কত অজানারে – ৬

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

বয়স তখনও কম, অনুভূতি তীক্ষ্ণ। অভিভূত হওয়াটা আশ্চর্য নয়। ব্যারিস্টার বোস স্মৃতিপটে গভীর দাগ কেটে গিয়েছিলেন। অনুতাপে দগ্ধ হয়েছি। কেন আমি স্লিপ লিখতে বলেছিলাম তাঁকে! অযথা চিন্তায় অনেক সময় নষ্ট করেছি। দোলা বেশি লাগার কারণ আছে। মধ্যবিত্ত বাঙালী জীবনের সঙ্কীর্ণ পরিবেশ থেকে এসে পড়েছি বিশাল জগতে। আচমকা সমুদ্রে পড়লে খালের নৌকার যে অবস্থা হয়।

নিজের উপর শ্রদ্ধা বাড়ছিল। সওদাগরী কিংবা সরকারী আপিসে গতানুগতিক কলম-পেশা নয়। সাক্ষাৎ জীবনের সঙ্গে আমার কাজ কারবার। গতিময়, বৈচিত্র্যময়, অনিশ্চয়তায় পূর্ণ জীবনকে অতি নিকট থেকে দেখতে পাচ্ছি।

দেখে দেখে শক্ত হয়ে যাবো। কারণে অকারণে অনুভূতির তন্ত্রীতে আলোড়ন সৃষ্টি হবে না। আজ যখন লিখছি, ব্যারিস্টার বোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে, শান্ত মেজাজে গ্রহণ করতাম তাঁর কাহিনী। অতি সাধারণ একটি ব্যর্থ দাম্পত্য জীবন, করুণ হয়েও বিস্ময়কর নয়।

কিন্তু অনভিজ্ঞ কাঁচা মনের কথা আলাদা। অসংখ্য প্রশ্নের আগাছা যেখানে গজিয়ে উঠেছে। বিলেত-ফেরত বোস ব্যারিস্টারিতে কিছু পান না। বার লাইব্রেরীতে দিবানিদ্রায় সময় না কাটিয়ে চাকরি করলে পারেন, অন্তত নিজের খরচ চলে যাবে।

সায়েবের কাছে এ প্রশ্ন তোলার সাহস হয়নি। কিন্তু সদুত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মনের অশান্তি কাটছে না।

হাইকোর্টে বাবুদের বেঞ্চিতে ছোকাদা বসেছিলেন। ব্যারিস্টার বোসকে চিনলেও, তাঁর অতীত জীবনের ইতিহাস ছোকাদা জানতেন না। বলে গেলাম তাঁকে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত। অর্জুনবাবু পাশে বসেছিলেন। তিনি বললেন, “এ নদীতে যে ডুবেছে সেই মজেছে। চুনো পুঁটি থেকে রুই-কাতলা সব এখানকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, মরলেও যাবে না।”

দার্শনিকের মতো ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন ছোকাদা। “কালো গাউন একবার ঘাড়ে চাপলে আর ছাড়ান নেই।”

ব্যারিস্টার সুব্রত রায়ের বাবু পাঁচুগোপাল হঠাৎ আবির্ভূত হলেন। প্রকৃতিতে গম্ভীর হলেও তাঁর রসবোধের অভাব নেই।

“কি দাদা কিসের গল্প হচ্ছে?” পাঁচুবাবু ছোকাদাকে জিজ্ঞাসা করলেন।

“নতুন এসেছে ছেলেটি, কিছুই জানে না। তাই এই কালো গাউনের রহস্যটা বুঝিয়ে দিচ্ছি,” ছোকাদা উত্তর দিলেন।

“দিন দাদা, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিন।” পাঁচুবাবু উঠে গেলেন।

ছোকাদা আমাকে বললেন, “দ্যাখো বাপু, মাঝামাঝি পথে থাকাই ভালো। অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে ভেঙে যাবে, অতি ছোট হয়ো না ছাগলে মুড়িয়ে খাবে। ব্যারিস্টার বোসের না হয় কষ্টের শেষ নেই। কিন্তু ওই যে পাঁচুর সাহেব সুব্রত রায়, তাঁরও কি সুখ আছে!”

বিশ্বাস হয়নি আমার। ব্যারিস্টার সুব্রত রায়, হাইকোর্টের অন্যতম সেরা ব্যারিস্টার সুব্রত রায়ের কী অভাব থাকতে পারে? কিন্তু যখন তাঁর সমগ্র জীবনটি আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয়েছিল তখন মত পরিবর্তন করেছি। বিচিত্র জীবন কথা।

জীবনের প্রান্তভাগে দাঁড়িয়ে ব্যারিস্টার সুব্রত রায় মাঝে মাঝে পিছন ফিরে তাকান। এ বয়সে সামনে দৃষ্টিপাত করে লাভ নেই। তাতে শুধু শেষের দিনগুলির পদধ্বনি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠে, জীবনের ক্ষণিক অবকাশ-মুহূর্তগুলোকে বিষাদপূর্ণ করে তোলে। ক্যালকাটা ক্লাবের ব্যালকনিতে বসে ব্যারিস্টার সুব্রত রায় সামনে সবুজ ঘাসের মখমলে মোড়া লনের দিকে তাকিয়ে থাকেন, ফিরে যান তাঁর পুরনো দিনে। বেশ লাগে, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি। মামলার চিন্তা নেই, কেস্- ল নেই, ব্যারিস্টার এইচ. স্যানিয়েলের সওয়ালের উত্তর দেওয়ার ভাবনা নেই। একেবারে মুক্ত, ভাবলেশহীন আত্মসমাধি।

সুব্রত রায়ের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। ব্রীফের পাহাড়। একটা মাথা, কত কেস্ নেওয়া সম্ভব? কিন্তু কেউ শুনতে চায় না। দুরূহ কেস্, জটিল আইন? সুব্রত রায়ের কাছে সে ব্রীফ আসবেই। কাজ কমানোর জন্য তিনি পাঁচুগোপালকে বলছেন,”পাঁচু, ষাট মোহরের কমে ফিস্ নেবো না।” পাঁচু ঘাড় নেড়েছে। কিছুদিন পরে মনে পড়লো কই কাজ তো কমেনি। “পাঁচুগোপাল, কী ব্যাপার?” পাঁচুগোপাল হাসে, “স্যার, একশ’ মোহর চাইলেও এটর্নিরা এখানে লাইন দেবে।”

সুব্রত রায়ের হাসি আসে। “ওদের ধারণা আমি কেস্ নিলেই জয় সুনিশ্চিত— যত খারাপ মামলাই হোক। কিন্তু দিনকে রাত করা সম্ভব নয়। সত্যের নিজস্ব গতি আছে, আইনের যাদুতে তাকে রুদ্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ওরা বুঝেও বোঝে না।”

এটর্নিরা আড়ালে বলে, লোকটা অর্থপিশাচ। এক পয়সা ফী কম নেবে না। সুব্রত রায় ভাবেন, কেন তিনি মোটা ফী নেবেন না? ব্রীফের খোঁজে একদিন তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন— একটা কেস্ জুনিয়র ব্রীফ কিংবা আনডিফেন্ডেড ম্যাটার। তখন কোনো এটর্নি মুখ তোলেননি; বলেছেন কাজ কোথায় মশায়?

আজ সারা হাইকোর্টে তাঁর যশ। সুব্রত রায় অমুক কোর্টে কেস্ করবেন, ছোকরা এডভোকেট ও ব্যারিস্টাররা সেখানে ছোটে। ব্যারিস্টার রায় কিভাবে প্লিড করেন দেখতে হবে। অনেকদিনের অভিজ্ঞ যোদ্ধা তিনি। ধীরে ধীরে এসে চেয়ারে বসেন। জজ সায়েব মৃদু হাসিতে তাঁকে স্বাগত জানান। তিনি বুঝতে পারেন, সোজা মামলা নয়। একমনে সুব্রত অন্যপক্ষের বক্তৃতা শুনে যান। জুনিয়রকে ফিসফিস করে কিছু হয়তো বলেন। জুনিয়র সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে একটি বই-এর মধ্যে কি যেন খুঁজতে থাকে, তারপর বইটা এগিয়ে দেয় তার সামনে। পড়া শেষে আত্মপ্রসাদের হাসি দেখা যায় তাঁর মুখে। বই-এর পাতার নম্বর কাগজে লিখে রাখেন। অন্যপক্ষ কোনো অস্ত্র ছাড়লে একমুহূর্তের জন্য তাঁর চোখ বুজে যায়। মনের গহনে কিসের অনুসন্ধান চলে। অনেক যুক্তির অস্ত্র সেখানে থরে থরে সাজানো। সুব্রত রায় তারই একটি তুলে নেন।

দিনের শেষে হাতে মোটা অঙ্কের চেক আসে। এটর্নি ধন্যবাদ দেয়, মক্কেল কৃতজ্ঞতায় হাত চেপে ধরে। ব্যারিস্টার রায় হাত ছাড়িয়ে নেন। না না, এসব তাঁর ভালো লাগে না। মক্কেলের জন্য নয়, নিজের জন্যই তিনি পরিশ্রম করেন। কেমন একটা অদ্ভুত জিদ চেপে বসে। ন্যায় অন্যায় যাই হোক, জিততে হবে।

রেম্পিনি সায়েবও তাই বলতেন, তখন বিশ্বাস হয়নি। “আমাদের পেশা ষাঁড়ের লড়াই-এর মতন। গোঁ চাই। বেপরোয়া হতে হবে। টাকা নিয়ে তুমি অপরের হয়ে লড়াই-এ নেমেছো; চোখ বন্ধ করে শিং উঁচিয়ে সামনে ছুটে যাও, আঘাত করো। জিতলে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে, হারলে কেউ চেয়ে দেখবে না।”

ব্যারিস্টার রায় ক্লান্তি অনুভব করেন। সারাজীবন তাঁকে শুধু জিততে হবে, একের পর এক হারাতে হবে বিপক্ষকে। কেস্-ল খুঁজতে হবে, যুক্তির শাণিত অস্ত্রে ছিন্নভিন্ন করতে হবে অপরপক্ষকে। বিশ্রাম নেই, মুক্তি নেই। জ্ঞানদাসুন্দরী দাসী ভারসেস চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানদাসুন্দরীকে জেতাতে হবে। পরেই মোহনলাল ভারসেস ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া। প্রমাণ করতে হবে ভারত সরকার সংবিধানের অমুক উপধারার বিধান লঙ্ঘন করেছেন।

সব কিছু মনে রাখতে হলে ব্যারিস্টার রায় এতদিন উন্মাদ হয়ে যেতেন। সে-কথা রেম্পিনি সায়েব অনেক আগেই বলেছিলেন, “সুব্রত, এ-লাইনে বড় হতে হলে অনেক কিছু মনে রাখতে হবে। অনেক কিছু নখাগ্রে চাই। কিন্তু ভুলতেও হবে অনেক কিছু। ভুলবার জন্য সাধনা করতে হবে। যা কিছু অপ্রয়োজনীয় অপ্রাসঙ্গিক, স্মৃতিপট থেকে মুছে ফেলতে হবে।”

তখন সুব্রত রায়ের বয়স অনেক কম। এই হাইকোর্টের বারান্দা দিয়ে রেম্পিনি কোর্টঘরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় পুরনো মক্কেলের সঙ্গে দেখা। “গুড মর্নিং মিস্টার রেম্পিনি। সেবার শুধু আপনার জন্য আমাদের জমিদারি রক্ষে পেয়েছিল। সাতদিন ধরে যে আশ্চর্য যুদ্ধ করেছিলেন, তা কোনোদিন ভুলবো না।”

“না না, ও-সব বলে লজ্জা দেবেন না।” রেম্পিনি সামনের দিকে পা বাড়ালেন।

কৌতূহলী সুব্রত রায়ের ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছা হয়। “কোন্ কেস্টা স্যার?”

“মনে নেই।” রেম্পিনি নিস্পৃহভাবে বললেন।

“সে কি? সাতদিন ধরে কেস করেছিলেন, তার কিছু মনে নেই?”

“একটুও মনে নেই। মামলার রায় বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি সব ভুলে যাই— নাম-ধাম, ঘটনা কিছুই মনে থাকে না, শুধু আইনের পয়েন্টটি ছাড়া।” রেম্পিনি সায়েব পিছনে ফিরে সুব্রতকে আরও বলেছিলেন, “তোমাকেও ভুলতে হবে। না ভুলতে পারলে বড় হতে পারবে না।”

ভুলতে ভুলতে সুব্রত রায় আজ জীবনের সকল আনন্দই ভুলতে বসেছেন। কী আছে সুব্রত রায়ের জীবনে? সুব্রত রায় ব্যারিস্টার— কিন্তু শুধুই ব্যারিস্টার, অপর পাঁচজনের মতো মানুষ নয়। সংসারের কর্তা নয়, প্রেমময় স্বামী নয়, স্নেহময় পিতা নয়। শুধু অর্থোপার্জনের যন্ত্র মাত্র। সুব্রত রায় ভাবেন এর থেকে সাধারণ চাকরি অনেক ভালো, দশটা-পাঁচটার বাইরে তারা মানুষকে গিলতে আসে না।

ভোর পাঁচটায় ব্যারিস্টার রায়ের দিনের শুরু। সাড়ে পাঁচটায় “চাকর যখন স্টোভ জ্বালিয়ে চা দিয়ে যায় মেয়েরা তখনও বিছানায়, দীপালিও ঘুমে অচেতন। নিদ্রাপর্ব শেষ করে দীপালি যখন দৈনন্দিন জগতের কাজে হাজিরা দেন, সুব্রত রায় তখন অন্য জগতে। লাইব্রেরী-রুমে বই-এর অতলে তখন তাঁর সকল সত্তা নিমজ্জিত। আটটায় জুনিয়র আলোক সেনের গলার আওয়াজ শোনা যায়। দু’জনে আলোচনা চলে—সেকশন টোয়েন্টিথ্রি-এ, ইন্ডিয়ান ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট। পাশের র‍্যাক থেকে তিনি বই টেনে নেন।

ঠিক ন’টায় চাকর সামনে এসে দাঁড়ায়। একটু বিরক্ত হয়েই সুব্রত রায় তার মুখের দিকে তাকান। ইঙ্গিতে তাকে অপেক্ষা করতে বলে, তিনি আরও খানিকটা পড়ে যান। চাকরের হাতে ইট-রঙের দুটো ট্যাবলেট ও এক গ্লাস জল। চাকর অধৈর্য হয়ে ওঠে। “আপকা ট্যাবলেট হুজুর”। ওষুধের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন সুব্রত রায়। মুখে জল নিয়ে ট্যাবলেট দুটো গলাধঃকরণ করতে করতেই তিনি ইলেকট্রিক বেলে মৃদু চাপ দেন। আওয়াজ শুনেই পাঁচু ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। পাঁচুকে বলেন, “ফাউলার ব্রাদার্সের মিস্টার মল্লিককে ডাকো।” ব্রীফের বান্ডিল হাতে মিস্টার মল্লিক এসে চেয়ারে বসেন। আলোচনা আরম্ভ হয়। কথাবার্তা জুনিয়র কাগজে নোট করে। মিস্টার মল্লিক বিদায় নেন। অন্য এটর্নি আসে, কনসাল্টেশন চলে।

তারপর একসময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে চেয়ার থেকে উঠে পড়েন। কোর্টের সময় হয়ে গিয়েছে। অন্দরমহলে ছোটেন সুব্রত রায়। কোনো কথাবার্তা নয়। সোজা বাথরুম। সেখান থেকে খাবার ঘর। খুব সামান্য খেতে হয়, যত সামান্য সম্ভব। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ–তেল নয়, ঘি নয়, মাংস বিষবৎ, চিনির সম্বন্ধ নেই। দীপালি সামনে দাঁড়ান, দু’-একটা কথা বলবার ছিল। কিন্তু এখন ওসব নয়, একটুও সময় নেই। মাথার মধ্যে আজকের কেসটা গজগজ করছে, অন্য কিছু সেখানে ঢুকবে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দীপালি সাদা ব্যান্ডটা গলায় বেঁধে দেন। “একটু যেন বেঁকে রইল,” সুব্রত বলেন। দীপালি হেসে ফেলেন। আজ নয়, পঁয়ত্রিশ বছরে একদিনও সুব্রতর ব্যান্ড বাঁধা মনঃপূত হয়নি। দীপালির হাসি কিন্তু সুব্রতর নজরে পড়ে না। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েই তিনি বলেন, “স্যরি অন্য সময় কথা কইবো। আজকে ফার্স্ট আওয়ারেই কেস্। পার্ট হার্ড ম্যাটার।” তারপর দ্রুতবেগে একতলায় নেমে আসেন।

রোভার গাড়িটা হাইকোর্টের ভিতর ঢুকে যায়। লিফ্ট-এ সোজা দোতলায় বার-লাইব্রেরী। ডেলি লিস্টে চার-পাঁচটা লাল দাগ দিয়ে রেখেছে পাঁচুগোপাল।

“গুড মর্নিং ব্রাদার,” ব্যারিস্টার সুকান্ত সেন আসছেন।

“গুড মর্নিং।”

“তোমার ওই স্ত্রী-ধনের কেস্টা সুপ্রীম কোর্টে ঠেলছি,” সুকান্ত বললেন।

“তাই নাকি? মোস্ট ইন্টারেস্টিং! দেখা যাক স্পেশাল বেঞ্চের ডিসিশন আপহেল্ড হয় কি না।”

সুকান্ত সেন সুব্রতর কলেজ-জীবনের বন্ধু। এক জাহাজে দু’জনে বিলেত গিয়েছিলেন। সুকান্ত গেল কেমব্রিজে, সুব্রত অক্সফোর্ডে। তারপর আবার দেখা লিঙ্কন্স ইন-এ। পাস করে দু’জনে প্রায় একই সময়ে দেশে ফিরেছিলেন। সুব্রত একা, সুকান্ত স্ত্রীকে নিয়ে। মিসেস আগাথা সেন। আগাথার রূপ ও যৌবন দু-ই ছিল। সেদিন এক পার্টিতে আগাথার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কে বলবে এই আগাথাকে সুকান্ত বিয়ে করেছিল! কোথায় গেল সেই সোনালী চুল, দুরন্ত যৌবন আর চঞ্চল চোখের চাহনি!

পরে লজ্জা পেয়েছেন সুব্রত। বয়স কি তাঁদের কম হলো? পঁয়ত্রিশ বছর আগের আগাথা সেন আজও সেরকম থাকবে কী করে?

এই আগাথা একদিন লন্ডন-প্রবাসী সুব্রতর মনেও দোলা লাগিয়েছিল। কিন্তু সুব্রত বিচক্ষণ, তাই নিজেকে সংযত রাখতে পেরেছিল। দীপালির বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে নি। প্রতি সপ্তাহে যে দীপালির চিঠি এসেছে!

রেম্পিনি: সায়েব প্রথমে শুনে আশ্চর্য হয়েছিলেন, “হোয়াট! তোমারও চাইল্ড ম্যারেজ?”

“না না স্যার, চাইল্ড ম্যারেজ নয়। বিলেতে যাবার ঠিক আগে আমাদের বিয়ে হয়।”

রেম্পিনি যেন আরও আশ্চর্য হলেন। “সার্টেনলি, ইউ ওয়ার নাথিং বাট এ চাইল্ড দেন।”

সুব্রত রায়ের আজও কেমন আশ্চর্য লাগে, লোকটাকে বাইরে থেকে একটুও বোঝা যেত না।

সুকান্তর বাবা রায়বাহাদুর অবনী সেন এলিস অ্যান্ড সেন সলিসিটরের ছয় আনা অংশীদার। বিরাট আপিস, অনেক কাজ। এলিস সায়েবও কিছু চিরকাল থাকবেন না, তখন সব কিছু তাঁর। সুকান্ত সেনের কাজের ভাবনা! প্রথম থেকেই মাসিক হাজার টাকার ব্রীফের ব্যবস্থা।

সুব্রত রায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে, বিলেত যাওয়াটাই সৌভাগ্য। ব্যারিস্টারি পাস করেছে এই যথেষ্ট। বাবা আর কিছু পারবেন না। সেকেলে পরিবার, উপার্জনের আগেই সংসারের দায়িত্ব চাপিয়েছে। দীপালিকে যত্নে রাখতে হবে। দীপালি আলোকপ্রাপ্তা, বেথুনের ভালো মেয়ে। তবুও সে কেমন সেকেলে। আচার ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গিতে মায়ের মতন, আগাথা সেনের মতো নয়। দীপালির অনেক আশা, স্বামী ব্যারিস্টার। অথচ বেচারা জানে না, ওখানে দাঁড়ানো কত কঠিন, সাফল্য কত অনিশ্চিত!

.

তিন বছর সুব্রত রোজ কোর্টে এসেছে। দিনের শেষে ক্লান্ত পদক্ষেপে বাড়ি ফিরলে দীপালি পায়ের মোজা খুলে, কোট নামিয়ে নিয়েছে। নরম হাতে গলার ব্যান্ড খোলার সময় চুড়ির আওয়াজে সুব্রতর চোখ বুজতে ইচ্ছা করে। মিঠে আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে ধিক্কার জাগে। কেমন করে দীপালিকে বলবে কোনো কাজ নেই, একটা ব্রীফও পাওয়া যায় না। দীপালি বুঝতে পেরে নিজেই বলে—”এই তো শুরু, ক্রমশ সব হবে। এখন থেকে ঝিমিয়ে পড়তে আছে নাকি!”

বেরোবার আগে লাল ব্যাগটাতে সে সব কিছু গুছিয়ে দেয় নিজের হাতে। ফ্লাস্কে গরম চা, কোনোদিন কফি, টফির কৌটায় খাবার। ব্যাগের এক কোণে সিগারেটের টিন। শাসনের সুরে দীপালি বলে, “গোনা ছ’টি সিগারেট আছে, তার বেশি খাওয়া চলবে না। সিগারেট খেয়ে কী যে আনন্দ পাও বুঝি না; আমার তো গন্ধেই গা ঘুলিয়ে ওঠে।”

সুব্রত আনন্দ পায়। কাছে ডেকে বলে, “একটা খেয়ে দেখো না। তখন আর বকতে ইচ্ছা করবে না।”

দীপালি রেগে যায়, “ভারি অসভ্য! মেয়েরা আবার সিগারেট খায় নাকি?”

“কেন খাবে না! সুকান্তর বৌ আগাথার রোজ একটা টিন লাগে।”

“বাঃ, উনি যে মেম।”

সুব্রত হাসিতে ফেটে পড়ে। “কী বুদ্ধি, মেমরা মেয়েমানুষ নয়!” রাস্তায় বেরিয়ে সুব্রত বিষণ্ণ হয়ে যায়। রূপ, যৌবন, স্বাস্থ্য, সময় সব আছে, তবুও কিছু নেই। টাকা চাই। দীপালিকে ভালো ভালো কাপড় কিনে দেবে, নিজে ট্রাম ছেড়ে মোটরে যাবে। কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে?

কৃতী ব্যারিস্টার সুব্রত রায়ের আজ হাসি লাগে। টাকা! টাকা আছে যথেষ্ট। কিন্তু কোথায় গেল সে-সব দিন। আজকের সুব্রতর মাথায় অন্য কিছু নেই, শুধু প্লেন্ট, রি-স্টেটমেন্ট, স্পেশাল বেঞ্চ, ফুল বেঞ্চ। দিনের শেষে যখন বাড়ি ফেরেন তখন ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে। দীপালি আজও ব্যান্ড খুলে দেন। মেয়েদের দেখা নেই, তারা বাবার কাছে আসে না। বাবাকে ভয় করে দূরে সরে থাকে। দীপালিকেও আজ অনেক দূরের দীপালি মনে হয়, গম্ভীর, নির্লিপ্ত।

“মীনার অনার্স পরীক্ষা আজ শেষ হলো,” দীপালি বলেন।

“তাই নাকি? কবে পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছিল?” এখানেই থেমে যেতে হয়। মীনার কোন্ বিষয়ে অনার্স তাও জানেন না তিনি। অভিনয় ধরা পড়ে যেতে পারে। সত্যি অন্যায়—সুব্রত রায়ের কপালের কুঞ্চন গভীর হয়। রেম্পিনি সায়েব ঠিকই বলেছিলেন, “এ-লাইনে সাধনার প্রয়োজন, সংসার পাতাও ঠিক নয়। তাতে হয় সংসার, না হয় তোমার প্রফেশন অবহেলিত হবে।” তখন সুব্রত হেসেছিল। আজ মনে হয় রেম্পিনি সায়েব বিয়ে না করে ভালোই করেছিলেন।

৭২

লাইব্রেরীতে যেতে হবে এখনি। সেখানে প্রবেশমাত্র সুব্রত সব ভুলে যাবেন। লক্ষ্যভেদী অর্জুনের মতো তখন কেন্দ্রীভূত দৃষ্টি। অপ্রাসঙ্গিক কিছু চোখে পড়ে না— গাছ নয়, গাছের ডাল নয়, এমন কি পাখির সর্বদেহ নয়, শুধু চোখ! বাড়ি নয়, গাড়ি নয়, দীপালি নয়, খোকন নয়, মীনা নয়, সুব্রতর সমস্ত মনোজগৎ ব্যাপ্ত করে কেবল কেস্ নম্বর ত্রিশ, অর্ডিনারি অরিজিন্যাল সিভিল জুরিসডিকশন।

রেম্পিনি সায়েবের নজরে পড়াটা ভাগ্যের লিখন। তিন বছরের ব্যর্থ প্রচেষ্টা। তিন বছরের মোট আয় একশ’ পনেরো টাকা। লাইব্রেরীতে বই পড়ছিল ব্রীফলেস সুব্রত রায়। কাঁধে একটা হাত পড়লো, সুব্রত চমকে তাকায়। মিস্টার উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনি, দোর্দণ্ড ব্যারিস্টার। রেম্পিনি তাকে চেম্বারে দেখা করতে বলে চলে গেলেন।

রেম্পিনির চেম্বারে তিনি সুব্রতকে বলেছিলেন, “যখনই লাইব্রেরীতে যাই, দেখি তুমি পড়ছো। আমার খুব পছন্দ। আমার চেম্বারে কাজ করবে?”

“এ আমার পরম সৌভাগ্য,” সুব্রত উত্তর দিল।

“ইয়ংম্যান, সৌভাগ্য বলে কোন কথা আমার ডিকশনারিতে নেই। পরিশ্রম ও একাগ্রতাই সব।”

টেম্পল চেম্বারের দোতলা। ঘরের বাইরে লেখা ডব্লিউ. ডি. রেম্পিনি, বার- এট-ল। ভিতরে দেওয়াল দেখা যায় না, অসংখ্য বই-এর সারি। মধ্যিখানের বিরাট টেবিলেও ডজনখানেক বই ছড়ানো। একদিকে মস্ত চেয়ার, কোন যুগের কে বলবে। রেম্পিনি সায়েব বলেন, “এটি লাইব্রেরী নয়, আমার গবেষণাগার।”

রেম্পিনির কাজ নয়তো, সাধনা। খ্যাতি ও অর্থ সে সাধনায় শৈথিল্য আনেনি। দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, মামলায় জিততে হবে। বই-এর পর বই পড়ে যান তিনি। নথিপত্রের প্রতিটি লাইনে স্বপক্ষে যুক্তির অনুসন্ধান চলে।

সুব্রত রেম্পিনির সামনে বসে থাকে। রেম্পিনি বলে যান, সুব্রত লিখে চলে। টাইপিস্ট দিয়েও কাজ হয়, কিন্তু রেম্পিনি বলেন, “কাজ শিখতে হলে একেবারে নিচু থেকে শুরু করা প্রয়োজন।”

বই-এর ভিতর মুখ রেখে রেম্পিনি বলেন, “ফিফটিন হলসবেরী।” সুব্রত আলমারি থেকে বই বার করে, দু’বার ফুঁ দিয়ে কিছুটা ধুলো তাড়িয়ে সেটা এগিয়ে দেয়। অতি সাবধানে রেম্পিনির হাত থেকে অন্য বইটি বার করে নিতে হয়। রেম্পিনি যেন বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়া চলছে। কখনও চোখে ক্লান্তি নামে। চশমা মুছতে-মুছতে তিনি বলেন, “সুব্রত…।” সুব্রত বুঝতে পারে। রেম্পিনির হাত থেকে বই নিয়ে নিজেই পড়তে আরম্ভ করে। রেম্পিনি চোখ বুজে শোনেন, আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়েন।

বাড়ি ফিরতে দেরি হয় সুব্রতর। বেচারা দীপালিকে একলা থাকতে হয়। পায়ের শব্দে দীপালি ছুটে আসে, কিন্তু কোনো কথা বলে না।

কিন্তু রেম্পিনি সায়েব কি পাগল? বলেন, কোর্টে যেতে হবে না, শুধু চেম্বারে বসে কাজ করো। তিনবছর কেস্ নিতে পারবে না, এটর্নি হাতে ব্রীফ গুঁজে দিলেও না। সাধনায় নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে প্রথমে।

“কিন্তু সংসার চলবে কেমন করে?”

“চাইল্ড ম্যারেজ বুঝি? যা হোক, সে ভাবনা আমার। প্রতি মাসে একশ’ টাকা পাবে। অনুগ্রহ নয়, চেম্বারে আমার কাজের পারিশ্রমিকরূপে।”

একদিন লাঞ্চের সময় রেম্পিনি বললেন, “সুব্রত, তোমাকে যেন রোগা রোগা দেখাচ্ছে।”

“না, কই?”

“আমার নজর এড়ায় না। যুদ্ধ করতে হলে ভালো শরীরের প্রয়োজন, বুঝেছ ইয়ংম্যান।” রেম্পিনি নিজের লাঞ্চ দু’ভাগ করেন।

“না, না, সে হয় না। আপনার খাবার…..”

“বুড়োদের কম খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। অবাধ্য হতে নেই।”

.

গুরু শিষ্যকে শিক্ষা দিয়ে যান যত গোপন অস্ত্র। আইনের রহস্য খুলে ধরেন সুব্রতর সামনে।

একদিনের কথা। রাত হয়ে গিয়েছে, বিজলী বাতি জ্বলে উঠেছে। টাউন হলের দিকে বড় জানলা দিয়ে গড়ের মাঠের হিমেল হাওয়া বয়ে আসছে। রেম্পিনি কেস্- ল খুঁজছেন। ঈপ্সিত বস্তুর সন্ধান মিলছে না। কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সুব্রতর ভালো লাগে না। বেচারী দীপালি তার পদধ্বনির প্রতীক্ষা করছে। গোলাপী মুখটা হয়তো শুকিয়ে গিয়েছে। একা হয়তো ভয় লাগছে। কয়েক গাছি অবাধ্য দুষ্টু চুল হয়তো মুখের ওপর এসে পড়েছে। মনে হয়, পাগলা সায়েবটাকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু দীপালি বারণ করবে, মনের দুঃখ চেপে রেখে বলবে, “তুমি একেবারে ছেলেমানুষ। আমি কি আর সেই ছোট খুকিটি আছি যে, ভয় পাবো?”

রেম্পিনি মোটা-মোটা বই-এর ভিতর কেস্-ল খুঁজছেন। সুব্রতকেও কয়েকটা বই দিয়েছেন, কিন্তু তার মন বসছে না কিছুতেই। দীপালি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।

রাত ন’টা। রেম্পিনি বললেন, “আর খুঁজতে হবে না। পেয়ে গিয়েছি। মোস্‌ “ইম্পর্টান্ট ডিসিশন!’

ভালো লাগছিল না সুব্রতর। খুঁজে না পেলে রেম্পিনি হয়তো সারারাত বই-এর পাতা ওল্টাতেন। কাজের নেশায় ঘুমের বালাই থাকে না লোকটার।

বই-এর নম্বরটা কাগজে লিখতে-লিখতে রেম্পিনি বললেন, “অনেক দেরি হলো, আই এম স্যরি। কিন্তু এইভাবেই নজির খুঁজতে হয়।”

“খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতন অবস্থা।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও সুব্রতর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়লো।

হঠাৎ কেমন যেন হয়ে পড়লেন রেম্পিনি। সুব্রতর মুখের দিকে তাকালেন। পাইপ ধরালেন। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে ঘরের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিজের মনেই বললেন, “তা সত্যি। কিন্তু পেয়েছিলাম। খড়ের গাদা থেকেই খুঁজে পেয়েছিলাম হারিয়ে যাওয়া ছুঁচ।”

সুব্রতর কাঁধে হাত রাখলেন রেম্পিনি। “সেইদিন আমার অন্ধকার জীবনে সূর্যের উদয় হলো। ভাবলে আজও আশ্চর্য লাগে।” তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন।

“স্যার হেনরী লং-এর দীর্ঘ দেহ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।” পাইপটা টেবিলে রাখলেন রেম্পিনি। “অনেক নিচু থেকে আমি এসেছি।”

.

চোদ্দ বছরের ছেলে উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনি বেয়ারার কাজ করে স্যার হেনরী লং-এর চেম্বারে। চা আনা, টেবিল মোছা, বই-এর ধুলো ঝাড়ার কাজ। স্যার হেনরী লন্ডনের প্রখ্যাতনামা ব্যারিস্টার। তাঁর পাঠাগারে অসংখ্য বই। কিশোর রেম্পিনির অসীম কৌতূহল। বই পড়তে বড় ভালো লাগে।

সকলের আগে চেম্বারে যায় সে। স্যার হেনরী আসবার আগেই টেবিল চেয়ার মুছে পরিষ্কার করে রাখতে হয়। ঢেকে রাখতে হয় এক গ্লাস জল। মনের আনন্দে বই পড়ার এই সুযোগ। ধুলো ঝাড়ার সময় মোটা-মোটা আইন বই-এর পাতায় সে চোখ বোলায়। পায়ের আওয়াজ হলেই সভয়ে বই বন্ধ করে আবার ধুলো ঝাড়তে আরম্ভ করে। প্রতিমাসে অনেকগুলো আইন পত্রিকা আসে। খাম ছিঁড়ে মলাটের উপর রবারস্ট্যাম্প তাকেই বসাতে হয়। স্যার হেনরীর টেবিলে সেগুলো দেবার আগে সে নিজের কৌতূহলের ক্ষুধা মিটিয়ে নেয়। যখন স্যার হেনরী এটর্নি ও মক্কেলদের সঙ্গে কেসের আলোচনা করেন, সুইং ডোরের আড়াল থেকে রেম্পিনি আগ্রহে কান পেতে থাকে। অনেক অজানা শব্দ ভেসে আসে, না বুঝলেও ভালো লাগে।

সেদিন সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। স্যার হেনরী তখনও চেম্বারে কি যেন খুঁজছেন। সাধারণত যেতে এত দেরি করেন না তিনি। বাইরে টুলে বসে রেম্পিনি সময় গুণছে। দূরের ঘড়িটা রাতের বার্ধক্য ঘোষণা করলো। রেম্পিনি ভিতরে তাকিয়ে দেখলো, স্যার হেনরী তখনও বই খুঁজছেন। দু’জন জুনিয়র সন্ত্রস্ত হয়ে বই ঘাঁটছেন। একের পর এক বই টেনে অনুসন্ধান চলছে। নাঃ, কোথায় সেই নজির! স্যার হেনরী পাগলের মতো বই-এর পাতায় খোঁজ করছেন। পর মুহূর্তে হতাশ হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন বইটা। কত দেরি হবে কে জানে? রাত আরও বাড়ে।

জুনিয়র অবশেষে বললে, “স্যার, আমার মনে হয় এ-বিষয়ে আমাদের স্বপক্ষে কোনো নজির নেই।”

“নিশ্চয় আছে! আমার বেশ মনে আছে কোথাও পড়েছি।” স্যার হেনরী মাথার চুল টানতে টানতে অভীষ্ট নজিরের বিষয়টা বিড়-বিড় করে বলতে লাগলেন।

হঠাৎ রেম্পিনির বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো। ভিতরে ঢুকে গেল সে। ভয়ে পা চলছে না। কয়েক পা পিছিয়ে এল সে। সাহস সঞ্চয় করে স্যার হেনরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। উত্তেজনায় সর্ব শরীর কাঁপছে। তার দেহের ছায়া স্যার হেনরীর হাতের বই-এর উপর পড়েছে।

বিরক্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন স্যার হেনরী। “বাড়ি যেতে চাও? একদিনের সামান্য দেরি সহ্য হয় না!”

“না, না স্যার।”

“তবে কী জন্য আমার সময় নষ্ট করছো?”

রেম্পিনি রুদ্ধবাক। দূরে র‍্যাকের লাল কাপড়ে বাঁধানো একখানি বই তাকে ডাকছে। কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে আকর্ষণ করছে ওই বইটার কাছে। এগিয়ে গিয়ে রেম্পিনি বইটা টেনে নিল——টাইমস ল’ রিপোর্টার।

“বলবো? বলবো স্যার?” রেম্পিনি কম্পিত হাতে বই-এর পাতা খুলে যায়, এইটা—এইটা কি?”

“ইউরেকা, ইউরেকা”, স্যার হেনরী চিৎকার করে উঠলেন। “এরই নিষ্ফল সন্ধানে চারঘণ্টা কেটে গিয়েছে।”

বেশ কিছুক্ষণ স্যার হেনরী কিশোর রেম্পিনির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

স্যার হেনরীর ক্যাব লন্ডনের অন্ধকারে মিশে গেল। রেম্পিনি অবাক। কিছু বকশিশ আশা করেছিল সে; মনের সুখে ডিনার খাওয়া যেতো। কিন্তু বকশিশ তো দূরের কথা, একটা মিষ্টি কথাও নয়। মনটা তিক্ত হয়ে উঠল।

পরের দিন স্যার হেনরী ডাকলেন, “উইলমট, তোমাকে এখনি একবার দর্জির দোকানে যেতে হবে।”

“আপনার কোনো স্যুট তৈরি করতে দেওয়া আছে কি?”

“না না, আমার নয়, তোমার নিজের।”

“অ্যাঁ!”

“দেরি নয়, এখনি চলো। অনেক কাজ বাকি। আজই সব শেষ করে রাখতে চাই। টেবিল মোছা তোমার কাজ নয়, তুমি ব্যারিস্টার হবে।”

নিদারুণ কর্মব্যস্ততার মাঝেও জীবনের সেই পরম পুণ্য লগ্নটি আজও রেম্পিনিকে নাড়া দেয়। কিছুক্ষণের জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলির মাঝে। বহুবর্ষ আগের অফিস-বয় রেম্পিনি তাঁকে ডাকে, তাঁকে বিহ্বল করে তোলে। এমন এক স্মৃতি-সলিলে অবগাহন মুহূর্তে রেম্পিনি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করেছিলেন সুব্রতর কাছে।

একনিষ্ঠ সাধনাই রেম্পিনিকে সাফল্যের সিংহদ্বারে বহন করে এনেছে, সে- কথা জেনেও সুব্রত নিজেকে পরিপূর্ণ রূপে উৎসর্গ করতে পারে না। রেম্পিনি বলেন, “সংসার, সমাজ সব ভুলে কাজ করে যেতে হবে।”

ছুটির দিনেও নিষ্কৃতি নেই। খুব ভোরে বাড়িতে ডেকে পাঠান। কেসের আলোচনা, কিংবা কিভাবে জেরা হবে, সে বিষয় চিন্তা চলে। সুব্রতর যেতে ইচ্ছা হয় না। ছুটিতেও কাজ? দীপালিকে কাছে বসিয়ে একটা দিন গল্প করাও চলবে না?

ওই তো সুকান্ত সেন। কত মামলা তার হাতে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনকে নষ্ট হতে দেয়নি। আগাথা সেন দীপালিকে সেই কথাই বলে গেল গত রাতে। ডিনারে সুকান্ত ও আগাথা কত গল্প করল।

পাহাড়ী ঝরণার মতো মেয়ে। বন্য স্বাস্থ্য, অদম্য জীবনীশক্তি। আগাথা বলে, “টাকার প্রয়োজন কেবল জীবনকে উপভোগের জন্য। সুকান্তর প্রাইভেট ও প্রফেশনাল লাইফের মধ্যে একটা সরলরেখা টেনে ভাগ করে দিয়েছি।”

সুকান্ত বাড়ি ফিরে আগাথার সঙ্গে চায়ে বসে, গল্প হয়। রাত আটটার পর কোনো কাজ নয়। ঘড়ির বাজনার সঙ্গে সঙ্গে সুকান্ত ভিতরে চলে যায়। এক জগৎ থেকে ফিরে আসে অন্য জগতে। রবিবারে আগাথাকে পাশে বসিয়ে সে মোটর চালায়। পিছনের সিটে টিফিন কেরিয়ারে খাবার, স্বামী-স্ত্রীর পিকনিক। মাঝে মাঝে আগাথা স্টিয়ারিং-এ বসে। স্পিডোমিটারে কাঁটার কম্পন ওকে ছেলেমানুষ করে তোলে। জোরে, আরও জোরে। হাওয়ায় আগাথার সোনালী চুলগুলো নাচছে। দু’জনে সিগারেট ধরায়, সঙ্গে মিহি সুরে কোন ইংরেজি গানের কলি। কলকাতা শহর পিছনে ফেলে ওরা ছুটে চলে যশোর রোড ধরে। বেলা এগোয়। গাড়ি থামে। লাল রঙের চাদর হাতে ওরা মাঠের মধ্যে নেমে পড়ে। বন-বালিকার মতো আগাথা ছুটতে থাকে। দূরে পাখির ডাকের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় তার কলহাস্য। দু’জনে লুকোচুরি খেলে। ক্যামেরায় আগাথা ছবি তোলে। তারপর টিফিন কেরিয়ারের খোঁজ পড়ে। দু’জনে কাড়াকাড়ি করে খায়। সানগ্লাসের কাঁচ মুছতে মুছতে আগাথা বলে,”বাব্বা, খেতে পারো বটে!” সুকান্ত উত্তর দেয়, “তুমিও কম যাও না।” “বটে? তিন ডজন স্যান্ডউইচ বুঝি আমি খেলাম?” দু’জনে হেসে ঘাসের ওপরে লুটিয়ে পড়ে।

আগাথার মুখ থেকেই দীপালি অবাক হয়ে শোনে। সুব্রত চুপ করে বসে থাকে। মনের ভিতর বাঁধন ছিঁড়ে আগাথাদের মতো বেরিয়ে পড়ার আহ্বানকে সজোরে দমন করতে হয়।

রেম্পিনি এসবের কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, “জানো হে সুব্রত, মোস্ট ইন্টারেস্টিং অ্যাফেয়ার!” সুব্রত ভাবে, কোনো মজার কথা নিশ্চয়, তাই আগ্রহে তাকায়। রেম্পিনি বলেন,”ট্রেডমার্ক অ্যাক্টের বাইশ ধারা সম্বন্ধে লর্ড ডানেডিনের…….”

বেশ কিছুদিন কাটে। সুব্রতকে রেম্পিনি কোর্টে নিয়ে যেতে আরম্ভ করলেন। পাশে বসে জুনিয়র সুব্রত রায় রেম্পিনিকে কাগজ এগিয়ে দেয়। কখনও সুব্রতর গাউন টেনে রেম্পিনি কানে কানে বলেন, “ব্যারিস্টার দাসের জেরা মন দিয়ে শোনো।” কখনও কোর্টে যাবার আগে জিজ্ঞাসা করেন, “বলো, এই কেসে আমাদের আর্গুমেন্ট কোন্ লাইনে হবে।” সুব্রত তার বক্তব্য বলে যায়, তিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তারপর মৃদু হেসে বলেন, “চলো কোর্টে যাই। আমার বক্তব্য সেইখানে শুনতে পাবে।”

আরও দিন যায়। রেম্পিনি নিজে না উঠে সুব্রতকে তুলে দেন। “জেরা করো।” সুব্রতর ভয় লাগে, গলা কেঁপে ওঠে। রেম্পিনি সাহস দেন। আস্তে আস্তে বলেন, “চমৎকার হচ্ছে। মোস্ট ইন্টেলিজেন্ট কোশ্চেন! এবার এইটা জিজ্ঞাসা করো।” কিছু পরে রেম্পিনি নিজেই হাল ধরলেন। অনভ্যস্ত সুব্রত স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।

দিনের শেষেও ছুটি নেই, টেম্পল চেম্বারে বসে ব্রীফ পড়তে হয়। দীপালির নরম মুখটি তখন সুব্রতর মানস পটে ভেসে ওঠে। কিন্তু মোটা-মোটা আইন বইগুলোর হুমকিতে সে যেন ভয় পেয়ে ত্রস্ত হরিণীর মতো সুব্রতর মন থেকে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যায়।

বাড়ি ফিরে একান্তে দীপালির পিঠে হাত রেখে সুব্রত খুব সহজ হবার চেষ্টা করে। সিনেমা থিয়েটারের সংবাদ নেয়, মিনি মাসি কেমন আছেন, দীপালির বান্ধবী অনুরূপা কবে আসছেন দিল্লী থেকে, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করে।

দীপালি উৎসাহ পায়। “শুনছো, আজ আগাথা সেন ফোন করেছিল। ওরা বড়দিনে মোটরে নৈনিতাল যাবে, ফিরবে নববর্ষে।” দীপালি আর কথা বলে না, জিজ্ঞাসাও করে না কিছু। তবু সুব্রতর মনে হয়, দীপালি প্রশ্ন করেছে। ওর মুখের প্রতিটি রেখা সুব্রতর কাছে উত্তর চাইছে। আস্তে আস্তে সে বলে, “এবার কোথাও যাওয়া হবে না। রেম্পিনি সায়েবের বিপক্ষে একটা কেস্ পেয়েছি। ভালো করে তৈরি হতে হবে।

বড়দিনে রেম্পিনি উপহার পাঠিয়েছেন। রঙিন সেলোফেন কাগজে মোড়া সুদৃশ্য বাক্স। দীপালিও ছুটে আসে, সায়েব কী দিয়েছেন? কাপড়? ড্রেসিং সেট? প্যাকেট খুলে দীপালি মুখ কুঞ্চিত করে। বই। তাও আইন বই। সঙ্গের স্লিপে লেখা, বইটি খুব মন দিয়ে পড়বে।

নতুন বছরে একই কোর্টে দু’জন ব্যারিস্টার ঢুকলেন। একদিকে উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনি, অন্যদিকে সুব্রত রায়। রেম্পিনি সুব্রতকে দেখেও দেখতে পেলেন না। যেন কোনো পরিচয় নেই। কেসে সুব্রতকে প্রতি পদে বাধা দিলেন রেম্পিনি। বহু রাত্রি জাগরণে সুব্রত যে সব যুক্তি সংগ্রহ করেছিল নিষ্ঠুরভাবে তার প্রতিটি খণ্ডন করলেন তিনি। তারপর আপন যুক্তির শানিত বজ্রে আক্রমণ করলেন আপন শিষ্যকে। সে অগ্নিবর্ষণ প্রতিরোধের সাধ্য কি সুব্রত রায়ের! পরাজয় হলো সুব্রত রায়ের। শোচনীয় পরাজয়।

দিনের শেষে ক্লান্ত সুব্রত টেম্পল চেম্বারে ফিরলো। রেম্পিনি পায়চারি করছেন। “সুব্রত, এমন সুন্দর কেসটা নষ্ট করলে? তোমার “লিমিটেশন’ পয়েন্টটা নেওয়া উচিত ছিল, তাহলেই আমার কোনো পয়েন্টই টিকতো না। ফাইভ কিংস বেঞ্চটা পড়লেই বুঝবে।” রেম্পিনি সম্পূর্ণ কেসটি আলোচনা করলেন। বললেন, “ভবিষ্যতে আরও সাবধানে কেস করবে।”

তারপরও কত মামলা হলো, যার একদিকে সুব্রত অন্যদিকে রেম্পিনি। প্রতিবার পরাজিত সুব্রত অবসন্ন মনে চেম্বারে ফিরে এসেছে। আর প্রতিবারই রেম্পিনি রেগে বলেছেন, “সুব্রত, হারা উচিত হয়নি।” কেস্-ল দেখিয়েছেন তিনি। সুব্রত চুপ করে শুনেছে।

গোঁ চেপে গিয়েছে সুব্রতর। দেহের সমস্ত রক্ত যেন মাথায় উঠে আসতে চায়। বারবার হারলে চলবে না। জিততেই হবে তাকে। দ্বিগুণ উৎসাহে সে কাজ করে যায়। মামলার গভীরে যাবার চেষ্টা করে। মনে এখন অন্য কিছুর প্রবেশাধিকার নেই। দীপালিরও নয়।

কোর্ট থেকে ফিরে ব্রীফ নিয়ে বসে সুব্রত; দীপালি পাশে এসে দাঁড়ায়। সুব্রত ব্রীফের পাতায় লাল পেন্সিলের দাগ দেয়।

“ওগো শুনছো।”

জীবনে এই প্রথম দীপালির উপস্থিতি অস্বস্তিকর মনে হয়। সান্ধ্য-স্নানের পর দীপালির দেহে মোহময় সুগন্ধও সুব্রতর প্রাণে সাড়া জাগায় না।

“চলো না, শ্যামবাজারে বাবাকে দেখে আসি। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। বাবার শরীরও ভালো নয়।”

দীপালির কথা সুব্রতর কানে যায়, যেন বহুদূর হতে উচ্চারিত একটি ক্ষীণ কণ্ঠ। সুব্রতর মস্তিষ্কে তাতে কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি হয় না। পড়া শেষ করে সুব্রত বলে, “কী যেন বলছিলে?” উত্তর না পেয়ে সুব্রত চেয়ে দেখে দীপালি নেই। অনেক আগে সে উঠে গিয়েছে। সুব্রতর ইচ্ছা হয় দৌড়ে গিয়ে দীপালিকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “চলো কোথায় যেতে হবে, হুকুম করো।”

কিন্তু এই দুর্বলতা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থায়ী হয়। রেম্পিনি সায়েব ভেসে ওঠেন চোখের সামনে—”কাজ করে যেতে হবে। সব কিছু ভুলে কাজ করে যেতে হবে।” দীপালির চিন্তা মুছে ফেলে সুব্রত আর একটা বই টেনে নেয়।

অবশেষে সেই দিন এল, যে দিনের জন্য সুব্রত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। যার জন্য দীপালিকে দূরে সরিয়ে দেওয়া, যার জন্য কত নিদ্ৰাবিহীন রাত্রিযাপন, সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত উপস্থিত। জয় হয়েছে সুব্রতর, আপন শিষ্যের হস্তে পরাজিত হয়েছেন উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনি। আজ আর তিনি বকবেন না। বলবেন না, সুব্রত তোমার হারা উচিত হয়নি। বরং আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরবেন সুব্রতকে। তাঁর শিক্ষাদান সার্থক হয়েছে। লিফটের অপেক্ষা না করে সুব্রত টেম্পল চেম্বারে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এল।

ভিতরে ঢুকেই সুব্রত থমকে দাঁড়ালো। রেম্পিনি একমনে বই পড়ছেন। সুব্রতকে দেখতে পেলেন না। গাউনটা খুলে রেখে সুব্রত নিজের চেয়ারে বসে পড়লো। তখনও রেম্পিনি নির্বাক হয়ে রইলেন। সুব্রতর সঙ্গে যেন কোনো পরিচয় নেই তাঁর। অস্বস্তি লাগে সুব্রতর, মনটা খারাপ হয়ে যায়। দু’-একটা সন্দেহের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। দেওয়ালের বই-এর সারিগুলোর দিকে সে তাকালো। তারাও যেন ভয় পেয়ে জড়সড় হয়ে রয়েছে। শুধু ঘড়িটা প্রগল্ভ শিশুর মতো আপন মনে বকে চলেছে। রেম্পিনি ডুবে রয়েছেন বই-এর ভিতরে।

সন্ধ্যা ছ’টা। সুব্রত চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো। “গুড নাইট স্যার।”

বই থেকে মুখ না তুলেই রেম্পিনি বললেন, “গুড্‌ নাইট।”

পরের দিন কাজের শেষে রেম্পিনি ডাকলেন, “সুব্রত”।

এই ডাকের জন্যই তো সুব্রত অপেক্ষা করছিল। সারারাত যে তার ঘুম হয়নি। কিন্তু একি, রেম্পিনিকেও যেন চেনা যাচ্ছে না। একদিনে বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। তিনি গম্ভীর, মিতভাষী ও বিমর্ষ।

“সুব্রত,” রেম্পিনি থামলেন। তাঁর চিন্তা যেন এখনও শেষ হয়নি। “সুব্রত, আমাদের আর এক-চেম্বারে কাজ করা চলবে না।” আর একটিও কথা বলেননি উইলমট ড্যানিয়েল রেম্পিনি। বেদনাহত সুব্রত চমকে উঠল। রেম্পিনি ততক্ষণে চোখ নামিয়ে নিয়েছেন। তিনি আবার ঢুকে গিয়েছেন ব্রীফের মধ্যে।

সেদিন রাত্রে নিজেকে ভয়ঙ্কর নিঃসঙ্গ মনে হলো সুব্রতর। সে যেন একা। এখন থেকে আইনের অন্তবিহীন আকাশে তাকে একাকী বিচরণ করতে হবে। দীপালিকে সব কথা বলতে ইচ্ছা হয়, কিন্তু সঙ্কোচ আসে। নিজের পেশার ব্যাপারে স্ত্রীকে ব্যস্ত করা কি উচিত হবে? আগাথা সেন স্বামীর প্রফেশনাল টক্ বরদাস্ত করেন না।

এই চিন্তার জালে সুব্রত হয়তো দিনে দিনে জড়িয়ে যেতো। কিন্তু কাজ আছে, অনেক কাজ। কোর্টে প্রতিষ্ঠা হয়েছে, এটর্নিরা দলে দলে ব্রীফ পাঠাচ্ছে। তারই মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিলো সুব্রত রায়।

সুব্রতকে ডুবে থাকতে হয় কাজের মধ্যে। এখন শুধু কাজ আর কাজ। রাত্রে ডিনারের পরও কাজ। ঘড়িতে দশটা বাজে, দীপালি নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায়। বলে, “শোবে চলো।”

“এই, আর কয়েক মিনিট।”

“রাত যে অনেক হলো।”

সুব্রত দীপালিকে অনুসরণ করে। কিন্তু হাতে খানকয়েক বই। বিছানাতে বইগুলো নামিয়ে রেখে টেবিল ল্যাম্পের সুইচটা সে জ্বালিয়ে দেয়। আর দীপালি অসহায়ভাবে বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখ ফুটে কিছুই সে বলে না।

সুব্রত রায়ের জগতের পরিধি আরও ছোট হয়ে আসে। কাজ বাড়ার অনুপাতে সময় কমছে। সিনেমা থিয়েটার যাওয়া বন্ধ হয়েছে অনেক আগেই। গল্পের বই পড়াও ছেড়ে দিতে হয়েছে, খবরের কাগজটাও রোজ দেখা হয়ে ওঠে না। এখন কেবল হলসবেরী, অল্-ই-আর, সি-ডবলু-এন, টি-এল-আর……..।

একদিন সাজগোজ করে দীপালি এসে দাঁড়ালো। ঘিয়ে রঙের সিল্কের শাড়ি বেশ মানিয়েছে। “কি ব্যাপার?” সুব্রত জিজ্ঞাসা করলো।

“কেন গত শনিবার আগাথা সেন বার বার বলে গেল, টি-পার্টি। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।”

“সে কি! আমার যে একদম মনে নেই। এদিকে দু’জন মক্কেলকে কথা দিয়েছি, তারা এখনি আসবে। খুব দুঃখিত।” দীপালি করুণ নয়নে চেয়ে থেকে চলে গেল।

.

এর পরেও তো কতদিন কাটলো। খোকন এসেছে সংসারে। বাবার স্নেহ, কিছুটা সে পেয়েছে। অন্তত রবিবারে খোকনের সঙ্গে খেলা করেছেন সুব্রত। তারপর যারা এসেছে বাবাকে দূর থেকে দেখেছে তারা। দীপালিই নাম রেখেছে শিপ্রা। সুব্রত খোঁজ রাখেননি। এসেছে মীনা। সুব্রত খেয়াল করেননি। অরুন্ধতী, যার ডাক নাম ডলি, বাবার কাছে আবদার করেছে, “আমরা একা-একা পিকনিকে যাই। তোমাকেও যেতে হবে কিন্তু।”

“সময় নেই। ক্লায়েন্ট আসবে এখনি।” রসকষবিহীন হয়ে উত্তর দিয়েছেন সুব্রত রায়।

সংসারের খবর পাঁচুগোপাল তবু বলতে পারেন খানিকটা। কিন্তু তাঁর সায়েবের কিছু জানা নেই।

.

ব্যারিস্টার সুব্রত রায় মুখে সেদ্ধ গুঁজে যান। সব সেদ্ধ। তেল নয়, ঘি নয়, ডাক্তারের বারণ। খাওয়াটা নিতান্ত কর্তব্যবোধে। সামনে দীপালি। পঁয়ত্রিশ বছর প্রতিদিন সে এমনিভাবে দাঁড়িয়ে আসছে। মেয়েরা কোথায়? না, সুব্রত রায় অযথা চিন্তায় সময় নষ্ট করবেন না। কালকে দুটো মামলা।

দীপালি খুব আস্তে বললেন, “খোকনকে চিঠি লিখবে না?”

“কেন, তুমি কি লেখোনি? লন্ডনের আবহাওয়া এখন কেমন?”

“আমি লিখলেই শুধু হবে কেন? তোমারই ছেলে বিদেশে—”

সুব্রত কথা শেষ করতে দিলেন না। “রবিবারে একবার মনে করিয়ে দিও।”

রবিবারে মনে করিয়ে দিয়েও যা হবে তা জানা আছে। দীপালি উত্তর দিলেন না।

বিবেকের দংশন সুব্রতকে জ্বালা দেয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। নিজের ছেলেকে চিঠি লেখা হয় না, মেয়েরা বাবাকে বোধ হয় ভুলেই গিয়েছে।

বহু দিনের পুরনো সুরে সুব্রত হঠাৎ ডেকে উঠলেন, “দীপা, চলো আজ গল্প করি। মীনা ও ডলিকে ডাকো।” ঠাকুরকে হাঁক দেন সুব্রত, “বাড়ির তরকারি একটু দিয়ে যাও, খেয়ে দেখি। রোজ রোজ সেদ্ধ ভালো লাগে না।” সুব্রতর মুখে কথার ফুলঝুরি। “একদিন সবাই মিলে সিনেমায় চলো।”

কিন্তু কেউ উত্তর দিচ্ছে না। দীপালি অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। বাবা হঠাৎ সিনেমার কথা বলছেন! কেউ বিশ্বাস করছে না তাঁকে। কেউ এগিয়ে আসছে না। সবাই তাঁকে ভয় করে, সমীহ করে। কিন্তু কেউ ভালোবাসে না।

দীপালি শেষে বললেন, “বেশ তো, ভালো কথা।”

নিষ্প্রাণ উত্তর। এরা আমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, সুব্রতর মনে হলো। অভিমান জাগলো, কিন্তু প্রকাশ করলেন না তিনি। বিরক্তিও চেপে রাখলেন। বুঝতে পারছেন, এদের প্রাণ চাঞ্চল্যকে তিনিই তিলে তিলে হত্যা করেছেন।

ঘড়ির দিকে তাকালেন সুব্রত রায়। পনেরো মিনিট অযথা নষ্ট হয়েছে। মনে পড়ে যায় আগামীকাল মামলা আছে। তোয়ালেতে হাত মুছে উঠে পড়লেন সুব্রত রায়।

লাইব্রেরী। টেবিল ল্যাম্পটা কাছে টেনে নিলেন তিনি। পড়বার চেষ্টা করেও মাথায় ঢুকছে না কিছু। প্রচণ্ড শক্তিতে তিনি সাংসারিক চিন্তা ভুলবার চেষ্টা করেন। কাদার মতো চিন্তাগুলো এতদিন জলের তলায় থিতিয়ে ছিল। নাড়া পেয়ে হঠাৎ তারা ঘুলিয়ে উঠেছে, রঙ পালটিয়েছে জলের।

চেয়ারে বসে রেম্পিনি সায়েবের কথা মনে পড়ে যায়। শেষদিনের কথা। অনেকদিন আগেকার কথা। রেম্পিনি ডেকে পাঠিয়েছেন সুব্রতকে। কতদিন দেখা নেই দু’জনে

“আমাকে ডেকেছেন?”

“হ্যাঁ।” কিছুক্ষণ থেমে রেম্পিনি ডাকলেন, “সুরত”।

“বলুন।”

“আমি চলে যাচ্ছি।”

“সে কি!”

“হ্যাঁ, ফিরে যাব নিজের দেশ স্কটল্যান্ডে। একটা ছোট কুঁড়ে ঘর কিনেছি সেখানে। অনেকদিন যুদ্ধ হলো, এবার অবসর। চাষ করবো নিজের হাতে, ফসল ফলাবো।”

উত্তর দিতে পারে না সুব্রত।

চেয়ার থেকে উঠে রেম্পিনি বললেন, “একটা কাজ আছে, সুব্রত। সেইজন্য তোমাকে ডেকেছি।” তারপর জামাকাপড়ের আলমারিটা খুললেন তিনি। অনেকগুলো কালো কোট ও গাউন ঝুলছে সেখানে।

“এই গাউনটা চেনো?” রেম্পিনির হাতে একটা জীর্ণ গাউন।

“নিশ্চয়ই। কতদিন আপনাকে দেখেছি কোর্টে পরে যেতে। দু’-একবার বলেওছি এত ছেঁড়া গাউন ভালো দেখায় না। আপনি উত্তর দেননি।

রেম্পিনি গাউনের দিকে আবার তাকালেন। পরম আগ্রহে দর্জির নাম লেখা, লেবেলটা পড়বার চেষ্টা করতে লাগলেন।

“তা সত্যি, আমাকে মানায় না। এ-গাউন পরবার যোগ্যতা আমার নেই; আমি অনেক ক্ষুদ্র।”

রেম্পিনির কথা সুব্রত ঠিক বুঝতে পারে না।

গাউনটা যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করে তিনি বললেন, “সুব্রত তোমাকে আগে বলিনি। কেউ জানে না। এ গাউন আমার নয়।”

“এ্যাঁ!”

গাউনটার উপর হাত বোলাতে বোলাতে রেম্পিনি বললেন, “মৃত্যুর আগে স্যার হেনরী লং আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।”

প্রিয় শিষ্যকে কাছে ডেকে স্যার হেনরী জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমাকে কী দেব উইলমট?”

“আমার জীবনে সবই তো আপনার দান”—–রেম্পিনি উত্তর দিলেন।

দীর্ঘদিনের রোগশয্যায় পাণ্ডুর বৃদ্ধ স্যার হেনরীর ঠোঁট দুটি কেঁপে উঠল। “আমাকে আর কোর্টে যেতে হবে না। যে জীবন পিছনে ফেলে এসেছি, তার উত্তরাধিকারী তুমি।”

স্যার হেনরী তাঁর কালো গাউনটি বালিশের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। কম্পিত হাতে সেটা বার করলেন তিনি। বললেন, “এই নাও উইলমট।”

গুরুর দান মাথা পেতে নিয়েছিলেন রেম্পিনি। দীর্ঘকাল পরম শ্রদ্ধা ও যত্ন সহকারে কালো গাউনটি রক্ষা করে এসেছেন তিনি।

সেদিন রাতে টেম্পল চেম্বারে লোক-চক্ষুর অন্তরালে রেম্পিনি সুব্রতকে পরম স্নেহে আলিঙ্গন করলেন। সজল চোখে সঁপে দিলেন কালো গাউনটি। বললেন, “যখনই কোনো কঠিন কেসে নিজেকে বিব্রত বোধ করবে, এই গাউন গায়ে দিয়ো।” বর্তমানে ফিরে আসেন সুব্রত রায়। তিনি ক্লান্ত। ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে ‘আসছে। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না। মামলার পয়েন্ট বার করতে হবে। সুব্রত রায় পায়চারি আরম্ভ করলেন।

রাত কত? ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চমকে ওঠেন। চারিদিক নিস্তব্ধ। সমগ্ৰ পৃথিবী নিদ্রামগ্ন। বিজলী বাতিটাও বুঝি নিদ্ৰাকাতর। ম্লান হয়ে এসেছে তার আলো।

আর ব্যারিস্টার সুব্রত রায় কেসের পয়েন্ট খুঁজছেন। কিন্তু মস্তিষ্ক শূন্য। কিছু মনে আসছে না। অব্যক্ত যাতনায় চুলগুলো ছিঁড়তে ইচ্ছে করে।

কী হবে ভেবে? এখন নিদ্রা। অন্ততঃ কয়েকঘন্টা শান্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু চোখের সামনে আগামীকালের কোর্টের দৃশ্য ভেসে ওঠে। ব্যারিস্টার স্যানিয়াল একের পর এক বাণ ছুঁড়ছেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি। উত্তর দিতে পারছেন না সুব্রত রায়। মাথা নিচু করে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। না না, তা হয় না।

ঘড়ির পেণ্ডুলাম দুলে চলে। যক্ষ পুরীতে বন্দী যেন সুব্রত রায়। চারিদিকে কলসী-কলসী মোহরের মতো মোটা-মোটা আইন বইগুলো জড়ো হয়ে রয়েছে। অনন্তকাল ধরে এই যখের ধন পাহারা দিতেই কে যেন তাঁকে মন্ত্রবলে বশীভূত করে রেখেছে। এই বন্দিশালা থেকে কেউ কি তাঁকে উদ্ধার করতে পারে না? ব্যারিস্টার রায় থমকে দাঁড়ান। দীপালি। হ্যাঁ। দীপালি পারে। সে আসবে। এখনই এসে বলবে, “রাত অনেক, শোবে চলো।”

ঘড়ির পেণ্ডুলাম দুলে চলে। না না, ভুল হয়ে গিয়েছে। দীপালি তো আসে না বহুদিন। অনেক বছর সে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কিছু বলবে না সুব্রতকে। সারা রাত জেগে থাকলেও কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।

দূরে টাঙানো গাউনটা হঠাৎ নজরে পড়ে যায়। মিশকালো রঙ। কত পুরনো কে জানে। অনেক জায়গায় ছোটো ছোটো ফুটো। রেম্পিনি সায়েবের গাউন। বহু দিনের সঙ্গী। যখনই কোনো জটিল মামলায় সন্দেহ জেগেছে, জেগেছে সামান্য ভয়, সুব্রত রায় পরম বিশ্বাসে তাকে অঙ্গে ধারণ করেছেন। বহু যুদ্ধের স্মৃতিমণ্ডিত বর্ম।

তাঁর দৃষ্টি গাউনের দিকে নিবদ্ধ। সেটি যেন ক্রমশ আকারে বাড়ছে। সুব্রত রায় ফিরে যেতে চান নিদ্রার ক্রোড়ে। কিন্তু একি! কালো গাউনটা যেন এগিয়ে আসছে। হ্যাঁ, ওই তো আরো কাছে এগিয়ে আসছে। পালাতে হবে। তিনি দ্রুত কয়েক পা পিছু হটে এলেন। কিন্তু দরজা কোথায়? ডানদিকে তাকালেন তিনি। তারপর বাঁদিকে। কিন্তু দরজা নেই। শুধু বই। বই-এর দেওয়াল। ওই তো সুব্রত রায় দেখতে পাচ্ছেন তাঁর দেহকে নিঃশ্বাস রোধ করে হত্যা করা হচ্ছে। ওই তো তাঁর নিজেরই মৃত দেহ পড়ে আছে। বীভৎস, পঙ্কিল। হৃদয় নেই, প্ৰাণ নেই, শুধু বিশাল মস্তিষ্ক। ভিতরে কী সব গিজ গিজ করছে, হ্যাঁ পোকা, আইনের পোকা।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। অন্ততঃ নিজের আত্মাকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। কিন্তু নিষ্ফল প্রচেষ্টা। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা জগৎ-সংসারকে বিলুপ্ত করে ঐ কালো গাউন আরও এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে বিজলী বাতির স্তিমিত আলোকে, নিদ্রামগ্ন পৃথিবীর অলক্ষ্যে ঐ হিংস্র, কুৎসিত, বিশাল দানব-পক্ষী তার ঘন কৃষ্ণবর্ণ পক্ষ বিস্তার করে সুব্রত রায়ের সকল সত্তা গ্রাস করতে ছুটে আসছে।

বার-লাইব্রেরীর সামনে বাবুদের বেঞ্চিতে বসে এই গল্প যিনি বলছিলেন, তিনি চুপ করলেন। আমরা অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ছোকাদা বেঞ্চির কোণ থেকে আরও কাছে সরে এলেন। বাইরের দিকে তাকিয়ে বিড়িতে আগুন ধরালেন। তারপর বললেন, “ওই কালো গাউনের মোহ বহু ব্যারিস্টারকে সংসার থেকে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছে।”

কিছুক্ষণ চুপ করে ছোকাদা আবার বললেন, “ওরে আমাদের সায়েবদের আসল বিয়ে ওই কালো গাউনের সঙ্গেই।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন