কত অজানারে – ৭

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

আমার টেম্পল চেম্বারে আসবার পর সায়েব যে সব মামলা করছিলেন তার বিষয় বিভিন্ন। রেল কোম্পানির সঙ্গে কয়েকটা মামলা সাত-আটদিন ধরে চললো। গাদা-গাদা কাগজ টাইপ করেছি, কিন্তু বিষয় এতোই নীরস যে হাঁপিয়ে উঠেছি। রেল কোম্পানির পর এক ট্রেডমার্কের কেস্, আরও নীরস, আরও জটিল।

তারপর একদিন চেম্বারে এলেন লেডী টাইপিস্ট হেলেন গ্রুবার্ট।

হেলেন সুন্দরী না হলেও কুৎসিত নয়। শ্যামাঙ্গী। হাতে অতি আধুনিক রুচির ভ্যানিটি ব্যাগ। মুখে কয়েকটা ছোটো ছোটো কালো দাগ। ঠোটের রঙ লিপস্টিকের কল্যাণে মা-কালীর জিভের মত লাল। পরিচ্ছন্ন বেশবাস। স্কার্টের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ কিংবা স্বচ্ছতা শালীনতার আইন লঙ্ঘন করেনি।

সায়েবের অনুমতি নিয়ে হেলেন সিগারেট ধরালো। রাঙা ঠোটে সাদা রেড এ্যাণ্ড হোয়াইট সিগারেট বিশ্রী দেখায়।

হেলেনের হাসি যেন কেমন লাগে। মনে হয়, শয়তানীতে ভরা। সারা দেহের কোথাও যেন স্নেহ মমতা নেই।

হেলেন গ্রুবার্ট মামলা করতে চায়। ক্ষতিপূরণের মামলা। কে একজন তাকে বছরখানেক প্রেম নিবেদন করে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়; এখন তার মতের পরিবর্তন হয়েছে। হেলেনকে সে ছাড়তে চায়, কিন্তু হেলেন তাকে ছাড়বে না। জলে নেমে পিছিয়ে আসা চলবে না। আসতে হলে কিছু খরচ করতে হবে।

হেলেন হি-হি করে হাসে। দশ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণের মামলা করবে সে। ব্রীচ অফ প্রমিস অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মামলা। সেইজন্যই ব্যারিস্টারের কাছে আসা।

হেলেনের হাসিতে আমার কেমন ঘৃণা বোধ হয়। প্রেমের পথে এত চোরাবালি কে জানে? তারই সুযোগ নিয়ে হেলেন কাউকে শোষণ করতে চায়। হেলেনের এককালের মনের মানুষ সুরজিৎ রায়ের জন্য দুঃখ হয়। বেচারা বোধ হয় পার্ক স্ট্রীটের উত্তরের জগতের আসল রূপটি জানে না; তাই জালে পড়েছে। হেলেন এখন সেই জাল গুটোতে চায়। কোর্টে মামলা করে দশ হাজার টাকা শুষে নেবে সে। চেম্বারে আসার আগেই বা কত নিয়েছে কে জানে।

ব্রীচ অফ প্রমিসের মামলা এদেশে বড়ো একটা হয় না। বিলেতে অবশ্য ভুরি- ভুরি মামলা হয় এই নিয়ে। আইনের চোখে বিয়ে এক ধরনের কন্ট্রাক্ট, একটা চুক্তি। কন্ট্রাক্ট আইনে চুক্তি ভঙ্গ হলে চুক্তি ভঙ্গকারীকে খেসারত দিতে হয়। কোনো ভদ্রলোক হয়তো একটি মেয়েকে বললেন, তোমায় বিয়ে করবো। মেয়েটি যে মুহূর্তে সম্মতি জানালেন, অমনি দু’জনের মধ্যে আইনের চোখে কন্ট্রাক্ট হয়ে গেল। পরে ভদ্রলোকটির যদি মত পরিবর্তন হয় এবং পূর্বেকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন, তাহলে ভদ্রমহিলা খেসারত আদায় করতে পারেন।

হেলেন গ্রুবার্ট ক্ষতিপূরণ চায় :—

গুরুতর মানসিক আঘাত – ৫,০০০ টাকা

সমাজে সম্মানহানি – ৩,০০০ টাকা

ভবিষ্যতে অন্য স্বামী লাভের অসুবিধা – ২,০০০ টাকা

মোট – ১০,০০০ টাকা

এ হিসেব হেলেনের নিজের তৈরি। সুরজিৎ রায়ের প্রত্যাখ্যানে রাতে তার ঘুম হয় না। ডাক্তার বলেছেন, এ গুরুতর নার্ভের ব্যাধি, তীব্র মানসিক আঘাতের ফল। এমন ক্ষতির জন্য পাঁচ হাজার টাকা অতি সামান্য।

সমাজে অনেকে জেনেছে, হেলেন গ্রুবার্ট সুরজিৎ রায়ের বাগদত্তা, শীঘ্র ওরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে ঘর করবে। বান্ধবীরা তাই জানে, মায়ের বন্ধুরাও তাই শুনেছেন। এলিয়ট রোডের সোসাইটিতে একথা কারও অজানা নয়। সবাই জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের বিয়ে হচ্ছে কবে? সে সমাজে হেলেনের মানহানি হয়েছে। এর জন্য তিন হাজার খুব ন্যায়সঙ্গত। অন্ততঃ হেলেনের মত তাই।

ভবিষ্যতে বিয়ের বাজারে তার স্বামী পাওয়া শক্ত হবে। সুরজিতের জন্য কত ছোকরাকে সে প্রত্যাখ্যান করেছে। দরকার হলে তাদের নাম দিতে পারে হেলেন। জন ফিলিপস, বব ডিক্সন, লায়নেল ডিকোস্টা কোর্টে সাক্ষ্য দিতে রাজী। এদের যে কোনো একজনকে সে বিয়ে করতে পারতো, কিন্তু সুরজিতের জন্য সব নষ্ট হয়েছে। হেলেন গ্রুবার্ট নেহাৎ দয়াপরবশ হয়ে, এই ক্ষতির জন্য দু’হাজারের বেশি চাইছে না।

মুখে একটু হাসি জাগিয়ে রেখে সায়েবকে হেলেন এসব বোঝাতে চেষ্টা করছে। সেই হাসি আমার নোংরা মনে হয়েছে। আরও খারাপ লেগেছে হেলেনের বুড়ী মাকে। মায়ের রঙ কাজল কালো। বয়সের স্রোতে গায়ের চামড়া কুঁচকে কিশমিশের মতো দেখালেও, রুজ ও লিপস্টিক ব্যবহারে আগ্রহ কমেনি। হাতের অনাবৃত অংশে তেলের অভাবে খড়ি উঠেছে। বুড়ীর একটি পা বোধ হয় অন্যটি অপেক্ষা সামান্য ছোটো। তাই চলার সময় দেহটা বেঁকিয়ে হাতের লাঠিটা এগিয়ে দিতে হয়। তার আগ্রহ ও উৎসাহ মেয়ের থেকে অনেক বেশি।

মিসেস গ্রুবার্ট মেয়ের কাছেই থাকে, মেয়েকে আগলে বেড়ায়। বুড়ী হলদে দাঁতগুলো বার করে সায়েবকে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলে, টাকার পরিমাণটা কিছু বাড়ানো যায় কি না।

হেলেন গ্রুবার্টের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শুনে সায়েব বললেন, “কেসের জন্য প্রমাণ চাই। সাক্ষীর প্রয়োজন হবে। সুরজিৎ রায় যে সত্যি বিয়ে করতে চেয়েছিল, তারও প্রমাণ দিতে হবে।”

বুড়ী মিসেস গ্রুবার্টের মুখে একগাল হাসি। “হুঁ-হুঁ আমি আগে থেকেই জানি যেদিন থেকে ও-ছোঁড়া হেলেনের পিছনে ঘুরছে, সেদিনই হেলেনকে বলেছিলাম, চিঠিপত্র কিছু হারিও না, যত্ন করে রেখে দিও। ওসব কাগজপত্র কখন দরকার লাগবে, কেউ জানে না।”

হেলেনের ভ্যানিটি ব্যাগটা ফুলে রয়েছে। ব্যাগের বোতাম টেপার আওয়াজ হয়। হেলেনের নধর নরম হাতখানি ব্যাগের ভিতর ঢুকে গেল। ভিতরে একরাশ চিঠির বাণ্ডিল। প্রিয়া হেলেনকে লেখা সুরজিৎ রায়ের চিঠি।

স্থিরভাবে হেলেন চিঠিগুলো সায়েবের দিকে এগিয়ে দিলো। সন্ধানী দৃষ্টিতেও হেলেনের মধ্যে কোনো সঙ্কোচের ভাব আবিষ্কার করতে পারলাম না। পয়সার জন্য ওরা সব পারে, আমার মনে হলো।

“চিঠিগুলো পড়ে দেখবেন,” এই বলে হেলেন ও তার মা সেদিনের মতো বিদায় নিলেন। মা ও মেয়ের হাই-হিল জুতোর খট খট আওয়াজ লিফটের কাছে এসে মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে সায়েব আমাকে ডাকলেন। চিঠির বাণ্ডিলটা তাঁর সামনে পড়ে রয়েছে। তিনি বললেন, “অসম্ভব। এ হাতের লেখা পড়তে গেলে মাথা ধরে যাবে। তুমি বরং আস্তে-আস্তে চিঠিগুলো টাইপ করে দাও। তারপর আমি পড়ে দেখবো।”

খান পঞ্চাশ চিঠি। টাইপরাইটারটা ডানদিকে সরিয়ে দিয়ে চিঠিগুলি রাখলাম। প্রতিটি চিঠি টাইপ করতে হবে।.

একটি প্রেম-কাহিনীর সম্পূর্ণ ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে এই চিঠির জঙ্গলে। কল্পনার স্টেথিস্কোপে আজও শোনা যেতে পারে দুটি যুবক-যুবতীর উষ্ণ প্রাণের স্পন্দন। নীল কাগজে ছোটো ছোটো হরফে লেখা সুরজিতের চিঠি। ওগুলো এখনও চিঠি—একজনকে লেখা এক যুবকের একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি। আমি তাদের নকল করবো। একজনের পরম বিশ্বাসে লেখা চিঠির মৃত্যু হবে। ব্যারিস্টারের ব্রীফের ভিতর পড়ে থাকবে তাদের মৃতদেহ। কোর্টের কেরানী নাকে চশমা লাগিয়ে চিঠির উপরে কালো কালিতে লিখবে এগজিবিট নম্বর অমুক।

কিন্তু সুরজিত রায়ের হস্তলিপির পাঠোদ্ধার প্রায় অসম্ভব। প্রতি কথা বুঝে টাইপ করতে হলে তিন দিন লেগে যাবে। টেলিফোন তুলে নিলাম। হেলেনের ফোন নম্বর জানা আছে। তাকে বললাম, “মিস্ গ্রুবার্ট, আপনার চিঠির বাণ্ডিলের অনেক কথা পড়তে পারছি না। কখন আপনার সময় হবে?”

হেলেন বললেন, “এখনি যাচ্ছি। আমার আজ বিশেষ কাজ নেই।”

আধঘণ্টার মধ্যে হেলেন টেম্পল চেম্বারে উপস্থিত হলো। জামা কাপড়ের বাহারটা আজ একটু বেশি। উগ্র সেন্টের গন্ধ। ঘামে পিঠের কাপড় ভিজে উঠেছে। হেলেনকে দেখে বললাম, “এমন দুর্বোধ্য হাতের লেখা সহজে চোখে পড়ে না।”

ফিক করে হাসলো সে। বললে, “আমার কিন্তু মোটেই আটকায় না। আমি বসে থাকবো। আপনি টাইপ করে যান। আটকালেই বলে দেবো।”

টেবিলের অন্যদিকে চেয়ারে বসলো সে। জিজ্ঞাসা করলে, “আপনার সায়েব কোথায়?”

“কোর্টে গিয়েছেন।”

“স্মোক করতে পারি?” সিগারেটের একটা দিক টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে হেলেন জিজ্ঞাসা করলো। অনুমতি পাবার আগেই সে সিগারেট ও লাইটারটা বার করে ফেলেছে। শুধু আগুন ধরাবার অপেক্ষা।

সেন্ট ও সিগারেটের গন্ধ মিশিয়ে নাকে আসছে। চিঠির বাণ্ডিলের দিকে নজর দিলাম।

সুরজিতের চিঠি নীল কাগজের প্রথম পাতায় শেষ হয় না। পাতার পর পাতা চলে একই চিঠি। চিঠি থেকেই তুলে দিই।

“….আমার দুষ্টু মেয়ে, এ-চিঠি চারের পাতায় পড়লো। টেবিলে বসে লিখতে হলে অনেক আগেই তোমার নরম ঠোটের উদ্দেশে একটি চুমা জানিয়ে ইতি টানতাম। কিন্তু বিছানায় আধশোয়া হয়ে নিশীথ রাতে চিঠি লেখায় সত্যি রোমাঞ্চ জাগে। সারা রাত আমি লিখে যেতে পারি, পাতার পর পাতা, যে-চিঠির আদি আছে, অন্ত নেই। শুরু আছে শেষ নেই। …”

চিঠির শেষ এখানেই নয়, আরও কয়েক পাতা আছে। নীল কাগজের বুকে কালো কালির আঁচড়ে সুরজিতের আবেগ বাসা বেঁধেছে।

হাসতে ইচ্ছা করে আমার। সুরজিৎ অপাত্রে তার ভালোবাসা দিয়েছে। এলিয়ট রোডের হেলেন তার প্রতিটি চিঠি সযত্নে রক্ষা করেছে। ভালোবাসার জন্য নয়, আদালতের সম্ভাব্য দলিল হিসেবে। কিন্তু এসব ভাবার কোনো অধিকার তো আমার নেই। আমি শুধু টাইপ করে যাবো।

হেলেনের হাতে পকেট-বুক সিরিজের একটা রঙচঙে আমেরিকান রহস্য- উপন্যাস। সে পড়তে আরম্ভ করে—আমিও টাইপ শুরু করি।

সুরজিতের লেখা প্রায়ই আটকায়। মেশিনের আওয়াজ বন্ধ হলেই হেলেন হেসে মুখ তুলে চায়। চিঠির উপর ঝুঁকে অংশ বিশেষ পড়ে দেয়। আমার মেশিন আবার চলতে থাকে, হেলেন গ্রুবার্টও ফিরে যায় বই-এর জগতে।

সময়ের অনুক্রমে চিঠিগুলো সাজিয়ে নিলাম। একটা নীল চিঠি তার পরেই পাতলা কাগজে হেলেনের উত্তর। প্রতিটি চিঠির নকল রেখেছে হেলেন। কোনো চিঠিই তার নিজের হাতের লেখা নয়। একটা চিঠিতে হেলেন লিখেছে—

“ডার্লিং,

টাইপকরা চিঠি পেয়ে রাগ করো না। এ চিঠি হাতের লেখারই সমান। আমার টাইপরাইটার মেশিনটি বড়ো ভালো। যন্ত্র হলেও আমার মনের কথা বোঝে। মনের কথা শোনবার জন্য এতদিন শুধু ওই ছিল; আজ তোমাকে পেয়ে তার দায়িত্ব কমলো। তবু মনে হয়, তোমার-আমার দেওয়া-নেওয়ার মূক সাক্ষীরূপে ওকে রেখে দেই। ও আমাকে লজ্জা দেবে না, হিংসে করবে না।

সত্যি বলছি, তোমার চিঠি টাইপ করার সময় এক অনাস্বাদিত- পূর্ব রোমাঞ্চ অনুভব করি; সারাদিন কত চিঠি টাইপ করি; কিন্তু তাতে থাকে ভিজে পাটের হিসেব, কিংবা চায়ের বাজার দর। ‘ডিয়ার সার’ ও ‘ডিয়ার সারস্’-এর মরুভূমিতে ‘ডার্লিং’ লিখতে বুকের ভিতর কেমন লাগে। কবে আসছো দেখা দিতে?

ইতি–
তোমারই হেলেন”

প্রশ্নটা সঙ্গে-সঙ্গে জেগে উঠলো। হেলেন গ্রুবার্ট নিজেই টাইপিস্ট। মেশিন বন্ধ করে বললাম, “মিস্ গ্রুবার্ট, আপনি নিজে টাইপ করলে তো অনেক তাড়াতাড়ি হতো। লেখা পড়তে আপনার কোনো অসুবিধে নেই।”

হেলেন মুখ তুললে। তার গলার হারের ছোট্ট লকেটটা দুলে উঠে কেন্দ্র থেকে সরে গেল। মুখ শুকিয়ে গিয়েছে তার। কোনো রকমে ঢোক গিলে বললে, “হ্যাঁ, সত্যি তো, আমি নিজেই তো টাইপ করতে পারি কিন্তু…” হেলেন কিছুক্ষণ ভাবলে। পরমুহূর্তেই বললে, “না-না, ওসব আমি পারবো না।”

বেশ রাগ হলো আমার। কিন্তু বলা যায় না কিছু। তাই উত্তর না দিয়ে দুটো সাদা কাগজের মধ্যিখানে কালো কার্বন পরিয়ে অক্ষরে চাবি টিপতে আরম্ভ করলাম, – মাই সুইট লিটল হেলেন…’

“রাগ করলেন?” আমার মুখের উপর বেশ খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে হেলেন জিজ্ঞাসা করলে।

ধোঁয়ার চোটে রাগটা বাড়লেও, বললাম, “না-না রাগের কী আছে। চিঠিগুলো টাইপ করা আমারই কাজ, আপনার নয়।”

টাইপ করতে লাগলাম—

“প্রিয় মিস্ গ্রুবার্ট,

সে দিনের পরিচয়টা নষ্ট করতে চাই না। ট্যাক্সি থেকে নেমে শুভরাত জানানোর আগে আপনিও তাই বলেছিলেন। আগামী শনিবার বিকেলে খুব ব্যস্ত থাকবেন নাকি? না হলে, চারটের সময় পার্ক স্ট্রীটের রেস্তোরায় আসলে আনন্দিত হবো।

শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি–

সুরজিৎ রায়”

“সেদিনের পরিচয়টা কিসের জানেন?” হেলেন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে।

“না। জানবার দরকারও নেই। প্রয়োজন হলে সায়েরকে বলবেন।” আমি উত্তর দিলাম।

হেলেন কিন্তু শুনলে না। বলতে লাগলো-

ওই ‘সেদিন’ থেকেই কাহিনীর শুরু। হেলেন গিয়েছিল এক পার্টিতে। সেখানে বল-ডান্স হচ্ছে। ঘরের কোণে নাচের বাজনা শরীরে চাঞ্চল্য জাগাচ্ছে। অনেকে নাচছে। হেলেনের বান্ধবীরা নাচছে তাদের ফিয়াঁসের সঙ্গে। হেলেন চুপচাপ সোফা থেকে তাদের অঙ্গভঙ্গী দেখছে। মিসেস রেম নীল আলোয় পিয়ানো ফটিতে সুরের মূর্ছনা তুলছেন। পার্ক স্ট্রীটের দক্ষিণের এই সব সামাজিক উৎসবের সঙ্গে হেলেনের পরিচয় নেই। সবার অলক্ষ্যে সময়টা কাটাতে পারলেই সে বাঁচে।

“আজকের রাতে চুপচাপ বসে থাকতে দিচ্ছি না। আসুন; যদি কোনো আপত্তি না থাকে, আমরা দু’জন—”

হেলেন চমকে উঠে সামনের দিকে তাকালো। নিখুঁত ইভনিং ড্রেসে সজ্জিত একটি যুবক ওকে ডাকছে। মৃদু হাসলো ছেলেটি। তার সাদা চকচকে দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠলো। হেলেনের ভয় লাগছে। নাচে তার তেমন অভ্যাস নেই। তালে ভুল হয়। বুড়ী মিসেস হিগিনের নাচের ইস্কুলে মাত্র দু’মাস গিয়েছিল সে। মাইনে দিতে না পারায় আর যাওয়া হয়নি।

“এই যে আসুন; বসে রইলেন কেন?”

হেলেন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ উত্তর না দেওয়া অভদ্রতা। হেলেনের বুকটা কেমন করে ওঠে। ভদ্রলোক কী ভাববেন, নাচ না শিখে বল-এ আসা। তবু সে উঠে দাঁড়ালো। কিছু বলবার আগেই ভদ্রলোক তার বিশাল বাহু দিয়ে হেলেনকে যেন লুফে নিলেন। ওরা ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়েছে।

“আমি সুরজিৎ রায়।”

“আমি হেলেন গ্রুবার্ট।”

“বাঃ চমৎকার নাম। প্যারিস নামে এখানে কেউ থাকলে আমাকে আপনার সঙ্গে নাচতেই দিত না নাচের মধ্যে সুরজিৎ আস্তে আস্তে বললে।

“আমার কিন্তু ডান্স ভালো জানা নেই। কেমন ভয় লাগছে।” নাচের মধ্যে হেলেন ফিস-ফিস করে উত্তর দিলে।

“হা ভগবান, এর জন্যেই বুঝি ফ্লোরে আসতে চাইছিলেন না! কিছু ভাবনা নেই, আপনি তো আর কোনো প্রিন্সের সঙ্গে নাচছেন না।” সুরজিৎ হেলেনকে আরও কাছে টেনে নেয়।

হেলেনের সর্বশরীরে অপূর্ব আনন্দের শিহরণ জাগে। সে কোনো উত্তর দিতে পারে না। শুধু তালে তালে পা মিলিয়ে যায়। সুরজিতের পুরুষালী চেহারা, যেন সুঠাম ইস্পাত। তার প্রশস্ত বুক আর চওড়া কব্জি হেলেনের বেশ ভারী মনে হয়। হেলেনকে সে অনায়াসে মাটি থেকে ডল পুতুলের মতো তুলে ফেলতে পারে।

সেই থেকেই দু’জনের পরিচয়। সুরজিতের বয়স বেশি নয়। হেলেনের সমবয়সী কিংবা সামান্য বড়ো হবে।

নাম দেখে আমি ভেবেছিলাম সুরজিৎ বাঙালী। কিন্তু হেলেনই ভুল ভেঙে দিল। বললে, “সুরজিৎ রায়ের বাবা বাঙালী খ্রীস্টান। এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু ছেলের নাম ডেভিড বা জন রাখলেন না। নাম দিলেন সুরজিৎ। ওয়েলেসলী পাড়ায় এমন নাম এর আগে কেউ শোনেনি।

হেলেনের বর্ণনা শেষ হলো। পরের চিঠিটা টেনে নিলাম।

“প্রিয় মিস্ গ্রুবার্ট,

গত শনিবারের কয়েকটি ঘণ্টা মনে রাখবার মতো। আপনি সত্যি খুব ভালো গল্প করতে পারেন। ফেরার পথে বৃষ্টি নেমেছিল, ভিজে যাননি তো? আমার কিন্তু জলে ভিজে ঠাণ্ডা লেগেছে মনে হয়। শরীর খুব সুস্থ বোধ হচ্ছে না।

শুভেচ্ছা জানবেন।

ইতি-
সুরজিৎ রায়।”

.

তার পরের চিঠি-

“প্রিয় মিস্ গ্রুবার্ট,

আপনার চিঠিতে বড়ো আনন্দ পেলাম। শরীর নিয়ে আপনাকে কিছু না লেখাই উচিত ছিল। এমন কিছুই হয়নি; এখন আগেকার মতো আপিস যাচ্ছি। ভালো কথা, আজ সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি একটা ছোট্ট লাল টুকটুকে পাখি জানালায় বসে গান গাইছে। পাখিটার সাহস কম নয়। আগামী শনিবার নিশ্চয় দেখা হবে। ইতি—”

শনিবারের অপরাহ্ণে ওদের দেখা-সাক্ষাৎ বাড়তে থাকে। প্রথমে রেস্তোরাঁয়। ক্রমশ চৌরঙ্গী পাড়ার বিভিন্ন সিনেমায়। বহুদিন আগেকার ঘটনার প্রতিধ্বনি তুলে আমার টাইপরাইটার কাজ করে চলে।

হেলেন গ্রুবার্ট কোন্ সময়ে উপন্যাস পড়া বন্ধ রেখে ছবি আঁকবার জন্য টেবিল থেকে পেন্সিল তুলে নিয়েছিল জানতে পারিনি। হঠাৎ দেখলাম আমার লেখার প্যাডে কতকগুলো বিচিত্র ছবি হেলেনের পেন্সিলের ডগা থেকে বেরিয়ে এসেছে। খুব বৃদ্ধ এক এ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক, সঙ্গে রাস্তার শীর্ণ মৃতপ্রায় একটা কুকুর।

এক চিঠি শেষ করে অন্য চিঠিতে হাত দিই। আমার ডান দিকে টাইপ- করা কাগজের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আর একটা নীল চিঠি টেনে নিলাম।

ইতিমধ্যে চিঠির সুরের পরিবর্তন হয়েছে।

“ডার্লিং হেলেন,

আমার সুইট হেলেন, শোনো। কোনো সংবাদ দাওনি কেন? দু’রাত আমার ঘুম নেই। তোমার ছোটো ফটোটা বার করে যতো দেখি ততো অবাক হই—আবার দেখতে ইচ্ছে করে। কিছুতেই তৃপ্তি হয় না।

কে তোমার নাম রেখেছিল, হেলেন? বহু বর্ষ আগে তুমিই ট্রয় নগর ধ্বংস হবার কারণ হয়েছিলে। আর আজ আমার শান্ত জীবনে ঝড় এনেছো তুমি। দুষ্টু মেয়ে, এখন রাত কত জানো? এইমাত্র আমার ক্লকে দুটো বাজলো। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। এমন বাদলা রাতে দু’জনে দেখা হলে কেমন মজা হতো…”

হেলেনের উত্তর টাইপ করতে কষ্ট হয় না। ঝরঝরে টাইপ করা চিঠি।

“আমার বীরপুরুষ,

চিঠিতে অনেক অভিমান করেছো। রাগও হয়েছে বুঝতে পারছি। কিন্তু সত্যি যদি আমায় ভালোবাসতে তবে চিঠি না লিখে নিজেই আসতে হেলেনের সন্ধানে। কিন্তু না এসে ভালোই করেছো। অত সুখ আমার সহ্য হতো না।

হেলেনের রূপের বর্ণনা দিয়ে কেন লজ্জা দাও? সেদিনের বর্ষামুখর রাতে আমিও জেগেছিলাম। বিজলীর সঙ্গে বজ্রের শব্দে বড়ো ভয় করছিল। তুমি থাকলে কিন্তু সত্যি বলছি আমার একটুও ভয় করতো না…”

কিছুকাল পরে লেখা একখানা চিঠির সঙ্গে কয়েকটা ফটো আটকানো রয়েছে।

“দুষ্টু মেয়ে,

সেদিন বোটানিক্‌সে তোলা ছবিগুলো পাঠালাম। ছবিতে তোমার হাসি ভারি মিষ্টি লাগে। এক নম্বর ছবিটা এনলার্জ করতে দিয়েছি। আমার টেবিলে সেটি থাকবে। তুমি হাসবে, আমি দেখবো। তোমার সোনালী চুলের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকবো। এখানে কিন্তু তুমি লজ্জায় মুখ লুকোতে পারবে না।”

জেমক্লিপে আঁটা ছবিটিও খুঁটিয়ে দেখলাম। হেলেন হাসছে। আজকের হতশ্রী, ক্লান্ত, বিগতবসন্ত হেলেন গ্রুবার্ট নয়। সেদিনের হেলেনের দেহে যৌবনের ভরা জোয়ার। সদ্য-ফোটা ফুলের মতো তাজা শরীর। চোখে অষ্টাদশীর চঞ্চল মাদকতা।

আর একটা চিঠি টেনে নিলাম।

“আমাকে পাগল করা হেলেন,

ওগো পরীরানী, এই মাত্র তুমি বিদায় নিয়েছো। আমার ঘড়ি বলছে মাত্র দশ মিনিট। কিন্তু মন বলছে কতদিন তোমাকে দেখিনি—একদিন নয়, একমাস নয়, বহুকালের অদর্শন বেদনা। তোমার ঘ্রাণ এখনো ছড়িয়ে রয়েছে এ ঘরের বাতাসে; তাইতো এখনই লিখতে বসলাম। রজনীগন্ধার যে গুচ্ছটি তুমি বুকে নিয়েছিলে, আদর করেছিলে পরম আবেগে, তারাও উদাসভাবে চেয়ে যেন তোমাকে খুঁজছে।

হেলেন, আজকের কথা ভুলবো না। আমাকে তুমি পরিপূর্ণ বিশ্বাস করে সম্মানিত করেছো। হেলেন, আমি সে বিশ্বাসের সকল দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।…”  

সুরজিতের লেখা এরপর কেমন অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পড়তে পারি না। চেষ্টা করেও বুঝতে পারি না সুরজিৎ কী বলতে চায় হেলেনকে। ছবি আঁকা ছেড়ে হেলেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।

চিঠিটা এগিয়ে দিলাম। “প্রথম দুটো প্যারা পড়তে পেরেছি। তারপর?” আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হেলেন গোড়া থেকে চিঠিটা পড়তে লাগলো। একবার শেষ করে বোধ হয় আবার পড়লো। সময় নষ্ট হওয়ায় অস্বস্তি লাগছে আমার।

শেষে হেলেন চিঠিটা ব্যাগে পুরে ফেললো। “এ-চিঠিটা টাইপ করার দরকার নেই, আমার কাছেই থাক।”

অন্য কোনো কথা না বলে হেলেন আবার ছবি আঁকায় মন দিলে।

বেশ কয়েকখানা চিঠির পর পুরী থেকে লেখা সুরজিতের একটা চিঠিতে নজর পড়লো। পুরীর সমুদ্রতীরে সুরজিতের মনে হেলেনের মুখ বার বার উঁকি দিয়েছে, কেন, এ-প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই।

পরের ডাকে উত্তর যায়, “এ আমার পরম সৌভাগ্য। আপিসে মোটেই ভালো লাগছে না। ছুটির পর নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। কেন জানি না।”

.

চিঠিতে ক্রমশ ওরা হৃদয়ের গোপনতম কথা প্রকাশ করে। ওরা দু’জনে দু’জনকে ভালোবেসেছে। ওরা ঘর বাঁধবে। কিন্তু এলিয়ট রোডে নয়। ও-পাড়া থেকে বহু দূরে, টালিগঞ্জ কিংবা গড়িয়াহাটায়। সুরজিতের রোজগার ভালো, ডালহৌসির এক পাটকলের আপিসে তার চাকরি। সুরজিৎ হেলেনকে বিয়ের পর চাকরিতে থাকতে দেবে না। সে আপিসে গিয়ে কী করবে? তার থেকে সংসারে তদারকী অনেক ভালো।

ডিসেম্বরের এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। সুরজিৎ এসেছে হেলেনের বাড়িতে। তার পরনে ছাই-রঙের স্যুট। গলায় প্রজাপতির মতন বো-টাই। মুখে ঈষৎ হাসি। হেলেনের আজ নতুন বেশ। ঘিয়ে রঙের শার্টিনের আঁট স্কার্ট বিজলী বাতিতে ঝলমল করছে। কোমরে একই রঙের প্লাস্টিকের বেল্ট। বুকের কাছে দুটি আধফোটা গোলাপ আটকানো রয়েছে। হেলেন চোখ বোজে, কে যেন এগিয়ে আসছে। সে আরও কাছে এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে বুকের কাছে স্পর্শের অনুভব। হেলেন চোখ খুললো। সুরজিতের হাতে তার বুকের গোলাপ।

“এ-গোলাপ আজ থেকে আমার”–সুরজিৎ বললে।

হেলেন হেসে উত্তর দিলে “ও-তো গোলাপ-কুঁড়ি। ফুল ফোটাবার যত্ন নিতে পারবে তো?”

ওরা আঙটি বদল করলো। হেলেনের নরম হাতে সুরজিৎ নিজের প্রতিশ্রুতির চিহ্নস্বরূপ আঙটি পরিয়ে দিলো। হেলেন সলাজে আবার চোখ বোজে। মার্চের এক সন্ধ্যায় চার্চের সামনে ওরা দু’জনে গাড়ি থেকে নামবে। প্রিয়জনের পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে তারা ধীরে ধীরে বেদীর দিকে এগিয়ে যাবে। বেদীর সামনে পুরোহিত দাঁড়িয়ে থাকবেন। তিনি ধীরে ধীরে বলবেন, “মৃত্যুর ক্রোড়ে আশ্রয় না পাওয়া পর্যন্ত আমরা পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবো।” ভক্তি অবনতচিত্তে পুনরাবৃত্তি করবে তারা। তারপর একমাসের ছুটিতে হনিমুন। গোপালপুর অন সী। হেলেন আর ভাবতে পারে না।

শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় হেলেন দিন গুনছিল। চিঠি লেখা কমিয়ে দিয়েছে সে। সুরজিতের সঙ্গে আজকাল বেশি বেড়াতে যেতে চায় না সে। বলে, লজ্জা লাগে। সুরজিত মাঝে মাঝে বাড়ি এসেছে, নীল রঙের চিঠিও পাঠিয়েছে। হেলেন লিখেছে, “আমার মনের মানুষ, আমাকে ঘরের কোণে বসিয়ে রাখবার তোমার এতো ইচ্ছা কেন জানি না। কিন্তু আমি তোমার অবাধ্য হবো না। বিয়ের পরই চাকরি ছেড়ে দেবো।” সুরজিৎ লিখেছে, “যে ফ্ল্যাটটা সেদিন তুমি ও আমি দেখে এলাম, ওইটাই ভাড়া নিচ্ছি। ফেব্রুয়ারীর প্রথমেই আমি ওখানে উঠে যাবো, আর মার্চমাসের সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকবো। বাড়িওয়ালাকে আজ দু’শ টাকা আগাম দিয়ে দিলাম।”

জানুয়ারীর মাঝামাঝি হেলেনের কাছে আবার একটি নীল চিঠি এল। এ- চিঠির জন্য হেলেন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। বিনা মেঘে বজ্রপাত। বিছানায় শুয়ে বালিশের তলায় মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ সে কাঁদলো। সুরজিৎ রায় নিজে আসতে সাহস করেনি, তাই চিঠি পাঠিয়েছে। সুরজিতের চাকরি গিয়েছে। যে চটকলের আপিসে তার চাকরি, সায়েবরা তা বিক্রি করে দিয়েছে। মাস পয়লায় সুরজিতের হাতে যে খামটা আসতো তার ভিতর থাকতো ছ’শ টাকার করকরে দশ টাকার নোট। সে খাম এবার থেকে আসবে না।

সুরজিৎ রায় ভেঙে পড়েছে। হেলেনকে সে পাবে না। এক পয়সা সঞ্চয় নেই তার। যা রোজগার করেছে এতোদিন, তাই সে খরচ করেছে।

হেলেন রুমালে চোখ মুছতে-মুছতে যে চিঠি লিখেছিল সেটা টাইপ করলাম—

“কোনো চিন্তা করো না ডার্লিং। সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। আবার তুমি চাকরি পাবে। শুধু আমাদের ঘর বাঁধতে একটু দেরি হবে। তাতে কী? আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকবো। আজ না হয় কাল, কাল না হয় পরশু আমরা ঘর বাঁধবোই।”

সুরজিতের উত্তর—

“ডার্লিং,

তোমার চিঠি বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি কি তুমি আমার পুরনো হেলেনই থাকবে? আমার একান্ত নিজস্ব হেলেনা! আমিও প্রতীক্ষায় থাকবো। নিশ্চয়ই থাকবো। যতোদিন প্ৰয়োজন।”

হেলেনের দিকে আড়চোখে তাকালাম। ছবি আঁকা বন্ধ করে, কোন সময় নিজের অজান্তে সে চোখ বুজেছে। টেবিলের উপর ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মাথা ঝুঁকে পড়েছে।

সুরজিৎ চাকরির চেষ্টা করছে। হেলেন নিজের খরচ কমানোর চেষ্টা করে। তাকে আরো টাকা রোজগার করতে হবে। সুরজিতের সামান্য কষ্টও সে সহ্য করতে পারবে না।

সে আর একটা ছোটো চাকরি জুটিয়েছে। শনিবার টার্ফ ক্লাবের কাউন্টার থেকে রেসের টিকিট বিক্রি; মাসে সত্তর টাকার মতো পাওয়া যাবে। শনিবার বিকেলে দু’জনে আর দেখা হয় না। সুরজিতের সময় আছে যথেষ্ট। ঐদিনটিতে হেলেনকে কাছে পেতে চায় সে। কিন্তু সাড়ে বারোটা বাজলেই আপিস থেকে হেলেনকে ট্যাক্সিতে রেসকোর্সের দিকে ছুটতে হয়।

বেশ কিছুদিন এমনিভাবে কেটে যায়। সুরজিত লেখে, চাকরি বোধ হয় আর জুটবে না। জীবন অসহ্য। হেলেন উত্তর দেয়, “লক্ষ্মীটি, ধৈর্য হারালে চলবে কেন? আমার যা কিছু উপার্জন সে তোমারই জন্য। সে টাকাকে তুমি এক মুহূর্তের জন্য অপরের ভেবো না। আমি আরও কিছু রোজগারের চেষ্টা করছি। সুদিন এল বলে।”

সুদিনের প্রতীক্ষায় বছর গড়িয়ে যায়। হেলেনের চিঠি থেকে বুঝি, অতিরিক্ত পরিশ্রমে সে ক্লান্ত। শরীরের দীপ্তি, মনের সজীবতা কমে আসছে। রুক্ষ-জীবনের দেবতা ধীরে-ধীরে হাস্য-মুখরা, প্রাণ-চাঞ্চল্যে ভরা হেলেনকে গ্রাস করছে।

সুরজিতের আর ভালো লাগে না। এক প্লাস্টিক কোম্পানিতে সেলসম্যানের কাজ পেয়েছে সে। কিন্তু যা মাইনে পায় তাতে ঘর ভাড়া দিয়ে দু’বেলা অন্নসংস্থান হয় না। নিজেকে ভদ্রভাবে বাঁচিয়ে রাখতে যে অক্ষম, তার বিয়ের চিন্তা পাগলের কল্পনা মাত্র।

রবিবারের এক বিকেলে ওদের দেখা হলো। সুরজিৎ আজকাল একদম কথা বলে না। চা খেতেও তার ইচ্ছা হয় না। বিল দিতে হবে হেলেনকে।

সুরজিৎ জিজ্ঞাসা করে, “আর কতদিন?”

হেলেন কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। সুরজিৎ যেন ছোট্ট ছেলে। ক্ষিদের সময় খেতে চায়, কিন্তু খাবার কোথা থেকে আসবে বুঝতে চায় না। তবু সুরজিৎকে ওর ভালো লাগে, ওকে আদর করতে ইচ্ছা করে। ওর ঘন কালো চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, আর বেশিদিন নয়।

নাঃ। হেলেনকে কিছু করতেই হবে। আর সামান্য মাইনে বাড়লেই তারা বিয়ে করবে। ঘর বাঁধবে। সুরজিৎ তারপর ভালো চাকরির চেষ্টা করতে পারবে।

ঢাকা আপিসের অফারটা সে গ্রহণ করবে। কোম্পানির ঢাকা ব্রাঞ্চে বছর খানেকের জন্য একজন লেডী স্টেনো চাই। মাইনে প্রায় ডবল এবং ফিরে আসার পর প্রমোশন সুনিশ্চিত। কিছুদিন তাকে সুরজিতের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু উপায় কী? ঢাকা থেকে ফিরেই ওরা বিয়ে করবে। একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে সবকিছু গুছিয়ে সংসার পাতবে।

ঢাকা থেকে লেখা হেলেনের চিঠির কপি আমার সামনে

“মাই নটি ডার্লিং, মাই স্কিপার,

কয়েক ঘণ্টা আগেও দমদমে তোমাকে দেখেছি, অথচ এই ক’ঘণ্টায় কত দূরে চলে এসেছি। হোটেলের ব্যবস্থা আপিস থেকেই হয়েছে, ওয়াই. ডবলু. সি. এতে জায়গা না পাওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবো।

এইমাত্র স্নান সেরে এসেছি। ঘর সাজাবো দু’একদিনের মধ্যে। তোমার বড়ো ছবিটা কিন্তু ড্রেসিং টেবিলে ইতিমধ্যে বসিয়ে দিয়েছি। তুমি আমার খুব কাছে হাসছো। অথচ তুমি কত দূরে! সবই ভগবানের ইচ্ছা। নইলে এমন হবে কেন ডার্লিং? তবুও সময় সময় মন প্ৰবোধ মানতে চায় না। সুইট ড্রিম, ইতি –

তোমারই হেলেন।”

মাস কয়েক পরে হেলেনের চিঠি :

“ডার্লিং,

আজকের ডাকে একটা সোয়েটার পাঠালাম। কিছুদিন আগে পশমটা কিনেছিলাম। চকলেট রঙে তোমায় ভালো মানাবে। সামনে শীত, তাই তাড়াতাড়ি বুনতে হলো। সোয়েটার গায়ে দিয়ে একটা ফটো তুলো। তার এক কপি আমায় পাঠাতে ভুলো না। তোমায় কতদিন দেখিনি। কবে আবার এক সঙ্গে সিনেমা দেখে পার্ক স্ট্রীটের সেই রেস্তোরাঁয় বসবো…”

চিঠির বাণ্ডিল পাতলা হয়ে এসেছে। ঘড়িতে প্রায় চারটে বাজে। সুরজিতের চিঠি দ্রুত টাইপ করি—

“আমার হেলেনা,

সোয়েটার পেয়েছি ঠিক সময়ে। সময় মতো উত্তর না দেওয়ার জন্য দুঃখিত। সোয়েটার এখনও পরিনি। কি হবে পরে? কে তাতে আনন্দ পাবে? ক্রমশ যেন বুড়ো হয়ে পড়ছি। কত দিন এমনি চলবে জানি না।” হেলেনের উত্তর আসে—

“অতো হতাশ হতে নেই। তুমি না পুরুষ? আর কয়েক মাসেই আমার ব্যাঙ্কে বেশ কিছু জমে যাবে। তখন আমাদের সামনে অফুরন্ত আনন্দের দিন।…”

সুরজিতের চিঠি—

“…কবে সে আনন্দের দিন আসবে? যখন আমরা বুড়ো হয়ে কবরে যাবার দিন গুনবো? সব মিথ্যা… তোমার টাকায় প্রয়োজন নেই। ঢাকাতে সময় নষ্ট না করে ফিরে এসো। জীবনে যদি দুঃখ ও কষ্ট থাকে আমরা এক সঙ্গে তার সম্মুখীন হবো…”

হেলেনের চিঠি-

“এতোদিন আমরা ভাগ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। এই শেষ বেলায় আর ধৈর্য হারিও না, লক্ষ্মীটি। রাত পোয়াতে আর বেশি বাকি নেই। হঠাৎ একদিন আমাকে কলকাতায় তোমার পাশে দেখতে পাবে। এখানে ঘড়ি খুব সস্তা। তোমার জন্য একটা ঘড়ি কিনেছি, যাবার সময় নিয়ে যাবো। ততোদিন ওতে দম দিচ্ছি। ঘড়ি বন্ধ হওয়া ভালো নয়। চালু ঘড়ি নিজের হাতে তোমার মণিবন্ধে পরিয়ে দেবো।…”

এর পরের কয়েকটা চিঠি দ্রুতবেগে শেষ করি। ছুটির সময় হয়ে এসেছে। প্রায় পাঁচটা। হেলেন-সুরজিৎ পত্রাবলীর শেষ চিঠিটা তুলে নিই। সুরজিৎ রায়ের চিঠি। কিন্তু নীল কাগজে লেখা নয়, সাদা সাধারণ কাগজ। ছোট্ট চিঠি।

এমন সময় হেলেন হঠাৎ ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লো। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সে বললে, “আই এম স্যরি। কোন্ সময় ঘুমিয়ে পড়েছি। ক’টা বাজে? সব শেষ তো?”

না প্রায় শেষ। এইটুকু বাকী :

“প্রিয় হেলেন,

এ-চিঠি তোমায় আঘাত দেবে। কিন্তু তার জন্য আমি দায়ী নই। তোমার ভুলের মাসুল তোমাকেই দিতে হবে। সুদিনের প্রতীক্ষায় জীবনের আর একটি দিনও ব্যয় করতে আমি রাজী নই। অথচ তুমি বার বার আমাকে অপেক্ষা করতে বলছো। কিছুদিন হলো আর একজন আমার জীবন-আকাশে দেখা দিয়েছে। তার নাম নাই বা শুনলে। সে তোমার মতো আমাকে উপেক্ষা করে না। অপেক্ষা করতেও বলে না। আমাকে পাবার জন্য সে পাগল; সে দুঃখ পেতে রাজী। আমাকে পেলেই সে সন্তুষ্ট—ভালো ফ্ল্যাট, ভালো পোষাক, সামাজিক সম্মান, প্রতিপত্তি সে কিছুই চায় না। আমার জীর্ণ কুটিরে বধূরূপে তার আগমন হবে শীঘ্র। তুমি সুদিনের অপেক্ষায় রূপ যৌবন বাক্সে বন্ধ করে বসে থাকো। যখন তোমার অভীষ্ট সুদিন আসবে, তখন বাক্স খুলে দেখবে সব কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। ইতি—

সুরজিৎ।”

আঙুল দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে হেলেন জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাকে তো খুব খাটিয়ে নিলাম। এবার আমি যেতে পারি কি?”

“হ্যাঁ। যেতে পারেন আপনি। সব চিঠিই টাইপ হয়ে গিয়েছে।”

“শেষ চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলবো ভেবেছিলাম। চিঠিটা কাছে রাখতে ঘেন্না হয়।”

“না ছিঁড়ে ভালোই করেছেন কোর্টে কাজে লাগবে।” আমি উত্তর দিলাম।

“হুঁ। বাছাধনের কত তেজ এবার বোঝা যাবে। অকৃতজ্ঞ! দশ হাজার টাকা কোথা থেকে যোগাড় হয় দেখবো।” ক্রোধের আগুনে হেলেন জ্বলছে।

“আচ্ছা, মামলাতে আন্দাজ কত টাকা লাগবে।” হেলেন আমাকে জিজ্ঞাসা করলে।

“ঠিক বলতে পারছি না। এটর্নিরা জানে।” আমি উত্তর দিলাম।

“তিলে তিলে রক্ত জল করে পয়সা রোজগার করেছিলাম লোকটার জন্য। কিন্তু আমার ভাগ্য ভালো। ফাঁদে পড়বার আগেই লোকটাকে চিনতে পেরেছি। ব্যাঙ্কে যা জমিয়েছি তার সব খরচ করতে আমি পিছপাও হবো না, মামলায় আমাকে জিততেই হবে। দশ হাজার টাকা আমি আদায় করবোই।” হেলেন হি- হি করে হাসতে লাগলো।

ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ছোট্ট আয়নাটা বার করে নিজের ঠোঁটটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হেলেন আবার জিজ্ঞাসা করলে, “তাই না, বাবু? মামলায় আমাকে হারাবে কে?”

“নিশ্চয়। নিশ্চয়। আপনার কেস খুব স্ট্রং।” আমি বললাম।

“ওকে যে শেষপর্যন্ত বিয়ে করিনি আমার সৌভাগ্য। কাণ্ডজ্ঞানহীন দুর্বলচিত্ত লোক।”

আয়নাটা ভ্যানিটি ব্যাগে পুরে রাখলো হেলেন। প্রতিশোধ চাই। সুরজিৎকে ধ্বংস করতে হবে।

দশ হাজার টাকা কোথায় পাবে সুরজিৎ রায়? তার সর্বস্ব নীলামে যাবে। দেউলিয়া খাতায় সুরজিৎ রায়ের নাম তুলিয়ে ছাড়বে হেলেন। তখন কোথায় থাকবে তার নতুন প্রিয়া? কোথায় থাকবে তার বিবাহের স্বপ্ন। সেদিন সুরজিৎকে আবার হেলেনের কাছে আসতে হবে। তখন? তখন রাস্তার কুকুরের মতো তাকে সে দূরে সরিয়ে দেবে। সুরজিৎ রায়কে সর্বনাশের শেষ স্তরে না দেখা পর্যন্ত হেলেনের আত্মা শান্তি পাবে না।

বুড়ী মা ও এটর্নি অমিয় চ্যাটার্জীর সঙ্গে হেলেনকে প্রায়ই চেম্বারে আসতে হয়। যাঁরা সাক্ষী দেবেন তাঁরাও দু-একদিন সায়েবের সঙ্গে আলোচনা করতে এলেন।

হেলেন গ্রুবার্ট একটার পর একটা সিগারেট উড়িয়ে যায়। তার মা জিজ্ঞাসা করেন, হতচ্ছাড়া ছোঁড়াটার কাছ থেকে টাকা আদায় করা যাবে কিনা।

মাস কয়েক পরে আদালতে হেলেন গ্রুবার্টের মামলা উঠলো। কোর্টরুমে বেজায় ভিড়। এমন মজার কেস্ রোজ হয় না। ব্যারিস্টারের বাবুরা, উকিলের মুহুরী ও এটর্নির কোর্ট-ক্লার্করা ঘরের প্রায় সবক’টা চেয়ার ও বেঞ্চি দখল করে বসে আছেন। এডভোকেট ফণি বিশ্বাসের মুহুরী প্রবোধ মুখুজ্যে, ব্যারিস্টার ভবানী ঘোষের বাবু গজানন, হারুবাবু, অর্জুনবাবু ও আরও কয়েকজন বসবার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

আমাকে দেখেই অর্জুনবাবু একটু কাছে এগিয়ে এলেন। “এই যে চাঁদ, বেশ মজাদার মামলা ফেঁদে বসেছেন তোমার সায়েব। মাইরি, একটু হিস্ট্রিটা বলো শুনি।” অর্জুনবাবুর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আরও সামনে এগিয়ে গেলাম। সামনের সারিতে দু’দলের ব্যারিস্টার বসে আছেন। সায়েব রয়েছেন, রয়েছেন জুনিয়র মিঃ মজুমদার ও এটর্নি অমিয় চ্যাটার্জী। সুরজিৎ রায়ের ব্যারিস্টাররাও বসে রয়েছেন। সায়েবের ঠিক পিছনে দুটি চেয়ারে হেলেন ও তার মা। হলের অন্যদিকে সেই একই সারিতে সুরজিৎ রায়। তার পাশে একটি কমবয়সী মেয়ে। হেলেন তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মেয়েটির চোখে ছোট শিশুর নিষ্পাপ দৃষ্টি।

মামলা শুরু হলো।

সুরজিৎ রায়ের ব্যারিস্টার বললেন, “আমার মক্কেল বাদিনীকে বিয়ে করবেন বলেছিলেন সত্য, কিন্তু সে-চুক্তি বাদিনী নিজেই ভঙ্গ করেছেন। অমুক তারিখের লেখা বাদিনীর চিঠি তার প্রমাণ।” তিনি হেলেনের চিঠি আদালতকে পড়ে শোনালেন। সায়েব বললেন, “সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা চুক্তিভঙ্গ নয়, অভিমানের চিঠি। প্রেমের ব্যাপারে এরকম অভিমান খুবই স্বাভাবিক। সুরজিৎ রায়ের অমুক তারিখের চিঠি পড়লেই সেটা বোঝা যাবে।” সায়েব চিঠিটা আদালতকে শোনালেন। সুরজিৎ রায় ইনিয়ে-বিনিয়ে হেলেনকে আদর জানিয়েছে সে চিঠিতে। বলেছে, অভিমান করো না। চিঠি দিতে দেরি হওয়ার জন্য আমি ক্ষমা চাইছি। তারপর দু’জনের পত্রালাপ পূর্বেকার মতোই চলেছে। সুরজিৎ হেলেনকে বধূরূপে পেতে চেয়েছেন। হেলেন লিখেছে, তোমাকে পতিরূপে পেলে, আমি ধন্য হবো।

পিছনের বেঞ্চ থেকে একজন ফিস-ফিস করে বললে, “প্রবোধদা, ছোকরা কি বোকা দেখেছো। সব কিছু লিখে বসে আছে। সাধে কি আর শাস্ত্রে বলে শতং বদ মা লিখ।

প্রবোধদা উত্তর দিলে, “ছুঁড়িটাও কম ওস্তাদ? সব ক’টা চিঠি রেখে দিয়েছে।”

আর একজন বললে, “রাখবে না? ওটাই তো ওদের ব্যবসা। ছেলেধরা পেত্নী।”

হেলেন-সুরজিৎ প্রেমপত্রের নানা অংশে লাল পেন্সিলের দাগ দিয়ে সায়ের জজকে শোনাতে লাগলেন। প্রতিবাদে ব্যারিস্টার সেনও অন্য অংশ পড়তে আরম্ভ করলেন।

উপস্থিত দর্শকরা আনন্দে আত্মহারা—চিঠিগুলি রসে বোঝাই। হেলেন মুখ নিচু করে বসে আছে। সুরজিৎ কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে। আর সুরজিতের পাশে নীল রঙের স্কার্ট-পরা মেয়েটি পরম বিস্ময়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে। মুখের ভাব থেকে মনে হয় যেন সে কিছু বুঝতে পারছে না। হেলেন তার কাছে এক দুয়ে রহস্যময়ী।

সওয়ালের আগে হেলেন সাক্ষ্য দিয়েছে। সুরজিৎকেও হেলেনের পরিত্যক্ত কাঠগড়াতে দাঁড়াতে হয়েছে। হেলেনের বুড়ী মা সাক্ষ্য দিয়েছেন—তাঁর মেয়ের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে, দুশ্চিন্তায় তার রাতে ঘুম নেই। ডাক্তার সাক্ষ্যে বলেছেন, এই সব ক্ষেত্রে দুরারোগ্য মানসিক ও স্নায়বিক ব্যাধির উৎপত্তি হয়।

পুরো দু’দিন মামলা চললো। তৃতীয় দিনে আবার সবাই কোর্টে উপস্থিত। আজ রায় বার হবে। রায়ের জন্য সবাই উদ্‌গ্রীব। সুরজিতের হাত ধরে সেই মেয়েটিও আজ এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। হেলেন সেদিকে তাকিয়ে দেখছে। মেয়েটিকে আজ আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। ঘিয়ে রঙের সার্জের স্কার্ট পরেছে সে। গলায় নকল মুক্তোর মালা।

সুরজিতের হাত ধরে আজকেও সে সবকিছু অবাক হয়ে দেখছে। হেলেনের দিকেও মাঝে-মাঝে আয়ত চোখে সে তাকাচ্ছে। সুরজিৎ গম্ভীর। হেলেন তার দিকে তাকাতে ঘৃণা বোধ করে। তবু এক দুর্নিবার আকর্ষণে হেলেনের দৃষ্টি সুরজিতের উপর গিয়ে পড়ে। একটা নতুন সোয়েটার পরেছে সুরজিৎ। হাতে বোনা চমৎকার সোয়েটারটিতে সুরজিতকে বেশ মানিয়েছে। হয়তো এই সোয়েটারই ঢাকা থেকে হেলেন তাকে পাঠিয়েছিল।

জজ এসে তাঁর আসন গ্রহণ করলেন। বেঞ্চ ক্লার্ক চিৎকার করে ডাকলো হেলেন গ্রুবার্ট ভারসেস্ সুরজিৎ রায়।

সুরজিৎ রায়ের হার হয়েছে। হেলেন গ্রুবার্টকে বিয়ে না করে সুরজিৎ চুক্তিভঙ্গ করেছে। ব্রীচ অব প্রমিস। জজসায়েবের অভিমত, হেলেন গ্রুবার্টের দাবি ন্যায়সঙ্গত।

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সুরজিৎ রায়। হিংস্র হাসিতে ভরে উঠেছে হেলেনের মুখ। কিন্তু সেই মেয়েটির বিশেষ পরিবর্তন নেই। পরম বিশ্বাসে সুরজিতের হাত ধরে সে পূর্বেকার মতোই দাঁড়িয়ে রইলো। তার আয়ত চোখের নিষ্পাপ দৃষ্টি থেকে মনে হলো যেন এ-যুদ্ধের কিছুই তার জানা নেই।

হেলেনের মা’র আনন্দ উছলে পড়ছে। বুড়ী লাফাতে লাফাতে কোর্টঘর থেকে বেরুবার সময় বললে, “মেয়েকে কতবার বলেছি, বেশি টাকা দাবি করো। মেয়ে আমার কথায় কান দিলে না। হুঁ হুঁ আমি জানি। যেদিন থেকে ও ছোঁড়া এসেছে, তখনই বলেছি, চিঠিপত্রগুলো যত্ন করে রাখিস, হুঁ-হুঁ।”

পাকা ঝিঙাবিচির মতো কালো-কালো দাঁতগুলো বার করে হেলেনের মা আমাদের ধন্যবাদ জানালো। কিন্তু মেয়ের দেখা নেই, বোধহয় আগেই চলে গিয়েছে। তবে ধন্যবাদ না জানিয়ে চলে যাওয়ার অসৌজন্য আমার দৃষ্টি এড়ায়নি।

বুড়ী বললে, “ডিক্রিটা তাড়াতাড়ি বার করে জারি করার ব্যবস্থা করতে হবে। যতো তাড়াতাড়ি টাকা আদায় করা যায়, ততোই ভালো।”

এটর্নি অমিয় চ্যাটার্জী বললেন, “তার জন্যে ভাববেন না, মামলায় যখন জিতেছি, সব তাড়াতাড়ি করে দেবো।”

চেম্বারে বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করলাম, হেলেন এসেছিল কিনা। বেয়ারা বললে, না আসেনি। এই হয়ে থাকে সাধারণত। মামলা যখন শেষ হয়েছে আর কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রুবার্টের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে।

.

হেলেন গ্রুবার্টের কাহিনী এইখানে শেষ হলে আজকে লেখার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু কয়েকদিন পরে এটর্নি মিস্টার চ্যাটার্জীর কাছে যে খবরটা পেয়েছিলাম তাতে তাজ্জব বনে গিয়েছিলাম আমি।

হেস্টিংস স্ট্রীটের মোড়ে একটা দোকানে চা খেতে যাচ্ছিলাম। পথে মিস্টার চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা। তিনি চিৎকার করে বললেন, “আরে মশাই, আপনাদের চেম্বারেই যাবো ভাবছিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার। আরে মশাই, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রং দেবতারাই বুঝতে পারেন না, আমরা তো কোন্ ছার?”

আমার অনুরোধে ব্যাপারটা আরও খুলে বললেন মিস্টার চ্যাটার্জী।

“মিস্ গ্রুবার্ট লিখে পাঠিয়েছেন, ডিক্রি জারি করতে হবে না, ক্ষতিপূরণের টাকায় তাঁর প্রয়োজন নেই। উনি নাকি শুধু মামলায় জিততে চেয়েছিলেন, তার বেশি কিছু নয়।”

ব্যাপার ঠিক বুঝতে না পেরে বাড়িতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন মিস্টার চ্যাটার্জী। কিন্তু বেয়ারা ফিরে এসেছে। হেলেন গ্রুবার্ট প্লেনে ঢাকায় চলে গিয়েছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন