কত অজানারে – ১৮

শংকর (মণিশংকর মুখোপাধ্যায়)

ছোকাদার কথা যখনই চিন্তা করি তখনই আর একজনের কথা মনে পড়ে। দশ নম্বর কোর্টেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। গোলগাল মোটাসোটা ভদ্রলোকটি, মুখে অমায়িক হাসি। নাম জগদীশবাবু। গলাবন্ধ সুতী কোট পরে যখন বসে থাকতেন তখন বাঙালী বলে মনে হতো না। ঠিক যেন মারোয়াড়ী ব্যবসাদার; কে বলবে তিনি পাবলিক প্রসিকিউটর পি. কে. রায়ের মুহুরী।

জগদীশবাবুর মতো এমন অমায়িক ভদ্রলোক খুব কম দেখেছি। আমার সঙ্গে দেখা হলেই পিঠে চাপড় দিয়ে বলতেন, “চলো, চা খেয়ে আসা যাক।” আইনপাড়ায় জগদীশবাবুর পয়সায় কতবার যে চা খেয়েছি তার হিসেব রাখিনি। কারণ সে- হিসাব শুনলে আমার ভদ্রতাবোধ সম্বন্ধে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করবেন। কিন্তু আমার কি দোষ বলুন? আমি চায়ের দাম দিতে গেলেই জগদীশবাবু বলতেন, “হাজার হোক বয়সে তো তোমার থেকে বড়ো, দোকানে আমার মানটা নাই বা নষ্ট করলে! লোকে বলবে, এক ফোঁটা একটা ছেলে বুড়োর চায়ের দাম দিচ্ছে।”

জগদীশবাবুকে অনেকবার বলেছি, “আমি আর এক ফোঁটা ছেলেটি নেই, এ-পাড়ার একটি ঝানু বাবুতে দাঁড়িয়েছি।” তিনি স্বীকার করেননি। কাঁধে হাত দিয়ে বলেছেন, “আইন পাড়াতে আর কিছু না শেখো, বাক্যবুলিতে ওস্তাদ হয়ে গিয়েছো।

অন্য মুহুরীরা বলতেন, “লোকটার দেমাক আছে। আমাদের সঙ্গে ভালো করে কথা কয় না।” কিন্তু কেন জানি না আমাকে দেখলেই পান চিবোতে চিবোতে হাসতে-হাসতে জগদীশবাবু বলতেন, “এই যে শ্রীমান, চেম্বারে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসা হয়েছে বুঝি। দশ নম্বর ঘরটা তোমার যে কেন ভালো লাগে জানি না। আমি তো মাঝে-মাঝে হাঁপিয়ে উঠি। সমস্ত জীবন এই একটা ঘরে কেটে গেল। তোমরা তবু নানান কোর্টে ঘুরে বেড়াবার সুযোগ পাও।”

তর্ক করতে আমার খুব ভালো লাগে। তাই বললাম, “আমার ইচ্ছে হয় দিনরাত দশ নম্বরে দাঁড়িয়ে থাকি। মানুষ কিছুতেই সন্তুষ্ট নয়। হলে, এই ঘর ছেড়ে আপনি অন্য কোথাও যেতে চাইতেন না।”

মোটা হাত দিয়ে আমার পিঠে একটা থাবড়া মারলেন তিনি। “ও, দুষ্টুমি হচ্ছে! ওরে, আমিও তো সন্তুষ্ট থাকতে চাই।” এবার তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে উঠলেন। তারপর নিজের মনেই বললেন, “কিন্তু পারি কই?”

“কিছু মনে করবেন, না জগদীশবাবু, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কথাটা বলিনি। আগে কখনো আপনাকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখিনি। কী হলো? রায় সায়েবের সঙ্গে কিছু গোলমাল হয়েছে নাকি?”

ম্লান হেসে তিনি বললেন, “না, রায় সাহেব আমার দেবতার মতো মানুষ। কিছু হয়নি। তবু এক এক সময় মনে হয়, এ ঘরে যদি কখনো না আসতাম, তা হলে ভালো হতো!”  

জগদীশবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় আজকের নয়। মিস্টার রায় তখনো পাবলিক প্রসিকিউটর হননি। জগদীশবাবুও তখন এতো মোটা ছিলেন না। দশ নম্বরে দিনরাত বসে না থেকে, মাঝে-মাঝে অন্য কোর্টে বেড়াতে যেতেন। আজকাল তো চা খাওয়ার সময় ছাড়া ওখান থেকে একটি পা-ও নড়বেন না।

দশ নম্বর ঘরের স্মৃতির সঙ্গে জগদীশবাবু অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে গিয়েছেন। হয়তো আমার দুর্বলতা, কিন্তু তাঁকে ছাড়া দশ নম্বর কোর্টকে এবং দশ নম্বর কোর্ট ছাড়া তাঁকে কিছুতেই কল্পনা করতে পারি না।

অনেকদিন আগে বাবুদের বেঞ্চিতে বসে ছোকাদার সঙ্গে গল্প করছিলাম। তাঁকে বলছিলাম, “এই বেঞ্চিতে বসে থাকলে প্রতি মিনিটে গল্পের খোরাক পাওয়া যায়। চোখের সামনে কত রকম লোকের আনাগোনা চলছে।”

ছোকাদা ঘাড় নেড়ে বললেন, “পরমহংসদেবের সেই সাধুর গল্প শুনেছিস তো? যে বলেছিল, সামনে এগিয়ে যা; তারপরে প্রথমে তামার খনি, আরও সামনে রূপোর খনি এবং আরও এগিয়ে সোনার খনি পাওয়া গেল। আমি পরমহংস নই, সুতরাং বিশ্বাস করবি না। কিন্তু তবু আমি বলছি সামনে এগিয়ে যা, অনেক কিছুর সন্ধান পাবি।”

ছোকাদাকে কখনও অবিশ্বাস করিনি। বার-লাইব্রেরীর বারান্দা ধরে তাই সোজা এগিয়ে গিয়েছি। প্রথমে বার এসোসিয়েশন, আরও এগিয়ে কাঠের পোল পেরিয়ে হাইকোর্টের আর এক অংশ, দশ নম্বর কোর্ট। সামনে পুলিশের ভিড়, থমথমে ভাব—দায়রা কোর্ট। মূল আদালতের সঙ্গে যেন কোনো আত্মার সম্বন্ধ নেই, তাই অস্পৃশ্যের মতো আসল বাড়ি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দশ নম্বর ঘরের সামনে থমকে দাঁড়াই। দরজায় পুলিশ রয়েছে। ভিতরে ঢুকতে দেবে তো? না, প্রবেশে বাধা নেই। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমিও ভিতরে ঢুকে পড়লাম। বিরাট হলঘর। মনে হয় অতি প্রাচীন। জনাকয়েক সার্জেন্ট সন্তর্পণে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

দরজা থেকে অনেক দূরে বিচারকের আসন। মস্ত বড়ো এক পুরনো আমলের চেয়ারে তাঁকে দেখা যাচ্ছে। তাঁর পোশাক অন্য জজদের মতো কালো নয়, টকটকে লাল। পাশেই লম্বা সারিতে জুরিদের আসনে আট-ন’জন চোখে চশমা গম্ভীর-মুখ ভদ্রলোক।

দূরে একটা বিরাট কাঠের খাঁচার ভিতর ঝাঁকড়া চুল আর গালভর্তি দাড়ি সমেত একটা লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। দর্শকরা তার দিকে এমনভাবে চেয়ে দেখছে, যেন চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দী সুন্দরবন থেকে নতুন আনা বাঘ—দেখবার মজা খুব থাকলেও খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসার ভয়ও আছে। তা ইচ্ছে করলে এ-লোকটা খাঁচা ভেঙে ফেলতে পারে, যেরকম দৈত্যের মতো চেহারা।

জজসায়েবের রক্তরাঙা পোশাকে মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা জ্বলজ্বল করছে। ঘরটার কোণে-কোণে অন্ধকার জড়ো হয়ে রয়েছে। সকাল দশটা না সন্ধ্যা ছ’টা বোঝা দায়। গাটা ছমছম করতে থাকে।

একজন সাক্ষী কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। ডাক্তারী কথা, সব বোঝা যায় না—রিগর মর্টিস, থোরাক্স। কালো গাউনপরা প্রশ্নকর্তাও যেন ডাক্তারী শাস্ত্রে পণ্ডিত, অবলীলাক্রমে ডাক্তারকে চ্যালেঞ্জ করছেন।

গলাবন্ধ কোট পরে এক ভদ্রলোক আমার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনিই জগদীশবাবু, তখন জানতাম না। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আসামী কে?”

ভদ্রলোক ফিসফিস করে বললেন, “কার্তার সিং। বাস ড্রাইভার কার্তার সিং বালীগঞ্জে রাত বারোটায় জোড়া-খুনের দায়ে ধরা পড়ে। বেটারা জানের মায়া করে না। কোনো উকিল দেয়নি মশাই। শেষপর্যন্ত কোর্ট থেকে আমার সাহেবকে কেসটা করতে বলায় উনি ডিফেণ্ড করছেন।”

“ওর কে কে আছে? আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এখানে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“কে জানে মশাই, বেটার সাতকুলে কেউ আছে মনে হয় না। বেটারা সেই ভোরে বাস চালাতে আরম্ভ করে, আর রাত এগারোটা পর্যন্ত ছুটি নেই। মধ্যিখানে শুধু দু’বার পেটপুরে মাংস রুটি টেনে নেয়। বাসই ওদের ঘরবাড়ি, রাত্রেও বাসেই ঘুমোয়।”

“কেস্ কেমন মনে হচ্ছে?”

“আমি কি মশাই গণৎকার? কার্তার সিং তো হাজতে আমার সাহেবকে বলেছে ওকে মিথ্যে করে মামলায় জড়িয়েছে। এ-সব মামলায় তো তদ্বিরই সব সাক্ষীসাবুদ কে যোগাড় করবে?”

প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। বার-লাইব্রেরী থেকে বই নিতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। আর দেরি করা যায় না, সায়েব চেম্বারে অপেক্ষা করছেন। চলে আসতে হলো। কিন্তু ফিরেও কার্তার সিং-এর ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া চুল ও লাল চোখকে ভুলতে পারলাম না। পৌনে চারটের সময়ে বার-লাইব্রেরীতে বই ফেরত দেবার অছিলায় দশ নম্বর কোর্টে আবার গেলাম। দরজা ভেজানো ছিল, ভিতরে ঢুকে দেখি জনমানবশূন্য। জজসায়েব, জুরি, উকিলবাবু কেউ নেই। কার্তার সিং-এর খাঁচাও খালি, কেবল গোটাকয়েক পায়রা বেআইনীভাবে ভিতরে প্রবেশ করে ঝটাপটি করছে। কোনো ভয় বা সম্ভ্রমবোধ নেই তাদের। জজসায়েবের চেয়ারে বসে বকুম-বকুম শব্দ করে, আবার কার্তার সিং-এর খাঁচার উপর ভারিক্কী, চালে এসে বসছে। চারটের আগে কেস বন্ধ হলো কি করে, বুঝতে পারলাম না।

জিজ্ঞাসা করার মতো কাউকে না পেয়ে বেরিয়ে আসছিলাম। এমন সময় গলাবন্ধ কোট-পরা ভদ্রলোকটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। “ভালোই হলো, আপনাকে খুঁজছিলাম। চারটের আগেই কোর্ট বন্ধ হয়ে গেল কেন?” আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম।

“কেস্ তো শেষ হয়ে গিয়েছে। কার্তার সিং-এর পনেরো বছর জেল।”

বোকার মতো আমি জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিলাম, “আপনার সাহেব কার্তার সিংকে বাঁচাতে পারলেন না?” তিনি হেসে ফেললেন, “বাঁচাবার মালিক কি আমরা? সব ওই ওপরের ভদ্রলোকের খেলা”—তিনি আঙুলটা এমনভাবে উপরের দিকে তুললেন যে, মাথার ছাদ ফুঁড়ে আকাশের ওধারে যিনি থাকেন তার কথা হচ্ছে বুঝতে পারলাম। আঙুল নামিয়ে আমাকে প্রায় আটমিনিট ধরে খুঁটিয়ে দেখলেন তিনি। “ক্রিমিন্যাল কেসে আপনার খুব আগ্রহ দেখছি। সকালে এসেছিলেন, আবার এ-বেলায় এলেন। আমার নাম জগদীশ বোস, তবে স্যার জগদীশ নই।” জগদীশবাবু উচ্চঃস্বরে হেসে উঠলেন। হাসির ঝড় শান্ত হলে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার নাম কি? কোথায় কাজ করেন?”

নাম-ধাম পরিচয় দিতেই তিনি আমার হাতটা চেপে ধরলেন, “আরে তাই নাকি? আপনার সায়েবের সঙ্গে আমার সায়েবের যে খুব ভাব। আমাদের আসল বন্ধুত্ব তাহলে অনেকদিনই হয়ে আছে, শুধু পরিচয় হয়ে ওঠেনি, এই যা।” জগদীশবাবু আবার হা-হা করে হেসে উঠলেন।

সেই থেকে আলাপ।

জগদীশবাবু বলেছিলেন, “সময় পেলে আসবেন মশায়।”

সময় পেলেই ছুটে যেতাম তাঁর কাছে। হাইকোর্টের সঙ্গে জগদীশবাবুর অনেকদিনের পরিচয়। বিশেষ করে দশ নম্বর কোর্টের নাড়ীনক্ষত্র তাঁর জানা। তিনি একদিন বলেছিলেন, “দেখুন, এই দশ নম্বরে টাকা-কড়ির সম্বন্ধ নেই। দশ হাজার কিংবা কুড়ি হাজার টাকার ডিক্রি নয়। আট, দশ কিংবা চোদ্দ বছরের জেল তো মশাই হামেশা হচ্ছে। কখনো আবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।”

জগদীশবাবু অবিচলভাবে বলেছিলেন, “ওইখানে থামলেও বা কথা ছিল। কখনও…নাঃ, থাক।”

“কেন বলুন না, বেশ হচ্ছিলো তো।”

“না থাক। সে-সব শুনিয়ে ছোটোছেলের মন খারাপ করিয়ে দিতে চাই না।” তিনি সস্নেহে আমার দিকে তাকালেন, “সর্বনাশা ঘর এটা। কত লোককে ভয় পাইয়ে দেয় ঠিক নেই। এই যে আমি, আজ না হয় সয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রথম যখন এসেছিলাম?” কথা থামিয়ে পকেট থেকে পান বার করলেন, আমাকেও একটা দিলেন।

আবার আরম্ভ করলেন, “রাত্রে ঘুমের ঘোরে চমকে উঠতাম। ভয় লাগতো। চোর-ডাকাত, খুন-খারাপি যতো সব রোমহর্ষক ব্যাপার। অথচ এই খাঁচায় ঢুকলেই আসামীগুলো নেতিয়ে পড়ে। মনটা একেবারে ঝিমিয়ে পড়তো। কিন্তু ওই যা বলছিলাম, সব সাময়িক। ক্রমশ সব সয়ে যায়, আপনারও যাবে।” জগদীশবাবু আমাকে আশ্বাস দিলেন।

“যতো পারেন দেখে যান”, জগদীশবাবু আর একদিন বলেছিলেন। “শুধু দেখে যান। আজকাল কেও অনেক বেড়েছে। কলকাতা শহরে ফৌজদারী মামলা অনেক হচ্ছে। আর কত রকমের মামলা! কত বিভিন্ন পদ্ধতিতে খুন! বুঝলেন মশায়, নেহাত গোবেচারা লোকগুলোই আজকাল দা কিংবা তলোয়ার দিয়ে খুন করে। এখন সব বৈজ্ঞানিক উপায়ে কাজ। খুন-জখম, নোটজাল থেকে পকেটমার পর্যন্ত সব সায়েন্সের ব্যাপার, ধরা শক্ত। কিন্তু ধরা পড়লেই পুলিশ কোর্ট এবং তাঁরা বাছাই করে কিছু এখানে পাঠিয়ে দেন। একদিন সকালের দিকে আসবেন কোর্ট বসার আগে, গোড়া থেকেই একটা কেস্ দেখলে ভালো লাগবে।

ঠিক দশটায় দশ নম্বরে একদিন গিয়েছিলাম। তখন বিশেষ কেউ আসেনি। টেবিল চেয়ার সব খালি, নাটক আরম্ভ হবার আগে রঙ্গমঞ্চ যেমন দেখায়। বেলা সাড়ে-দশটায় কয়েকজন পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকলেন। নিচে রাস্তায় তাঁদের কালো রঙের বিরাট গাড়িটা গর্জন করে খানিকটা ধোঁয়া ত্যাগ করে থেমে গিয়েছে। কোটপরা দু-একজন কর্মচারীও হন্তদন্ত হয়ে এসে নিজেদের কাজ আরম্ভ করলেন। কয়েকজন ভদ্রলোক উকিলদের জন্য রক্ষিত চেয়ারগুলো দখল করে বসলেন। একটা বন্ধ দরজা হঠাৎ খুলে গেল। সারি বেঁধে কারা যেন আসছেন। সামনের লোকটির হাতে ন্যায়দণ্ড। পিছনে লাল পোশাকে জজসায়েব। তাঁর পেছনে আর একজন। জগদীশবাবু বলে দিলেন সামনের লোকটি শেরিফ। জজসাহেবের পাশে তাঁরাও আসন গ্রহণ করলেন। এমন সময় এক ভদ্রলোকের তারস্বর চারিদিকের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো—ইয়া ইয়া ইয়া, অল পার্সনস্ দোজ হ্যাভ্ এনিথিং টু ডু উইথ মাই লর্ড দি জাস্টিস প্রিজাইডিং ওভার দীজ সেশনস্ কাম নিয়ার এণ্ড গিভ ইউর অ্যাটেনশন। ঘোষকের কণ্ঠস্বর এক অশ্রুতপূর্ব শব্দঝঙ্কারের সৃষ্টি করে। তোমরা এসো। কাছে এসো। মাই লর্ড দি জাস্টিস দোষীদের দণ্ডবিধান করবেন, তোমরা এসো।

খাঁচার মধ্যে একজনকে এতোক্ষণে দেখতে পাওয়া গেল। একে একে ন’জন জুরি শপথ গ্রহণ করে তাঁদের নির্দিষ্ট আসনে বসলেন। তাঁরা বাইরের লোক— কেউ আপিসের কেরাণী, কেউ স্কুল-মাস্টার, কেউ বা অধ্যাপক। সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে তাঁরাই বিচার করবেন আসামী দোষী অথবা নির্দোষ। মামলা আরম্ভ হতেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, চেম্বারে ফিরতে হবে।

জগদীশবাবু বলে দিলেন, “আবার আসবেন মশায়।”

.

তারপর অনেকদিন কেটে গিয়েছে। জগদীশবাবু আমাকে মশায়’ বলা ছেড়ে দিয়েছেন। সম্বোধনটা আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে শ্রীমানে পর্যবসিত হয়েছে। জগদীশবাবুর সাহেব, মিস্টার রায় আসামী পক্ষ ছেড়ে সরকারী প্রসিকিউটরের কাজ নিয়েছেন। যে লোক আগে আইনের হাত থেকে আসামীকে ছিনিয়ে আনতেন, তিনিই আজ তাকে দোষী প্রমাণ করেন। মিস্টার রায়কে বহুবার কোর্টে দেখেছি। আমাকে দেখলেই মৃদু হেসে চোখটা টিপে যেতেন তিনি। পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকবছর। টাক আর চুল নিজেদের মধ্যে আপসে ভাগ বাঁটোয়ারা করে মাথাটা পার্টিশন করে নিয়েছে।

জগদীশবাবু কিন্তু একটুও পাল্টাননি। “এই যে শ্রীমান, অনেকদিন আসা হয় না কেন? চলো, একটু চা খেয়ে আসা যাক।” তাঁর সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি। একদিন অভিমান করে বললাম, “আমিই শুধু আপনার কাছে আসি। আপনি তো একবারও টেম্পল চেম্বারে আসেন না।”

“ছেলে বটে, সবকিছু হিসেব করে রেখেছে। আচ্ছা যাবো।” জগদীশবাবু হেসে বললেন।

কথা রাখতে টেম্পল চেম্বারে তিনি সত্যি একদিন এলেন। আমার আনন্দের সীমা নেই। সায়েব ভিতরে ছিলেন। তিনি হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। “আজ যেন খুব খুশি মনে হচ্ছে।”

“অনেক কষ্টে আজ এঁকে আনতে পেরেছি।” জগদীশবাবুর পরিচয় দিলাম সঙ্গে-সঙ্গে।

কেমন আছে পি. কে?” সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন। “আমরা অনেকদিনের বন্ধু। দশ নম্বরে দু’জনে একসঙ্গে অনেক কেস করেছি।” জগদীশবাবুর সঙ্গে তিনি বহু কথা বললেন।

“পাবলিক প্রসিকিউটরের মুহুরী হতে কেমন লাগছে জগদীশবাবু?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

গম্ভীর হয়ে উঠলেন তিনি। “বেশ ছিলাম আগে। এখন খাতির বেড়েছে, কিন্তু শান্তি অনেক কমেছে। ভালো লাগছে না।” কিন্তু কেন তা বললেন না, আমারও জিজ্ঞাসা করতে সাহস হলো না।

জগদীশবাবুর খোঁজে কিছুদিন পরে দশ নম্বরে আবার গিয়েছি। এবার খাঁচার মধ্যে বছর পঁয়তাল্লিশের একটা শীর্ণ লোক। লোকটা বাঁ-হাতে নিজের চোখ দুটো ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“বুড়োবয়সে ভীমরতি, নচ্ছার,” জগদীশবাবু বলছিলেন।

“কী কেস্?”

“থ্রি-সেভেনটি-এইট।”

“সে আবার কি? এতোদিন তো শুধু ফোর-টোয়েন্টি জানতাম।”

“থাক্ আর জেনে দরকার নেই।” তারপর নিজের মনে জগদীশবাবু বললেন, “আহা, নিষ্পাপ, অবোধ মেয়েটা।”

লোকটা তখনও মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে বেঞ্চিতে আট-দশ বছরের মেয়ে কোলে করে এক পশ্চিমা ভদ্রমহিলা। পাশে আর একজন মহিলা। ঘোমটায় সব ঢাকা, ঠিক যেন কলা বৌ। বয়স কত, বাঙালী না পশ্চিমা, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। পরনের শাড়ি ময়লা হলেও লাল পাড়টা জ্বলজ্বল করছে। দশ নম্বর কোর্টে কেমন থমথমে ভাব।

জুরিরা নিশ্চয় তাঁদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন। কেননা, জজসায়েব খাঁচার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “প্রিজনার অ্যাট দি বার, তুমি জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত…..জুরিরা একবাক্যে তোমাকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন…. সৌভাগ্যের বিষয় সমাজে তোমার মতো চরিত্র বেশি নেই। দশবছর সশ্রম কারাদন্ড ….।”

কিন্তু বিচারকের কণ্ঠস্বর কার কান্নার মধ্যে ডুবে গেল। চমকে ঘাড় ফেরালাম। ঘোমটার ভিতর থেকে সেই মহিলা ডুকরে কাঁদছেন। আসামী তখনও মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা পোশাকে দু’জন সার্জেন্ট তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। অবগুণ্ঠিতা মহিলাটি অশ্রু সংবরণের ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আসামীও অন্য দরজা দিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এডভোকেটের কালো গাউনটা হাতে জড়াতে জড়াতে মিস্টার রায় চেয়ার ছেড়ে উঠতেই, জগদীশবাবু তাঁর হাত থেকে ব্রীফটা নিয়ে নিলেন। দশ নম্বর ঘরের অন্যতম নায়ক মিস্টার রায়ের নিষ্ক্রমন-পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উদাস নয়নে পুরু লেন্সের চশমার ভিতর দিয়ে তিনি যখন শিশুর মতো চেয়ে থাকেন, তখন কে বলবে ইনি ক্রিমিন্যাল বারের মুকুটমণি। তার হাত থেকে আসামীর নিষ্কৃতি স্বপ্নের ব্যাপার। নিপুণভাবে জাল পেতে তিনি ধীরে-ধীরে গুটিয়ে আনেন। অকাট্য যুক্তিতে জুরিদের সামনে আসামীদের অপরাধগুলো তুলে ধরেন— সোনা চোর……ডাকাত….. ব্যাঙ্ক লুটের সর্দার, জালিয়াত। আমি আর তাঁকে ক’বার দেখেছি! দেখেছেন জগদীশবাবু, আর দেখেছে ওই সাদা পোশাকের কটা-চোখ এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সার্জেন্ট। সে জানে, খাঁচার ভিতর থেকে আসামী কেমন সত্রাসে মিস্টার রায়ের দিকে চেয়ে থাকে। সে জানে, মিস্টার রায়ের কেসে কতবার তাকে খাঁচা খুলে বলতে হয়েছে, তুমি মুক্ত; আর কতবার তাকে ধীরে ধীরে রিভলবার বেল্টের সামান্য স্পর্শ অনুভব করিয়ে আসামীকে ঘিরে দরজার দিকে যেতে হয়েছে।

“এ-সপ্তাহে একটা আসামীও খালাস পায়নি। প্রত্যেকটা কেসে সাকসেস। পিঠে চাপড়-বসিয়ে জগদীশবাবু বললেন, “চলো, একটু চা খেয়ে আসা যাক।”

দু’হাতে পয়সা রোজগার করছেন জগদীশবাবু। তবু সারাক্ষণ শুকনো মুখে বসে থাকেন। সর্বদা যেন কিছু চিন্তা করছেন। তিনি বিয়ে-থা করেননি সুতরাং সংসারের ঝামেলা নেই। রামজী হাজরা লেনে তাঁর পৈতৃক বাড়িতে অন্য ভাইদের সঙ্গে থাকেন। তাঁর ভাইপো’র অন্নপ্রাশনে সেখানে নেমতন্ন খেয়ে এসেছি। বাড়ির অবস্থা বেশ ভালোই।

“এখন অনেক কাজকর্ম। তাই রায় সাহেবের বাড়িতেই থাকছি। মাঝে মাঝে বাড়ি যাই।” জগদীশবাবু বললেন।

“কিন্তু সবসময় কী এতো চিন্তা করেন?”

তিনি হাসলেন, “আগে বেশ ছিলাম। এখন মোটে ভালো লাগে না। সাহেব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছেন। আমি বলে রাখলাম, উনি বেশিদিন বাঁচবেন না। আমি

বুঝে উঠতে পারছিনা।” জগদীশবাবু মাথাটা নাড়লেন।

“আমরা তো বাইরে থেকে কিছু বুঝি না,” আমি বললাম।

“ভিতর থেকে আমি ঠিক বুঝি,” তিনি উদাসভাবে উত্তর দিলেন। “অন্য কিছুতে গোলমাল নেই। যতো নষ্টের গোড়া এই মার্ডার কেস। ওঁর মাথা ঠিক থাকে না। রাত্রে ঘুম নেই। মাঝরাত পর্যন্ত বাড়ির বারান্দায় পায়চারি করেন। কেউ কাছে গেলে তেড়ে মারতে আসেন। পাতে ভাত পড়ে থাকে, খেতে পারেন না। না ঘুমিয়ে চোখগুলো লাল হয়ে থাকে। এমন করলে লোক বাঁচে? কিন্তু কেন এমন হয়?” জগদীশবাবু বুঝতে পারেন না। “মন্ত্র-শক্তি? উঁহু। কিন্তু জোর করে বলতে পারি না, হলেও হতে পারে।”

তাঁকে বোঝালাম, “আপনি অযথা ভাবছেন। আসলে হয়তো কিছুই নয়।”

আমার প্রবোধবাক্যে যে কিছু ফল হয়নি, মাসখানেক পরে জগদীশবাবুর চেহারা দেখে বুঝলাম। মুখটা আরও শুকিয়ে গিয়েছে, চোখের কোণে কালি পড়েছে। আমাকে দেখেই তিনি চায়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “ভালো লক্ষণ নয়। আমার মাথা ঘুলিয়ে উঠছে।” জগদীশবাবুকে কখনো এতো উতলা দেখিনি। “কাউকে বলো না, তোমাকে গোপনে বলছি।” জগদীশবাবু বলতে লাগলেন।—

“সেদিন তখন সন্ধ্যে সাতটা হবে, রায় সাহেব বই পড়ছেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। এমন সময় বাইরের দরজা ঠেলে একটা মেয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে পড়লো। ঘোমটায় কিছুই দেখা যায় না। একবার শুধু নাকে রূপোর নথটা দেখতে পেলাম। বাইরে রিক্শা দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির জলে ভিজে মেয়েটির কাপড় দেহের সঙ্গে লেপটে রয়েছে। আচমকা সে সাহেবের পা জড়িয়ে ধরলো। “আপনাকে বাঁচাতেই হবে।” তিনি কোনোরকমে পা ছাড়িয়ে নিলেন। “আমার স্বামী খুনের আসামী।”

“জগদীশ।” রাগে রায় সায়েবের গলা কাঁপছে। “এখনই, এই-মুহূর্তে চলে যেতে বলো।” তাঁর চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে।

“অত্যন্ত বে-আইনী কাজ করতে এসেছেন, এখনি চলে যান,” আমি বললাম।

মেয়েটি তবুও নড়লো না, বলতে লাগলো, “আপনার দয়ায় আমার সংসার রক্ষে পাবে……”

দাঁতে দাঁত চেপে রায় সাহেব আমাকে ডাকলেন, “জগদীশ।”

মেয়েটি চমকে উঠে এক পা পিছিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত দো’মনার পর সে আবার এগিয়ে গেল, রায় সাহেবের দিকে। কিন্তু সভয়ে আবার দরজার কাছে সরে এল সে। ঘোমটার ভিতর থেকে সরু গলায় বললে, “বাইরে যে বৃষ্টি পড়ছে!”

“তবু যেতে হবে এবং এখনই।” আমার আগে রায় সাহেব বলে দিলেন।

মেয়েটা বেরিয়ে গেল। বৃষ্টি পড়ছে আরও জোরে। বিদুৎ চমকাচ্ছে মাঝে- মাঝে। প্রচণ্ড শব্দে কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়লো। হঠাৎ রায় সাহেব চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে পড়লেন। “জগদীশ, মেয়েটাকে ডাকো।”

কোথায় ডাকবো স্যার? সে অনেকক্ষণ চলে গিয়েছে।”

“না-না,ওসব জানি না। এখনি ডাকো। কেন তাকে যেতে দিলে?”

“আপনিই তো বললেন।”

কিন্তু রায় সাহেব শুনলেন না। তখন বৃষ্টির মধ্যে খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। হেডলাইটে অন্ধকারের বুক চিরে একটা মোটর হুস করে বেরিয়ে গেল।

মিনিট দশেক জলে ভিজে যখন ফিরলাম, তিনি তখন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। “তাঁকে খুঁজে পেলাম না স্যার।” চোখ বন্ধ করে তিনি বললেন, “বেশ, ভালো কথা। কিন্তু কেন খুঁজে পেলে না?” আমি আরও ভয় পেলাম। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কোনো উত্তর মনে আসছে না।

হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলেন রায় সাহেব। হা-হা করে হাসতে লাগলেন তিনি। “কি আবোল-তাবোল বকছিলাম! একেবারে ভিজে নেয়ে গিয়েছো। এখনি জামা-কাপড় ছেড়ে এসো, নইলে অসুখ বাধিয়ে বসবে।”

জগদীশবাবু দুঃখের সঙ্গে বললেন, “এমন লোকের সঙ্গে কাজ করা ঝকমারি। অন্য সময় কোনো গোলমাল নেই। কিন্তু মার্ডার কেসে সব উল্টে যায়। সমস্ত রাত ধরে কেস্ তৈরি করবেন। অথচ ভোর পাঁচটায় ওঠা চাই। সাড়ে-পাঁচটায় ঘোড়ার গাড়িতে কাশী মিত্তিরের ঘাট। আমিও সঙ্গে যাই। স্নান করে কপালে চন্দন তিলক কেটে বাড়ি ফিরেই উনি পুজোতে বসবেন—পাক্কা একঘণ্টা গৃহদেবতা রাধাগোবিন্দ জিউ-এর সেবা।

“এসব লোকের এ-লাইনে আসা উচিত হয়নি।” জগদীশবাবু নিজের মনে বললেন।

.

আবার দশ নম্বরে গিয়েছি।

এবার খাঁচায় জালিয়াত গণপতি চাটুজ্যে। দশটাকার নোটের ছাপাখানা খুলেছে বাড়িতে। গণপতির পক্ষে বড়ো এড্‌ভোকেট রায় সাহেবের সঙ্গে জোর যুদ্ধ চালাচ্ছেন। আর খাঁচায় বাবরি চুলওয়ালা, রোগা, কুঁজো গণপতি চাটুজ্যে ঝিমুচ্ছে।

মামলায় ফল কী হবে, আন্দাজ করতে ইচ্ছে হয়। গণপতি চাটুজ্যে হয়তো জালিয়াত নয়, খালাস পেয়ে যাবে। কিংবা দশটি বৎসর শ্রীঘর। কেউ বলতে পারে না, কী হবে। জগদীশবাবু থাকলে আমরা ভাগ্য-পরীক্ষা করতাম। দুটো আঙুল কপালে ঠেকিয়ে এনে আমার মুখের সামনে ধরতেন। আমি একটা আঙুল ধরতাম। উনি বলতেন, “নাঃ, বেটা এ-যাত্রা ফক্কা।” জগদীশবাবু কোর্টে নেই।

বেরিয়ে এলাম। উটের মতো লম্বা ও রোগা গণপতি চাটুজ্যে খাঁচায় দাঁড়িয়ে রইলো।

.

“ক্রিকেট খেলার মতো গ্লোরিয়স আনসার্টেণ্টি। অনিশ্চয়তা।” সায়েব আমাকে একবার বলেছিলেন, “জুরিরা কি মত দেবেন বলা যায় না। কতবার সুফল আশা করে নিরাশ হয়েছি। আবার কখনও ঠিক উল্টো।”

তিনি একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন —

“ঐ দশ নম্বর ঘরে অনেক দিন আগে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। এখানকার এক হাসপাতালের দু’জন ঝাড়ুদার আসামী। নরহত্যার অভিযোগ

দু’পক্ষের মামলা-শেষে জজ জুরিদের দিকে চেয়ারটা সামান্য ঘুরিয়ে নিলেন। একঘণ্টা পরে সমগ্র মামলার বিশ্লেষণ যখন শেষ হলো, তখন সহজেই ফলাফল আন্দাজ করতে পারলাম। নিশ্চিত পরাজয়। নিজেদের মধ্যে আলোচনার জন্য জুরিরা ভিতরে চলে গেলেন। সারাদিন পরিশ্রমে মন অবসাদে পূর্ণ। হাসপাতালের একদল ঝাড়ুদার কোর্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারাই চাঁদা তুলে মামলার খরচ চালাচ্ছে। কিন্তু কোনো আশা নেই। আমি বেরিয়ে এলাম।

শীতের অকাল সন্ধ্যা গাঢ়ভাবে নেমে এসেছে। হাইকোর্টের কোথাও লোকজন নেই। ক্লান্তিতে দেহ আর চলতে চায় না। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ওল্ড পোস্ট আপিস স্ট্রীটও প্রায় জনমানবশূন্য। অনিচ্ছুক দেহটা টানতে-টানতে কোনোরকমে টেম্পল চেম্বারের লিফটে এসে দাঁড়ালাম।

চেম্বার বন্ধ। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে সুইচ হাতড়াতে লাগলাম। শেষপর্যন্ত আলোটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠলো। গাউনটা টেবিলেই পড়ে রইলো। তারপর সমস্তদিনের ঘনীভূত ক্লান্তিতে টেবিলে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, বুঝতে পারিনি। আচমকা ঘুমে ব্যাঘাত পড়লো। টেম্পল চেম্বারে ধুপ-ধাপ শব্দ হচ্ছে। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কারা যেন উন্মাদ বেগে উঠে আসছে। ক্রমশঃ শব্দ আরও কাছে এগিয়ে আসছে। অজানা আশঙ্কায় মনটা ভরে উঠলো। ড্রয়ার থেকে রিভলবার বার করবো কিনা ভাবছি। ধুপ-ধাপ, দুদ্দাড় শব্দ প্ৰায় উপরে এসে গিয়েছে। একদল লোক বন্যাজলের মতো আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে। ঢুকতে বারণ করলাম, কেউ শুনলো না। হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমার পায়ের ধুলো তারা মাথায় ঠেকাচ্ছে। ‘আমরা দু’জন ছাড়া পেয়েছি।’ একজন ঝাড়ুদার হিন্দিতে বললো।

আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। জুরিরা অপ্রত্যাশিতভাবে আসামীদের মুক্তি দিয়েছেন।”

এ-গল্প জগদীশবাবুকে বলেছি।

“আমিও দেখেছি অনেকবার। জীবন ও মৃত্যু কখনও-কখনও একটা সরু সুতোর উপর ঝুলে থাকে,” জগদীশবাবু বলেছিলেন।

লোভ সামলাতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করে বসলাম, “আচ্ছা, কতবার মৃত্যুদণ্ড দিতে শুনেছেন আপনি?”

“সে কি আর গুণে রেখেছি ভাই?” জগদীশবাবু মনে-মনে হিসেব করতে লাগলেন। “ঠিক বলতে পারছি না। কিন্তু অনেকবার হবে।”

“চলো, চা খেয়ে আসি।” তিনি বললেন।

“একটু পরে খাওয়া যাবে, এখন গল্প হোক।”

“তবে একটা পান খাই।” পান চিবোতে লাগলেন জগদীশবাবু। হঠাৎ পান চিবোনো থেমে গেল। আবার আরম্ভ হলো একটু পরে, যেন কিছু ভাবছিলেন।

“তুমি তো রাজ্যের খবর রাখো, হয়তো বলতে পারবে। এই ফাঁসির হুকুম হবার পর আসামীদের কোথায় নিয়ে যায়, মাঝে-মাঝে জানতে ইচ্ছা হয়। তুমি কিছু জানো?”

আমি কিছুই জানতাম না। জগদীশবাবুর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি।

কিন্তু অনেকদিন পরে জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম। জানতে পেরে প্রথমেই জগদীশবাবুর কথা মনে পড়েছিল। কিন্তু তখন কোথায় জগদীশবাবু? আচ্ছা, ঘটনাটা আগে বলে নিই, তারপর সে-কথায় আসা যাবে।

টেম্পল চেম্বারে একটা পোস্টকার্ড এসেছিল, ইংরেজিতে লেখা :-

আলীপুর সেন্ট্রাল জেল

ডিয়ার মিঃ-

আমি ফাঁসীর আসামী। আপনি দয়া করিয়া অন্তত একবার দেখা করিতে আসিবেন। আপনার জন্য আমি পথের দিকে তাকাইয়া থাকিব। আসা চাই-ই। ইতি—

রাম সিং।

চিঠিটা পড়ে সায়েব আলীপুরে ফোন করলেন। বললেন, “আমরা লাঞ্চের পরই সেন্ট্রাল জেলে যাবো।”

আলীপুর জেলের গেটের সামনে আমরা যখন গাড়ি থেকে নামলাম, তখন প্রায় দুটো। সায়েবকে অভিবাদন জানিয়ে দ্বাররক্ষী সার্জেন্ট লৌহ-কপাট উন্মুক্ত করলো। একটা বড়ো খাতায় আমাদের নাম ও ঠিকানা লিখতে হলো।

“আপনি কি এখনই দেখা করতে চান?” সার্জেন্ট জিজ্ঞাসা করলেন।

“হ্যাঁ, তাহলে ভালো হয়।”

সার্জেন্টের সঙ্গে আমরা চললাম। সামনে আর একটি বিশাল লৌহ-কপাট। এবার আসল রাজ্য। অনেকগুলি লোক খালি গায়ে কাজ করছে। কেউ মাটি কোপাচ্ছে, কেউ ডাল ভাঙছে। অনেকে কাজ বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমরা সার্জেন্টকে অনুসরণ করে আরও এগিয়ে চললাম। দু’পাশে লাল রঙের ছোটোছোটো বাড়ি। প্রতি বাড়ির সামনে সশস্ত্র প্রহরী। শেষ পর্যন্ত একটি বাড়ির সামনের শাস্ত্রী সার্জেন্টকে স্যালুট জানালো। সার্জেন্ট থমকে দাঁড়ালো। বাইরে লেখা – Condemned Ward.

আমরা ভিতরে ঢুকে পড়লাম। স্বল্পপরিসর দুটি ঘর। প্রথমটি ফাঁকা, কেউ নেই। অন্যটিতে এক দীর্ঘ দেহ পশ্চিমা পায়চারি করছে। কাঁধে পৈতে, পরনে সাদা রঙের টার্কিস তোয়ালে। আমার বুকের ভিতর কেমন ঢিপ্-টিপ্ করতে লাগলো।

“রাম সিং তুমি যাঁকে চিঠি লিখেছিলে তিনি এসেছেন”, সার্জেণ্ট বললেন।

রাম সিং তাড়াতাড়ি বন্ধ গেটের রেলিঙের সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘরের বাইরে একটি কুঁজো। হাত বাড়িয়ে জল গড়িয়ে নেওয়া যায়।

“আমাকে আপনি এবারের মতো খালাস করে দিন। আর কখনো করবো না।” রাম সিং হিন্দিতে এমনভাবে বলতে লাগলো যেন সায়ের ইচ্ছা করলে এখনই দরজা খুলে তাকে মুক্তি দিতে পারেন। ভাঁটার মতো লাল লাল দুটো চোখ নিয়ে রাম সিং আমাকে বললে, “আমি ইংরিজি জানি না। সায়েবকে দয়া করে একটু বুঝিয়ে বলুন।”

জেলের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সায়েব তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিসের কেস?”

এক সঙ্গে তিনটে খুন। বড়বাজারে এক ধনী ব্যবসায়ীর বাড়িতে দারোয়ান ছিল রাম সিং। দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে মালিক গিয়েছিলেন পাটনায়। একদিন গভীর রাতে রাম সিং মালিকের স্ত্রীর শোবার ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে অন্য তিনজন কর্মচারীর কাছে ধরা পড়ে যায়। “কি হচ্ছিলো ওই ঘরে? আমরা সব বুঝতে পেরেছি। গত রাতেও তোমাকে ওই ঘর থেকে বেরোতে দেখেছি। দাঁড়াও, বাবু ফিরে আসুক।” পরদিন সকালে ঐ তিনজন কর্মচারীর মুণ্ডু ও ধড় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। রাম সিং ফেরার। তিন মাস পরে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের হাতে রাম সিং ধরা পড়লো।

দশ নম্বর কোর্টে বিচার ও মৃত্যুদণ্ড।

অফিসারটি বললেন, “কাগজপত্র আপিসে আছে দেখতে পারেন।”

রাম সিং আবার হিন্দিতে বললে, “আমাকে এবারের মতো বাঁচিয়ে দিন। আমার আড়াইশ’ টাকা দেশে আছে। লিখলেই পাঠিয়ে দেবে।”

সায়েবের প্রশ্নে অফিসারটি আরও বললেন, রাম সিং-এর আপীলও নাকচ হয়েছে। এমন কি করুণাভিক্ষার আবেদনেও ফল হয়নি।

রাম সিংকে সায়েব জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, তোমাকে আমার কাছে চিঠি লিখতে কে বলেছে?”

“মেজরসাব্ বোলা।”

মেজরসাব! Who is this Major he is referring to?”

সার্জেণ্ট বললে, “মেজর রোশনলাল, ঐ পাশের ঘরটাতে ছিলেন।”

সঙ্গে সঙ্গে মেজর রোশনলালের কথা মনে পড়ে গেল। খবরের কাগজে তাঁর চাঞ্চল্যকর মামলার রিপোর্ট রোজ পড়েছি।

যুদ্ধফেরত ইয়ার-নোজ-থ্রোটের ডাক্তার মেজর রোশনলাল। দু’তিনটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। শেষে লেকের জলে মৃতদেহের কিছু অংশ ফেলতে গিয়ে যিনি ধরা পড়ে গেলেন।

“হ্যাঁ, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সেই মেজর রোশনলালই ও ঘরটাতে ছিলেন। পরশু তার ফাঁসি হয়ে গিয়েছে।” সার্জেন্ট বলছিল।

“অদ্ভুত নার্ভের লোক মেজর রোশনলাল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভেঙে পড়েননি। কিন্তু ফাঁসির মঞ্চে উঠে রোশনলাল দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন, you know I am a Hindu। আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি। আমার মৃত্যুর জন্যে যারা দায়ী, তাদের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য লক্ষ-লক্ষবার আমি এই পৃথিবীতে ফিরে আসবো।”

পাশের ঘরটার দিকে আবার চাইলাম। সেটা সত্যি-সত্যি খালি।

“মেজরসাব্ বলে গিয়েছেন আপনাকে চিঠি লিখতে।” রাম সিং আবার বললে।

আমার অনভ্যস্ত হৃৎপিণ্ডটা দ্রুতগতিতে বাজনা বাজাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।

রাম সিং-এর দিকে শেষবারের মতো চেয়ে সায়েব বললেন, “আমি সত্যি দুঃখিত। কিন্তু আর কিছু করবার নেই।”

আমরা বেরিয়ে আসতে-আসতে শুনলাম রাম সিং তখনও বলছে, “কিন্তু এবারের মতো আমাকে বাঁচিয়ে দিন আর কখনো করবো না।”

জগদীশবাবু এ-গল্প শুনলে আনন্দিত হতেন। পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলতেন, “বা, কত খবর যে তুমি যোগাড় করতে পারো!” তারপরেই বলতেন, “চলো, চা খেয়ে আসি। পাঞ্জাবীর দোকানের দুটো সিঙাড়া একস্ট্রা।”

কিন্তু এ-গল্প জগদীশবাবুকে বলা হয়নি। সেন্ট্রাল জেলে যাবার অনেক আগে ট্রামের চাকায় দুটি পা হারিয়ে মেডিক্যাল কলেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

সে-আলোচনা থাক। লিখতে গেলেই চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। কাগজপত্র দূরে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ব্যারিস্টারের বাবুর ধাতে সাহিত্য সহ্য হবে না। গরীবের কেন আবার এই ঘোড়া রোগ!

আবার মনে পড়ে যায় দশ নম্বরের কথা। জগদীশবাবু তখন যদি জানতেন, এ-সব আমি কোনোদিন লিখবো হয়তো রেগে যেতেন, কিছু বলতেন না। কিংবা খুশি হয়ে পাঞ্জাবীর দোকানে ডবল-হাফ চা ও চারখানা একস্ট্রা সিঙাড়া খাওয়াতেন।

দশ নম্বর কোর্টের বেঞ্চিতে বসে আমরা দু’জনে কত মামলা দেখেছি। জগদীশবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছি, “মিস্টার রায়ের খবর কি?”

“আমাকে জিজ্ঞাসা করো না। তিন দিন কোর্টে আসছেন না।”

“কেন?”

“সেদিন এক মার্ডার কেসে পনেরো বছরের জেল হলো। রায় সায়েব কেমন যেন হয়ে গিয়েছেন। বাড়িতে কারুর সঙ্গে কথা বলেন না। ভোর চারটের সময় স্নানে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আমাকে না নিয়েই। তারপর দু’ঘণ্টা ধরে রাধাগোবিন্দের পুজো হচ্ছে। কিন্তু শরীরে এত অত্যাচার সইবে কেন? জ্বর হয়েছে।”

কয়েকদিন পরে আবার সব ঠিক। মিস্টার রায়কে কোর্টে কেস করতে দেখেছি পূর্ণোদ্যমে। আমাকে দেখে তিনি মৃদু হেসেছেন।

কিছুদিন পরে মিস্টার রায়কে মস্ত এক কেসে দিনের পর দিন দশ নম্বর কোর্টে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। কোন পক্ষ জিতবে বলা কঠিন। বিষ-প্রয়োগে ভ্রাতৃহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত আসামী কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত জমিদার। হত্যাকাণ্ড ঘন-রহস্যের মেঘে আবৃত। কিন্তু মিস্টার রায় কোনো কিছু রহস্যের অন্ধকারে থাকতে দেবেন না।

জগদীশবাবু বললেন, “এমন পরিশ্রম করলে লোকটা বাঁচবে না।”

“কি বলছেন জগদীশবাবু, বাঁচবেন না!” আমি বললাম।

“বাঁচবে কী করে? বাঁচবে কী করে শুনি? এই রকম নিত্য পূজা,—নিরামিষ আহার, তার ওপর মার্ডার কেস্,” জগদীশবাবু বিড়-বিড় করতে লাগলেন।

আসামী পক্ষের ব্যারিস্টার শক্তি মুখার্জি সওয়াল করছেন। “হে জুরি-বৃন্দ, আইন বলে, শত-সহস্র অপরাধী মুক্তি পাক কিন্তু একটি নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়। এক হীন ষড়যন্ত্রের ফলে আমার মক্কেল আপনাদের সম্মুখে অভিযুক্ত। গত চারদিন ধরে আপনাদের নিশ্চয়ই তা বোঝাতে পেরেছি—”

শক্তি মুখার্জির পর জজ-সাহেব জুরিদের কাছে মামলা বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করলেন। জাজেস চার্জ টু দি জুরি। দশ নম্বর ঘরের সমস্ত আলো জ্বলে উঠেছে। জজ-সায়েব বলে চলেছেন…”এক অতি কঠিন ও রহস্যজনক মামলায় আপনারা জুরিরূপে উপস্থিত। সরকারপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে সমর্থ হয়েছে কি না, ধীরমস্তিষ্কে বিচার করবেন।… সর্বশেষে মনে করিয়ে দিই, শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কোনো ব্যক্তির শাস্তিলাভ অবাঞ্ছনীয়।

ন’জন জুরি কোর্ট ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। জজ সায়েবও ভিতরে চলে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে কোর্টের গুঞ্জন বাড়লো।

জগদীশবাবুকে এই আমার শেষ দেখা। তিনি বললেন, “শেষ পর্যন্ত দেখে যাও, আর তো বেশি দেরি নেই।”

মিস্টার রায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। শক্তি মুখার্জি আসামীর সঙ্গে কি সব কথা বলছেন।

জগদীশবাবু বললেন, “চলো, চা খেয়ে আসি।”

হেস্টিংস স্ট্রীটে পাঞ্জাবীর দোকানে চা ও সিঙাড়া খেয়ে মিনিট কুড়ি পরে আমরা ফিরে এলাম। জুরিরা এখনও আসেননি। মিস্টার রায় শক্তি মুখার্জির সঙ্গে কথা বলছেন।

একঘণ্টা শেষ হয়ে গেল। জুরিরা ফিরলেন না। দু’ঘণ্টা… তিনঘণ্টা। জগদীশবাবু ও আমি বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম, শীত-শীত লাগছে। অন্য কোথাও লোকজন নেই। কে যেন যাদুমন্ত্রে এই কলহাস্যমুখর বিশাল রাজপুরীকে নির্জন পাষাণপুরীতে পরিবর্তিত করেছে।

রাত আটটা। জুরিরা এখনও এলেন না। সকলে জুরিদের জন্য নির্দিষ্ট প্রবেশপথের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজাটা এবার সামান্য দুলে উঠলো। বোধ হয় জুরিরা ফিরছেন। নাঃ, লাল তকমাপরা জজ-সায়েবের চাপরাসী শুধু উঁকি মেরে চলে গেল।

খাঁচার মধ্যে আসামী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“এতো দেরি হচ্ছে কেন? কি এতো আলোচনা হচ্ছে?”

“আরে মশাই, বর্ডার লাইন কেস্।”

প্রায় ন’টা। শীতটা আরও বেড়েছে। দশ নম্বর কোর্টের ঘড়ির পেণ্ডুলামটা বাঁদিক থেকে ডানদিকে ও ডানদিক থেকে বাঁদিকে যাতায়াত করছে।

মৃদু গুঞ্জন উঠলো, “আসছে, আসছে।”

এবার সত্যিই জুরিরা আসছেন। পিছনের দরজাটা আস্তে-আস্তে খুলে গেল। ওই তো জুরিরা ঢুকছেন। প্রথমে ফোরম্যান। এক, দুই, তিন, চার….

মিনিটখানেকের মধ্যে জজ-সায়েব এলেন। ঘরে অশরীরী নিস্তব্ধতা। যেন বুকের স্পন্দন শোনা যাচ্ছে।

ঘোষক রাত্রের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করছেন, “মিস্টার ফোরম্যান এণ্ড জেন্টলমেন ইন দি জুরি, হ্যাভ ইউ কাম টু ইউর ডিসিশন—আপনারা কী কোনো সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়েছেন?”

“হ্যাঁ, ধর্মাবতার…”

বুকের ভিতরে বাজনার বেগ বেড়ে যাচ্ছে।

“আর ইউ ইউন্যানিমস্?” আপনারা সকলে একমত?

অসংখ্য যন্ত্রের ঐকতানে সৃষ্ট আবহসঙ্গীত যেন কানে আসছে। মিস্টার রায় তাকিয়ে আছেন। শক্তি মুখার্জি আগ্রহের আতিশয্যে চেয়ার ছেড়ে প্রায় দাঁড়িয়ে উঠেছেন। খাঁচার আসামী যেন আরও কাছে আসতে চায়।

“আসামী দোষী না নির্দোষ?”

সঙ্গীতের শব্দঝঙ্কার যেন সহস্রগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

“দোষী…”

সকল গুঞ্জন মুহূর্তে স্তব্ধ।

জজ-সায়েব চক্ষু কুঞ্চিত করে এক মিনিট কি যেন ভাবলেন। কিন্তু তিনি প্রস্তুত হয়েই এসেছেন। বাঁদিকের পকেট থেকে একটা জিনিস বার হলো। কালো টুপি।

জগদীশবাবু আমার হাতে মৃদু চাপ দিলেন। “হয়ে গেল।”

“প্রিজনার এট দি বার…” জজ-সায়েব ধীরে ধীরে বলে চললেন। শেষ কথাটা আজও মনে পড়ে। “টু বি হ্যাড বাই নেক আনটিল ডেড্।”

চরম দণ্ড।

সার্জেন্ট দণ্ডিতের পাশে এসে দাঁড়ালো।

… … … …

প্রায় সবাই চলে গিয়েছে। জগদীশবাবু তখনও বসে রয়েছেন। উত্তেজনায় তাঁর সর্বদেহ কাঁপছে। “এবার, এবার কি হবে? রায় সাহেব?”

মিস্টার রায় যেন কেমন হয়ে গিয়েছেন। মাতালের মতো চোখ দিয়ে শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে আছেন। “বাড়ি চলুন স্যার। অনেক রাত হয়েছে”, জগদীশবাবু মিস্টার রায়ের হাতটা ধরে বলছেন। তাঁর খেয়াল নেই। জগদীশের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। জগদীশবাবু দু’হাতে তাঁর দেহটাকে ঝাঁকুনি দিলেন। কিছুই হলো না। ছলছল করছে জগদীশের চোখ। তারপর বাহ্যজ্ঞানহীন লোকের মতো মিস্টার রায়কে তিনি একরকম তুলেই নিয়ে গেলেন। যাবার সময় আমাকে দেখতে পর্যন্ত পেলেন না।

অবাক হয়ে ভাবছি, এ কী রহস্য! কেন মিস্টার রায় এমন হয়ে পড়েন? ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের হিংস্রতা নিয়ে তিনি শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন, কিন্তু শেষে অবসাদে টলে পড়েন। কেন এমন হয়?

কোনো সদুত্তর খুঁজে পাইনি। অনেক ভেবেছি। কিন্তু সব নিষ্ফল। রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত হয়নি।

আমার সকল জিজ্ঞাসায় ছেদ টেনে দিয়ে দশ নম্বর ঘরের বিশাল দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। রাত অনেক।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন