শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
“এর নাম হাইকোর্ট।”
অবাক হয়ে হাইকোর্টের উঁচু চুড়োটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, এর নাম হাইকোর্ট। বিভূতিদার মুখের দিকে তাকালাম। বিভূতিদার হাত ধরেই এখানে এসেছি। চাকরি হবে, যা-তা চাকরি নয়। সায়েব ব্যারিস্টার, তাঁর কাছে চাকরি।
এর আগে তো রাস্তায় ছোটখাটো জিনিস ফেরি করেছি। কিন্তু ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ মন্ত্র মনে-প্রাণে জপ করেও জীবনধারণ যখন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল তখন বাণিজ্যদেবীর ভগিনী দেবী সরস্বতী অপ্রত্যাশিতভাবে কৃপাবৰ্ষণ করলেন। অবশ্য আমার পক্ষে খুরুট রোডের বিবেকানন্দ স্কুলে মাস্টারি লাভ কোনোদিনই সম্ভব হতো না, যদি না ওই স্কুলের শ্রদ্ধেয় প্রধানশিক্ষক আমার ‘বাজেট-সংকট’ সম্বন্ধে কিছুটা ওয়াকিবহাল হতেন। মাস্টার মানে অঙ্ক ইংরেজির নয়। মাস্টার সমাজে অঙ্ক ও ইংরেজির মাস্টারমশায়রা কুলীন। বাকি সব ইতরে জনা সর্বশাস্ত্রবিদ। আমি শেষোক্ত দলে। সুতরাং ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, বাংলা, সংস্কৃত কোনোটা পড়াতে বাকি রাখিনি। সেখান থেকে সোজা চলে এসেছি রামকৃষ্ণপুর ঘাট এবং হোরমিলার কোম্পানীর ‘অম্বা’ স্টীমারে নদী পেরিয়ে হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের চুড়োটার দিকে আবার তাকালাম। বর্শার ফলকের মতো তীক্ষ্ণ শীর্ষ যেন মেঘের আবরণ ভেদ করে আকাশের সঙ্গে মিলিয়ে যেতে চাইছে। আমার অবস্থা দেখে বিভূতিদা হেসে বলেছিলেন, “বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো একেই বলে; রোজ এখানে আসতে হবে, চুড়ো কেন ওই বাড়িটার ভিতরের অনেক কিছুই ক্রমশ দেখতে ও জানতে পারবে। এখন চেম্বারে চলো।”
এসব অনেকদিন আগেকার কথা। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি বিভূতিদা ঠিকই বলেছিলেন। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীট ও তার পাশের ওই আকাশচুম্বী লাল প্রাসাদটিতে অহরহ জীবন নাটকের কত খেলা চলেছে। জীবনের কয়েকটা বছর সেখানে খরচ করে স্মৃতির খাতায় জমার অঙ্ক অনেক বেড়ে গিয়েছে। যত দেখেছি তার কতটুকু আর আজ মনে পড়ে? তবুও কত বিচিত্র মুখের ছবি সেখানে সাজানো।
বিভূতিদা বললেন, “সায়েব-সুবোরা সাধারণত কেমন খটমট হয়, কিন্তু এ সায়েব অন্য মানুষ, একেবারে অন্য মানুষ। কোনো ভয় নেই। প্রথমে যদিও সামান্য অসুবিধা হয়, ক্রমশ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“চেম্বার কাকে বলে?”
আমার প্রশ্নে বিভূতিদা হেসে ফেললেন। “সায়েব যেখানে বসেন। ওই-যে সামনের হলদে রঙের বাড়িটা।”
এতক্ষণে সেদিকে আমার নজর পড়লো। বাড়ির নাম টেম্পল চেম্বার। কতকালের পুরনো বাড়ি বলা শক্ত। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটের এক পাশে টেম্পল চেম্বার, অন্য পাশে হাইকোর্ট।
টেম্পল চেম্বারে ঢোকার পথে দেওয়ালে অসংখ্য চিঠির বাক্স। তার কোনোটি চকচকে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত। কোনোটি বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকে প্রসাধনহীন জীর্ণ মলিন বেশে পথের পাশে ডাকপিয়নের প্রতীক্ষারত।
মস্ত বড় বাড়ি। কিন্তু ঠিক বোলতার চাকের মতো—এক একটি খোপে এক একটি এটর্নির বাসা। অনেক ঘরে দিনদুপুরেও সূর্যালোক প্রবেশ অসম্ভব, ফলে ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই-এর ব্যবসার প্রসার হয়েছে। কিন্তু মনের হরষে দিবসে বাতি জ্বালা সত্ত্বেও এখানকার ভাড়াটিয়াদের নিশীথ-প্রদীপের কোন অভাব হয় না।
লিফটে কেমন এক সোঁদা গন্ধ। প্রাগৈতিহাসিক যুগের লিফ্ট। তিনজনের বেশি একত্রে ঊর্ধ্বে আরোহণের আগ্রহ প্রকাশ করলে সরাসরি স্বর্গারোহণের সমূহ সম্ভাবনা। লিফটের জন্য অনেক যাত্রী সার দিয়েছেন। কালো কোটপরা এটর্নি, কালো গাউন হাতে ব্যারিস্টার। আধময়লা জামাপরা এটর্নি বাড়ির বাবু, ফিনফিনে ধুতি ও মাথায় টুপিওয়ালা দীর্ঘবপু মারওয়াড়ি কোনো শাঁসালো মক্কেল। আমার ঠিক সামনে গরদের চাদর গায়ে এক বাঙালী বিধবা। হাতে হরিনামের ঝুলি, কাঁচা সোনার রঙ। হয়তো কোনো জমিদার গৃহিণী, আইনের হেফাজত সামলাতে পুজো ছেড়ে এটর্নি আপিসের লিফটে লাইন দিয়েছেন।
গুটিগুটি পা পা করে আমরা শেষ পর্যন্ত লিফটের ভিতর ঢুকে পড়লাম। লিটম্যান একবার আড়চোখে তাকালো, কিন্তু কথা বললে না। বয়স এমন কিছু হয়নি, কিন্তু মাথায় চুলগুলো একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে। “এই যে বৃন্দাবন, সব খবর ভালো তো? সায়েবের নতুন বাবু”– বিভূতিদা আলাপ করিয়ে দিলেন। লিফ্ট হুহু করে উপরে উঠছে, এক একটি তলা মুহূর্তের জন্য ঝিলিক দিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। বৃন্দাবন এবার আমার দিকে ভালো করে তাকালো, কিন্তু কিছু বলবার পূর্বেই তাকে হাতল ঘোরাতে হলো। নামবার সময় এসে গিয়েছে।
পকেট থেকে চাবি বার করে বিভূতিদা দরজা খুললেন। আলো জ্বলে উঠলো। একটা বড় ঘর। মধ্যে পার্টিশন। সামনের ছোট অংশে একটা টেবিল, আলমারি, কাগজপত্র। “আমরা এখানে বসি।” সুইংডোর ঠেলে বিভূতিদা আমাকে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে বললেন,” সায়েব এখানে বসেন।” মস্ত টেবিল, চারিদিকে অনেকগুলো চেয়ার। অন্য কোণে আর একটা ছোট টেবিল। তিনদিকের দেওয়াল র্যাকে ঢাকা, তাতে অসংখ্য মোটা মোটা আইন বই।
“এত বই!”
“এ আর ক’খানা।” বিভূতিদা বুঝিয়ে দিলেন, “বই নিয়েই তো এখানকার কারবার। কারখানার যেমন হাতুড়ি বাটালি, তেমনি এগুলো ওকালতির যন্ত্রপাতি। আরও অনেক বই লাগে। বার লাইব্রেরিতে যখন নিয়ে যাব তখন দেখতে পাবে।” সায়েব এখনও আসেনি। একটা চেয়ারে বসে পড়লেন বিভূতিদা। আমাকেও বসতে বলে কেমন দুঃখভরা চোখে তাকালেন। তারপর আরম্ভ করলেন নিজের কথা।
ষোলো বছর আগে বিভূতিদা যখন টেম্পল চেম্বারে এসেছিলেন, তাঁর বয়স তখন কুড়ি বছর। পাঁচ টাকা মাইনেতে টেম্পল চেম্বারে এক এটর্নি আপিসের টাইপিস্ট। লিফটে জাঁদরেল চেহারার এক ইংরেজ ব্যারিস্টারের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়েছে, বিভূতিদা ভয়ে এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আপিস থেকে বেরোবার সময়ও এক একদিন সায়েবের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, “কী কাজ করো?”
এক শনিবার দেড়টার সময় বিভূতিদা মেশিন বন্ধ করেছিলেন। বেয়ারা এসে বললে, “পাশের ঘরের ব্যারিস্টার সায়েব আপনাকে ডাকছেন।”
“আমার একটা জরুরী টাইপের কাজ করে দিতে পারবে? এখানেই টাইপরাইটার রয়েছে।” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
রাজী হয়ে গিয়ে বিভূতিদা একমনে টাইপ করে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে গেল, “মাই সন, কমলালেবু খাবে?” বিভূতিদা চমকে উঠে দেখলেন সায়েব দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর হাতে একটা কমলালেবু। বিভূতিদা অবাক। এ আবার কেমন সায়েব? মনিবরা আবার টাইপিস্টদের সঙ্গে কমলালেবু ভাগ করে খায় নাকি?
কাজকর্ম শেষ করে চলে যাবার সময় সায়েব তাঁর হাতে একখানা পাঁচ টাকার নোট গুঁজে দিলেন—”তোমার পারিশ্রমিক।”
“আজ্ঞে, আমার কাছে তো ভাঙানি নেই।
“না না, ভাঙানির দরকার নেই, পুরো পাঁচ টাকাই দিলাম।”
বিভূতিদার বিশ্বাস হয় না। দেড়ঘণ্টায় পাঁচ টাকা—এ যে তাঁর একমাসের মাইনে।
ছুটির পর এমনি কাজ করে মাঝে মাঝে পাঁচ টাকার নোট পেতে লাগলেন বিভূতিদা। শেষপর্যন্ত সায়েব একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার কাছে কাজ করবে?”
বিভূতিদা এক কথায় রাজী। এমন সুযোগ কে ছাড়বে?
দিন কয়েক কাজ করেই কিন্তু বিভূতিদা হাঁপিয়ে উঠলেন। ভয়ঙ্কর খাটুনি। দিন নেই, রাত নেই, শুধু কাজ। ছুটির দিনেও নিস্তার নেই, সন্ধে সাতটা আটটা পর্যন্ত টাইপ করো। অসম্ভব। সায়েবকে কিছু না জানিয়েই, বিভূতিদা চেম্বার থেকে ডুব দিলেন। পুরনো এটর্নি আপিসই ভালো। কিন্তু দু’দিন পরে টেম্পল চেম্বারের সামনে বিভূতিদা সায়েবকে দেখতে পেলেন। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেও সায়েবের কাছে ধরা পড়ে গেলেন তিনি। হাতটা চেপে ধরলেন সায়েব। “চাকরি ছেড়ে যাবে কোথায়, দুষ্টু ছেলে?”
কাঁচুমাচু মুখে, ইস্কুল পালানো ছেলের মতো সায়েবের পিছুপিছু বিভূতিদা আবার চেম্বারে ফিরে এলেন।
“সেই যে এলাম, এই ছাড়ছি। মাঝখানে একটানা ষোলো বছর কেটে গিয়েছে।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিভূতিদা বললেন।
এই ষোলো বছরে বিভূতিদা সায়েবকে চিনেছেন। সায়েব তাঁকে ডেকে বলেছেন, “বিভূতি, তোমার বাড়ি যাব।”
“সেকি! আমরা যে বড়ো নোংরা জায়গায় থাকি।”
“উঁহু, তবুও যাব।”
সায়েব বাড়ি এসেছেন। পরনে ধুতি-চাদর-বাঙালীর বাড়ি বাঙালী সাজে যেতে ইচ্ছে হয়েছে তাঁর। ধুতি পরা সোজা নয়। কোমরে কাপড় আটকে থাকতে চায় না। তাই বেল্ট দিয়ে কাপড় পরেছেন সায়েব। শান্তিপুরি ধুতি, গরদের পাঞ্জাবী আর সিল্কের চাদর।
“তোমার মাদারের সঙ্গে আলাপ করবো।” ঘোমটা দিয়ে বিভূতিদার মা এসে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন “ছেলেকে আপনার হাতেই ছেড়ে দিয়েছি।”
সায়েব আবার এসেছেন, মায়ের অসুখের সংবাদ পেয়ে। কিন্তু তাঁর গাড়ি যখন কালী বাঁড়ুজ্যে লেন-এর সরু রাস্তা দিয়ে কোনো রকমে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো তখন সব শেষ। শ্মশান-যাত্রীরা তার আধ ঘণ্টা আগে গলির মোড় পেরিয়ে চলে গিয়েছেন। আপিসে বিভূতিদা কেঁদে ফেলেছেন। সায়েব কাঁধে হাত রেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়েছেন। “তোমার মাদারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, এখন থেকে তোমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমার।”
আরও দিন গিয়েছে। ছোট ভাই-বোনদের স্কুল কলেজে পাঠিয়েছেন বিভূতিদা, সায়েব খবর নিয়েছেন। বোনের বিয়েতে তিনি এসেছেন। জিজ্ঞাসা করেছেন, “সব ঠিক তো?”
কালী বাঁড়ুজ্যে লেন-এ সায়েব আবার গাড়ি থেকে নেমেছেন—পরনে এবারও ধুতি। কিন্তু তাঁর হাতে ফুলের তোড়া, আর মুখে হাসি। বিভূতিদার যে বিয়ে!
এমনি করে কোন ফাঁকে বিভূতিদা ও সায়েব দু’জনেই ভুলে গিয়েছেন তাঁদের প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক। এ যেন এক সংসারে বাস, এক সূত্রে বাঁধা জীবন।
কিন্তু ষোলো বছর পরে বিভূতিদার মনে হঠাৎ ভয় ধরেছে। বিভূতিদার ছেলেপুলে হয়েছে। সংসারে দায়িত্ব অনেক। সায়েব বেশ বৃদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু বিভূতিদার সামনে জীবনের অনেকটা অংশ পড়ে রয়েছে।
শুনে সায়েবও চিন্তিত হয়ে ঘাড় নেড়েছেন—”সত্যিই তো। পার্সোনাল সার্ভিসের এই দোষ। ঠিক আছে।” কয়েক মাসের মধ্যেই ক্লাইভ স্ট্রীটে বিভূতিদার চাকরি যোগাড় করে ফেলেছেন সায়েব।
“সেই সায়েবকে আমি স্বার্থপরের মত ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তুমি কিন্তু সায়েবকে দেখো!” বিভূতিদার চোখে জল।
“সায়েবকে দেখবে তো?” বিভূতিদা আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
“দাঁড়ান আগে তো ইন্টারভিউ হোক। সায়েব আমাকে পছন্দ করবেন কিনা তারই ঠিক নেই।”
এমন সময় কয়েক জোড়া জুতোর শব্দ শোনা গেল।
“সায়েব আসছেন,” বিভূতিদা বললেন।
“আমার যে ইংরেজি কথা আটকে যায়।”
“কোনো ভয় নেই। শুধু গুডমর্নিং বলবে। তারপর আমি আছি।”
কিন্তু উত্তেজনার বশে আসল সময়ে আমার মুখ থেকে গুড মর্নিং ও বার হলো না। বরং সায়েবই আমাকে গুডমর্নিং জানিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পিছনে মোহনচাঁদ ও দেওয়ান সিং দুই বেয়ারা।
কোনো ইংরেজের সঙ্গে আমার জীবনে এই প্রথম সাক্ষাৎ। ছ’ফুট লম্বা গোলাপী রঙের দেহ, এই বয়সেও সম্পূর্ণ সোজা, সারা মাথা জুড়ে টাক, সমস্ত মুখটিতে হাসি ছড়িয়ে আছে।
বিভূতিদা আমাকে ভিতরে সায়েবের টেবিলের কাছে নিয়ে গেলেন। “এই ছেলেটির কথাই বলেছিলাম।”
“অল রাইট, কাজকর্ম সব বুঝিয়ে দিয়েছ তো?”
“না, আগে দেখা না করেই……”
চোখ দুটো বড় বড় করে ঘাড় নেড়ে খুব গম্ভীরভাবে তিনি বললেন, “তাই তো, ঠিক বলেছ। Yes, yes, I must ask him some very difficult questions and that too with Scotch accents.”
এ্যাঁ!
বিভূতিদা ভাবে বুঝলেন, বললেন, “না, না, সায়েব কিছুই জিজ্ঞাসা করবেন না। এমনি মজা করছেন।”
নাম জিজ্ঞাসা করলেন সায়েব। পুরো নাম শুনে বললেন, “উঁহু, এত বড় নাম আমি বলতে পারবো না। একটা ছোট্ট পোর্টেবল নাম চাই।”
চোখ বুজে সায়েব নিজেই ভাবতে লাগলেন।
“ভালো নাম দেওয়া খুব কঠিন কাজ! কিন্তু। হুঁ, পেয়ে গিয়েছি— শংকর। এ নামে তোমার কোনো আপত্তি আছে?”
ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটের জীবনে আমার আসল নামটা সেদিন থেকেই হারিয়ে গিয়েছে। কেউ ডাকে না আমায় সে নামে। পুরনো বেনারসী শাড়ির মতো সেটা বিস্মৃতির বাক্সে কোথায় চাপা পড়ে আছে, আমার নিজেরও খোঁজ নেবার আগ্রহ হয় না।
পকেট থেকে চাবির রিং বার করে বিভূতিদা আমার হাতে দিলেন। “এ- সংসার এখন থেকে তোমার। সব কিছু কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নাও আমার কাছ থেকে।”
ছোটখাটো কয়েকটা খাতাপত্তরের খুঁটিনাটি তিনি বুঝিয়ে দিলেন। “চেম্বারে অনেক কিছুই করবার আছে। কিন্তু সেসব ক্রমশ নিজেই বুঝতে পারবে। কোনো ট্রেনিং-এর দরকার নেই। সবচেয়ে কাজে লাগবে যে বিদ্যেটি এম. এন. দত্তর শর্টহ্যান্ড স্কুল থেকে আয়ত্ত করেছ। কোর্টে কাজ কম থাকলেই সায়েব অনেক চিঠি লিখবেন, সেগুলো যত্ন করে টাইপ কোরো।”
শর্টহ্যান্ড থেকে যে চিঠিটি আমি প্রথম টাইপ করেছিলাম সেটি আজও মনে আছে। খুব আস্তে আস্তে বলেছিলেন সায়েব। আট-দশ লাইনের চিঠিটা টাইপ করে টেবিলে দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পরেই মোহনচাঁদ বললে, “সায়েব আপনাকে ডাকছেন।” ভিতরে ঢুকে আড়চোখে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে আমার কান লাল হয়ে উঠলো। দশ লাইনে গোটা পনেরো ভুল। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না আমাকে।
চিঠিটা আবার টাইপ করে এগিয়ে দিলাম। এবার হেসে বললেন, “বাঃ সুন্দর হয়েছে।”
আমি অবাক!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন