শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
টেম্পল চেম্বারে আমার দেখা শেষ উল্লেখযোগ্য চরিত্রের নাম নিকোলাস ড্রলাস। তাকে আমি আজও ভুলতে পারিনি। ধর্মতলা স্ট্রীট কিংবা ডালহৌসির মোড়ে এখনও মাঝে-মাঝে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেই। ভিড়ের মধ্য থেকে ড্রলাসের হঠাৎ আবির্ভাব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। দেখা হলেই চিরপরিচিত কায়দায় ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে সে নিশ্চয় বলবে—”হ্যাল্লো বাবু, হাউ দু ইউ দু।” তারপর সে মামলার খবর জানতে চাইবেই। কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারবো না। ড্রলাস যে-ধরনের মানুষ, উত্তর না পেয়ে হয়তো রাস্তার মধ্যেই চিৎকার শুরু করে দেবে।
টেম্পল চেম্বারে যতো অদ্ভুত ও সৃষ্টিছাড়া মানুষ দেখেছি, নিকোলাস বোধহয় তাদের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক। ড্রলাসের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ছে। একখানা চিঠি নিয়ে সে সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কঙ্কালসার চেহারা। চোখে মুখে কর্কশ রুক্ষতার ভাব। চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে ড্রলাস কাশতে শুরু করলো। কাশি সহজে থামতে চায় না, সঙ্গে হাঁপানির টানের মতো শব্দ। চিঠিটা সম্পূর্ণ পড়তে দেবার মতো ধৈর্য নেই তার। দু’বার ঢোক গিলে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলে, “ইউ তেক্ মাই কেস্ আর নত্?”
চিঠি লিখেছেন বিচারপতি রায়। পত্রবাহক জনৈক দুঃস্থ নাবিক। এখানকার কোনো বিখ্যাত জাহাজ কোম্পানীর বিরুদ্ধে এক জটিল মামলায় জড়িত। সাহেব এই মামলা গ্রহণ করলে জাস্টিস রায় আনন্দিত হবেন।
সায়েব মামলা গ্রহণ করবেন জেনে ড্রলাসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কি একটা বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু কাশিতে আবার তার কথা আটকে গেল। একটু সুস্থ হয়ে, ছেঁড়া শার্টের হাতা গুটিয়ে, ঘুষি পাকিয়ে সে বলল, “হুঁ, দুনিয়াতে জোর না করলে কিছু হয় না। যতোদিন ভালো ছেলের মতো সবার হাতে পায়ে ধরলাম কিছু হলো না। আর যেই মেজাজ গরম করলাম, চিৎকার করলাম, অমনি জজ সায়েবেরও টনক নড়লো। আর পাক্কা কুড়ি মিনিটে ব্যারিস্টার যোগাড়।”
সেদিন নিকোলাসের ভাবভঙ্গীতে ভয় পেয়েছিলাম। লোকটা মাতাল না পাগল? কিন্তু ক্রমশ নিকোলাসকে জেনেছি। বুঝেছি সে পাগল তো নয়ই, মাতালও নয়।
নিকোলাস ড্রলাসকে বুঝতে হলে তার বিচিত্র জীবনকাহিনী গোড়া থেকে শোনা প্রয়োজন। সায়েব ও আমি নিকোলাসের মুখ থেকে তার ভবঘুরে জীবনের আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনেছিলাম।
নিকোলাস ড্রলাস গ্রীসের লোক—যে গ্রীসে পেরিক্লিস ও আলেকজান্ডার জন্মেছিলেন, যে দেশের মাটিতে লালিত হয়েছিলেন সক্রেটীস ও এরিস্টটল। নিকোলাসের গ্রীস অবশ্য অন্য যুগের। বিগতকালের গৌরবের লেশমাত্র সেখানে নেই। সমস্ত দেশ দারিদ্র্যে জীর্ণ। অর্ধেক লোকও পেট পুরে খেতে পায় না। নিকোলাসের স্বপ্ন ছিল বড়ো লোক হবার। নিজের দেশে তা সফল হবে না। তার এক দূর-সম্পর্কের ভাই দেশ ছেড়ে নিউইয়র্কে এক রেস্তোরাঁ খুলে কিছুকালের মধ্যে ব্যাঙ্কে দু’পয়সা করেছিল। নিউইয়র্কে লোকের হাতে পয়সা আছে। আর সে-পয়সা তারা যখের মতো আগলে রাখে না, প্রাণ-ভরে খরচ করে। সুতরাং সেখানে রাতারাতি ভাগ্যপরিবর্তন করা শক্ত হবে না; নিকোলাস ভেবেছিল। এক অশুভ মুহূর্তে সে দেশ ছেড়ে নিউইয়র্কে পাড়ি দিয়েছিল নিশ্চয়। নতুবা যে নিউইয়র্কে লোটা-কম্বল সম্বল করে এসে লোকে বছর কয়েকের মধ্যে ডলারের সমুদ্রে সাঁতার কাটে, সেখানে তিন বছরেও ভাইয়ের রেস্তোরাঁয় কুকের কাজ ছাড়া নিকোলাসের অন্য কিছু জুটলো না কেন? রোজগারের মধ্যে খাওয়া পরা ছাড়া সপ্তাহে দু’ডলার।
ড্রলাসের ধৈর্যের বাঁধে ভাঙন ধরেছিল—আত্মীয়স্বজনও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সুযোগ পেলে তারাও কুড়ি ডলারের কাজ করিয়ে দু’ডলার দেয়। শেষে একদিন ভাই-এর সঙ্গে হাতাহাতির উপক্রম। লোকজন এসে না সরিয়ে দিলে দু’জনকেই পুলিশের শরণ নিতে হতো।
রাজপথে রাত্রি কাটিয়ে ড্রলাস চাকরির সন্ধান করে। অবশেষে এক জাহাজে চাকরি জুটলো। ড্রলাস ভাবে, ভাগ্য প্রসন্ন বলতে হবে। এতো সহজে চাকরি, প্রথমেই এসিস্ট্যান্ট স্টুয়ার্ডের পদ! মাইনে প্রথমে বছরে মাসিক দু’শ’ ডলার, তারপর মাসিক আড়াইশ।
সাগর দিয়ে ঘেরা দেশের মানুষ ড্রলাস। সমুদ্রকে ভয় পায় না। সে ভাবলো, মন্দ কি? নানান দেশ দেখা যাবে, ঘোরা যাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।
জাহাজের নাম এস. এস. ওয়াটারম্যান, চলেছে ভারতবর্ষের দিকে। জাহাজে খাবারের দায়িত্ব ড্রলাসের। কোল্ড রুম থেকে মাংস, মাখন ইত্যাদি বার করা, রান্না ও মেনুর ব্যবস্থা তাকে করতে হয়। কোল্ডরুমে সর্বক্ষণ কাজ করে ড্রলাসের ঠান্ডা লাগলো। চীফ স্টুয়ার্ডকে সে ক’দিন বলেছিল, সর্দি না কমা পর্যন্ত কোল্ড রুমে অন্য কাউকে কাজ দিন। চীফ স্টুয়ার্ড তাতে কান দেননি। ডিউটি কমা দূরের কথা, ছ’ঘন্টার জায়গায় ন’ঘন্টা কাজের শুকুম হলো।
অনিয়ম ও অত্যাচারে ড্রলাসের রোগ পাকিয়ে উঠলো। কিন্তু ঘন্টার পর ঘন্টা ঠান্ডা-ঘরে কাজের বিরাম নেই। কলকাতায় এসে ড্রলাসের অত্যাচার-জর্জরিত শরীর আর বসে থাকতে রাজী হলো না। জাহাজের ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, ডবল নিউমোনিয়া। খিদিরপুরের কাছাকাছি এক হাসপাতালে রোগীকে পাঠানো হলো।
এস. এস. ওয়াটারম্যানের কলকাতায় বারো দিন থাকবার কথা। কিন্তু কোনো কারণে সাতদিনের মাথায় জাহাজ হঠাৎ রেঙ্গুনের পথে পাড়ি দিলো। ড্রলাস তখনও হাসপাতালে। অসুস্থ শরীরে ঠাণ্ডা-ঘরে কাজ করায় রোগ বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। জাহাজের কর্তারা ড্রলাসকে জানিয়ে গেলেন, চিন্তার কিছু নেই। রেঙ্গুন থেকে ফেরার পথে তাকে তুলে নেওয়া হবে।
প্রায় একমাস পরে নিকোলাস ড্রলাস হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল। বুকভরে গ্রহণ করলো উন্মুক্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস। যমে-মানুষে টানাটানিতে যমের হার হয়েছে। কিন্তু ডাক্তাররা বললেন সারাজীবনই তাকে ব্রঙ্কাইটিস ও হাঁপানিতে ভুগতে হবে।
“শয়তান, ওরা আসলে শয়তান।” সায়েবকে বলতে বলতে ড্রলাস চিৎকার করে উঠলো। মুখের ভাবে মনে হলো জাহাজ কোম্পানীর সায়েবদের সামনে পেলে সে খুন করতে পারে।
“আমার কি এই শরীর ছিল? না কোনোদিন ভেবেছি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ষোলো ঘন্টা শুধু কাশতে কাশতে কেটে যাবে? বড়কর্তার হাঁচি হলেই কেবিনে শুয়ে পড়বেন। আর হতভাগা ডাক্তারগুলো ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ফেলে রেখে ডেকের এ-কোণ থেকে ও-কোণ পর্যন্ত ছুটোছুটি করবে। আর আমরা বমি করে মরতে বসলেও একবার আসবে না।”
কলকাতায় কোম্পানীর আপিসে মাসখানেক নিষ্ফল যাতায়াতের পর ড্রলাস জানলো এস. এস. ওয়াটারম্যান আর কলকাতায় আসছে না। ড্রলাস ভাবলে, হয়তো অন্য জাহাজে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে এবং পরে কোনো বন্দরে এস. এস. ওয়াটারম্যানের দেখা মিলবে।
নতুন জাহাজের অপেক্ষায় আরও কিছুদিন কাটে। ধৈর্যের শেষ সীমায় এসে ড্রলাস একদিন জাহাজ কোম্পানীর বড়োসায়েবের ঘরে ঢুকে পড়ে চিৎকার শুরু করলো। “মাসের পর মাস আমাকে ল্যাজে খেলানো চলবে না। কোন্ জাহাজে আমার যাবার ব্যবস্থা করছো বলো।” বড়োসায়েব উত্তর না দিয়ে বেয়ারা দিয়ে ঘর থেকে তাকে বার করে দিলেন। যাবার আগে ড্রলাসও বলেছিল, “আমার কথায় উত্তর দেবে কেন? কিন্তু উকিলের চিঠির উত্তর দিতে পথ পাবে না।”
এটর্নির চিঠি জাহাজ আপিসে সত্যই এসেছিল। কোম্পানীও সত্বর উত্তর দিতে কসুর করেননি। এটর্নি জানতে চেয়েছেন, তাঁর মক্কেল নিকোলাস ড্রলাসকে এস. এস. ওয়াটারম্যানে ফেরত পাঠাবার কী ব্যবস্থা করা হচ্ছে?
কোম্পানী উত্তর দিলেন, “নিকোলাস ড্রলাস নামে আমাদের কোনো কর্মচারী নেই। তবে একজন নিকোলাস ড্রলাসকে কয়েকমাস পূর্বে অসুস্থতার জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল।”
মাথার উপর বাজ পড়লেও নিকোলাস এতো আশ্চর্য হতো না।
চাকরি গিয়েছে! কী অপরাধে? এতদিন পযর্ন্ত তাকে কিছু বলা হয়নি কেন? রাগে ও অপমানে ড্রলাসের সর্বশরীরে জ্বলন শুরু হয়। কোম্পানীকে সে ছাড়বে না। তাদের যোগ্য শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। গ্রীসের সন্তান সে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নোয়ানোর শিক্ষা তাদের সাত-পুরুষে নেই।
সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তাই দিয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের হলো। অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করলে সে।
ভারতবর্ষে মামলা চালানো খুব সোজা ব্যাপার নয়। এর জন্য অর্থ ও ধৈর্যের প্রয়োজন। আইনের লড়াইতে ড্রলাস অভ্যস্ত নয়। যে পরিবেশে সে মানুষ, সেখানে হাতের কব্জিতে জোর থাকতে কেউ আদালতে যায় না। মরদরা আদালতে নালিশ করার আগে নদীতে ঝাঁপ দেবে। চেম্বারে এসে ড্রলাস প্রায়ই বলতো, “ভেরি ব্যাদ প্লেস। এবিদি থিফ্ হিয়ার, বিগম্যান বিগ্ থিফ্।” পৃথিবীতে কাউকে সে বিশ্বাস করে না। এখানে সবাই চোর, সবাই নাকি জাহাজ কোম্পানীর টাকায় ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
মামলা দায়ের হওয়ার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “এই ক’বছর কি করা হচ্ছিলো?”
ড্রলাসের মুখ লাল হয়ে উঠলো। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিছু বলতে চায় সে। কিন্তু ভাষার অসুবিধা। ইংরেজি ভালো বলতে পারে না। উত্তেজনার মাথায় সে গ্রীক ভাষায় অনর্গল বকে যাচ্ছিলো। আমাদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে দেখে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বললে, “শয়তান কোম্পানী! দুষমন কোম্পানী! ওরা ভেবেছিল আমাকে কলকাতা থেকে সরাতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।”
আসলে, মামলা দায়ের করার কিছুদিন পরেই পুলিশের শুভদৃষ্টি তার উপর পড়লো। যুদ্ধের বাজারে বেকার বিদেশী স্বভাবতই সন্দেহজনক। জাহাজ কোম্পানীও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই সন্দেহজনক গ্রীকটির দেশে ফিরবার খরচ দিতে রাজী হয়েছেন।
তখন ভালো করে সকাল হয়নি; রাস্তার আলো তখনও জ্বলছে। এলিয়ট রোডের এক অন্ধকার ঘর থেকে নিকোলাস ড্রলাসকে তুলে নিয়ে সিকিউরিটি পুলিশের গাড়িটা সোজা খিদিরপুরে হাজির হলো। কেন তাকে বহিষ্কৃত করা হচ্ছে, ড্রলাস জানতে পারেনি। শুধু তাকে বলা হয়েছিল, তোমাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু দেশ কোথায়? দেশ তো নাৎসীদের হাতে। বিতাড়িত গ্রীক সরকার তখন আলেকজান্দ্রিয়াতে রাজধানী বসিয়ে দিন গুনছেন। পুলিশের মতে আলেকজান্দ্রিয়াই তার দেশ। ড্রলাস চিৎকার করে প্রতিবাদ করেছিল। অনুনয় বিনয়েও কিছু ফল হয়নি। অভিমানে হতভাগ্য নাবিকের চোখের কোলে সেদিন জল এসেছিল। সে জানতে চেয়েছিল, কী তার অপরাধ? সে তো চোর নয়, গুণ্ডা নয়, কোনো দোষই করেনি সে। তা ছাড়া, কোম্পানীর কাছে তার অনেক টাকা পাওনা রয়েছে। তারা ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশ সে-সব কথায় কান দেয়নি।
গ্রীসের অস্থায়ী রাজধানীতে ড্রলাসের জন্য আরও অনেক দুঃখ তোলা ছিল। জাহাজ থেকে নামবার সঙ্গে-সঙ্গে সামরিক পুলিশ শত্রুপক্ষের গুপ্তচর সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করলো। ড্রলাস কাকুতি-মিনতি করে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল সে গুপ্তচর নয়। কিন্তু সামরিক কোর্টের বিচারকরা সহজে বিচলিত হন না। এরকম ছন্নছাড়া লোক গুপ্তচর না হয়ে পারে না। অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাগারের অন্ধকার নিকোলাস ড্রলাসকে গ্রাস করলো।
প্রায় চার বছর পরে লৌহ-কপাট আবার উন্মুক্ত হলো। কিন্তু এই চার বছরের একদিনও ড্রলাস জাহাজ কোম্পানীকে ভুলতে পারেনি। ভুলবেই বা কী করে? পুরো চার বছর সে কাশিতে কষ্ট পেয়েছে। কাশতে কাশতে চোখ দুটো প্রায়ই বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা হয়েছে। আর প্রতিবারই মনে পড়েছে, কোম্পানী তার পিছনে পুলিশ লাগিয়েছে। কে জানে, তারাই হয়তো এখানে জেলের ব্যবস্থা করেছে।
মুক্তি পেয়ে ড্রলাস দেশে ফিরলো না। ফিরবার ইচ্ছা হয়নি এমন নয়, কিন্তু তাকে প্রতিশোধ নিতেই হবে। অন্যায়ের উত্তর না দিতে পারলে গ্রীকের জীবনে রইলো কি?
আবার কলকাতা। চার বছর আগে যে নিকোলাস ড্রলাসকে এই শহর বিদায় দিয়েছিল, সে আবার এসেছে। কোথায় আলেকজান্দ্রিয়া আর কোথায় কলকাতা। কিন্তু কপর্দকহীন নিকোলাস যে কী ভাবে এই দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করেছিল জানি না।
“আমার কেসের কী হলো?” ভূত দেখলেও হাজরা ও বাসু কোম্পানীর সিনিয়র পার্টনার হাজরা সায়েব এমন আশ্চর্য হতেন না। কোনো মক্কেল যে বছর পাঁচেক পর হঠাৎ আবির্ভূত হতে পারে ও মামলার খবর জানতে চাইতে পারে, এ তাঁর স্বপ্নেরও অগোচর। ড্রলাস বললে, “মাই কেস্ উইথ দি শিপিং কোম্পানী। আই নত্ ঘোস্ত্।”
বাদীর অনুপস্থিতিতে মামলার অবস্থা কি হয়েছে হাজরা সাহেব জানতেন না। সে খবর যদি কেউ জানে, তিনি স্বয়ং ভগবান, কিংবা ওপাড়ার ভাষায় যম।
আইনের চৌহদ্দি ড্রলাসের জানা নেই। জানতেও সে চায় না। কিন্তু কেন সে ক্ষতিপূরণ পাবে না? জাহাজ কোম্পানী কেন তাকে প্রতারণা করবে? এই সামান্য ব্যাপারে বাদী, বিবাদী, প্লেন্ট, রিটন্ স্টেটমেন্টের কী প্রয়োজন, সে বুঝতে পারে না।
ড্রলাসের সমস্ত রক্ত তখন মাথায় উঠেছে। সে নিজেই আজ জজের সঙ্গে বোঝাপড়া করবে। কিন্তু আজব জায়গা! নিজের কথা নিজে বলার রেওয়াজ নেই। তোমার হয়ে কথা বলবার জন্য অন্য লোক গাউন পরে বসে রয়েছে, পয়সা দিলেই জজ-সায়েবকে সব বুঝিয়ে দেবে। সোজা কোর্ট ঘরের মধ্যে ঢুকে ড্রলাস চিৎকার শুরু করে, “হোয়াত্ এবাউত্ মাই কেস? কোম্পানী এ থিফ্ স্যার। দে সেন্ত মি তু জেল।”
কোর্ট-ঘরে আলোড়ন পড়ে যায়। চাপরাসীরা ছুটে আসে। আধময়লা শার্ট · ও প্যান্ট-পরা ড্রলাসকে পাগল ভেবে অনেকে ভয়ে ছুটতে শুরু করে। জাস্টিস রায় নিজে চেয়ার থেকে নেমে এসে ড্রলাসকে শান্ত করার চেষ্ট করলেন। নিজের বক্তব্য গুছিয়ে বলার শক্তি নেই। শুধু হাতের মুঠো পাকিয়ে সে বলে, “এভরিবদি থিফ্। কোম্পানী গিভিং মানি তু এভরিবদি।” জাস্টিস রায় সেদিন এই গ্রীক নাবিকের জন্য প্রকৃত দুঃখ অনুভব করেছিলেন। না হলে এটর্নি হাজরাকে তিনি ডেকে পাঠাতেন না; আর সায়েবকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে মামলা গ্রহণ করতে বলতেন না।
ড্রলাস প্রায়ই আমাদের চেম্বারে আসে। প্রথমদিকে তাকে এড়িয়ে যেতাম। সে কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলতো, “হ্যাল্লো বাবু, হাউ দু ইউ দু?”
গ্রীক বলতে পূর্বে আমার মনের মধ্যে গ্রীক ভাস্কর্যের নিদর্শনগুলো ভেসে উঠতো। প্রশস্ত বক্ষ,; উন্নত নাসা, পেশীবহুল দেহ। ময়লা বেশবাসে কঙ্কালসার রক্তহীন ড্রলাসকে দেখে মনে হতো সে শুধু শিল্পীর স্বপ্নে রূপ পরিগ্রহ করেছে। ড্রলাসের তবুও আকর্ষণী শক্তি আছে। তার টানা-টানা চোখ দুটোর দিকে তাকালে অকারণে ভালোবাসা জন্মায়।
ড্রলাসের প্রতি সাহেবের গভীর মমতা। দিনের পর দিন বিনা ফী-এ তাঁকে নথিপত্র তৈরি করতে দেখেছি। সায়েব বলতেন, “জলের লোকদের আমি ভালোবাসি। আমি নিজে যে সাগরজলে-ঘেরা দেশের লোক। ছোটবেলায় কত জেলে কত নাবিকের সঙ্গে ভাব করেছি, কত গল্প করেছি। ওরা বড় অসহায়। ডাঙার মানুষের প্যাঁচালো বুদ্ধির সঙ্গে পেরে ওঠে না।”
কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি নিজেও ড্রলাসের অনেক গল্প শুনেছি। শুধু জাহাজের নয় দেশবিদেশের গল্প। নিজের গ্রামের কথা নিকোলাস প্রায়ই বলতো। তার পাড়াপড়শীরা খুব ভালো লোক। আমরা স্বচ্ছন্দে তার গ্রামে যেতে পারি, কোনো অসুবিধা হবে না। নিকোলাসের কাছ থেকে আসছি শুনলে, তারা খুব যত্ন করবে। তবে হ্যাঁ, সে যে এত কষ্টে আছে, যেন কিছুতেই না বলি। আমি হেসে জিজ্ঞাসা করতাম, কিন্তু কথা কইবো কী করে, গ্রীক তো জানি না। আর ও-ভাষা শিখতে গেলে তো তিনমাসে মাথায় টাক পড়ে যাবে। নিকোলাস আমায় বোঝাতো, একদম মিথ্যা কথা। ইংরেজরা ইচ্ছা করে পৃথিবীতে এইরকম রটিয়েছে। গ্রীক খুব সোজা ভাষা, ইংরেজি থেকে অনেক সহজ। আমার শিখতে মোটেই অসুবিধা হবে না। আর না শিখলে চিন্তা নেই। বুড়ো ইউমোফপুলাস খুড়ো গ্রামে আছেন। রেলি ব্রাদার্সে চাকরি নিয়ে পুরো পঁচিশবছর তিনি কলকাতা আর বোম্বাইয়ে কাটিয়ে গিয়েছেন। চোস্ত ইংরেজি বলেন। তিনিই সব বুঝিয়ে দেবেন। ইংরেজিতে কথা বলার লোক পেলে খুব খুশী হবেন ইউমোফপুলাস খুড়ো।
ড্রলাসের এই শান্ত স্নেহমধুর রূপটাই সব নয়। অতি সহজে সে ধৈর্য হারায়। একদিনের কথা। কোম্পানীর কাছে কত টাকা দাবি করা যায় আলোচনা হচ্ছে। সায়েব বললেন, তিনবছরের বেশি মাইনে দাবি করে লাভ নেই। সঙ্গে-সঙ্গে ড্রলা স চিৎকার শুরু করলো, “কেন? আমি সাতবছরের মাইনে পাবো। আমাকে তো অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।” সায়েব প্রথম মৃদু হেসে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, আইন অনুযায়ী কাজ করতে হবে। নিজের খেয়াল-খুশি মতো দাবি করা চলে না। ড্রলাস ততোক্ষণে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, “আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। সবাই চোর এখানে। কোম্পানী সব জায়গায় টাকা ঢালছে।”
কথাগুলো আর সহ্য করতে পারলাম না। বললাম, “ড্রলাস, তুমি অকৃতজ্ঞ। সায়েব যে কেন অনর্থক তোমার জন্য এতো পরিশ্রম করছেন জানি না।”
গলার স্বর আরও চড়িয়ে ড্রলাস বললে, “আমিও তাই জিজ্ঞাসা করছি। আমি কি লোক দেখিনি? বিনা উদ্দেশ্যে কেউ এতো খাটে? আমি অতো বোকা নই, নিশ্চয় ভিতরে কিছু—” কথা শেষ না করেই সে ঘর থেকে সবেগে প্রস্থান করলো।
রাগে আমার সর্বশরীর জ্বলতে লাগলো। এমন অকৃতজ্ঞের জন্য সায়েব যে কেন সময় নষ্ট করেন, তিনিই জানেন।
বই থেকে মুখ তুলে সায়েব মৃদু হাসলেন। বললেন, “বেচারাকে দোষ দিই না। পৃথিবীতে স্নেহ ভালোবাসা কারুর কাছে পায়নি। কেন সে আমাকে বিশ্বাস করতে যাবে?”
তবুও ড্রলাসের ঔদ্ধত্য সেদিন ক্ষমা করতে পারিনি। ভেবেছি এমন লোকের জন্য কাজ না করাই ভালো।
কয়েক ঘণ্টা পরের কথা। সায়েব ডিক্টেশন দিচ্ছেন। আমি শর্টহ্যাণ্ড খাতায় লিখছি। এমন সময় জুতোর শব্দে চেয়ে দেখলাম দরজার আড়ালে ড্রলাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধীরে-ধীরে ভিতরে প্রবেশ করে সে ঘাড় নিচু করে দাঁড়ালো। অপরাধী ছাত্র যেমন করে শিক্ষকের সামনে আসে, সেও তেমনি পা ঘষতে ঘষতে কাছে এগিয়ে এসে, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সায়েব মুখ তুলে বললেন, “হ্যাল্লো ড্রলাস।” মুখ নিচু রেখেই ড্রলাস কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললে, “স্যার, আই এম সরি। ইউ নত্ ব্যাদ ম্যান। আই এম সরি।” তারপর আচমকা সবাইকে বিস্মিত করে সে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“আশ্চর্য মানুষ,” দরজার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সায়েব বললেন।
পরের দিন ড্রলাসের সঙ্গে আবার দেখা হয়েছে। মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে সে আবার বলেছে, “হ্যাল্লো বাবু, হাউ দু ইউ দু?” আগের দিন যেন কিছুই ঘটেনি।
সায়েবের ঘরে অন্য মক্কেল ছিল। ড্রলাসকে আমার সামনের চেয়ারে বসতে দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম চা আনবো কিনা। অনেক অনুরোধের পর সে রাজি হলো। চা-এর কাপে চুমুক দিতে-দিতে কথায়-কথায় জিজ্ঞাসা করলাম, “মিঃ ড্রলাস, এখন কি করে চলছে?”
“ওয়ান লোফ্ ফর লাঞ্চ এণ্ড ওয়ান লোফ্ ফর দিনার,” ড্রলাস উত্তর দিলে।
“মাঝে-মাঝে ডকে জাহাজের অফিসারদের ফাই-ফরমাশ খেটে দিই, মাসে বারো-তেরো টাকা হয়। তাছাড়া তুমি তো জানো, সায়েব কিছু-কিছু…….।” আমি অবশ্য জানতাম না। বুঝলাম, তিনি সেটা গোপন রেখেছেন।
জিজ্ঞাসা করলাম, “মিঃ ড্রলাস, এতো কষ্ট কেন সহ্য করছো? চেষ্টা করলেই তো অন্য জাহাজে চাকরি যোগাড় করতে পারো।”
দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে ড্রলাস আমার দিকে তাকালো। মনে হলো সন্দেহ করছে, কোম্পানী হয়তো আমাকেও টাকা দিয়েছে। উত্তেজিত হয়ে সে বললে, “তুমি কি বলতে চাও শয়তানকে শাস্তি না দিয়েই চলে যাবো? সে হবে না। বছরের পর বছর তারা আমাকে ঘুরিয়েছে, আমাকে চালান করেছে, জেলে পাঠিয়েছে। আমি ওদের ছেড়ে দেবো? তাছাড়া মামলা তো শীঘ্রই কোর্টে উঠবে।”
মামলার দিন নির্ধারণ এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। স্বয়ং দেবতারাও এখানে অক্ষম। মামলা দায়ের করে, আপনি পায়ে হেঁটে পৃথিবী ভ্রমণে বেরুতে পারেন। হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে তিব্বত ও চীন পরিভ্রমণ সমাপ্ত করুন। তারপর সাহারায় বছরখানেক কাটিয়ে, সোজা দক্ষিণে চলে যান। উত্তরমেরু, দক্ষিণমেরুও বেড়িয়ে আসতে পারেন। ফিরে এসে দেখবেন, অপরপক্ষ আজ পেটের ব্যথা, কাল মেয়ের বিয়ের অজুহাতে তখনও দিন নিচ্ছেন।
ড্রলাসের মামলায় এই সত্যের নিদারুণ উপলব্ধি হলো। তাড়াতাড়ি শুনানির যথাসাধ্য চেষ্টা করেও ফল হয়নি। প্রায়ই নানান অজুহাতে দিন পিছোয়। রুক্ষ চুল, মলিন মুখে ড্রলাস এসে দাঁড়ায়। যখন শোনে আবার দিন পড়েছে, সমস্ত মুখটা যন্ত্রণায় কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। ড্রলাসের এই ভয়াবহ রূপ আমাকে অনেকবার দেখতে হয়েছে।
একদিন কিন্তু সে বোমার মতো ফেটে পড়লো। “এগেন দেত! অল থিফ্ হিয়ার। এভরিবদি তেকিং মানি ফ্রম কোম্পানী।” সায়েবের শরীর ক’দিন ভালো যাচ্ছিল না। রাগতস্বরে আমাকে বললেন, “কবে এই নাবিকটার হাত থেকে উদ্ধার পাবো, বলতে পারো শংকর?”
“আচ্ছা, আচ্ছা দেখা যাবে।” বলে ড্রলাস জোরে দরজা ঠেলে দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে আমার টেবিলের সামনে বসলো। তারপর কাগজে ঘষ ঘষ করে কি যেন লিখলো। কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে বললে, “দেখে রাখো, আমিও চিঠি লিখে দিচ্ছি।”
বারকয়েক চেষ্টা করেও পাঠোদ্ধারে অক্ষম হলাম। বুঝলাম, এটা নির্ঘাত গ্ৰীক ভাষা। ফেরত দিয়ে বললাম, “মিস্টার ড্রলাস আমি গ্রীক বুঝি না। আর এই চত্বরে কেউ বোঝে বলেও জানি না।” রাগতস্বরে ড্রলাস বললে, “তুমি কি বলতে চাও জজরাও গ্রীক জানে না?” আমিও শ্লেষের সুরে বললাম, “এটা গ্রীস নয়, তবে জজরা যদি মিস্টার নিকোলাস ড্রলাসের জন্য গ্রীক শিখে থাকেন, জানি না।” কথাটা বলেই লজ্জা অনুভব করলাম। বেচারাকে আঘাত দেওয়া উচিত হয়নি। ড্রলাস আমার মুখের দিকে অসহায়ভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, “আমি যে ইংরেজি জানি না। জানলে চীফ জাস্টিসকে লিখতাম। আর লিখেই বা কি হবে! সেখানেও কোম্পানী কি যায়নি?” কাগজটা পকেটে পুরে যথাসম্ভব জোরে মাটিতে পা ঠুকতে-ঠুকতে সে বেরিয়ে গেল।
পরের দিন সকালে ড্রলাস আবার হাজির। হাসিমুখে বললে, “হ্যালো বাবু, হাউ দু ইউ দু?” গতকালের ঘটনা যেন সে ভুলে গিয়েছে। অন্যদিন অপেক্ষা আজ তাকে অনেক হাসিখুশি দেখাচ্ছে। জামাকাপড়গুলো ধোপভাঙা।
“বাবু, আমার সঙ্গে একবার আসবে?” জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন?” “সেটা পরে জানতে পারবে। এখন চলো।” প্রায় জোর করেই ড্রলাস আমাকে সঙ্গে নিয়ে চললো। তার উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্য বলতে কি, একটু ভয় হলো। যে রকম লোক, সব কিছুই করা সম্ভব। লিফ্ট থেকে নামলাম। টেম্পল চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমরা ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীট ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার ভয় আরও বাড়ছে। হঠাৎ কাঁধে ড্রলাসের হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। “বাবু, আমার জন্য তোমাকে খুব খাটতে হচ্ছে, না?” ড্রলাসের স্নেহভরা কণ্ঠস্বর।
যেখানে এসে আমরা থামলাম, সেটি এক রেস্তোরাঁ। খাবারের অর্ডার দিয়ে ড্রলাস গুণগুণ করে গান ধরলে। আমি তখনও কিছু বুঝতে পারছি না।
হঠাৎ সে বললে, “আশ্চর্য লাগছে? কিন্তু আজ যে ২০শে নভেম্বর, আমার ছেলের জন্মদিন। দেশে থাকলে কত আনন্দ হতো। নয়, দশ, এগারো…..হ্যাঁ সে বারো বছরেই পা দিলো।” চায়ের কাপে মুখ দিতে গিয়ে ড্রলাস চমকে উঠলো। কাপটা একটু সরিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করলে, “কিন্তু ওরা বেঁচে আছে তো? এতো বড় যুদ্ধে সব হয়তো লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে। সাতবছর কোনো খবর পাইনি। আচ্ছা বাবু, তোমার কি মনে হয়? আমার ছেলে, তার মা, ওরা বেঁচে আছে?”
কী উত্তর দেবো? ঘরছাড়া হতভাগ্য নাবিক, দীর্ঘ সাতবছর প্রিয়জনের সঙ্গসুখে বঞ্চিত। জীবনের-মরুভূমিতে নিজেকে রক্ষা করতেই সে ব্যস্ত। স্ত্রী-পুত্রের জন্য চিন্তার অবসর নেই। তবুও মাঝে মাঝে ক্যালেণ্ডারের একটা বিশেষ দিন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় ঘরের কথা, সন্তানের কথা।
বললাম, “নিশ্চয় বেঁচে আছে। হয়তো এতদিনে মাস্টার ড্রলাস অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে।”
“হয়তো আমাকে চিনতে পারবে না। কিন্তু যাই বলো, প্রথম যখন দেখা হবে তখন ভারি মজা হবে।”
বিরহী ড্রলাসের মন কোন সুদূরে চলে যায়। কল্পনার পটে হয়তো আগামী দিনের কথা জেগে ওঠে। মামলায় জিত হয়েছে। অনেক টাকা নিয়ে সে নিজের গ্রামে একটা দোকান করে বসেছে। পাড়ার লোকেরা গল্প শুনতে আসে। নিউইয়র্ক শহরটা কেমন; এডেন ও আলেকজান্দ্রিয়ার মধ্যে কোনটা ভালো; ইণ্ডিয়া, সেই ইণ্ডিয়া যেখানে আলেকজাণ্ডার সসৈন্যে গিয়েছিলেন, তার এখন কী অবস্থা? কলকাতা শহর, জাহাজ কোম্পানী, ইংরেজ ব্যারিস্টার আরও কত কি….
দু’টাকার বিল এল। ড্রলামের কয়েকদিনের খাবার খরচ। ভাবলাম, নিজেই পয়সাটা দিই। মন বললে, না, ছেলের জন্মদিনে, পিতার গর্ব ক্ষুণ্ণ করবার অধিকার তোমার নেই।
অবশেষে জানুয়ারীর গোড়ার দিকে মামলার দিন পাকাপাকিভাবে নির্ধারিত হলো। জাস্টিস রায় কথা দিয়েছেন, ড্রলাসের মামলা দিয়ে নতুন বছরের কাজ আরম্ভ করবেন।
বড়োদিনে সেবার সায়েবের রাণীক্ষেতে যাবার কথা ছিল। মেমসায়েব আগেই চলে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি যাওয়া স্থগিত রাখলেন। ছুটির পরেই মামলা। শক্ত কেস, উপরন্তু কোনো জুনিয়র নেই।
কথায়-কথায় সায়েবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বড়োদিনের উৎসবে এবার কে কে আসবেন?” সায়েব হাসলেন, “তুমি জানো, এককালে আমি যুদ্ধ করতাম।”
“হ্যাঁ জানি, এলবামে অনেক ছবি দেখেছি।”
“এবার বড়োদিনে একজন যোদ্ধাকে নিমন্ত্রণ করছি। মস্ত যোদ্ধা।
নাম জানতে চাইলাম। সায়েব আবার হাসলেন। “ইলিয়ড, অডিসির গল্প পড়েছো? হোমারের অমরকাব্যের মহানায়ক ইউলিসিস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি খড়্গহস্ত। শত্রু সংহারের জন্য দেশত্যাগী হলেন তিনি। পিছনে পড়ে রইলো প্রিয়া, পড়ে রইলো সাধের সংসার। অতিক্রান্ত হলো বহুবর্ষ। নানা দেশের আকাশে উড়লো তাঁর বিজয়কেতন। ইউলিসিস, ক্লান্ত শ্রান্ত। জায়া চিন্তায় মগ্ন। কিন্তু অভিযান এখনও শেষ হয়নি। অনেক বাকি। এখনো সময় হয়নি নিকট।
ইউলিসিসকে কেন্দ্র করে ছোটোবেলায় অসংখ্য স্বপ্ন রচনা করেছি। ভেবেছি তাঁর সাক্ষাৎ পেলে খুব মজা হবে। কিন্তু দেখা হয়নি। আজ এতোদিন পরে এই বৃদ্ধবয়সে তাঁর দেখা মিলছে। তিনি আজও প্রবাসী, গৃহহারা। বড়োদিনে তিনিই আমার একমাত্র অতিথি। তাঁর নাম নিকোলাস ড্রলাস।”
বড়োদিনের নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে আমি ড্রলাসের কাছে যাবো। সায়েব বললেন, “যাবার পথে আমার একটা শার্ট, একটা প্যান্ট ও একটা টাই নিয়ে যেও; দেওয়ান সিংকে বলা আছে। আর ড্রলাসকে বলো, এগুলো না নিলে আমি দুঃখিত হবো।”
সেদিন শনিবার। প্রায় দুটো বাজে। ড্রলাসের ঘরের মধ্যে ঢুকতেই দুর্গন্ধে গা ঘুলিয়ে উঠলো। হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে ঘরের এক কোণে ড্রলাস খেতে বসেছে। সামনে পুরনো খবরের কাগজের উপর একটা পাউরুটি ও খানিকটা চিনি কাপড়ের বাণ্ডিল ও চিঠিটা তার হাতে দিলাম। সে কথা বলতে পারলে না। শুধু কৃতজ্ঞতায় আমার হাত চেপে ধরলে।
বড়োদিনের লাঞ্চ-টেবিলে সেবার আমিও উপস্থিত ছিলাম। ধোপদুরস্ত সুট পড়েছে ড্রলাস। সিগারেটের টিন এগিয়ে দিয়ে সায়েব বললেন, “মিঃ ড্রলাস, তুমি আমার অতিথি। কোনোরকম লজ্জা করলে চলবে না।” খাওয়ার আগে মদ এল। লাল গ্রীক মদ। যথারীতি গ্লাস উপরে তুলে সায়েব বললেন, “নববর্ষে আমার একান্ত প্রার্থনা নিকোলাস ড্রলাসের জীবনে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হোক।” অভিভূত ড্রলাস ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। অনেক কালের রোদে-পোড়া মাটিতে প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা পড়েছে।
বছরের গোড়াতেই মামলা শুরু হলো। কঠিন মামলা। জাহাজ কোম্পানী নামজাদা ব্যারিস্টার দিয়েছেন। আইনের সামান্যতম খুঁটিনাটি নিয়ে বাক্যযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যার জন্য দু’পক্ষই অসংখ্য নজির দেখালেন। জাহাজের মালিক স্প্যানিশ, কিন্তু জাহাজের রেজেস্ট্রি আর্জেন্টিনায়। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ও চুক্তি ভেঙেছে ভারতবর্ষে।
পুরো পাঁচদিন মামলা চললো। পঞ্চম দিনের শেষে সায়েবকে চিন্তিত মনে হলো। গাউন হাতে করে হাইকোর্টের সিঁড়ি দিয়ে তিনি নামছিলেন। শীতের দিনেও তাঁর কপালে ঘাম জমে উঠেছে। ঐতিহাসিক সিঁড়ি। শতাব্দী ধরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন যোদ্ধারা এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছেন ও নেমেছেন। এ তো শুধু ন্যায়ের মন্দির নয়, ন্যায়ের দুর্গও বটে। মানুষের অধিকার রক্ষার সদাজাগ্রত প্রহরী।
.
রেড রোড ধরে গাড়ি ছুটছিল। শীতের অপরাহু। পশ্চিম আকাশ থেকে সূর্য সবেমাত্র বিদায় নিয়েছে। ছমছমে ভাব। দিনের শেষে ক্লান্ত পাখির দলও বাসা অভিমুখে চলেছে। দিগন্ত পানে তাকিয়ে সায়েব বললেন, “প্রাচীন যুগে এমন সময়ে যুদ্ধ বিরতির বিউগল বেজে উঠতো। নিকোলাস ড্রলাসের যুদ্ধও শেষ করে এলাম। ফলাফল অনিশ্চিত।”
রায়ের দিনে সায়েব কোর্টে গেলেন না। পরিবর্তে জুনিয়র মিস্টার মজুমদারকে পাঠালেন। ড্রলাসকে সঙ্গে নিয়ে আমি কোর্টে গেলাম। কোর্ট-রুমে বেশ ভিড়। ড্রলাস গম্ভীরমুখে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো। তার পাশে বসতে সাহস হলো না। কে জানে রায় শুনে কী করে বসবে। মিনিট কয়েক পরেই ঘরের কোণে পর্দা সরে গেল। জাস্টিস রায় আসছেন। বুকের মধ্যে দপদপ করছে।
নিকোলাস ড্রলাসের জয় হয়েছে। আনন্দের আতিশয্যে বেঞ্চি থেকে লাফিয়ে পড়লাম, কিন্তু ড্রলাস কোথায়? সে ততোক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে। তাকে সামলাতে আমিও পিছন-পিছন ছুটলাম। ড্রলাসের কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। গাড়ি-ঘোড়ার তোয়াক্কা না করে রাস্তা পেরিয়ে সে টেম্পল চেম্বারের উপর উঠছে। যেন ম্যারাথন দৌড়। যুদ্ধে জয় হয়েছে জয়বার্তা নিয়ে চলেছে গ্রীক বার্তাবহ।
চেম্বারে যখন হাজির হলাম, সাহেব তখন খবর পেয়ে গিয়েছেন। শুনতে পেলাম ড্রলাস বলছে, “আই এম সো সরি স্যার। এভরিবদি নত্ থিফ্।”
সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “যুদ্ধে জয় তো হলো। এখন কী করবে?”
আনন্দের আতিশয্যে প্রায় নাচতে-নাচতে ড্রলাস বললে, “টাকা পেলেই দেশে ফিরবো। তার আগে বউকে টেলিগ্রাম পাঠাবো, আমি বেঁচে আছি। শীঘ্র দেখা হবে।”
মিঃ মজুমদার কিন্তু গম্ভীরমুখে ফিরলেন। আড়ালে সায়েবকে ডেকে কী সব বললেন। সায়েবের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে। এক মুহূর্তে জয়ের আনন্দ কোথায় হারিয়ে গেল। কোম্পানী রায় মানবে না, তারা আপীল করবে। অর্থাৎ আরও দু’বছর।
চোখের নিমেষে ড্রলাস কি যেন করে বসলো। তার হাতের কাঁচের গ্লাশ মেঝেতে আছড়ে পড়লো। ঝনঝন করে শব্দ। ড্রলাস নেই। চারিদিকে ভাঙা কাঁচের টুকরো।
ঘরের মধ্যে থমথমে বিশ্রী গুমোট। ভাঙা গ্লাসের টুকরোগুলোর দিকে সায়েব কয়েকবার বিষণ্নমুখে তাকালেন। একটা কথাও বললেন না। চারটের অনেক আগে ক্লাবে ফিরে এলেন। বিকেলের ট্রেনে মাদ্রাজ যেতে হবে। সেখানে জরুরী কেস্ আছে। দিন দুই পরের কথা। চেম্বারে বসে আছি। সায়েবের অনুপস্থিতিতে বিশেষ কাজ নেই। টেলিফোন বেজে উঠলো। নিকোলাস ড্রলাস ফোনে সায়েবের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।
“তারা আবার এসেছে আমাকে ধরতে। আমাকে এখুনি তারা ধরে নিয়ে যাবে। সায়েবকে একটিবার ফোন ধরতে বলো, প্লীজ।”
আমাকে বলতে হলো, সায়েব এখানে নেই, মাদ্রাজ গিয়েছেন। টেলিফোনেই তার ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলাম। আর কথা বলবার আগেই ফোনের সংযোগ কেটে গেল।
এক সপ্তাহ পরে সায়েব ফিরলেন। সব বললাম তাঁকে। সিকিউরিটি পুলিশকে ফোন করে তিনি ড্রলাসের সংবাদ জানতে চাইলেন। উত্তর এল, নিকোলাস ড্রলাস নামে এক গ্রীককে বিশেষ ক্ষমতাবলে ভারতবর্ষ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে।
ফোন নামিয়ে রেখে সায়েব শুধু বললেন, “হুঁ।”
সেই শেষ, এরপর নিকোলাস ড্রলাসের আর কোনো খবর পাইনি। বিশাল পৃথিবীর বৃহৎ জনারণ্যের কোথায় সে মিশে গিয়েছে কে জানে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না এ-কথা ভাবতেই পারি না। নিকোলাস ড্রলাসকে আমি জানি। সে আবার আসবে। আবার সে ছুটবে কোম্পানীর পিছনে।
“হ্যাল্লো বাবু, হাউ দু ইউ দু?” ড্রলাসের মুখ থেকে সেই অতিপরিচিত ডাক শোনবার প্রতীক্ষায় আছি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন