শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
“তারপর, এই কেসে তহুরী বাগালে কত?” ছোকাদা জিজ্ঞাসা করছিলেন একদিন। বার-লাইব্রেরীর সামনে বেঞ্চিতে আমরা অর্থাৎ বাবুরা দলবেঁধে বসেছিলাম। ছোকাদার এই আচমকা প্রশ্নে একটু ঘাবড়ে গেলাম।
‘কোন কেসের কথা বলছেন?”
কেন তোমার ওই হেলেন গ্রুবার্টের কেস্। তহুরীর চান্স ছেড়ো না। লজ্জা করলে তোমারই লোকসান।”
“কিন্তু তহুরী জিনিসটা কি তাই বললেন না।”
হা-হা করে অর্জুনবাবু, দীনুবাবু, হারুবাবু সবাই হেসে উঠলেন। “একেবারে সাক্ষাৎ পরমহংসদেব, তহুরী কাকে বলে জানে না। এ ছেলে এখন বাঁচলে হয়।”
বাবুদের কথায় কান না দিয়ে ছোকাদা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। “বাবুদের তহুরীকে অনেকে বকশিশ বলে। কিন্তু আমরা তা মানতে রাজী নই। এটা আমাদের ন্যায্য পাওনা। সায়েবরা যতো মোহর ফী নেবেন, ততো টাকা আমাদের পাওনা ত্রিশ মোহর ফি হলে, ত্রিশটাকা তহুরী।”
“কিন্তু বাপু যা দিনকাল পড়েছে তাতে একটাকা রেটে কোনো এটর্নি তহুরী দিতে চায় না। তবে যতোটা পারো বার করে নেবে। ত্রিশ টাকার জায়গায় যদি কুড়ি টাকা হয় তাই সই। আরে বাপু আসল রোজগার তো ওই তহুরী থেকে। ওই যে পাঁচুগোপাল”–ছোকাদা দেখে নিলেন পাঁচুগোপাল আছে নাকি। যখন দেখলেন সে নেই তখন মন খুলে বললেন, “ওই পাঁচুগোপাল মাইনে আর ক’টাকা পায়? কিন্তু বাপু জ্বরে কী আসে যায়, পিলেতে যে মেরে দেয়। প্রতি মাসে নিদেন হাজার টাকা পাঁচুগোপাল পকেটে পোরে। অমন নিরীহ ভালোমানুষটি সেজে বসে থাকলে কী হয়, ইচ্ছে করলে অনেক ব্যারিস্টারকে ও কিনে রাখতে পারে।”
“বলেন কি?” অজান্তে আমার চোখ দুটো বড়ো হয়ে উঠেছিল।
“যা বলছি শুনে নাও,” ছোকাদা বললেন। “পাঁচুগোপালকে তহুরী চাইতে হয় না, এটর্নিরা হাতে গুঁজে দিয়ে যায়। কিন্তু সবাই তো আর পাঁচুগোপাল নয়। আমাদের তহুরী আদায় করতে কালঘাম ছুটে যায়।”
“সত্যি মাইরি এটর্নিরা তহুরী দিতে গিয়ে এমন ভাব করে যেন টাকাটা তার নিজের পকেট থেকেই যাচ্ছে।” অর্জুনবাবুর হাত পা নাড়ানোর ভঙ্গিতে এটর্নিদের প্রতি তাঁর বিরক্তিটা বেশ প্রকাশিত হলো।
“আর আজকালকার সায়েবরাও তেমনি হয়েছে। এটর্নিদের মুখ ফুটে কিছু বলবে না। সায়েব ছিল উড্রফ সায়েব। কিন্তু সে সব দিন কি আর আছে রে দাদা।” ছোকাদা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন।
উড্রফ সায়েবের গল্প বলার জন্য আমরা সবাই ছোকাদাকে চেপে ধরলাম। ছোকাদা বলতে লাগলেন—
“উড্রফ সায়েব মস্ত ব্যারিস্টার। এক এটর্নি তাঁকে ব্রীফ পাঠালেন। ফীও ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু তহুরী? সায়েব এটর্নি জানালেন, তহুরী দেওয়াটা তাদের প্রথা নয়। উড্রফ সায়েবও কম যান না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ব্রীফ ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। আর লিখে দিলেন, বাবুকে তহুরী না দিলে ব্রীফ নেওয়াটা তাঁরও প্রথা নয়।”
“এটর্নি তখন কী করলো?”. অর্জুনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
“এটর্নি তখন দীনদয়ালকে তহুরী দেবার পথ পায় না।” ছোকাদা বললেন।
“উড্রফ সায়েবের বাবুর নাম বুঝি দীনদয়াল?” আমি জিজ্ঞাসা করলুম।
“হুঁ”, ছোকাদা বললেন। “দীনদয়ালকে আমি দেখেছি। গম্ভীর প্রকৃতির লোক, পারতপক্ষে কারুর সঙ্গে কথা বলতেন না। কালো চোগাচাপকান চাপিয়ে কোর্টে আসতেন। আজকাল বার-লাইব্রেরীর কেদারবাবু ছাড়া ওরকম ড্রেস আর কেউ পরে না। এটর্নি উকিল তো দূরের কথা, এই বার-লাইব্রেরীর অর্ধেক ব্যারিস্টারকে তিনি তোয়াক্কা করতেন না।
জুড়িগাড়ি চড়তেন দীনদয়াল। তাজা বাঘের মতো দুটো ঘোড়া সে গাড়ি টানতো। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটের মোড়ে তাঁর কোচম্যান পা দিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে লোক সরাতো। পিছন থেকে সহিস লাফ মেরে মাটিতে নেমে দরজা খুলে দিতেই, দীনদয়ালবাবু বেরিয়ে আসতেন। তারপর ধীরে-ধীরে ঢুকে যেতেন হাইকোর্টের ভিতর।”
সেই দীনদয়ালবাবু একদিন জুড়িগাড়ি চড়া ছাড়লেন। দীনদয়ালবাবুর জুড়ি গাড়ি ত্যাগের যে গল্প ছোকাদা খুব আস্তে আস্তে এবং রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন তার কতটুকু সত্য বলতে পারবো না। গল্পের ঝোঁকে সে-কাহিনীর মধ্যে ছোকাদা আপন মনের মাধুরী মিশিয়েছিলেন কিনা কে জানে!
সে-যুগের খাঁটি জমিদারী মেজাজ ছিল দীনদয়ালবাবুর। ঘোড়া দুটি তাঁর বাঘের মতো। (ঘোড়ারা বাঘের মতো হয় কিনা জানি না, তুলনাটি ছোকাদার) দীনদয়ালবাবুর নেশা ছিল, তাঁর গাড়ি সবাইকে ডিঙিয়ে চলে যাবে। কোচম্যানরা সে-কথা জানতো তাই সামনে কোনো গাড়ি পড়লে তারা সর্বদা চেষ্টা করতো সেটিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে।
একদিন হেস্টিংস স্ট্রীটে এক গাড়ি পড়লো দীনদয়ালের গাড়ির সামনে। আর যাবে কোথায়! তাঁর কোচম্যান ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে সামনের গাড়িকে নিপুণভাবে পাশ কাটিয়ে পিছনে রেখে হাইকোর্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। অন্য গাড়িটাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পিছনে এসে দাঁড়ালো। দীনদয়ালবাবু যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, তাই হলো। সেই গাড়ি থেকে নামলেন স্বয়ং উড্রফ সায়েব!
“হ্যাল্লো দীনদয়াল”–উড্রফ সায়েব দীনদয়ালের পিঠে হাত রাখলেন। কিন্তু গাড়ি সম্বন্ধে তাঁকে একটি কথাও বললেন না।
চুপ করে রইলেন দীনদয়াল। পরের দিন থেকে দেখা গেল তিনি পায়ে হেঁটে কোর্টে আসছেন। তিনি যে সেই জুড়ি গাড়ি চড়া ছাড়লেন, ভবিষ্যতে কেউ একদিনের জন্যও তাঁকে জুড়িগাড়ি চড়তে দেখেনি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন