কত অজানারে – ১৫

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

চলার পথে অনেক কিছুই তো পথিকের চোখে পড়ে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কত অসংখ্য বৃক্ষ, অগণিত গৃহ, মানুষ, পশু, পক্ষী সে দেখে। কিন্তু যাত্ৰাশেষে প্রতিজনকে মনে থাকে না। মনের পটে বহু প্রতিফলনে মাত্র একটি ছবির সৃষ্টি হয়। কবি বলেছেন, “মালিকা পরিলে গলে প্রতি ফুল কেবা মনে রাখে’। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে অনেক শীত ও বসন্ত, অনেক বেদনা ও আনন্দ আমি প্রত্যক্ষ করেছি। আনন্দের উপর হয়তো কখনো বেদনার পলিমাটি পড়েছে, আবার কখনও বেদনার উপর আনন্দের প্রলেপে নতুন স্তর সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আজকে যখন সে-সব কথা আবার ভাবতে বসি, তখন তাদের বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করতে পারি না। ভাঁজে- ভাঁজে যারা পৃথক ছিল, সময়ের পেষণে তারা এক হয়ে গিয়েছে।

অনেক লোককে দেখেছিলাম, অনেক গল্প শুনেছিলাম, সব মনে নেই। কিন্তু ভাবতে-ভাবতে সেদিন রবীন্দ্র কলিতার কাহিনীটা মনে পড়ে গেল।

টেম্পল চেম্বারে সায়েবের ঘরে একটি র‍্যাকে অসংখ্য কাগজ জমা হয়ে ছিল। অনেক পুরনো ব্রীফের বাণ্ডিল সেখানে সাজানো থাকতো। উপরের ধুলো থেকে সহজেই বলা যায়, বহুদিন সেখানে কারুর হাত পড়েনি। মামলা শেষ হয়ে গেলে কাগজপত্রগুলো লাল ফিতে দিয়ে বেঁধে আমিও সেখানে রেখে দিতাম। আইনপাড়ায় একটি কাগজও কেউ নষ্ট করে না। সব যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়, কখন কাজে লেগে যাবে কেউ জানে না।

এই কাগজের পাহাড় থেকে স্থানচ্যুত হয়ে একটা ছেঁড়া পাতা কেমন করে মেঝেতে এসে পড়েছিল লক্ষ্য করিনি। মোহনচাঁদ সেটি আমার টেবিলে তুলে দিয়ে বললে, “বাবু আপনার কাগজ পড়ে গিয়েছে।”

ধুলো ঝেড়ে নিছক কৌতূহল-বশেই ময়লা কাগজটাতে চোখ বোলাতে লাগলাম। কোনো এক রবীন্দ্র কলিতার বাবা মহামান্য বড়লাট বাহাদুরের কাছে সন্তানের হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেছেন। প্রথম পাতা থেকে আর কিছু বোঝা গেল না। রবীন্দ্র কলিতা সম্বন্ধে জানবার আগ্রহটা বোধহয় সেই কারণেই আরও বেড়ে গেল। সায়েবের ব্যাগের ভিতর কাগজটা রেখে দিলাম, সময় মতো তাঁকে জিজ্ঞাসা করা যাবে।

সুযোগও এসে গেল। সেদিন রবিবার। সমস্ত দুপুর ও বিকেল কাজ করে আমরা চায়ের টেবিলে বসেছিলাম। সুযোগ বুঝে ব্যাগ থেকে ছেঁড়া কাগজটা বার করে সায়েবের দিকে এগিয়ে দিলাম।

সায়েব হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি প্রাচীন পুঁথিপত্র নিয়ে গবেষণা করছো নাকি?”

কাগজটা কিভাবে কুড়িয়ে পেয়েছি তাঁকে খুলে বললাম। কয়েক মিনিট ধরে ছেঁড়া পাতাটা তিনি মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। তারপর চায়ের কাপটা নিজের দিকে একটু টেনে নিয়ে বললেন, “রবীন্দ্রকে কিন্তু বেশ মনে আছে।”

আমি বললাম, “বলুন না শুনি।”

ম্লান হেসে তিনি উত্তর দিলেন, “সে-গল্প অন্যদিন শুনলে ভালো হয়। শুধু শুধু আজকের চায়ের আসরটাকে নিরানন্দ করে তুলতে চাই না।”

আমার কৌতূহল তখন জেঁকে বসেছে। বললাম, “পুরনো দিনের কথায় তো দুঃখ পাবার কিছু নেই। আমি এখনই শুনতে প্রস্তুত আছি।”

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সায়েব বাইরে খোলামাঠের দিকে তাকালেন। বিকেলের পড়ন্ত রোদে গাছের ছায়াগুলো ক্রমশ আরও শীর্ণ ও দীর্ঘ হচ্ছে। দু’জন মালী ঘাসকাটা কল দিয়ে একমনে ঘাস কাটছে। আর ঘাসের ভিতর আমরা দু’জন মুখোমুখি বসে রয়েছি। সায়েব বলতে লাগলেন—

ক্রিমিন্যাল কেস করতে একবার চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। দিন সাতেক থাকার দরকার। দায়রা জজের আদালতে কেস। একদিন সন্ধ্যায় ওখানকার স্থানীয় এক উকিল আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সঙ্গে একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক। মাথার চুল প্রায় সমস্ত সাদা হয়ে এসেছে। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। চোখগুলো কোটরের মধ্যে ঢুকে রয়েছে।

ভদ্রলোক নিজে ভালো ইংরেজি জানেন না। ছোকরা উকিলটি বললেন, “নিরুপায় হয়েই খগেনবাবু আপনার কাছে এসেছেন। ওঁর বড়োছেলেটিকে আপনিই একমাত্র বাঁচাতে পারেন।”

বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ছলছল চোখে এগিয়ে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলেন।

“রাজনৈতিক অপরাধের মামলা”, উকিলবাবু বললেন।

খগেনবাবুর বড়োছেলে রবীন্দ্র কলিতা। নামটা অসমীয়া মনে হলেও ওঁরা আসলে বাঙালী, চট্টগ্রামের অধিবাসী।

সাব পোস্টমাস্টার খগেনবাবু এক বছর হলো অবসর নিয়েছেন। পেনশনের সামান্য টাকায় সংসার চলে না। যা কিছু সঞ্চয় ছিল তা মেয়ের বিয়েতে প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রের আশায় দিন কাটছে। ছেলে বড়ো হয়ে রোজগার করবে। ইস্কুল ছেড়ে সে কলেজে ঢুকেছে। পড়াশোনায় সে বেশ ভালো। বাপমায়ের দৃঢ় বিশ্বাস রবীন্দ্র সংসারের মুখোজ্জ্বল করবে।

একদা গভীর রাতে ডাকাডাকিতে খগেনবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। দরজা খুলে দেখলেন, লাল পাগড়িতে বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। রাগতস্বরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি সরকারের পেনশন হোল্ডার, আমার বাড়িতে রাত্রে হামলা কেন?”

পুলিশ অফিসারটি বললেন, “আপনার ছেলে রবীন্দ্র কলিতাকে চাই।”

খগেনবাবু অবাক। “আপনি নিশ্চয় ভুল করেছেন। আমার ছেলে নিতান্ত বালক। ইস্কুল ছেড়ে সবে কলেজে ঢুকেছে।”

“আজ্ঞে ভুল আমাদের সহজে হয় না।” পুলিশ অফিসারটি বিছানা থেকে ঘুমন্ত রবীন্দ্রকে তুলে নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠলেন।

পরের দিন খগেনবাবু থানায় গেলেন। স্বদেশী কাজে সন্দেহজনক গতিবিধির জন্য পুলিশ বহু ছেলেকে হাজতে এনেছে, রবীন্দ্র তাদেরই একজন। অনুসন্ধান শেষ হতে সময় লাগবে। ইতিমধ্যে জামিনও চলবে না। সপ্তাহখানেক থানায় যাতায়াত করে ছেলের সঙ্গে তাঁর মাত্র একদিন দেখা হয়েছিল। কোর্টে কেস ওঠার অপেক্ষায় ছিলেন খগেনবাবু।

কিন্তু একদিন ভোরে আবার কড়া নাড়ার শব্দে তিনি দরজা খুললেন। দুই লরী বোঝাই পুলিশ সমেত দারোগা এসেছেন। সঙ্গে তল্লাসী-পরোয়ানা। তারা সমস্ত বাড়ি তছনছ করে যেখানে যা পেলো খুলে দেখলো, কিছু বই ও কাগজ সঙ্গে নিয়ে গেল। পুলিশ অফিসারটি যাবার আগে বললেন, “গতকাল সন্ধ্যায় আপনার ছেলে হাজতের মধ্যে একজন দারোগাকে খুন করেছে।”

উকিলটি বললেন, “আপনি এখন যে মামলা করছেন, ঠিক তারপরেই ওই কোর্টে রবীন্দ্রের কেস্ উঠবে।”

ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে আমি না বলতে পারলাম না। ঠিক করলাম ওই কেস্টা করেই কলকাতায় ফিরবো।

পরের দিন রবীন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য থানায় গেলাম। ডেপুটি সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট অব পুলিশকে আগেই খবর দিয়ে দেখা করার অনুমতি নিয়ে রেখেছিলাম। বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে, ঘরের ভিতর আমি রবীন্দ্র কলিতার জন্য অপেক্ষা করছি। একটু পরেই সে এল। নিতান্ত বালক, গোঁফের রেখা পর্যন্ত স্পষ্ট হয়নি। দীর্ঘ সুঠাম দেহ, বড়ো-বড়ো দুটি উজ্জ্বল চোখ। চুলগুলো ঢেউ- খেলানো।

আমি বললাম, “রবীন্দ্র, তোমার কেস্টা আমি করবো ঠিক করেছি।”

সে কিন্তু গম্ভীরভাবে বললে, “আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই। আমি জানি, যা করেছি তা ঠিকই করেছি এবং ফলাফল জেনেই করেছি।”

“তুমি নিজেই খুন করেছো রবীন্দ্র?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম। “হ্যাঁ ম্যাজিস্ট্রেটকে তো বলেছি, আমিই খুন করেছি।”

আঠারো বছরের ছেলের মুখে এমন নির্ভীক উত্তর শুনে আমার নরেন মণ্ডলের কথা মনে পড়ছিল।

“রবীন্দ্র, অবুঝ হতে নেই। আমি আবার আসবো। ইতিমধ্যে মনস্থির করা চাই।” এই বলে আমি সেদিনের মতো বিদায় নিলাম।

পরের দিন কোর্ট থেকে সোজা থানায় গেলাম। রবীন্দ্র আবার এসে দাঁড়ালো। প্রথমে আমরা সাহিত্য, খেলাধূলা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করলাম। রবীন্দ্র বেশ কথা বলছিল। বিদায় নেবার কিছু আগে আসল প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম। “রবীন্দ্র, তোমার মামলা দিন কয়েকের মধ্যেই কোর্টে উঠবে।”

সে তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলো। “আমি নিজেই খুন করেছি। রাগের মাথায় খুন করিনি, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করেই শয়তানটাকে শাস্তি দিয়েছি।”

রবীন্দ্রকে বোঝালাম, “এখন ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। আমাকে কেস্টা তৈরী করার সুযোগ দাও।” কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়েই সে ভিতরে চলে গেল

তার বাবা সে-কথা শুনে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “আপনাকে কিছু করতেই হবে। ওর মাথায় নিশ্চয় ভূত চেপেছে, নইলে প্রাণের মায়া করে না!”

পরের দিন আবার গেলাম রবীন্দ্রকে দেখতে। সঙ্গে চকোলেট ও বিস্কুট নিয়ে গিয়েছিলাম। দু’জনে ভাগাভাগি করে সেগুলো খেতে লাগলাম। সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, “টেগোরের কিছু পড়েছেন?”

আমি বললাম, “তাঁর যে-সব বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে প্রায় সমস্ত পড়েছি। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়ও আছে। জোড়াসাঁকোতে টেগোরের বাড়িতে অনেকবার গিয়েছি।”

রবীন্দ্র খুব আগ্রহের সঙ্গে শুনে বললে, “আমাদের দু’জনের একই নাম, যদিও আমি কবি নই।”

আমি হেসে উঠলাম। কিন্তু আজ সময় নষ্ট করলে চলবে না। তার হাত চেপে ধরে বললাম, “কেঁদে-কেঁদে তোমার বাবা ও মায়ের কী অবস্থা হয়েছে জানো না। তাদের মুখ চেয়েই আমি রোজ এখানে আসছি।”

রবীন্দ্র আবার গম্ভীর হয়ে উঠলো। কোথায় মিলিয়ে গেল তার মুখের হাসি। আর একটা চকোলেট এগিয়ে দিলাম তার দিকে, সে নিলে না।

আমি বললাম, “রবীন্দ্র, অন্তত আসল ঘটনাটা আমাকে বুঝিয়ে বলো।”

এবার সে আপত্তি করলে না। “ওই শয়তান দারোগাটাকে আমরা অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম। লোকটা মানুষ নয়, পশু। ওর ধারণা ছিল রুলের গুঁতো ও আঙুলে পিন ফুটিয়ে যে কোনো স্বদেশীওয়ালাকে ঘায়েল করা যায়। অনেকদিন ধরে বিভিন্ন থানায় বুটের ধাক্কায় লোককে জ্বালিয়ে এসেছে। অন্য কোনো প্রমাণ না পেয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করবার আশায় আমাদের উপর তার সবরকম ওষুধ ব্যবহার চলেছিল। ভাতে কাঁকর বোঝাই করে দিচ্ছিল পশুটা। বুট দিয়ে লোকটা আমাদের পা মাড়িয়ে দিতো। টান দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে আনতো। আমার অন্য বন্ধুরা ইতস্তত করছিল, কিন্তু আমি নিজের কর্তব্য ঠিক করে নিলাম। লুকিয়ে একটা থান ইট যোগাড় করে রেখেছিলাম। শয়তানটার সাহস এমন বেড়েছিল যে, একাই রুলকাঠ নিয়ে আমার সেলে ঢুকে পড়লো একদিন। আমিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। থান ইঁটের এক ঘায়ে মাথাটা থেঁতলে গেল।” রবীন্দ্র পায়চারি করতে করতে বললো, “কিন্তু আমি মোটেই দুঃখিত নই।”

যে-কেসে চট্টগ্রামে এসেছিলাম, সেটা শেষ হওয়ার ঠিক পরেই জেলা-জজের কোর্টে রবীন্দ্রের মামলা আরম্ভ হলো। ক্ষণিকের উত্তেজনাবশে হত্যা বলে প্রমাণ করার ইচ্ছা ছিল আমার। আইনের চোখে কাল্পেল্ হোমিসাইড ও মার্ডারের পার্থক্য অনেক। পূর্বাহ্নে চিন্তা করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করার নাম মার্ডার। আর ক্ষণিকের উত্তেজনার প্ররোচনায় আঘাতজনিত হত্যার নাম কাল্পেল্ হোমিসাইড নট এমাউন্টিং টু মার্ডার। এর জন্য অপেক্ষাকৃত লঘু শাস্তি হয়ে থাকে। যদি প্রমাণ করতে পারি, মৃত দারোগাটির অমানুষিক দুর্ব্যবহারে রবীন্দ্রের বয়সী কোনো যুবকের পক্ষে শান্ত থাকা সম্ভব নয়; ধৈর্যের শেষ বাঁধও একদিন ভেঙে পড়লো এবং উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে সে দারোগাকে আঘাত করে, তবে আট দশ বছরের বেশী জেল হবে না।

কিন্তু কিছুই সম্ভব হলো না। কোর্টে সর্বসমক্ষে রবীন্দ্র বললে যে, তার কৃতকর্মের জন্য সে মোটেই দুঃখিত নয়। বরং, অন্যায়ের প্রত্যুত্তর দিতে পারার জন্য সে তৃপ্ত। সবাই চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। জজও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আমি হতাশ হয়ে চুপচাপ এক কোণে বসে রইলাম, কিছু করার নেই। রবীন্দ্রের বাবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমার জুনিয়র তাঁকে কোর্টের বাইরে নিয়ে গেলেন।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মামলা শেষ। বিচারাধীন থাকাকালে রাজকর্মচারীকে হত্যার অপরাধে রবীন্দ্র কলিতার মৃত্যু-দণ্ডের আদেশ দিয়ে জজ জানতে চাইলেন, সে কিছু বলতে চায় কিনা। রবীন্দ্র বললে, “হ্যাঁ, আমার কিছু বলার আছে।”

কোটভর্তি লোক তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আদেশপত্রে সইয়ের জন্য কলমটা দোয়াতে ডুবিয়ে জজ-সায়েবও আসামীর মুখের দিকে তাকালেন। আসামীর কাঠগড়া থেকে সে বললে, “দারোগা বিপদভঞ্জন দত্তকে খুন করে আমি মোটেই দুঃখিত নই। বরং আনন্দিত।” আঠারো বছরের রবীন্দ্র কলিতার মুখ ঘৃণায় বিকৃত হয়ে উঠলো।

চট্টগ্রামের কাজ তো শেষ হলো। বিদায় নেবার আগে রবীন্দ্রকে শেষবারের মতো দেখতে গেলাম। বেলা তখন প্রায় পাঁচটা। একবার ভাবলাম, চলে যাই, দেখা করে লাভ নেই। যা হবার তো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রকে না দেখে উঠতে পারলাম না। ভিতরে তালা খোলার আওয়াজে বুঝলাম পুলিশ তাকে নিয়ে আসছে। ভাবতে লাগলাম, প্রথমে কী বলবো। কিন্তু তার একটুও পরিবর্তন হয়নি। তেমনি হাসিতে ভরা মুখ। তবুও আমার চোখ তুলতে সাহস হচ্ছিলো না। মাথা নিচু করে ঢোক গিলে বলতে গেলাম, “রবীন্দ্র আমি সত্যি—”

আমাকে বাধা দিয়ে, চোখ দুটো বড়ো করে সে বললে, “চকোলেট এনেছেন তো?”

কোটের পকেট থেকে চকোলেটের ঠোঙাটা এগিয়ে দিলাম। ছোট্ট ছেলের মতো একসঙ্গে দুটো চকোলেট সে মুখে পুরে দিলে।

ফুটবল খেলা দিয়ে আমাদের আলোচনা আরম্ভ হলো। নিজের সম্বন্ধে একটি কথাও রবীন্দ্র তুলতে দিলে না—মন্ত্রবলে সে যেন ওই প্রসঙ্গ একেবারে ভুলে গিয়েছে।

“ত্রিশবছরে ভারতবর্ষে কত লোক দেখলাম। কিন্তু রবীন্দ্রকে আজও ভুলতে পারলাম না। আঠারো বছরের ছেলে, অথচ জীবনের সব আকর্ষণকে যেন জয় করে ফেলেছে”––সায়েব আস্তে আস্তে বলে যাচ্ছেন। বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, “আলোটা জ্বালিয়ে দেবো?” তিনি বারণ করলেন, “সব সময় আলো ভালো লাগে না। এই তো বেশ আছি।”

“তারপর?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“তারপর আমরা অনেক আলোচনা করলাম।”

রবীন্দ্র আরও বললে, বাবার অজান্তে বছরখানেক ধরেই সে সন্ত্রাসবাদী দলে কাজ করছিল। বহুদিন গোপনে ইস্কুল পালিয়ে সে ক্লাবে গিয়েছে। বাড়িতে বলেনি।

আমি বললাম, “তোমার বৃদ্ধ বাবা-মা’র কথাও ভেবে দেখা উচিত ছিল।”

সে ম্লান হাসলো। “আমার পরেও তো একটা ভাই রয়েছে, এবারে ম্যাট্রিক দেবে।” সে থামলো। “আপনারা কলকাতায় থাকেন, যদি দয়া করে ওর কিছু একটা করে দেন তাহলে অনেক উপকার হয়। অনর্থক আমার জন্যে এখানে কয়েকটা দিন নষ্ট করে গেলেন।”

রবীন্দ্র ও আমি সামনাসামনি বসে কথা বলছিলাম। কিন্তু দু’জনের মধ্যে লোহার রেলিঙের দুস্তর ব্যবধান। দুটো রেলিঙের মধ্য দিয়ে আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। জনৈক পুলিশ অফিসার একটু আেেগ বলে গিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের পর আরও পনেরো মিনিট কেটে গিয়েছে। রবীন্দ্র ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলে।

কলকাতায় ফেরার কয়েকদিন পরেই অর্ধ-উন্মাদ রবীন্দ্রের বাবা চেম্বারে হাজির হলেন। হাতে একটা চামড়ার সুটকেস। স্টেশন থেকে সোজা চেম্বারে চলে এসেছেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, “খবর না দিয়ে হঠাৎ কলকাতায় এলেন, কী ব্যাপার?”

খগেনবাবু কপালে হাত দিয়ে বলেন, “বাড়িতে টিকতে পারলাম না, অসম্ভব!” মিনিটখানেক ফ্যালফ্যাল করে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তিনি তাকিয়ে রইলেন। নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না, কান্নায় ভেঙে পড়লেন। “রবির- মা প্রায়ই ফিট হচ্ছেন। ছেলেটাকে কোনোরকমে প্রাণে রক্ষা করা যায় না? না হয় সারাজীবন জেলেই রাখুক।” কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে-মুছতে তিনি চামড়ার সুটকেসটা টেবিলের উপর তুললেন। পকেট থেকে চাবি বার করে ডালা খুলে এককোণ থেকে জামা-কাপড় সরিয়ে তিনি একটা কাপড়ের পুঁটলি বার করলেন। অতি যত্নে কম্পিত হাতে বাঁধন খুলতেই কয়েকগাছা সোনার চুড়ি বেরিয়ে পড়লো। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওর মায়ের শেষ সম্বল। এইগুলো আমাকে দিয়ে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন, আপনাকে কিছু করতেই হবে।”

আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। কী করতে পারি?

“আপনারা বড়ো ব্যারিস্টার, ইচ্ছে করলেই ছেলেটাকে বাঁচাতে পারেন।” রবীন্দ্রের বাবা আবার কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে লাগলেন।

.

হাইকোর্টে আপীল ফাইল করা হলো। খগেনবাবু কিছুদিনের জন্য কলকাতায় রয়ে গেলেন।

জেল থেকে রবীন্দ্রের চিঠিও পেয়েছি। সেন্সর করা চিঠি। রবীন্দ্র লিখেছে, সে ভালোই আছে। এখন আর চালে কাঁকর নেই, বিছানায় ছারপোকা নেই। একেবারে জামাই-আদর। সে আরও লিখেছে, ভগবান তাকে বিশ্বাস ও বল দিয়েছেন, কোনো কিছুতেই সে ভয় পায় না।

বাংলায় ঠিকানা লেখা আর একটা চিঠি পেলাম। সুধাংশু কর, এডভোকেট, আমার সঙ্গে তখন বসতো। সে আমাকে ইংরেজী করে শোনালো।

—সায়েব,

বড়ো ব্যারিস্টার,

কলকাতা হাইকোর্ট।

আঁকাবাঁকা অক্ষরে রবীন্দ্রের মা লিখেছেন, জজদের যেন আমি তাঁর হয়ে বলি, ছোটোছেলে বুঝতে পারেনি। ভগবানের কাছে আমার মঙ্গলের জন্য দিনরাত প্রার্থনা করছেন।

প্রার্থনা করেও কিছু হলো না। আপীলে আইনের যুক্তি বিশেষ কিছু দেখাতে পারলাম না। তবুও ঘণ্টাখানেক আর্গুমেন্ট করেছিলাম। দু’জন জজ মন দিয়ে আমার বক্তব্য শুনলেন। সরকার পক্ষের উকিলও তাঁর বক্তব্য উপস্থিত করলেন। জজরা রায় দিলেন, এই কেসে লঘুতর শাস্তি দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।

“এখন উপায়?” রবীন্দ্রের বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।

.

হঠাৎ অন্ধকারকে বিদায় করে ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। সায়েব ঘাড় ফেরালেন। দেওয়ান সিং কোনো কাজে বাইরে গিয়েছিল, ফিরে এসেই আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।

“দেওয়ান, আলোটা নিভিয়ে দাও, আজ আর কাজ করবো না। অন্ধকারে বেশ আছি।” সায়েবের কথায় দেওয়ান আলো নিভিয়ে দিলে। ক্ষণিকের আলোয় বিরক্ত হয়ে রাত্রি যেন আরও খানিকটা অন্ধকার মুখ থেকে ফুঁ দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে।

“সরি ফর দিস ইণ্টারপশন।” সায়েব আবার আরম্ভ করলেন।

“শেষপর্যন্ত বড়লাটের কাছেই আবেদন করে দেখবো ভাবলাম। ডিসেম্বর মাস, বড়লাট ওই সময়ে প্রতি বছর কলকাতায় আসেন। খগেনবাবুর হয়ে দীর্ঘ আবেদন লিখলাম। তিনি তাতে সই করলেন। যে পাতাটা আজ আমাকে দেখালে ওটা তারই কপি।

বেলভেডিয়রে বড়লাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঘটনাটা তাঁকে বুঝিয়ে বললাম। আসামীর অতি অল্প বয়স, প্রায় বালক। প্রাণদণ্ড মকুব করে অন্য যে কোনো শাস্তি দিন। মন দিয়ে আমার কথা শুনে তিনি বললেন, আচ্ছা ভেবে দেখি। রাইটার্স বিল্ডিং ও গভর্নরের উপদেশ না নিয়ে আমার পক্ষে তো কিছু করা সম্ভব নয়।”

বললাম, “নিশ্চয়; তবে আসামীর বৃদ্ধ পিতার একমাত্র অনুরোধ ছেলেটির প্রাণরক্ষা করতেই হবে।”

কয়েকদিন পরে আবার খোঁজ নিলাম। সরকার এখনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।

খগেন্দ্র কলিতা রোজ এসে চেম্বারে বসে থাকেন, কখন উত্তর আসে ঠিক নেই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বাড়িতে খবর পাঠাচ্ছেন তো?”

তিনি ঘাড় নাড়লেন, “রোজ একটা করে চিঠি ছাড়ি।”

টেম্পল চেম্বারে খগেন্দ্র কলিতার নামে শেষপর্যন্ত সেই বহুপ্রতীক্ষিত চিঠিটা এল। অন হিজ ম্যাজেস্টিস সার্ভিস মার্কা খামে আষ্টেপৃষ্ঠে লাল শীলমোহর। খগেনবাবু তখনও চেম্বার আসেননি। ওঁরই নামে চিঠি বলে নিজেও খুলতে পারলাম না। অস্থিরভাবে চেয়ার ছেড়ে পায়চারি করছি, কখন তিনি আসবেন। অন্যদিন দশটার মধ্যেই খোঁজ নিতে আসেন, অথচ সাড়ে দশটা হয়ে গেল আজ।

ভাবতে-ভাবতেই তিনি এসে গেলেন। মোটা খামটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। হাত পা কাঁপছে তাঁর। প্রথম চেষ্টায় খামটা ছিঁড়তেই পারলেন না, শরীরের সকল শক্তি যেন উবে গিয়েছে। দ্বিতীয় চেষ্টায় চিঠিটা খাম থেকে বার হলো। তাঁর কোটরে ঢোকা স্তিমিত চোখ দুটো উত্তেজনায় যেন বেরিয়ে আসছে! কী লিখেছে?

ব্যর্থ। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ। বড়লাট এই কেসে হস্তক্ষেপ করতে অনিচ্ছুক। খগেনবাবু চিঠিটা পড়লেন। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে বারবার পড়লেন। চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে ঝাপসা চোখে বোবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমি কথা বলতে পারলাম না। তিনি বেরিয়ে গেলেন। এগারোটার সময় কোর্টে কেস্ ছিল, আমাকেও বেরিয়ে যেতে হলো।

এর কিছুদিন পরেই রবীন্দ্র কলিতার প্রাণদণ্ডাজ্ঞা কার্যকরী হয়, খবর পেয়েছিলাম।

ফাঁসির আগে সে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল—মরতে সে একটুও ভয় পাবে না। সম্ভব হলে আমি যেন মাঝে-মাঝে তার বাবা-মা’র খবর নিই। আর ছোটোভাইটার জন্য যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারি তো খুব ভালো হয়।

.

সায়েব চুপ করলেন। ছেঁড়া কাগজটা টেবিলে পড়ে রয়েছে।

সায়েবকে আমি জানি। রবীন্দ্রের শেষ অনুরোধ রক্ষার জন্য তিনি নিশ্চয় কিছু করেছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “রবীন্দ্রের ভাই-এর কী হলো?”

অন্ধকারে তাঁর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। ঘাড়টা বেঁকিয়ে নিরাসক্তভাবে তিনি বললেন, “ওদের সংসারই অভিশপ্ত, আমি কী করবো? কলকাতায় নিয়ে এসে তাকে বহু কষ্টে মানুষ করলাম। ভাবলাম বাবা ও মায়ের দুর্গতি বুঝি এবার ঘুচলো। কিন্তু হলো না। প্রথমবারে ছিল রাজরোষ, আর দ্বিতীয়বারে রাজরোগ। যক্ষ্মায় মারা গেল।”

এবার আলো জ্বালিয়ে দিলাম। মনে হলো আধ-ছেঁড়া কাগজটা টেবিলে শুয়ে আমাদের দু’জনের দিকে যেন ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে আছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন