কত অজানারে – ১২

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

রাণীক্ষেতে এক মাস সায়েবকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলাম। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, কলকাতায় তাঁকে কাছে পাইনি। কিন্তু সাধারণত কলকাতায় কাজের চাপে তাঁর ব্যারিস্টার সত্তাই প্রাধান্য পেতো। রাণীক্ষেতে সে বালাই নেই। এখানে প্রকৃতি মানুষের উপর এমন প্রভাব সৃষ্টি করে যে, তার বহির্মুখী চিন্তা অন্তর্মুখী হয়। বহুদিনের প্রবাসী মন হঠাৎ যেন ঘরে ফিরে আসে। স্বভাবতই সে তখন দেখে, অনেক কিছু অবিন্যস্ত হয়ে জমে আছে। মাঝে মাঝে তাই কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে চলে গিয়ে মনের ঘরটি সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। একথাও কিছু আমার নিজের নয়। পাহাড়ী পথে বেড়াতে-বেড়াতে সায়েবই একদিন বলেছিলেন।

যা হোক, ঠিক একমাস পরে একদিন বাসে চড়ে আবার সমতলভূমির উদ্দেশে আমার অধোযাত্রা শুরু হলো। সমস্ত রাস্তায়—বাস এবং ট্রেনে—ভেবেছি আমি কত ভাগ্যবান। সায়েবের মতো মানুষের সংস্পর্শে আসা সত্যই ভাগ্য। বিদেশী তিনি। তার উপর জাতে ইংরেজ। আমরা সবাই যা জানি এবং আমাদের দেশে ইতিহাস যা সাক্ষ্য দেয় তা থেকে ইংরেজদের সম্বন্ধে ধারণাটা বিশেষ উচ্চ হয় না। কিন্তু জাত হিসেবে ভালোমন্দ বিচার করা যায় না। তা যদি যেতো সায়েব এমন হতে পারতেন না। নিজের হৃদয়কেও এমনভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে পারতেন না।

মানুষের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার অসংখ্য নিদর্শন আমি পেয়েছি। এ- ভালোবাসা কোনো জাতিগত অথবা স্থানগত গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আরও দু’-একজন বিদেশীকে আমার দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে যাঁদের ভারতবর্ষের প্রতি ভালোবাসা সুবিদিত। কিন্তু তাঁদের অনেকের ভালোবাসা পক্ষপাতপূর্ণ। ভারতের সকল কিছুই তাঁদের ভালো লেগেছে। তুমি ভারতীয়, সেইটেই তাঁর ভালো লাগার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু আমি সায়েবের কাছে আরও কিছু দেখেছি। ভালোবাসাটা মানুষের জন্য। তুমি মানুষ এই পরিচয়ই যথেষ্ট, আর কিছুর প্রয়োজন নেই। তেমনি, কেউ যদি অন্যায় করে, তিনি সর্বশক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। জাত কিংবা স্থানের খবর নেননি।

সে-পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল একটি মামলায়। এই মামলায় সায়েব কিন্তু ব্যারিস্টার ছিলেন না। তিনি নিজেই বাদী। তিনি নিজেই মামলা করেছিলেন কয়েকজনের বিরুদ্ধে। একটি ক্লাবের সভ্য ছিলেন সায়েব। এটি কেবলমাত্র ইউরোপীয়দের ক্লাব। ভারতীয় সভ্য এখানে নেওয়া হতো না। স্বাধীনতার কিছু আগে অনেক ইংরেজ এদেশ থেকে তল্পিতল্পা গুটোচ্ছিলেন। ফলে ক্লাবের সভ্য-সংখ্যা আকস্মিকভাবে অনেক কমে গেল। গুণে দেখা গেল যাঁরা এখনও সভ্য আছেন তাঁদের সংখ্যা মাত্র সাত-আট জন। ক্লাবের তহবিলে কিন্তু তখনও কয়েকলক্ষ টাকা। সায়েবকে বাদ দিয়ে অন্য সভ্যরা ঠিক করলেন, এই সুযোগে ক্লাব তুলে দিয়ে সম্পত্তি বিক্রি করতে পারলে প্রত্যেকেই কিছু টাকা পাবেন। সায়েব কিন্তু রাজী হলেন না। তিনি বললেন, ক্লাব নষ্ট করা কিছুতেই উচিত হবে না। আমরা সহজেই ভারতীয় সভ্য নিতে পারি। তাতে ক্লাব আবার পূর্বেকার মতো চলতে পারবে। অন্য সভ্যরা তাঁর কথা শুনে হাসলেন। সংখ্যাধিক্যের জোরে ক্লাব তুলে দেওয়ার প্রস্তাব সভায় গৃহীত হলো।

সায়েব কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমন অন্যায় তিনি হতে দেবেন না। ক্লাব তুলে দেবার পিছনে স্বার্থান্বেষীদের ষড়যন্ত্র রয়েছে, তার মনে হলো। যে-রাতে ক্লাব তুলে দেওয়ার সভা হয়েছিল, সে রাতে তিনি ঘুমোতে পারলেন না। বই-টই ঘেঁটে তিনি সিদ্ধান্ত করলেন, অন্য সভ্যদের কাজের মধ্যে আইনঘটিত গলদ আছে।

মামলা রুজু করলেন তিনি। ইংরেজ মহলে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল এর জন্য। আইনের প্রশ্নটা আমার মনে নেই। তবে সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এই মামলার শুনানীর ভার যে এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক স্পেশাল বেঞ্চের উপর ন্যস্ত হয়েছিল তা ভুলিনি। মামলার তদবিরের জন্য সায়েব অনেক ছুটোছুটি করেছিলেন। এখন তিনি ব্যারিস্টার নন, মক্কেল। এই কেসের প্রথম অংশে সায়েবের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন স্যার তেজবাহাদুর সপ্রু। স্যার তেজবাহাদুর তখন অসুস্থ। তবুও তিনি অনেকের বাধা অমান্য করে আদালতে এসেছিলেন। এবং যতোদূর মনে পড়ে এই তাঁর শেষ মামলা। এরপরেই তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।

এই মামলায় শেষ পর্যন্ত সায়েব জিতেছিলেন। ক্লাব বন্ধ হয়নি। ভারতীয়দের সহযোগিতায় বর্তমানে সে-ক্লাবের আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।

.

কলকাতায় ফিরে এসে হাইকোর্ট না খোলা পর্যন্ত চুপচাপ কাটিয়ে দিয়েছি। কোর্ট খোলার কয়েকদিন আগে সায়েবও ফিরে এলেন। মাসখানেক রাণীক্ষেতে থাকার ফলে শরীরের বেশ উন্নতি হয়েছে। মুখের রক্তাভা, চোখের ঔজ্জ্বল্যও যেন বেড়েছে। মনের প্রফুল্লতার কথা নাই বা বললাম।

তারপর সত্যই একদিন কোর্ট খুললো। দশটার সময় ডালহৌসীতে ট্রাম থেকে নেমে চার্চ লেনের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহু চিন্তা মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল। ছোকাদা, অর্জুনবাবু, পাঁচুগোপালবাবু, এঁদের সঙ্গে আবার দেখা হবে। এতোদিন যেন আইন-পাড়ার অস্তিত্ব ভুলেই গিয়েছিলাম।

ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে পা দিয়ে আরও অনেক কিছু মনে পড়তে লাগলো। বার লাইব্রেরীর কেদারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বললাম,”এই যে, কেমন আছেন?” কেদারবাবু, যিনি লাইব্রেরী থেকে বই আনতে গেলে খিঁচখিঁচ করেন, তিনিও আজকে অন্য মানুষ। হাত তুলে নমস্কার করলেন। বললেন, “তোমাদের সব খবর ভালো তো?” তারপর নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন, “বই-টই কিছু দরকার নেই আজকে?” অনেকদিন পরে দেখা হওয়ার এই গুণ, মনে মনে ভাবছিলাম।

হাইকোর্ট বাড়িটার দিকে এতোক্ষণে চোখ পড়লো। চকচক করছে বাইরের দিকটা, ছুটির মধ্যে রঙ করা হয়েছে। মনে হলো দীর্ঘ বিরহের শেষে প্রিয়তমের আগমন-দিনে বধূ যেন সযত্নে নিজেকে সাজিয়েছেন। কিন্তু তারপরেই অন্যরকম ভাবতে লাগলাম। শতাব্দী ধরে এই বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে। যুগযুগান্ত ধরে সে দেখেছে অসংখ্য মানুষের শোভাযাত্রা। কতজন তাদের যৌবনে এখানে এল। তারপর প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের বেড়া ডিঙিয়ে একদিন টুপ করে অদৃশ্য হয়ে গেল মৃত্যুর অন্ধকারে। এই বিংশ শতকের মধ্যভাগে আমি যেমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে দেখছি, উনিশ শতকেও কতজন ঠিক তেমনভাবে তার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে। একই কথা পাশের বাড়ি টেম্পল চেম্বার সম্বন্ধে বলা যেতে পারে। বয়সে হাইকোর্ট থেকে বোধ হয় কম যায় না। সে বলছে, হাইকোর্ট থেকে আভিজাত্যে আমি হয়তো ছোটো, কিন্তু বাইরের লোকের পরিচয় প্রথমে আমার সঙ্গেই হয়। আমি যখন সব জেনে গিয়েছি, তখন হাইকোর্টের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দিই।

টেম্পল চেম্বারের এটর্নি আপিসগুলো আগেই খুলেছে। শুধু আমাদের ঘরটাই বন্ধ ছিল। ঘর খুলে দেখলামু জমাদার পরবাসীয়া বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে। সায়েবের টেবিলটা নিজেই সাজাতে লাগলাম। চিঠির কাগজ, দোয়াত- কলম, পিন কুশন, ব্লটিং যথাস্থানে আছে কিনা দেখতে-দেখতে দেওয়াল-ঘড়ির দিকে নজর পড়লো। সেটি দম অভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। দম দিতে আবার ঘড়ির প্রাণ সঞ্চার হলো, টিক-টিক করে চলতে লাগলো। আমার মনে হলো, এই পাড়াটাও যেন ঘড়ির মতো দম-বন্ধ হয়ে পড়েছিল। আজ থেকে আবার পুরনো কায়দায় চলতে আরম্ভ করলো।

প্রথমদিনেই মামলা আছে। তাই সায়েব একটু সকাল সকাল এলেন। বেয়ারারা তখনও কেউ আসেনি। এদিকে সায়েব নিজে কোট পরতে পারেন না। কয়েকবার কোট-পরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। শেষে তিনি রেগে উঠলেন। বললেন, “বেয়ারাগুলো এখনও কেন আসছে না?” এতোক্ষণ চুপচাপ মজা দেখছিলাম। এবার কোনোরকমে হাসি চেপে রেখে তার হাত থেকে কোটটা নিয়ে পরিয়ে দিলাম। ছোটোছেলের মতো মুখ বেশ গম্ভীর করেই তিনি কোট পরলেন। তারপর বোতাম লাগাতে লাগাতে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই, তাঁর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললেন, “জীবনে এতো কিছু শিখলাম, কিন্তু এই কোট-পরোটা শিখতে পারলাম না। ছোটো বেলায় মা পরিয়ে দিতেন, তারপর কলেজ-জীবনে এক চাকর ছিল, সেই আমাকে নষ্ট করলো। আমি মুখ থেকে কিছু বলবার আগেই সে সব বুঝে নিতো, এমনকি কোট পর্যন্ত পরিয়ে দিতো। ট্রেঞ্চে বসে লড়াই করতে শিখলাম, কামান দাগাতে শিখলাম, যুদ্ধের সময় তিনদিন না খেয়ে কাটাতে শিখলাম, কিন্তু কোট-পরাটা আমার দ্বারা হয়ে উঠলো না।”

হাসতে হাসতে তিনি কোর্টে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই মোহনচাঁদ এল। তাকে বললাম, “তুমি বসো, আমি একটু ঘুরে আসছি।”

বলা বাহুল্য আমার গন্তব্যস্থান বার-লাইব্রেরীর সামনে বাবুদের বেঞ্চি। আমাকে দূর থেকে দেখেই অর্জুনবাবু হাত নাড়তে লাগলেন। বাবুদের বেঞ্চি আজ একেবারে বোঝাই। সবাই এসেছেন। ছোকাদা বসেছেন ঠিক মধ্যিখানে।

“তারপর কার কী রকম কাটলো,” ছোকাদা জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্জুনবাবু বললেন, “আমাদের খবর আর কী হতে পারে, দাদা? দুপুরে খাসা একখানা ঘুম লাগাতাম। এক-আধদিন সিনেমায় গিয়েছিলাম। পুজোর ক’টা দিন তো বাড়ি থেকে বেরোইনি।”

ছোকাদা বললেন, “আমার ঠিক উল্টো। পুজোর ক’টা দিনই বেরোতাম। রোজ যেতাম আমাদের রামকেষ্ট আশ্রমের পুজো দেখতে। আহা, মনটা ওখানে গেলেই পবিত্র হয়ে যায়। তা ছাড়া সন্ধ্যাবেলায় থিয়েটার-টিয়েটারও ছিল।”

অর্জুনবাবু বললেন, “আমাদের হারুর খবর কী? আমাদের তো একটা খাওয়া পাওনা। তা হারু, তোমার ওয়াইফ যে চাইল্ড এক্সপেক্ট করেছিল, কী হলো?”

হারুবাবু লজ্জা পেলেন। ছোকাদা মিটমিট করে হেসে বললেন, “লজ্জা কি, বলো।” হারুবাবু বললেন’ “দশমীর দিন খোকা হয়েছে।”

শ্লীলতাবোধ-বিহীন হয়ে অর্জুন তড়াং করে বেঞ্চি থেকে উঠে হারুবাবুকে জড়িয়ে ধরলে। হারুবাবুর ভগিনীর সঙ্গে নিজের একটি নিকট সম্বন্ধ স্থাপন করে বললে, “গতবারেও খোকা, আবার এবারেও খোকা! মাইরি লাকি চ্যাপ তুমি। তোমার ওয়াইফ একেবারে গোল্ড মাইন।” অর্জুন আরও কিছু নোংরা বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু ছোকাদা বাধা দিলেন। “এসব কী হচ্ছে অর্জুন? মুহুরীদের মতো সস্তা ইয়ার্কি দিচ্ছো।”

অর্জুনের মনে আঘাত লাগলো। ছোকাদাকে মুখ খিঁচিয়ে বললে, “তুমি আর শিবঠাকুরটি সেজে বসে থেকোনি। তিনকাল কেষ্টঠাকুরটি হয়ে ফষ্টিনষ্টি করলে, আর এখন বেড়ালের মাছে অরুচি।

বাক্‌বিতণ্ডা ক্রমেই বাড়তে লাগলো। ছোকাদাও চোখা চোখা বাক্যবাণ ছাড়তে লাগলেন। গতিক সুবিধে নয় বুঝে আমি পালিয়ে এলাম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন