শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
বেশ লম্বা ছুটি। দু’মাসের কিছু বেশি। পুজোর আগেই হাইকোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে। হঠাৎ যেন যাদুকরের মন্ত্রে ঘুমিয়ে পড়বে ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীট। রাস্তায় একজন লোকও দেখা যাবে না। চায়ের দোকানগুলোও মাসখানেকের জন্য ঝাঁপ বন্ধ করে দেবে। টেম্পল চেম্বারের একতলার পানওয়ালাও দোকান বন্ধ করে তার লালরঙের টিনের স্যুটকেসে বউ-এর শাড়ি, ছেলের ইজের ও জামা, একটা গন্ধ তেল ও চিত্রতারকাদের প্রিয় সৌন্দর্যসাবান বোঝাই করবে। তারপর সোজা চলে ষাবে হাওড়া স্টেশন। ঝিমিয়ে পড়বে টেম্পল চেম্বার। একজন বাদে লিফটম্যানরা ছুটি পেয়ে যাবে। হাইকোর্টেও দু’জন বাদে অন্য জজদের ছুটি। তাঁরাও ছুটবেন দূরদূরান্তে নতুন বায়ু সেবনের লোভে। যে দু’জন জজ কলকাতায় পড়ে থাকেন, তাঁদের নাম ভেকেশন জজ। কলকাতার দুর্গাপূজা দেখেই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। জরুরী কেসগুলোর বিচারের দায়িত্ব তাঁদের। জরুরী না হলে কিন্তু তাঁরা কেস ধরবেন না। কেউ এসে বলবে, ধর্মাবতার অমুক বাড়িটা আমার অমুক আত্মীয় বেআইনিভাবে ভাঙতে আরম্ভ করেছে, কিন্তু আসলে বাড়িটা ওর একার নয়। জজ- সায়েব বললেন, “ঠিক আছে। হাইকোর্ট খুললে দু’পক্ষের মতামত শোনা যাবে। এখন বাড়ি ভাঙা বন্ধ থাক। ইনজাংশন দিলাম।”
ছুটির আগে বেজায় কাজ সবার। বাবুরা দিনরাত ছুটোছুটি করছেন। সায়েবরা এটর্নির বিল পাঠিয়েছেন, সেসব আদায় করতে হচ্ছে। সারাবছরের হিসাব চুকিয়ে দেওয়া হয় এই সময়। এটর্নি আপিসে সন্ধ্যার পরও কাজ হচ্ছে। টাইপিস্টরা রাত আটটা পর্যন্ত বিল তৈরী করছে, ক্লায়েন্টদের কাছে তাড়াতাড়ি বিল পাঠাতে হবে। নাকে চশমা লাগিয়ে বিলবাবু বিলে টিক্ দিয়ে যাচ্ছেন। এ ক’দিন আপিসের খরচায় চারখানা কচুরী, এক আনার আলুর দম ও একটা দানাদার বরাদ্দ। তাছাড়া চা তো আছেই। এটর্নি আপিসে বিলবাবুর খাতির সবচেয়ে বেশি। আপিসের কাজকর্মের নাড়ীনক্ষত্র তাঁর জানা। কানে কলম গুঁজে টুলের উপর অনেক সময় উবু হয়ে বসে তিনি বিড়ি ধরান। টাইপিস্ট চক্রবর্তীকে ডেকে বললেন, “চক্কোতি, কাজে যে বড্ডো আঠা দেখছি। একটা বিড়ি খেয়ে নাও।” চক্রবর্তী বলে, “এই যে দাদা, অরিজিনেটিং সামনটা আজকে এনগ্রোস করে রাখতেই হবে। কাল সকালে ফাইল হবে। তা বারো আনা মেরে দিয়েছি। আচ্ছা থাক, বাকি চার আনা একটু জিরেন দিয়েই করা যাবে।” পকেট থেকে পুরোনো টাইপরাইটার রিবনের একটা কৌটা থেকে চক্কোত্তি বিড়ি বার করে ধরায়। তারপর চেয়ারটা একটু বিলবাবুর দিকে বেঁকিয়ে নিয়ে বলে, “কি রকম হালচাল বুঝছেন দাদা?” ঠোঁট দুমড়ে হতাশার ভাব প্রকাশ করে বিলবাবু বললেন, “আর ভায়া, এবারে মাত্র পনেরো হাজার টাকার বিল। গতবার কুড়ি হাজার হয়েছিল। তার আগের বারে বাইশ হাজার।”
চক্কোত্তি বললে, “জেনারেল মার্কেটই খারাপ দাদা। খেতে পেলে তবে তো লোকে কেস করবে।”
বিলবাবু রাজকেষ্ট হাজরা একমত হলেন না। একটু রেগেই বললেন, “কচু জানো তুমি। এ শালা এমন জিনিস যে খেতে না পেলেও লোকে কেস্ করবে। দশ নম্বরের এ. পি. বাসু কোম্পানি এবার কত বিল করেছে জানো? একলাখ পঁচিশ হাজার।”
“এক লা-আ-খ-পঁ-অ-চিশ হাজার .!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের মত চুনোপুঁটি নিয়ে ওরা কারবার করে না। বড়ো বড়ো রাজামহারাজা মারোয়ারী ওদের ক্লায়েন্ট।”
“কেন আমাদের তো সোহনলালজী রয়েছেন, দুটো তেলকলের মালিক।” চক্কোত্তি নিজের আপিসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য বেশ উদ্গ্রীব হয়েই বললো।
“ওদের রামদাস হরিরাম তোমার দশটা সোহনলালকে কিনে রাখতে পারে। সোহনলাল একটা পার্টি নাকি, প্রতিবার বিল কমাবার জন্য লেখে। আর ওদের পাটকল, চিনিকলের মালিকরা বিল কখনো উল্টিয়ে দেখে না। সঙ্গে সঙ্গে চেক পাঠিয়ে দেয়।”
“বলেন কি?”
চক্রবর্তীর কথায় বোধহয় সামান্য অবিশ্বাসের ভঙ্গি মেশানো ছিল। কেননা, ‘রাজকেষ্টবাবু বেশ রাগতস্বরে বললেন, “বাপু, এসব পরের মুখে ঝাল খাওয়া নয়। আমার ভায়রাভাই ছেনো সামন্ত ওখানকার কোর্ট-ক্লার্ক।”
এবার অবিশ্বাসের আর কিছু রইলো না। চক্রবর্তী বললে, “সে সব যাক দাদা, এবার বোনাসের হাওয়া কি রকম বুঝছেন? আর ক’টা দিনই বা আছে।”
বোনাসের খবরে, অন্য যারা এতোক্ষণ কাজ করছিল তারাও কাজ বন্ধ করে রাজকেষ্টর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। রাজকেষ্টবাবু বললেন, “এবার কিন্তু একমাসের হচ্ছে না। বড়ো, মেজো ও ছোটকর্তার মধ্যে আলোচনা হচ্ছিলো সেদিন। ছোটবাবু বললেন ঢালা পঁচিশ টাকা করে প্রত্যেককে দেওয়া হবে। একমাসের দেওয়া হবে না। বড়োকর্তা তবু একবার বলেছিলেন, অন্তত তিন সপ্তাহের মাইনে দাও। তা ছোটো ও মেজকর্তা কেউ রাজী হলেন না।”
সকলের মুখে যেন কালি ছিটিয়ে দিয়ে গেল। কোর্ট-ক্লার্ক হরিসত্য একটি অশ্লীল গালি দিয়ে বললে, “শালা পঁচিশ টাকায় মাগের একটা শাড়িও হবে না যে। বড়োকর্তার তবু প্রাণটা ভালো কিন্তু ওই কেমন মিনমিনে স্বভাব, ছোটোভাইদের কথার উপর কথা বলবে না।”
রাজকেষ্টবাবু এবার একটু মালিকের পক্ষ ঝুঁকে কথা বললেন। “আরে বাপু দেবেই বা কী করে? শুনতে পনেরো হাজার টাকার বিল্। ওর মধ্যে এগারো হাজার তো, ‘আউট অফ পকেট’ খরচা। দশ হাজার তো ব্যারিস্টারের পেটে চলে যাবে।”
রাজকেষ্টবাবু এবার একটু জোর দিয়ে বললেন, “অশোক দাশগুপ্ত তো অলরেডি ছ’হাজার টাকার বিল্ পাঠিয়েছে। ওখানে তো এক পয়সা কমানো যাবে না। ওঁর বাবুরই বা কি তেজ়! একমিনিট দেরি হলেই বলবেন, “আমার সময় নষ্ট হচ্ছে। অন্য কাজ আছে।”
সকলের রাগটা শেষপর্যন্ত ব্যারিস্টারের উপর গিয়ে পড়লো। এরার বোনাস না পাবার জন্য যেন ব্যারিস্টাররাই দায়ী।
এদিকে বাবুদের বেঞ্চিতেও জোর আলোচনা চলছে। দু-একজন বাবু গালিগালাজে এটর্নির আদ্যশ্রাদ্ধ করছেন—টাকা আদায় করা ঝকমারি কাজ। তাগাদা দিয়ে জুতোর হাফসোল ক্ষয়ে গেল অথচ টাকা আদায়ের নাম নেই। একজন বললে, সামনে পুজো, অথচ একটা পয়সা তহুরী পাচ্ছি না। ছ’নম্বরে মিত্তিরের কাছে অনেকগুলো টাকা পাওয়ার কথা ছিল। ব্যাটা এখন বলে, “দাঁড়ান মশায় আপনার সায়েবের বিল্ মেটাই আগে। আপনারটা বড়োদিনের সময় দেওয়া যাবে।”
তারপর আলোচনা আরম্ভ হলো, আগামী ছুটিতে কে কোথায় যাবে। হারুবাবু বললেন, “আমার সায়েব এবার শিলং যাচ্ছেন!” অর্জুনবাবু বললেন, “আমার সায়েব আরও দূরে, মুসৌরী।” ভবানীবাবু বললেন, “আমার সায়েব আরও দূরে কাশ্মীর যাচ্ছেন।”
কিন্তু সবাইকে হারিয়ে দিলেন অশোক দাশগুপ্তের বাবু। “আমার সায়েব এবার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছেন। বছরকয়েক যাওয়া হয়নি। ছুটি হবার আগের দিন বোম্বাই চলে যাচ্ছেন। ওখান থেকে জাহাজ ধরবেন। অবশ্য ফিরবেন উড়োজাহাজে।” অশোক দাশগুপ্তের শ্বশুরবাড়ি যে বিলেত সবাই জানে। অর্জুনবাবু আর লোভ সামলাতে পারলেন না। বললেন, “তা তোমার সায়েব মাইরি দেখে দেখে ভালো জায়গায় শ্বশুরবাড়ি করেছেন। বিলেতের মতো জায়গায় শ্বশুরের ঘাড়ে থাকবেন।”
বাগচী সায়েবেরও শ্বশুরবাড়ি বিলেতে। তাঁর বাবু সুনীল বললে, “না হে না, বিলিতী শ্বশুররা জামাইদের বিশেষ খাতির করে না। এই তো আমার সায়েবের শাশুড়ী প্রায়ই চিঠি লেখে, কিন্তু কখনও জামাই-ষষ্ঠীতে নেমন্তন্ন করেছে?”
হাহা করে হেসে উঠলো সবাই। তারপর একজন জিজ্ঞাসা করলে “আমাদের সায়েবরা তো হিল্লী-দিল্লী যাচ্ছে, কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
অর্জুনবাবু বললেন, “আমি যাচ্ছি ডোমজুড়ে। অনেকদিন দেশে ঘরে যাওয়া হয়নি। তা হারু কোথায় যাবে? তুমি তো হাজরা সায়েবের কাছ থেকে একমাসের বোনাস বাগিয়েছো।”
হারুবাবু একটু সঙ্কুচিত হয়ে বললেন, “জিজ্ঞাসা করে লজ্জা দিচ্ছো কেন, সবই তো জানো। আমার ওয়াইফ যে কোনো মোমেন্টে চাইল্ড এক্সপেক্ট করছে। আর ভাই, তা ছাড়া যা দেনা বাঁধিয়ে রেখেছি। তার উপর ক’টা মাস এক পয়সা তহুরী মিলবে না।”
ছোকাদা এতোক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। একটু কাব্য করে বললেন, “মহাকালের মাপকাঠিতে এই আড়াই মাস তো বিন্দুমাত্র। আমি কোথাও যাবো না। কাসুন্দেতেই পড়ে থাকবো, আর পাড়ার রামকেষ্ট আশ্রমের দুগ্গাপুজো দেখবো। যাক, অনেকদিন পরে আবার সব দেখা হবে। কেউ কারুর অপরাধ নিও না। সব ভুলে খোলা মনে চলে চলো।”
সায়েব যাচ্ছেন রাণীক্ষেত। প্রতিবার ছুটির সময় তিনি রাণীক্ষেত যাবেনই। হিমালয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই শৈলাবাসে তাঁর একটা বাংলো আছে। রাণীক্ষেতের অজস্র গল্প শুনেছি তাঁর মুখে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুইজারল্যাণ্ডকে নাকি হার মানায়
তাই হঠাৎ যখন সায়েব বললেন, চলো রাণীক্ষেত দেখে আসবে, তখন আনন্দে কথাটা বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সায়েব বললেন, “পুরো ছুটি না থাকো, অন্তত কয়েক সপ্তাহ সেখানে কাটিয়ে আসবে। আমারও সুবিধা হবে। তুমি থাকলে কিছু কাজ করতে পারবো।”
.
সে-এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। লক্ষ্ণৌ থেকে প্রায় আড়াইশ’ মাইল দূরে কাঠগুদাম। সেখান থেকে হিমালয় শুরু। তারপর পার্বত্য পথে, দেওদার ও পাইন বনের পাশ কাটিয়ে, পাহাড়ী নদীর বুকের উপর তৈরী পোল পেরিয়ে, কখনো চড়াই, কখনো উতরাই-এর বাহান্ন মাইল পথ। আমার জীবনের সে-এক স্মরণীয় অধ্যায়।
বাড়ির নামটিও সুন্দর—ফেয়ারল্যাণ্ডস। চারিদিকে বন্য পাইন ও দেওদারের সমারোহ। বাগানে বিচিত্র বর্ণের অজস্র ফুলের মেলা বসেছে। নয়নাভিরাম পার্বত্য পথ। ভোরে গাছের ডালে এক ঝাঁক পাখীর কলতান। দূরে চিরতুষারাবৃতা নগাধিরাণী নন্দাদেবী। চারিপাশের ধূসর পর্বতশ্রেণী যেন নন্দাদেবীর অনুগত প্রজাবৃন্দ। তারাও শীঘ্র তুষারের মুকুট পরবে।
সায়েব বলেছিলেন, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। মিলিটারীতে থাকতেই প্রথম এখানে এসেছিলাম। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম। কেমন এক নাড়ীর টান অনুভব করেছিলাম। যেন কতবার এখানে এসেছি। তারপর এই দীর্ঘ ত্রিশবছরে প্রায় প্রতিবার এসেছি এখানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ একমনে দেখেছি। হিমালয়কে। কখনও শিশুর মতো শূন্য মনে দেখেছি, কখনও দার্শনিকের নিবিষ্ট চিত্তে। কিন্তু তবু ভরিলো না চিত্ত। আজও আমার তৃপ্তি হয়নি।”
একমাস কাটিয়েছিলাম রাণীক্ষেতে। যা দেখেছিলাম, তার প্রকৃত বর্ণনা দিতে গেলে আর একখানা বই লিখতে হয়।
একমাস পরে যখন ফিরে এলাম তখন শুধু প্রকৃতিকেই দেখিনি, অন্তত একটি মানুষকে— একটি বিচিত্র স্ত্রীলোককে দেখে এসেছি। কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। মর্তের স্বর্গে গিয়েও সায়েব আইনের কাজ করেছিলেন। সেই সুযোগে আমিও কিছু-কিছু টাইপ করেছিলাম।
মহিলাটির নাম মিস্ ট্রাইটন। যে কাহিনী বলবো তাতে আইনের স্পর্শ অতি সামান্য। তবু ট্রাইটনকে আমি যে ভাবে দেখেছি ও তাঁর সম্বন্ধে যা শুনেছি তা বলবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।
রাণীক্ষেতে থাকবার দিন কয়েক পরেই একদিন বিকেলে দেখি বাগানে ছড়ি হাতে সায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে বললেন, “আজ একটু দূরে বেড়াতে যাবো। তুমিও চলো, মিস্ ট্রাইটনকে দেখে আসবে। অন্যবার এখানে এসেই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই।”
আমরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে-হাঁটতে সায়েব বললেন, “মিস্ হলেও ফ্যানি ট্রাইটনকে যুবতী ভেবো না। তাঁর বয়স সত্তরের কাছাকাছি।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “উনি কি এখানেই সারাবছর থাকেন?”
সায়েব বললেন, “হ্যাঁ, ওঁর নিজের একটা ছোট্ট বাড়ি আছে, সেখানেই সারাবছর পড়ে থাকেন। শীতকালে যখন চারিদিকে বরফ পড়ে, এখানে প্রায় কেউ থাকে না। স্থানীয় লোকেরা পর্যন্ত নিচে নেমে যায়। কিন্তু মিস্ ট্রাইটন কোথাও যায় না। এখানকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন।”
এতোক্ষণ আমরা উপরের দিকে উঠছিলাম। পাহাড়ী পথচলায় আমি অনভ্যস্ত, এইটুকুতেই বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। সায়েবের তখনও ক্লান্তি আসেনি। আমার অবস্থা দেখে বললেন, “চলো একটু বসা যাক। রাস্তার মাঝে-মাঝে ওই জন্য বেঞ্চি বসানো আছে।” .
আমি অসম্মতি জানালাম। বললাম, “আরও খানিকটা যেতে পারবো।”
এবার পথটা ঢালু। গড়গড় করে রাস্তা ধরে নেমে যাচ্ছি আমরা। মিস্ ট্রাইটনের কথা উঠলো আবার। সায়েব বললেন, “সখ করে কেউ এই জনহীন দেশে শীতকালে পড়ে থাকো। বেচারার জামাকাপড়ের দিকেই চাওয়া যায় না। শতচ্ছিন্ন অবস্থা।”
মিনিট কুড়ি হাঁটবার পর সায়েব এক জায়গায় থামতে বললেন। প্রধান রাস্তা থেকে বেরিয়ে একটা সরু এবড়েখেবড়ো পথ বনের মধ্যে মিশে গিয়েছে। এই পথ ধরে যেতে হবে। আমরা প্রায় এসে গিয়েছি। কিন্তু সাবধান, পথটা পিছল হয়ে আছে।”
একটু হাঁটতেই পাইনবনের ফাঁক দিয়ে একটা বাড়ি দেখা গেল। ছোট্ট বাড়ি, সংস্কারের অভাবে জীর্ণ অবস্থা। কিন্তু বেশ পরিষ্কার। আর চারিদিকে ফুলের বাগান। সেই বাগানের মধ্যে আরামকেদারায় এক বৃদ্ধা বসে আছেন। একমনে তাকিয়ে আছেন দূরে ত্রিশূল পর্বতের দিকে। ইঙ্গিতে সায়েব পা টিপে-টিপে চলতে বললেন। সন্তর্পণে আমরা তাঁর পিছনে এসে দাঁড়ালাম। তাঁর মাথায় সিল্কের রুমালের মতো কী একটা বাঁধা। সূর্য তখনও অস্ত যায় নি। মিস্ ট্রাইটন প্রকৃতির শোভার মধ্যে ডুবে রয়েছেন। মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে থাকার পরও আমাদের উপস্থিতি তিনি টের পেলেন না।
সায়েব এবার সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “গুড আফটারনুন মিস্ ট্রাইটন। কেমন আছেন? অনেকদিন পরে আবার দেখা।”
মিস্ ট্রাইটন প্রথমে চমকে উঠলেন। কিন্তু সায়েবকে দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে চাকরকে ডাকতে লাগলেন, “একবাল সিং দুটো চেয়ার নিয়ে এসো।” তারপর একগাল হেসে বললেন, “কী সৌভাগ্য আমার কর্ণেল। একবালের কাছেই শুনলাম আপনি রাণীক্ষেতে এসেছেন। খবর ভালো তো?”
সায়েব চেয়ারে বসে পড়লেন। বললেন, “মন্দ চলছে না। তবে বয়স তো কম হলো না। সুতরাং চোখের দৃষ্টি পাল্টাতে আরম্ভ করেছে। পৃথিবীটাও আমার সঙ্গে বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাই সব কিছুতেই আর আনন্দ পাই না।”
“কী যে বলেন কর্নেল” যুবতী মেয়ের মতো সলজ্জ হাসিতে মুখ ভরিয়ে মিস্ ট্রাইটন বললেন। “এই বয়সে আপনার মতো হাসিখুশি লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।” মিস্ ট্রাইটন মাথার রুমালটা ঠিক করে নিলেন।
আরাম কেদারা থেকে উঠে দাঁড়ালেন মিস্ ট্রাইটন। বললেন, “একটু পায়চারি করা যাক্।”
এবার ভালো করে দেখতে পেলাম তাঁকে। দীর্ঘ দেহ বয়সের ভারে সামান্য বেঁকে গিয়েছে। শরীরের জলুস চলে গেলেও সহজে বোঝা যায়, বয়সকালে তিনি সুন্দরী ছিলেন। দেহের গঠন, মুখের শ্রী ও চামড়ার রঙ থেকে বিগত দিনের সুন্দরী- শ্রেষ্ঠা মিস্ ট্রাইটনকে কল্পনা করতে কষ্ট হয় না। তাঁর চোখের চাহনিতে কিন্তু আজও মাদকতা আছে।
বেড়াতে বেড়াতে মিস্ ট্রাইটন জিজ্ঞাসা করলেন আমরা চা খাবো কি না। আমরা বললাম, এইমাত্র খেয়ে এসেছি।
তারপর উঠলো ছবির কথা। মিস্ ট্রাইটন বললেন, “কর্ণেল অনেকেগুলো নতুন ছবি এঁকেছি। একেবারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে আঁকা।”
আমার দিকে ফিরে সায়েব বললেন, “তোমাকে বলা হয়নি, মিস্ ট্রাইটন একজন প্রতিভাবান শিল্পী। সুন্দর ছবি আঁকেন।”
আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন মিস্ ট্রাইটন। তারপর তাঁর আঁকা ছবি দেখাতে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন।
একটা ঘরের মধ্যে প্রায় শ’খানেক ছবি। কিন্তু ছবি দেখে আমি একেবারে হতাশ হলাম, অতি সাধারণ, সস্তা ধরণের ছবি। প্রতিটির বিষয়বস্তু প্রায় এক। চাঁদনীরাতে নদীর বুকে পালতোলা নৌকা; কিংবা পাহাড়ের পিছনে সূর্যাস্ত। সায়েব ছবিগুলোর খুব প্রশংসা করলেন। একটা ছবি আমাকে দেখিয়ে বললেন, “কি অদ্ভুত রঙের খেলা দেখছো!” আমিও বললাম, “সত্যি অপূর্ব।” আর একখানা ছবির কাছে মিস্ ট্রাইটন আমাদের নিয়ে গেলেন। “এ-ছবিটা আপনার কেমন লাগছে, কর্নেল?” সায়েব বললেন, “সুন্দর ছবি হয়েছে। নেচারের এমন মাইনিউট স্টাডি অনেকদিন দেখিনি।” মিস্ ট্রাইটন বললেন, “গত ডিসেম্বরে একদিন ভোরে পাহাড় দেখছিলাম। হঠাৎ আঁকার অনুপ্রেরণা পেলাম। প্রকৃতিকে যেন নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম সেদিন। মনের সেই ভাবটাই এই ছবিটিতে ফুটিয়েছি।”
সায়েব ছবিটির দিকে আর একবার তাকিয়ে অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন, “মিস্ ট্রাইটন, এই ছবিটি আমার চাই। কত দাম হবে বলুন।”
“কর্নেল, বাইরের লোকের কাছে আমি তো ছবি বিক্রি করতে চাই না। তবে আপনি পরিচিত বন্ধু, কুড়িটা টাকা দেবেন।”
সায়েব বললেন, “না-না, আপনি দর কমিয়ে বলছেন। অন্তত, পঁচিশ টাকা দাম এ ছবির।” পকেট থেকে পঁচিশটা টাকা বার করে তার হাতে দিলেন সায়েব। পুরনো স্টেটসম্যান কাগজে ছবিটা মুড়ে সায়েবের হাতে দিয়ে মিস্ ট্রাইটন বললেন, “অসংখ্য ধন্যবাদ, কর্নেল। এই টাকা না পেলে এবার দুধের বিল্টা যে কিভাবে দিতাম জানি না।”
আমরা আবার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তাঁর ফুলগাছগুলো আমাদের দেখালেন। বাগান দেখতে দেখতে অনেক কথা হলো দু’জনে। বেশ স্ফূর্তিতে রয়েছেন মিস্ ট্রাইটন। মাঝে-মাঝে যুবতীসুলভ লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তিনি। তারপর হাসছেন, হাসির কথা বলছেন। এদিকে সূর্য প্রায় ডুবু-ডুবু। পাহাড়ের পিছন থেকে অস্তমিত সূর্যের বিগতপ্রায় রশ্মি সমস্ত আকাশকে রাঙিয়ে তুলেছে। কেমন যেন উদাস হয়ে গেলেন ট্রাইটন। একটু মনমরা হয়ে পড়েছেন যেন।
সে-দিনের মতো বিদায় নিয়ে পাইনবনের মধ্যে দিয়ে আমরা আবার বড়ো রাস্তায় হাজির হলাম। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “ছবিটা আপনার ভালো লাগলো কেমন করে?”
সায়েব হাসলেন। বললেন, “টাকাটা কোনোরকমে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য ছিল। বেচারার কি অবস্থা দেখলে তো। এখানে যে-সব ইংরেজ বেড়াতে আসে তাদের অনেকের কাছেই উনি ছবি বেচেন। আমিও অনেকবার কিনেছি। মিস্ ট্রাইটনের সমাজ নেই, সংসার নেই, আত্মীয়-স্বজনও আছে মনে হয় না। এখানকার ক্লাবেরও মেম্বার হতে পারেন না, অনেক চাঁদা।”
বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু একেবারে নির্জন পথ। অনেকটা হেঁটেছি। বেশ শ্রান্তি অনুভব করছিলাম। হাঁটতে- হাঁটতে সায়েব বলে যাচ্ছেন, “এই বয়সে বুড়ী রোজ মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়ায়। কোনদিন হয়তো রাস্তাতেই মরে পড়ে থাকবে। বাড়িতেও কেউ দেখবার নেই। একটা বেয়ারা ও একটা খানসামা আছে। কিন্তু তাদের অবস্থাও মনিবের মতো। অতি সামান্য মাইনে। এই দুর্মূল্যের বাজারেও উনিশ শ’ চোদ্দ সালের হারে মাইনে পায় তারা। কিন্তু বুড়ীর প্রতি তাদের এমন মমতা যে, চাকরি ছাড়তে পারে না। ওরা বলে, আমরা না থাকলে বুড়ীর কষ্ট হবে। কিন্তু মিস্ ট্রাইটন তাদের মোটেই বিশ্বাস করেন না। লোক পেলেই বলেন, “আমাকে বোকা পেয়ে ওরা চারিদিক থেকে চুরি করছে। দোকানবাজার অথচ উনি নিজেই করেন। যতোদূর জানি চাকররা শুধু সপ্তাহে একবার কেরোসিন তেল কিনে আনে।”
বেচারা মিস্ ট্রাইটনের জন্য আমারও বেশ দুঃখ হচ্ছিলো। নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার জীবনের বেদনা মনে-প্রাণে অনুভব করবার চেষ্টা করেছি।
দু’-একদিন তার সঙ্গে পথে দেখা হয়েছে। মাথায় স্ট্র হ্যাট চাপিয়ে ও হাতে একটা লাঠি নিয়ে চলেছেন। বাজারে তাঁকে দেখেছি। তিন মাইল পথ হেঁটে তিনি রোজ বাজারে যান। আলু থেকে ঢেঁড়শ পর্যন্ত সব কিছু দরাদরি করেন। দোকানদাররা অস্থির হয়ে পড়ে। কলকাতার গঙ্গাস্নান ফেরত বুড়ীদের মত ফাউ না পাওয়া পর্যন্ত মিস্ ট্রাইটন তাদের নিষ্কৃতি দেন না।
আমাদের বেয়ারা ত্রিলোচন সিং-এর কাছে শুনেছি মিস্ ট্রাইটনকে নিয়ে স্থানীয় লোকদের নানা, গল্প হয়। কেউ বলে বুড়ী ইংরেজ নয়, ফিরিঙ্গী। কেউ বলে, না বুড়ী আসল মেম, কিন্তু এখানে গুপ্তচরের কাজ করে। ত্রিলোচন সিং চোখ পাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলে, “বাবু, বুড়ী মেমসায়েব একটা ডাইনী। যে কোনো লোককে ছাগল করে দিতে পারে। বুড়ী মন্তর দিয়ে একবাল সিংকে বশ করে রেখেছে। ও মাইনে না পেলেও চাকরি ছেড়ে যেতে পারবে না।”
ত্রিলোচন আরও বলেছিল, বুড়ী ভয়ঙ্কর খিটখিটে। আর ছোটোছেলেদের মোটেই দেখতে পারে না। ছেলেরা নাকি নোংরা আর ভয়ানক গোলমাল করে। কয়েকদিন পরে লাঞ্চে মিস্ ট্রাইটনকে সায়েবের স্ত্রী নিমন্ত্রণ করে পাঠিয়েছিলেন। একটার সময় তার আসবার কথা। কিন্তু তিনি. আসেননি। দেখা গেল পরিবর্তে চাকরকে পাঠিয়েছেন। লিখেছেন তাঁর শরীর খুব খারাপ, হেঁটে আসতে পারবেন না। কিন্তু ডাণ্ডীতে আসবার উপায় নেই, ডাণ্ডীওয়ালা দু’টাকা চাইছে। সায়েব চিঠি লিখে দিলেন—”আমরা এখানকার একটা ডাণ্ডি পাঠাচ্ছি। আসতেই হবে।” দু’টাকা দিয়েই ডাণ্ডি ভাড়া করে ত্রিলোচন সিং নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে মিস্ ট্রাইটনকে আনতে চললো।
আধঘন্টার মধ্যে তিনি এলেন। চকচকে ফুল-লতাপাতাওয়ালা জামা পরেছেন। খাওয়ার সময় তিনি অনেক কথা বললেন। হোমের আলোচনাই বেশি হলো। হোমের ডিমের র্যাশন উঠলো কিনা, অমুক পার্কে নিয়ন আলোর বিজ্ঞাপন কেন দেওয়া হলো; সে নিয়ে মিস্ ট্রাইটনের চিন্তার অন্ত নেই।
লাঞ্চে সেদিন আরও একজন ভদ্রমহিলা উপস্থিত ছিলেন। তিনি জনৈক মিশনারীর স্ত্রী, নতুন ইংলন্ড থেকে এসেছেন। আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন “যাই বলেন এদেশের কালী ঠাকুরের মূর্তি দেখলে ভয় লাগে। একটি বীভৎস সৃষ্টি।”
মিশনারীর স্ত্রীকে কালী মাহাত্ম্য বোঝানোর চেষ্টা বাতুলতা জেনেই আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম মিস্ ট্রাইটনের মুখ কালো হয়ে উঠেছে। মনে হলো যেন তিনি ভয় পেয়েছেন। তাঁর হাতের কাঁটা ও ছুরি যেন কাঁপছে। কোনো রকমে বললেন, “এ সব আলোচনা আমি মোটেই পছন্দ করি না। আমি খ্রীস্টান। কিন্তু আপনি জানেন না, দীজ ইন্ডিয়ান গডেসেস কেন বি ডেঞ্জারাস।”
মিশনারীর স্ত্রী বোধহয় অপমানিত বোধ করলেন। বললেন, “আপনার কথা তো বুঝতে পারলাম না।”
রেগে উঠলেন মিস্ ট্রাইটন। ন্যাপকিনে মুখ মুছতে-মুছতে বললেন, “আমি আর বোঝাতে পারবো না।” তাঁর মুখ তখনও বিবর্ণ হয়ে রয়েছে।
তাড়াতাড়ি অন্য প্রসঙ্গ তুলে সায়েব আলোচনার মোড় ফিরিয়ে দিলেন। ক্লাইমেট নিয়ে কথা আরম্ভ হলো। আলোচনা কিন্তু জমলো না। মিশনারীর স্ত্রী কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলেন। মিস্ ট্রাইটনও আর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারলেন না।
এরপর মাত্র দু’দিন মিস্ ট্রাইটনকে বাজারে দেখেছিলাম। তারপর আর দেখা হচ্ছিলো না। মেমসায়েবের মুখে শুনলাম তাঁর অসুখ।
মেমসায়েব ও মিস্ ট্রাইটনের মধ্যে খুব ভাব। দু’জনের প্রকৃতিতে কিন্তু বিরাট পার্থক্য। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার প্রতি সায়েবের স্ত্রীর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। ভারতের অধ্যাত্মজীবনকে তিনি শুধু শ্রদ্ধা করেন না, মনপ্রাণ দিয়ে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করেন। মিস্ ট্রাইটন এসব মোটেই পছন্দ করেন না। তবু দু’জনের মধ্যে যথেষ্ট প্রীতি গড়ে উঠেছে। মিস্ ট্রাইটনের বাড়ি মেমসায়েবকে রোজ যেতে হয়। একটু দেরি হলে মিস্ ট্রাইটন বেয়ারা পাঠিয়ে খবর নেবেন।
ইদানিং মিস্ ট্রাইটন আর হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন না। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকেন। শুধু বিকেলে বাগানে আরাম কেদারায় বেয়ারারা ধরে এনে বসিয়ে দেয়।
.
বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। শরৎকালে এই পাহাড়ে মাঝে-মাঝে একদল মেঘ যেন দল ভেঙে পথ হারিয়ে এসে পড়ে। তারপর শুরু হয় বারিবর্ষণ। সে-দিনও তেমনি আচমকা বৃষ্টি নেমেছে। ড্রইংরুমে আমরা দু’জনে চুপচাপ বসে আছি। ঝড়বাদল মাথায় করেই মেমসায়েব মিস্ ট্রাইটনকে দেখতে গিয়েছেন। কাঁচের শার্সি বন্ধ করে আমরা চুপচাপ বসে আছি। একঘেয়ে বৃষ্টিপড়ার টিপ টিপ শব্দ কানে আসছে। কেরোসিনের আলোটা টেবিলে জ্বলছে। সায়েব মাঝে মাঝে কথা বলছিলেন। কিন্তু নীরবতার অংশই বেশি। একবার বিদ্যুৎ চমকালো, ঘরের ভিতরটা মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠলো, একটু শীত-শীত লাগছে।
এমন সময় মনে হলো বাইরে কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। চাকরবাকর কেউ ছিল না। নিজেই দরজা খুলে দিলাম। ছাতা হাতে মিস্ ট্রাইটনের চাকর একবাল সিং দাঁড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টির ছাঁটে জামা-কাপড় ভিজে গিয়েছে। হাতে একটা টর্চ। ভিজে জামার পকেট থেকে একবাল সিং একটা চিঠি বার করে সায়েবের হাতে দিলে। সায়েব পড়লেন। মেমসায়েব লিখেছেন,”মিস্ ট্রাইটনের অসুখ বেড়েছে। একলা থাকতে ভয় পাচ্ছেন, মাঝে মাঝে ভুল বকছেন। সুতরাং মেমসায়েব আজ ওইখানেই থেকে যাবেন, রাত্রে বাড়ি ফিরবেন না। আরও লিখেছেন, বুড়ী উইল করবার জন্য জ্বরের মধ্যে ছটফট করছে। কাল ব্রেকফাস্টের পরই টাইপরাইটার ও কিছু ভালো কাগজ নিয়ে আমরা যেন এখানে আসি! অবশ্য যা অবস্থা বুড়ী ততক্ষণ নাও টিকতে পারে। শেষে মেমসায়েব লিখছেন, “একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি। মনে হয় পৃথিবীতে সবই সম্ভব। কাল সকালে শুনে তুমিও আশ্চর্য হবে।”
সয়েব লিখে দিলেন, কাল সকালেই আমরা যাচ্ছি। একবাল সিং বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেল।
আরও জোরে বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে হাওয়া বইছে প্রবল বেগে। সায়েব বললেন,”মেমসায়েব নতুন খবর কী পেলেন আন্দাজ করতে পারছি না।”
বললাম “আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।”
সায়েব বললেন, “বিচিত্র জীবন এই মিস্ ট্রাইটনের। সেদিন যা শুনলাম তাতেই অবাক হয়েছি। আরও কি রহস্য লুকিয়ে আছে কে জানে।
“কেন উনি এখানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে থাকেন, সেইটাই এক রহস্য”, আমি বললাম।
কেরোসিনের আলোটা তিনি একটু জোর করে দিলেন। তারপর বললেন, “রহস্যই বলতে পারো। তবে যারা কারণ জানে, তাদের কাছে এ-এক বেদনার কাহিনী।”
আমি চুপ করে রইলাম। কৌতূহল বাড়ছে।
“সেদিন লাঞ্চের সময় কালী ঠাকুরের প্রসঙ্গে মিস্ ট্রাইটন কী রকম হয়ে পড়েছিলেন লক্ষ্য করেছিলে?”
“নিশ্চয় করেছিলাম। কালীর প্রতি ওঁর কেমন যেন দুর্বলতা আছে মনে হলো।”
“সে-কাহিনী তোমায় বলবো। এখানে কেউ জানে না। কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে আমার স্ত্রীকে মিস্ ট্রাইটন তাঁর জীবন-কাহিনী বলেছিলেন। আমি তাঁর কাছে শুনেছি।”
বাইরে আবার বিদ্যুৎ চমকালো। সোফাতে জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। শীত আরও বেড়েছে। “বলুন গল্পটা!”
“দাঁড়াও তার আগে দু’কাপ কফির ব্যবস্থা করা যাক। যেরকম ঠান্ডা পড়েছে।” ত্রিলোচন সিংকে ডাক দিয়ে সায়েব কফি আনতে বললেন।
কফি এল। দুধ চিনি মিশিয়ে একচুমুক খেতেই তৃপ্তি পাওয়া গেল। শীতের সঙ্গে কিছুক্ষণ লড়াই করা যাবে। গল্প আরম্ভ হলো।
“ট্রাইটনরা তিন পুরুষ ধরে ভারতবর্ষকে জানেন। মিস্ ট্রাইটনের পিতামহ সিপাহী বিদ্রোহে যুদ্ধ করেছিলেন। মিস ট্রাইটনের বাবা ছিলেন বেঙ্গল পুলিশের বড়ো কর্মচারী।
একমাত্র মেয়েকে মিস্টার ট্রাইটন ভয়ঙ্কর ভালোবাসতেন। বাইরে তিনি ছিলেন দোর্দন্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার, যেমন কর্তব্যপরায়ণ, তেমনি রাগী। কিন্তু মেয়ের কাছে তিনি একেবারে ছোটোছেলেটির মতো।
মিস্টার ট্রাইটনের ছিল শিকারের নেশা। শিকারের নামে তিনি পাগল। তাই সময় পেলেই চলে যেতেন কাঠুরিকোটে। কাঠুরিকোট কুমায়ুন রেঞ্জের ছোট্ট শহর। তার খুব কাছেই ওক ও পাইনের ঘন বন। সেই বনে থাকে কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ। গ্রীষ্মের সময় দলে-দলে ইংরেজ পরিবার এখানে এসে শহরটা ভরিয়ে দেয়।”
সায়ের বলে যাচ্ছিলেন। “মেয়েকে সঙ্গে করে মিস্টার ট্রাইটন সেবারে কাঠুরিকোট এলেন। সেদিনের মিস্ ট্রাইটনকে কল্পনা করো। উদ্ভিন্নযৌবনা রূপবতী ইংরেজ-ললনা। চোখে-মুখে রূপলাবণ্য ও প্রাণচাঞ্চল্য ঝরে পড়ছে। কাঠুরিকোটে এমন সুন্দরী মেয়ে আর দুটি নেই। ফলে, মনে-মনে অনেকেই তাকে ঈর্ষা করে। সবাই জানে ফ্যানি ট্রাইটনের খুব ভাল বর মিলবে। গভর্নরের এ.ডি.সি. ক্যপ্টেন ওয়েন্টওয়ার্থ পাত্র হিসাবে মন্দ নয়। এখন প্রায় রোজই সে ট্রাইটনদের বাড়িতে আসে এবং কয়েকঘন্টা কাটিয়ে যায়। তাদের অনুরাগ যে জমে উঠেছিল সে খবর সবাই জানে। ফ্যানি ট্রাইটন বিকেলের দিকে ওয়েন্টওয়ার্থের জন্য অপেক্ষা করে। দেরি হলে ওয়েন্টওয়ার্থ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে, বলে দুঃখিত, বড্ডো দেরি হয়ে গেল।
ফ্যানি কপট রাগ দেখায়। বলে, “আপনার কত কাজ। এখানে যে এসেছেন সেই আমাদের সৌভাগ্য।”
“ও, রাগ করা হচ্ছে। দাঁড়াও বাবাকে বলছি, আপনার মেয়ে সুযোগ পেলেই আমাকে কড়া-কড়া কথা শোনায়।” ওয়েন্টওয়ার্থ সত্যিই বাবাকে বলে দেবে এমন একটা ভাব দেখায়। হাতটা টেনে ধরে ফ্যানি বলে, “খুব অভিমান হয়েছে। সব কিছু বাবাকে লাগানো চাই। চা খাবে?”
চা আসে। মিস্টার ট্রাইটনও ওদের সঙ্গে মাঝে মাঝে চা খান। তারপর ওদের দু’জনকে একলা রেখে বেড়াতে বেরিয়ে যান।
মাঝে মাঝে অভিমানের পালা চলে। দু’জনে খুব ঝগড়া করে। ওয়েন্টওয়ার্থ দু’-একদিন চা খেতে আসে না। আবার মিটমাট হয়ে যায়। ফ্যানি চিঠি পাঠায়, আসছো না কেন? ওয়েন্টওয়ার্থ তখন আসে, চা খায়, গল্প করে।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় মিস্ ট্রাইটন একলা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। মনটা খারাপ। পরশু থেকে ওয়েন্টওয়ার্থের সঙ্গে অভিমানের পালা চলেছে। এবার কিছুতেই সে চিঠি লিখবে না। দেখা যাক কতদিন পরে সে আসে। সব সময় ছেলেমানুষি ভালো লাগে না। ওয়েন্টি সেদিন ওকে খুকুমণি বলে ডেকেছিল বলেই তো ঝগড়া হলো।
ঘোড়ার খুরের আওয়াজে ফ্যানি মুখ তুলে তাকালো। আবছা অন্ধকারে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কে যেন এগিয়ে আসছে। মাথার টুপিটা কপাল পর্যন্ত নামানো কে, ওয়েন্টি? না সে তো অত লম্বা নয়। আগন্তুকের পরিধানে শিকারীর পোষাক। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঘোড়ার পিঠ থেকে আগন্তুক নেমে পড়লো। চেহারা বটে! একেবারে সোজা। ভারি ভারি পা ফেলে তিনি এগিয়ে এলেন।
বাবাকে ডেকে দিয়ে ফ্যানি সোফায় গিয়ে বসলো। দরজার কাছে গিয়ে মিস্টার ট্রাইটন বলে উঠলেন, “আরে যুবরাজ যে।” যুবরাজ! ফ্যানি ট্রাইটন চমকে উঠলো। দূর থেকে মনে হয়েছিল কোনো ইংরেজ।
টুপি হাতে করে যুবরাজ ভিতরে ঢুকলেন। “আগামীকাল শিকারে ক’জন বাজনাদার নেওয়া হবে ঠিক করলেন না। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তাই ভাবলাম নিজেই কথা বলে আসি।”
মিস্টার ট্রাইটন পরিচয় করিয়ে দিলেন। “আমার মেয়ে। আর ইনি ঝোলপুরের যুবরাজ, আমার শিকারীবন্ধু। এঁর কথা তোমাকে অনেক বলেছি। দুঃসাহসিক শিকারী।”
মিস্ ট্রাইটন ও আগন্তুকের দৃষ্টি-বিনিময় হলো। অপূর্ব সৌন্দর্যবান পুরুষ। চোখের তারা দুটি কুচকুচে কালো। মাথার চুলও ঘন কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু সামনের কিছু চুল পাতলা হয়ে এসেছে, যেন টাকের পূর্বলক্ষণ। টুপি মাথায় থাকলে মনে হয় ওয়েন্টওয়ার্থের বয়সী। যুবরাজের ব্যক্তিত্বে এমন এক আকর্ষণ আছে যা মিস্ ট্রাইটনকে চঞ্চল করে তুললো।
এমন সময় বাইরে একজোড়া জুতোর শব্দ শোনা গেল। এ শব্দ ফ্যানির পরিচিত। “ফ্যানি, ফ্যানি” বলে ডাকতে ডাকতে ওয়েন্টওয়ার্থ ভিতরে ঢুকছিল। হঠাৎ যুবরাজকে দেখে একটু থমকে দাঁড়ালো সে, তারপর গম্ভীরভাবে বললে, “আরে যুবরাজ যে। অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি।”
মিস্ ট্রাইটনের পাশে গিয়ে ওয়েন্টওয়ার্থ বসলো। চায়ের আসর বেশ জমে উঠেছে। আড়ালে একসময় সে ফ্যানির হাতটা একটু টিপে দিলো। মিস্ ট্রাইটনের শরীরে এক অনাস্বাদিতপূর্ব শিহরণ জেগে উঠলো। একসঙ্গে দুটি পুরুষ যেন তাকে আকর্ষণ করছে।
চায়ের শেষে যুবরাজ বিদায় নিলেন। মিস্টার ট্রাইটনও নিজের কাজে ভিতরে চলে গেলেন। অতিক্রান্ত যুবরাজের দিকে বাঁকাচোখে ওয়েন্টওয়ার্থ তাকিয়ে রইলো। একটা সিগারেট ধরালো সে। তারপর বেশ কড়াভাবেই বললে, “ডার্টি নিগারগুলো আমাদের বাড়িতে ঢুকে মেয়েদের সঙ্গেও ভাব জমাতে শুরু করেছে দেখছি।”
রাগের কারণ আন্দাজ করতে ফ্যানির সময় লাগলো না। ওয়েন্টিকে তার আরও রাগাতে ইচ্ছা করছে। তাই দুষ্টুমি করে সে বললে, “অমন সুন্দর যার গায়ের রঙ, তাকেও তুমি কালো নিগার বলো!”
ওয়েন্টওয়ার্থ অবাক। বলে কি মিস্ ট্রাইটন!
মিস্ ট্রাইটন ওয়েন্টওয়ার্থের আরও কাছে সরে এসে বললো,”তোমাকে মানতেই হবে, যুবরাজকে হঠাৎ দেখলে ইংরেজ বলে মনে হয়।”
রাগে ওয়েন্টওয়ার্থের মুখ লাল হয়ে উঠলো। “তাই বটে। মুসলমান হলেও বা কথা ছিল। কিন্তু এই হিন্দুগুলো………”
মিস্ ট্রাইটনের ওখানেই থামা উচিত ছিল। কিন্তু তার আরও দুষ্টুমি করতে ইচ্ছা হলো। তাই বললে,”ঘোড়ায় চড়লে যুবরাজকে যে কি সুন্দর দেখায়!”
“ঘোড়ায় চড়লে কি হবে, হতভাগাটা সুদখোরের অধম”, ওয়েন্টওয়ার্থ উত্তর দিলে।
মিস্ ট্রাইটনের মাথায় সেদিন বোধহয় ভূত চেপেছিল। না হলে কি কেউ জিজ্ঞেস করে, “বিল, যুবরাজকে তুমি দেখতে পারো না কেন?”
“যুবরাজকে দেখতে পারি না বললে ভুল হবে। তবে ইংরেজ মেয়েদের বিশেষ করে সমর্থা মেয়েদের এ দেশে আসতে দেওয়া উচিত নয়।” সিগারেটটা শেষ না করেই এ্যাট্রেতে ফেলে দিয়ে ওয়েন্টওয়ার্থ বললে, “যতরাজ্যের অনাসৃষ্টি হয় তার থেকে। আর এই লোকগুলো ভারি চালাক। তাদের বাড়ির মেয়েদের মুখ পর্যন্ত আমাদের দেখায় না। অথচ আমাদের মেয়েদের সঙ্গে মেশার জন্য কী আগ্রহ!”
মিস্ ট্রাইটন বললে, “বিল, এদেশের মেয়েদের দেখলে তোমার খুব লাভ হবে না। তারা অসম্ভব লাজুক।”
“হতে পারে। কিন্তু শাড়ি-পরা মেয়েদের যা সুন্দর দেখায়, আমাদের অনেক বিউটি কুইন তার কাছে দাঁড়াতে পারবে না।”
ফ্যানি বেশ আঘাত পেলো। বিলের মুখে ভারতীয় মেয়েদের সৌন্দর্য-স্তুতি তার মোটেই ভালো লাগলো না। ভারতীয় মেয়েদের সৌন্দর্য নিয়ে তার এত আগ্রহ কেন?
রাগ বেশ চড়ে উঠেছিল। তাই বিলকে আঘাত করেই ফ্যানি বললে, “আসলে যুবরাজকে তুমি হিংসা করো।”
আশ্চর্য, ওয়েন্টওয়ার্থ তবুও রাগ করলো না। শুধু গম্ভীরভাবে বললে, “যাহোক, যুবরাজ যদি তোমার উপর বেশি আগ্রহ দেখায় আমাকে বলতে ভুলো না ডার্লিং। ও-রোগের ওষুধ আমার জানা আছে।”
“আগ্রহ দেখানোর কথাটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না,” সোফায় হেলান দিয়ে অভিমানের সুরে মিস্ ট্রইটন বললে।
ওয়েন্টয়ার্থ চেয়ে দেখলো ফ্যানির চোখে জল। কষ্ট হলো তার। এইটুকু মেয়েকে এতখানি আঘাত দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না। লন্ঠনের স্তিমিত-আলোতে ফ্যানিকে সে আবার দেখলো। সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। ওয়েন্টয়ার্থ তার সোনালী চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দেবার লোভ সংবরণ করতে পারলো না। যার চুল সেও প্রতিবাদ করলো না। তাকে সে আরও কাছে টেনে এনে আদর করতে লাগলো। তারপর অজস্র চুমায় ভরিয়ে দলে তার মুখ। আর বললে, “ফ্যানি বড়ো দুষ্টু তুমি। দুষ্টুমি করলে তোমাকে আরও সুন্দর দেখায়।”
যুবরাজের কথা মিস্ ট্রাইটন হয়তো ভুলে যেতো। কিন্তু সেদিনের ঘটনা আর ওয়েন্টওয়ার্থের ব্যবহার, যুবরাজকে তার মনের গভীরে বসিয়ে দিলো। কেমন এক আকর্ষণ আছে যুবরাজের মধ্যে। সেদিন নিশ্চয় যুবরাজকে দেখে ওয়েন্টওয়ার্থের হিংসে হয়েছিল। যুবরাজের কথা সে প্রায়ই ভাবে। কি সুন্দর সুগঠিত দেহ, কি গৌর কান্তি, কি সুন্দর চোখ।
যুবরাজের চিন্তা তার মাথায় প্রায়ই ঘোরে। ওয়েন্টওয়ার্থ আসে। দু’জনে বেড়াতে যায়। কিন্তু তবুও মন পরিষ্কার হয় না। তারপর সেদিন ক্লাবের সেই ঘটনা। স্ফিয়ার ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছিলো মিস্ ট্রাইটন। হঠাৎ একটা ছবিতে চোখ পড়লো। আরে, এ-যে যুবরাজের ছবি! একটা নিহত বাঘের উপর পা দিয়ে যুবরাজ দাঁড়িয়ে আছেন। ছবিখানা নেবার অদম্য ইচ্ছে তার বুকের মধ্যে চেপে বসলো। ক্লাবঘরে তখন কেউ নেই। সবাই বাইরে লন্ টেনিসে ব্যস্ত। ছবিটা সে আবার দেখলো। শিকারী যুবরাজ ছবিতে হাসছেন। চারিদিকে সন্তর্পণে তাকিয়ে নিয়ে, মাথার কাঁটা দিয়ে ছবিটা সে দ্রুত কেটে নিলো। তারপর আরও দ্রুতবেগে সেটা ব্যাগের মধ্যে পুরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মিস্ ট্রাইটন।
বাড়ি ফিরে কিন্তু অনুশোচনা হলো। ছবি কাটা জঘন্য নোংরা স্বভাব। লজ্জাও লাগলো। এ-ছবি রাখবেই বা কোথায়। চাকর বাকরদের যা স্বভাব, ওরা সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখে। অন্য কেউ জানতে পারলে! জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মিস্ ট্রাইটন আবার ছবিটা দেখতে লাগলো। যুবরাজ হাসছেন। কি সুন্দর পেশীবহুল দেহ। প্রকৃত বীরের চেহারা। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছবিটা সে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললো।
সবার আশা ওয়েন্টওয়ার্থ বিয়ের কথা তুলবে। বিয়ের বাজারে তার দাম আছে সত্য। কিন্তু মিস্ ট্রাইটনের মতো পাত্রীও সহজে মেলে না। হেমন্তের পাকা ফসলের মতো সোনালী চুল, টানা-টানা চোখ, নরম গড়ন, ওয়েন্টওয়ার্থকে মুগ্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট।
ওয়েন্টওয়ার্থ আজকাল প্রায়ই আসে। দু’জনে গল্প করে। হাতে হাত রেখে ওয়েস্টভিউ পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত দেখতে যায়। যুবরাজের কথা একবারও ওঠে না।
বাবা ও মেয়ে বিকেলে ড্রইংরুমে একদিন বসেছিলেন। ওয়েন্টওয়ার্থ এখনই আসবে। তারপর চা-পান। একটু পরেই সে এল। চা-পর্ব শেষ করে ওয়েন্টওয়ার্থ মিস্টার ট্রাইটনকে জিজ্ঞাসা করলে, “স্যার এন্টনি ব্রেকনের জন্মোৎসবে যে চড়ুইভাতির আয়োজন হচ্ছে তাতে ফ্যানি যাচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন যাবে না। স্যার এন্টনি নিজে বারবার বলে গিয়েছেন।” মিস্টার ট্রাইটন উত্তর দিলেন।
ওয়েন্টওয়ার্থ একটু অভিভাবকী সুরে বললে, “না, স্যার এন্টনির পার্টিতে ওকে যেতে দেবেন না। হতভাগা যুবরাজটাও ওখানে থাকবে।”
মিঃ ট্রাইটন নির্বিবাদী মানুষ। ভিতরের খবর কিছুই জানতেন না। তাই হেসে বললেন, “যুবরাজ তো খুবই ভদ্রলোক। শিকারীরা কখনও খারাপ হয় না। আর ফ্যানিকে দেখবার জন্য তুমি তো রয়েছো।”
ওয়েন্টওয়ার্থ রাগতস্বরে বললে, “স্যার এন্টনি যে কেন ইণ্ডিয়ানদের পার্টিতে ইনভাইট করেন বুঝি না।”
মিঃ ট্রাইটন বললেন, “যুবরাজ যে স্যার এন্টনির কলেজ-জীবনের বন্ধু। দু’জনে একই সময়ে কেমব্রিজে পড়তেন।”
চড়ুইভাতিতে সারাদিন খুব হৈ-চৈ হলো। স্যার এন্টনি লোককে আপ্যায়িত করতে জানেন। অজস্র খাবারের ব্যবস্থা। স্যার এন্টনি নিজে অত্যন্ত রসিক। সমস্ত দলটিকে সারাদিন হাসালেন। ম্যাজিক দেখালেন। উপস্থিত মেয়েদের হাতে একটা করে তাস দিলেন। হঠাৎ দেখা গেল সেগুলো ফুল হয়ে গিয়েছে। মোটা মিস্টার ওয়াকারকে নাচতে বললেন। তাজ্জব ব্যাপার। নাচার সঙ্গে সঙ্গে ডিম পড়ছে মাটিতে।
নানা রঙের বেলুন আকাশে ভাসছে। রামধনু রঙের পিকনিকের ছাতাগুলো দূর থেকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন মেলা বসেছে।
ক্রমশ বেলা পড়ে আসে। সারাদিনের আনন্দ শেষ হবার সময় এগিয়ে আসছে। ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে এবার সবাই বেড়াতে শুরু করলো। কেউ চললো দূরে একটা পাহাড়ী ঝরনার দিকে। কেউ বা স্থির হয়ে দিগন্তে সূর্যাস্তের সমারোহ দেখতে লাগলো।
মিস্ ট্রাইটন ও যুবরাজ দলছাড়া হয়ে পড়েছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা এক কালীমন্দিরের সামনে হজির হলেন।
মন্দিরের দিকে আঙুল দেখিয়ে কথায় কথায় মিস্ ট্রাইটন যুবরাজকে বললেন, “আপনাদের এই দেবীটিকে আমার মোটেই ভালো লাগে না।”
প্রথমে যুবরাজ কিছু বললেন না। শুধু একটু বিষন্নভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, “চলুন না দেবীকে দেখেই আসি।”
“বেশ তো”, বলে মিস্ ট্রাইটন যুবরাজের সঙ্গে মন্দিরের ভিতর ঢুকে পড়লো। ভিতরে কেমন থমথমে ভাব। লোকজন কেউ নেই। অথচ মেঝে তকতকে পরিষ্কার। গা ছমছম করে ওঠে। অস্তগামী সূর্যের রক্তরাঙা আভায় লোলজিহ্বা দেবীকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। চারিদিকে যেন শ্মশানের অখণ্ড নীরবতা।
মিস্ ট্রাইটন বললে, “মাগো, এমন ভয়ঙ্কর দেবীকে আমার মোটেই পছন্দ হয় না।”
যুবরাজ যেন শুনতে পেলেন না। তিনি কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর দৃষ্টি দেবীর দিকে নিবদ্ধ।
মিস্ ট্রাইটনের মনে হলো যুবরাজ যেন তাঁর কথায় কোনো গুরুত্ব আরোপ করছেন না। ভদ্রতার খাতিরেও যুবরাজের উত্তর দেওয়া উচিত ছিল।
বেশ কয়েক মিনিট গিয়েছে। যুবরাজ তখনও চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছেন। মোটেই ভালো লাগছিল না মিস্ ট্রাইটনের। যুবরাজের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জোর গলায় সে বললে, “মাটি বা পাথরের মূর্তিতে আমি একটুও ভয় পাই না।” কিন্তু যতো জোরে কথাটা উচ্চারিত হলো মনে তার অর্ধেক জোরও ছিল না। ভারতবর্ষেই তার জন্ম। দূর থেকে অনেক কালীমন্দির সে দেখেছে। কিন্তু কখনও মন্দিরের ভিতরে ঢোকবার সুযোগ হয়নি।
মিস্ ট্রাইটন এবার ভালোভাবেই দেবীমূর্তির দিকে তাকালো। নানা অলঙ্কারভূষিতা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক নারীমূর্তি সম্পূর্ণ উলঙ্গিনী বেশে এক পুরুষের উন্মুক্ত বক্ষের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কণ্ঠে নরমুণ্ডের মালা। কটিদেশে বিচ্ছিন্ন নর- হস্তের সারি। বাম হাতে উন্মুক্ত তরবারি, অপর হাতে সদ্যছিন্ন নরমুণ্ড। সব থেকে বীভৎস নারীমূর্তির লোলজিহ্বা। অজানা ভয়ে মিস ট্রাইটনের বুক শিউরে ওঠে। এখানে না এলেই ভালো হতো। মনে হল ওই বীভৎস নারী মূর্তি যেন তাকে গ্রাস করতে আসছে।
যুবরাজের উপর তার রাগ হচ্ছিলো। লোকটা তাকে ভিতরে এনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একটা কথা পর্যন্ত বলছে না।
যুবরাজের নিস্পন্দ দেহ এবার নড়ে উঠলো। দেবীকে তিনি সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। তারপর মিস ট্রাইটনকে বললেন, “দেবী হলেন জগৎশক্তি। জীবন, মৃত্যু, সৃষ্টি, ধ্বংস, সকল কিছুর প্রতিভূ তিনি। এক হাতে ধ্বংস করেন, অপর হাতে বর দেন।”
দেবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে যুবরাজ আবার চোখ বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। কেমন যেন ভয় লাগছে মিস্ ট্রাইটনের। রাগও হচ্ছে। সে বলে উঠলো, “সব মিথ্যে। এই কুৎসিত বিবসনা দেবীকে আপনি জীবনের প্রতিমূর্তি বলেন? মানসিক অসুস্থতা না থাকলে জীবনে কেউ এমন ভাবতে পারে না।”
চোখ বন্ধ করা হলো না যুবরাজের। কথাটা শুনেই ফিরে তাকালেন তিনি। তিনি যেন বহুদূরে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ মিস্ ট্রাইটনের আহ্বানে আস্তে-আস্তে যেন ফিরে আসছেন। একদৃষ্টিতে মিস্ ট্রাইটনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কিছু ভাবছেন। হয়তো উত্তরটাই ভাবছেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, “আপনার বয়স সামান্য। আরও বয়স হোক। তাছাড়া, জীবনে আঘাত না পেলে জগৎশক্তিকে বোঝা যায় না, মিস্ ট্রাইটন।”
“জীবনে কেউ আঘাত পেয়েছে কি না পেয়েছে, সেটা অতো সহজে বলা যায় না যুবরাজ।”
চমকে উঠলেন যুবরাজ। আবার যেন দূরে সরে যাচ্ছেন তিনি। “তা সত্যি, আমি দুঃখিত,” যুবরাজ ধীরে-ধীরে উত্তর দিলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন রহস্যময় মনে হলো। তিনি যেন কাছে নেই। লক্ষযোজন দূর হতে যেন তার বাণী ভেসে আসছে।
মিস্ ট্রাইটন যুবরাজের মুখের দিকে তাকালো। বাইরের প্রকৃতির মতো যুবরাজের মুখমণ্ডলে দুঃখের নিবিড় অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘোড়ার পিঠে শিকারীর বেশে যে যুবরাজকে সে দেখেছিল এ যেন সে-লোক নয়। অন্য কেউ। একটা অসহায় অথচ রহস্যময় মানুষ। হয়তো সে একটা শিশু কিংবা যুবক, কিংবা পঙ্গু বৃদ্ধ!
মিস্ ট্রাইটন বুঝতে পারছে তার মনের মধ্যে বেশ পরিবর্তন আসছে। সমস্ত দেহ শিরশির করে উঠছে। এক বিচিত্র অনুভূতির জোয়ারে হৃদয়ের আধার কানায়- কানায় বোঝাই হয়ে আসছে। একটি শ্রান্ত, অবসন্ন পুরুষের উষ্ণ মাথা নিজের বুকে চেপে ধরার এমন অদম্য কামনা তার কোনোদিন হয়নি। অশান্ত শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়াতে মায়ের যেমন ইচ্ছা হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক অব্যক্ত বেদনায় মিস্ ট্রাইটনের মন ভরে ওঠে।
হঠাৎ চিন্তায় বাধা পড়লো। “তোমরা দুটি মানিকজোড় এখানে!” ঝড়ের মতো ওয়েন্টওয়ার্থ ভিতরে ঢুকে এসেছে। পিছনে চড়ুইভাতির অভ্যাগতরা পিল- পিল করে ঢুকছে।
মিস্ ট্রাইটন শিউরে ওঠে। যুবরাজ নির্বাক নিশ্চল।
“—বেরিয়ে আয় ওখান থেকে।” মত্ত হাতীর মতো ওয়েন্টওয়ার্থ টলছে।
ধীর পদক্ষেপে যুবরাজ মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন।
“কালা কুত্তা, নোংরা শুয়ার,” ওয়েন্টওয়ার্থ চিৎকার করতে থাকে।
যুবরাজ স্থিরভাবে বললেন, “কোনো অশোভন উদ্দেশ্য থাকলে এমন প্রকাশ্য স্থানে আমি আসতাম না, ক্যাপ্টেন ওয়েন্টওয়ার্থ।”
চোপরাও কুত্তা।” ওয়েন্টওয়ার্থ যুবরাজের গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো। তারপর জিজ্ঞাসা করলে, “মিস্ ট্রাইটন, হতভাগা আপনার কোনো—মানে, কোনো কিছু ইয়ে করবার চেষ্টা করেনি তো?”
যুবরাজের বিশাল দেহটা কেঁপে উঠলো। লাল হয়ে উঠলো তাঁর সারা মুখটা। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে তিনি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন। দেহে তাঁর অসুরের শক্তি, সকলে জানে। এবার হয়তো ওয়েন্টওয়ার্থকে একহাতে তুলে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। কিন্তু সে চিন্তা শুধু কয়েক মুহূর্তের জন্য। কাঁপুনি থেমে গেল। হাতের মুঠো অবশ্য তখনও খোলেনি।
ইতিমধ্যে স্যার এন্টনি এগিয়ে এসে দু’জনের মধ্যে দাঁড়ালেন। “ওয়েন্টি ওয়েন্টি কী করছো তুমি? যুবরাজকে আমি জানি, তিনি সে-রকম মানুষ নন।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার জানা আছে। বেটাদের হারেমে ডজন-ডজন মেয়ে তবু আশা মেটে না। ওদের স্ত্রীদের জন্য আমার দুঃখ হয়,” ওয়েন্টওয়ার্থ তখনও ফুঁসছে।
যুবরাজ এক পা সামনে এগিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, “আমার স্ত্রী সম্বন্ধে কিছু না বললে অনুগৃহীত হবো। তিনি মৃতা।” সবাই চমকে উঠলো। যুবরাজ মৃতদার, কেউ জানে না।
আমরাও হঠাৎ ত্রিলোচন সিং-এর ডাকে চমকে উঠলাম। ত্রিলোচন বলছে, আমাদের ডিনার প্রস্তুত। বর্তমানে ছিলাম না আমরা। সায়েবের কাহিনী অবলম্বন করে ফিরে গিয়েছিলাম অর্ধশতাব্দী আগের কাঠুরিকোটে।
.
গল্প থামিয়ে সায়েব বললেন, “বাইরে এখনও বেশ বৃষ্টি পড়ছে, কমবার বিশেষ লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আকাশ মেঘে ছেয়ে রয়েছে।”
কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর?”
সায়েব বললেন, “তারপরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। মিস্ ট্রাইটনের নামে কুৎসা ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। যে-মেয়ে নেটিভদের সঙ্গে কেলেঙ্কারি করতে পারে, ক্যাপ্টেন ওয়েন্টওয়ার্থ তাকে বিয়ে করতে পারে না।
একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলেন মিস্ ট্রাইটন। কোথায় গেল সেই যুবতীসুলভ ব্রীড়া, বনহরিণীর চঞ্চলতা। দিনরাত মনমরা হয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। মাঝে মাঝে ভয়ে চমকে ওঠেন। কাঠুরিকোটের সেই কালীমূর্তি মাঝে-মাঝে চোখের সামনে জেগে ওঠে। মনে যেটুকু শক্তি ছিল তাও নিঃশেষে মিলিয়ে গেল।
মনের মানুষ কেউ যদি এগিয়ে আসে সেই আশায় রূপ, যৌবন ও কামনার ডালি নিয়ে মিস্ ট্রাইটন বছরের পর বছর প্রতীক্ষায় কাটালেন। কিন্তু আশা সার্থক হলো না। যারা এসেছে পছন্দ হয়নি তাদের। আর গোপনে গোপনে ভয়ে শিউরে উঠেছেন তিনি। কাঠুরিকোটে কালীমন্দিরের লোলজিহ্বা দেবী যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, দুঃখের আগুনে যেন তিনি এই যুবতীকে দগ্ধ করবেন।”
বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। তাই সায়েবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “একজন শিক্ষিতা ইংরেজ মহিলার মনে এমন ভয় জাগলো কেন?”
সায়েব বললেন, “মনের প্রকৃতি কেউ জানে না। সেদিনের ঘটনা মিস্ ট্রাইটনের অবচেতন মনের কোথাও আঘাত দিয়েছিল নিশ্চয়।”
“যা হোক্, তারপর?”
“আরও অনেকদিন প্রতীক্ষা করেছিলেন তিনি। দিগন্তের অস্তমিত সূর্য যখন চারিদিকে আবীর ছড়িয়ে দেয়, যখন ঘরমুখো পাখীর কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি, তখন তিনি কেমন হয়ে পড়েন। ওই বুঝি সেই নরকঙ্কালভূষিতা দেবী
তাকে গ্রাস করতে আসছেন।
বহু বৎসর অতিক্রান্ত হলো। যুবতী মিস্ ট্রাইটন প্রৌঢ়া মিস্ ট্রাইটনে পরিণত হলেন। মিঃ ট্রাইটন ইতিমধ্যে পরলোকের পথে পাড়ি দিয়েছেন। তারপর এই রাণীক্ষেতে একটা বাড়ি কিনলেন তিনি। কিন্তু কালীর প্রভাব তিনি এড়াতে পারেননি। তাঁর সমস্ত জীবনের উপর কালী যেন আজও এক দীর্ঘ অশুভ ছায়াপাত করে আছে।
—সায়েব তাঁর কাহিনী শেষ করলেন। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে।
.
পরের দিন ভোরে টাইপরাইটার হাতে করে মিস্ ট্রাইটনের বাড়ি গিয়েছিলাম। মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠেছে। দেখলাম মিস্ ট্রাইটনের বাগানের মধ্যে মেমসায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কালকের ঝড়ে ফুলগাছগুলো লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে।
আমাদের দেখে মেমসায়েব এগিয়ে এলেন। সায়েব চাপাগলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন আছে?” মেমসায়েব বললেন, “ডাক্তার এসেছিল। এ যাত্রা রক্ষে হবে বলে মনে হয় না। বুড়ী উইল করবার জন্য ছটফট করছে। দূরসম্পর্কের এক বোনপো’কে সব দিয়ে যেতে চায়। কিন্তু একটু বসতে হবে, বুড়ী এইমাত্র ঘুমিয়েছে।”
সায়েব বললেন, “বোনপো’র পাবার মধ্যে তো এই ভাঙা বাড়ি, কতকগুলো ছেঁড়া কাপড়, আর গোটাকয়েক ছবি।”
মেমসায়েব বললেন, “না-না, এতদিন আমরা কেউ জানতে পারিনি। কলকাতার ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কে বুড়ীর পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। আর বিভিন্ন কোম্পানীর কাগজে আরও সাড়ে তিনলাখ টাকা। এ-কথা কাউকে কখনও বুড়ী বলেননি। শুধু কাল সন্ধ্যায় তিনবার বমি করার পর যখন নাড়ি প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল তখন আমাকে সর্ বললে।”
মেমসাহেব আবার ভিতরে ঢুকে গেলেন।
আমি ভাবছিলাম ব্যাঙ্কে যার এত টাকা তিনি ছবি বিক্রি করে খান! প্রাতঃসূর্যের কিরণে নন্দাদেবী ঝলমল করছে। সেই দিকে তাকিয়ে আমার হাত ধরে সায়েব বললেন, “এ-ও জীবনের এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন