শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
হোটেল ছেড়ে সায়েব চৌরঙ্গী রোডের উপর এক ক্লাবে উঠে গেলেন। তিনি অনেক বৎসর ধরে সে ক্লাবের সভ্য। ক্লাবে থাকবার ব্যবস্থা অতি সুন্দর। দু’খানা ঘরই শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। ঘরগুলির আকারও বেশ বড়ো।
ছুটির পর আমাকে রোজ সেখানে যেতে হয়। বাড়ি ফিরতে সেজন্য আরও একটু দেরি হয়। কিন্তু গড়ের মাঠের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যা আটটার সময় ট্রামগুলো যখন হু-হু করে চলে, বেশ লাগে। আরও ভালো লাগে যখন সাড়ে চারটের সময় গাড়িতে চড়ে সায়েবের সঙ্গে রেড রোড ধরে যাই। ড্রাইভারের পাশে বসে মোহনচাঁদ। পিছনে সায়েব ও আমি। দূরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। তারপর একসময় মেমোরিয়ালকে বাঁ পাশে ফেলে রেখে আমরা আরও এগিয়ে যাই। দমকা হাওয়ার জন্য চোখ বন্ধ করে থাকি। যখন মোটরের চাকার সঙ্গে নুড়ির ঘর্ষণে অস্পষ্ট খড়বড়-খড়বড় আওয়াজ হতে থাকে তখন চোখ খুলি; বুঝতে পারি ক্লাব এসে গিয়েছে। ক্লাব বাড়িটার চারিদিকে অসংখ্য ফুলের গাছ। একদল মালী সর্বক্ষণ তাদের পরিচর্যায় ব্যস্ত। পাশেই তাদের জালে ঘেরা টেনিস লন। প্রতি মিনিটে দু’একটা গাড়ি এসে দরজার কাছে থামছে। দু’- একজন গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভিতরে চলে যাচ্ছেন, আর গাড়িটা আরও এগিয়ে গিয়ে একজায়গায় অলসভাবে পড়ে থাকে।
জামা-কাপড় ছাড়তে সায়েব ভিতরে চলে যান। আমিও সেই সুযোগে সোফাতে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করি। একটু পরে চা আসবে। চা শেষ করে, আবার কাজ আরম্ভ হবে। সায়েব বলে যাবেন, আমি শর্টহ্যাণ্ড লিখে নেবো।
.
এই ক্লাবেই শ্রীমতী সুনন্দা উইলসনকে প্রথম দেখি। শ্রীমতী না বলে তাঁকে মিসেস সুনন্দা উইলসন বলা উচিত। কারণ বাঙালী হলেও শ্রীমতী সম্ভাষণ তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা।
ক্লাবে সায়েবের ঘরে আমি একা বসেছিলাম। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। দরজা খুলে দেখলাম টেনিস র্যাকেট হাতে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। ভিতরে আসতে বললাম তাঁকে। ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি ভিতরে ঢুকে এলেন। একটা চেয়ার তাঁর দিকে এগিয়ে দিলাম। বোধ হয় এইমাত্র খেলে ফিরছেন ভদ্রমহিলা। কপালে মুক্তোর মতো কয়েকটি ঘামের ফোঁটা কিছুতেই রুমালের বাধা মানতে চাইছে না।
ঈষৎ হেসে তিনি বাঙলাতেই জিজ্ঞাসা করলেন, “সায়েব আছেন?” মধুক্ষরা কণ্ঠস্বর।
সায়েব ছিলেন না, লাইব্রেরীতে বই আনতে গিয়েছিলেন। বললাম, “এখনই আসবেন, একটু যদি অপেক্ষা করেন।”
সুনন্দা দেবী নিতান্ত বালিকা নন, বয়স হয়েছে। অন্তত পঁয়ত্রিশ। কিন্তু চোখে- মুখে ও ব্যবহারে বালিকাসুলভ চপলতা। সুনন্দা দেবীকে ফরসা বলতে হবে, তবে কুঁচবরণ রাজকন্যার মেঘবরণ চুল জাতীয়া কিছু নন।
তাঁর পরিধানে বাঙালোর সিল্কের আকাশ রঙের শাড়ি ও হাতকাটা ব্লাউজ। মণিবন্ধে কালো ব্যাণ্ডে ছোটো সোনার ঘড়ি চিকচিক করছে। মাথাভর্তি বিলিতী ফ্যাসনে কাটা কোঁকড়ানো চুল সব জায়গায় বিন্যস্ত নয়। সুনন্দা দেবীর চঞ্চল চাহনিতে পাহাড়ী ঝর্ণার মতো আবেগ আছে। তিনি কৌচে বসে হাতের র্যাকেটটা ছোটো ছেলের মতো লোফালুফি করতে লাগলেন। একটু পরেই উঠে গিয়ে দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখতে লাগলেন। পরমুহূর্তেই আবার র্যাকেটটা হাতের উপর স্থিরভাবে দাঁড় করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ঘরে ঢুকেই সায়েব আশ্চর্য হলেন। “সুনন্দা যে, কী খবর? এতোদিন কোথায় ছিলে? বোম্বাই থেকে কবে আসা হলো?”
সুনন্দার ইংরেজিতেও অপূর্ব মিষ্টতা। “প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ দিতে এলাম। রবার্টও আসতো; কাজে আটকে পড়েছে বেচারা।”
সায়েব ও সুনন্দার মধ্যে অনেকক্ষণ কথা হলো। সুনন্দা জানালেন, “আমরা ইণ্ডিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি। রবার্টের কাজের মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে, তাছাড়া বিলেতের হেড আপিসে সে প্রমোশন পাচ্ছে।”
“সুখবর সন্দেহ নেই। রবার্ট চাকরিতে আরও উন্নতি করবে, আমি বলে রাখলাম।” সায়েব খুব খুশি হয়েই বললেন। ম্লান হেসে সুনন্দা বললেন, “যাবার আগে ভাবলাম বাঙলাকে দেখে যাই। কলকাতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। হয়তো আর দেখা হবে না।”
“কবে এসেছো কলকাতায়?” সায়েব আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
“তা দিন তিনেক হয়ে গেল। ভাবলাম শেষ বিদায় আপনার কাছেই নেওয়া উচিত। অনেকদিনই তো আপনার কথা মনে রাখতে হবে।”
সায়েব মৃদু হাসলেন। “না সুনন্দা, বাঙালীদের প্রশংসায় আমার মোটেই বিশ্বাস নেই। তারা আমায় এতো ভালোবাসে যে, প্রশংসার মাত্রা ঠিক রাখতে পারে না।”
“আপনি ব্যারিস্টার মানুষ, আপনার সঙ্গে তর্ক করে আমি পারবো কেন?”
“বটে! কথাবার্তায় তোমার সঙ্গে আমি কোনোদিনই পেরে উঠিনি। তোমার বাবাকে দু’-একবার বলেওছি, এ-মেয়ে ব্যারিস্টার হলে আমাদের আর করে খেতে হবে না!” হা-হা করে হেসে উঠলেন সায়েব।
“টুকিটাকি মার্কেটিং কিছু বাকী আছে। এখন বরং উঠি। না হলে সেগুলো আজ শেষ করতে পারবো না।” সুনন্দা উঠে পড়লো।
‘কলকাতা থেকে যাবার আগে রবার্টকে নিয়ে একদিন এসো। কবে কলকাতা ছাড়ছো?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
“পরশু সন্ধ্যার ট্রেনে।”
“তাহলে আগামীকাল ডিনারে আসতেই হবে। লাস্ট ক্যালকাটা ডিনারটা আমার সঙ্গে হওয়াই উচিত। মনে আছে কি, তোমার প্রথম ক্যালকাটা ডিনার এই বুড়োর সঙ্গে হয়েছিল?”
হেসে ফেললেন সুনন্দা। বললেন, “নিশ্চয়ই আসবো। রবার্টও খুব আনন্দিত হবে।”
“হ্যাঁ, একেবারে ভুলে গিয়েছি। ছেলেদের কী হলো? তাদের কী ব্যবস্থা করলে?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন।
সুনন্দা গম্ভীর হয়ে উঠলেন। একটু যেন বিমর্ষও মনে হলো। “রবার্ট বেচারার তুলনা হয় না। বললে ওরাও সঙ্গে যাবে। পাশপোর্টের গোলমাল আছে, সে এমন কিছু নয়।”
সায়েব বললেন, “আহা বেচারাদের জন্য কষ্ট হয়। রবার্টের কোনো ছেলেপুলে হয়েছে নাকি?”
সুনন্দার চোখে আবার ছেলেমানুষি ফিরে এল। দুষ্টু হাসি হেসে বললেন, “রবার্ট বলে এরাই তো ছেলেপুলে, আর দল বাড়িয়ে কী হবে?”
টেনিস র্যাকেটটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে সুনন্দার ঋজু তনুদেহ ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁর হাঁটার মধ্যেও ছন্দ আছে, প্রাণ আছে, স্বীকার করতেই হবে।
আমার কাছে দু’জনের কথাবার্তা কেমন হেঁয়ালী ঠেকলো। কে এই সুনন্দা? রবার্ট উইলসনই বা কে? ছেলেপুলেই বা কাদের?
পরের দিন সকালে সায়েবের নির্দেশে হোটেলে টেলিফোন করে সুনন্দাকে রাত্রের ডিনারের কথা মনে করিয়ে দিয়েছি। তিনি বলেছেন, “অসংখ্য ধন্যবাদ। মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।”
ডিনারে ওঁরা দু’জন এসেছিলেন। তারপর যাবার দিন সুনন্দা হোটেল থেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। জানিয়েছেন ডিনারের জন্য ধন্যবাদ। আর সঙ্গে পিন দিয়ে একটা ফটো এঁটে দিয়েছেন—রবার্ট উইলসনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন সুনন্দা দেবী।
ছবিটা বেশ কয়েকবার দেখে সায়েব আমাকে বললেন, “ছবিটা আমার এলবামে আটকিয়ে রাখো। সুনন্দার আরও ছবি আছে ওই এলবামে।”
.
সুনন্দার কাহিনী পরে সম্পূর্ণ জেনেছি। সায়েব বলছিলেন, “উকিল বা ডাক্তারদের ট্র্যাজেডি এই যে, মামলা জেতার পর কিংবা রোগ সেরে যাওয়ার পর মক্কেল বা রোগীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। কিন্তু ডাক্তার তাঁর রোগীকে সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী দেখলে আনন্দিত হন। সুনন্দাকে সুখী দেখে আমারও আনন্দ হচ্ছে। সুনন্দাকে আর এক কারণে মনে থাকবে। সুনন্দার জন্য দু’বার ডাইভোর্স কোর্টে হাজিরা দিয়েছি, এখানে সচরাচর এমনটি ঘটে না।”
সুনন্দার সঙ্গে সায়েবের পরিচয় অনেকদিনের। সায়ের তখনও কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি শুরু করেননি। শিলং-এ শৈলবিহারে এসেছেন বিলেত থেকে সদ্য আগত কর্নেল সায়েব। শিলং পাহাড়ে প্রভাতী শীতের আমেজ তখনও বেশ রয়েছে। অন্ধকার ভালোভাবে কাটেনি। ঘোড়ার পিঠে চড়ে সামনের চড়াই ধরে সায়েব এগিয়ে যাচ্ছেন, অবাক হয়ে দেখছেন প্রকৃতির অপরূপ লীলাবৈচিত্র্য। হঠাৎ সেই প্রায়ান্ধকারে আর একজন অশ্বারোহী রাস্তার উল্টোদিক থেকে এসে পড়লেন। সরু রাস্তা। সামনের অশ্বারোহীকে পথ ছেড়ে দেবার জন্য সায়েব ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন। ওদিকে অন্য ভদ্রলোকটিও পথ ছেড়ে দেবার জন্য ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছেন।
আলাপ জমে উঠলো দু’জনের। ইনি অসিত সেন, সুনন্দার বাবা। ছ’ফিট লম্বা দেহ। প্রথম মহাযুদ্ধে সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছিলেন। মুখে সর্বক্ষণ সিগারেট জ্বালিয়ে রাখেন। নেশার মধ্যে দুটি—শিকার ও ফুলবাগান।
অসিত সেন খ্রীস্টান। তিনি ইঞ্জিনীয়ার। দুটি ছেলে ও একটি মেয়েকে মনের মতো মানুষ করেছেন। ছেলেমেয়েরা ইতিমধ্যেই কয়েকবার বিলেত ঘুরে এসেছে। অসিত সেনের বিশ্বাস, ভারতীয় আদবকায়দা তাঁর সন্তানেরা যতো কম শেখে ততোই মঙ্গল। শ্রীমতী সেন বিদেশিনী, ফ্রান্সের মেয়ে। মেয়ের নামকরণে কিন্তু অসিত সেন ভারতীয় ধারা অনুসরণ করলেন। অডি, ফ্যান্সি বা বিউটি নয়, নাম রেখেছেন সুনন্দা।
আশ্চর্য মেয়ে এই সুনন্দা। বয়স কত হবে? দশ কি এগারো। সে ঘোড়ায় চড়ে, সাঁতার কাটে, ভাইয়ের সঙ্গে ফুটবল খেলে। এমনকি বাবার সঙ্গে শিকারে বার হয়। সদাচঞ্চল, হাস্যমুখরা, ছোট্ট সুনন্দাকে সায়েব নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। সকালে ঘোড়ার পিঠে চড়ে দু’জনে বার হতেন একসঙ্গে। ঘুরে আসতেন বেশ কয়েক মাইল।
সেই যে আলাপ জমলো, ক্রমশ তা আরও ঘনিষ্ঠ হলো। শিলং থেকে কলকাতা ফিরে এসে সায়েব সুনন্দা ও তার বাবাকে চিঠি লিখেছেন। তারা উত্তর দিয়েছে। বড়োদিনের উৎসবে সায়েব সুনন্দা ও তার ভাইদের নামে পার্সেল পাঠিয়েছেন।
সীনিয়র কেমব্রিজ শেষ করে সুনন্দা আর পড়লো না। মিউজিক ও ছবি আঁকার দিকেই ইদানিং নজরটা তার বেশি পড়েছে। গৌহাটিতে ওরা থাকে। তবে মাঝে-মাঝে কাজের জন্য অসিত সেনকে শিলং যেতে হয়। সেখানেও একটা বাঙলো আছে। তাই ছেলেমেয়েরা প্রায়ই সঙ্গে যায়।
কয়েক বছর পরে ইস্টারের ছুটিতে সায়ের আবার শিলং গিয়েছেন। অসিত সেন কিছুতেই হোটেলে থাকতে দেননি। জোর করে নিজের বাঙলোতে সায়েবকে নিয়ে গিয়েছেন। তখন অবশ্য সায়ের আর মিলিটারীতে নেই, হাইকোর্টে ব্যারিস্টারি করেন।
আরও কয়েক বছর পরে সায়েব সুনন্দার বিয়ের চিঠি পেলেন। অসিত সেন লিখলেন, সুনন্দার রুচি ও পছন্দ ভালো। ছেলেটি উচ্চবংশের বাঙালী খ্রীস্টান, নাগপুর প্রবাসী।
বিয়েতে সায়েব যেতে পারেননি। কিন্তু লোক মারফত প্রচুর উপহার পাঠালেন। অসিত সেনকে লিখলেন, “মেয়েকে সৎপাত্রে দিতে পেরেছো জেনে নিশ্চিন্ত হলাম।”
তারপর সুনন্দা নাগপুরে চলে গিয়েছে। সেখান থেকে মাঝে মাঝে সায়েবকে চিঠি লিখেছে।
কলকাতায় যে বাড়িতে সায়েব তখন থাকতেন সেটি জনৈক উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীর সরকারী বাসভবন। গৃহস্বামী মিস্টার ফিলিপ নটন সায়েবের বহুদিনের পরিচিত।
সায়েব বলছিলেন, “এই বাড়িতেই সুনন্দাকে ক’দিন কাটিয়ে যেতে লিখলাম।” সুনন্দা সানন্দে রাজী হলো। নাগপুরের একঘেয়েমি কাটাবার জন্য কলকাতা মন্দ নয়। সুনন্দা এল। সঙ্গে তার স্বামী। মিস্টার ও মিসেস নর্টনের সঙ্গে সায়েব ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিসেস নর্টন জিজ্ঞাসা করলেন, “কতদিন থাকবে?”
সুনন্দা বললেন, “আমার সপ্তাহ তিনেক থাকবার ইচ্ছা। উনি অবশ্য তিনদিনের মধ্যে চলে যাবেন। আপিসে ছুটি পাওনা নেই।”
মিস্টার নর্টনের ওখানে আর একটি লোক বসেছিলেন। সায়েব তাঁকে বেশ ভালোভাবে চেনেন। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার সঙ্গে সুনন্দার পরিচয় করিয়ে দিতে হলো।
এই ভদ্রলোকটির সমস্ত ইতিহাস সায়েব আমাকে বলেছিলেন। ভদ্রলোকের আসল নাম বলবো না। বাংলাদেশের অনেকেই তাঁকে চিনে ফেলতে পারেন। গত যুদ্ধের সময় কোনো অজ্ঞাত উপায়ে প্রচুর অর্থ ও সেই সঙ্গে প্রচুর সুনাম তিনি জোগাড় করেছেন।
মনে করা যাক তাঁর নাম শৈলেন বৈরাগী। বহুকাল আগে নর্টন সায়ের এক মিশনারী বন্ধুর সঙ্গে দার্জিলিং-এ বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। তাদের এক প্রাথমিক স্কুলে একটি ছেলেকে তিনি দেখতে পান। কেন জানি না ছেলেটির প্রতি তাঁর মায়া পড়ে গেল। কালো পাথরের মত রঙ, কোকড়া-কোকড়া চুল, আর বিস্মিত একজোড়া চোখ। খোঁজ নিয়ে জানলেন ছেলেটির বাবা ও মা চা-বাগানের কুলি। বাপ-মায়ের অনুমতি নিয়ে ছেলেটিকে খ্রীস্টধর্মে দীক্ষার ব্যবস্থা করলেন তিনি। দার্জিলিং-এর বিনাপয়সার স্কুলে পড়ানো তাঁর পছন্দ হলো না। একটু বড়ো হতেই দক্ষিণের এক কনভেন্টে তাকে পাঠিয়ে দিলেন।
কনভেন্ট থেকে মিস্টার নর্টন বৈরাগীকে সোজা বিলেত পাঠালেন। কিন্তু পড়াশুনা না করে বৈরাগী সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে মন দিয়ে টেনিস আর ক্রিকেট খেলে বেড়ালেন। কেবল মিস্টার নর্টনের ভয়ে তাকে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতে বসতে হলো এবং সেই পরীক্ষায় ফেলকরা ছাত্রদের মধ্যে নিম্নতম স্থান দখল করার কৃতিত্ব অর্জন করলেন। পরীক্ষায় ফেল হয়ে বৈরাগী বিলেতের আদব- কায়দা শিখতে মনস্থ করলেন। নাচ, গান ও মদ্যপানে অনেকগুলো ডক্টরেট পাবার যোগ্যতা নিয়ে বৈরাগী স্বদেশে ফিরলেন।
বহু চেষ্টায় মিঃ নটন তাঁর জন্য এক চাকরি যোগাড় করলেন। ক্লাইভ স্ট্রীটে এক নামজাদা সওদাগরী আপিসে মোটা মাইনের চাকরি।
বৈরাগীর গুণাবলী ক্রমশ কলকাতার উচ্চ মহলে ছড়িয়ে পড়লো। চৌরঙ্গীতে এক ফ্লাটে তিনি থাকেন। বৈরাগীর দৃষ্টি একদিকে খুবই উদার। রায়বাহাদুর, রাজাবাহাদুর ও স্যারদের কন্যা থেকে আরম্ভ করে আপিসের টাইপ- ললনাদের উপর পর্যন্ত তিনি সমান নজর রাখেন। একদিনের কথা। সায়েব কোর্ট থেকে ফিরছেন। তাঁর গাড়িটা ভিতরে ঢোকবার সময় সামনে মালপত্র বোঝাই এক ট্যাক্সি দেখতে পেলেন। কয়েকজন চাকরবাকর তার চারদিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে সায়েব এগিয়ে গেলেন। ট্যাক্সিতে দু’জন ইংরেজ মহিলা বসে আছেন। হাবভাবে বোঝা যায় এদেশে তাঁদের সদ্য পদার্পণ। মহিলাদের মধ্যে একজন বয়স্থা। তিনি আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, “এটি কি রাজকুমার বৈরাগীর প্যালেস?” সায়েব আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিলেন, “যতদূর জানি বাড়ির মালিক ভারত সরকার। বর্তমানে মিঃ ফিলিপ নর্টনের সরকারী বাসভবন।” যুবতী মহিলাটি ভীত হয়ে উঠলেন, তাঁর মুখ কাগজের মতো সাদা দেখালো। অনুসন্ধানে জানা গেল, তাঁরা সদ্য বোম্বাই-মেল থেকে নেমেছেন। আসছেন বিলেত থেকে। ‘রাজকুমার’ বৈরাগীকে তাঁরা জাহাজ থেকে টেলিগ্রাম করেন। আশা ছিল, ‘রাজকুমার’ স্টেশনে উপস্থিত থাকবেন। আরও জানা গেল, যুবতী মহিলাটি বৈরাগীর বাগদত্তা। বিয়ে করে পাকাপাকি ভাবে ঘর বাঁধবার জন্যই তিনি এখানে এসেছেন। সায়েব ভদ্রমহিলাদের একটি হোটেলে থাকবার ব্যবস্থা করে দিলেন এবং বললেন বৈরাগীকে তিনি খবর পাঠাচ্ছেন হোটেলে দেখা করবার জন্য।
খবর পেয়ে বৈরাগী প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সহজেই নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর কয়েকদিন ছোটাছুটি করে ভদ্রমহিলাদের কি বোঝালেন ভগবান জানেন। কিন্তু মা ও মেয়েকে একদিন রুমাল নাড়তে নাড়তে বোম্বাই মেলে বিদায় নিতে দেখা গেল।
বৈরাগীর আশ্চর্য আকর্ষণ-শক্তি; অনেকটা সম্মোহনী শক্তির মতো। তার চারিত্রিক পরিচয় জেনেও অনেক মেয়ে তার পিছনে ছোটে।
কিন্তু কে জানতো সুনন্দার মতো বুদ্ধিমতী মেয়েও সেই ভুল করবে। বৈরাগী ঘন-ঘন যাতায়াত শুরু করলো; সুনন্দাও আজ এই অছিলায়, কাল অন্য অছিলায় দেরী করে ফিরতো। সুনন্দার কথা সায়েব সরলভাবে বিশ্বাস করেছেন। তাছাড়া সুনন্দা যে পরিবেশে মানুষ সেখানে বিবাহিতা মহিলাদের অবাধ স্বাধীনতা।
ঘটনার গুরুত্ব বোঝা গেল মাস কয়েক পরে। অসিত সেন কলকাতায় সায়েবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। সেনের মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। মনের কোণে উদ্বেগের উপস্থিতি সহজেই বোঝা যায়। অসিত সেন সায়েবকে অবাক করলেন। বললেন, নতুন বিয়েতে সুনন্দা নাকি মোটেই সুখী হয়নি। কলকাতা থেকে নাগপুর গিয়ে সে মাত্র একমাস ছিল, তারপর সোজা গৌহাটি ফিরে গিয়েছে।
দু’দিন পরে সুনন্দাও কলকাতায় এল। সুনন্দা স্বামীর হাত থেকে মুক্তি চায়। সায়েব বোঝালেন, “সুনন্দা তোমার বয়স হয়েছে। কোনো সিদ্ধান্তে আসার আগে ভালো করে ভেবে দেখো।”
সুনন্দা কিন্তু অবিচলিত। সে বললে এই বিয়েটা একেবারে ভুল হয়ে গিয়েছে। “আমার টেম্পারামেন্টের সঙ্গে মিঃ বোসের মোটেই খাপ খায় না। আসলে লোকটা নির্জীব।” যে স্বামীর মধ্যে প্রাণের চাঞ্চল্য নেই, উদ্দীপনা নেই, তার কাছে সুনন্দা জীবনটা নষ্ট হতে দেবে না। শিলং পাহাড়ের লীলা-চঞ্চল ঝর্ণা কিছুতেই নাগপুরের এক বদ্ধ ডোবায় গিয়ে মিশতে পারে না।
সুনন্দারা যে পরিবেশে মানুষ সেখানে মা-বাবারাও সন্তানের ব্যক্তিগত ব্যাপারে বিশেষ মাথা গলাতে সাহস করেন না। সাংসারিক ব্যাপারে অসিত সেনের মাথা খোলে না, সুনন্দা তাঁর একমাত্র মেয়ে। তার জীবনে তিনি কণ্টক হতে চান না।
.
সুনন্দা দেবীর কাহিনী এই পর্যন্ত একটানা শুনেছিলাম। দিনটা ছিল শনিবার হাইকোর্ট ওই দিন বন্ধ থাকে। চা খেতে খেতে বিকেলে গল্প হচ্ছিলো। কিন্তু আমার গল্প শোনায় বাধা পড়লো। বেয়ারা এসে বললে, সায়েবের টেলিফোন এসেছে। টেলিফোনে কথাবার্তা শেষ করে সায়েব যখন ফিরলেন, তখন মনে হলো গল্পের সূক্ষ্ম তারটা যেন ছিঁড়ে গিয়েছে। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
“হুঁ। তারপর অসিত সেন আমাকে বললেন, আইনের দিকটা তোমাকেই সামলাতে হবে।”—সায়েব আবার বলতে আরম্ভ করলেন।
“আগেই বলেছি সুনন্দারা খ্রীস্টান। খ্রীস্টান আইনে ডাইভোর্স বা বিবাহ- বিচ্ছেদ সম্ভব। ইচ্ছে করলেই অবশ্য বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় না। এর জন্য কতকগুলো অপরাধের প্রয়োজন—-আমরা যাকে বলি ম্যাট্রিমনিয়াল অফেন্স (বৈবাহিক অপরাধ)। কোন্ কোন্ অপরাধে ডাইভোর্স সম্ভব ভারতীয় ডাইভোর্স আইনে তা লেখা আছে, নিশ্চয় জানো।”
“হুঁ, আপনার কাছে কিছু-কিছু শুনেছি।
“চরিত্রহীনতা ও নিষ্ঠুরতা এই দুটো অভিযোগই প্রধান।” সায়েব এটু থামলেন। তারপর আবার বললেন, “কিন্তু এই নিষ্ঠুরতা কথাটি একটু গোলমেলে। দেশ, কাল ও সমাজ ভেদে এর বিভিন্ন অর্থ। এমনকি যার উপর নিষ্ঠুরতা করা হচ্ছে তার দৃষ্টিভঙ্গির উপরও অনেকটা নির্ভর করে।”
আমি বললাম, “তা বটে। কেননা একবার আমাদের বাড়ির পাশের বস্তিতে একটা লোক তার স্ত্রীকে মারছিল। আমরা রেগেমেগে লোকটাকে শিক্ষা দিতে ছুটে গেলে সেই স্ত্রীলোকটিই স্বামীর সঙ্গে যোগ দিয়ে বললে, আমার সোয়ামী আমায় মারছে তাতে পাড়ার নোকের মাথাব্যথার কী আছে?”
শুনে সায়েব হাসলেন। বললেন, “সব দেশের বস্তিতেই ওরকম হয়। তবে . আমাদের দেশের উচ্চতর সমাজে নিষ্ঠুরতা বোধ ক্রমশ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হচ্ছে। এটা মানসিক নিষ্ঠুরতার যুগ। স্বামী একটু বেঁকিয়ে কথা বললে, কিংবা একলা সিনেমায় গেলেই বেজায় আঘাত লাগে।”
আমি হাসতে যাচ্ছিলাম। সায়েব বললেন, “হাসছো কি? এই তো সেদিন ওদেশে স্বামী রাত্রে ভয়ঙ্কর নাক ডাকান বলে একটা ডাইভোর্স হয়ে গেল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, বেশিদিন এরকম নাক ডাকানো শুনলে স্ত্রীর স্নায়ুবিকার দেখা দিতে পারে।
আমেরিকার এক ভদ্রলোক ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে ঘুমোন। ভোর হলেই এলার্ম– ঘন্টা মিনিট পাঁচেক ধরে বাজতে থাকে। স্ত্রী বললেন, ওসব চলবে না। এলার্ম আমার ঘুমের মৌজ নষ্ট করে দেয়। সকালের দিকেই আমার যা একটু ঘুম আসে। স্বামী রাজী হন না। দিন কয়েকের মধ্যে ভদ্রমহিলা কোর্টে নিষ্ঠুরতার অভিযোগে বিবাহ- বিচ্ছেদের মামলা করলেন।”
“সুনন্দা স্বামীর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনলেন?”
“নিষ্ঠুরতার অভিযোগ। অবশ্য নাক ডাকানো বা এলার্ম ঘড়ি রাখার মতো অভিযোগ নয়। ভেবে-ভেবে সে আমাকে যে সব ঘটনা বলেছিল, সেগুলোকেই সাজিয়ে-গুছিয়ে কোর্টে ফাইল করা হলো।”
“তারপর?”
“নাগপুরের বর কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন না। কেন করেননি বলতে পারবো না, তবে সম্ভবত যে-মেয়ে স্বেচ্ছায় স্বামীর ঘর করতে চায় না তাকে বেঁধে রাখতে চাননি। সুনন্দার মামলার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। আইন ও ঘটনার মারপ্যাচে সুনন্দা জিতে গেল। হাইকোর্ট ডিক্রি দিলেন, তুমি মুক্ত। নাগপুরের সেই ছেলেটি, যাকে তুমি একদিন লজ্জাবনত চোখে স্বামীরূপে গ্রহণ করে চার্চ থেকে বেরিয়ে এসেছিলে, সে এখন তোমার স্বামী নয়।
অসিত সেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তার অনুরোধ রক্ষা করতে পেরেছি বলে আমিও আনন্দিত হলাম।
মামলা জিতবার পর সুনন্দা কয়েকবার কলকাতায় এসেছে। কিন্তু হোটেলে উঠেছে, আমার ফ্ল্যাটে থাকেনি। দু’-একবার আমার সঙ্গে দেখা না করেই গৌহাটি ফিরে গিয়েছে, এমন খবরও আমার কানে এসেছে।
ছ’মাসের মধ্যে বৈরাগী তিনবার শিলং পাড়ি দিয়েছে। আমার সঙ্গে মিঃ নটনের ফ্ল্যাটে তার দু’একবার দেখা হয়েছে। কিন্তু শিলং প্রসঙ্গ সে একেবারে চেপে গিয়েছে।
কিছুকাল পরে একটা চিঠি পেলাম। সুনন্দা লিখেছে, সে আবার বিয়ে করেছে। এতোদিনে সে মনের মতো পার্টনার পেয়েছে, নাম শৈলেন বৈরাগী। দু’জনের প্রথম পরিচয় আমার মাধ্যমে হয়েছিল, সুতরাং একটা স্পেশাল কেক আমার পাওনা।
অসিত সেনও সঙ্গে চিঠি পাঠিয়েছেন। এই বিয়েতে তিনি ও মিসেস সেন খুশি হয়েছেন জেনে আমিও আশ্বস্ত হলাম। কেননা বৈরাগী সম্বন্ধে অনেক কিছুই অসিত সেন একবার আমার মুখে শুনেছিলেন। যা করবার, তাঁরা জেনেশুনেই করেছেন।
বৈরাগীর চৌরঙ্গীতে যে ফ্ল্যাট ছিল সুনন্দা বিয়ের পর সেইখানেই উঠলো। একদিন ডিনারে দু’জনকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। সুনন্দাও একদিন ওদের ফ্ল্যাটে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। ফ্ল্যাটটা মন্দ নয়। ফার্নিচারগুলো সুরুচির পরিচায়ক। তাছাড়া মিস্টার নর্টন অবসর নিয়ে বিলেত যাবার আগে বৈরাগীকে কিছু দামী ফার্নিচার দিয়ে গিয়েছেন। সুনন্দা সেগুলো সুন্দর করে সাজিয়েছে।
একবছরের কিছু বেশি সুনন্দা ওই ফ্ল্যাটে ছিল। মধ্যিখানে কয়েক মাস মোটেই তার সঙ্গে দেখা হয়নি। একদিন তার বাড়িতে টেলিফোন করলাম। সুনন্দাই টেলিফোন ধরেছিল। সন্তানসম্ভবা সে, তাই বাড়ি থেকে বেরোয় না। অন্য খবরটবর কেমন, জিজ্ঞাসা করলাম। সুনন্দা বললে,”এই একরকম।”
মাসখানেক পরে আবার টেলিফোন করতে গিয়ে একেবারে নতুন গলা শুনতে পেলাম—”কাকে চাই?” “সুনন্দা বৈরাগীকে একটু দিন না।” উত্তর এল, “তাঁরা তো এ-মাসের গোড়াতেই কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এ-ফ্ল্যাটে আমরা নতুন এসেছি। যতোদূর জানি মিস্টার বৈরাগী অন্য কোথায় আরও ভালো চাকরি পেয়েছেন।”
এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে গিয়েছে। হাইকোর্টে আমার কাজ এতো বেড়ে গিয়েছে যে, বন্ধু-বান্ধবদের বিশেষ খবরাখবর নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বলতে লজ্জা নেই, নানান কাজে তারপর সুনন্দাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
হঠাৎ একদিন সকালে টেলিফোন বেজে উঠলো। সুনন্দা কথা কইছে। দেখা করতে চায় সে, খুব জরুরী প্রয়োজন।
সুনন্দা এল। এ কোন্ সুনন্দা? কী অবস্থা হয়েছে তার! চোখের কোণে কালি, রক্তহীন পান্ডুর মুখ। শরীরের বাঁধুনি ভেঙে গিয়েছে, কঙ্কালসার চেহারা। চমকে উঠলাম। একি সেই সুনন্দা যে একদিন শিলঙে টগবগিয়ে ঘোড়া ছোটাতো! একি সেই সুনন্দা বাবার সঙ্গে শিকারে বার হতো!
“কেমন আছো সুনন্দা?” জিজ্ঞাসা করলাম।
সুনন্দা ম্লান হাসলো।
“অসুখ হয়েছিল নাকি? একদম চেনা যায় না যে।”
সে আবার ম্লান হাসলো, কিন্তু উত্তর দিলে না।
“বাবার খবর কি? অনেকদিন তাঁর সংবাদ পাইনি।”
সুনন্দা মুখ নিচু করলে। “বাবার অবস্থা নাই বা বললাম।”
“অলোক ও অসীম দু’জনেই ফ্রন্টে। মা বছরখানেক মারা গিয়েছেন।”
কোনো কথা বলতে পারলাম না।
সুনন্দা ফুঁপিয়ে উঠলো। “আপনার কাছে আবার আসতে হলো। যাতে না আসতে হয় তার জন্য ভগবানের কাছে প্রতিদিন প্রার্থনা করেছি। পাঁচবছর মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আর পারছি না।”
তার মাথায় হাত রাখলাম। “কী হয়েছে সুনন্দা? আমার কাছে আসতে লজ্জা কী? তোমার কথা কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, সুনন্দা। লক্ষ্মীটি, ভালো করে সমস্ত বলো।”
চোখ মুছলো সে। “তখন আপনার কথা না শুনে যা ভুল করেছি!”
“ভুল তো মানুষ মাত্রেই করে সুনন্দা। সুতরাং তার জন্য দুঃখ করো না।”
সুনন্দার পাঁচ বছরের ইতিহাস শুনলাম সেদিন।
তারা ইচ্ছে করে কলকাতা ছাড়েনি। চারিদিকে বৈরাগীর দেনা। ছোট আদালত থেকে প্রায়ই আপিসের মাইনে কোর্টে জমা দেবার হুকুম আসে। কোম্পানী এসব সহ্য করবে কেন? চাকরি গেল।
রাঁচীতে সামান্য একটা চাকরী মিললো। কিন্তু মদের বিল দিতেই সব চলে যায়। সুনন্দার প্রতি বৈরাগীর মোহভঙ্গ হয়েছে। খোলাখুলি সে বলে দিয়েছে, তুমি যেতে পারো, কোনো প্রয়োজন নেই আমার। সুনন্দা চোখে অন্ধকার দেখে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সে শিউরে ওঠে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও বৈরাগী প্রতিবছর অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ডেকে আনছেন। একে একে ওরা চারজন এল। এদিকে পাওনাদারদের ভয়ে মিস্টার বৈরাগী রাঁচী ছেড়ে মাদ্রাজে হাজির হলেন। সেখানকার বাজারেও বেশ কিছু দেনা বাঁধিয়ে অবশেষে রেঙ্গুনের পথে পাড়ি দিলেন। স্ত্রী-পুত্র মাদ্রাজে পড়ে রইলো। যাবার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেন, টাকার ভাবনা নেই, বড়ো চাকরি পেয়েছি। মাসে মাসে টাকা পাঠাবো। সুনন্দার নিজের যা কিছু সঞ্চয় ছিল যাবার আগে জাহাজে খরচের অছিলায় তা হস্তগত করতেও মিস্টার বৈরাগী ভোলেননি।
রেঙ্গুন থেকে একটি পয়সাও আসেনি।
কিছুদিন পরে খবর এলো বৈরাগী-সায়েব রেঙ্গুনে যাননি। গোপনে কলকাতাতেই আবার আড্ডা গেড়েছেন।
সুনন্দার কান্না আর বাধা মানলো না। “আমি মুক্তি চাই, শয়তানটার হাত থেকে বাঁচতে চাই।”
বছর পাঁচেক আগেও একদিন সুনন্দা এই রকম মুক্তি চেয়েছিল। সেদিনের সুনন্দা ছিল সত্যই মুক্ত। কোনো দায়িত্ব ছিল না তার। আজ সে চারটি সন্তানের জননী। তবু সে মুক্তি চায়। জীবনে বাঁচার মতো বাচঁতে চায়।
শোকে মুহ্যমান অসিত সেন চিঠি লিখলেন—”আমার দুর্ভাগ্য, মেয়েটাকে সুখী দেখতে পেলাম না। শয়তানটার হাত থেকে সুনন্দাকে বাঁচাতেই হবে। তোমার কাছে বোধ করি আমার এই শেষ অনুরোধ।”
আবার মামলা শুরু হলো। বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা। এবারের অভিযোগ আগেকার মতোই, নিষ্ঠুরতা।
সুনন্দাকে কোর্টে দাঁড়াতে হলো। চারটি নাবালক শিশুকেও বিচারকের সামনে আনতে হলো। জজকে আইন দেখালাম, সাক্ষী তো আছেই। কাগজের রিপোর্টাররা তাঁদের পাঠকদের জন্য মনোমতো খবর যোগাড় করলেন। সুনন্দা আবার মুক্তি পেলো।
জীবনের অন্তহীন যাত্রাপথে আবার একাকী যাত্রা শুরুর অনুমতি মিললো।
“তারপর?” গল্পের ঝোঁকে আমি জিজ্ঞাসা করে বসলাম।
নিস্পৃহভাবে সায়েব হাসলেন। জীবনে এতো দেখেছেন তিনি যে, এখন সহজে আশ্চর্য হন না। বললেন—
“সুনন্দারা এমন মেয়ে যারা বারবার আঘাত পেয়েও হতোদ্যম হয় না। বার- বার তারা ঝড়ের মাঝেও জীবনপদ্মের পাপড়িগুলো মেলে ধরতে চায়। স্বাদ পেতে চায় রূপ-রস-গন্ধ-গানে-ভরা জীবনের।
সুনন্দাকে ভাগ্যবতী বলবো। কিছুদিনের মধ্যেই এক বিপত্নীক ইংরেজ তাকে বিয়ে করলো। রবার্ট উইলসন সুনন্দাকে ভালোবাসে, তাকে সুখী করতে চায়। সুনন্দা আবার পুরনো দিনের সুনন্দার মতোই টেনিস খেলে, মোটর ড্রাইভ করে। আশা করি, সাগরপারেও তেমনি পূর্ণ আনন্দেই সে দিন কাটাবে।”
এ-গল্প সায়েবের কাছে অনেকদিন আগে শুনেছিলাম। যুদ্ধের সময় মিঃ বৈরাগী প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এখন তিনি প্রখ্যাত ব্যক্তি। তাঁর নাম প্রায়ই কাগজে দেখি। পণ-প্রথা নিবারণ, স্ত্রীশিক্ষাদান, নারী ও শিশুমঙ্গল প্রভৃতি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে তাঁর খ্যাতি দিগ্দিগন্ত পরিব্যাপ্ত। খবরের কাগজে প্রকাশিত তাঁর ছবি.আজও আমাকে মাঝে মাঝে বিদেশবাসিনী সুনন্দার কথা মনে করিয়ে দেয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন