শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)
ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে আমার যে সব মামলা দেখবার সুযোগ হয়েছিল তাদের প্রায় কোনোটিই বিখ্যাত বিচার কাহিনী রূপে খবরের কাগজে হেড্ লাইনে স্থান পাবার যোগ্যতা অর্জন করেনি। কিন্তু বিখ্যাত মামলা ছাড়াও অনেকে ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে নীরবে পদার্পণ করে নিঃশব্দে বিদায় নেয়। তারা আমার কাছে কম মূল্যবান নয় এবং তারাই আজও আমার মনের মধ্যে ভিড় করে রয়েছে।
তেমনই একজনের কথা এখন বলবো। আরতি রায়ের পর বছরখানেকের মধ্যে মনে রাখার মতো এই একটি লোককেই দেখেছিলাম।
বছর কয়েক আগে হাইকোর্টের কাছে যাঁদের যাতায়াত ছিল তাঁদেরই অনেকেই তাঁকে দেখে থাকবেন। ঠিক একটার সময় প্রায়ই ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটে রিক্শার ঠুনঠুন আওয়াজ হয়। লাঠির উপর দুটি হাতে ভর দিয়ে সেই রিক্শায় একজন বিমর্ষমুখ আরোহী বসে থাকে। পরনে ছেঁড়া প্যান্ট, ছেঁড়া শার্ট, পায়ে শতছিন্ন কেড্স জুতো। কোনো বাড়ির সামনে রিক্শা থামিয়ে সায়েবটি ভিতরে ঢুকে যান, বেরিয়ে এসে আবার রিক্শা চড়েন। একটু এগিয়ে অন্য এক আপিসের সামনে তিনি আবার নেমে পড়েন।
আবার কখনো কখনো যুগলে আবির্ভাব হয়। যেমন বুড়ো সায়েব, তেমনি বুড়ি মেম। মেমের গায়ের রঙ নিকষ কালো। স্কার্টটা কতদিন যে ধোপার বাড়ি যায়নি ভগবান জানেন। কাছে গেলেই বোঁটকা গন্ধে দেহ ঘুলিয়ে ওঠে। পায়ে মোজা নেই। হাঁটু পর্যন্ত ধুলো কাদাতে বোঝাই, হাতে ভ্যানিটি ব্যাগের বদলে চটের রেশন থলি।
মেমসায়েবকে দেখে সবাই মুচকি হেসে পালাবার চেষ্টা করে। শুধু টেম্পল চেম্বারের সিঁড়ির নিচের পানওয়ালা বিশ্বনাথ গলা পরিষ্কার করে বলে, “গুড মডিং মেমসাব, গুড মডিং। লাটসাবকে সাথ গভর্নমেন্ট হাউসমে, আপকো যোঁ খানা থা…..।” রাগে ও অপমানে কাংস্যবিনিন্দিত কণ্ঠে মেমসায়েব পানওয়ালার ঊর্ধ্ব ও অধস্তন সাতপুরুষের উদ্দেশে সুমিষ্ট সম্ভাষণ বর্ষণ করতে থাকেন। “এ মেমসাব, কসুর মাফ কিজিয়ে। আপ্কে ওয়াস্তে খুদ লাটসাব এক সিগ্রেট ভেজা হ্যায়।” পানওয়ালা একটা সিগারেট বার করে নাড়তে থাকে। এবার মেমসায়েবের ক্রোধাগ্নিতে শান্তিজল পড়লো। একরকম ছুটে গিয়েই পানওয়ালার হাত থেকে সিগারেটটা ছিনিয়ে নিয়ে সামনের গ্যাসপোস্টে বাঁধা দড়ির আগুনে সেটা তিনি ধরিয়ে নেন।
মেমসায়েবের সামনে পড়লেই মুশকিল। আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবেন। একটু আড়ালে এনে চুপি-চুপি বলবেন, “বাবু ক্যান ইউ স্পেয়ার ফোর অ্যানাস?” আপনি যদি চুপ করে থাকেন তখন বলবেন, “অল রাইট, টু অ্যানাস উইল ডু।”
এই বুড়ো একদিন লাঠি ভর করে কাঁপতে-কাঁপতে সায়েবের চেম্বারে এলেন, সঙ্গে সায়েবের অনেকদিনের পরিচিত এটর্নি মিঃ জেকব।
মিঃ জেকব সায়েবকে বললেন, “আমার নতুন মক্কেল মিস্টার জেমস্ গোল্ড।”
ছেঁড়া শার্টের বোতামটা লাগাতে-লাগাতে মিস্টার গোল্ড বললেন, “আমি একটু প্রাইভেটে কথা কইতে চাই।”
“নিশ্চয় নিশ্চয়।” আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
মিনিট কুড়ি ধরে ভিতরে তিনজনের কথাবার্তা চললো। মিস্টার জেকবের প্রতিবাদে গোল্ড একবার চড়া গলায় বললেন, “না না।”
এমন সময় সায়েব আমাকে ভিতরে ডেকে বললেন, “আমাদের কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। তুমি মিস্টার গোল্ডের ঠিকানাটা লিখে নাও।”
“আমার ঠিকানায় চিঠি দিলেই চলবে,” মিস্টার জেকব বললেন। “আমি মক্কেলের ঠিকানা সর্বদাই রাখি, যদি হঠাৎ কিছু…” সায়েব উত্তর দিলেন।
মিস্টার গোল্ড একটু ইতস্তত করে বললেন, “ওই তো লিখে নিন,…স্যালভেশন হোম।”
ঠিকানা খাতায় লিখে নিলাম। গোল্ড খাতাটার দিকে চেয়ে রইলেন। “বললেন, অনেকদিনের পুরনো খাতা।”
“অ্যাড্রেস বুক যত পুরনো, ততো তার আভিজাত্য। আমি ইন্ডিয়াতে আসা থেকে এই খাতা ব্যবহার করছি।”
“হ্যাঁ,” গোল্ড বললেন, “খাতাটি দেখেই চিনেছি।”
আমরা অবাক। “আপনি এ-খাতা দেখেছেন আগে?”
“না, বাজে কথা থাক,” গোল্ড বললেন।
“No, no Mr. Gold, that sounds interesting”, সায়েব বললেন।
“আমাকে চিনতে পারছেন না?”
“ঠিক …….ঠিক মনে করতে পারছি না”, সায়েব লজ্জিতভাবে বললেন। “আপনার খাতাটা দিন।” গোল্ড আমার হাত থেকে খাতাটা নিয়ে নিলেন। মিনিট পাঁচেক ‘জি’ অক্ষরের মধ্যে খুঁজতেই বেরোলো। “এই যে দেখুন” খাতাটা তিনি সায়েবের দিকে এগিয়ে দিলেন।
“জেমস্ ফ্রেডরিক গোল্ড।”
…………
…………
ডিঃ সাহারানপুর
ইউনাইটেড প্রভিন্স।
“মনে পড়েছে, এইবার মনে পড়েছে”, সায়েব বলে উঠলেন। “অনেকদিন আগেকার কথা। কিন্তু একদম চেনা যায় না।”
“আমি অবশ্য প্রথমেই পেরেছি”, গোল্ড ম্লান হাসলো।
মিস্টার জেকব বললেন, “আমরা দিন কয়েক পরে আবার আসবো। ফী কত মোহর লাগবে জানিয়ে দেবেন।”
ওঁরা দু’জনেই চলে গেলেন। আমি অবুঝের মতো সায়েবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“এই এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোককে আগে আপনি চিনতেন?”
“এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান?”
“কেন? মিস্টার গোল্ড—”
সায়েব গম্ভীরভাবে বললেন, “জেমস্ গোল্ডের শিরায় শতকরা একশ’ ভাগ ইংরেজ রক্ত।”
“কিন্তু ওঁর বউ তো মিশ কালো, যিনি টেম্পল চেম্বারের তলায় মাঝে- মাঝে ভিক্ষা করেন।”
“জেমস্ গোল্ডের বউ? আগে যখন জানতাম, গোল্ড তখন অকৃতদার। আর আজও আমাকে বলে গেল সে সংসারে একা।”
“গোল্ডকে কয়েক সপ্তাহ ধরে রিকশায় চড়ে এপাড়ায় যাতায়াত করতে দেখছি।”
“টাকা থেকেও মানুষ যে পথের ভিখারী হতে পারে, তার এমন দৃষ্টান্ত আগে দেখিনি।” সায়েব বলতে লাগলেন—
“বছর পনেরো আগের কথা। সাহারানপুর জেলা কোর্টে এক বড়ো মামলায় আমি ব্রীফ পেয়েছিলাম। এখানকার এটর্নি বলে দিয়েছিলেন, ওখানে থাকবার অসুবিধা হবে না, মক্কেলের বিরাট বাড়ি আছে। আমার মক্কেল জেমস্ গোল্ড স্টেশনে এসেছিলেন, সঙ্গে বিরাট অস্টিন গাড়ি। গোল্ডের বাড়ির সামনে যখন গাড়ি থামলো, আমি অবাক। বাড়ি বলা চলে না—প্রাসাদ।
গোল্ডের সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা করতে এসেছি। তিনি প্রথমেই বলে দিলেন, ‘এ-বাড়ি আপনার নিজের মতো মনে করে থাকবেন। সংসারের খুঁটিনাটি আমি একদম বুঝি না। চাকর-বাকরদের হুকুম করলেই সব পেয়ে যাবেন।
দ্বামী আসবাবপত্রে প্রতিটি ঘর বোঝাই। হাতীর দাঁতের কাজ ও বিখ্যাত চিত্রকরদের পেন্টিং-এর সংগ্রহটি বিলেতের অনেক লর্ড পরিবারকে লজ্জা দিতে পারে।
দিন পাঁচেক ছিলাম সাহারানপুরে। প্রতিদিন বিকেলে গোল্ডের ফিটন গাড়িতে কাছাকাছি কয়েকটি গ্রামের মধ্যে বেড়িয়ে এসেছি।
বিশাল ডাইনিং হলে আমরা মাত্র দুটি প্রাণী। খাওয়ার সময় গোল্ড গল্প করতেন, শুধু মামলার গল্প। জীবনে মামলা ছাড়া যেন কিছু জানেন না। উনি বলেছিলেন, ‘আমার কাকার সঙ্গে মামলা করেছি, বোনের সঙ্গে এখনও কেস্ ঝুলছে। একবার তিন কাজিনের বিরুদ্ধে ডিক্রি পেয়েছি।’ নিজে উকিল না হলেও আইনের কিছু জানতে তাঁর বাকি নেই। মাছধরা, ছবি আঁকা, গলফ খেলার মতো মামলা করাই গোল্ডের নেশা।”
কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “বাড়িটা কতদিনের পুরনো? অনেক যত্নে সব কিছু সাজানো।”
“এ-বাড়িতে আমি মাত্র বছরখানেক রয়েছি। এক বুড়ীর কাছ থেকে কিনেছিলাম। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে আমার ভালো লাগে না। বছরখানেক পরে হয়তো অন্য কোথাও বাড়ি কিনে চলে যাবো, কিছুই ঠিক নেই।”
“আরও জানলাম তাঁর সংসারবন্ধন নেই। অলস অবসরে মদ্যপান ও উচ্ছৃঙ্খলতাভরা জীবন। মামলা ছাড়া আর কিছু করেন না। পিতৃপুরুষের সঞ্চিত ধনই নির্ভর।
মামলা শেষে কলকাতায় ফিরে এসেছি। তারপর এই পনেরো বছর গোল্ডের খবর রাখিনি।
আবার আজ দেখা। কঙ্কালসার বৃদ্ধ গোল্ডকে তুমিও দেখলে, সে আজ পথের ভিখারি।”
“কিন্তু কেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“কিছুদিন আগে কোনো গোপন কারণে গোল্ডের বিরুদ্ধে এক পরোয়ানা বার হয়। জীবনে বহু কুকর্মের অংশীদার গোল্ড নিখোঁজ হলেন। কিন্তু সরকার ছাড়লেন না। ফেরারদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবার বহু উপায় তাঁদের আছে। গোল্ডের মাথায় বজ্রাঘাত। তার সমস্ত সম্পত্তি এখন সরকারী হেফাজতে। এমন কি ব্যাঙ্কের তিন লাখ টাকাও তাঁরা ‘ফ্রীজ’ করেছেন। গোল্ড কপর্দকশূন্য হয়ে স্যালভেশন হোমে দিন কাটাচ্ছেন।”
এটর্নি জেকব এসেছিলেন পরামর্শ নিতে, সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা আইনসঙ্গত হয়েছে কিনা।
গোল্ড এলেন কয়েকদিন পরে। লিফট থেকে ঘর পর্যন্ত আসতেই ধুঁকছেন। শতছিন্ন হাফশার্টের তলার অংশটা দিয়ে তিনি নিজের মুখ মুছলেন। সায়েবকে বললেন, “টাকা আমার চাই। আমার টাকা আমি ভোগ করতে পারবো না?”
সায়েব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মিস্টার গোল্ড, অধৈর্য হলে চলবে কেন?”
দু’-একটা কথার পর গোল্ড চলে গিয়েছেন। কিন্তু পরেই দেখি তাঁর সঙ্গিনী মহিলাটি দরজা থেকে উঁকি মারছেন। “মিস্টার গোল্ড আছেন?”
গোল্ড নেই শুনে তিনি রাগে গজগজ করতে লাগলেন। “কি ঝঞ্ঝাট! আর ভালো লাগে না। এইখানে থাকবে বলে মিনসে চলে গেল?” মহিলাটি বেরিয়ে গেলেন।
আধ ঘন্টার মধ্যেই আবার গোল্ড এলেন, সঙ্গে মিস্টার জেকব। ভিতরে অন্য একজন এটর্নির সঙ্গে সায়েব কথা বলছিলেন। গোল্ড তাঁর নড়বড়ে দেহ নিয়ে কাঁপতে-কাঁপতে আমার সামনের চেয়ারে বসলেন।
আমি বললাম “এক ভদ্রমহিলা আপনাকে খুঁজতে এসেছিলেন।”
“মিস্ ফিগিন নিশ্চয়,” রাগে গোল্ড দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন। “কতবার বলে দিয়েছি বাইরে রাস্তায় অপেক্ষা করতে, তবুও কথা শোনা হয় না।”
মিস্টার জেকব আমাকে ইশারা করে মিটমিট করে হাসতে লাগলেন।
আরেকদিন সাড়ে দশটার সময় চেম্বারে ঢুকে গোল্ড গম্ভীরমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “মিস ফিগিন আর আসেনি তো?”
উত্তর দিলাম, “না, আর আসেননি।”
“আবার যদি আসে আমাকে বলে দেবেন।”
ভিতরে ঢুকে গোল্ড সায়েবের হাতে একটা চেক দিলেন। “মিস্টার জেকব এই পাঁচশ’ টাকার চেক পাঠিয়েছেন, উনি লাঞ্চের পর আসবেন।” তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “উনি না আসা পর্যন্ত এখানেই বসতে পারি?”
“নিশ্চয়”, সায়েব বললেন। গোল্ড বসে রইলেন, সায়েব নিজের কাজ করতে লাগলেন।
কয়েকমিনিট পরে একটু ইতস্ততঃ করে গোল্ড আবার বললেন, “আপনার গোটাকয়েক পুরনো শার্ট পাওয়া গেলে উপকার হতো। ঠান্ডাটা বেশ পড়তে আরম্ভ করেছে।”
“আমার অনেক জামা পড়ে আছে। আপনার কাজে লাগলে আনন্দ পাবো। কালই কয়েকটা নিয়ে আসবো।”
গোল্ডের এবার কাঁদোকাঁদো অবস্থা। বললেন, “এভাবে আর জীবন কাটাতে পারছি না। টাকাটা উদ্ধারের আশা আছে কিনা সত্যি করে বলুন।”
সায়েব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “চেষ্টা করে দেখতে হবে। আমরা প্রথমেই গভর্নমেন্টকে নোটিশ দিয়ে চিঠি পাঠাচ্ছি।”
মামলার টাকা কোথা থেকে এবং কেমন করে আসছে গোল্ডের কাছে শুনে সায়েব স্তম্ভিত। মিস্টার জেকব ব্যারিস্টারের ফী ও আনুষঙ্গিক খরচা নিজেই বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পরিবর্তে প্রায়ই নানা কাগজে সই করিয়ে নেন। কালকেই পঞ্চাশ হাজার টাকার হ্যান্ডনোট গোল্ড সই করেছেন।
শুনে সায়েবের মুখ কুঞ্চিত হলো। বললেন, “মিঃ গোল্ড, কী ভয়ঙ্কর ফাঁদে পা দিয়েছেন, বুঝতে পারছেন? সরকারের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার হলেও এক কপর্দক আপনার ভোগে আসবে না। সেটি পকেটস্থ করবার জন্য অনেকে ওঁৎ পেতে বসে আছে।”
গোল্ড চমকে উঠলেন। “আমার সঙ্গে কথা হয়েছে টাকাটা পেলে দশ হাজার টাকা জেকবকে দেবো। উনি আর কিছু চাইবেন না।”
“ক’খানা কাগজে এখন পর্যন্ত সই করেছেন?”
“ঠিক মনে নেই, তবে অন্তত পাঁচটা।”
অসহ্য ক্রোধে সায়েব পায়চারি করতে করতে বললেন, “আরও আগে আমার জানা উচিত ছিল।”
“জেকব বলেছিলেন, এসব যেন আপনার কানে না যায়।”
গোল্ডকে তখনকার মতো বিদায় দিয়ে সায়েব পায়চারি করতে লাগলেন। আমি চেয়ারে বসেছিলাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন “মানুষের বিপদের সুযোগ নিয়ে জেকবের মতো লোকেরা সব করতে পারে। প্রদীপের তলায় অন্ধকারই সর্বাপেক্ষা গাঢ়। ধর্মাধিকরণের পাশেই যত অধর্মের ঘাঁটি।” সায়েব অস্থির হয়ে উঠলেন।
একটু পরে বললেন, “গোল্ডের কেসে ফী নেবো না। আমি অন্য এটর্নির ব্যবস্থা করছি।”
যথাসময়ে জেকবকে সায়েব জানিয়ে দিলেন, তার কারচুপি ধরা পড়ে গিয়েছে এবং এই অন্যায় তিনি বরদাস্ত করবেন না। জেকব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন— “আপনি ফী নিয়ে কাজ করবেন। মক্কেলের সঙ্গে আমি কি করছি না করছি, তাতে আপনার মাথা গলানোর প্রয়োজন নেই।”
সায়েব উত্তর দিলেন, “মিঃ জেকব, এই বয়সে আমি অন্যায়ের নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকতেও রাজী নই।”
জেকবও দমবার পাত্র নন। তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে অন্য কারও অযাচিত উপদেশ শুনতে তিনি যে মোটেই আগ্রহান্বিত নন, তা সায়েবকে জানিয়ে দিলেন।
জেকবের তেজ অবশ্য বেশিক্ষণ রইলো না। যখন তিনি শুনলেন যে, প্রয়োজন হলে সায়েব সমস্ত বিষয়টি হাইকোর্টের গোচরে আনবেন, তখন নরম হয়ে পড়লেন। দিনকয়েক পরে গোল্ডের সই করা কাগজগুলো নিয়ে জেকব চেম্বারে এলেন। কাগজগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হলো। পোড়া কাগজের ছাই-এর দিকে কিছুক্ষণ বাঁকা-চোখে তাকিয়ে থেকে জেকব দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলেন।
গোল্ড বেশ কিছুক্ষণ সায়েবের দিকে চেয়ে রইলেন। “আপনার ঋণ কখনও শোধ করতে পারব মনে হয় না।”
সায়েব উত্তর দিলেন, “যতক্ষণ না টাকাটা উদ্ধার করছি ততোক্ষণ আপনার কিছু উপকারই হলো না। সুতরাং কৃতজ্ঞতার প্রশ্নই ওঠে না।”
“কতদিন সময় লাগবে বলতে পারেন?” গোল্ড আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
“বেশিদিন লাগবে না”, সায়েব প্রবোধ দিলেন।
কয়েকদিন পরেই গোল্ড আবার এসেছেন। লাঠির উপর ভর করে জীর্ণ দেহটা কোনোরকমে টেনে এনে বেঞ্চিতে বসে হাঁপাতে লাগলেন। দারিদ্র্য ও বার্ধক্য একসঙ্গে যেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। চোখের কোণে ঘন কালো রেখা তার ক্লান্ত মুখচ্ছবিকে আরও অন্ধকার করে তুলেছে।
সায়েব নেই, কোর্টে গিয়েছেন।
“কখন ফিরবেন?” হতাশ হয়ে গোল্ড জিজ্ঞাসা করলেন।
“চারটের আগে নয়,” আমি বললাম।
দেওয়ালের র্যাকে থাকে-থাকে সাজানো ল রিপোর্টারগুলোর দিকে গোল্ড উদাস নয়নে চেয়ে রইলেন।
সায়েবের কাছে শুনেছি এসব রিপোর্টারের মধ্যে গোল্ডবংশের অনেক কাহিনী লুকিয়ে আছে। বহুকাল ধরে গোল্ডরা মামলা করে আসছে। এক শতাব্দীর আগে মুরস ইণ্ডিয়ান রিপোর্টার-এও গোল্ডদের অন্তত গোটা পাঁচেক মামলার সন্ধান পাওয়া যাবে।
গোল্ড কখনো আমাদের সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না। নেটিভদের সঙ্গে সম্পর্ক সম্বন্ধে তিনি অতিমাত্রায় সচেতন এবং আমাদের কাছে আত্মাভিমান প্রকাশের সামান্য সুযোগও নষ্ট করতেন না। কিছু জানবার থাকলে সোজা সায়েবের কাছে চলে যান, আমাদের দিকে ফিরেও তাকান না।
সায়েব না থাকায় বোধকরি সেদিন আমার সঙ্গে দু’চারটে কথা বললেন। “এটর্নি পাড়ার সঙ্গে আমাদের অনেকদিনের পরিচয়”, গোল্ড তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে যাচ্ছিলেন। “ব্যারিস্টারদের পিছনে লাখ-লাখ টাকা খরচ করেছি আমরা। বাবু, তুমি তার কিছুই বুঝবে না। তোমার সায়েবকে জিজ্ঞাসা করো, আমার কেসের জন্য কতবার আইন পালটিয়েছে।” তারপর মুখ বিকৃতি করে বললেন, “বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি! জাস্টিস্ আমীর আলীর জাজমেন্টের কপি এখনও আমার কাছে আছে। কোন ব্যারিস্টার আমার কেস্ করেনি? ল্যাংফোর্ড জেমস, এল. পি. পিউ, এস. এন. ব্যানার্জী, এন. এন. সরকার- গোল্ড খানিকটা আত্মপ্ৰসাদ অনুভব করলেন। “এই যে তোমার সায়েব মামলা করছেন, টাকা পেলেই প্রতিটি পাই মিটিয়ে দেবো। এসব তোমার সায়েব বুঝবেন, তোমাকে বলে লাভ নেই। আমি এখন উঠি।”
.
নতুন এটর্নি কয়েকদিন পরে জানালেন মামলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সরকার বাজেয়াপ্ত টাকা প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করছেন।
গোল্ডের আফসোসের শেষ নেই। এতগুলো টাকা—তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে, অথচ একটা পয়সা নেই। উত্তেজনায় দেহটা থর-থর করে কাঁপতে থাকে। ধিক্কারে সমস্ত মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে।
গোল্ডের নতুন এটর্নি হিসেবে মিঃ লাহাকে সায়েব ঠিক করেছিলেন। তিনি কেস্ ফাইল করলেন।
কিন্তু গোল্ডের আর দেখা নেই। দিন দশেকের মধ্যে টেম্পল চেম্বারে এলেন না। আমাদেরও মনে ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন দেখি দরজার কোণ থেকে মিস্ ফিগিন উঁকি মারছেন। হাতে ময়লা রেশন ব্যাগ।
মিস্ ফিগিনকে সায়েবের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গোল্ডের খবর কী? এ-পাড়ায় একদম আসছে না কেন?”
“আপনারা জানেন না?”
“না তো, কী হয়েছে?”
মিস্ ফিগিন বললেন, “প্যারা-টাইফয়েডে হাসপাতালে পড়ে আছেন। কাল জ্বর প্রায় ছেড়ে গিয়েছে। বুড়োর সখ কম নয়, আপেল আর বেদানা খাবার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু আমি কোথায় এসব জিনিস পাবো বলুন তো?”
মিস্ ফিগিনের হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে সায়েব বলে দিলেন, “উনি যেন খুব সাবধানে থাকেন। কেস্ সম্বন্ধে কিছু জানতে চাইলে বলবেন, কাজ এগোচ্ছে।”
“আমি কেন ছাই বুড়োর জন্যে ঘুরে মরি, আমার কী দায়?” গজগজ করতে করতে মিস্ ফিগিন চলে গেলেন।
সায়েব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বেচারার জন্য দুঃখ হয়। এ- কেস্ কতদিন চলবে কিছু ঠিক নেই। বুড়ো গোল্ড এ-টাকা দেখে যেতে পারবে আশা হয় না।
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আরও বললেন, “এক একসময় মনে হয় যেন গোল্ড-বংশের সম্পদ অভিশপ্ত। বহু পুরুষের সঞ্চিত অর্থের সঙ্গে অভিশাপের বিষ মিশে রয়েছে। যতোদূর জানি, এ-সম্পদ সৎপথে উপার্জিত নয়। ভগবানের বিচারে কি এক রহস্যময় বৈচিত্র্য আছে। কখনো কখনো পরিহাসচ্ছলে বহুজনের অপরাধের শাস্তি তিনি জমা করে রাখেন। তারপর একজনকে তার ফল ভোগ করতে হয়।” সায়েব হাসলেন। “নাঃ, আমরা বড়ো দার্শনিক হয়ে পড়ছি।”
কিছুদিন পরে গোল্ড আবার এলেন। কঙ্কালসার দেহটাকে হঠাৎ দেখলে ভূতের মতো মনে হয়। পরমায়ু যেন ফুরিয়ে এসেছে। সায়েব তাঁকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। দু’জনে প্রায় আধঘণ্টা ধরে কথা বললেন। তারপর গোল্ড বেশ অসন্তুষ্টভাবে বেরিয়ে গেলেন। যাবার সময়ে বললেন, “ওসব হবে না। কিছুতেই হবে না। ওরা আমার দু’চোখের বিষ।”
তারপর কয়েক সপ্তাহ ধরে সায়েবের সঙ্গে গোল্ডের গোপন আলোচনা চলতে লাগলো। দু’জনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেন। কিন্তু কি বিষয়ে সায়েব তা প্রথমে আমাকে বলেননি।
শনিবারে হাইকোর্টে কোনো কেস্ হয় না। চেম্বারে তিনি একটু দেরিতে এলেন। আমাকে ভিতরে ডেকে বললেন, “একটা উইল টাইপ করতে হবে। আজকেই সব তৈরী করে রাখতে চাই।”
সায়েব বলে চললেন। আমি লিখে নিলাম—দীস্ ইজ দি লাস্ট উইল এণ্ড টেস্টামেন্ট অফ…। উলভারহ্যামটনের গোল্ড পরিবারের মাইকেল গোল্ডের শেষ সন্তান, অকৃতদার, অপুত্রক জেমস্ ফ্রেডরিক গোল্ডের শেষ উইল। ভারতবর্ষের অভিভাবকহীন শিশুদের জন্য তিনি তাঁর চার লক্ষ টাকার সম্পত্তি একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে যাচ্ছেন।
শুনে আমি চমকে উঠলাম। হাত কেঁপে গেল। তাঁর মুখের দিকে তাকাতে সায়েব রহস্যময়ভাবে হাসলেন। বললেন, “বহু কষ্টে রাজী করিয়েছি। গোল্ডের জীবদ্দশায় এ মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কিন্তু তার মৃত্যুর পরও টাকাটা সৎকার্যে ব্যয়িত হলে গোল্ডের অভিশপ্ত আত্মা কিছুটা শান্তি পাবে।”
মোটা নীল কাগজে কম্পিত হাতে জেমস্ গোল্ড সই করলেন। সই করতে বিশেষ ইচ্ছা ছিল না। কেননা উইলটা খামে পুরে সায়েবের দিকে এগিয়ে দিয়েই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “টাকা পাবার কি মোটেই আশা নেই? টাকা রয়েছে— অথচ আমার কষ্ট।”
অসুস্থদেহে রোজ লাঠিতে ভর দিয়ে গোল্ড চেম্বারে আসতেন। দিন-দিন ক্ষীণবল দেহে এতোদূরে আসার প্রয়োজন নেই। তবু তিনি আসেন। ধুঁকতে ধুঁকতে বেঞ্চিতে বসে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘গুড মর্নিং।’ নিজের গল্প শুরু করেন আজকাল—পুরনোদিনের গল্প। কল্পনার পাখা উড়িয়ে সেই অতীতে ফিরে যাবার চেষ্টা করেন, যখন কেউ ভাবতে পারতো না গোল্ড বংশের এক সন্তান বিত্তহীন অবহেলিত হয়ে কলকাতার পথে-পথে ঘুরে বেড়াবেন।
“জানো বাবু, রবার্ট ক্লাইভ উইলিয়ম গোল্ডের উপর কীরকম নির্ভর করতেন? ক্লাইভের অনেকগুলো চিঠি আমি রেখে দিয়েছি। ইণ্ডিয়ানদের সে-সব কখনো দেখাবো না। সময়মতো পুড়িয়ে ফেলতে হবে।” গোল্ডের খেয়াল নেই তাঁর শ্রোতা একজন ইণ্ডিয়ান।
তিনি বর্ণনা করে যান—উইলিয়াম গোল্ডের পর কলকাতার রাস্তা দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছেন ডগলাস্ গোল্ড। নেটিভরা সভয়ে একধারে সরে দাঁড়াচ্ছে। সামনে এক গরুর গাড়ি রাস্তা জুড়ে রয়েছে। ডগলাস্ বাক্যব্যয়ে বিশ্বাস করেন না। গাড়োয়ানের পিঠের উপর তাঁর হাতের চাবুক নেমে আসে। রাস্তা পরিষ্কার, ঘোড়া লাফাতে লাফাতে অদৃশ্য হয়ে যায়।
উত্তেজনায় গোল্ডের গলা কাঁপতে থাকে। আমি নীরবে শুনে যাই। জীবনের নির্মম রথচক্রে নিষ্পেষিত এই হতভাগ্যের ক্ষণিক স্বপ্নপরিক্রমায় বাধা দিতে করুণা হয়।
আর একদিন টেম্পল চেম্বারের সামনে ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম। গোল্ড কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করছেন। কে নাকি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে চলে গিয়েছে। তিনি বলছেন, “কোনো ম্যানার জানে না ইণ্ডিয়ানরা।” মিস্ ফিগিন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে দেখে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। বললেন, “বাবু, প্লিস্ ডোন্ট মাইণ্ড। একটা সিকি দাও, মিস্টার গোল্ডকে রিক্শায় চড়িয়ে নিয়ে যাই। একে দিনকাল খারাপ এখনই না মারধর খায়।”
আমি একটা রিক্শা ডেকে দিলাম। গোল্ড তখনও রাগে ফুলছেন। গলা ফাটিয়ে চিৎকারের চেষ্টা করছেন। কিন্তু অবাধ্য দেহটা মনের আদেশ পালন করতে পারছে না। মিস্ ফিগিনের হাতটা জোরে সরিয়ে দিলেন তিনি। “বুড়ী ফিরিঙ্গী জ্বালাতন করিস্ না।’
মিস্ ফিগিন রাগে হিন্দীতে বাক্যবর্ষণ আরম্ভ করলেন। “তা বলবে না মিসে! রোজকার রিক্শাভাড়া কিভাবে জোটাই জানো না তো।” গোল্ডকে কোনোরকমে রিক্শাতে বসিয়ে রেশনের থলি নিয়ে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। রিক্শাওয়ালা দু’বার ঘণ্টি ঠুকে চলতে আরম্ভ করলো।
হাইকোর্টে জেমস্ গোল্ড হেরে গেলেন। সুপ্রীম কোর্টে শেষ চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সায়েব প্রায় হতচৈতন্য গোল্ডকে সান্ত্বনা দিলেন।
“সত্যি চেষ্টা করবেন বলুন, না হলে এখান থেকে আমি যাবো না।”
“যখন কথা দিয়েছি, নিশ্চয় করবো।” সায়েব বললেন।
কয়েক সপ্তাহ পরে পার্ক স্ট্রীটের সমাধিক্ষেত্রে আমাকে একবার যেতে হয়েছিল। সাহিত্যচর্চার রোগ তখন সবেমাত্র ধরতে আরম্ভ করেছে। স্যার উইলিয়ম জোন্সের উপর একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধের সর্বশেষ উপকরণ সংগ্রহের জন্য ওখানে যাওয়া।
সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে। সমাধিক্ষেত্রে ঢুকেই মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল। ছোটো-বড়ো অসংখ্য স্তম্ভ নীরবে শতাব্দীর ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। এখানে অনেকে ঘুমিয়ে আছেন। কেউ প্রবল প্রতাপ শাসক, কেউ নৌবহরের সেনাপতি, কেউ বা সামান্য ব্যবসায়ী। কাছে গিয়ে অনেকগুলি স্তম্ভ স্পর্শ করলাম। আজ কোনো ভয় নেই, গোরা সৈন্যরা তাদের প্রভুকে রক্ষার জন্য তেড়ে আসবে না। সেনাপতিকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য কেউ নেই—নিজের বুকের উপর ফলকটি একমাত্র ভরসা।
স্যার উইলিয়ম জোন্সের সমাধিপার্শ্বে দাঁড়ালাম। তে-কোণা বিরাট সৌধ, আকৃতিতে অনেকটা পিরামিডের মতো। বহু-শাস্ত্রজ্ঞ স্যার উইলিয়ম, এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা।
সেই কবরখানার মধ্যে আমার থেকে একটু দূরেই গোল্ডকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। এখানে বুড়ো কী করতে এসেছে? কয়েকটা সমাধি পেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেই, বুড়ো আমার দিকে কটমট করে তাকালেন। তারপর রাগতস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি এখানে কেন? কেন তুমি এখানে এসেছ?”
বুড়োর অসৌজন্যে আমার মাথাটা গরম হয়ে উঠলো। বেশ রেগেই উত্তর দিলাম, “তার কৈফিয়ত আপনাকে দেবার ইচ্ছা আমার নেই।”
লোকটার সঙ্গে কথা বলতেও আমার ঘৃণা বোধ হচ্ছিলো। সমাধিক্ষেত্রে আমার কাজ শেষ হয়েছে। গোল্ডকে পিছনে ফেলে রেখে আমি চলে আসছিলাম। গোল্ড তখন আমাকে ডাকছেন, “বাবু, বাবু, একবার শুনে যাও।” সে আহ্বানে কান না দিয়ে আমি চলে যাচ্ছিলাম। তখন তিনি নিজেই আমার কাছে ছুটে এলেন। “বাবু, কিছু মনে করো না। আমারই দোষ হয়েছে। তুমি এখানে এসে ভালোই করেছো। এসো সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।”
“কার সঙ্গে পরিচয় করাবে? এখানে তো অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!” গোল্ড হাসলেন, “এসো, তাঁরা শুয়ে আছেন।”
ঝোপঝাড় ভেঙে আমরা প্রধান গেটের কাছে এলাম। রাস্তা পেরিয়ে অন্য এক সমাধিক্ষেত্রে আঙুল দিয়ে গোল্ড একটা সৌধ দেখিয়ে দিলেন। অনেক পুরনো, অযত্নে মলিন হয়ে রয়েছে। বড়ো ফলকটা অনেক কষ্টে পড়লাম—
Here lies in Perfect Peace
William Robert Gold,
One of the most devoted
and gallant officers
of the Hon’ble Company
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অন্যতম কর্মচারী, নির্ভীক যোদ্ধা, স্ত্রীপুত্রের প্রতি পরম স্নেহশীল উইলিয়ম রবার্ট গোল্ড এক শতাব্দীর নিদ্রা সমাপ্ত করে আর এক শতাব্দীর নিদ্রায় মগ্ন। ১৭৩০ সালে উলভারহ্যামটনে জন্ম, বিশ বৎসর বয়সে ভারতবর্ষে আগমন
পাশে আর একটি ফলক। এলিজাবেথ গোল্ড। ‘মতজগতে উইলিয়মের শয্যাসঙ্গিনী, পতিগতপ্রাণা, স্নেহশীলা জননী এলিজাবেথ স্বামী অপেক্ষা দশ বৎসরের কনিষ্ঠা। কিন্তু পরম করুণাময় জগৎপিতা উইলিয়মের পূর্বেই তাঁকে ডেকে পাঠালেন।’
ইশারায় গোল্ড আরও কয়েকটি ফলক দেখালেন—ডগলাস, ডেভিড ও চার্লস।
উলভারহ্যামটনের গোল্ডদের বংশধারা সে-যুগের কলকাতার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ও মহামারীর মধ্যেও অব্যাহত গতিতে চলেছে, বুঝতে পারলাম। সে- ধারা এক শতাব্দী অতিক্রম করে আর এক শতাব্দীতে পড়েছে। গম্বুজওয়ালা সমাধিটিতে আরও অনেকে রয়েছেন। নেপিয়ার গোল্ড, সিনথিয়া গোল্ড, রিচার্ড গোল্ড, রেভিনিউ বোর্ডের অন্যতম সদস্য হ্যারল্ড গোল্ড, হার ম্যাজেস্টির সৈন্যবাহিনীর সুযোগ্য কর্নেল স্টুয়ার্ট গোল্ড।
অবাক হয়ে একটি পরিবারের শতাব্দীর ইতিহাস লক্ষ্য করছিলাম। গোল্ডের সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এসে ঠোটে আঙুল দিয়ে সন্তর্পণে বললেন, “খুব আস্তে, ওঁদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে।”
সমাধি থেকে তিনি কিছুটা দূরে সরে গেলেন। চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, যেন তাঁর পিতৃপুরুষরা কথাগুলো শুনে না ফেলে। তারপর বললেন, “গোল্ডদের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন কী জানো? তারা একসঙ্গে ঘুমিয়ে থাকবে। জীবদ্দশায় এলাহাবাদ, মাদ্রাজ আর আফ্রিদী সীমান্ত যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যুর পর তারা পার্ক স্ট্রীটের এই কোণে আসতে চায়।”
প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ যেন এখানকার আকাশে বাতাসেও ছড়িয়ে রয়েছে।
“গোল্ডদের সবচেয়ে প্রিয় আকাঙ্ক্ষা যেন এই সমাধিতে শেষ আশ্রয় মেলে।” আধো-অন্ধকারে তাঁর স্বরে এক অনির্বচনীয় বেদনার সুর ধরা দিচ্ছিলো। “কিন্তু সে হবার নয়। আমার উইলটা তোমাদের কাছে রয়েছে; তাতে লিখে দিয়েছি কলকাতা থেকে অনেক দূরে আমাকে যেন মাটি দেওয়া হয়।”
“কেন? উলভারহ্যামটনের গোল্ডদের বংশধর জীবনের দিবাবসানে পিতৃপুরুষের পাশে কেন স্থান পাবেন না?”
রেগে উঠলেন তিনি। চাপা গলায় বললেন, “সে বুঝবার ক্ষমতা ভগবান নেটিভদের দেননি।”
সন্দিগ্ধভাবে তিনি আমার দিকে তাকালেন। “আমার জন্য তোমার এতো দরদ কেন? ভেবেছো মিষ্টি কথায় ভুলে যাবো! কিন্তু হাজার হোক, রাজার জাত আমরা। তোমাদের উদ্দেশ্য সব বুঝতে পারি। আমার বংশে কলঙ্ক লেপন না করলে তোমাদের সুখ হবে না। কিন্তু কিছুতেই নয়। কী লিখবে আমার স্মৃতি ফলকে? স্যালভেশন হোমের জেমস্ গোল্ড এখানে শুয়ে আছে। খুব মজা হবে, না? কিছুতেই নয়। আমি কিছুতেই তা হতে দেবো না।”
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনি আরও ভিতরের দিকে হাঁটতে লাগলেন। অন্ধকারে সাপ কিংবা পোকামাকড় থাকা আশ্চর্য নয়, কিন্তু তাঁর খেয়াল নেই। গতিক সুবিধের নয়। আমি সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এলাম।
সুপ্রীম কোর্টে মামলা করা হয়নি শেষ পর্যন্ত। কাগজপত্র তৈরি হবার আগেই গোল্ডের মৃত্যু সংবাদ চোখের জল মুছতে মুছতে মিস্ ফিগিন একদিন চেম্বারে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন