শুনলেও আনন্দ। কিন্তু এই ক’দিনে শরীর যে শুকিয়ে গিয়েছে।”
“চাঁদু কোথায়?
“দেখো দিকিনি। নিশ্চয় আরতির সঙ্গে ঝগড়া করছে। ও দুটোকে কিছুতেই শান্ত রাখতে পারি না।”
মাস কয়েক পরে বিরাট মিষ্টির ঝুড়ি হাতে অমল বাড়িতে ঢুকলো। “মাসিমা সুসংবাদ, পাশের খবর বেরিয়েছে।”
“বাঃ, সেজন্য তো আমি তোমাকে খাওয়াবো। তুমি আবার আনলে কেন?”
“আর মাসিমা, আপনি না হয় খাওয়ালেন, কিন্তু আরতিরা ছাড়বে কেন? যা হোক, আপনাদের আশীর্বাদে রেজাল্ট ভালোই হয়েছে। কিন্তু আর তিনটে নম্বর মাসিমা…”
“তিনটে নম্বরে কি হবে?”
“তিন নম্বর হলেই ফার্স্ট হয়ে যেতাম। জাস্টিস মুখুজ্যের মেয়ে আরাধনা আমাকে বিট করে দিলে। জাস্টিস মুখুজ্যে আবার বাবার বিশেষ বন্ধু। ওঁর অনেকদিনের ইচ্ছা আরাধনাকে আমি…।”
“তাই নাকি?”
“কতবার জাস্টিস মুখুজ্যে আমাকে বলেছেন সময় পেলেই আলিপুরে চলে আসবে। আমার কিন্তু ওসব পছন্দ হয় না। আরাধনা তো ওই রাগেই টেবিল- টেনিস, ব্যাডমিন্টন ছেড়ে শুধু বই নিয়ে ডুবে থাকলো।”
অমলের ‘মাসিমা’ অবাক হয়ে শোনেন।—”এমন সোনার টুকরো ছেলে কোথায় মেলে?”
আর একদিন অমল বললে, “মাসিমা চাঁদু ও আরতিকে সিনেমায় নিয়ে যাবো? লাইটহাউসে ভালো বই হচ্ছে।”
মাসিমা আরতিকে যেতে বললেন। “যা সিনেমা দেখে আয়।” আরতি রাজী হয় না। “আমি যাবো না। ভালো লাগে না।”
“তা কেন যাবে? পাড়ায় যতো পচা বাংলা বই হচ্ছে তার সবগুলো তো দেখা চাই। লাইটহাউসে গেলে একটু-আধটু ইংরেজি শেখা যাবে, সেখানে ভুলেও যেও না।”
শেষ পর্যন্ত চাঁদু ও আরতি সিনেমায় গিয়েছিল। বাড়ি ফিরলো ট্যাক্সিতে। চাঁদু বললে, আজ অমলদা খুব খাওয়ালেন, চমৎকার রেষ্টুরেন্ট।
“মাসিমা, এবার মিনার্ভায় ভালো বই এসেছে। চাঁদুর তো দেখা বিশেষ প্রয়োজন, যত সব সায়েন্সের ব্যাপার। আই-এস-সি’তে শুধু বই পড়লে তো চলবে না, বাইরের অনেক কিছু জানতে হবে। আমাদের অমিয় চাটুজ্যে, যে ম্যাট্রিকে দুটো আই-এস-সি’তে তিনটে লেটার পেয়েছিল, কলেজের বই তিন মাসে শেষ করে সে শুধু বাইরের বই পড়তো।”
সিনেমা দেখে সন্ধ্যার সময় ট্যাক্সিতে অমলরা ফিরলো। আরতির হাতে এক থোক রজনীগন্ধা। বললে, “অমলবাবু কিনে দিয়েছে। খুব সস্তায় ট্যাক্সি-স্ট্যাণ্ডের সামনে বিক্রি হচ্ছিলো।”
“এই যে দিদি, আরতির জন্য ওই সুন্দরপানা ছেলেটিকে তাহলে জামাই করছেন?” পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলা বেড়াতে এসে জিজ্ঞাসা করলেন।
“কে বললে?”
“না বললেও বোঝা যায়। পাড়াশুদ্ধ সবাই জানে। কালকে কি পাকা দেখা ছিল? অতো ফুলটুল নিয়ে গাড়ি থেকে নামা হলো।”
আরতির মা প্রথমে প্রতিবাদ করেছিলেন, কিন্তু পাড়ায় যেখানে যান, একই কথা। “আরে বাবা, লুকোচ্ছ কেন? অমল নিজে চায়ের দোকানে গল্প করছিল, আমার ছেলে সেখান থেকে শুনে এসেছে। আরতির সঙ্গে ওর নাকি ইয়ে’ চলছে।”
আরতির-মার কাঁদতে ইচ্ছে হয়। রসময় মুখুজ্যের বংশে এমন অপবাদ!
.
এটর্নি বৈদ্যনাথবাবু একটু দেরিতে এসে সায়েবের পাশে বসেছিলেন।
রসময় মুখুজ্যে ছিলেন তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু। বন্ধুর মৃত্যুর পর তিনি মাঝে-মাঝে আরতিদের দেখাশোনা করতে যেতেন। আরতির মায়ের চিঠি পেয়ে তিনি দেখা : করতে এলেন। আরতির মা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। বৈদ্যনাথবাবু বুঝতে পারেন না ব্যাপার কতদূর এগিয়েছে।
অমল জানালো, সে আরতিকে বিয়ে করতে পারে, তবে বাবা জানতে পারলেই বিপদ। গোপনে শুভকর্ম সারতে হবে। পরে মায়ের মাধ্যমে বাবাকে শান্ত
করা খুব শক্ত হবে না।
“অগত্যা আমাদের বিয়েতে মত দিতে হলো,” বৈদ্যনাথবাবু বললেন। “তাছাড়া আরতির-মা তখন বললেন, ছেলেটি খারাপ নয়।”
সায়েব এতোক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। এবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “বিয়েটা কী ভাবে হলো বলুন।”
“সিভিল ম্যারেজ আইনে বিয়ে। রেজিস্ট্রার বাড়িতে এসে বিয়ে দিয়ে গেলেন।” বৈদ্যনাথবাবু উত্তর দিলেন।
আরতির মা আত্মীয়স্বজনদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। অমল কায়স্থ, তিনি প্রথমে জানতেন না। ধারণা ছিল ব্রাহ্মণ। না হলে জাস্টিস মুখুজ্যের মেয়ে আরাধনার সঙ্গে—। বৈদ্যনাথবাবুর প্রশ্নে কিন্তু প্রকৃত সত্য প্রকাশ পেলো।
বিয়ের দিন রাত্রে প্রচুর রান্না হয়েছে। অমল বলেছিল, তার অনেক বন্ধুবান্ধব আসবে। কিন্তু কোথায় বন্ধুরা? কারুর দেখা নেই। অমল বললে, “কি জানি, এল না কেন, অথচ সবাই আসবে বলেছিল।”
মেয়েকে সোনায় সাজিয়ে দিয়েছিল আরতির মা। দান-সামগ্রীর কোনো ত্রুটি রাখেননি।
বিয়ের পর কনে-জামাই-এর বিদায় নেওয়াটা চিরাচরিত রীতি। কিন্তু এক্ষেত্রে কোথায় যাবে তারা? কনের বাড়িতেই ফুলশয্যা পাতা হলো। রাশি-রাশি ফুলে সাজানো ঘর। নানা বর্ণ ও গন্ধের পুষ্পাভরণে আরতিকেও সদ্য ফোটা ফুলের মতো দেখাচ্ছিল।
কিছুদিন মন্দ কাটলো না। “জামাই-এর যত্নের জন্যে যখন যা প্রয়োজন করেছি”, আরতির মা বলছিলেন। “আমি নিজে একটু সুখী মানুষ। দোতলার দক্ষিণমুখো ঘরটাতে চিরকাল শুতাম। জামাই-এর জন্য তাও ছেড়ে দিয়েছি।”
সায়েব বললেন, “আপনি এবার থামুন।” আরতিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “অমলকে তোমার পছন্দ হয়েছিল?”
আরতি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।
সায়েব আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “বিয়ের পর অমল তোমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতো?”
আরতি এবার উত্তর দিলে। বললে, “প্রথম প্রথম আমাকে খুব আদর করতো।”
সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “তারপর?”
আরতি আবার চুপ হয়ে গেল। বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও মুখ খুললে না।
আরতির মা বললেন, “তারপরের ঘটনা আমি সব জানি। আরতির কাছ থেকেই শুনেছিলাম।”
আরতির-মা যা বললেন তাতে জানা গেল বিয়ের কিছুদিন পরেই অমলের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন আরম্ভ হয়। দিন পনেরোর জন্য আরতি ও চাঁদু মামার বাড়ি গিয়েছিল। অমল যায়নি, বালিগঞ্জের বাড়িতে শাশুড়ির কাছেই ছিল।
ফিরে এসে আরতি দেখলে অমল যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। মাঝে- মাঝে সে টাকা চায়। প্রায়ই বলে, “কিছু টাকা দিতে পারো? বাড়ি যাওয়া হচ্ছে না, টাকাও আনা হচ্ছে না।” মাকে বলতে আরতি লজ্জা পায়। নিজের গোপন সঞ্চয় যা ছিল তার থেকে কিছু স্বামীকে দেয়।
“তুমি যে ব্যবসা করেছিলে, সেখানে যাও না?” আরতি জিজ্ঞাসা করলে।
আরতিকে জড়িয়ে ধরে অমল, “তোমাকে ফেলে যেতে ইচ্ছে হয় না।”
“ছিঃ, লোকে বলবে কি?” বাহুবন্ধন থেকে আরতি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।
“আরতি কিছু টাকা দিতে পারো?”
“আমার নিজের তো আর কিছুই নেই,” আরতি দুঃখের সঙ্গে উত্তর দেয়।
“বাজে কথা ছাড়ো, টাকা আমার চাই। মায়ের কাছে চাও।”
আরতি চমকে ওঠে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর কোন সময়ে মায়ের কাছে টাকা আনতে উঠে যায়।
“আমার কিছু টাকা দরকার।”
“তিনদিন আগে মায়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা এনে দিয়েছি।”
“বাজে বকিও না।”
“বারবার হাত পাততে লজ্জা করে। আমি পারবো না।”
“লজ্জাবতী লতা-আমার। ওষুধ পড়লে তোমার ঘাড় পারবে।”
“আরতি কেঁদে ফেলে। বিছানায় মুখ লুকিয়ে চোখের জলে মাথার বালিশ ভিজিয়ে ফেলে। মাকে বলতে ইচ্ছা হয় সব। কিন্তু সঙ্কোচে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। সেদিন রাত্রে ষাট পাওয়ারের বাতি নিবিয়ে, অমল নীলাভ স্তিমিত আলোর সুইচ টিপে দিলে। বিছানার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো সে। ঘৃণা বোধ হচ্ছিলো আরতির। নীচ, অসভ্য লোক। অমল তার মুখের চাদরটা সরিয়ে দিতে চেষ্টা করলো। ঘৃণায় রি রি করে উঠলো আরতির দেহ।
অম্বুল কানের কাছে মুখ এনে বললে, “রাগ হয়েছে বুঝি। মাপ চাইছি। বাবাকে এখনও রাজী করাতে পারছি না, তাই মনটা মোটেই ভাল নেই। কখন যে কাকে কি বলে ফেলি!” আরতি তবুও নিশ্চল পাথরের মতো পড়ে রইলো।
অমল আবার ক্ষমা চাইলো। বারবার প্রত্যাখান সত্ত্বেও পিঠে হাত বোলাতে লাগলো। “লক্ষ্মীটি চোখ খোলো, দেখো কি এনেছি।”
আরতি আর অভিমান রাখতে পারলো না। সে চোখ খুললো। অমলের হাতে দু’ছড়া শ্বেত-শুভ্র রজনীগন্ধার মালা। মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ভুলে গেল আরতি। স্বামীর বন্য ও উষ্ণ আলিঙ্গনে তার অন্তরের সকল সঞ্চিত অভিমান ও অপমানের তুষার গলে গেল।
রাত পোহায়। অমল যেন পুরনো দিনের অমল। আনন্দ ও হাসিতে পরিপূর্ণ। আরতি আজ খুব খুশী। অহেতুক আশঙ্কায় নিজেকে জর্জরিত করেছিল সে, তাই ভেবে লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠলো।
“দেখুন মাসিমা”–সম্বোধনের ত্রুটি বোঝামাত্রেই অমল লজ্জিত হয়ে সংশোধন করে বলে, “দেখুন মা, চাঁদুর জন্যে একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে। এমন সুযোগ রোজ আসে না। আমারই জানাশোনা এক পাঞ্জাবীর বিরাট দর্জির দোকান আছে। বেচারার বউ মারা যাওয়ায় কলকাতা ছেড়ে এই মাসের মধ্যে চলে যেতে চায়। চালু কারবার। মাসে হাজার টাকা স্ট্যাণ্ডিং ইনকাম। দশ হাজার টাকা পেলেই সে দোকান বিক্রি করে দেবে। একেবারে যাকে বলে সুবর্ণ-সুযোগ। দোকানের দাম তো দশ মাসেই উঠে যাবে।”
“কিন্তু অতো টাকা কোথায় পাবো? তুমি তো সব জানো বাবা।”
“তার জন্য ভাবনা কি? কসবার বাড়িটা বন্ধক রাখলেই টাকা পাওয়া যাবে। মাসে-মাসে দোকানের আয় থেকে শোধ দিলে দশমাসের মধ্যেই বাড়ি খালাস হয়ে যাবে।”
“শ্বশুরের বাড়ি বন্ধক দেওয়া অলক্ষ্মীর নিদর্শন।”
রাতে ষাট পাওয়ারের বাতি নিবে নীলাভ মৃদু আলোটা আবার জ্বলে ওঠে। সবকিছু অস্পষ্ট, অথচ মোহময় মনে হয় আরতির। অমল আবার পকেট থেকে মালা বের করলো। শ্বেত-শুভ্র রজনীগন্ধা।
দেহ ও মনে পরিতৃপ্ত আরতি কল্পনার স্বর্গে বিচরণ করছিল কিন্তু সেখান থেকে স্বামী আবার তাকে পৃথিবীর মাটিতে টেনে আনলো। বললে, “তোমার মায়ের মোটেই বুদ্ধি নেই। থাকলে টাকা দিয়ে দোকানটা নিতেন। ভাবছি, আমি নিজেই তাহলে ব্যবসাটা নিই। তুমি কি বলো?”
“চমৎকার হয়। প্রতিমাসে হাজার টাকা রোজগার।”
“কথাটা মন্দ নয়। অর্ধেক টাকা তো যোগাড় করতে পারবো, কিন্তু বাকী অর্ধেক নিয়েই সমস্যা। তোমার গহনাগুলো মাস পাঁচেকের জন্য বন্ধক দিতে পারলে…”
শুনেই আরতি ভয়ে কুঁচকে ওঠে। নীল আলো আর ভালো লাগে না। ষাট পাওয়ারের বাতিটা জ্বালাতে পারলে ভূতটা হয়তো পালাতো।
পরের দিন সকালে অমলকে একান্তে ডেকে আরতি বললে, “গহনা সম্বন্ধে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি রাজী তো হলেনই না, বরং রেগে উঠলেন।”
আশ্চর্য, অমল কিন্তু রাগ করলো না। শান্তভাবেই বললে, “ও।”
.
একটানা শর্টহ্যাণ্ড লিখে ক্লান্ত হাত আর চলতে চাইছিল না। সায়েবের মুখের দিকে তাকাতেই তিনি বুঝতে পারলেন। বৈদ্যনাথবাবুকে বললেন, “একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। আমার স্টেনোগ্রাফার অনেকক্ষণ লিখেছে, ওর একটু রেস্ট প্রয়োজন।”
বৈদ্যনাথবাবু তখন জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন বুঝছেন?”
সায়েব বললেন, “সবটা না শুনে কিছু বলবো না। তবে এই মেয়েটির জন্য আমি সত্যই দুঃখিত।”
আরতির মা বললেন, “ওর ভাগ্যটাই খারাপ। না হলে পাঁচবছর বয়সে বাবাকে হারাবে কেন?”
সায়েব উত্তর দিলেন না। বৈদ্যনাথবাবুকে বললেন, “এক গ্লাস করে অরেঞ্জ স্কোয়াশ আনতে বলি।”
বৈদ্যনাথবাবু বললেন, “আমার আপত্তি নেই।”
আরতি বললে, “মা কিন্তু বাইরে কিছু খান না।”
একজন বাদে আমরা সবাই অরেঞ্জ স্কোয়াশ খেলাম। আবার কাজ আরম্ভ হলো।
দোকান কেনবার প্রস্তাব প্রত্যাখানের পর অমল যেন একেবারে পালটিয়ে গেল।
টাকার কথা একদম তোলে না। সকালে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যায়, ফেরে সূর্য ডোবার অনেক পরে। বোধ হয় ব্যবসার পিছনে খুব পরিশ্রম করছে।
একদিন বাড়ির সকলকে সে সিনেমা দেখিয়ে আনলো। ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার আগে কে. সি. দাশের দোকানে বিরাট ভোজ।
সেই রাত্রে ষাট পাওয়ারের বাতি নিভে নীলাভ আলোটা আবার জ্বলে উঠলো। পকেট থেকে রজনীগন্ধার মালা বেরুলো। সোহাগ দেখিয়ে আরতি বললে, “আজকাল অত্যন্ত পরিশ্রম করছো। অমন সোনার মত রঙ রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে।”
“হুঁ। ব্যবসার বাজার ভালো চলছে, তাই খাটতে হচ্ছে।” অমল উত্তর দিলে।
সপ্তাহখানেক পর আরতির হাতে একশ’ টাকা দিয়ে অমল বললে, “মায়ের কাছ থেকে যা নিয়েছিলে, ফেরত দিও।”
হাতে টাকা পেয়ে মা লজ্জিত হলেন। জামাইকে তিনি ভুল বুঝেছিলেন।
দিনকয়েক পরে খাবার সময় অমল বললে, “দিল্লী থেকে প্লেনে আমার কাকা আজ কলকাতায় আসছেন। কাকা আমাকে খুব ভালোবাসেন। তাই ভাবছি আরতিকে নিয়ে ওই সময় দমদম যাবো।”
বেলা চারটায় ট্যাক্সি হাজির। আরতিকে এক ঘণ্টা ধরে সাজিয়েছেন মা। বেনারসী শাড়ি, গলায় আধুনিক ডিজাইনের হার, পরিপুষ্ট নিটোল হাতে চুড়ির গোছা—যেন লক্ষ্মী-প্রতিমাটি। একটুখানি ঘোমটা দিয়েছে আরতি, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে।
যাবার আগে মা বললেন, “চাঁদুকে সঙ্গে নিয়ে যাও।”
অমল বেশ অসন্তুষ্ট হলো। অনিচ্ছার সঙ্গে বললে, “বেশ তো। চলুক আমাদের সঙ্গে। তবে পড়াশুনার ক্ষতি হবে।”
মা বললেন, “একদিনের ব্যাপার, এমন কিছু ক্ষতি হবে না। তাছাড়া তোমরা তো সাতটা-আটটার মধ্যে ফিরে আসছো।”
চাঁদুকে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিয়ে অমল বললে, “হ্যাঁ, সাতটা-আটটার মধ্যে ফিরবো।” ট্যাক্সি ছেড়ে দিলো!
শ্যামবাজারের মোড়ে শীতের সন্ধ্যা নেমে এল। ট্যাক্সি থামিয়ে অমল বেরিয়ে পড়লো। ফিরলো দ্বারিকের দোকান থেকে কেনা একটা সন্দেশের চৌকো বাক্স হাতে। ট্যাক্সি স্টার্ট নিচ্ছিলো। এমন সময় অমল বললে, “এই যাঃ। একটু থামো। কাকার জন্য তো আরও কিছু নরমপাকের সন্দেশ নিতে হবে। উনি কড়াপাক একদম পছন্দ করেন না, মনেই ছিল না। আরেকবার যেতে হবে। চাঁদু ভাই এবার তুমি….।”
“হ্যাঁ-হ্যাঁ নিশ্চয়।” জামাইবাবুর হাত থেকে পাঁচ টাকার নোট নিয়ে চাঁদু দ্বারিকের দোকানের দিকে চললো।
“একটু পা চালিয়ে। প্লেনের সময় হয়ে এসেছে,” অমল মুখ বাড়িয়ে বললে।
নরমপাকের সন্দেশ নিয়ে চাঁদু তাড়াতাড়ি ফিরে এসে গাড়ি দেখতে পেলো না। গাড়িটা কোথায়? এইখানেই তো ছিল। এগিয়ে গেল নাকি। চাঁদু চারিদিকে তাকায়, গাড়ি অদৃশ্য।
অধীর উৎকণ্ঠায় সেদিন কাটলো। ভয়ে আরতির-মা’র দেহ কাঁটা দিয়ে উঠলো। একমাত্র মেয়ে তাঁর। পিতৃহীন। পরের দিন পুলিশে খবর দিলেন। শুনে দারোগাবাবু হাসলেন। বললেন, “বিয়ে-করা-বউকে জামাই নিয়ে গেলে পুলিশ কি করবে?”
মাস পরিবর্তন হলো। কোনো সংবাদ নেই। চারিদিকে অনুসন্ধান চললো, কিন্তু সব ব্যর্থ।
প্রায় দু’মাস পরে বাড়ির সামনে আবার একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। হর্ন শুনে মা ছুটে বেরিয়ে এলেন। একি? ট্যাক্সিতে আরতি বসে রয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে আরতির! আরতি বললে, “কথা পরে, আগে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দাও।”
আরতিকে চেনা যায় না। শরীরে এক ফোঁটা মাংস নেই। রক্তহীন পাংশু দেহ। পরনে নোংরা সাদা খোলের শাড়ি। হাতে একগাছি নোয়া, আর কিছু নেই।
আরতি কোনো কথা বলে না, শুধু কাঁদে। ডাক্তার এল। পরীক্ষা করে বললেন, দেহের অবস্থা শোচনীয়। রক্তহীনতা রোগ। গুরুতর নাভার্স ডিসঅর্ডার। ম্যালনিউট্রিশন তো আছেই।
বৈদ্যনাথবাবুও খবর পেয়ে দেখতে এলেন। অনেক বুঝিয়ে আরতির কাছে সব শুনলেন।
সেদিন ট্যাক্সি থেকে চাঁদুকে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি ছুটতে লাগলো সারকুলার রোড ধরে। বিবেকানন্দ রোডে মোড় ফিরে সোজা হাওড়ার পুল। শেষপর্যন্ত শালকিয়ার এক বস্তির সামনে গাড়ি থামলো। অমল গহনাগাটি সব খুলে দিতে বললে। আরতি বললে, “এসব আমি দেবো না।”
“বোকামি করো না। রাত্রে কত গুণ্ডার দল কাছাকাছি থাকে। আমি সাবধানে রেখে দেবো। কাল সকালেই আমরা ট্রেনে দেওঘর যাচ্ছি। সেখানে বাবা-মা আছেন।”
শালকিয়ার বস্তিতে চব্বিশ ঘন্টা কাটিয়ে সন্ধ্যায় হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে দেওঘর। কোথায় বাবা-মা? কেউ নেই। বাড়িটা শহর থেকে কিছু দূরে, কুণ্ডায়। বোধ হয় পূর্বেই ঠিক ছিল। এক কুদর্শনা মধ্য বয়সী স্ত্রীলোক আরতিকে বললে “চলহে রাণীসাহেবা, হাঁড়ি ঠেলতে চলো। এখানে কেউ তোমার মাইনে- করা ঝি নেই।” ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছিল বলে একদিন তো সে চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তুলে দিলো। আরতি একদিন বললে, “আমি মা’কে চিঠি লিখবো।”
“অতো মাতৃসোহাগে কাম নেই,” মেয়েটি দন্ত বিকশিত করে বললে।
সপ্তাহ কয়েক পরে আবার হাওড়া স্টেশনে। সেখান থেকে বারাকপুর। একটা ছোট্ট টালির চালের বাড়ি। খাওয়া-দাওয়ারও বেশ অভাব। দু’বেলা ডাল-ভাত ছাড়া কিছুই জোটে না। বোধ হয় গহনা বিক্রির টাকা ফুরিয়ে এসেছে।
এইখানে সায়েব বললেন “একটু থামুন”। চেয়ে দেখলাম সায়েবের কপালের রেখাগুলো গভীর হয়ে উঠেছে। আরতির মা বর্ণনা করছেন। আরতি নীরবে এক ধারে বসেছিল। তাকে সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “এ সব কি সত্য?”
আরতির মা ঝুলির মধ্যে মালা জপতে জপতে বললেন, “নিশ্চয়, একদম সত্য।”
“আপনাকে নয়, আরতিকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই।” সায়েব রেগে উঠলেন।
আরতি কিন্তু উত্তর দিলো না। আবার কাঁদতে লাগলো।
“এর পরের ঘটনা আরও জঘন্য। সায়েবকে বলো ভদ্রঘরের ব্যাপার, এগুলো কোর্টে বলা চলবে না।” আরতির-মা আমাকে বললেন।
সায়েব আগ্রহভরে তাঁর দিকে মুখ ফেরালেন।
কোনো এক সন্ধ্যায় অমলের সঙ্গে এক অবাঙালী ভদ্রলোক বারাকপুরের বাড়িতে এলেন। আরতিকে আড়ালে ডেকে অঞ্চল বললে, “আমার ব্যবসায়ের নতুন পার্টনার, ওকে অসন্তুষ্ট কোরো না।”
অবাঙালী ভদ্রলোকটির সঙ্গে অমল আরতির পরিচয় করিয়ে দিলে। ভদ্রলোক তার দিকে বক্রদৃষ্টিতে তাকালেন। অমলের সঙ্গে তার কথা হতে লাগলো। আরতি বসে রইলো চুপচাপ। একটু পরেই অমল বললে, “আমি এখন আসছি। তোমরা ততোক্ষণ গল্প করো।” অমল উঠে গেল। ঘরে মাত্র দুটি প্রাণী। চার দিক নিঝুম। ভদ্রলোক আবার চোখ দিয়ে এক কদর্য ইঙ্গিত করলেন। চেয়ারটা আরও কাছে এগিয়ে এনে বসলেন।
আরতি সঙ্গে-সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো। বললে, “আমি চললাম, আমার রান্না আছে। আপনি বসবেন, না উঠবেন?” দরজা খুলে আরতি আঙুল দিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিলে। উত্তেজনায় সে ঘেমে উঠেছে।
সেদিন রাতে অমল ফিরলো দেরিতে। অমলের হাতে আরতির নিগ্রহ চললো ক’দিন।
কয়েকদিন পরে অমল আরতিকে কাছে ডাকলো। “কাল সন্ধ্যায় আমার পার্টনার আবার আসবে, এবার গোঁয়ার্তুমি করলে জীবন্ত কবর, মনে থাকে যেন।”
পরের দিন সকালে দু-আনা পয়সা সম্বল করে আরতি কি করে সকলের অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে শ্যামবাজারে এবং সেখান থেকে ট্যাক্সি করে একডালিয়া রোডে উপস্থিত হয়েছিল আরতির মা তাও বললেন।
সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “আরতি ফিরে আসার পর আপনারা পুলিশে খবর দিয়েছিলেন কি?”
“না, দিইনি।”
“দেওয়া উচিত ছিল,” সায়েব বললেন। তারপর বৈদ্যনাথবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মামলার ব্যাপারটা এবার বলুন।”
বৈদ্যনাথবাবু বললেন, “অমল আরতিকে ফিরিয়ে দেবার জন্য উকিলের চিঠি দেয়। আমরা তখন জুডিসিয়ল সেপারেশনের জন্য মামলা দায়ের করি। অমল সঙ্গে-সঙ্গে দাম্পত্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা করেছে। বলেছে, নাবালিকা স্ত্রীর উপর স্বামীর সর্বপ্রথম অধিকার।”
“আপনাদের কাছে যা শুনলাম, তাতে মনে হয় লোকটার অবস্থা খারাপ। কিন্তু মামলা করার টাকা পাচ্ছে কোথা থেকে?”
বৈদ্যনাথবাবু বললেন, “সত্যি চিন্তার বিষয়।”
আরতির মা বললেন, “ওনার সেই অবাঙালী পার্টনার নিশ্চয় টাকা যোগাচ্ছেন।”
সেদিনের মতো বৈদ্যনাথবাবু, আরতি, তার মা ও ভাই বিদায় নিলেন। আরতির মা যাবার আগে সায়েবকে ভালো করে কেস্ করবার জন্য অনুরোধ করে গেলেন।
দিন তিনেক পরে ব্রীফ পড়া শেষ করে সায়েব আমাকে একটা নোট লিখে নিতে বললেন। লেখা শেষ হবার পর বললেন, “অমল বলছে সে কোনোদিন বলেনি যে, এম. এ. পাশ; অথবা তাঁর বাবা ইঞ্জিনীয়ার। কেষ্টা বেশ মজার। আমরা বলছি, “অমল একটা ঠক। শাশুড়ীর পয়সা বার করবার জন্য আরতির উপর দৈহিক অত্যাচার করেছে।” ওরা বলছে,”আরতির মা প্রায়ই জামাই-এর কাছে টাকা নিয়েছেন। টাকা দিতে না পারায় মেয়েকে আটক রেখেছেন। সুতরাং আরতিকে ফেরৎ দেওয়া, হোক।”
আমি বললাম, “লোকটার শয়তানী বুদ্ধি খুব।”
যেদিন মামলা আরম্ভ হলো সেদিন সকালে কোর্টে গিয়েছিলাম। বেশ সাজগোজ করে আরতি এসেছে। ফিকে নীল রঙের ঢাকাই শাড়ি পরেছে। পানে ঠোঁট দুটো লাল হয়ে রয়েছে। একসঙ্গে এতো লোকজন দেখে কেঁদে ফেললে। ঘোমটা দিয়ে তার মা পাশে বসে ইষ্টনাম জপ করছেন।
চন্দ্রশেখর সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “জজ-সাহেব কখন আসবেন?”
আমি বললাম,”সময় হয়ে গিয়েছে। এখনই আসবেন।”
চন্দ্রশেখর কোঁকড়া চুল, সুদর্শন একজন লোককে দেখিয়ে বললে, “ওই হচ্ছে অমল।” আমাদের দেখেই অমল একটু দূরে সরে গেল।
এদিকে কোর্টঘরেও অনেক লোক জমা হয়েছে। কিন্তু জজ-সায়েব তাঁদের হতাশ করলেন। দর্শকদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন। নিতান্ত অনিচ্ছা সহকারে সকলকে বাইরে চলে যেতে হলো।
মামলা আরম্ভ হলো। বসে বসে শুনতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। কিন্তু উপায় নেই। বার-লাইব্রেরী থেকে কতকগুলো বই চেম্বারে নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া টাইপের কাজ অনেক রয়েছে। লাইব্রেরীতে বই আনতে গিয়ে ছোকাদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি ডেকে বললেন,”এই যে স্যার, এতো হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছো কোথায়? মিত্তিরের কোর্টে তোমাদের ওই বাইজীর মামলাটা শুনতে গেলাম, তা বার করে দিলে।”
“বাঈজী কোথায় পেলেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“আরতী-বাঈ না ওইরকম কী একটা যে নাম শুনলাম।”
হারুবাবু বিড়ি টানছিলেন। তিনি বললেন, “ছোকরা আছে ভালো। সব লাতাই কেস। আর শালা আমার সায়েবের শুধু আরবিট্রেশন ম্যাটার, একটু রসকষ নেই। তা যাহোক তোমার আরতি-বাঈ-এর ফ্যাক্টটা পরে বলো কিন্তু।”
টিফিনের সময় সায়েব চেম্বারে লাঞ্চ করতে এলেন। বেশ রেগে রয়েছেন মনে হলো। মোহনচাঁদ কোর্টে ছিল। সে বলল, “বাবু, কোর্টে আমাদের এক সাক্ষীকে . অন্যপক্ষের ব্যারিস্টার এমন জেরা করেছেন যে, সে ফেন্ট হয়ে পড়ে গেল।” ব্যাপারটা খেতে খেতে সায়েব বললেন। “নিজের ব্যারিস্টারকে সমস্ত ঘটনা খুলে না বললে এই হয়। মামা সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন যে, বিশেষ -বিবাহ-আইনে আরতির বিয়ে হয়। কিন্তু আসলে তার আগে হিন্দু মতে আর একটা বিয়ে হয়েছিল। সে কথা আরতির মা কিংবা বৈদ্যনাথবাবু কেউ আমাকে বলেননি। অমলের ব্যারিস্টারের কাছে লিখিত প্রমাণ ছিল। ওই মামাই হিন্দু বিয়ের পরের দিন কাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিটা ওরা আদালতে দেখিয়েছে। চিঠি দেখেই মামা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। আমারও ভয়ঙ্কর রাগ হচ্ছিলো। একবার ভাবলাম, এ কেস করবো না। আরও কিছু চেপে রেখেছে কিনা কে জানে। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে চলে আসতে পারলাম না। পুত্তর গার্ল। কোর্টে আমাকে কানে কানে বলে গেল, “অমলের কাছে যদি আমাকে ফিরে যেতে হয়, তা হলে আত্মহত্যা করবো।”
আরতির মুখ চেয়ে এই কেসে সায়েব অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। প্রতিদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন।
চারদিন ধরে মামলা হলো। অথচ আমি একদিনও কোর্টে যেতে পারিনি। সকালে অনেক কাজ দিয়ে যেতেন সায়েব। মোহনচাঁদের মুখ থেকেই যা খবরাখবর পাই তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মোহনচাঁদ বলতো, “এই কেসে সায়েব বাঘের মতো লড়াই করেছেন। বলতে বলতে মাঝে মাঝে তিনি রেগেও উঠেছেন। তিন ঘন্টা ধরে অমলকে জেরা করেছেন।”
এ ক’দিন তাঁকে একবারও হাসতে দেখিনি। কেসের কোনো কথাও আমাকে বলেননি। শুধু একবার বলেছিলেন, “মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে।”
শেষপর্যন্ত মামলায় সায়েবেরই জয় হলো। জাস্টিস মিটার অমল রায়ের কেস্ ডিসমিস করলেন। তিনি বললেন, স্ত্রী যেখানে দৈহিক নির্যাতনের আশঙ্কা করে, সেখানে আদালত তাকে ফিরে যেতে বলতে পারেন না।
রায় বেরোবার পরের দিন বিকালে আরতিকে নিয়ে তাঁর মা ক্লাবে সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আজও খুব সাজগোজ করেছিল আরতি। তার মা বললেন, “নে সায়েবের পায়ের ধুলো নে। ওনার জন্যে তো এ যাত্রা রক্ষা পেলি।”
সায়েব বললেন, “নমস্কার করতে হবে না। আমি এমনি আশীর্বাদ করছি। আর কিন্তু কেঁদো না। এখন কেউ তোমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।”
আরতির মা বললেন, “আমাদের বাড়িতে আপনাকে একদিন খেতে যেতে হবে।”
“নিশ্চয় যাবো। বেঙ্গলী নেমতন্ন খাবার সুযোগ আমি কখনও ছাড়ি না।”
সায়েবের সঙ্গে আমিও আরতিদের বাড়ি যাবার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। গাড়ি করে শনিবারের এক সন্ধ্যায় একডালিয়া রোডের দিকে আমরা যাচ্ছিলাম। সায়েব বললেন, “শংকর, উকিল ব্যারিস্টারদের হৃদয় অনুভূতিপ্রবণ হওয়া উচিত নয়। আজকের নিমন্ত্রণে যেতে মোটেই আনন্দ পাচ্ছি না। জেতাটা যেন হার হয়ে গিয়েছে। এ-যেন শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ।”
একডালিয়া রোডের বাড়িতে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা আটটা। একটু পরেই আমরা খেতে বসলাম। “টেবিল চেয়ারে খাবারের আয়োজন দেখে সায়েব বললেন, টেবিল চেয়ারের প্রয়োজন ছিল না। আমি আসনে বসতে পারতাম।” সবই বাঙালী খাবার—ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ। সায়েব কাঁটা চামচ দিয়ে খাচ্ছেন। আমরা অবশ্য হাত চালাচ্ছি। কাঁটা চামচ চালানো বন্ধ রেখে সায়েব মাঝে মাঝে আমাদের খাওয়া দেখছেন। বললেন, “স্ট্রেঞ্জ, তোমরা একহাতে কি তাড়াতাড়ি খাও! আর আমরা দু’হাত লাগিয়েও মাছের কাঁটা বাছতে পারি না।” বাঁধাকপির তরকারিটা সামান্য জিভে ঠেকিয়ে দেখলেন ঝাল কিনা। তারপর সানন্দে খেতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে আমাকে বলেন, “টেবিল-ম্যানারে ভুল হলে বলে দিও।”
কোমরে আঁচল জড়িয়ে আরতি পরিবেশন করছে। সে সায়েবকে বললে, “লিট্ল মোর?”
“আর একটুও নয়। এতেই বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছে।
আমি বললাম, “আমাদের মা বোনদের এই নিয়ম। খেতে না পারলেও জোর করে খাওয়াবে।”
খাওয়া শেষ হলে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে সায়েব আমাকে বললেন, তোমাকে আর একবার দোভাষীর কাজ করতে হবে।”
দেওয়ালে টাঙানো উত্তরা ও অভিমন্যুর ছবির দিকে সায়েব তাকিয়ে ছিলেন। তারপর আরতির মাকে বললেন, “আমি সত্যিই দুঃখিত। এমন সুন্দরী টুকটুকে মেয়ে স্বামীসুখে বঞ্চিত হলো ভাবতে কষ্ট লাগে। কিন্তু এমনই হিন্দু আইন যে বিবাহবিচ্ছেদের ব্যবস্থা নেই, বিধবা ছাড়া আবার বিয়ে করাও সম্ভব নয়। মানুষের প্রয়োজনের প্রতি সমাজ একেবারে উদাসীন।”
আরতিকে কাছে ডাকলেন তিনি। অন্য সকলকে বাইরে ‘বার করে দিলেন। বললেন, “আরতি মাই ডিয়ার গার্ল, আমি বৃদ্ধ, তুমি তো সবে মাত্র জীবন শুরু করছো। তুমি আশা ছেড়ো না, সামনের দিকে চেয়ে থাকো হিন্দু সমাজেও আলোড়ন আসছে। আমি হয়তো তখন বেঁচে থাকবো না, কিন্তু এমন দিন আসবেই যখন তুমি আর মুখ শুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে না, মনের মতো বরের সঙ্গে আবার ঘর সংসার করবে। সেদিন কিন্তু এই বুড়োটাকে ভুলো না।”
আরতি কোনো কথা বললে না। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখে ধীরে-ধীরে সে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তারপর আকাশের অগণিত তারার দিকে সে উদাসভাবে তাকিয়ে রইলো।
আরতি রায়কে সেই আমার শেষ দেখা। কে জানে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে একডালিয়া রোডের সেই শ্রীহীন দোতালা বাড়ির মেয়েটি হয়তো আজও প্রতি সন্ধ্যায় অধীর প্রতীক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর দিন গোনে কবে নতুন আইন পাশ হবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন