শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
চোখ আর কান, দেখা আর শোনা দুই থেকেই শিখছি। চোখ দিয়ে দেখছি নতুন মক্কেল, নতুন এটর্নি, নতুন ব্যারিস্টার আর কান দিয়ে শুনছি নতুন নতুন কাহিনী। ছোকাদা নাকি আগে এতো গল্প বলতেন না। আমাকে কেমন একটু সুনজরে দেখেছেন, অন্তত অর্জুনবাবু তাই বলেন। তাই একটু ধরলেই গল্প বলতে আরম্ভ করেন।
কিন্তু আরও অনেক বেশি শুনেছি ও জেনেছি সায়েবের কাছ থেকে। সায়েব ও আমি— এক ব্যারিস্টার ও তাঁর বাবু। কিন্তু যখন তিনি কথা বলতে আরম্ভ করেন, সম্বন্ধটা খেয়াল থাকে না। আর গল্পের বিষয়বস্তুও সবসময় হাইকোর্টকে কেন্দ্র করে পড়ে থাকে না। মাঝে-মাঝে অনেক দূরে সরে যায়। তিনি বর্ণনা করেন এই কলকাতা কেমন ছিল জব চার্নকের সময়, কেমন মেজাজী লোক ছিলেন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস, কেমন ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস।
ছুটির দিন ভোরবেলায় হয়তো আমাকে নিয়ে কবরখানা দেখাতে বেরিয়ে পড়লেন। সেন্ট জনস্ চার্চের পিছনে শতাব্দী প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র থেকে আরম্ভ করে পার্ক স্ট্রীটের অতি আধুনিক সমাধিক্ষেত্র পর্যন্ত আমরা গিয়েছি। সেন্ট জনে কেউ নেই, শেওলা পড়েছে কবরে। আর পার্ক স্ট্রীটে সদ্য-আনা এক কফিনকে ঘিরে কয়েকটি ভদ্রমহিলা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
কখনও সায়েব বলেছেন, “চলো তোমাদের কালীঘাট দেখে আসি। এতোদিন কলকাতায় রয়েছি অথচ মাত্র একবার গিয়েছি সেখানে।” কালী-দর্শন করে ফেরার পথে প্রাচীনকালের ইংরেজদের যুদ্ধ জিতে এখানে পূজা দিতে আসার গল্প তাঁর কাছে শুনেছি।
এই কলকাতা শহরের উপর কেমন একটা আত্মীয়তার টান আছে সায়েবের, সেটা বেশ বুঝতে পারি। অবশ্য, ভালোবাসাটা সমগ্র ভারতবর্ষের উপর। বিভূতিদার মুখেই শুনেছিলাম সায়েব এই দেশকে নিজের দেশ করে নিয়েছিলেন। এই দেশেতে জন্ম না হলেও এই দেশেতে জীবনের শেষ ক’টাদিন কাটিয়ে এখানেই মরতে চান তিনি।
“এই কলকাতার সঙ্গে আমাদের পরিবারের অনেকদিনের পরিচয়।” সায়েবই বলছিলেন একদিন।
“তাই নাকি? জানতাম না তো।”
“বলতে গেলে এই শহরের গোড়াপত্তন থেকেই আমাদের বংশের কেউ- না-কেউ জড়িয়ে আছে। একজন ছিলেন ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর। তার অনেকদিন পরে আর একজন হেস্টিংসের পরিষদ সভ্য হয়ে এলেন। প্রচুর অর্থ রোজগার করেছিলেন তিনি। কী উপায়ে, সেটা নিশ্চয় তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। এদেশের নবাবদের দেখে-দেখে তাঁরাও এক-একটি নবাব বনে গিয়েছিলেন। খিদিরপুরে তিনি যে বাড়ি তৈরি করেছিলেন, সেটি অনেক রাজপ্রাসাদকে লজ্জা দিতো। নদীতে বইতো তাঁর ময়ুরপঙ্খি। বিকেলে তিনি গঙ্গার শোভা দেখতে বেরোতেন। বাঁদীরা করতো সেবা, বাঈজীরা গাইতো গান— আর মাঝে মাঝে বসতো জুয়ার আসর। বড়ো-বড়ো চাঁইরা আসতেন সে আড্ডায়, সারারাত ধরে চলতো খেলা। একরাতে কয়েক লাখ টাকা হেরে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু কুছ পরোয়া নেই।
বিলেতে ফিরে গিয়ে বড়ো বড়ো লর্ডদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি যে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, বহুলোক তা দেখতে আসতো। আর সে-যুগের সেরা চিত্রকর স্যার জোসুয়া রেনল্ডসকে দিয়ে নিজের তৈলচিত্র আঁকিয়েছিলেন। স্বভাবটি তাঁর ছিল ঠিক আরব্য উপন্যাসের আবু হাসানের মতো। বড়ো ডিনার পার্টিতে তিনি লোককে নিমন্ত্রণ করে পাঠাতেন। শুধু তাই নয়, ঘোড়ার গাড়িওয়ালাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবস্থা ছিল। রাস্তা থেকে তারা গেস্ট ধরে নিয়ে আসতো এবং ইন্ডিয়া- ফেরত বাড়ির মালিক চিৎকার করতেন “আউর দো গাড়ি গেস্ট মাংতা।”
শেষপযর্ন্ত কিন্তু জুয়াতে সব গেল। বাড়ি গাড়ি সব খুইয়ে প্রায় পথে নামবার অবস্থা। বংশধরদের জন্য তিনি কেবল রেখে গেলেন স্যার জোসুয়ার আঁকা ছবিটা। সে ছবি এখন বিলেতের জাতীয় আর্ট গ্যালারীতে আছে।
এরপর আরও কয়েকজন এসেছেন। তবে ইতিহাসে নাম রেখে যাওয়ার মতো কেউ নয়।”
এসব গল্প সাধারণত ছুটির দিনে হয়। ছুটির দিনে আমাকে প্রায়ই যেতে হয়। রবিবারের জন্য অনেক কাজ পড়ে থাকে। বিশেষ করে বাইরের লোকদের চিঠিপত্র লেখা, আগামী সপ্তাহের কেগুলোর কাগজপত্র তৈরি করে রাখা, অন্যদিনে হয়ে ওঠে না।
এমনই এক রবিবারের রৌদ্রঝরা সকালে সায়েব ঘড়ির দিকে তাকালেন। সবে মাত্র ন’টা। লনে গাছের তলায় শরতের স্নিগ্ধ রোদ যেখানে উঁকি মারছে তার খুব কাছেই আমরা সামনা-সামনি বসে রয়েছি। সবুজ বেতের চেয়ারের সঙ্গে সবুজ ঘাসের রঙ এক হয়ে গিয়েছে। কয়েকখানা চিঠি টাইপ করেছি। দূরে একটা গাছের আড়াল থেকে একটা নাম-না-জানা পাখি মাঝে-মাঝে ডেকে উঠছে।
সায়েব হঠাৎ বললেন, “মানুষের রসবোধ সবচেয়ে কম। না হলে পাখির গানের তালে তালে সূর্য যখন শিশিরের সঙ্গে খেলা করছে, তখন তুমি ও আমি আকাট গদ্যের মতন কাজ করে চলি কেন?” তারপর তিনি পেনের মুখটা বন্ধ করলেন। “ছুটির দিনে বেশি কাজ ভালো নয়। এখন বরং গল্প।”
আমি আনন্দে সায় দিয়ে টাইপরাইটার বন্ধ করলাম।
“কাজে ফাঁকি দিচ্ছি একথা কিন্তু কাউকে বলো না”-–কানের কাছে মুখ এনে কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে সায়েব বললেন। আমি হেসে ফেলি। সায়েব বললেন, “ভাবে মনে হচ্ছে তুমি বিনা ঘুষে রাজী নও। বেশ, বিপদে যখন পড়েছি তখন ঘুষ দেবো। কী ঘুষ চাও বলো—অরেঞ্জ না লাইম স্কোয়াশ?”
“দুই-ই সমান, তবে অরেঞ্জ স্কোয়াশ শুধু খেতেই ভালো নয়, দেখতেও চমৎকার।”
“বাঃ, এই না হলে বাঙালীর বুদ্ধি! একসঙ্গে রসনা ও চক্ষু পরিতৃপ্তির ব্যবস্থা। এমন বুদ্ধিমত্তার জন্য তোমার প্রাইজ পাওয়া উচিত। প্রাইজটা হলো আজকের লাঞ্চ।”
আমি বললাম, “না না, লাঞ্চের দরকার নেই। কাজ শেষ হলেই বাড়ি চলে যাবো।”
চোখ বুজে ঘাড়টা নেড়ে সায়েব শুদ্ধ ভাষায় বললেন, “কী জিনিস হারাইতেছেন আপনি জানেন না। ভুলে যাচ্ছেন যে ইস্টবেঙ্গলের রান্না চীনের রান্নার সঙ্গে পাল্লা দেয়। আর আমাদের ক্লাবের কুক এসেছে ইস্টবেঙ্গলের চট্টগ্রাম থেকে।”
বেয়ারা অরেঞ্জ স্কোয়াশ রেখে গেল। গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললাম, “ঘুষ নেওয়া কিন্তু অপরাধ, জেল পর্যন্ত হতে পারে।”
কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে সায়েব বললেন,”সেজন্য ভাবনা নেই। জেল দিতে হলে প্রথমে কোর্টে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে আসামী পক্ষ সমর্থন করবেন এমন একজন ব্যারিস্টার যিনি বর্তমানে তোমার সামনেই বসে রয়েছেন।
মনটা আজ হাল্কা রয়েছে বুঝতে পারলাম। তাই আমার সাহস যেন আরও বেড়ে গেল। পরিহাস-ছলে বললাম,”সে তো সম্ভব হবে না। ঘুষদাতাকে পুলিশ যে সাক্ষী হিসাবে কাঠগড়ায় তুলবে।”
হেসে উঠলেন সায়েব। “বাঃ চমৎকার! ব্যারিস্টারের বাবুর মতোই কথা হয়েছে। আইন-টাইনগুলো বেশ শিখে নিচ্ছো বুঝতে পারছি।”
এরপরে আলোচনাটা ফৌজদারি মামলাকে কেন্দ্র করেই চলতে লাগলো। একটু পরেই ইংলন্ডের ক্রিমিন্যাল কেসে বিচার পদ্ধতির কথা উঠলো। সায়েব বললেন, “ফৌজদারি কেসে বিলেতের সঙ্গে এখানকার অনেক তফাত। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। লণ্ডনে আমি যে ব্যারিস্টারের কাছে কাজ শিখেছিলাম ফৌজদারি মামলায় তিনি প্রথিতযশা। বহু চাঞ্চল্যকর মামলায় আসামীদের খালাস করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এটর্নিরা মক্কেলের সঙ্গে যখন তাঁর চেম্বারে আসতেন, তখন তিনি গম্ভীরভাবে বলতেন, আজ কাগজপত্র রেখে যান আগামীকাল সন্ধ্যায় আসবেন। পরের দিন এটর্নি ও তাঁর জামিনে মুক্ত মক্কেল হাজির হলে, ব্রীফের লাল ফিতেটা খুলতে খুলতে তিনি বলতেন, আপনার নথিপত্র মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। পুলিশের অভিযোগের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার কী বলার আছে?’
কলকাতায় ব্যারিস্টারি আরম্ভ করার কিছুদিন পরেই এক এটর্নি মক্কেল- সহ আমার কাছে এলেন। ফৌজদারি মামলা। গুরুকে অনুসরণ করে আমিও এটর্নিকে পরের দিন দেখা করতে বললাম। দ্বিতীয় দিন তাঁরা চেম্বারে এলে খুব গম্ভীরভাবে বললাম, ‘কাগজপত্র সব দেখেছি। পুলিশের অভিযোগও পড়লাম। এখন এর বিরুদ্ধে আপনি কী বলতে চান?’
সঙ্গে সঙ্গে এটর্নি ও মক্কেল আঁতকে উঠে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। একটু পরেই এটর্নি বিরক্তভাবে বললেন, ‘আজ্ঞে সেইটাই যদি জানবো তা হলে আপনার কাছে আসবো কেন? আসামীর বক্তব্য, অর্থাৎ খুনের সময় আসামী কোথায় ছিল, নিহত ব্যক্তির সঙ্গে তার কতখানি পরিচয় থাকা উচিত, সে-সব আপনাকেই ঠিক করতে হবে।’
অনেকদিন পরে কথাপ্রসঙ্গে হাইকোর্টের একজন ইংরেজ বিচারপতিকে এই গল্প বলেছিলাম। বিচারপতি শুনে বললেন, “আমি কিন্তু আরও লজ্জায় পড়েছিলাম। তখন পেশওয়ার হাইকোর্টে নতুন জজ হয়েছি। খুন, ডাকাতি, রাহাজানি প্রভৃতি মামলায় পেশওয়ার বোধহয় ভারতবর্ষের এক নম্বর হাইকোর্ট। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কৃতী আইনজ্ঞদের সংখ্যা এই কোর্টে খুবই কম। কৌতূহল-বশবর্তী হয়ে একদিন ওখানকার এড্ভোকেট জেনারেলকে এর কারণ জিজ্ঞাসার লোভ সামলাতে পারলাম না। এডভোকেট জেনারেল প্রথমে উত্তর দিতে সঙ্কোচ বোধ করছিলেন। শেষে বললেন,–-“এর কারণ অতি জটিল। আসল ব্যাপারটা হলো যে, এদেশের খুনী, আসামী ও ডাকাতরা দেখেছে যে, বড় উকিল ব্যারিস্টারদের পিছনে টাকা খরচ করা অপেক্ষা জুরিদের দিকে নজর দিলে, খরচ অনেক কম হয় অথচ দ্রুত ও নিশ্চিত ফললাভ।”
আমি আগ্রহের সঙ্গে শুনে যাচ্ছি। অরেঞ্জ স্কোয়াশে আর একটা চুমুক লাগিয়ে সায়েব বললেন, “দেখো, এই জুরিদের নিয়ে সব দেশেই গণ্ডগোল। এমন কি ইংলণ্ডে পর্যন্ত মাঝে-মাঝে কথা ওঠে, জুরির বিচারে কিছু লাভ হয় কিনা। তা ছাড়া অসততার অভিযোগ খুব কম হলেও মাঝে-মাঝে যে শোনা যায় না এমন নয়। তবে হ্যাঁ, সততা সম্বন্ধে চীনদেশের জুরিদের বেজায় সুনাম।”
“বলা বাহুল্য ঘটনাটি চিয়াং কাইশেকী আমলের।” সায়েব অরেঞ্জ স্কোয়াশে আর একটা চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন—”চীনা জুরিরা সোজাসুজি কোনো বে- আইনী অর্থ নেন না। তবে প্রথমদিনে মামলা শেষে যখন জুরি আদালত থেকে বার হবেন তখন রাস্তার উল্টোদিক থেকে মস্ত এক ছাতা নিয়ে অন্য একজন লোককে আসতে দেখা যাবে। এই ছাতা জুরিবাবুর সিগন্যাল। জুরি জিজ্ঞাসা করবেন, হ্যাঁ মশাই, আপনি কি পাগল? এই চমৎকার শুকনোদিনে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছেন!’ ছাতাওয়ালা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেবে, ‘না মশাই, অতো বোকা আমি নই। আমি আবহাওয়া ব্যাঁপারে পণ্ডিত লোক। এখনই পাঁচমিনিটের মধ্যেই বৃষ্টি হবে, সেইজন্যই ছাতা নিয়ে বেরিয়েছি। বিশ্বাস না হয় বাজি লড়ে যান পাঁচহাজার ডলার।’ জুরিবাবুও বাজি লড়ে যান। পাঁচমিনিটের মধ্যে কোথায় বৃষ্টি? ছাতাওয়ালা আড়চোখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি হেনে পাঁচহাজার ডলার জুরির হাতে তুলে দিয়ে চলে যায়।”
“চীনা আসামীদের বুদ্ধির প্রশংসা করতে হবে,” আমি বললাম।
আলোচনা ঘুরে-ঘুরে জুরি থেকে সাক্ষীতে হাজির হলো। এদেশের একশ্রেণীর সাক্ষীদেরও সুনামের অভাব নেই। টাকার পরিমাণ অনুযায়ী তারা ঠিক করে কোন্ পক্ষে সাক্ষ্য দেবে।
সায়েব বলতে লাগলেন, “তখন স্বদেশী বোমার যুগ। আলিপুর কোর্টে জজরা খুব সন্ত্রস্ত হয়ে খাসকামরা থেকে আদালত ঘরে যান। ইতিপূর্বে এই পথেই একজন জজের উপর বোমা ছোঁড়া হয়েছিল। খাসকামরা থেকে বেরিয়ে একদিন সকালে জনৈক জজ-সায়েব দেখলেন, পথে একটি লোক দাঁড়িয়ে। লোকটির দুই হাতই চাদরের ভিতর। জজ-সায়েব মনে মনে যে ভয় পেলেন না এমন নয়, তবুও যথাসম্ভব সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে দাঁড়িয়ে কেন? জানো, এখনই তোমাকে পুলিশে দিতে পারি।” লোকটির কাঁদো-কাঁদো অবস্থা। জজ- সায়েব তবুও সন্দেহমুক্ত হলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কোর্টে এসেছো কেন?” লোকটি উত্তর দিলে, “সাক্ষী দিতে।” জজ-সায়েব সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন কেস্-এ? বাদী বিবাদীর নাম কি?” লোকটি আশ্চর্য হয়ে বলল, “আজ্ঞে যে কোনো কেস স্যার। পার্টি পেলেই সাক্ষী দিতে পারি।” জজ-সায়েব কোনোরকমে হাসি চেপে এজলাসে চলে গেলেন।
আলিপুরের সাক্ষীর কথায় জনৈক প্রখ্যাত হাস্যরসিক অভিনীত নক্সায় সাক্ষী গড়গড়ি হাজরার কথা মনে পড়ে গেল। গড়গড়ি হাজরার পেশা সাক্ষ্যদান। বহুকালের ঘড়েল সাক্ষী সে এবং তাকে জেরা করতে গিয়ে উকিলের যে বিপত্তি হয়েছিল শুনে এককালে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম।
গড়গড়ি হাজরার কথা মনে আসতেই হাসি চেপে রাখা শক্ত হয়ে উঠেছিল।
আমাকে হাসতে দেখে সায়েব বললেন, “আসলে সাক্ষীর বক্তব্যের উপরেই সমস্ত মামলা নির্ভর করে। কিন্তু তারা যদি নির্ভরযোগ্য না হয় তা হলে জজের পক্ষে নীরং ত্যক্ত্যা ক্ষীরং গ্রহণ করা শক্ত হয়ে ওঠে। মিথ্যে সাক্ষ্যদান অবশ্য সবদেশেই কিছু-না-কিছু হয়। তবে এ-দেশে একটু বেশি।”
সামান্য অরেঞ্জ স্কোয়াশ তখনও গ্লাসের তলায় পড়েছিল। সেটা নিঃশেষ করে মুখ মুছতে মুছতে সায়েব বললেন, “অবশ্য ফৌজদারি কেসে আসামীরাই যে এক তরফা মিথ্যা সাক্ষী হাজির করে, বললে সত্যের অপলাপ হয়। উঁচু পুলিশ মহলে এই নিয়ে এক পকেটমারের গল্প চালু আছে। পকেট মারার জন্য যখন তার তিনমাসের জেল হলো, তখন পকেটমার ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিল, “হুজুর পকেট মেরেছি সত্যকথা। কিন্তু রাত সাড়ে এগারোটায় নির্জন রাস্তায় পকেট মারলাম, অথচ পুলিশ তিনজন সাক্ষী হাজির করলে কী করে বুঝতে পারছি না।”
আমার হাসিতে ফেটে পড়বার মতো অবস্থা। একটু থেমে সায়েব বললেন, “না, আলোচনা লঘু হয়ে যাচ্ছে। আমি আবার এমন সাক্ষী দেখেছি যে প্রাণের মায়া করে না। অদ্ভুত সাহস। অনেকদিন হয়ে গিয়েছে কিন্তু একটুও ভুলিনি তাকে।” সায়েব বেশ গম্ভীর হয়ে উঠলেন।
“কে সে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“নরেন মণ্ডলের কথা তোমাকে কি আগে বলিনি?”
“না তো।”
তিনি আবার ঘড়ির দিকে চাইলেন। “লাঞ্চে বসতে তখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। রৌদ্রটা বেশ চড়ে উঠেছে। চলো, ঘরের ভিতর যাওয়া যাক।”
ঘরের ভিতর বসে তিনি আরম্ভ করলেন নরেন মণ্ডলের গল্প—
.
সায়েবের ব্যারিস্টারি আরম্ভ করার কয়েক বছর পরের ঘটনা। মফস্বলের দু-একটা শহরে যাওয়া হলেও কলকাতার বাইরে বাঙলাদেশের সঙ্গে তার তখনও বিশেষ পরিচয় হয়নি। তাঁর ড্রাইভার প্রভাত মণ্ডলের বাড়ি বরিশাল। ধর্মে খ্রীস্টান হলেও গ্রামের চাষ আবাদেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হয়।
একদিন দুপুরে সায়েব চেম্বারে কাজ করছিলেন। হঠাৎ প্রভাত এসে কাঁদতে শুরু করলো—”আমার সর্বনাশ হয়েছে।” সায়েব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। প্রভাতের কান্না থামিয়ে বহু কষ্টে যা জানা গেল, তাতে চিন্তিত হয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
বরিশালে প্রভাতদের পাশের গ্রামে কেবল হিন্দুদের বাস। হিন্দুরা নাকি তাদের দেখতে পারে না। শেষ পর্যন্ত হিন্দুরা দলবল নিয়ে তাদের আক্রমণ করে। আত্মরক্ষার জন্য বাধা দিতে গিয়ে অনেক হতাহত হয়। অথচ পুলিশ কেবল প্রভাতদের গ্রামের লোকদের গ্রেপ্তার করেছে। নরহত্যা ও দাঙ্গার অভিযোগে।
প্রভাত কান্নায় ভেঙে পড়ে। “আমার কাকা, জ্যাঠা, নিজের ভাই সবার ফাঁসি হয়ে যাবে। আমরা যে খ্রীস্টান। হিন্দুরা কাউকে ছাড়বে না।”
ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে অবশেষে প্রভাতকে সঙ্গে নিয়ে সায়েব বরিশালের সুখদা গ্রামে রওনা হলেন।
সুখদা গ্রামকে বাইরের জগতের সঙ্গে সংযুক্ত রাখার জন্য আধুনিব যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। স্টীমারঘাট থেকে খাল বেয়ে নৌকাযোগে মাইল পাঁচেক যেতে হয়। সেখান থেকে পাল্কি একমাত্র বাহন।
সায়েব বলছিলেন, “ট্রেন থেকে বাংলাদেশের শস্যশ্যামলা রূপ এর আগে দেখেছি সত্য। কিন্তু সে-দেখা দূরের দেখা। সুখদার পথে পাল্কি থেকে বাংলাদেশকে অতি নিকট থেকে দেখার প্রথম সুযোগ পেলাম। চালচলনে চাকচিক্য না থাকলেও এক সরল নিরাভরণ স্নিগ্ধতা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। পাল্কি দুলে-দুলে চলে, আমার অদ্ভুত লাগে। মনে হয় যেন বর্তমান থেকে ফিরে যাচ্ছি এক অতি প্রাচীন যুগে। বেহারাদের অস্পষ্ট গোঙানিতে ভয় পেয়ে থামতে বলি। জিজ্ঞাসা করি, তোমরা বোধ হয় খুব ক্লান্ত? তারা হাসতে থাকে। প্রভাত বলে, “না সায়েব, ওরা মুখে অমন আওয়াজ করে। তাতে ওদের চলতে সুবিধা হয়।”
গ্রামাঞ্চলের দিবাবসান। এই বিদেশীকে বহন করে পাল্কি চলেছে আলের, উপর দিয়ে। সুখদা গ্রামের খুব কাছেই ডাকবাংলো। সেখানে যখন পাল্কি থামলো সূর্য তখন পৃথিবীর কাজ শেষ করে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছেন। দীর্ঘ ভ্রমণে সায়েব ক্লান্ত, তাই সময় নষ্ট না করে সামান্য কিছু খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চারিদিবে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একদল পোকা তাদের নাইট ক্লাবে কনসার্ট বাজাতে ব্যস্ত।
ঘুম ভাঙলো মোরগের অবিশ্রান্ত ডাকে। সূর্যের আলো আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সুপারি গাছগুলো যেন ঘুম থেকে উঠে রোদ পোয়াচ্ছে। বারান্দায় চেয়ারে বসে সায়েব দেখছিলেন একটা লোক কোমরে গামছা বেঁধে তরতর করে খেজুর গাছের মাথায় উঠে গেল। সেখানে লালরঙের মাটির পাত্র ঝুলছে। স্নানের ডাক পড়েছে, সায়েব ভিতরে চলে গেলেন।
স্নানঘর থেকেই বেশ কিছু লোকের গলার শব্দ তিনি শুনতে পেলেন। বেরিয়ে এসে দেখলেন, সুখদা গ্রামের অনেকে দেখা করতে এসেছে। বাঙালী প্রথায় হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে সায়েব সবার মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। কয়েকজন ভয়ে দূরে সরে গেল, খুব কাছে গেলে পাছে সায়েব চটে যান। দু’একজন সঙ্গে ডাব এনেছে। “কোকোনাট স্যার, ভেরী গুড ভেরী সুইট।” সায়েব হেসে বললেন, বোঝাতে হবে না, কলকাতায় অনেক ডাব খেয়েছি। বিলেতেও পাওয়া যায়।”
দলের কয়েকজনের ডাক পড়লো। সেদিনের ঘটনার বিবরণ তাদের মুখে সায়েব শুনতে চান।
গ্রামের মোড়লদের চোখ বড়ো-বড়ো হয়ে উঠলো। “আমরা নিরপরাধ পাশের গাঁয়ে হিন্দুদের বাস। সেখানে আমাদের ধীরেন এক বিঘে জমি কেনে। কিন্তু হিন্দুরা আমাদের দেখতে পারে না। সকালে ধীরেন লাঙ্গল দিতে যাবার কিছু পরেই ওরা দল বেঁধে তেড়ে আসে; বলে জমিতে চাষ করতে দেবে না। সঙ্গে তাদের লাঠিসোটা। মারামারিতে আমাদের অনেক জখম হয়েছে। কিন্তু পরেরদিন পুলিশ গাঁয়ের অর্ধেক লোককে চালান দিলো। আমরা শুনলাম, হিন্দুদের কে একজন খুন হয়েছে। হিন্দু পুলিশ, সে-তো আমাদের ধরবেই, কিন্তু আমরা কিছুই জানি না।”
“আপনারা একদম কিছু জানেন না, কেমন করে সম্ভব?”
উপস্থিত সকলে সমস্বরে বলে উঠলো, “সত্যি আমরা নিরপরাধ। খ্রীস্টানদের এখানে কেউ দেখতে পারে না।”
সায়েব আবার বললেন, “দেখুন, আপনাদের আত্মীয়-স্বজন যারা এখন হাজতে রয়েছে, তাদের বাঁচাতে হলে আমাকে সব কিছু জানতে হবে। হিন্দুদের একজন খুন হয়েছে, অথচ আপনাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, কী করে বিশ্বাস করি?”
সবাই ভয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। তারা যে কিছু চেপে রাখতে চেষ্টা করছে তা সায়েবের বুঝতে দেরি হলো না।
“সত্যকথা না বললে এ-মামলায় আমি কিছু করতে পারবো না। হিন্দুরা দল বেঁধে মারতে এল, আপনারা নিরস্ত্র, অথচ তাদের একজনের মৃত্যু হলো— অবিশ্বাস্য। আসল ঘটনা আপনারা যদি না বলেন, আমি আর সময় নষ্ট করতে পারবো না, আজকেই কলকাতায় ফিরবো।”
ফিসফিস করে বাংলায় আলোচনা চলতে থাকে। এমন সময় পিছনের একটি ছেলের দিকে সায়েবের নজর পড়লো। সে যেন সামনে আসতে চাইছে, অথচ কয়েকজন লোক তাকে জোর করে ধরে রেখেছে। কিছুতেই এগোতে দিচ্ছে না। সায়েব তৎক্ষণাৎ ছেলেটাকে ডাকলেন। সে এবার লোকগুলোর হাত ছাড়িয়ে কাছে এসে দাঁড়ালো। পিছনের এক বৃদ্ধ হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লো, “ও বাবা, তুই যাস না। ও বাবা তুই যাস না।”
ছেলেটি একবার পিছন ফিরে আবার সামনে তাকালো। সুঠাম ইস্পাতের মতো চেহারা। বয়স বোধহয় আঠারো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের দীর্ঘ শরীর যৌবন- দীপ্তিতে পরিপূর্ণ।
সবাইকে চলে যেতে বলে সায়েব ঘরে ঢুকে গেলেন, পিছনে ছেলেটি। নাম নরেন। সায়েব ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আধঘণ্টা পরে সায়েব দরজা খুলে নরেনের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন। “পারবে তো বলতে?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন। “নিশ্চয়ই পারবো। সত্যকথা বলার সৎসাহস আমি রাখি।” বুক ফুলিয়ে নরেন উত্তর দিলে।
“বাঃ, এই তো স্পোর্টসম্যানের মতো কথা।”
ছেলেটি নমস্কার করে সামনের দিকে পা বাড়ালো।
কী যেন ভাবলেন সায়েব। ডাকলেন, “নরেন, নরেন শুনে যাও।” নরেন আবার ফিরে এল। তিনি বললেন, “তোমাকে শেষবারের মতো জিজ্ঞাসা করে নিচ্ছি। কোর্টে গিয়ে পিছিয়ে আসবে না তো?”
নরেন বোধ হয় সামান্য বিরক্ত হলো। বললে, “আমি যে মুগুর দিয়ে ব্যায়াম করি সেটা ছুঁয়ে বলতে পারি, পিছিয়ে আসবো না।”
পিঠে স্নেহভরা একটা চাপড় দিয়ে সায়েব বললেন, “কিন্তু মনে থাকে যেন স্বেচ্ছায় তুমি এই পথে এসেছো। সমস্ত বিপদ জেনেই তুমি মত দিয়েছো। সেটা তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।”
“যা সত্য তা বলার স্পর্ধা আমি রাখি। তাতে যা হয় হবে,” নরেন বুক ফুলিয়ে বললে।
শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ে সায়েবের চোখ দুটো বড়ো-বড়ো হয়ে উঠলো। নরেনকে বললেন, “কিন্তু খুব সাবধান। এখন যেন ঘুণাক্ষরে কিছু প্রকাশ না হয়। তা হলে সমস্ত উদ্দেশ্য পণ্ড হয়ে যাবে। কেউ যেন জানতে না পারে।”
নরেন সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে বিদায় নিলো।
কিছুদিন পরের কথা। বরিশাল কোর্টে তিল ধারণের স্থান নেই। কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার এসেছেন, ভয়ঙ্কর মামলা। সমস্ত শহরে চাঞ্চল্য। সবাই দেখতে চায় ব্যারিস্টাররা কেমন করে কেস্ করে। কাঠগড়ায় সতেরোজন আসামী, ঘোরতর অপরাধে অভিযুক্ত। অভিযোগ প্রমাণিত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিশ্চিত।
পাবলিক প্রসিকিউটর রজত সেন মামলার উদ্বোধন করলেন। পুলিশের ঘোরতর অভিযোগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা। গত দশই জানুয়ারী সুখদা গ্রামের একদল খ্রীস্টান দলবদ্ধভাবে পাশের গ্রামের একটি অসহায় হিন্দু পরিবারকে আক্রমণ করে। আসামীদের হাতে ছিল তীক্ষ্ণ ও বিপজ্জনক অস্ত্রশস্ত্র। হিন্দু ও খ্রীস্টান পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্য অনেকদিনের। এই ঘটনার পূর্বে খ্রীস্টানদের মধ্যে গোপন বৈঠকের সংবাদ পুলিশের জ্ঞাত। রাতের আঁধারে তাদের অধিকাংশ কার্যকলাপ।
হিন্দুদের বাড়ির কর্তা যখন বাধা দিতে এসে নিহত হন বাড়িতে তখন শুধু স্ত্রীলোকেরা ছিলেন। তাঁদেরই একজন শুধু আওয়াজ শুনে ঘটনাস্থলে বেরিয়ে আসেন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শিনী সেই ভদ্রমহিলাটিকেও সরকার সাক্ষ্য দেবার জন্য সময় মতো আহ্বান করবেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির অমুক অমুক ধারায় এক, তিন ও সাত নম্বর আসামী অভিযুক্ত। ভারতীয় দণ্ডবিধির অমুক ধারার উপধারায় চার, ছয়, বারো ও চৌদ্দ নম্বর আসামী অভিযুক্ত। এমন করে রজত সেন সতেরোজন আসামীর বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ পাঠ করে গেলেন।
বক্তৃতায় যতি পড়লো। জজ সায়েব চোখের চশমা নামিয়ে নথিপত্রের দিকে নজর দিলেন। জুরিরা তাঁদের সামনের কাগজে কি সব লিখলেন। জজ সায়েব একে একে প্রত্যেক আসামীকে সম্বোধন করলেন, “তোমাদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এসেছে সে সম্বন্ধে কোনো কিছু বলার আছে?” ধীরে-ধীরে সবাই বললে, “ধর্মাবতার, অভিযোগ মিথ্যা, আমরা নিরপরাধ।”
সাক্ষ্য শুরু হয়। অনেক সাক্ষী। কেউ খ্রীস্টানদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রমাণে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলো। কেউ হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলের বর্ণনা দিলো। দূর থেকে তারা একটি দলকে পালাতে দেখেছে। তাদের মুখ চেনা সম্ভব নয়, তবে তারা সুখদা গ্রামের দিকে পালায়। ডাক্তার সাক্ষ্য দিলেন, কোনো গুরুভার অস্ত্রের আঘাতের ফলেই অঘোর রায়ের মৃত্যু হয়। আঘাতের কয়েকমিনিটের মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। তবে দেহের অংশেও সামান্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। আরও অনেক সাক্ষী কাঠগড়ায় এল। ঈশ্বরের নামে শপথ করে তাদের বক্তব্য জজ-সায়েবকে শোনালো।
এবার প্রত্যক্ষদর্শিনীর সাক্ষ্য। পাবলিক প্রসিকিউটর রজত সেন জানালেন, “ধর্মাবতার, এবার এই নাটকীয় ঘটনার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকে আপনার সম্মুখে হাজির করবো।”
রাইমণি দেবী কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন, তাঁর দেহের কিছুই দেখা যায় না। টানা ঘোমটা—যেন একটা শাড়ি ধীরে-ধীরে হাঁটতে হাঁটতে সবার চোখের সামনে হাজির হলো। রাইমণি দেবীর ভয়ানক লজ্জা, অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। আবার সাধতে হয়। তখন আস্তে-আস্তে উত্তর দেন। প্ৰশ্ন মনঃপূত না হলে তাঁর মাথাটা নড়ে ওঠে। চুড়ির ঠিনিঠিনি আওয়াজ হয়।
রজত সেনের প্রশ্নপর্বের পর সায়েব উঠলেন। জেরা করতে হবে। একজন ইন্টারপ্রিটার সায়েবের প্রশ্ন বাংলা করে সাক্ষীকে শোনান ও তার উত্তর ইংরেজিতে জজ-সায়েবকে বললেন।
“রাইমণি দেবী, মৃত অঘোর রায় আপনার কে?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
উত্তর—“আমার ভাশুর।”
“আপনার বয়স কত?”
চুড়ির ঠিনিঠিনি আওয়াজ হয়, মাথাটা নড়ে ওঠে। ইন্টারপ্রিটার বললেন, ধর্মাবতার, উনি লজ্জা পেয়েছেন উত্তর দিতে চাইছেন না।
আবার প্রশ্ন, “রাইমণি দেবী, আপনার বয়স কত?”
আবার চুড়ির ঠিনিঠিনি। তবে উত্তর এল, “অনেক।”
“এই দাঙ্গা যখন ঘটে তখন আপনি কী করছিলেন?”
“মুড়ি ভাজছিলাম।”
“তখন সময় কত?
“আমাদের বাড়িতে ঘড়ি নেই।”
“তবু আন্দাজ—”
“সূর্য ওঠার ঘণ্টাখানেক পরে।”
রাইমণি দেবী ক্রমশ বললেন, ভয়ানক আওয়াজ শুনে তিনি বাইরে ছুটে আসেন। সত্তর-আশিজন লোক পাগলের মতো তাঁদের পাশের জমির দিকে ছুটে আসছে। হাতে তাদের কতরকমের যন্তর। লাঠিসোটা তো আছেই। একসঙ্গে তাদের দেখেছেন, তাই সকলকে চিনে রাখা সম্ভব নয়। তবে যারা কাছাকাছি ছিল রাইমণি তাদের মুখ ভোলেন নি।
“ওই যে ছ’ নম্বর আসামী, ওই আমার ভাশুরের হাত চেপে ধরে। চার নম্বর আসামী তাঁর চুলের মুঠিতে হাত দেয়। তিন নম্বর তখন লাঠি ঘুরিয়ে নাচছিল। দু’নম্বর তাঁর মুখে ঘুষি মারতে থাকে।” এসব রাইমণি দেবীর ছবির মতো মনে আছে। তারপর কোথা থেকে এক নম্বর আসামী তীরের মতো ছুটে আসে। হাতে তার অদ্ভুত যন্ত্র, রাইমণি দেবী তার নাম জানেন না।
সবাইকে সরিয়ে দিয়ে দুরন্ত পশুর মতো, সেই যন্ত্রটা দিয়ে এক নম্বর আসামী আমার ভাশুরকে…” রাইমণি দেবী আর বলতে পারলেন না। কান্নার শব্দ শাড়ির আবরণ ভেদ করে কোর্ট-ঘরে ছড়িয়ে পড়লো।
“রাইমণি দেবী, এবার আপনার সামনে একটি ছেলেকে হাজির করবো।”
কোর্টের মধ্যে নরেনকে দেখা গেল। সে কাঠগড়ার খুব কাছে রাইমণি দেবীর সামনে এসে দাঁড়ালো।
“ছেলেটিকে ভালো করে দেখুন, চেনেন কিনা।”
ঘোমটার ফাঁক দিয়ে একটি তীব্র দৃষ্টি নরেনের উপর এসে পড়ে। কিছুক্ষণ নীরবতা। “না, একে কখনো দেখিনি।”
“খুব ভালো করে দেখুন, সেদিন ঘটনাস্থলে ছেলেটিকে দেখেছেন কিনা।”
“না, দেখিনি।” রাইমণি দেবী দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন।
সরকারপক্ষের সাক্ষ্য এখানেই শেষ। লাঞ্চের পর সায়েব উঠলেন। বললেন, “ধর্মাবতার, আমি মাত্র একটি সাক্ষী উপস্থিত করবো।” জজ-সায়েব চমকে উঠলেন, “সরকারপক্ষের যেখানে পঁচিশজন সাক্ষী সেখানে আপনার মাত্র একজন?” তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
“ইওর অনার, সাক্ষ্য গ্রহণের পূর্বে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। আমার সাক্ষীর বক্তব্য অনেককেই চমকিত করতে পারে। তার বক্তব্য অবিশ্বাস্য বলে অনেকের সন্দেহ হতে পারে। এই মামলার আসল সত্য উদ্ধারের জন্যে প্রথম থেকে আমি আগ্রহশীল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সব সময় প্রকৃত সত্যের প্রতি আমরা যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করি না। এদেশের বিচারকের পক্ষে তাই প্রকৃত সত্যকে মিথ্যা ও অতিভাষণের খাদ থেকে মুক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। একটি বিশেষ পক্ষের হয়ে এখানে উপস্থিত হলেও আমি বিচারকের সেই কঠিন কর্তব্যের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল।”
নরেন কাঠগড়ায় দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি কঠিন, মুখাবয়ব ভয়লেশহীন।
“নরেন, এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে তুমি কী জানো?”
ঘরে যেন বাজ পড়লো। জজসায়েব চমকে উঠলেন। জুরিদের ফোরম্যান নিজেদের অজান্তে বলে উঠলেন, “এ্যা!” রজত সেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
“হ্যাঁ, আমিই খুন করেছি। সেদিন খুব সকালে আমার দুই কাকার সঙ্গে হিন্দুদের গাঁয়ে আমাদের নতুন জমিতে লাঙ্গল দিতে যাই। আমি নিজে চাষ করি না। শুধু শখ করে কাকাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম। সকালে খোলা জায়গায় ব্যায়াম করা আমার অনেক দিনের অভ্যাস। জমিতে এসে ছোটকাকা লাঙল ধরলেন, মেজোকাকা হুঁকো টানতে লাগলেন। আমি একটু দূরে মুগুর ভাঁজতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে মেজোকাকা লাঙল ধরলেন, এবার ছোটোকাকার বিশ্রাম। জমির লাগোয়া যাঁদের বাড়ি সেই অঘোর রায় ছুটে এলেন। জমিতে লাঙল চালানোয় তাঁর আপত্তি; এ-জমির জন্য তিনি নাকি আগেই বায়না দিয়েছেন। ছোটোকাকা মানতে রাজী নন। টাকা দিয়ে তাঁরা জমি নিয়েছেন। কে আগে বায়না করেছিল তাতে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। ক্রমশ বচসা বেড়ে ওঠে। অঘোর রায় হঠাৎ ছোটোকাকার পেটে সজোরে লাথি মারলেন। ছোটোকাকার চিৎকারে আমি দ্রুতবেগে ছুটে এলাম। অঘোর রায় তখন ছোটোকাকার বুকের উপর বসে তাঁর গলা টিপে ধরার চেষ্টা করছেন। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। দুরন্ত রাগে কোন্ সময় ডান হাতের মুগুরটা অঘোরের মাথায় বসিয়ে দিয়েছি নিজেই জানি না। অঘোর মাটিতে শুয়ে পড়তে সম্বিত ফিরে পেলাম। একি করেছি! অঘোরের মাথা ফেটে রক্তের নদী বইছে। দেহ নিশ্চল। লাঙল নিয়ে আমরা তিনজনে দ্রুতবেগে পালালাম।
তারপর পুলিশের অনুসন্ধান। আমাদের গ্রামের প্রায় সবাইকে তারা হাজতে নিয়ে যায়। শুধু আমিই কেমন করে বাদ পড়ে যাই। আমি তখন পাশের গ্রামে বোনের বাড়িতে রয়েছি।”
কোর্টঘর নিস্তব্ধ। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে হত্যাপরাধ স্বীকার, এর আগে কেউ দেখেনি। ছেলেটির আইনের হাতে পরিণামের কথা কল্পনা করে অনেকে শিউরে উঠলো। আহা রে, কতই বা বয়েস।
সায়েব আবার দাঁড়ালেন। “ধর্মাবতার, আমি আর কোনো সাক্ষী উপস্থিত করবো না। আসামী পক্ষের মামলা এইখানেই শেষ।”
জজ জুরিদের দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে মামলার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করার কর্তব্য তাঁরই, দোষী নির্দোষ নির্ধারণের ভার জুরিদের। রুদ্ধদ্বার আলোচনার জন্য জুরিরা কোর্টঘর ত্যাগ করলেন। অধীর আগ্রহে সকলে প্রতীক্ষা করছে। জুরিদের কত দেরি হবে কে জানে?
কিন্তু বেশী দেরী হলো না। মাত্র পাঁচ মিনিট। জুরিরা ফিরে এসেছেন। জুরিদের ফোরম্যান উঠে দাঁড়ালেন।
মিস্টার ফোরম্যান এণ্ড জেন্টলমেন অফ দি জুরি, হ্যাভ ইউ কাম টু এ ডিসিশন?
“ইয়েস ইওর অনার।”
……………….
“নট গিল্টি।”
আসামীরা মুক্ত।
কোর্টঘরের বাইরে সুখদা গ্রামের অনেকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার মুখে হাসি। গম্ভীরমুখে নরেনও তাদের মধ্যে রয়েছে। সায়েব তার পিঠে হাত রেখে বললেন, “তুমি আমাদের হিরো। সত্যকথা বলবার এমন সৎসাহস আমি কখনও দেখিনি। তোমার জন্যই এতোগুলো নিরপরাধ লোকের মুক্তি হলো।”
কিন্তু সবার মুখ হঠাৎ আবার কালো হয়ে উঠলো। নরেনের বাবা কাঁদছেন। কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, “কিন্তু আমার যে সর্বনাশ হলো। নরেনের তো ফাঁসি হয়ে যাবে।”
সায়েব হাসলেন। নরেনের বাবাকে বললেন, “আমাদের সৌভাগ্য যে, আপনার ছেলে হত্যাকাণ্ডের দিন পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। কিন্তু আর বিশেষ ভয় নেই। আপনার ছেলেকে এখন পুলিশ ধরে কিছুই করতে পারবে না। কেননা কেবল আদালতে নরেনের স্বীকারোক্তির উপর নির্ভর করে শাস্তি বিধান আইনসঙ্গত নয়। তার জন্য আরও সাক্ষ্যের প্রয়োজন। কিন্তু এক্ষেত্রে পুলিশ সাক্ষী কোথায় পাবে? এই ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী রাইমণি দেবী তো আদালতে বলেই দিয়েছেন নরেনকে তিনি ঘটনাস্থলে দেখেননি। নরেনের বিরুদ্ধে নতুন কেসে তিনি আবার বলতে পারেন না যে, নরেনকে তিনি দেখেছেন। সুতরাং…।”
.
ঘড়ির দিকে তাকালেন সায়েব। বললেন, “চলো, এবার মধ্যাহ্ন ভোজনপর্বটা শেষ করে নেওয়া যাক।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “পুলিশ নরেনকে তারপর কী করলো?”
সায়েব বললেন, “আমরা কয়েকমাস অপেক্ষা করলাম। কিন্তু পুলিশ কিছু করতে সাহস করলো না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো? কলকাতার তখনকার পুলিশ কমিশনারকে একদিন আমি এই গল্পটা শুনিয়ে বলেছিলাম, এই রকম সাহসী ছেলে, যে ফাঁসিকাঠের ভয় না করে কোর্টে সত্যকথা বলতে পারে, তাকে পুলিশবাহিনীতে নেওয়া উচিত। পুলিশ কমিশনার আমার কথা রেখেছিলেন। নরেন পুলিশে কাজ করে।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন