কত অজানারে – ১৬

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

টেলিফোনটা বাজছিল অনেকক্ষণ ধরে, ওটা আমার টেবিলেই থাকে। ভিতরে সায়েবের কাছে নোট নিচ্ছিলাম। খাতা-পেন্সিল সেখানে রেখে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে ফোনের রিসিভার তুলে নিলাম। ওপাশ থেকে একটি মেয়েলী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। “সিটি ওয়ান-সেভেন-টু-ফোর?” এপাশ থেকে জানিয়ে দিলাম তাঁর ভুল হয়নি। ওপাশ থেকে আবার বলা হলো, “আমি ডক্টর মিত্র কথা বলছি। আপনার সায়েবের সঙ্গে কখন দেখা হতে পারে?” ডক্টর মিত্রকে দেখা করার সময় জানিয়ে সেটা সায়েবের ডাইরীতে লিখে রাখলাম।

টেলিফোনে কথা শেষ করে কতবার এমনিভাবে ডাইরীতে দিনক্ষণ লিখে রেখেছি। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটের জীবনে, টেলিফোনের মাধ্যমে কত আলাপের সূত্রপাত হয়েছে। ফোনের অজানা অচেনা লোকটি হাজির হয়েছেন তাঁর সমস্যার বোঝা নিয়ে। সায়েব চেষ্টা করেছেন সাহায্য করার, আমি নেপথ্যে দাঁড়িয়ে নীরবে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত সব দেখে গিয়েছি। কেউ জিতেছে, কেউ বা হেরেছে। আশা সফল হয়নি, বিদায় নিয়েছে, ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীট থেকে। তাদের পায়ের চিহ্ন হয়তো ও-পাড়ায় আর কোনো দিনও পড়বে না। তাদের সকলকে মনে রাখতে পারিনি। অপরিচয় থেকে পরিচয় যেমন দ্রুত ও আকস্মিকভাবে হয়েছিল, বিস্মৃতি ততো দ্রুত না হলেও ধীরে-ধীরে কুয়াশার মতো নেমে এসেছে।

তবু সেই অন্ধকারের মধ্যেও অনেকে আজও স্মৃতিপটে জ্বল-জ্বল করছেন। তাঁদের মুখগুলো অতি স্পষ্টভাবে এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোখ, মুখ, কপালের প্রতিটি রেখা মনে পড়ে যায়। ডাইরী লিখিনি কোনোদিন, দৈনন্দিন ঘটনাগুলো রোজনামচার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখিনি। কিন্তু সেজন্য আপসোস করি না, হয়তো ভালোই হয়েছে। আমার অগোচরে মন যাকে ভালো বুঝেছে, শুধু তাকেই সযত্নে সঞ্চয় করেছে, প্রয়োজন অপ্রয়োজনের বাছাই করার হাঙ্গামা থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দিয়েছে।

ডক্টর শেফালী মিত্র প্রথম দিন চেম্বারে কিভাবে এসেছিলেন, একটুও ভুলিনি। চোখে চশমা, মণিবন্ধে কালো সিল্কের ব্যাণ্ডে খুব ছোট্ট একটি ঘড়ি। বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম হলেও স্নিগ্ধ। অতি সাধারণ সরু কালোপেড়ে শাড়ি পরেছিলেন তিনি। দোহারা চেহারা। হাতে স্টেথসকোপ।

ডক্টর মিত্রের চিকিৎসা-জগতে সুনাম আছে। তাঁর চেম্বারে মাসিমাকে নিয়ে আমি একবার গিয়েছিলাম। শাড়ির উপর সাদা অ্যাপ্রন পরে রোগী দেখছিলেন তিনি। টেম্পল চেম্বারে প্রথম দর্শনেই তাঁকে চিনতে পারলাম।

তাঁকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে সায়েব বললেন, “বসুন ডক্টর মিত্র। উকিল ডাক্তারদের সম্বন্ধটা সাধারণত এক তরফা হয়। আপনারা এ-দিকে আসুন আর নাই আসুন, আমি আপনাদের চেম্বারে যেতে প্রায়ই বাধ্য হই, রোগবিরোগ তো লেগেই আছে! আপনাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতাবোধ সেইজন্য খুবই সজাগ।”

ডক্টর মিত্র ম্লান হেসে টেবিলের উপরে স্টেথসকোপটা রাখলেন। “আচ্ছা, বলতে পারেন মেয়ে কার?”

শর্টহ্যাণ্ডের নোটবুক হাতে আমিও পাশে বসেছিলাম। প্রশ্ন শুনে ডক্টর মিত্রের মুখের দিকে তাকালাম। মেয়ে কার—আইনের প্রশ্ন? না, হেঁয়ালি? শাস্ত্রবাক্য মনে পড়ে গেল—নারী প্রথম জীবনে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন।

সায়েব বললেন, “আপনার প্রশ্নের অর্থ ঠিক বুঝতে পারলাম না। আইনের চোখে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে প্রত্যেক মেয়েই স্বাধীন।”

ডক্টর মিত্র একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, “আমি নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। অন্তরাত্মা জানেন, জাহানারা আমার। কিন্তু আইনে নাকি অন্যরকম লেখা আছে! সত্যি নাকি, আপনি ঠিক করে বই-টই দেখে বলুন! আপনি যা ফী বলবেন তাই দেবো, কিন্তু জাহানারাকে আমার চাই।”

বিলেত-ফেরত ডক্টর শেফালী মিত্রকে এমন ভাবাবেগে কথা বলতে দেখে আমি অবাক।

“কে এই জাহানারা?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।

“আমি দুঃখিত, কিছু মনে করবেন না। এমন অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম যে, আসল ঘটনা বর্ণনা না করেই প্রশ্নের উত্তর চাইছি।” নিজেকে সংযত করে নিলেন ডক্টর মিত্র। তিনি বেশ লজ্জা পেয়েছেন।

“জাহানারা আমার মেয়ে। তার পুরো নাম জাহানারা প্যাটেল।”

শেফালী মিত্রের মেয়ে জাহানারা প্যাটেল! বিস্মিত হলেও অত্যন্ত সহজভাবে সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার মেয়ে?”

শেফালী মিত্র গম্ভীরভাবে বললেন, “জাহানারা আমাকেই মা বলে জানে। আমি তাকে গর্ভে ধরিনি সত্য, কিন্তু নিজের মেয়ের মতনই মানুষ করেছি।” তাঁর এলোমেলো কথায় সমস্ত ঘটনা আরও হেঁয়ালিপূর্ণ হয়ে উঠছে, মনে হলো।

সায়েবের অনুরূপ অবস্থা। তিনি নিজেই বললেন, “আপনার সম্পূর্ণ ইতিহাস আমার গোড়াতে শোনা প্রয়োজন। জাহানারা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।”

ডক্টর মিত্র লজ্জিত হলেন। “ঠিক বলেছেন। ইতিহাসটা খাপছাড়াভাবে বর্ণনা করে লাভ নেই।”

.

“আজ থেকে অনেকবছর আগে আমি একজন ইহুদিকে বিয়ে করি। আমি তখন শেফালী মিত্র নই, শেফালী সলোমন। আমার স্বামীর কাঠের ব্যবসা ছিল। তাঁকে বেশ ধনী বলা চলতে পারে। কিন্তু ফ্যান, ফোন, বাড়ি, গাড়ি সব থেকেও আমাদের শান্তি ছিল না।

আমি নিজে ডাক্তার, বিশেষ প্র্যাকটিস করতাম না। করার প্রয়োজন ছিল না এবং স্বামীও পছন্দ করতেন না যে, আমি দিনরাত ডাক্তারীতে মেতে থাকি।

কিন্তু অশান্তি সেজন্য নয়, কারণ অন্য। বছর কয়েকের মধ্যে আমার কোনো সন্তান হলো না। বড়ো বড়ো কয়েকজন ডাক্তারকে দেখালাম। তাঁরা সকলে একমত—আমার সন্তান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।”

শেফালী মিত্র আস্তে-আস্তে, ভেবে-ভেবে কথা বলায় শর্টহ্যাণ্ডে অনায়াসে লিখে যাচ্ছিলাম।

“তারপর?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।

“তারপর বিবাহ-বিচ্ছেদ। মিস্টার সলোমন বেশি বয়সে আবার বিয়ে করেছিলেন, আমি সংবাদ পেয়েছিলাম।

মিস্টার সলোমন ব্যবসাসূত্রে মাঝে-মাঝে রেঙ্গুনে যেতেন। আমিও তাঁর সঙ্গে সেখানে কয়েকবার গিয়েছি। জানাশোনা হয়ে গিয়েছিল কিছু-কিছু। ওখানকার এক মেয়েদের হাসপাতালে চাকরি খালি ছিল। মাইনে কম হলেও কাজটা ছাড়লাম না। হাসপাতালের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কিছু-কিছু প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতে লাগলাম।

আউট-ডোরে কত রকমের লোক আসে—চীনা, বার্মিজ, ভারতীয়। কিছু- কিছু বাঙালীর সঙ্গেও দেখা হতো। মাতৃসদনটির সুনাম আছে রেঙ্গুনে।

ওখানেই সোফিয়া প্যাটেলের সঙ্গে প্রথম দেখা। রক্তহীন ফ্যাকাশে, শীর্ণ দেহ। চোখের কোণে কালো রেখা। মুখের ম্লান হাসিটুকু ছাড়া জীবনের আর কোনো লক্ষণ নেই।” ডক্টর শেফালী মিত্র হাতের স্টেথসকোপটা নাচাতে নাচাতে বলতে লাগলেন, আর আমি লিখে চললাম দ্রুতবেগে।

সোফিয়া প্যাটেলের রোগ নির্ণয় করলেন শেফালী মিত্র—অ্যানিমিয়া। মেয়েটির বছর তেইশ বয়স। অস্থিসার দেহে বড়ো বড়ো চোখ দুটি বেমানান মনে হয়। ডক্টর মিস্ শেফালী মিত্র কোন্ সময়ে সোফিয়াকে ভালোবেসে ফেলেছেন। সপ্তাহে একদিন সে আউট-ডোরে আসে। ডক্টর মিত্র সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। অন্য রোগীদের ফেলে রেখে তাকে পরীক্ষা করেন, ওষুধ দেন। সুন্দর ইংরেজি বলে মেয়েটি। দু’জনে গল্প হয়। ডক্টর মিত্র ভুলে যান আরও রোগী বাইরে অপেক্ষা করছে। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় দিতে হয়। সোফিয়াকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন তিনি।

নতুন রোগিণী ডাক্তারকে একদিন চা-এ নিমন্ত্রণ করলেন। ডাক্তার খুবই আনন্দের সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে গেলেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে গল্প করে, শেষপর্যন্ত চা ছাড়াও রাত্রের খাবার পালা সাঙ্গ করে তিনি বাড়ি ফিরলেন।

সোফিয়ার আউট-ডোরে যাওয়া বন্ধ হলো। রোগ যে সেরে গেল তা নয়, শেফালী মিত্র নিজেই রোগিণীর বাড়িতে আসেন, দুজনে খুব ভাব। নিঃসঙ্গ প্রবাস জীবনে সোফিয়ার মতো বন্ধু পেয়ে ডক্টর মিত্রের আনন্দের সীমা নেই।

কিন্তু রোগ প্রশমনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং বাড়ছে। ডক্টর মিত্র কিন্তু পরাজিত হতে প্রস্তুত নন। বড়ো ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তিনি চিকিৎসা চালাতে লাগলেন।

সোফিয়া মুসলমান। তাঁর স্বামীর সামান্য চাকরি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। স্বামীও বেশ মিশুক। ডাক্তারের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি প্রায়ই বলেন, “আপনার সঙ্গে দেখা না হলে সোফিয়ার যে কি হতো জানি না।”

যা হোক, সোফিয়া অবশেষে সুস্থ হয়ে উঠলেন। শেফালী মিত্র এজন্য সকল কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। সম্পূর্ণ সেরে উঠে সোফিয়া একদিন নিজের হাতে রান্না করে ডাক্তারকে খাওয়ালেন। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তাঁরা তিনজন সামনাসামনি বসেছিলেন। শেফালী মিত্রের মনটা সামান্য খারাপ। সোফিয়া ভালো হয়ে গিয়েছেন, তাঁরও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল।

কিন্তু বেশ খুশি মনে সে-রাত্রে ডক্টর মিত্র বিদায় নিলেন। সোফিয়া তাঁর দুটি হাত ধরে বলেছেন, “রোগ ফুরোলেই যে নটে গাছটি মুড়োলো এমন যেন না হয়। তোমাকে আসতেই হবে। এখন আর ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক নয় কিন্তু! আমার জোর বেড়ে গিয়েছে। এখন সমান-সমান ক্ষমতা, আমরা দুজনে বন্ধু।”

তাঁরা দু’জনে সত্যই বন্ধু হয়ে উঠলেন। সোফিয়া সাধারণ ঘরের মেয়ে, উচ্চশিক্ষা পাননি। তবুও তিনি শেফালী মিত্রের শ্রেষ্ঠ বান্ধবী। সোফিয়ার বাড়িতে প্রায়ই আসেন ডক্টর মিত্র। হাসপাতালের বদ্ধ হাওয়ায় যখন মনটা হাঁপিয়ে ওঠে, তখন সেখান থেকে পালিয়ে এসে সোফিয়ার সঙ্গে ঘর-সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করতে বেশ লাগে। সোফিয়ার রান্না ভালো। ডাক্তারী ছেড়ে শেফালী মাঝে-মাঝে রান্নাঘরে এপ্রেন্টিসগিরি করেন। তেল-নুন-লঙ্কার পরিমাণ নিয়ে তর্ক হয়।

দু’জনের মনের কথাও চাপা থাকে না। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখের কথা সোফিয়াকে খুলে বলেন শেফালী মিত্র। নিঃসঙ্গ জীবনের বেদনার বোঝা খানিকটা হাল্কা হয়ে যায়। রুগ্ন দেহ সোফিয়া ডক্টর শেফালী মিত্র অপেক্ষা মনে অনেক সুস্থ ও সবল। সোফিয়া তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়। দেয় খানিকটা মানসিক সান্ত্বনা।

সোফিয়ার শরীর আবার খারাপ হচ্ছিলো। দেহে যে মাংস লেগেছিল, ক্রমশ তা শুকোতে লাগলো। মুখের রক্তাভা, চোখের দীপ্তিও কমছে। স্টেথসকোপটা কান থেকে খুলতে খুলতে শেফালী মিত্র রোগিণীর স্বামীকে একদিন বললেন, “এবার আরও সাবধান হতে হবে। প্রেগনেন্সি।”

সোফিয়াকে মাস কয়েক ধরে শেফালী মিত্র যে যত্ন ও সেবা করলেন, চোখে না দেখলে তা বিশ্বাস হয় না। সোফিয়ার স্বামী প্রায়ই বলতেন, “আপনার ঋণ কখনও শোধ করতে পারবো না। আল্লার দয়ায় আমার স্ত্রী আপনার মতো বন্ধু পেয়েছে।”

সোফিয়া বিছানায় শুয়ে থাকেন। তাঁকে দেখলেই হাতটা তুলে নাড়ান। ম্লান মুখখানি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিছানার খুব কাছে চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে শেফালী বসেন। গল্প হয় দু’জনে। কখনো বই পড়েন তিনি, আর সোফিয়া চুপ করে শোনেন।

ভাবী-মায়ের চেয়ে ডাক্তারের আগ্রহ উদ্দীপনা অনেক বেশি। সোফিয়াকে কতরকমের উপদেশ দেন তিনি। বলেন, “কোনো অনাচার যেন না হয়। মনে থাকে যেন শরীরটা এখন তোমার একার নয়।”

কিছুদিন পরে শেফালী মিত্রকে আরও আনন্দিত মনে হলো। সোফিয়ার খুব কাছে বসে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে তিনি বললেন, “সোফিয়া নতুন খবর আছে।

ভাবী-মা উৎকর্ণ হয়ে থাকেন। “কী খবর?”

শেফালী স্নেহভরে সোফিয়ার একটি হাত ধরে বললেন, “যতোদূর মনে হয়, একজন নয়, ওরা দু’জন আসছে।”

“যমজ!” সোফিয়া উত্তেজনায় উঠে বসলেন।

পরের দিন শেফালী আবার যথাসময়ে সোফিয়াকে দেখতে এলেন। হাসপাতালে সারাদিনের পরিশ্রমে দেহ ক্লান্ত। রুমালে মুখ মুছতে-মুছতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন আছো?”

দুষ্টুমিভরা হাসি দিয়ে সোফিয়া উত্তর দিলেন, “ভালোই আছি। খুব ভালো আছি।”

তারপর সোফিয়া যা বললেন, শেফালী মিত্রের অবচেতন মনে সেই কামনা বহুদিন অবহেলিত হয়ে ঘুমিয়ে ছিল। প্রথম ধাক্কায় তিনি কেঁদে ফেললেন, বিশ্বাস হচ্ছিল না কিছুতেই। সোফিয়া স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। যমজ ছেলে হলে তার একটি শেফালী নিতে পারেন। জীবন বেঁচেছে তাঁর করুণায়। কোনো কিছুতেই সে ঋণ পরিশোধ হবে না। তাছাড়া দুটি সন্তান মানুষ করাও সোফিয়ার রুগ্ন দেহে সম্ভব নয়।

যমজ সন্তানই এল শেষপর্যন্ত। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। অর্ধচেতন সোফিয়ার বিছানার পাশে শেফালী মিত্রকে অনেক বিনিদ্র রাত কাটাতে হলো। হাসপাতালের বড়ো ডাক্তার অবশেষে বললেন, এবার বিপদ কেটে গিয়েছে।

.

“সুস্থ হয়ে নতুন-মা বাড়ি ফিরে এলেন।” ডক্টর শেফালী মিত্র চেম্বারে বসে বলে যাচ্ছেন।

আমার হঠাৎ খেয়াল হলো কাহিনীর মধ্যে এমন ডুবে গিয়েছি যে, কোন্ ফাঁকে লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

“সব লিখে নিচ্ছো তো?” সায়েব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর ডক্টর মিত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি বলে যান।”

“আমার বর্ণনা হয়তো একটু দীর্ঘ হচ্ছে, কিন্তু আমি আপনাকে সব বলতে চাই। আপনি তবেই বুঝতে পারবেন, কে অন্যায় করেছে।” ডক্টর মিত্র সায়েবের মুখের দিকে সম্মতির জন্য তাকালেন।

“নিশ্চয়, আপনি যা বলতে চান বলুন।”

“সোফিয়া কথা রেখেছিল। মেয়েটি আমাকে দিয়ে দিলো সে।” শেফালী মিত্র আবার বলতে লাগলেন।

“সোফিয়া কিন্তু একটি শর্ত আরোপ করেছিল। মেয়ের নাম আমি নিজেই দিয়েছি জাহানারা, ও নাম পরিবর্তন করবে না,” সে বলেছিল।

ডক্টর মিত্র আপত্তি করেননি। ছোট্ট ফুলের মতো মেয়েটি বুকে করে তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন

আট মাসের মেয়ে জাহানারা প্রথম কয়েকদিন কেঁদেছিল। পরে সব ঠিক। আয়া রেখেছেন ডক্টর মিত্র। পেরেম্বুলেটরে জাহানারাকে বসিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় অন্য কাজ বন্ধ রেখে নিজে পার্কে বেড়িয়েছেন।

জাহানারা হাঁটতে শিখেছে। শেফালীর চিন্তা বেড়েছে। সবাইকে বলে বেড়ান, “আমার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। মেয়ের এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। মেয়ে খুব দুষ্টু, কিছুতে আয়ার কাছে ঘুমোবে না। আমাকে সময়মতো বাড়ি ফিরতেই হবে।”

মেয়ের দৌরাত্ম্যে সোফিয়ার কাছে যাওয়া কমিয়ে দিলেন ডক্টর মিত্র। দু’- একবার মেয়েকে নিয়েই ওখানে গিয়েছেন তিনি। জাহানারা সোফিয়াকে মাসি বলে ডাকে।

ডক্টর মিত্রের সমগ্র হৃদয় সে ধীরে-ধীরে গ্রাস করলো।

কিছুদিন পরে রেঙ্গুনে এক ভয়ঙ্কর দাঙ্গা বাঁধলো। দাঙ্গায় অনেকে প্ৰাণ হারালো, লুঠতরাজ কম হলো না।

দাঙ্গা থামতেই ডক্টর মিত্র কলকাতায় চলে এলেন। রেঙ্গুন বাস আর নিরাপদ নয়। কলকাতায় তিনি চেম্বার খুললেন।

সোফিয়াও আর রেঙ্গুনে থাকলেন না, ফিরে গেলেন বোম্বাই। সেখানে তাঁর স্বামী একটি চাকরি পেয়েছেন, মাইনে অনেক কম। কিন্তু উপায় কী?

শেফালী আর সোফিয়ার পত্রালাপ এই গোলমালেও বন্ধ হয়নি। শেফালী বোম্বাইতে জাহানারার ছবি পাঠিয়েছেন।

একটু বড়ো হলে জাহানারাকে দিয়ে চিঠি লিখিয়েছেন, “মাই ডিয়ার আন্টি, তুমি কেমন আছো?”

আণ্টি উত্তর দিয়েছেন, “সোনা মেয়ে আমরা ভালো আছি। তোমার মামি লিখেছে, তুমি নাকি খুব ভালো মেয়ে। শুনে আমরা খুব খুশি হয়েছি।”

ইংরেজি শেখাবার জন্য গভর্নেস রেখেছেন ডক্টর মিত্র।

কলকাতার সেরা মিশনারী কনভেন্টে জাহানারা পড়তে যায়। নিজে গাড়ি করে মেয়েকে স্কুলে রেখে আসেন। ছুটির আগেই গেটের কাছে গাড়ি নিয়ে তিনি অপেক্ষা করেন। ঘণ্টা পড়ার একটু পরে মেয়ে লাফাতে লাফাতে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। হাত থেকে বইগুলো নামিয়ে নিয়ে মেয়েকে পাশে বসান তিনি। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। তিনি বললেন, “মুখ শুকিয়ে গিয়েছে, রোদে ঘুরেছো নিশ্চয়!”

জাহানারা রাস্তার দু’দিকে তাকাতে তাকাতে বলে, “না মা, আমি একটুও রোদে ঘুরি না। রোদে ঘুরলে যে কালো হয়ে যায়, আমাদের ক্লাসের নমিতা বলেছে।”

ডক্টর মিত্র লোভ সামলাতে পারেন না। জিজ্ঞাসা করেন, “রঙ কালো হলে কী হয়?”

জাহানারা সন্দিগ্ধভাবে তাকিয়ে বলে, “আহা তুমি যেন জানো না। রঙ কালো হলে বিয়ে হবেনা।

শেফালী মিত্র হাসতে-হাসতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।

বাড়ি ফিরেই সোফিয়াকে চিঠি লিখেছেন তিনি। জাহানারার দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বর্ণনা করতে ভোলেন না। “তোমার মেয়ে তোমার মতোই হয়ে উঠছে ক্রমশ। যে কোনো মানুষের মন পাঁচ মিনিটে জয় করে নিতে পারে। জাহানারাকে দেখে আমি সহজে কল্পনা করতে পারি ছোটবেলায় তুমি কেমন ছিলে।”

“চোদ্দবছরে পড়লো জাহানারা আর আমারও কপাল মন্দ হতে বসেছে।” ডক্টর শেফালী মিত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন।

“কেন?” প্রশ্নটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আমার কাজ শুধু লিখে যাওয়া, যা কিছু জিজ্ঞাস্য সায়েব জেনে নেবেন। কিন্তু গল্পের ঝোঁকে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছি।

শেফালী মিত্র ম্লানমুখে বলতে লাগলেন, “মাসখানেক আগে সোফিয়া চিঠি লিখেছিল, কয়েকদিনের কাজে তার স্বামী কলকাতায় আসছেন।

উত্তরে আমি লিখলাম, “তুমিও চলে এসো কলকাতায়, কতদিন দেখা নেই। আমার বাড়িতে অনেক ঘর খালি পড়ে আছে, থাকবার অসুবিধা হবে না।”

তারপর একদিন হাওড়া স্টেশন থেকে সোফিয়া ও তার স্বামীকে আনতে গেলাম। কতদিন পরে দেখা। প্ল্যাটফর্মেই আনন্দে সোফিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বাড়িতে এসেই জাহানারাকে ডাকলাম। সেও ছুটে এল, জিজ্ঞাসা করলে, “কেমন আছো আণ্টি?”

জাহানারা, সোফিয়া ও আমি একসঙ্গে প্রায়ই সিনেমায় যেতাম। বোটানিকাল গার্ডেনে ফিস্ট হলো এক রবিবার। জাহানারার কনভেন্ট দেখিয়ে আনলাম সোফিয়াকে। পিয়ানো বাজিয়ে শোনালো জাহানারা, দেখালো তার নিজের আঁকা রঙীন ছবি। আণ্টিকে একটা বাঁধানো ছবি উপহার দিয়েছে সে।

আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি আমি রাখিনি। তবুও সোফিয়া কেমন গম্ভীরভাবে থাকে। জাহানারার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করছিল সে। আমি আপত্তি করিনি, ভেবেছি এমনি গল্প হচ্ছে, আর কিছু নয়

কিন্তু জাহানারার বাবা সেদিন আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন। সোজাসুজি বললেন, “জাহানারাকে এবার আমরা নিয়ে যেতে চাই। এতোদিন দেখাশোনা করেছেন। সেজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”

মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো প্রথমে। মনে হলো এখনই মেঝেতে লুটিয়ে পড়বো। “এ-সব কথার অর্থ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

সোফিয়া আড়ালে দাঁড়িয়েছিল এতোক্ষণ। কাছে এগিয়ে এসে সে বললে, “আমার মেয়ে আমি ফেরত চাই; অতি সরল অর্থ।”

আমি সহ্য করতে পারলাম না। তখনি বার করে দিয়েছি দু’জনকে। বলেছি, “হোটেলে যাও। আমার বাড়িতে জায়গা হবে না।”

ওরা চলে গেলে রাগটা একটু কমলো। অতোটা অভদ্রতা না করলেও হতো। কিন্তু আপনি বলুন, “আমার রাগ করাটা কি অন্যায় হয়েছে?” শেফালী মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন।

“গতকাল পুলিশ এসেছিল আমার বাড়িতে। জাহানারার সমস্ত খবর নিয়ে গেল। ওরা নাকি থানায় খবর দিয়েছে।”

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। বড়ো ভয় লাগছে।

আজ সকালে আবার এক এটর্নির চিঠি পেয়েছি। জাহানারাকে সত্বর তার বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে লিখেছে।

“কিন্তু জাহানারা…জাহানারাকে আমি কেন দেবো? সে-তো আমারই মেয়ে।” উত্তেজনায় শেফালী মিত্রের স্বর থরথর করে কাঁপছে।

“আমি আইনের কিছু জানি না। আমাকে কি করতে হবে বলুন। জাহানারাকে আমি এতো বড়ো করে তুলেছি, তাকে ছাড়তে পারবো না। আমি পাগল হয়ে যাবো—।” শেফালী মিত্র, কলকাতার প্রথিতযশা ডাক্তার শেফালী মিত্র, রুমালে চোখ মুছতে লাগলেন।

“টাকার জন্য ভাবনা নেই। আপনি বলুন জাহানারা কি আমার নয়?” রুমালে আবার চোখ মুছলেন তিনি।

চশমাটা খুলে রেখে সায়েব জিজ্ঞাসা করলে, “রেঙ্গুনে জাহানারাকে যখন আপনি প্রথম নিয়ে এলেন তখন কোনো লেখাপড়া হয়েছিল কী? লিখিতভাবে দত্তক গ্রহণ করাটাই সাধারণ রীতি।”

শেফালী মিত্র উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, “না লেখাপড়া তো হয়নি!” হঠাৎ রেগে উঠলেন তিনি। “কিন্তু কাগজে লেখাটাই কি সব? আপনাদের আইনে মুখের কথার কি কোনো মূল্য নেই? কোনো কিছু লেখা নেই বলে ওরা জাহানারাকে নিয়ে যাবে?” শেফালী মিত্রের মুখ লাল হয়ে উঠেছে।

“উতলা হবেন না ডক্টর মিত্র। আইনে রেল ইঞ্জিনের মতো একটা নির্দিষ্ট লাইন ধরে যেতে হয়। মুখের কথায় বিশ্বাস করা যে সব সময় সম্ভব হয় না!” সায়েব প্রবোধ দিলেন।

সামান্য চিন্তা করে তিনি আবার বললেন, “আপনার পক্ষে অনেক কিছু বলবার আছে। তবে জাহানারার বাবার কেসও যে খুব দুর্বল তাও বলা যায় না। জাহানারা এখনও নাবালিকা। নাবালিকার অভিভাবকত্ব নিয়েই দু’পক্ষের টাগ- অফ-ওয়ার। আমাদের দুটি পথ খোলা আছে—এক জাহানারার বাবা কোর্টে মামলা করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা; অথবা হাইকোর্টে আমরাই জাহানারার অভিভাবকত্বের জন্য আবেদন করতে পারি।”

শেফালী মিত্র বললেন, “আর অপেক্ষা করতে চাই না। আমরাই বরং কোর্টে কেস্ করি।”

এটর্নির নাম বলে দিলেন সায়েব। তাঁর কাছে প্রথমে যেতে হবে, তিনি কেস ফাইলের প্রাথমিক কাজগুলো করবেন।

চেয়ার থেকে ডক্টর শেফালী মিত্র উঠে পড়লেন। স্টেথসকোপটা টেবিল থেকে তুলে তিনি সায়েবকে বললেন, “পরিচিত মহলে আপনার অনেক কেসের গল্প শুনেছি। আমার বিশ্বাস আছে আপনার উপর। জাহানারাকে ওরা যেন ছিনিয়ে না নেয়।”

শেফালী মিত্র চলে গেলেন।

নোটবুকের পাতাগুলো উলটিয়ে দেখছিলাম। শেফালী মিত্রের হৃদয়ের কথা শর্টহ্যান্ডের আঁকাবাঁকা টানের মধ্যে ধরে রেখেছি।

ঘড়িতে চারটে বাজে। সায়েব বললেন, “এবার যাওয়া যাক।” আমার নোটবুকের দিকে তাকিয়ে তিনি একটু হাসলেন। কিন্তু কথা বললেন না।

হাইকোর্টে মামলা ফাইলের পর ডক্টর মিত্র মাঝে-মাঝে চেম্বারে আসতেন। নমস্কার জানিয়ে বলতাম, “সায়েব ভিতরে আছেন, চলে যান।”

তিনি কিন্তু মাঝে-মাঝে আমার কাছে এসে দাঁড়াতেন। “আপনারা তো এ- লাইনে রয়েছেন, আইনের কিছু-কিছু বোঝেন। আচ্ছা জাহানারাকে আমি রাখতে পারবো না?”

যতোদূর জানি, অতি কঠিন মামলা। তবু হেসে বলতাম, “আপনি ভাববেন না। জাহানারার আসল মা আপনিই।”

তিনি একটু সাহস পেতেন। বলতেন, “আমার ছবির এলবাম এনে একদিন আপনাদের দেখাবো, কতটুকু মেয়েকে বুকে করে এনেছিলাম। সেবার ওর নিউমোনিয়ার মতো হলো। তখন কোথায় ছিল ওর আপন মা? এতো যদি ভালোবাসা, কলকাতায় এসে মেয়ের সেবা করলে না কেন? আমি বলে রাখলাম, ওর মায়ের হাতে পড়লে জাহানারা ছ’মাসও বাঁচবে না। বলুন, আমি অন্যায় বলেছি?”

“না না, এক শ’ বার সত্যি। সে-সব আমার তো ভালোভাবে জানা আছে।” আমি বলতাম।

ইতিমধ্যে কেসের কাজ এগোচ্ছে। জাহানারার বাবা প্রতিবাদ জানিয়েছেন যে, তাঁর মেয়ের অভিভাবক তিনি হবেন, বাইরের লোকের অধিকার নেই সেখানে। প্রত্যুত্তরে শেফালী মিত্র এফিডেভিটে আপন বক্তব্য জানিয়েছেন।

সায়েব শেফালী মিত্রের বাড়িতে গেলেন একদিন। বললেন “আপনার মেয়েকে ডাকুন, একটু গল্প করে যাই।” জাহানারার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এসেছেন তিনি।

নেপথ্যের সকল প্রস্তুতি শেষে যে জজের কোর্টে মামলা উঠলো বিচক্ষণ বিচারক হিসাবে ব্যারিস্টার মহলে তাঁর প্রচুর সুনাম।

জাহানারার বাবার পক্ষেও বড়ো ব্যারিস্টার। তিনি জাহানারাকে মা-বাবার কাছে ফেরত দিতে চান।

সায়েব বললেন, “জাহানারাকে তার বাবা ও মা ডক্টর মিত্রকে দিয়ে দেন।”

অপরপক্ষ সঙ্গে-সঙ্গে দান প্রমাণের কাগজপত্র চেয়ে বসলেন। কিন্তু আমাদের কাগজপত্র কিছু নেই। তখন ওঁরা বললেন, জাহানারাকে ডক্টর মিত্র ভালোবাসতেন এবং তার মায়ের শরীর অসুস্থ হওয়ায় তাকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। মেয়ের ভরণপোষণের জন্য জাহানারার বাবা কয়েকবার টাকা পাঠাতে চেয়েছেন। কিন্তু শেফালী মিত্র নেননি।

তাঁরা আরও বললেন, মুসলমান আইনে মেয়ের স্বাভাবিক অভিভাবিকা মা; সুতরাং জাহানারার অভিভাবিকা সোফিয়া প্যাটেল।

সায়েব বললেন, “তাঁরা অভিভাবকের কর্তব্য করেননি।”

ওঁরা উত্তর দিলেন, নিশ্চয় করা হয়েছে। অসংখ্য চিঠিতে মেয়ের সংবাদ নিয়েছেন তাঁরা। অনেক দূরে বাস ও আর্থিক অনটনের জন্য সব সময় চাক্ষুষ দেখা হয়নি। কিন্তু মেয়ের অভিভাবকত্ব তাঁরা কোনোদিন ত্যাগ করেননি। মেয়েকে এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে ভর্তির সময়ও তাঁদের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। ডক্টর মিত্র জাহানারাকে নিয়ে দু’বার সমস্ত ভারতবর্ষ ভ্রমণে বেরিয়েছেন, দু’বারই অনুমতির জন্য তিনি চিঠি দিয়েছেন।

সায়েব উত্তরে বললেন, “অনুমতির জন্য চিঠি দেননি ডাঃ মিত্র, দিয়েছিলেন সাধারণ সংবাদ হিসেবে। যাঁরা তাঁকে মেয়ে দিয়েছেন মেয়ের খবরাখবর তাঁদের মাঝে-মাঝে জানানোটা তিনি কর্তব্য মনে করেছেন।”

শেফালী মিত্র রোজ কোর্টে বসে থাকতেন। দেড়টায় লাঞ্চের জন্য জজসায়েবের সঙ্গে-সঙ্গে সবাই উঠে পড়লেন। ডক্টর মিত্র নিজের চেয়ারে বসে রইলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “খেতে যাবেন না?”

ডক্টর মিত্রের চোখ ছলছল করছে। “আমার খেতে ইচ্ছে নেই। কেমন বুঝছেন বলুন?” তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

“রায় না বেরুনো পর্যন্ত কেউ বলতে পারে না কী হবে। অযথা চিন্তা করবেন না। কিছু খেয়ে আসুন।”

তবু গেলেন না তিনি। বললেন, “খেতে গেলে বমি হয়ে যাবে, এখানেই বসে থাকি।”

লাঞ্চ শেষে আবার কোর্ট বসলো। তর্কযুদ্ধ পুনরায় আরম্ভ হলো।

অপরপক্ষের ব্যারিস্টার বললেন, “বাবা কিংবা মায়ের অভিভাবকত্বের দাবি অনস্বীকার্য। একমাত্র কোনো ঘোরতর অপরাধ বা ত্রুটি প্রমাণিত হলে তাদের অপসারিত করে অন্য অভিভাবক নিযুক্ত করা যেতে পারে। ডক্টর মিত্রের এমন কোনো অভিযোগ আছে কি যে, জাহানারার বাবা চরিত্রহীন, মদ্যপ, উচ্ছৃঙ্খল বা অভিভাবক হিসেবে অযোগ্য?”

সায়েব বললেন, “না,–জাহানারার বাবার বিরুদ্ধে সেরকম অভিযোগ আমাদের নেই।”

অপরপক্ষের ব্যারিস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, “তবে কোন্ অপরাধে জাহানারার মা এবং বাবা নিজের মেয়েকে পাবেন না?”

“আমরাও একই প্রশ্ন উত্থাপন করছি। চোদ্দবছর ধরে নিজের সকল স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে পালন করে শেফালী মিত্র আজ জাহানারাকে হারাবেন কেন!” সায়েব উত্তর দিলেন।

তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা এতোদিন পরে কেন মেয়েকে ফেরত চাইছেন?”

“আমরা মেয়েকে বিয়ে দিতে চাই এবং অল্প বয়সেই।” জাহানারাকে যে ধরণের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাতে সে একটি পুরো মেসায়েব বনে যাবে। কোনোদিন ঘরসংসার করতে পারবে না।” অপরপক্ষ উত্তর দিলেন।

সায়েব বললেন, “মাই লর্ড, নাবালিকার মঙ্গলের জন্যই অভিভাবকের প্রয়োজন। যতোদিন না বয়ঃপ্রাপ্ত হয়, নিজের মঙ্গলামঙ্গলের জ্ঞান জন্মায়, ততদিন অভিভাবক তাকে ঠিক পথে চালিয়ে নিয়ে যান। এক্ষেত্রে জাহানারার ভবিষ্যতই আমাদের একমাত্র চিন্তার বিষয়। বাবা-মা’র কাছে থাকা তার ভবিষ্যতের পক্ষে শ্রেষ্ঠ হলে, আপনি জাহানারাকে নিশ্চয় তাঁদের কাছে ফেরত দেবেন।”

তারপর তিনি একে-একে দেখালেন, চোদ্দবছর ধরে জাহানারা প্রাচুর্যের পরিবেশে লালিত-পালিত হয়েছে। হঠাৎ পরিবেশ পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। ভালো স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে সে এবং ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে মনে-মনে সে যে ছবি এঁকেছে বাবার কাছে ফিরে গেলে তা কখনো বাস্তবে রূপান্তরিত হবে না।

জড়সায়েব বললেন, “আমি নিজে জাহানারার সঙ্গে কথা কইতে চাই।” জাহানারা কোর্ট-রুমে এল। সাদা সিল্কের সালোয়ার পরা ফুটফুটে মেয়ে। চাঁপা ফুলের রঙ। চুলে লাল সার্টিনের রিবন, হাতে লেডিজ রিস্টওয়াচ। জজসায়েব জাহানারাকে নিজের বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ, অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ।

ডক্টর মিত্র কোর্ট-ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। উত্তেজনায় ছটফট করছেন তিনি। আমাকে বললেন, “আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। জাহানারাকে জজসায়েব কী জিজ্ঞাসা করবেন?”

“বলা শক্ত। কিন্তু জাহানারা আপনার বিরুদ্ধে কিছু বলবে না নিশ্চয়!” আমি তাঁকে আশ্বাস দিলাম।

ডক্টর মিত্র একটু মনোবল পেলেন বোধহয়। “হুঁ, জাহানারা আমাকে খুব ভালোবাসে।” কিছুক্ষণের জন্য ভ্রূকুঞ্চন করলেন তিনি। তারপর বললেন, “কিছুই বলা যায় না। হয়তো—”

মিনিট চল্লিশ পরে জজসায়েব কোর্টে ফিরে এলেন। বললেন, “চল্লিশ মিনিট সময় নেওয়া আমার উচিত হয়নি। কিন্তু জাহানারার সঙ্গে আমার এমন ভাব হয়ে গেল যে, একটা ছোট্ট গল্প পর্যন্ত এই ফাঁকে শুনে নিয়েছি।” জজসায়েবের কথায় কোর্টের সবাই হেসে উঠলেন।

অবশেষে পাঁচদিনব্যাপী যুদ্ধের অবসান হলো। ডক্টর মিত্র আমাদের সঙ্গে টেম্পল চেম্বারে এলেন। চোখ দেখে বোঝা যায় রাতে ঘুম হচ্ছে না। আমাকে চুপি- চুপি জিজ্ঞাসা করলেন, “কেমন বুঝছেন, সত্যি করে বলুন।”

আমি বললাম, “কালকে রায় বেরিয়ে যাবে। যুদ্ধ সায়েবও কম করেননি। দেখা যাক।”

পরের দিন সকালে ডক্টর মিত্র, জাহানারাকে সঙ্গে করে চেম্বারে এলেন। জাহানারার চুলে আজ নীল রঙের ফিতে। পরনে অর্গাণ্ডির ফ্রক, বুকের কাছে হনিকুম্ব করা, হাতে একখানা বাংলা বই।

“তুমি বাংলা জানো?” আমি জাহানারাকে জিজ্ঞাসা করলাম। “বাঃ, আমি তো মামিকে প্রায়ই বাংলা পড়ে শোনাই।”

যথা সময়ে আমরা হাইকোর্টে ছ’নম্বর ঘরে হাজির হলাম। জজসায়েব এলেন একটু পরে। সামনের সারিতে সায়েব ব্রীফ হাতে বসে আছেন। পাশে বিপক্ষের ব্যারিস্টার। অনেক পিছনে একটা চেয়ারে শেফালী মিত্র। আমাকে কাছে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন বুঝছেন?” উত্তেজনায় তাঁর হাত কাঁপছে। জাহানারাকে চেম্বারে রেখে এসেছেন। সেখানে সে ছবির বই পড়ছে।

জজসায়েব তাঁর রায় পড়তে লাগলেন। দু’পক্ষের বক্তব্য তিনি বিশদভাবে আলোচনা করলেন। তারপর জাহানারার চোদ্দ বছরের জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস, এমন কি তার জন্মের পূর্বে রেঙ্গুনে ডক্টর মিত্র ও সোফিয়ার পরিচয় কাহিনীর বর্ণনা দিতে লাগলেন।

সে-কাহিনী আমাদের ভালোভাবে জানা আছে। আমরা শুধু তাঁর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করছি। শেফালী মিত্র সামনের চেয়ারটায় হাত দিয়ে জজের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। উত্তেজনায় হাতটা তখনও মাঝে-মাঝে কেঁপে উঠছে। ভাবছেন, জজসায়েব ফলাফলটা আগেই বলে দিতে পারতেন।

জজসায়েব গার্ডিয়ানস্ এণ্ড ওয়ার্ডস্ এ্যাক্ট-এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। আমি একবার শেফালী মিত্র এবং আর একবার জাহানারার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছি। সোফিয়া কোর্টে আসেননি। প্যান্ট পরে জাহানারার বাবা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শেফালী মিত্র চেয়ারটা আরও সামনে এগিয়ে নিলেন। জজসায়েব টাইপ-করা জাজমেন্ট পড়ে যাচ্ছেন—মামলাটা বিচিত্র। জাহানারার কোনো সম্পত্তি বা গচ্ছিত অর্থ নেই। সুতরাং, নাবালিকার অভিভাবকত্বের জন্য যাঁরা কোর্টে মামলা করতে এসেছেন তাঁদের বৈষয়িক স্বার্থ নেই। তাঁরা দু’জনেই জাহানারাকে ভালোবাসেন, আর কিছু নয়। ফলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আমার পক্ষে আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। জাহানারার বাবা ও মা’কে অভিভাবকত্ব থেকে বঞ্চিত করার মতো কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ মেয়ের প্রতি আদর্শ পিতামাতার সকল কর্তব্য তাঁরা নিশ্চয় পালন করেননি। অপরদিকে ডক্টর শেফালী মিত্রের ব্যারিস্টার যে কথা বলেছেন, তাঁর মক্কেল হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে জাহানারাকে পালন করছেন।

জাহানারার বাবা ও মা সামাজিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। বেশি লেখাপড়া শেখা, তাঁরা ভালো চক্ষে দেখেন না এবং তাঁরা কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী।

আমার মনে হয়, এই দোটানায় জাহানারার ভবিষ্যৎ আমাদের প্রধান চিন্তার বিষয়। তার সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। বালিকা হলেও পৃথিবীর খানিকটা বোঝবার মতো বুদ্ধি তার হয়েছে। জাহানারার সঙ্গে কথা বলে আমি মুগ্ধ হয়েছি। ক্লাশে ফার্স্ট হয় সে। ভবিষ্যতে সে মস্ত বৈজ্ঞানিক হতে চায়। জগৎকে জানবার আগ্রহ আছে প্রচুর। ডক্টর মিত্রকে সে মা বলে, এবং তাঁকে ছেড়ে যেতে চায় না। শুধু তাই নয়, এখনই বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে তার নেই। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে আমাকে ছোটোখাটো বক্তৃতা সে শুনিয়েছে।

সুতরাং, জাহানারার অভিভাবকত্ব ডক্টর মিত্রকে দিলাম। তবে আশা করি, মেয়েকে মাঝে-মাঝে, বাবা-মা’র সঙ্গে তিনি মেলামেশা করতে দেবেন।

জজসায়েব কাগজ বন্ধ করে হাসতে লাগলেন। আনন্দে শেফালী মিত্রের চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। খুব খুশি তিনি। প্রায় নাচতে-নাচতে কোর্ট-ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। মজা করে জিজ্ঞাসা করলাম, “আমাকে তো অনেকরার প্রশ্ন করেছেন, এখন আপনি কেমন বুঝছেন বলুন?”

“তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না। এখন আবার প্রশ্ন করছি, ক’সের সন্দেশ খেতে পারেন বলুন?” আমরা দু’জনে হাসতে লাগলাম।

জাহানারাকে নিতে ডক্টর মিত্র চেম্বারে এলেন। সায়েব আগেই এসে বসেছিলেন। মেয়েকে কোলে বসিয়ে শেফালী মিত্র অনেকক্ষণ গল্প করলেন। “মেয়েকে নিয়ে আমার কত মুশকিল দেখছেন তো?”

জাহানারা চুপচাপ এইসব কথাবার্তা শুনছিল। হঠাৎ কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে সায়েব বললেন, “আপনার মেয়ে আমার কাছে মুখ বুজে থাকে, কিন্তু জজের কাছে খুব কথা বলে। আমি কী অন্যায় করেছি?”

ঘাড় নিচু করে জাহানারা বললে, “না-না।”

“আর না-না, বেশ দেখতে পাচ্ছি!” সায়েব উত্তর দিলেন।

“আপনাকে দেখলে ও লজ্জা পায়”, ডক্টর মিত্র বললেন।

“তা নয়, আসলে আমি যে বুড়ো হয়ে গিয়েছি। মাথায় একটি চুলও নেই। তাই হয়তো…নাঃ, বলবো না। বলার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু জজসায়েবকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে ও যেভাবে বলেছে, তাতে আমার বলতে সাহস হচ্ছে না।” আমরা হাসিতে ফেটে পড়লাম।

লজ্জায় চোখ বুজে জাহানারা বললে, “ধ্যাৎ!”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন